শিবশংকর ভট্টাচার্যর সমস্ত গল্প
নতুন পল্লির মাঠে স্টেজ বাঁধা হয়েছে। পাড়ার ছেলেমেয়েরাই নাচবে, গাইবে। শুনলাম বিখ্যাত শিল্পী স্বরাজ রায় বাকি আসছেন। তাঁর তখন গায়ক হিসেবে খুব নামডাক। খুব উৎসাহ নিয়ে শুনতে গেছি। টিভি-রেডিওর রমরমা না থাকায় যে-কোনো ফাংশনে দর্শক-শ্রোতার ভিড় হত। তখন তো ইলেকট্রিক আসেনি, ফলে জেনারেটর আনা হয়েছে। দু-একটা আলো আর মাইক চালানো যাবে। সন্ধে নাগাদ তার ফটফট আওয়াজে কান পাতা দায় হল। কালোমতো একটা লোক জেনারেটরওয়ালার কাছে গিয়ে বলছে শুনলাম—“হ্যাঁ রা আবাগীর ব্যাটা, লোকে শুনবে কী? গান, না তোর ওই ফটর ফটর?”
গ্রাম-গঞ্জে তখন মুখে মুখে এসব কথা চলত। লোকে কিছু রাগ করত না। ওতে নাকি কথার ওজন বাড়ে। জেনারেটরওয়ালা ক্ষেপে অস্থির। চোখ-মুখ পাকিয়ে বলল, “যা দিকিনি বুড়ো! গান কারে কয় জানিস? জমিতে লাঙল দি’গে যা।”
সে লোকটা কিন্তু রাগ করেনি। দাঁত বার করে বুদ্ধি দিচ্ছে—“একটু গভীর করে গর্ত খুঁড়ে যন্তরটা ওতে ঢোকা দি’নি।”
মিস্তিরি বলল, “শব্দ কমবে?”
“কমবে, কমবে। তার উপুরি তিরপল চাপালেই কমবে।”
ওই ওষুধেই কাজ হল। ফট ফট কমে হালকা গুরগুর। মাটির কাঁপন টের পাওয়া গেল মাঠে বসেছি বলে। খোঁড়াখুঁড়ি ওই লোকটাই করে দিল। কাজ সেরে কাদামাখা গায়ে বসল এসে আমাদের পাশে। কে যেন ওকে হাবা ঠাকুদ্দা বলে ডাকল শুনলাম। হাবা আবার কারও নাম হয় নাকি! আমরা বন্ধুরা মিলে খুব হাসাহাসি করতে লাগলাম। ছোটো ছেলেপুলে আমরা—কীসে হাসতে আছে, কীসে নেই অতশত জানি না—মজাদার কিছু হলেই হল।
অনেক লোক হয়েছে। নাচগান চলছে। একবার শুধু তক্তপোশের পায়ার ইট সরে যাওয়ায় বেসামাল হয়ে পড়ে গেল খোকনের বোন—আর কোনও গোলমাল নেই। হঠাৎ শুনি স্বরাজ রায় আসছেন না। ব্যস, মজাটা অর্ধেক মাটি! বেশ কিছু দর্শক বাড়ি চলে গেল। ভানু তখন সবে বেহালা শিখছে। এমনিতে গান-টান গাইতে দেখেছি। কী দরকার ওর বেহালা নিয়ে স্টেজে ওঠার? মিনিট পাঁচেক ক্যাঁ-কোঁ চলবার পর গুনগুন বাড়তে লাগল। বাড়তে বাড়তে রীতিমতো শোরগোল। গান না গেয়ে বেহালাটা আনা বোধহয় দেখনদারির জন্য। ভানু পাততাড়ি গুটিয়ে উঠে পড়তেই স্টেজ ফাঁকা, আর কেউ নেই। সন্তোষকাকু হঠাৎ স্টেজে উঠে বললেন, “আমাদের অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পী শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য।”
পালাবার চেষ্টা করেও ধরা পড়ে গেলাম। ওই প্রথম আমার স্টেজে গান গাইতে বসা। যা কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি তাই হল। মাইকের লোকটা বলে দিল ভালো হয়ে বসে মাউথ-পিসের কাছে মুখ রেখে গাইতে। না, ডানপিটে গোছের ছিলাম বলে হাঁটু কাঁপেনি।
আমি বাথরুম সিঙ্গার। পাড়ার লোকে আমার গান শুনে বুঝত আমি কোথায়। চালাকি করে চোখ বুজে স্টেজকে বাথরুম ভেবে গান ধরলাম। তখন তেরো বছর বয়সে আমার গলা ছিল লতা, সন্ধ্যা বা আরতি মুখোপাধ্যায়ের মতো। ছ’টা গান একদমে গেয়ে উঠে পড়লাম। আশ্চর্য, কেউ গোলমাল করেনি বা ঢিল ছুড়েনি।
এত কথা আমার গুণপনা জাহির করবার জন্য বলছি না, না বললে তারপর কী ঘটল সেটা বলা হবে না। অবশ্য সন্তোষকাকু কী করে আমার গানের কথা জানলেন, এটা একটা রহস্য। ওঁর বাড়ি আমাদের বাথরুম থেকে অনেক দূরে।
বাড়ি ফিরছি। ওই কালো-কুলো বিচ্ছিরি দেখতে লোকটা দেখি পাশে পাশে হাঁটছে। ছোটো বলে মনে ছেলেধরার ভয় ছিল। ছুট লাগাব কি না ভাবছি, লোকটা আমার পিঠে হাত রাখল। হাসি হাসি মুখ।—“বড়ো ভালো গাইলি তো! কে শেখাল?”
“কে আবার শেখাবে?”
“শুনে শুনে?”
“হ্যাঁ।”
কোথায় থাকি-টাকি শুনে বলল, “কাল বিকেলে আসব।”
আমি খেলার মাঠে যাই শুনে বলল, “তবে রবিবার সকালে।”
ওই হাবা ঠাকুদ্দার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।
রবিবার সকালে এসে মা-বাবার সঙ্গে কী কথা হল জানি না। হারমোনিয়াম আছে শুনে খুশি। অবাক কাণ্ড! হারমোনিয়াম বার করে যখন বাজাতে আরম্ভ করল, আমরা অবাক। চেনা হারমোনিয়ামটাকে মনে হল অচেনা। চেহারা দেখে বোঝাই যায় না ওর ভেতরে এরকম একজন শিল্পী লুকিয়ে আছে! শুধু তাই নয়, পকেট থেকে যন্ত্রপাতি বার করে হারমোনিয়ামটা খুলে নতুন করে লাগিয়ে দিল। শব্দ-সুরও ভালো হয়ে গেল। কোনো-কোনো রিডের শব্দ নাকি ঠিক ছিল না। শুনলাম ওর বাড়ি রেল-লাইনের ও-পারে। এরপর থেকে ওর আনাগোনা চলতেই লাগল। আমার নাকি গান না শিখলে চলবেই না। যাবার আগে বলে গেল, “রেল-লাইনের ও-পারেই আমার ঘর। সময় করে যাস একবার। বড়ো খুশি হব।”
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সোনারপুর তো এখনকার মতো ছিল না। বিদ্যুৎ নেই, পাকা রাস্তা নেই। স্টেশন থেকে মাইল খানেক দূরে শীতলা গ্রাম। বাজার স্টেশনের পাশেই। এখানেই একটা দুটো মুদি দোকান। তারপর বাড়ি পর্যন্ত আর কোনও দোকান নেই। পথের দু-পাশে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছাড়া ছাড়া কিছু ঘরবাড়ি, তার পেছনেই দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত। রাতের অন্ধকারে আলোর মালার মতো রেলগাড়ি যেতে দেখতাম; ক্যানিং যাবার গাড়ি। সোনারপুর স্টেশন ছেড়ে কালিকাপুর যাবার পথে প্রায় পুরোটাই দেখতে পেতাম। মাঝখানে বিদ্যাধরপুর তখনও ছিল না। বাড়ি থেকে হাঁটাপথে অনেকদূর বলতে এই রেল-লাইনের ও-পারটা। মাঝে একটা জঙ্গল-ঘেরা বিল, বড়ো ভয়ের জায়গা ছিল। তার পাশে বিদ্যাধরী নদীর খাল। ভয়ের কারণ ছিল। মাঝে-মাঝেই সেখানে খুন হয়ে যাওয়া মানুষের শরীর পড়ে থাকত। বোধহয় ডাকাতেরা টাকার লোভে মানুষ মারত। রাতে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও চট করে ঘেঁষত না কেউ ওদিকে।
ওদিক দিয়েই হাবা ঠাকুদ্দার গ্রামে যাবার পথ। বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম একদিন শ্রাবণ মাসের শেষদিকে। হাঁটু অবধি প্যাচপ্যাচে কাদা ভেঙে যখন ওর বাড়িতে পৌঁছলাম খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। মাঝে একপশলা বৃষ্টিতে জামাকাপড় ভিজে চুপচুপ করছে। বাবলুটা রামদুষ্টু। পৌঁছবার পর বলল, শুকনো ইট পাতা পথে নতুন পল্লি হয়ে আসা যেত, নাকি আমাকে নাকাল করতেই এই জংলি পথে আসা। হাবা ঠাকুদ্দা ব্যস্ত হয়ে গামছা দিয়ে গা-মাথা মুছিয়ে জামা ছাড়িয়ে মাদুর পেতে বসাল। এমন দিনে এসেছি বলে বকুনি দিল খুব। তারপর এক বাটি করে গরম দুধ নিয়ে এসে বসল আমাদের কাছে। প্রায় ফোকলা মুখে একগাল হাসি।—“তোরা এইছিস বলে কী যে আনন্দ হল বলবার নয়। অনেকদিন যেতি পারিনি বাবা তোদের ওদিকি। বড়ো ভালো করিছিস এসে। ক’টা চুনোমাছ ধরিছিলুম। ঝাল রাঁধি, দুটো ভাত খেইয়ে যাবি বাবারা।”
ভাত খাওয়ার সময় নেই শুনে মুড়ি-নারকোল মাখতে বসে গেল। আমি তখন অবাক চোখে ওর ঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। কতরকম বাজনা যে ঠাসা রয়েছে ঘরে! কোনোটা পুরো, কোনোটা আধখানা তৈরি। মাটির ঘর বর্ষার জলে ভেঙে পড়ছে; মাথার ওপর টালির চালের অবস্থাও ভালো নয়। এখান ওখান দিয়ে জল পড়ছে। আসবাবপত্র বলতে ক’টা অ্যালুমিনিয়ামের বাসন আর চাষ করার যন্ত্রপাতি। বাজনা তৈরির পুরোনো কিছু করাত, র্যাঁদা, বাটালিও চোখে পড়ল। চালের বাতায় গোঁজা শ-খানেক ছোটো-বড়ো বাঁশি। বড়ো লাউয়ের একতারা ঝুলছে মাথার ওপর থেকে। ঘরে আর কাউকে দেখলাম। ঠাকুদ্দা বোধহয় একাই থাকে বাড়িতে। দরজার ওপর একটা পুরোনো ফটো ঝুলছে। দেখে কেমন চেনা চেনা ঠেকল।
মুড়ি খেতে খেতে ওর বাঁশি বাজানো শুনছিলাম। কী অপূর্ব সুর! ঠাকুদ্দার গলাটা ভাঙা বলে গানটা শুধু গাইতে পারে না, কিন্তু গান বুঝতে বা গায়ক-গায়িকা চিনতে পারার ক্ষমতাটা দুর্দান্ত। কোনও ফাংশন বাদ যেত না তার। সে ছোটো-বড়ো ঘরোয়া যা-ই হোক।
তারপর আরও অনেকবার ওর বাড়ি গেছি। শীতের দিনে খেজুরের রস, নিজের হাতে জ্বাল দেয়া খেজুর গুড় খাইয়েছে মুড়ি দিয়ে মেখে। নিজে কী খায় তাও দেখেছি। লংকা-পেঁয়াজ-আলুসেদ্ধ দিয়ে পান্তাভাত—দিনে একবারই। আমরা অবাক হলাম ওর চালচলন দেখে। খাটতে পারে বটে লোকটা। মুখেও বলতে শুনেছি—“কাজ না করে থাকতি পারিনে রে বাপ। গায়ে ব্যথা হয়। শুয়ে বসি থাকতি গেলে কেমন অসুবিধে হয়, মাথা খারাপ হবে বলে মনে হয়। গান কর দিকি কথা না বলে। ওইটা গা।” বলে মাথা-টাথা চুলকে ভাঙা গলায় নিজেই গেয়ে উঠত—পালাবার গান, গায়ের বধূর গান বা আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে।
আমি এখন বড়ো হয়েছি। গলার মেয়েলি ভাবটা কেটে গম্ভীর হয়েছে। আমি গান গাইলে বুঁদ হয়ে শুনত। প্রশংসা বিশেষ করত না। ধরা গলায় বলত, “গান কর, গান কর। জমিতে পাকা ধান দেখলি চাষির যেমন মন খুশি হয়, গান শুনলিও তাই। সুর না থাকলি বেঁচে থাকাও হয়ে উঠত না রে। সব সুর তালে বাঁধা, কেটে গেলেই শেষ। কানে তুলো দিয়ে বসে থাক দিকি! বাতাসের শব্দ, গাছের পাতা, জলের শব্দ, পাখির ডাক—কিচ্ছু না শুনলে মাথা যাবে খারাপ হয়ে। সলিল আর মন্টু আসত এখানে। মাঝে মাঝে হেমন্তও আসত। ওরাও তোদের মতোই ছোটো তখন। চাংরিপোতা থেকে হেঁটে আসত বাঁশি শোনাতে। আমিই গড়ে দিতাম বাঁশি। কতদিন আর আসে না!”
আমার মুখে কথা নেই। চোখ গোল গোল করে শুনছি ওর কথা। সলিল চৌধুরী, মন্টু ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন আমাদের দেবতার মতো। সারা ভারতকে নেশা ধরিয়েছে তাঁদের গানের সুর। তাঁরা এখানে আসতেন! এবার ছবির লোকগুলোকে চিনতে পারলাম। সলিল চৌধুরী আর হেমন্ত বসে আছেন হাবা ঠাকুদ্দার মাটির দাওয়ায়, পেছনে হাবা ঠাকুদ্দাও বসে। হাফ প্যান্ট আর ফতুয়া গায়ে পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে তখন। আমার কেমন স্বপ্নের মধ্যে আছি বলে মনে হল।
আরও অনেক বছর কেটে গেছে। কাজের জন্য শহরে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে গ্রামে আসি, হাবা ঠাকুদ্দার খোঁজখবর নিই, যাওয়া হয়ে ওঠে না। হঠাৎ একদিন আবার গিয়ে হাজির হলাম ওর আস্তানায়। একটা কাপড় আর এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে গেছি। ঠাকুদ্দা একদম বুড়ো হয়ে গেছে। ওগুলো রেখে ওর সামনে দাঁড়াতে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, চিনতে পারল কি না বোঝা গেল না। বসে ছিল, বসেই রইল। চোখে ভাষা নেই কোনও। মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল আমার।
একজন মহিলা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে যেতে ফিসফিস করে বললেন, “কার কাছে এলি বাবা? ওর মাথাটা গেছে একেবারে। কাউরে চিনতি পারে না, কথা কয় না। খাইয়ে না দিলি খায় না। ওর কানটা নষ্ট হয়ে যাবার পর থেকেই এমন। এই তো অবস্থা, চিকিৎসা করানোর টাকাও ছিল না।”
মাস দুই বাদে খবর পেলাম মারা গেছে হাবা ঠাকুদ্দা। সুর-তাল কেটে গেলে যা হবার, তাই হয়েছে ওর।
অলঙ্করণ- শিবশঙ্কর ভটাচার্য