গল্প- ঘটেছিল যাহা-সুনৃতা মাইতি -বসন্ত২০২৩

      এই লেখকের আগের গল্প- আমরা  হারব না কিছুতেই

golpoghotechilojaha

বুল্টি বড়ো ঠাম্মির পিঠের দিকে একটা বালিশ রেখে দিল যত্ন করে। বড়ো ঠাম্মি ডিভানের ওপর আয়েশ করে বসে বললেন, “একটি দেশের কাছে আজকের সন্ধ্যাটা ভারি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা জানো তোমরা?”

গেনু, অন্তু, বুঁচকি, পটকাই কিংবা বুল্টিরা তা জানবে নাই-বা কেন ! আজ তো চৌদ্দই আগস্ট। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। আর এই সন্ধ্যাটাকে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক-সন্ধ্যাও বলা যায়। গেনুদের আবাসনের আঙিনায় স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনের সমস্ত বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে। ফুল-টুল সকাল সকাল কাল হরেকৃষ্ণকাকু দিয়ে যাবেন। এখন বাচ্চারা সবাই বড়ো ঠাম্মির গল্পের আসরে বসে গেছে। আজ দিনটা পড়াশুনো না করলে বড়োরা কিছু বলবেন না। বড়ো ঠাম্মি তো আর রোজ রোজ আসেন না। অন্তরার বড়ো ঠাম্মির বয়স পঁচাশি ছুঁইছুঁই। তিনি অন্তরার ঠাম্মির সবচেয়ে বড়ো দিদি। উত্তর কলকাতায় সাবেকি বাড়িতে একলাই থাকেন। খানদুই বহু পুরোনো কাজের লোক অবশ্য আছেন সবসময়। দেশকে নিজের চোখে স্বাধীন হতে দেখেছেন তিনি। তাই গেনু, অন্তু, পটকাইরা ঠিক করেছিল বড়ো ঠাম্মির হাত দিয়েই এবার জাতীয়  পতাকা উত্তোলন করা হবে। প্রস্তাব পাড়া মাত্রই বড়ো ঠাম্মি তল্পিতল্পা-সহ বোনের বাড়ি হাজির। ভারি চমৎকার গল্প বলেন তিনি। আবাসনের খুদেগুলোর কাছে তার আকর্ষণ সাংঘাতিক।

নরুন পাড়ের সাদাটে খোলের দেশজ শাড়ি পরে আছেন তিনি। ধবধবে সাদা চুলে প্রচুর খুঁজলেও একটিও কালো চুলের অবশেষ মিলবে না। ফর্সা টুকটুকে মুখে বহু রেখার আঁকিবুকি। কিন্তু চোখ দুটো এখনও ভারি সতেজ। বুড়োদের মতো ঘোলাটে নয়।

স্বাধীনতার গল্প, না ভূতের গল্প! তাই নিয়ে এতক্ষণ ভয়ানক শোরগোল চলছিল সবার মধ্যে। বড়ো ঠাম্মি পান-টান খান না। নিজের তৈরি বিশেষ মুখশুদ্ধি রাখেন ডিবেতে। আমলা, হরিতকি, লবঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। তারই খানিক মুখে ফেলে সামান্য ক’টি দাঁত দিয়ে চিবোতে চিবোতে সবাইকে থামতে ইশারা করলেন। তারপর বললেন, “আজ যে গল্পটা তোদের বলব তার একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। ভূতপ্রেতের অভাব কলকাতায় কোনোদিনই ছিল নাকো। তবে এখন তেনারা একটু সিঁটিয়ে গেছেন নগরায়নের দাপটে এই আর কি। তোরা ন্যাশনাল লাইব্রেরি, হেস্টিংস হাউস কিংবা রাইটার্স বিল্ডিং-এর ভূতেদের কথা হয়তো শুনেছিস। তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় কলকাতা একটা ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার এক বছর আগের কথা। স্বাধীনতার বহু বছর আগে থেকেই ব্রিটিশরা তাদের তুরুপের শেষ তাসটি দিয়ে রাজত্ব বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। তোরা সবাই হয়তো সেটা জানিস। ডিভাইড অ্যান্ড রুল। তারই ভয়াবহ ফলশ্রুতি ১৯৪৬ সালের কলকাতা রায়ট। ইতিহাসে হয়তো তোরা পড়েছিস ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এর কথা। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েকটি দিন কলকাতার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। দুই সম্প্রদায়ের  মানুষ বহু বছরের ঐক্য আর সম্প্রীতির ইতিহাস ভুলে নিজেদের মধ্যে হিংসায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এতে সবচেয়ে দুর্বিপাকে পড়েন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। লুটতরাজ চলতে থাকে নির্বিবাদে। প্রচুর মানুষ প্রাণ হারান। আমি তখন আট কি নয়। তবুও পুরো ঘটনাটাই আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট ধরা আছে। বাংলার  মুখ্যমন্ত্রী তখন হাসান শাহিদ সুরাবর্দী আর ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল। ইংল্যান্ডের রাজা তখনও ষষ্ঠ জর্জ। আর প্রধানমন্ত্রীর আসনে গেড়ে বসে আছেন বৃদ্ধ উইনস্টন চার্চিল।

“উত্তর কলকাতায় যৌথ পরিবারে আমরা অনেকে মিলে থাকি। আমরা চার ভাইবোন, মা, ঠাকুমা, মেজকাকু, ছোটকাকু ও দুই পিসি। সে-সময় বাবা আর কাকুরা বাদে কেউ আমরা পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বের হই না। তখন বেশ ক’বছর ধরে  সব জায়গা থেকে দলে দলে মানুষজন কাজের আর খাদ্যের আশায় কলকাতায় ভিড় জমাচ্ছিলেন। অবশ্য চিত্রটা রাতারাতি পালটে গিয়েছিল সেই বছরটায়। কত মানুষ কলকাতা ছাড়তে শুরু করলেন। আমাদের বাড়ির পুরুষরা সবাই স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভেদের রাজনীতি তারা ঘৃণা করতেন। আমাদের মহল্লায় সব সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থাকতেন। তখন সকালে আমাদের ব্রেকফাস্ট কী ছিল জানিস?” বলেই তিনি এবার একটু থামেন। তারপর দীর্ঘ একটি নিশ্বাস নেন।

“চিঁড়ে কিংবা মুড়ি। তুমি আর ঠাম্মি মিলে গল্প করো যে!” অন্তরা ফুট কাটে।

বড়ো ঠাম্মি ভঙ্গিমা পালটে বসতে বসতে বলেন, “ঠিক। ষোলো তারিখের সকালবেলা। তা সকালে  সবাই সারি দিয়ে বসেছি। মা চিঁড়ে আর গুড় দিচ্ছেন সকলের থালাতে, হঠাৎ দেখা গেল হাবলু নেই। হাবলু আমাদের ছোটো ভাই। তোদের বম্বের ছোটদাদু। তখন তার চার বছর বয়স। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। হাবলুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে বাবা কাকারা কেউ নেই। তাঁরা পার্টির জরুরি মিটিংয়ে গেছেন। এদিকে বেলা বাড়তেই কলকাতায় সাংঘাতিক অবস্থা। আপার সার্কুলার রোড, হ্যারিসন রোড, স্ট্র্যান্ড রোড পুরো জ্বলছে। লুট হয়ে যাচ্ছে ধর্মতলার সব নামি দোকানগুলো। বাদ পড়েনি প্রখ্যাত কাপড়ের দোকান কমলালয় স্টোর্সও। পুলিশ ফোর্স অপ্রতুল কিংবা কোনও কারণে নিষ্ক্রিয়। শান্তিকামী কিছু  মানুষই একমাত্র সারা কলকাতা টহল দিয়ে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। আমাদের বাড়ি থেকে বার হওয়া নিষেধ। হাবলু একটু দুরন্ত প্রকৃতির ছেলে। ওকে অনেক বোঝানো হয়েছিল বাড়ি থেকে কোথাও না যেতে। বাচ্চা মানুষ, অত কি বোঝে! চুপ করে কখন বেরিয়ে গেছে। মা তো কেঁদেকেটে অস্থির। বাড়ির সব কাজকর্ম মাথায় উঠেছে। এমন সময় দেখি প্রতিবেশী বটাদার হাত ধরে হাবলু বাড়ি ফিরে এসেছে। বড়ো রাস্তায় একা দেখতে পেয়ে বটাদা ওকে ধরে এনেছেন। হাবলুর মুখ শুকনো। কথা কইছে না কোনও। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল সে নাকি ফুল কুড়োতে গিয়েছিল। আমাদের বাড়ি থেকে সোজা পথ ধরলে ডাইনে একটা পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়ি চোখে পড়ত। তার ঠিক সামনেই একটা ফুলের গাছ ছিল। কী ফুল মনে নেই। গাছ আলো করে ফুল ফুটে থাকত।

“‘তা হাবলু, ফুল কই রে?’ সবাই প্রায় সমস্বরে তাকে শুধোলুম।

“‘ফুল কুড়োই, পাশে রাখি আর কে যেন নিয়ে নেয়। পাই না ফুল।’ মাথা নাড়িয়ে ভয়ার্ত মুখে বলল হাবলু।

“ছোটো বাচ্চা ছেলের কথা কে আর ধর্তব্যের মধ্যে আনে! আমরা সবাই খুব করে হেসে-টেসে হাবলুকে বাইরে না যাবার বিষয়ে এন্তার জ্ঞান প্রদান করলাম। একমাত্র মা আর ঠাকুমাই দেখি একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে এতেই যা শান্তি।

“সন্ধ্যা নামতে না নামতেই হাবলুর ধুম জ্বর এল। গা একেবারে আগুনের মতো তপ্ত। আর তার সঙ্গে বেহিসেবি প্রলাপ কথন। কারা নাকি হাবলুকে ডাকছে! জানালা দিয়ে কিংবা দরজা দিয়ে। কই, আমাদের চোখে তো কিছু পড়ছে না! আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন অত ডাক্তারবদ্যি ছিল না। অল্প কিছু হলে ঠাকুরথানের জলপড়া খাইয়ে দেওয়া হত, আর গুরুতর কিছু হলে নাখোদা মসজিদের এক মৌলভি সাহেব এসে ঝাঁড়ফুক করে দিয়ে যেতেন। তাতেই কু-বাতাস মিলিয়ে যেত। খুব দূরে না থাকলেও এই দাঙ্গা পরিস্থিতিতে মৌলভি সাহেবকে সকালের আগে পাওয়া মুশকিল। পাশের বাড়ির বটাদা সকাল হলেই গিয়ে তাকে নিয়ে আসবেন। বাবা আর মেজকাকা পার্টির জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় বাড়িতে ফিরতে পারবেন না। তাঁরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে উন্মত্ত রক্তপিপাসু মানুষদের নানাপ্রকারে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। এদিকে হাবলুর জ্বর বেড়েই চলেছে। মা ওর মাথায় জলপটি দিচ্ছেন আর কেঁদে চলেছেন অবিরত। সবার মুখ ম্লান। শুধু একটানা একটা অদ্ভুত গোঙানির স্বরে হাবলু বলে চলেছে—‘তোমরা আমাকে ধরো। ওরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।’

“আমাদের ঠাকুমা শশীবালা ভারি প্রত্যুৎপন্নমতি আর তেজিয়ান মহিলা ছিলেন। তখন তাঁর মধ্যবয়স। কিন্তু গাঁয়ের মেয়ে ছিলেন বলে অভিজ্ঞতা আর সাহস দুটোই তাঁর ঢের ছিল। তিনি সিংহগর্জনে বললেন, ‘কে নেবে আমার নাতিকে? কার এত বুকের পাটা? শশীবালা বেঁচে থাকতে ওটি হবার নয়। ওরে, তোরা সবাই মিলে হাবলুকে ঘিরে বসে যা রে। প্রত্যেকে হাতে হাত আর পায়ে পা লাগিয়ে বসো। ফাঁক যেন না থাকে।’

“অমনি মা, বাকি দুই ভাইবোন আর দুই পিসি—সবাই ঠাকুমার কথামতো বেঁধে বেঁধে গোল হয়ে বসে গেল। উপায় কী আর! আমি এক দৌড়ে ঠাকুর ঘরে গিয়ে নিবিষ্ট মনে ঠাকুরকে ডাকতে শুরু  করলাম। রাত তখন অনেক গড়িয়েছে। সময়টা মনে নেই। এমন সময় মনে হল আমাকে কেউ ডাকছে। পেছন ফিরে দেখি দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রাণের বন্ধু  আফরোজা। আফরোজা আর আমি কিছুদিন আগে পর্যন্ত এঁটুলির মতো পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে থাকতাম। আর তার সঙ্গে দেখা হয় না। শুনছিলাম ওরা নাকি এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাবে। ছোটো পিসি আবার কার থেকে শুনেছে ওরা নাকি পূর্ববাংলায় ওদের কোন শরিকের বাড়ি চলে যাবে। শুনে আমার ভারি মনখারাপ করত। সেই আফরোজা আমাদের এমন বিপদের কথা শুনে এত রাতে ছুটে এসেছে! আফরোজা হাঁফাচ্ছে। খুব তড়িঘড়ির মধ্যে আছে মনে হল। আমার হাতে একটা রুপোর চৌকোমতো তাবিজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর সময় নেই রে। আমি চলে যাচ্ছি। এটা ভাইকে শিগগিরি পরিয়ে দে গে। দেরি করিস না। ওই শয়তানটা খুব খতরনাক।’

“ভালো করে দেখি এ তো আফরোজার গলার কবজ!

“‘কিন্তু এটা তো তোর…’ এটুকু বলতে পেরেছি মাত্র অমনি আফরোজা বলল, ‘আমার আর এটা লাগবে না। আমি তাঁর রহম আর করমে আছি। আল্লা নেগেবান।’

“‘রাতেই রওনা দিচ্ছিস কেন রে? তোদের সব মালপত্তর বাঁধাছাদা হয়ে গেছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কথার জবাব না দিয়ে আফরোজা এক ছুটে পালাল।

“বসার ঘরে গিয়ে দেখি মানুষ-গণ্ডিতে বসা সবার চোখ লাল। কেউ বসে থাকতে পারছে না। ঢুলতে ঢুলতে পড়েই যাবে মনে হচ্ছে। আজকেই যেন রাজ্যের ঘুম সবার চোখে ভর করেছে। ঠাকুমা ভারি বিপদগ্রস্ত মুখে ইষ্টনাম জপছেন আর সবাইকে ধমকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মনে হয় আর পারবেন না। মায়ের চোখ-মুখ ফুলে একাকার। আমি ঠাকুমাকে গিয়ে তাবিজের কথা বললাম। ঠাকুমা একমনে কী যেন ভাবলেন দু-দণ্ড। তারপর আমার হাত থেকে ঝট করে তাবিজটা নিয়ে মানুষ-গণ্ডি পেরিয়ে হাবলুর হাতে বেঁধে দিয়ে বললেন, ‘জয় মা বিপত্তারিণী। মা-ই পাঠিয়েছেন এই কবচ।’

“কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ঘুম তাড়িয়ে চাঙ্গা হয়ে বসল। ধীরে ধীরে হাবলুর জ্বর কমতে লাগল। ক্রমে ভোরের আলো ফুটে উঠল। হাবলু নিস্তেজ হয়ে ঘুমোচ্ছে। এমন সময় মৌলভি সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বটাদার সঙ্গে এলেন। এই বিপর্যয়ের মাঝে থাকতেও পারবেন না খুব বেশিক্ষণ। খুব স্পষ্টভাবে মৌলভি সাহেবের মুখটা মনে পড়ে না। তবে তাঁর হাতে থাকত একটা তসবি মালা। গালের দাড়িতে মেহেদি রং। সুর্মা পরা গভীর কালো চোখে তিনি চারদিক মাপছেন। চোখের দৃষ্টিটা আমি ভুলিনি। সেটা বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। তারপর ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে বলছেন, ‘ইয়া আল্লা! এই আউলাদকে বাঁচালেন কী করে আম্মা! এ তো খতরনাক পাল্লায় পড়েছিল!’

“তারপর মৌলভি সাহেব হাবলুর সারা শরীরে হাত বুলিয়ে মন্তর পড়তে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল আফরোজার কবচখানি। তিনি বললেন, ‘ইয়া আল্লা! এ তো… এ তো আমারই দেওয়া সুলেমানি তাবিজ! কে দিল?’

“‘আমার বন্ধু আফরোজা। রাতে এসে…’ আমি বাধো বাধো স্বরে বলি।

“‘হায় হায়, সে-বেটির তো বড়ো মুসিবত হবে তাহলে! প্রায় চার বছর আগে সে-বেটিকে খুব নাকাল করেছিল ওই খতরনাক নাপাক চিজটা। আমি এই নকশ-এ-সুলেমানি তাবিজটা বেটিকে পরাতে বাধ্য হয়েছিলাম। বহুবছর আগে খ্বাজা আশরফ আলি লখনোবি আমাকে এটা দিয়েছিলেন। বড়ো শক্তিশালী এই তাবিজ। এটা থাকলে বেটার আর কোনও খতরা নেই। কোথায় যেন ফুল তুলতে গিয়ে সেই বেটির জানটাই যেতে বসেছিল। যাবার সময় ওর বাড়ি হয়ে যাব। আমাকে নিয়ে চলো কেউ।’ বলেই  বাড়ির চারদিকে মন্ত্রপূত জল ছড়িয়ে আর কীসব পাঠ করে বেরিয়ে গেলেন মৌলভি সাহেব। তার বেশ কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ গলিতে প্রচুর চিৎকার শুরু হল। ছোটকাকু বিপর্যস্ত মুখে বাড়ি ফিরে এলেন। এসেই যা বললেন তাতে আমাদের আক্কেলগুড়ুম।

“আফরোজাদের বাড়িতে ভয়ানক ব্যাপার ঘটে গিয়েছে। ঘরে তাদের পরিবারের সকলের লাশ পড়ে আছে। কাল রাতে সন্তর্পণে এসে কিছু ধর্মান্ধ মানুষ আফরোজাদের গোটা পরিবারকে একসঙ্গে হত্যা করেছে। আমরা কোনোদিনও ভাবতে পারিনি আমাদের নাকের ডগায় এরকম একটা অমানবিক ঘটনা ঘটতে পারে। আর আফরোজা! সে তো আমার মনের দোসর ছিল। প্রতি ঈদে আফরোজাদের বাড়ি থেকে সিমাইয়ের পায়েস আসত। আর জন্মাষ্টমীর দিন আমি ওকে দিয়ে আসতাম গোপালের প্রসাদী মালপোয়া আর নারকোল নাড়ু।

“এদিকে বাড়িতে সবাই আমাকে ঘিরে ধরে কেবলই কাল রাতের কথা শুধোচ্ছে। আমার পাগল পাগল লাগছে। আমি ক্রমাগত কেঁদে চলেছি। এমন সময় ঠাকুমা কী বুঝলেন কে জানে, সবার কবল থেকে বাঁচিয়ে আমাকে ঠাকুরঘরে নিয়ে শীতলপাটি বিছিয়ে শুইয়ে দিলেন। আফরোজা আমার চোখের জল দেখতে একটুও ভালোবাসত না। পরে যখন বড়ো হলাম, মনে প্রশ্ন এল, অত রাতে কীভাবে এল আফরোজা? আমার চোখের জল মোছাতে? সবাই তো বলছিল ওদের নাকি ঘুমের মধ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আফরোজা যে বলেছিল ওরা চলে যাচ্ছে! সত্যিই কি ওটা আফরোজা ছিল, নাকি ওর অপার্থিব অস্তিত্ব! আফরোজা বলেছিল তাবিজের দরকার আর ওর নেই। ও স্বয়ং ঈশ্বরের হেফাজতে আছে। তবে কি ও তখন… এইসব প্রশ্নের জবাব পাইনি আজও।” বলে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন বড়ো ঠাম্মি।

সবাই চুপ। ঘরে পিনপতন নীরবতা। শেষে পটকাই ঢোঁক গিলে নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন করল—“আর ফুলের গাছ আর খতরনাক বস্তুটা? ওটা কী ছিল বড়ো ঠাম্মি?”

বড়ো ঠাম্মি গলা খাঁকারি দিলেন একবার। তারপর বললেন, “বলছি। তারপর তো শুট অ্যাট সাইট জারি হল ১৮ তারিখ রাত থেকে। ১৯ তারিখে মেটিয়াবুরুজে ৩০০ ওড়িয়া মজদুরকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হল। কলকাতা তখন নিথর। লজ্জায়, ঘৃণায় আর বেদনায়। লাশের ঢের জমেছে রাস্তায় রাস্তায়। মাথার ওপর শকুন উড়ছে। শেষ পর্যন্ত ২১ তারিখ থেকে লর্ড ওয়াভেল বাংলার সরাসরি দায়িত্ব নিলেন। গোর্খা রেজিমেন্ট মোতায়েন হল। ২২ তারিখে মোটামুটি শান্ত হল কলকাতা। তারপর বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর অবশেষে ঠিক পরের বছর ভারত স্বাধীন হল। তার কয়েক বছর পর ওই জীর্ণ বাড়িটা প্রমোটারদের কবলে চলে যায়। তখন ফুলগাছটাও কাটা পড়ে। ওখানে মাটি খুঁড়তে গিয়ে তিন-তিনটে শক্তপোক্ত নরকঙ্কাল পাওয়া যায়। উত্তর কলকাতার ওই এলাকায় ব্রিটিশদের পা চাটা এক গুণ্ডা কালু শেখের রবরবা ছিল একসময়। লোকে বলে ওগুলো কালু শেখ আর তার শাগরেদ দুজনের অবশেষ। কালু শেখ নাকি কলকাতায় রুজিরুটির সন্ধানে সদ্য আসা সহায় সম্বলহীন গরিব পরিবারগুলোর বাচ্চা চুরি করে হয় সমাজবিরোধী কাজে লাগাত নয়তো ধনী দেশিয় ব্যক্তি কিংবা ব্রিটিশ অফিসিয়ালদের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে সাপ্লাই করত। এসব কথার সত্যি-মিথ্যা জানি না। কারাই-বা কালু শেখ আর তার শাগরেদদের মেরে ওখানে পুঁতে রেখেছিল এটাও রহস্য।”

এতটা একটানা বলে বড়ো ঠাম্মি একটু থামলেন। তাঁর চোখ ছলছল করছে। তারপর বললেন, “যে স্বাধীনতা তোমরা জন্মসূত্রে পেয়েছ সেটা কিন্তু সহজ পথে আসেনি। তোমরা সেটা ভুলো না যেন। তবে কী জানিস, আজকাল  আফরোজাটার কথা খুব মনে পড়ে। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে আমার। এ পার্থিব জীবন প্রায় শেষ চরণে। আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বরের বাগানে পৌঁছে আবার আফরোজার সঙ্গে দেখা হবে। আর-একটা কথা। জানবি ঈশ্বরের বাগানে মানুষে মানুষে কোনও বিভেদ নেই। ধর্ম নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি তো দুরস্থান, আমি বিশ্বাস করি একদিন সেখানে দোলনায় দুলতে দুলতে দুজনে আবার একসঙ্গে রবি ঠাকুর আর নজরুলের কবিতা পড়ব।”

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s