আর কয়েক মুহূর্ত পরেই আমার মৃত্যু হবে। অথচ তা জেনেও আমার খুব একটা দুঃখ হচ্ছে না। শারীরিক কষ্ট একটু আগে বেশ চরমভাবেই হচ্ছিল। হাজার হোক, নাক দিয়ে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে ফুসফুস ফেটে যাওয়াটা খুব একটা সুখকর অনুভূতি তো আর নয়! তবে এখন মনে হয় শরীর থেকে কষ্টের বার্তা আর মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছচ্ছে না। কিন্তু তা বলে মরে যাওয়ার জন্য মনখারাপ হবে না? আমার মৃত্যু তো শুধু আমার নয়, আমার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু আমার স্বপ্নের, আমার ভালোবাসার, আমার ইচ্ছের, আর… আমার সত্যের। আমার আবিষ্কৃত সত্য—অপ্রিয়, কিন্তু সত্য।
সত্য তো সত্যই, তার কি প্রিয়-অপ্রিয় হওয়ার দায় আছে? সত্যটা প্রিয়, না অপ্রিয় সেটা তো মানুষবিশেষে। সমস্যা হল আমার আবিষ্কৃত সত্যটা যে মানুষটার কাছে অপ্রিয়, তিনি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে কয়েক হাজার গুণ বড়ো! তিনি, যাঁর নাম আমাদের মানে ওঁর শিষ্যদের মুখে আনা নিষিদ্ধ—বিশ্বের সবচাইতে প্রসিদ্ধ দার্শনিক পণ্ডিত। দেশ-বিদেশ জোড়া তাঁর নামডাক। তিনি নিজেই গণিত আর দর্শনশাস্ত্রের এক প্রতিষ্ঠান। আর আমি সেই প্রতিষ্ঠানের এক নগণ্য ছাত্র, তিনি আমাদের সবার গুরুদেব। তাই তাঁর বিশ্বাসের কাছে আমার সত্যের পরাজয়।
জন্মান্তর! মৃত্যুর পর আবার ফিরে আসা! এই বিশ্বাসের জোরেই কি আমার আগতপ্রায় মৃত্যুর কথা ভেবেও কোনও দুঃখ হচ্ছে না? আমাদের গুরুকুলের আমরা সবাই জন্মান্তরে বিশ্বাস করি। গুরুদেব আমাদের শিখিয়েছেন—মৃত্যুতে কেবলমাত্র নশ্বর দেহেরই সমাপ্তি হয়, মানুষের আত্মা অমর। আত্মার জরা নেই, মৃত্যু নেই, শেষ নেই। গুরুদেব বলেন, মানুষের আত্মা নাকি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আত্মার অংশবিশেষ। গ্রহ-নক্ষত্র-নীহারিকা-ছায়াপথ সবার সম্মিলিত যে সংগীত ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে উৎসারিত হয়, সেই সংগীতের তালেই আমাদের আত্মা আমাদের জীবনকে চালিত করে। একমনে ধ্যান করলে নাকি সেই সংগীত নিজের শরীরের ভেতর উপলব্ধি করা যায়। গুরুদেব নিজে এই অতিজাগতিক সংযোগ উপলব্ধি করেছেন, গভীর এবং জটিল তপস্যার মাধ্যমে। সেদিনটার কথা স্পষ্ট মনে পড়ে গেল যেদিন গুরুদেব তাঁর অভিজ্ঞতার কথা আমাদের বলছিলেন।
সেদিন আমার এই গুরুকুলের প্রথম দিন। আমার গ্রাম মেটাপনটিয়োন থেকে জলপথে ক্রোটন শহরে আসতে সময় লেগেছিল পাক্কা একদিন আর এক রাত। ক্রোটন বন্দর থেকে পায়ে হেঁটেই চলে এসেছিলাম গুরুকুলে। কী করব? পয়সাকড়ি তো আর সঙ্গে তেমন নেই। আমার সম্বল তো শুধু এই গুরুকুলে থেকে গুরুদেবের কাছে গণিত শেখার অদম্য ইচ্ছেটুকু। বন্দর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিস্তৃত সুবিশাল গুরুকুল যেন শান্তির মূর্ত রূপ। প্রকৃতই অধ্যয়নের স্থান। শুধু অধ্যয়ন আর পাঠাভ্যাসই নয়, বিদ্যাচর্চা, বিতর্ক, সংগীত, কুস্তি, শরীরচর্চা—সব মিলিয়ে যেন কৈশোরের প্রাণোচ্ছ্বলতায় পরিপূর্ণ এক স্বপ্নের জগৎ। সেদিন গুরুকুলে আমারই মতো নবাগতদের ভিড়। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে। নবাগতদের পথপ্রদর্শক হিসেবে রয়েছেন প্রবীণ সহপাঠীরা। তাঁদের নির্দেশমতো আমরা তৈরি হয়ে গিয়েছি—স্নান সেরে, লম্বা সাদা কাপড় পরে ছুটতে ছুটতে পৌঁছেছি বিরাটকায় প্রধান সভাগৃহে।
বাইরে দিনের আলো তখন ফুরিয়ে এসেছে। সভাগৃহে আলোর জোগান দিচ্ছে দেওয়ালে দেওয়ালে লাগানো মশাল। আলো-আঁধারির মায়ায় ডুবে থাকা সভাগৃহের মধ্যস্থল কিন্তু আলোকোজ্জ্বল। যদিও এর কারণ নিশ্চয়ই সভাগৃহের বিশেষ আকৃতি এবং চার দেওয়ালের বিশেষ বিশেষ জায়গায় মশালগুলির অবস্থান। কিন্তু আমার মনে হল যেন এই ঔজ্জ্বল্যের উৎস সভাগৃহের মধ্যস্থলে চওড়া বেদির ওপর উপবিষ্ট দীর্ঘকায় মানুষটি। ধবধবে সাদা রেশমের দীঘল অঙ্গবস্ত্র আর মাথায় সাদা কাপড়ের পাগড়িতে মানুষটিকে দেবতুল্য মনে হচ্ছে। টিকোলো সরু নাসিকার নীচ থেকে নেমে আসা, মুখমণ্ডল পরিবেষ্টন করে থাকা, শুভ্র রেশমের মতো শ্মশ্রুরাজি সাক্ষ্য বহন করছে মানুষটির দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ সাধনার। অর্ধনিমীলিত উজ্জ্বল সুনীল চোখ দুটো থেকে বেরিয়ে আসছে জ্ঞানের ছটা। শ্মশ্রুরাজির পেছনে লুকিয়ে থাকা ঠোঁটের কোণের হাসি যেন আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে এই বিপুল জ্ঞানের বিতরণই এই মানুষটির জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। ভাবতেই বুকটা গর্বে ভরে উঠল যে, দেবতুল্য এই মানুষটি আমাদের গুরুদেব!
তাঁর নাম আমাদের মুখে আনা নিষিদ্ধ। কিন্তু এখন যখন মরেই যাচ্ছি, তখন আর বাধা কোথায়? আমাদের গুরুদেব, পিথাগোরাস ও’সামিওস!
সেদিন গুরুদেবের দেওয়া ভাষণ আমার পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে আছে। গুরুদেব বলতে শুরু করলেন, “নবাগতদের সবাইকে স্বাগত জানাই। কিন্তু তোমাদের অভ্যর্থনা জানাবার অধিকার আমার আছে কি না আমি জানি না। কারণ, আমি মনে করি, তোমরা সবাই নিজেদের যোগ্যতার বলেই এই গুরুকুলে পঠনের সুযোগ পেয়েছ। তোমাদের অধ্যবসায় এবং সাধনাকে আমি সাধুবাদ জানাই। তোমাদের কঠোর সাধনার ফলে তোমরা এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এই সুযোগ পেয়েছ, তাই তোমরা স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত। উচ্ছ্বাস এবং তার বহিঃপ্রকাশ মানুষের জীবনধারার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার একান্ত নিবেদন—তোমরা অনুগ্রহ করে এই কথাটি মনে রেখো যে, তোমাদের এই উচ্ছ্বাস যত ক্ষণস্থায়ী হয় ততই তোমাদের মঙ্গল। কারণ, আমি মনে করি তোমাদের জীবনে সাধনার এই সবে শুরু। জীবনে এখনও আরও অনেক কঠিন পরীক্ষা দেওয়া বাকি। কাজেই উচ্ছ্বাসের সময় এখন নয়।
“তোমাদের মনে হয়তো এখন প্রশ্ন আসছে যে, তোমাদের জীবনে কখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে যখন তোমরা জানবে যে তোমাদের সাধনা শেষ হয়েছে? তোমরা কি জানো কখন সেই সময় আসবে? কে বলতে পারে তোমাদের মধ্যে?”
এই প্ৰশ্ন শুনে আমার বুক হঠাৎ দুরু দুরু কাঁপতে লাগল। ভীষণ ইচ্ছে হল গুরুদেবের বিখ্যাত সেই উক্তিটা বলি—‘জেনো সেদিন হবে জ্ঞানসাগরে সন্তরণের ইতি/ যবে জগৎ জুড়ে থাকবে নাকো কোনও অসঙ্গতি।’ কিন্তু আমার গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। বুকের উথালপাতালের ধাক্কা আমায় যেন বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।
হঠাৎ দেখি ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমারই বয়সি একটা ছেলে বলে উঠল, “গুরুকুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, তখন।”
এই শুনে গুরুদেব মৃদু হেসে উঠলেন। মুখে হাসির রেশ রেখেই বলে উঠলেন, “ভালো উত্তর, কিন্তু আমার ছোট্ট বন্ধু, আমি দুঃখিত যে তোমার উত্তর সঠিক হয়নি। তোমরা হয়তো শোনোনি, কিন্তু এখন প্রায়ই শুনতে পাবে, যা আমি আমার সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে বলে থাকি, ‘জেনো সেদিন হবে জ্ঞানসাগরে সন্তরণের ইতি/ যবে জগৎ জুড়ে থাকবে নাকো কোনও অসঙ্গতি।’”
গর্বে আমার বুকটা আবার ভরে উঠল। আর পাশের ছেলেটি হতোদ্যম হয়ে বসে পড়ল।
গুরুদেব বলে চললেন, “কীরকম অসঙ্গতির কথা আমি বলছি তোমরা কি জানো?”
আমি এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। গুরুদেবের প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলাম, “ব্রহ্মাণ্ড যা দ্বারা চালিত হয় তাকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। এটা একটা অসঙ্গতি।”
গুরুদেবের চোখ ঝলসে উঠল, মুখমণ্ডল আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “একদম ঠিক! কী নাম তোমার?”
“গুরুদেব, আমার নাম হিপ্পাসোস ও’মেটাপনটিয়োন।”
“ধন্যবাদ হিপ্পাসোস, তুমি ঠিক বলেছ। এটা একটা অসঙ্গতিই বটে। কিন্তু আমার ধারণা, এই সমস্যার সমাধান আমরা খুব শীঘ্রই দেখতে পাব। আমি নিজেই এই সমস্যার সমাধানের অনেক কাছে চলে এসেছি। আমি জানি ব্রহ্মাণ্ড সংখ্যার দ্বারা চালিত হয়। আমি বরং তোমাদের একটু ব্যাখ্যা করেই বলি।
“সংখ্যা, মানে ১, ২, ৩ ইত্যাদি। হাতের আঙুলের সংখ্যা ৫ যোগ ৫, অর্থাৎ সাকুল্যে ১০। আজকে তোমরা যারা এখানে উপস্থিত হয়েছ তাকে চিহ্নিত করে একটা সংখ্যা, আবার রোজ ক্রোটন বন্দরে যত জাহাজ নোঙর করে তাও একটি সংখ্যা, ক্রোটন শহরে আজ যত শকট এসে পৌঁছেছে তাও একটি সংখ্যা। প্রত্যেকটি জাহাজে এবং প্রত্যেকটি শকটে তোমরা যারা ছিলে সেই তোমাদের সব সংখ্যা যোগ করলে যে সংখ্যা পাব তা হল এখানে উপস্থিত তোমাদের সংখ্যা। এর কোনও ব্যত্যয় নেই। এমনকি রোজ সকালে রুটি কেনা থেকে শুরু করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গতিপ্রকৃতি—সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এই সংখ্যার দ্বারা।”
হঠাৎ আমাদের সামনে থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল, “কিন্তু গুরুদেব, একটি রুটি যদি ১ হয়, তাহলে যখন সেই রুটি ছুরি দিয়ে কাটা হয় তখন তাহলে এক-একটি টুকরোকে কোন সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করব?”
“চমৎকার প্রশ্ন! কী নাম তোমার খুকি?”
“আমার নাম আলেফিয়া ও’ক্রোটন, গুরুদেব।”
“ধন্যবাদ আলেফিয়া। তুমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছ। সত্যিই তো, টুকরোগুলির সংখ্যা ২, কিন্তু তারা তো এসেছে ১ থেকে। আমরা জানি ১ থেকে ২ বড়ো, তাহলে কি এখানে পূর্ণ ছোটো হয়ে যাচ্ছে অংশ থেকে? তা তো অসম্ভব! তাহলে? এ তো এক অসঙ্গতি!
“এর উত্তর হল এই যে, আমরা কেবলমাত্র পূর্ণ সংখ্যা দিয়েই সবকিছুর ব্যাখ্যা করতে পারব এমনটা নয়, আমাদের সাহায্য নিতে হবে ভগ্নাংশেরও! সত্যই, ১ রুটির যদি ২ অংশ হয়, তাহলে প্রতিটি অংশ চিহ্নিত হয় ১/২ দ্বারা, যাকে আমরা বলি, এক দ্বিতীয়াংশ।”
দর্শকদের মধ্যে যেন সম্মিলিত বিস্ময়ের ঢেউ বয়ে গেল।
আমাদের সবাইকে আরও অবাক করে দিয়ে গুরুদেব এবার হাতে তুলে নিলেন একটি লাইর । তিনি বললেন, “ব্রহ্মাণ্ড শুধু সংখ্যার দ্বারা চালিত হয়—এই কথা শুনে তোমরা সবাই নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হচ্ছ। কিন্তু যদি শুধু সংখ্যার কথা বলি, তাহলে আমার একটু ভুল হবে। ব্রহ্মাণ্ড চালিত হয় সংখ্যা এবং তাদের সম্পর্কের মেলবন্ধনের খেলায়। ঠিক যেমন সংগীত।” বলে গুরুদেব লাইর-এর একটি তার টানলেন। লাইরের মিষ্টি সুরে সভাগৃহ অনুরণিত হতে লাগল। “এই যদি হয় পূর্ণ সুর ১,” বলতে বলতে গুরুদেব লাইর-এর তারটির ঠিক মাঝখানে এক হাতের আঙুল দিয়ে চেপে বাকি অংশের তার অন্য হাতে আবার একটু টেনে দিলেন। আবার সুর তৈরি হল, কিন্তু এবার একটু চড়া। গুরুদেব বললেন, “এই তবে অর্ধ সুর ১/২।”
তারপর একনাগাড়ে এক হাতে লাইর-এর তারের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করতে করতে অন্য হাতে তার টেনে বাজাতে লাগলেন। সুরের মূর্চ্ছনায় সভাগৃহ উদ্বেল হয়ে উঠল। গুরুদেব বলে যেতে লাগলেন— “১/৩ সুর, ১/৪ সুর, ৩/৪ সুর, ৫/৬ সুর, ২/৩ সুর—আরও সহস্র, লক্ষ, কোটি সুরের মূর্চ্ছনা—সব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সংখ্যার দ্বারা।”
গোটা সভাগৃহ যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর লাইর আবার নীচে নামিয়ে রেখে গুরুদেব বলতে শুরু করলেন, “এই সুর শুধু আমাদের বাদ্যযন্ত্রের নয়। এই সুর নিরন্তর ধ্বনিত হচ্ছে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে। তার কারণ কি তোমরা জানো? কারণ, সংখ্যা। যে সংখ্যাগুলির সাহায্যে তোমরা লাইর-এর সুমধুর সংগীতের ব্যাখ্যা পেলে, সেই সংখ্যার দ্বারাই মহাজাগতিক সুরে তালে তালে মেতে চলেছে গ্রহ-নক্ষত্র-নীহারিকা-ছায়াপথ। সেই তালেই নশ্বর মানবদেহে নেচে চলেছে অবিনশ্বর আত্মা। গভীর মনঃসংযোগের সঙ্গে ধ্যানের মাধ্যমে তাই মানবদেহে এই মহাজাগতিক সুরের লহরী উপলব্ধি করা সম্ভব। আমি নিজে সেই উপলব্ধি করেছি। একবার নয়, বহুবার! বারংবার! সেই সময়কার অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব। তুরীয়াবস্থার সে এক চরমতম প্রকাশ! শুধু তাই নয়, প্রত্যেকবার এই উপলব্ধির স্বরূপ ভিন্ন এবং আগেরবারের তুলনায় গভীরতর। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যার এই উপলব্ধি হয়নি তাকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।
“কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরাও আমার মতো সেই উপলব্ধির স্বরূপ দর্শন করতে পারবে। তোমাদের সাধনার দ্বারা, তোমাদের অধ্যবসায়ের দ্বারা এবং সর্বোপরি এই গুরুকুলের সমস্ত নিয়মকানুন অক্ষরে অক্ষরে পালনের দ্বারা। তোমরাও আমার মতো এবং আমার আর সকল ছাত্রছাত্রীর মতো উপলব্ধি করবে সংখ্যার মাহাত্ম্য। যে সংখ্যা
পৃথিবীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনা থেকে শুরু করে মহাজগতের লীলা পরিচালনা করে চলেছে, সেই পূর্ণ সংখ্যা এবং তাদের ভগ্নাংশের মাহাত্ম্য। যে সংখ্যাকে আমরা নাম দিয়েছি মূলদ সংখ্যা ।”
*
সেদিন গুরুদেবের ভাষণ শোনার পর সারা শরীরে অদ্ভুত এক চাঞ্চল্য অনুভব করেছিলাম, যা এর আগে জীবনে কখনো করিনি। গুরুদেবের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলাম পৃথিবীর সমস্ত অসঙ্গতির উদ্ধারকল্পে। গুরুকুলের কঠোর নিয়মানুবর্তিতার শেকলকেও মেনে নিয়েছিলাম স্বচ্ছন্দে। আমার তখন একমাত্র লক্ষ্য গুরুকুলে জ্ঞান আহরণের যত সুযোগ আছে, তার সমস্তটার সদ্ব্যবহার করা এবং তারপর গুরুদেবের আদর্শে জ্ঞান বিতরণ আর পৃথিবীর রহস্যোদ্ঘাটনে জীবন নিবেদন করা। তবে আমার এই সাধনায় যে কখনও ব্যাঘাত ঘটছিল না, এমনটা নয়। বন্ধুরা অনেকেই মনে করত আমি বাড়াবাড়ি করছি। তাদের মতে, উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে আমি নাকি আমার নিজের প্রতি ঘোরতর অন্যায় করছি।
গুরুকুলে সহপাঠীদের অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল থিওডোরোস। সেই যে ছেলেটি সভাগৃহে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। থিওডোরোস কিন্তু আমার মতো নয়, সে সবসময় মেতে রয়েছে আনন্দ-ফুর্তি নিয়ে। তার বক্তব্য, বাড়িতে বাবা-মায়ের শাসনের হাত থেকে সে এখন মুক্তি পেয়েছে, সেই মুক্তি সে যতটা সম্ভব উপভোগ করতে চায়। তার জীবনে কোনও উচ্চাশা নেই। সে তাই আমার কঠোর পরিশ্রম দেখে কখনও ক্ষোভ প্রকাশ করে, কখনো-বা বিদ্রুপ করে, কখনও আবার হতাশায় ডুবে যায়। আমার বন্ধুদের আমায় নিয়ে যে ধারণা হয়েছে যে, আনন্দ-উৎসবে অংশগ্রহণ না করে আমি নিজের প্রতি অন্যায় করছি, সেই ধারণার উৎস খুব সম্ভবত থিওডোরোসই।
থিওডোরোস আর আমি গুরুকুলে একই কক্ষে বাস করি, যদিও দিনের বেশিরভাগ সময় সে কক্ষের বাইরেই কাটায়। আজ থেকে প্রায় দুই পক্ষকাল আগে, যেদিনের ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল, সেদিনও আমি আমাদের কক্ষে একাই ছিলাম। জ্যামিতির সঙ্গে মূলদ সংখ্যার সঙ্গতি খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েই হয়ে গেল গোলমালটা।
কক্ষে শুয়ে শুয়ে সেদিন শেখা গুরুদেবের বিখ্যাত উপপাদ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলাম। উপপাদ্যটা জ্যামিতি সংক্রান্ত। হঠাৎ গুরুদেবের ভাষণ মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি হল মূলদ সংখ্যা। মানে পূর্ণ সংখ্যা এবং সেইসব সংখ্যা যাদের পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশ হিসেবে লেখা যায়। এই প্রসঙ্গে আচমকাই মাথায় এক অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেল।
গুরুদেবের উপপাদ্যে বলা রয়েছে যে, একটি সমকোণী ত্রিভুজের ভূমির দৈর্ঘ্যের বর্গ এবং উচ্চতার দৈর্ঘ্যের বর্গের যোগফল অতিভুজের দৈর্ঘ্যের বর্গের সমান হয়। তাহলে যদি এমন একটা সমকোণী ত্রিভুজ নিই যার ভূমির দৈর্ঘ্য ১, উচ্চতার দৈর্ঘ্যও ১, তাহলে তার অতিভুজের দৈর্ঘ্য হবে এমন একটি সংখ্যা যার বর্গ হলো ১^২ + ১^২ = ২।
অর্থাৎ অতিভুজের দৈর্ঘ্য ২-এর বর্গমূলের সমান। সেই সংখ্যাটি, অর্থাৎ ২-এর বর্গমূল, ১-এর থেকে বড়ো, কারণ ১-এর বর্গ ১ যা ২-এর থেকে ছোটো। আবার সংখ্যাটি ২-এর থেকে ছোটো, কারণ ২-এর বর্গ ৪, যা ২-এর থেকে বড়ো। কাজেই ২-এর বর্গমূলকে একটা ভগ্নাংশই হতে হয়, গুরুদেবের ভাষণ মেনে নিলে। কী সেই ভগ্নাংশ, যা ১-এর থেকে বড়ো, কিন্তু ২-এর থেকে ছোটো, আর যার বর্গ হল ২?
সেদিন থেকে শুরু করে টানা এক সপ্তাহ আমি দিনরাত এই প্রশ্নটা নিয়ে ভেবে গেছি। কিন্তু কোনও সমাধান পাইনি। নিরন্তর ভেবে গেছি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ভেবে গেছি। পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়েছি, শিক্ষকদের কাছে ভর্ৎসনা শুনেছি, দাদাদের হাতে হেনস্থা হয়েছি, থিওডোরোস ও অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে টিটকিরি খেয়েছি, কিন্তু প্রশ্নটার ওপর চিন্তাভাবনা করা ছাড়িনি। তবুও সমাধান পাইনি। কখনও মনে হয়েছে এই বুঝি নাগালের মধ্যে সমাধান, কিন্তু পরমুহূর্তেই উপলব্ধি করেছি যে ভুল হয়েছে। কখনও স্বপ্নে মনে হয়েছে সমাধান পেয়ে গেছি। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আর মনে করতে পারিনি।
তারপর একদিন হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি যা সমাধান করতে চাইছি, তা সম্ভবই নয়!
সত্যিই তো, এই সম্ভাবনার কথা তো এতদিন ভেবেই দেখিনি! এমন যদি হয় যে, গুরুদেব যা বলছেন সেটাই ভুল? যদি ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর ব্যাখ্যা মূলদ সংখ্যা দিয়ে না হয়, তাহলে? যদি ব্রহ্মাণ্ডে অমূলদ সংখ্যা থেকে থাকে, তাহলে? যদি ২-এর বর্গমূল তেমনি এক অমূলদ সংখ্যা হয়?
যেমনি এই চিন্তা মাথায় এল, অমনি যেন এক লক্ষ চিন্তা হুড়মুড়িয়ে ধেয়ে এল। আর, সত্যি বলছি, ঠিক গুরুদেবের বর্ণনা করা তুরীয়াবস্থার মতো যেন আমি নিজের অন্তরে উপলব্ধি করতে পারলাম ব্রহ্মাণ্ডের সংগীত। কিন্তু সে সংগীত মূলদ সংখ্যার দ্বারা চালিত নয়। সে সংগীত মূলদ আর অমূলদ সংখ্যার মেলবন্ধনে তৈরি এক অভূতপূর্ব মূর্চ্ছনা! মুহূর্তের মধ্যে মাথায় খেলে গেল কী করে প্রমাণ করা সম্ভব যে ২-এর বর্গমূল কিছুতেই মূলদ সংখ্যা, মানে দুটো পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশের সমান হতে পারে না।
আমার ঘুম তখন সম্পূর্ণ কেটে গেছে। পাশের বিছানায় শুয়ে থিওডোরোস তখন সজোরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আমি অন্ধকারেই লিখতে শুরু করলাম।—
ধরা যাক ২-এর বর্গমূল একটি মূলদ সংখ্যা = ক/খ। এমনটা ধরে নিতেই পারি যে ক এবং খ পরস্পর মৌলিক , অর্থাৎ তাদের মধ্যে ১ ব্যতীত অন্য কোনও সাধারণ গুণনীয়ক নেই। (যদি সাধারণ গুণনীয়ক থেকেও থাকে তা দিয়ে লব এবং হর উভয়কেই ভাগ করলেও মূলদ সংখ্যাটির কোনও পরিবর্তন হয় না তা আমরা জানি। কাজেই সমস্ত সাধারণ গুণনীয়ক দিয়ে লব এবং হরকে ভাগ করার পর আমরা এমন ক এবং খ পেয়ে যাব যারা পরস্পর মৌলিক।)
এবার, যেহেতু, ক/খ = ২-এর বর্গমূল, উভয়পক্ষে বর্গ করলে পাই,
ক^২/খ^২ = ২,
বা, ক^২ = ২খ^২
অর্থাৎ, ক^২ একটি এমন পূর্ণবর্গ সংখ্যা যা কিনা ২-এর গুণিতক , মানে ক^২ একটি পূর্ণবর্গ জোড় সংখ্যা ।
কিন্তু তার মানে ক একটি জোড় সংখ্যা। কারণ ক যদি জোড় সংখ্যা না হয়, তাহলে ক একটি বিজোড় সংখ্যা । সেক্ষেত্রে ক^২ দুটি বিজোড় সংখ্যার গুণফল। কিন্তু, আমরা জানি দুটি বিজোড় সংখ্যার গুণফলও সবসময় বিজোড় সংখ্যাই হয়। তাই সেক্ষেত্রে ক^২ একটি বিজোড় সংখ্যা, যা একটু আগেই আমরা দেখেছি সত্যি নয়।
অর্থাৎ, ক একটি জোড় সংখ্যা। ফলে, এরকম একটি পূর্ণসংখ্যা, ধরা যাক গ, আমরা পাব যে,
ক = ২গ,
বা, ক^২ = ৪গ^২।
এখন, যেহেতু ক^২ = ২খ^২, তাই আমরা লিখতে পারি,
৪গ^২ = ২খ^২,
বা, খ^২ = ২গ^২
অর্থাৎ, খ^২ একটি পূর্ণবর্গ জোড় সংখ্যা। অতএব, ঠিক ক-এর বেলায় যা যা যুক্তি দিয়েছিলাম, ঠিক সেই সেই যুক্তির সাহায্যে আমরা দেখতে পারি যে, খ-ও একটি জোড় সংখ্যা, অর্থাৎ, ২ দ্বারা বিভাজ্য ।
কিন্তু এ তো বিভ্রাট! কারণ আমরা শুরুই করেছিলাম এই বলে যে, ক এবং খ পরস্পর মৌলিক, কিন্তু হিসেব করে দেখা গেল উভয়েই ২-এর গুণিতক, অর্থাৎ, ২ এদের এক সাধারণ গুণনীয়ক। কাজেই তারা পরস্পর মৌলিক হতে পারে না!
ক এবং খ একাধারে পরস্পর মৌলিক আবার পরস্পর মৌলিক নয়—এই দ্বন্দ্বের একটাই সমাধান, ২-এর বর্গমূলকে ক/খ আকারে লেখা অসম্ভব!
*
বাকি রাতটা সেদিন উত্তেজনার বশে আর ঘুমোতে পারলাম না। ভোরের আলো ফুটতেই আমার লেখা প্রমাণ নিয়ে ছুটলাম গুরুদেবের কক্ষের উদ্দেশ্যে।
ছুটতে ছুটতে বার বার শুধু একটা কথাই কানে বাজতে লাগল: ‘ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর ব্যাখ্যা শুধু মূলদ সংখ্যার দ্বারা সম্বব নয়। অমূলদ সংখ্যাও চাই। চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারার দরকার নেই, এই পৃথিবীর জমিতেই আঁক কেটে এমন সরলরেখাংশ টানা সম্ভব যার দৈর্ঘ্য একটি অমূলদ সংখ্যা।’
আমার মনে পড়ল আমাদের মন্ত্র—‘জেনো সেদিন হবে জ্ঞানসাগরে সন্তরণের ইতি/ যবে জগৎ জুড়ে থাকবে নাকো কোনও অসঙ্গতি।’
আজ আমি সত্যি সত্যি একটি অসঙ্গতির সমাধান করেছি! এমন অসঙ্গতি যার সমাধান করতে গিয়ে স্বয়ং গুরুদেব পর্যন্ত ভুল পথে চলেছিলেন। আমার অসামান্য আবিষ্কার আমাদের গুরুকুলের মর্যাদাকে আরও সহস্রগুণ বাড়িয়ে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস।
গুরুদেবের দ্বাররক্ষার দায়িত্বে থাকা দাদাদের লক্ষাধিক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোনোমতে গুরুদেবের কক্ষে প্রবেশ করলাম। উত্তেজনায় আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। দাদারা কী বুঝল জানি না, আমার অনেক কাকুতি-মিনতির পর ছেড়ে দিল।
গুরুদেবের কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে দেখতে পেলাম গুরুদেব ধ্যানমগ্ন। কতক্ষণ এভাবে কাটল জানি না, মনে হচ্ছিল যেন অনেকটা সময়। গুরুদেবের ধ্যান ভাঙার পর ওঁর সঙ্গে কী কী কথা হয়েছিল এখন স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে।
“এ কি! হিপ্পাসোস, তুমি এখানে?” গুরুদেব বললেন, “তুমি তোমার পাঠাভ্যাসে যাওনি? প্রার্থনায়?”
“ক্ষমা করবেন গুরুদেব, আমি আপনাকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাতে এসেছি। আপনাকে এই মুহূর্তে না বললেই নয়!”
“না হিপ্পাসোস, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথাই পাঠাভ্যাস আর প্রার্থনার চেয়ে বড়ো নয়। তুমি এখন যাও, তোমার পাঠভ্যাসে যোগ দাও। দিনের শেষে তুমি এসে আমার সঙ্গে দেখা কোরো, কেমন?”
“কিন্তু গুরুদেব, আমি যে এক মহাজাগতিক অসঙ্গতির সমাধান পেয়েছি। আমি অমূলদ সংখ্যার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পেরেছি! আপনি অনুগ্রহ করে একবার আমার প্রমাণটা একটু যাচাই করে দেখুন।”
অমূলদ সংখ্যার কথা শুনে গুরুদেব কি একটু চমকে গিয়েছিলেন? নাকি সেটা আমার দৃষ্টির ভুল? যাই হোক, গুরুদেব নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, “হিপ্পাসোস, নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া কোনও মহৎ কার্য কখনোই সম্পন্ন হয় না। নিয়মানুযায়ী এখন তোমার পাঠাভ্যাসের সময়, আর তুমি তাই করবে। তুমি তোমার প্রমাণের লেখাটি আমার কাছে রেখে যাও, আমি দেখে রাখব। তুমি দিনের শেষে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। তখন আমরা তোমার প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করব। তুমি এখন যাও।”
গুরুদেবের কথায় এমন কিছু ছিল যে, আমি আর কোনও কথা বলতে পারলাম না। আমার লেখা প্রমাণ গুরুদেবের কক্ষে রেখে আমি আমার কক্ষে ফিরে এলাম। তারপর গুরুদেবের আদেশানুযায়ী পাঠাভ্যাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
সারাদিন সময় যেন একটু একটু করে অতি ধীর লয়ে এগোল। একটা দিন যেন মনে হল এক যুগের সমান!
দিনের শেষে পাঠাভ্যাসের সময় অতিক্রান্ত হতেই আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না। সোজা গুরুদেবের কক্ষে উপস্থিত হলাম। গুরুদেব যেন আমার আসার অপেক্ষা করছিলেন। আমি ওঁর কক্ষে প্রবেশ করতেই বললেন, “হিপ্পাসোস, এসো এসো। তোমারই অপেক্ষা করছিলাম। শোনো, তোমার প্রমাণ মোটামুটি ঠিকই আছে। কিন্তু আরও একটু গুছিয়ে লিখতে হবে, বুঝলে? তোমার আবিষ্কার খুবই যুগান্তকারী। তাই খুব সাবধানে আমাদের এই তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তাই আমার আদেশ, তুমি তোমার আবিষ্কারের কথা কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিও না। তোমার সহপাঠী, বন্ধু, দাদা—কাউকে না। কেমন? যথাসময়ে আমরা তোমার এই আবিষ্কার লোকসমক্ষে প্রকাশ করব।”
*
সেদিনের পর থেকে দেড় পক্ষকাল পেরিয়ে গিয়েছে, গুরুদেব আমায় কিছু জানাননি। প্রত্যেকটা দিন অপেক্ষা করে থেকেছি কখন গুরুদেব আমায় ডেকে পাঠান এই আশায়। পড়াশুনোয় মন বসাতে পারিনি। বন্ধুদের এড়িয়ে গেছি, পাছে ভুলবশত আমার আবিষ্কারের কথা কাউকে বলে ফেলি।
দিনের পর দিন এভাবে কেটেছে, এক-একটা দিন মনে হয়েছে যেন এক-একটা যুগ। কিন্তু গুরুদেবের ডাক আর আসেনি।
*
এমনি করে একদিন, মানে গতকাল, থিওডোরোস টানতে টানতে নিয়ে গেল কাছের সরাইখানায়। সব কথা স্পষ্ট মনে নেই। থিওডোরোস আর অন্যান্যরা মিলে সেদিন উলটোপালটা নানারকম পানীয় খাইয়েছিল। খুব যে মন্দ লেগেছিল তা নয়, কিন্তু আমার বিশেষ মনে নেই গতকাল কী কী হয়েছিল। এটুকু মনে আছে যে, অনেকদিন পর গত রাত্রে আমি অঘোরে ঘুমিয়েছিলাম।
আজ সকালে উঠে দেখি থিওডোরোস ওর বিছানায় নেই। আমার বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। কেন যেন মনে হয়েছিল, কাল রাত্রে সরাইখানায় অতগুলো পানীয় গলাধঃকরণের পর আমি খুব ‘অমূলদ, অমূলদ’ বলে চেঁচিয়েছিলাম। জানি না কেন, মনে হচ্ছিল, থিওডোরোস গিয়ে গুরুদেবকে বলে দেবে না তো যে, আমি লোকসমক্ষে আমার আবিষ্কারের কথা বলে ফেলেছি? নাহ্, আমার এই ধারণা নিশ্চয়ই অমূলক। থিওডোরোস আমার প্রাণের বন্ধু, সে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করবে?
সারাদিন যেন ঘোরের মধ্যেই কাটল। গতকাল রাত্রের কথা ভাবলে একটু অনুশোচনা, একটু যেন অপরাধবোধ হচ্ছিল। অতটা পানীয় খেয়ে নেওয়া উচিত হয়নি। তার চেয়েও বড়ো কথা, অমূলদ সংখ্যার ব্যাপারটা এভাবে রাষ্ট্র করে দেওয়াটাও উচিত হয়নি, যেখানে গুরুদেব নিজে আমায় নিষেধ করেছিলেন। এতদিন ধরে পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়ার ব্যাপারটাও আমাকে আজ যেন বেশি করে নাড়া দিচ্ছিল। নাহ্, আমাকে আবার আমার স্বমহিমায় ফিরে আসতেই হবে, যে করেই হোক!
*
সন্ধেবেলায় থিওডোরোস এসে যখন বলল, “অ্যাই হিপ্পো! চল সরাইখানায় যাই।”
আমি প্রথমটায় রাজি হইনি। তারপর যখন বলল, “আরে চল না বাপু, আজ আমাদের সঙ্গে আলেফিয়াও যাবে ওখানে।” সেটা শুনে প্রথমে মনটা নেচে উঠলেও, আমি এবারও ‘না’-ই বললাম। আলেফিয়াকে আমি মনে মনে খুব পছন্দ করি, তা থিওডোরোস জানে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজি হলাম না, কারণ কালকের কথা ভেবে এখন আমার পুরোপুরি অনুশোচনাই হচ্ছিল। তারপর থিওডোরোস মোক্ষম চালটা চালল—“কাল কী কী কাণ্ড করেছিস, সেটা একটু ওখানকার লোকজনদের জিজ্ঞেস করে দেখবি না?”
এবার আমি না বলতে পারলাম না। খুনি যেমন তার অপরাধস্থল আর-একবার ময়না করতে আসে, আমিও তেমনি চলেছিলাম সরাইখানার উদ্দেশ্যে।
ব্যস! এইটুকুই। তারপর আর কিছু মনে নেই।
*
ভূমধ্যসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ আর দুলুনিতে যখন চোখ খুলল, তখন আবিষ্কার করলাম আমার হাত-পা পেছন মুড়ে বাঁধা। মুখের ভেতর কাপড় গুঁজে দেওয়া। মাথার পেছনটা ব্যথায় টনটন করছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রে নৌকোর ওপর অন্যান্য মানুষদের ঠিকঠাক চিনতে পারলাম না। শুধু আলেফিয়ার মুখটা দেখতে পেলাম। সুন্দর মুখ উদ্বেগে অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর দেখতে পেলাম থিওডোরোসকে। তার সদাহাস্যময় মুখে এখন এক পাশবিক জিঘাংসা!
থিওডোরোস চিৎকার করে উঠল—“তুই গুরুদেবকে অপমান করিস! তোর এত সাহস! গুরুদেব বলেছেন না অমূলদ সংখ্যা বলে কিছু হয় না, হতে পারে না! তুই সেটা বিশ্বাস করিস না? তোর এত অহংকার?”
থিওডোরোস চিৎকার করতে লাগল—“গুরুদেব আমাদের শিখিয়েছেন, গোটা ব্রহ্মাণ্ডের চাবিকাঠি মূলদ সংখ্যা। তিনি এর সাহায্যেই মিলিয়ে দিয়েছেন ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে আমাদের সংসারকে। তাঁর এই তত্ত্ব একদিন আমি সারা বিশ্বসংসারে ছড়িয়ে দেব। সবাই একডাকে চিনবে পিথাগোরাস আর থিওডোরোসকে। আর তুই কিনা আমার সেই স্বপ্ন ছারখার করে দিতে চাস?”
অন্ধকারেও ঠাহর করতে পারছিলাম যে, থিওডোরোসের মুখ প্রতিহিংসায় কুঁকড়ে গিয়ে একটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে তার, কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর কেঁপে যাচ্ছে।
উত্তাল ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ের গর্জনকে ছাপিয়ে উঠল থিওডোরোসের গলার আওয়াজ—“মৃত্যুই তোর উপযুক্ত শাস্তি! আজ তোর সঙ্গে-সঙ্গেই তোর অমূলদ সংখ্যার অস্তিত্বও এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।”
আমি কিছু বলার আগেই থিওডোরোস আমায় ধাক্কা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের জলে ফেলে দিল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আমি ছটফট করতে করতে নিমেষের মধ্যেই তলিয়ে গেলাম।
*
হয়তো এই মুহূর্তেই আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু তাতে আমার দুঃখ হচ্ছে না। না, জন্মান্তরের তত্ত্বে আমি বিশ্বাস করি না। অমূলদ সংখ্যার অনস্তিত্বের মতোই জন্মান্তরের ধারণাও পিথাগোরাসের এক অন্ধ বিশ্বাস। কাজেই ওতে আমার কণামাত্র ভরসা নেই। আমার দুঃখ হচ্ছে না, কারণ আমার মনে এখন দুঃখের জন্য কোনও স্থান আর ফাঁকা নেই। আমার গুরুর অন্ধবিশ্বাসে, আমার প্রাণের বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায়, আমার ভালোবাসার নির্লিপ্ততায়, আর আমার সত্যের অক্ষমতায় আমি বিস্মিত। এতটাই বিস্মিত যে দুঃখের আর স্থান নেই।
জন্মান্তরে বিশ্বাস করি না, তাই জানি আর এই নির্মম পৃথিবীতে ফিরে এসে নতুন করে কষ্ট পেতে হবে না। শুধু এটুকু আশা রাখি যে, আগামী প্রজন্ম যেন আমায় মনে রাখে। আমি হিপ্পাসোস ও’মেটাপনটিয়োন, যাকে পিথাগোরাসের অন্ধবিশ্বাসের তাড়নায়, তাঁরই ছাত্রছাত্রীরা হত্যা করেছিল। আমি হিপ্পাসোস ও’মেটাপনটিয়োন, যাকে সত্যের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল।
কৈফিয়ত:
এ-কথা স্পষ্টতই বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই কাহিনি কাল্পনিক। আবার এ-কথাও সত্যি যে এর অনেকটাই প্রামাণ্য ইতিহাস। সত্যি-মিথ্যের চুলচেরা হিসেব কষে কাহিনির স্বাদ কষাটে করতে চাই না। তোমরা কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য ‘Hippasus’ নামটা ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে পারো।
অলঙ্করণ- দেবসত্তম পাল