শঙ্করপুরের ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টর মৎস্যগন্ধা গেস্ট হাউসের কাছে, সুমদ্র থেকে মিটার তিনশো দূরে ঝাউবনের মাঝে, ছোটো বালির পাহাড়ের ওপর পুরোনো দিনের লালরঙের দোতলা বাড়িটা যতবার দেখেছি, ততবারই মনে হয়েছে, এই বাড়িটায় দু-একদিন থাকতে পারলে বেশ হত। বাড়িটা মোটেই ভাঙাচোরা নয়, বরং রীতিমতো সংস্কার হয় বাড়িটার। এর আগে বার তিনেক শঙ্করপুর এসে বাড়িটার সামনে ঘোরাঘুরি করলেও ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি গেটের সামনে মুশকো চেহারার দুটো কুকুর বসে থাকতে দেখে। সামনে যেতেই এমন একটা চাপা গরগর করে শব্দ উঠেছিল যে হার্টবিট বেড়ে গেছিল। কুকুর-বেড়ালের সঙ্গ মোটেই আমার পছন্দ হয় না।
সমুদ্রের ধারের কুয়াশাঢাকা সকাল আমার খুব পছন্দের। বছর কয়েক ধরে আমি শীতকালে একবার শঙ্করপুরে আসি ছবি তোলার জন্য। চম্পা নদীর মোহনার ধারে শীতের সকালে তোলা আমার একটা ছবি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিল। এই লাল বাড়িটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে একটা ছবির ফ্রেম আমার মাথায় দু-বছর ধরে ঘুরে বেড়ালেও ওই কুকুরের ভয়ে আর ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি। বাড়িটায় কাউকে দেখতেও পাইনি যে ডেকে কথা বলব। বাড়িটা নিয়ে অনেকবার স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করব করব করেও করা হয়ে ওঠেনি। আসলে আমি খুব একটা লোকের সঙ্গে মিশতে পারি না।
ভোরবেলা শঙ্করপুর থেকে চাঁদপুরের দিকে সমুদ্রের পাশের উঁচু বাঁধের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া পাকা রাস্তাটা ধরে হাঁটার সময় নজরে এল, লালবাড়ির দরজা খুলে জংলা রঙের প্যান্ট আর লাল জ্যাকেট গায়ে টুপি পরা একজন লোক বেরোচ্ছেন। আর দেরি করিনি, ছুটে গিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লোকটা কয়েক মুহূর্ত পরে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধের ক্যামেরা ব্যাগটার দিকে নজর করে বললেন, “আরে আপনি?”
চমকে উঠেছিলাম। আরে, ইনি তো বৈজ্ঞানিক তপনানন্দ সেন! এতদিন ওঁর সঙ্গে পরিচয় এমনকি ওঁর সঙ্গে দু-একটা অভিযানেও গেছি আর আমি জানতেই পারিনি যে শঙ্করপুরে ওঁর বাড়ি আছে!
এ-কথা সে-কথার পর আমি আমার ছবি তোলার বাসনাটা জানালাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন ওঁর বাড়িতে গেস্টরুম আছে, আমি হোটেল ছেড়ে এখনই ওঁর বাড়িতে চলে আসতে পারি। কোনও অসুবিধা হবে না। সমুদ্রের জলের ওপর জাহাজ আর ট্রলার থেকে ভেসে থাকা তেল কী করে সহজে শুষে নেওয়া যায় তা নিয়ে একটা অন্যরকম কাজ করছেন। সে কারণেই প্রতিবছর শীতকালে এখানে আসেন পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে। পূর্বপুরুষের বাড়িটা অবহেলায় পড়ে ছিল, সেটাকেই সংস্কার করে গবেষণাগার বানিয়ে নিয়েছেন।
আমি কোনোভাবেই সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। ওঁর সঙ্গে বাড়ির লনে বসে এক কাপ চা খেয়ে হোটেলে গিয়ে বিল মিটিয়ে ব্যাগপত্তর গাড়িতে চাপিয়ে সোজা চলে আসি ওঁর বাড়ি।
দুপুরের খাওয়াদাওয়াটা জম্পেশ হয়েছিল। ইয়া বড়ো বড়ো কাঁকড়া আর তোপসে মাছের ঝোল। খাওয়াদাওয়ার আগে অবশ্য বাড়িটা ঘুরে দেখে নিয়েছিলাম। অনেকটা স্কুলের প্যাটার্নের বাড়িটা। একটা বিশাল লনকে ঘিরে চারদিকে সার সার ঘর। বাড়িটার চতুর্দিকে প্রচুর ঝাউগাছ। যাতে হওয়ার দাপট সহজে বাড়িটার ক্ষতি না করতে পারে তাই গাছগুলো এমনভাবে লাগানো যে, প্রাথমিক চোটটা গাছগুলো সামলে নেয়। পুরোনো আমলের ঘরগুলোর দেওয়াল, কুড়ি ইঞ্চি মোটা। তাই কি গ্রীষ্ম কি শীত, সবসময় ঘরের ভেতরটা সহনীয় উষ্ণতা বজায় থাকে? ঘরের জানালার কাঠগুলো ওঠানো নামানো যায়। কী যেন বলে এই জানালাগুলোকে? হ্যাঁ, খড়খড়ি। সে যাই হোক, শুনলাম এই ধরনের জানালার সুবিধা এই যে, প্রচণ্ড ঝড় উঠলে ওই জানালার কাঠগুলো হরাইজন্টাল করে দেওয়া হয়, আর দরজাও খুলে রাখা হয়। তাতে হাওয়া একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়, ফলে বাড়ির কাঠামোর কোনও ক্ষতি হয় না। তা ছাড়া বাড়িটা ঠিক ঝাউবনের মধ্যে, ফলে হাওয়া এলে সব চোট গাছগুলোই সামলে নেয়। একসময় এখানে নাকি সমুদ্রের ধারে প্রচুর ঝাউগাছ ছিল। সব নাগাড়ে কেটে ফেলায় সমুদ্রের পাড় এখন আর পোক্ত নেই, সমুদ্রও এগিয়ে এসেছে অনেকটা। ঝড় উঠলে, প্রাকৃতিক কোনও রক্ষাকবচ না থাকায় সমুদ্রের হাওয়া সপাটে ধাক্কা মারে, তাতে বাড়িঘরের প্রচুর ক্ষতি হয়।
এই বাড়িতেও যথারীতি উনি একা। ওঁর পোষা দুটো কুকুর, একজন রান্নার লোক তথা দারোয়ান আর একজন মালি—সর্বসাকুল্যে এই ক’জন লোক। কুকুর দুটো আমায় খানিক শুঁকে-টুকে গেটের কাছে গিয়ে বালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এর আগেও তপনানন্দ সেনের অন্য গবেষণাগার দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে ওঁর গবেষণাগারে। কিন্তু এই গবেষণাগারটি যে কীরকম তা জানা নেই। খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই উনি নিজেই বললেন, “চলুন, আমার ল্যাবরেটরিটা দেখাই। ভালোই হয়েছে আপনি এসে পড়েছেন। আজ রাতে আমার পোষ্যগুলোকে ছাড়ব, দেখি কী ফল দাঁড়ায়।”
পোষ্য! চমকে উঠেছিলাম। সেগুলো আবার কীরকম?
বাড়ির পেছনের অংশের একটি ঘর খুলে লাইটটা খুট করে জ্বালাতেই নজরে এল একটা বিশাল চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চাটার একদিকে দুটো বড়ো পেডেস্টাল ফ্যান লাগানো। জলের ওপর কালো পোড়া তেল ভাসছে। জলের মধ্যে চোবানো দুটো মেশিন সমানে কৃত্রিম ঢেউ বানিয়ে চলেছে। বুঝলাম না ওই জলের ভেতর ওঁর পোষ্যগুলো আছে কি না।
“ওপরে তাকান।” তপনানন্দ সেনের কথা শুনে ছাদের দিকে তাকিয়ে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কারণ, ছাদের সিলিং অন্ধকার।
“কিছু দেখতে পেলেন?”
“না! অন্ধকার হয়ে আছে, কিছু বুঝতে পারছি না।”
“বেশ, তাহলে আপনিও কিছু দেখতে পেলেন না। আমার পোষ্যরা অন্ধকারের জীব। তাই বেশি আলো জ্বালানো যায় না এ-ঘরে। এবার সরে আসুন দরজার কাছে।”
আমি দরজার কাছে সরে দাঁড়াতেই উনি হাতে ধরে থাকা একটা রিমোটের মতো বোতামে চাপ দিতেই কতগুলো কালো কালো পাখির মতো কী যেন উড়ে এসে হামলে পড়ল জলের ট্যাঙ্কে। মুহূর্তের মধ্যেই দেখি জলের ওপর ভাসতে থাকা তেলগুলো নেই। তেল শুষে নিয়ে যেগুলো উড়ে এসে জলে পড়েছিল সেগুলো আবার উড়ে চলে গেল। বুদ্ধুর মতো দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার আর করার কিছু ছিল না।
“কিছু বুঝলেন?”
“না!”
“ওগুলো ছিল মেকানিক্যাল বাদুড়। আলো কম থাকায় বুঝতে পারেননি হয়তো। দেখতে একদম বাদুড়ের মতো হলেও ওগুলো একধরনের রোবট। উড়তে পারে। ওদের ঠোঁটগুলো একধরনের সাকার। তরল শুষে নিয়ে জমা করে পেটের মতো দেখতে ছোটো ট্যাঙ্কে। ওই তেল দিয়েই আবার চালু হয় ওদের ইঞ্জিন। ফলে আমাকে ওগুলোকে ওড়ানোর জন্য আলাদা করে জ্বালানি ভরতে হয় না। মেকানিক্যাল বাদুড়ের পেটে একটা করে ব্যাটারি আছে, যার কানেকশন এই রিমোট দিয়ে অন করা যায়। ওই দামি গাড়ির মতো আর কি—দূর থেকে বোতামে চাপ দিয়ে ইঞ্জিন চালু করা যায়। প্রবল হাওয়াতেও উড়তে পারে আমার পোষ্যগুলো। দেখেছেনই তো কী জোরে চলছে পাখাগুলো।”
“করেছেন কী!”
“না না, এগুলো আর কী, আজ রাতে একটা পরীক্ষা করব সমুদ্রে। এই ছোটো ছোটো বাদুড় দিয়ে বেশি তেল জল থেকে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমি ছ’টা মেকানিক্যাল ঈগল বানিয়েছি। ওদের ঠোঁট শুধু সাকারই নয়, এক-একটা ফুটো করার মেশিন। লোহার মোটা পাত ফুটো করতে পারে ঈগলের ঠোঁটগুলো। এটা বানিয়েছি মাঝিদের অসাবধানে বা ট্রলার উলটে জলে পড়ে ভাসতে থাকা তেলের ব্যারেল ফুটো করে তেল সংগ্রহ করার জন্য। জানেন না, কত তেলভরতি ব্যারেল ভেসে বেড়ায় সমুদ্রে। তারপর কিছুদিন পর জাহাজ বা ট্রলারে ধাক্কা খেয়ে সেই ব্যারেল ফুটো হয়ে তেল ছড়িয়ে পড়ে জলের ওপর। কত শত সমুদ্রের প্রাণীর যে ক্ষতি করে এই ভাসমান তেল! আমার পোষ্যদের নাকে সেন্সর লাগানো আছে, ওরা খুঁজে নেয় তেল।”
“এ তো দারুণ আবিষ্কার! পেটেন্ট নেননি এখনও?”
“এখনও আমার ল্যাবের বাইরে কিছু পরীক্ষা হয়নি। আমি আর এই বাড়ি দেখভাল করা দুজন লোক ছাড়া আপনি হলেন চতুর্থ ব্যক্তি যিনি এই পরীক্ষার ব্যাপারে জানলেন। আপনি তো জানেন পেটেন্ট-টেটেন্টে আমার উৎসাহ নেই। আমি মজা পাই বলে নিজের ছন্দে কাজ করি।”
“তা, আজ রাতে সমুদ্রে পরীক্ষা চালাবেন? অনেক লোকজন তো লাগবে।”
“কেউ লাগবে না, পুরো পরীক্ষাটা চলবে এই বাড়িতে বসেই। শুধু একটাই খামতি রয়ে গেছে, ক্যামেরা লাগানো হয়নি রোবটগুলোর গায়ে, ফলে অপারেশনটা দেখা যাবে না। পরে ওদের মাথার ওপর ক্যামেরা লাগিয়ে দেব। আজ সন্ধেবেলাতেই খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেবেন, রাত বারোটা থেকে কাজ শুরু করব। সারাদিন ধরে এক এক করে পোষ্যগুলোকে চেক করে নিতে হবে ব্যাটারিগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কি না। আজ আর ল্যাবরেটরিতে নয়, আসল ময়দানে নেমে পরীক্ষা।”
সারাদিন ধরে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়ালাম, বিশেষ করে চম্পা নদীর মোহনায়, যেখানে মাছ ধরার ট্রলার দিনরাত সমুদ্র থেকে আসছে যাচ্ছে। সার সার ট্রলার মোহনায় দাঁড়িয়ে। কয়েকটা জলে আধা গা ডুবিয়ে কয়েকটা আবার ডাঙার ওপর। ছোটোখাটো মেরামতের কাজ লেগেই আছে ট্রলার-ভরা মোহনায়। মাছের গন্ধে ম ম করছে চারদিক। আমার চোখ জলে ভাসমান তেলের ব্যারেল খুঁজে চলেছে। তপনানন্দ সেনের মেকানিক্যাল ঈগল চোখে দেখিনি। ওগুলো কত বড়ো হতে পারে আইডিয়া নেই। ঈগলগুলো কি মোহনায় উড়ে বেড়াবে, না সমুদ্রের গভীরের দিকে উড়ে যাবে কিছুই জানা নেই।
তপনানন্দ সেনের সাথে দেখা হল সন্ধেবেলা।— “সব রেডি, চলুন একবার সমুদ্রের ধার থেকে ঘুরে এসে খাবার খেয়ে নিই।”
“আচ্ছা, আপনার পোষ্যগুলো, ইয়ে মানে ঈগলগুলোকে কি সমুদ্রের ধারে নিয়ে গিয়ে ছাড়বেন?”
“না না, এখান থেকেই ছাড়ব। দেখতেই পাবেন। এই রোবটগুলো মাত্র মাইল দুয়েক দূরে যেতে পারবে। ওরা মাইল দুয়েক রেডিয়াস জুড়ে উড়ে বেড়াবে। যেখানে মেটালের মধ্যে তেল সেন্স করবে সেখানেই ড্রিল করতে শুরু করবে। ওদের মাথার চিপে প্রোগ্রাম সেট করা আছে, ঠিক একঘণ্টা পরে ফেরত এসে যাবে রোবটগুলো। কিন্তু সমস্যা হল এখানে জলে ভাসমান তেলের ব্যারেল পাবে কি না। জলের ছোঁয়ায় না থাকলে সেই ব্যারেল ওরা ফুটো করবে না।”
“মানে এখানে, ধরুন আপনার বাড়িতে একটা তেলভরতি ব্যারেল রাখা থাকলে আপনার পোষ্যরা সেই ব্যারেল ফুটো করে তেল সাক করবে না?”
“না। তাহলে তো আমার পরিকল্পনাটাই মাটি। আমি তো জলের ওপর ভাসমান তেল পরিষ্কার করতে চাই।”
আটটা নাগাদ খেয়ে নিয়ে আমি আমার ঘরে চলে এলাম। মিস্টার সেন গিয়ে ঢুকলেন ওঁর ল্যাবরেটরিতে। বিছানায় খানিক গড়াগড়ি দিলাম। ঘুম আসবে না জানতাম। খানিক ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। জানি রাতের অন্ধকারে কিছুই ছবি আসবে না। তবুও ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশগানটা রেডি রাখলাম। বার বার ঘড়ির দিকে নজর যাচ্ছে। মিস্টার সেন পারফেক্ট ম্যান। ওঁর সঙ্গে আগের অনেক অভিযানের অভিজ্ঞতায় জানি ঠিক বারোটাতেই উনি কাজ শুরু করবেন।
সাড়ে এগারোটা বাজতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লনে পায়চারি করতে লাগলাম। ঘড়ির কাঁটা যেন এগোচ্ছেই না।
“ওপরে ছাতে চলে আসুন।” ছাদের পাঁচিলের ওপর থেকে মুখ বাড়িয়ে মিস্টার সেন ডাক দিলেন।
মোবাইলের ঘড়িতে দেখাচ্ছে বারোটা বাজতে এক মিনিট বাকি। ছাদে পৌঁছে দেখি একটা হালকা আলো জ্বলছে। ছাদের আলসের ওপর চারটে বিশাল সাইজের ঈগল বসে আছে। জানা না থাকলে অল্প আলোয় ধরতেই পারতাম না যে ওগুলো আসলে রোবট, কোনও পাখি নয়। সমুদ্র থেকে ছুটে আসা প্রবল হাওয়ায় দু-পাশে ডানা ছড়িয়ে বসে থাকা পাখির পালকগুলো তিরতির করে কাঁপছে।
আমি ছাতে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই উনি হাত বাড়িয়ে রিমোটের বোতামে চাপ দিতেই পাখি, থুড়ি রোবটগুলো উড়ে চলল সমুদ্রের দিকে। ঝকঝকে তারাভরা আকাশে মিনিট খানেকের মধ্যেই বিন্দু হয়ে হারিয়ে গেল বিশাল পাখিগুলো।
মিস্টার সেন একদম চুপ করে আছেন। ওঁর রাঁধুনি দু-কাপ চা নিয়ে এল। চায়ের গন্ধে ম ম করে উঠল ছাদ। সেই বিশেষ চা। যা ওঁর পারিবারিক চা-বাগানে ওঁর জন্যই আলাদা করে ব্লেন্ডিং হয়। এই চা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।
তিনশো মিটার দূরে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে। সমুদ্রের মাঝে বহুদূরে বিন্দুর মতো জ্বলছে মাছধরা ট্রলারের আলো। বাড়ির খানিক দূরে মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে হেড লাইট জ্বালিয়ে মাঝে-মাঝেই বিকট আওয়াজ তুলে এক-একটা ভ্যানো যাচ্ছে। মৎস্যজীবী দলের আনাগোনা দিনরাত চলে এখানে। ঝাউবনে থেকে থেকে একটা তক্ষক ডেকে চলেছে। রাতচরা পাখিরও অভাব নেই। মাথার ওপর দিয়ে একটা দুটো করে উড়ে যাচ্ছে খানিক থেকে থেকে। সোয়েটারের ওপর উইন্ডচিটার পরে থাকায় শীত টের পাচ্ছি না। বরং কী হবে কী হবে এই উত্তেজনায় কপালে ঘাম হচ্ছে। মিস্টার সেন একটা পাতলা হাফ সোয়েটার গায়ে দিয়ে আছেন। পাখিগুলো উড়ে যাবার পর থেকে একটাও কথা বলেননি উনি। শুধু বিশাল ছাদের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে পায়চারি করে চলেছেন।
আমি মাথার ওপরকার আকাশ দেখছি বার বার। পাখিগুলো যে কোনদিক থেকে ফেরত আসবে জানা নেই। মিস্টার সেনের হাতের রিমোট থেকে পিঁ পিঁ করে দু-বার আওয়াজ হতেই মোবাইলটা বের করে দেখি একটা বাজে। মানে পাখিগুলো ফেরার সময় হয়ে গেছে। হাতের মুঠো দুটো দুই চোখের সামনে দূরবীনের মতো করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যদি দেখা যায় পাখিগুলোকে!
মিনিট খানেকের মধ্যেই শঙ্করপুরের দিকের আকাশে চারটে কালো বিন্দু ক্রমশ বড়ো হতে হতে উড়ন্ত পাখির আকার নিল। খানিক সময়ের মধ্যেই ছাদের আলসেতে এসে বসল পাখিগুলো। মিস্টার সেন একটা পাখির ডানা ধরে একটা মোচড় মারতেই একটা ঢাকনামতো খুলে গিয়ে তেল চুঁইয়ে পড়তে লাগল।
“অপারেশান সাকসেসফুল।” উচ্ছ্বাসহীন গলায় বলে উঠলেন মিস্টার সেন।— “আমরা না দেখলেও আমার পোষ্যরা ঠিক জলে-ডোবা তেলের ব্যারেল খুঁজে পেয়েছে। যান, এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুন গিয়ে, কাল সকালে কথা হবে।”
ঘরে এসে বিছানায় শুলেও ঘুম এল না। এত বড়ো একটা সাকসেস, আর উনি কী ভীষণ নির্লিপ্ত! খানিকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে চারটে বাজতেই উঠে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ভোরটা ছবি তোলার আদর্শ সময়। মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মোহনায়। সূর্য সবে আকাশে লাল রঙ মাখাতে শুরু করেছে। বালির ওপর লাল কাঁকড়া ঝাঁকে ঝাঁকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। একটা মৃত ডলফিনের শরীর থেকে ঠুকরে ঠুকরে মাংস খাচ্ছে এক বিশাল দাঁড়কাক। মোহনায় দাঁড়িয়ে থাকা সার সার ট্রলারের দিক থেকে খুব চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে। খুব মাছ ধরা পড়েছে বোধহয়। ছবি তোলার মোক্ষম সাবজেক্ট।
“এইভাবে তেল চুরি করতে দেখিনি। পুলিশে খবর দাও তাড়াতাড়ি।”
তেল চুরি! খানিক থমকে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলাম ভিড় লক্ষ করে।
“ভাই, কী হয়েছে?”
আমাকে ক্যামেরা হাতে এগোতে দেখে সাংবাদিক ভেবে এগিয়ে এলেন কয়েকজন।
“কী হয়েছে? এই কালু, ওঁকে ট্রলারে তুলে দেখা তো। ছবি তুলে কাগজে পাঠাক।”
ট্রলারে উঠে দেখি তেলে ভেসে যাচ্ছে ট্রলারের নীচের অংশটা। একটা তেলের ব্যারেলের খানিক অংশ জলে ডুবে, তার গায়ের ওপরের দিকে একটা ছোট্ট ফুটো।
“একটা নয়, চার-চারটে ট্রলারের এই হাল করেছে চোরেরা। কখন যে করল কেউ টেরই পায়নি। তবে বেশি তেল চুরি করতে পারেনি।”
ঝটাপট কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে ট্রলার থেকে নেমে ছুট লাগালাম। মিস্টার সেনকে খবর দেওয়াটা খুব জরুরি। সব ট্রলারের তেলের ব্যারেলেই যে খানিক জল লেগে থাকে!