গল্প- গুপ্তধনের ফাঁদে-শেলী ভট্টাচার্য-বসন্ত২০২৩

শেলী  ভট্টাচার্যের আগের গল্প- ট্রি-বট, উৎসর্গ, অ্যান্টিরোবট

golpoguptadhanerfande

মাধব চাটুজ্জেদের বাড়ির ভাঙা পাঁচিলের উপর বসে আনমনে পা দোলাচ্ছিল গুলুদা। শুভ্র বকের সারির মতো মেঘের দলেরা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের বুকে। সেইদিকে তাকিয়ে ভাবছিল ও—আহা, কী অপূর্ব প্রকৃতি। বাতাসে কান পাতলেই যেন ঢাকের মিঠে বোল শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। নাকে ভেসে আসছে শিউলি বিছানো উঠোনের সোঁদা গন্ধ। ভোরে পদ্মপাতার উপর নোলকের মতো টলটল করছে শিশিরের বিন্দু। এমন সময়েই যে মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। মনে হয়, দল বেঁধে কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসি।

পরিচিত গলার শব্দে গুলুদার ভাবুক জগতের ছন্দপতন ঘটল, “সে আমি জানব কী করে বল! আমার তো জানিসই, ইতিহাসে পাতিহাঁস হাল ছিল।”

বেশ বিরক্তির সুরে কথাগুলো বলছিল দীপু। বেণু ঠোঁট টিপে হাসছিল ওর কথায়। গুলুদাকে দেখে ওরা প্রায় সমবেত স্বরে বলে উঠল, “কী ব্যাপার, আজ এত তাড়াতাড়ি যে! অন্যদিন তো তোমার অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে আমাদের কোমর টনটন করে ওঠে।”

দীপু আরও যোগ করল—“এলাকায় বড়ো ব্রিজ হচ্ছে, কীসব হাইওয়ে-টাইওয়েও হবে নাকি! গুলুদার কি নিশ্বাস ফেলার সময় আছে এখন?”

“মেলা ফুট কাটিস না দীপু। পি.ডব্লু.ডিতে কাজ করি বলে নিজেকে হর্তাকর্তা কোনোদিনই মনে করিনি আমি। তবে সত্যি ব্রিজটা তৈরির ব্যাপারে বেশ তোড়জোড় চলছিল ক’দিন ধরে। সামনে ভোট আসছে। এখনই তো উন্নয়ন করার দিন। আজ সকালে নোটিশ এসেছে। কালীপুজোর পরেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।” গুলুদা সোজাসাপটা উত্তর দিল।

“আহা, চটছ কেন? আমি তো তোমার কর্তব্যপরায়ণতারই প্রশংসা করছিলাম।”

গুলুদার মুড বিগড়ালে এতদিন পরের জমে ওঠা আড্ডাটা নেতিয়ে যাবে। তাই পরিস্থিতিকে যথাসম্ভব ম্যানেজ করার চেষ্টা করল দীপু। বেণু চুপ করে ছিল। মনে মনে বলছিল, দীপুটার স্বভাব আর যাবে না। এই এলাকায় গৌতম মজুমদারের কর্তব্যনিষ্ঠার কথা কারই-বা অজানা আছে। শুধু অফিসে বলে নয়, ওর ঘরের একমাত্র সদস্য বিধবা যশোদাপিসির ক্ষেত্রেও সদা সতর্ক গুলুদা। তাছাড়াও পাড়ায় যখন যার যেমন দরকার পড়ে, একবার তলব করলেই গুলুদা সেখানে গিয়ে হাজির হয়ে যায়। তবে টাকাপয়সার ব্যাপারে একটু চেপে চলে দাদা। তা লোকে আড়ালে যতই কৃপণ বলুক, গুলুদার সাফ কথা—‘ভবিষ্যৎ ও বর্তমান বিপদকালীন পরিস্থিতির জন্য মিতব্যয়ী হওয়াটা সঠিক পদক্ষেপ।’

“শোনো না গুলুদা, দীপুদের বাড়িতে ওর এক দাদা এসেছে। সে নাকি লেখক!”

বেণুর কথায় এক নিমেষে মুড ঠিক হয়ে গেল গুলুদার। আজীবন বইপাগল মানুষটা লেখকদের বড্ড শ্রদ্ধা করে। শিশুদের মতো চোখ বড়ো বড়ো করে কৌতূহল প্রকাশ করল—“তাই নাকি?”

“দাঁড়াও দাঁড়াও, তিনটে চা দিতে বলি আগে। তারপর আমিই সবটা বলছি।” দীপু পাশের চায়ের দোকানের দিকে যেতে যেতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বিস্কুট খাবে তো সবাই?”

এদিক থেকে দুজনের ঘাড় নাড়া দেখে চায়ের সঙ্গে বিস্কুটের অর্ডার দিল দীপু। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের সঙ্গে ওদের আড্ডা জমে উঠল। দীপুই বলতে শুরু করল।—“আমার এই দাদা হল গিয়ে মায়ের পিসতুতো দিদির ছেলে। সন্তুদা বরাবরই লিটারেচার-প্রেমী মানুষ ছিল। আমার যতদূর মনে আছে, উত্তর কলকাতাতে যখনই ওদের বাড়িতে গিয়ে উঠতাম, তখনই ওকে বই মুখে করে বসে থাকতে দেখতাম। আমি তো বরাবরই পড়াশোনায় কমা ছাত্র ছিলাম। হয়তো সেই কারণেই ওর ধারেকাছে তেমন ঘেঁষতাম না। খালি মনে হত, এই বুঝি পড়া জিজ্ঞেস করবে। সে যাই হোক, সেই দাদাকে আজ প্রায় আট বছর পরে দেখলাম। সে এখন নাকি লেখক। বেশ কয়েকটি পত্রপত্রিকায় তার লেখা এসেছে। উপন্যাস-টুপন্যাসও লেখে নাকি!”

“বলিস কী, লেখক মানুষ! আমার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দে ভাই!” রীতিমতো আকুতির সুর গুলুদার গলায়। উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগল, “সারাজীবনে এত বই পড়লাম, কিন্তু একজন লেখকের সঙ্গে দু-দণ্ড বসে নিবিড়ভাবে কথা বলা হল না। এটা একটা আপসোস ছিল আমার। খালি মনে হত, লেখকেরা ঠিক কতটা কল্পনা আর কতখানি বাস্তবকে নির্ভর করে অমন সুন্দর সুন্দর সাহিত্য রচনা করেন, তা যদি একটু জানতে পারতাম। আহা, এও তো এক সাধনা।”

বলতে বলতে আনমনে দূরের মাঠটার দিকে তাকিয়ে রইল গুলুদা। যত বয়স বাড়ছে, পিসির সঙ্গের প্রভাব গুলুদার উপর ভালোভাবেই পড়ছে। কেমন যেন ভাবুক ভাবুক হয়ে উঠছে দাদা—মনে মনে ভাবল বেণু। ভাবনার সর কাটিয়ে তরল গল্পের মধ্যে ডুব দিতে দীপুকে তাড়া দিল ও—“আহা, আসল ব্যাপারটা বল না!”

“বলছি, বলছি। আসল ব্যাপারটা হল সন্তুদাকে সামনের বছর কোন এক পত্রিকায় নাকি নববর্ষ উপলক্ষে ঐতিহাসিক উপন্যাস জমা করতে হবে। সেই জন্য আমায় খালি বলেই চলেছে, দেওয়ানগঞ্জে যাবে। আমাকেও যেতে বলছে ওর সঙ্গে। আমি সারাটা জীবন এই ইতিহাস বিষয়টা থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম। সেই ইতিহাসকে খুঁটিয়ে জানার জন্য কিনা আমাকেই সঙ্গী করতে চাইছে ও!”

দীপুর কথার মাঝেই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল গুলুদা। ওর মুখ জুড়ে খুশির আলো খেলা করে বেড়াচ্ছিল। আগ্রহে বলে উঠল ও, “আমি যাব।” দীপু আর বেণুর পিঠ চাপড়ে বলল, “আরে তোরাও যাবি। এই তো কিছুক্ষণ আগে আমার মনে হচ্ছিল, এমন ফুরফুরে শরতের দিনে কোথাও একটা ঘুরে আসা উচিত। সেটা যদি বালির দেওয়ানগঞ্জ হয়, তাহলে তো উপরি পাওনা হবে রে।”

“উপরি পাওনা কেন?” বিস্ময়ে প্রশ্ন করল বেণু।

“আরে, বালির দেওয়ানগঞ্জে যে বাংলার সর্ববৃহৎ দুর্গা প্যানেল রয়েছে। তাছাড়া ওখানে রয়েছে নবরত্ন মন্দির। শুনেছি, অপূর্ব টেরাকোটার কাজ রয়েছে সেসব ভগ্নপ্রায় স্থাপত্য জুড়ে। তাছাড়া এককালে রেশম শিল্প আর পিতলের কাজের জন্য ওই অঞ্চলের খুবই সুখ্যাতি ছিল।”

“তুমি কখনও আগে গিয়েছিলে নাকি?” দীপু প্রশ্ন করল।

“না রে, কলেজ-বেলায় একবার যাব বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তখন তো পকেট গড়ের মাঠ। ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না। তবে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে ঘুরে এসে ওখানকার গল্প বলেছিল আমায়।” গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসল গুলুদা। উৎসাহের সঙ্গে বলল, “চল না, সবাই মিলে ঘুরেই আসি। এই সপ্তাহের শনিবারই বেরিয়ে পড়ি চল।”

দীপু টের পেল, গুলুদার উঠল বাই তো কটক যাই ব্যাপারটা তুমুল চাগাড় দিয়ে উঠেছে।

বেণু কী যেন একটা চিন্তা করছিল। কিছুক্ষণ পরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমার অসুবিধা নেই। সোমবার বিকালে টিউশন পড়ানো আছে। তার আগেই চলে আসব আশা করি।”

“তোর মাথাখারাপ হয়ে গেছে! দেওয়ানগঞ্জ হল গিয়ে হদ্দ গ্রাম। ওখানে কি হোটেল বা ওয়ো রুম পাবি তুই যে দু-তিনদিন থেকে তারিয়ে তারিয়ে ঘোরার মজা নিবি!”

কিছুটা ব্যঙ্গের সুর ছিল দীপুর কথায়। গুলুদা তাতে মন দিল না। ওর মাথায় এই মুহূর্তে দুটো আনন্দ কিলবিল করে নাচছে। এক হল সেই কলেজ জীবনের ইচ্ছা মেটানোর সুযোগ, আর-একটা হল লেখকমশাইয়ের সঙ্গে লেখার রসদ জোগানোর স্থলে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া। এ যেন ডবল ধামাকা। পিসিমার মতোই জয়তারা বলে লাফ দিয়ে পাঁচিল থেকে নেমে দাঁড়াল গুলুদা। দু-হাতের ইশারায় তাড়া দিয়ে বলল, “আর মাত্র তিনদিন বাকি। বেণু, অণুকেও বলে দিস ব্যাগ গুছিয়ে নিতে।”

“তুমিও কি ওই গ্রামে থাকার কথা ভাবছ নাকি!” দীপু বিস্ময়ে বলল।

“অনেক তো হোটেলে গিয়ে থাকলাম, এবার না-হয় এক রাত গ্রামবাসীদের কারও ঘরে রাত কাটিয়ে দেব।”

“তারা যদি রাজি না হয় তো?” দীপুর দ্বন্দ্ব চরমে।

“সেসব তখন দেখা যাবে’খন। তোর দাদাকে তো একটু সময় দিতে হবে নাকি? আমাদের চোখ আর ওঁর চোখ কি একরকম! ওঁকে তো লিখতে গেলে সেই অঞ্চলের লোকেদের কাছ থেকে মন্দিরগুলোর ইতিহাস জানতে হবে, টেরাকোটার কাজগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। লেখা কি আর এতই সহজ রে! যতই তুই গুগলে মাথা গুলে পড়ে থাকিস না কেন, এটা জেনে রাখ, মাটির ইতিহাস মাটির কাছাকাছি মানুষজনেরাই ভালো বলতে পারে।” বলতে বলতে আবার কেমন যেন ভাবুক হয়ে গেল গুলুদা।

একবার যখন দলের পান্ডা হুজুগে মেতেছে, তখন বাকিদের এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়ার জো নেই। অতএব গুলুদা আর তার টিম মানে, দীপু, বেণু, বেণুর খুড়তুতো স্পোর্টস ওম্যান বোন অণু চলল বালির দেওয়ানগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে চলল দীপুর লেখক দাদা সত্যেন্দ্র সেন ওরফে সন্তু।

হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে আরামবাগে নেমে একটা টোটো ধরে নিয়েছিল ওরা। বাস রুট থাকলেও নিজেদের মতো করে গল্পগাছা করবে বলে টোটোতে উঠল। হালদারপাড়া অবধি প্রায় বারো কিলোমিটার পথ পেরোনোর সময় গুলুদার সঙ্গে বেশ কথাবার্তা চলছিল সন্তুর। ট্রেনে বসেই গুলুদা ওর সঙ্গে ভালোই আলাপ জমিয়ে ফেলেছিল। তাই টোটোতে উঠে দুজনেই ইতিহাসের প্রসঙ্গে চলে গেল। দীপু স্টেশনে নেমেই বুঝেছিল, এবার সেই নচ্ছার বিষয়টাকে নিয়ে দুজনে দলাইমলাই করবে। তাই ড্রাইভারের পাশের সিটটাতে উঠে বসেছিল ও। টোটো একটু স্পিড নিতেই ওর ধারণা বাস্তবতা পেল।

“বালি দেওয়ানগঞ্জ কেন নাম হয়েছিল জানো তো?” ফুরফুরে আমেজে বলল গুলুদা।

“যতটুকু জেনেছি, আগে এই অঞ্চলের নাম ছিল মকদমনগর। একবার বন্যায় নাকি দ্বারকেশ্বর নদ এমন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল যে, এই অঞ্চলের সবটুকু জায়গা বালির নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। এলাকার এই দুরাবস্থা দেখে সেই সময়কার শালিবান রাজার দেওয়ান জগৎসিংহ এগিয়ে এসেছিলেন। বালি সরিয়ে সম্পূর্ণ অঞ্চলকে উদ্ধার করিয়েছিলেন তিনি। তারপর গ্রামের দক্ষিণদিকে একটা গঞ্জ স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকেই এই জায়গার এমন নামকরণ।”

সন্তুর কথায় তৃপ্তিতে গুলুদা বলল, “বাহ্‌, ইতিহাস ছোঁয়ার আগেই দেখছি ইতিহাসকে জেনে এসেছ তুমি। তা এই এলাকা নিয়ে কেমন জঁরের উপন্যাস লিখতে চাও?”

“রহস্য হলে তো ভালোই হয়। আজকাল তারই চল বেশি। কিন্তু চাইলেই-বা এই হদ্দ গ্রামে রহস্য পাব কোথায়?” এদিক ওদিক তাকিয়ে আপসোসে বলল সন্তু।

বেণু এতক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে বলল, “যেখানে একসময় গুপ্তধন গচ্ছিত ছিল, সেখানে তো রহস্য থাকতেই পারে।”

“গুপ্তধন!” চোখ বড়ো বড়ো করে বলল অণু।

“হ্যাঁ রে, দুর্গা মন্দিরের কাছেই রয়েছে শিব কুঠি, যেখানে এখনও নাকি চোরা কুঠুরি, সরু সিঁড়ি পথ এমনকি মাটির নীচে সুড়ঙ্গ আছে বলেও অনেকে বলেন।”

বেণুর কথায় দীপুর এবার বেশ রাগই হল। ও বুঝল, ও বাদে প্রায় সবাই ইন্টারনেট সাঁতরে ইতিহাসকে অল্পবিস্তর ছুঁয়ে এসেছে। একমাত্র ওই বোবার মতো বেকুব হয়ে বসে রয়েছে।

“শিব কুঠির কিন্তু অন্য এক ইতিহাসও রয়েছে।” রহস্যময় গলায় বলল গুলুদা।

কিছুটা যাওয়ার পরেই টোটোর চালক আর এগোতে চাইল না। ওখান থেকে নাকি পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের রাস্তা শিব কুঠি। টোটোর ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে গ্রামের মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলল সকলে। পথের দু-ধারে আলু আর পাটের ক্ষেত। আশেপাশে লোকজনের চিহ্নটিও দেখা গেল না। গুলুদা হাতের কবজি উলটে গম্ভীর গলায় বলল, “বেলা একটার সময়ই এত নির্জনতা!”

“আগেই বলেছিলাম, এটা হদ্দ গ্রাম। লোকজন আদৌ ক’জন থাকে তাই দেখো!” দীপু সুযোগ পেয়ে ফুট কাটল।

“তোমরা কি দিনের বেলাতে ভয়-টয় পাচ্ছ নাকি?” অণু স্বভাবসিদ্ধ সাহসী গলায় বলল।

“ধুস, এ কি সেই ডাকাতি কালী মন্দির থেকে ফেরার ঘুটঘুটে অন্ধকার নাকি?”

গুলুদার কথায় সন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, “সেটা আবার কোথায়?”

“সে অন্য গল্প। তোমায় ফেরার সময় বলব’খন। যা এক ডাকাতের দলের পাল্লায় পড়েছিলাম আমরা…”

গুলুদার কথা শেষ হল না, অদূরে একজন গ্রাম্য সাইকেল আরোহীকে দেখা গেল। সকলেই পা চালিয়ে এগিয়ে গেল তার কাছে। সেও ওদের দেখে ততক্ষণে থেমে গিয়ে বাঁ পা-টাকে মাটিতে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দীপু ধেড়ে গলায় প্রশ্ন করল, “দুর্গা মন্দির আর কত দূরে বলতে পারবেন?”

“এই পথ দিয়ে হেঁটে গেলে একটু বেশি সময় লাগবে, তবে ওইদিকে শর্টকাট রাস্তা আছে।” আঙুল তুলে বাঁদিকের একটা সরু পথের দিকে ইঙ্গিত দিল বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের লোকটা। আরও বলল, “ইতিহাস এখানে পথে পথে। ওই পথে গেলেও তা টের পাবেন।”

“তাই নাকি? কিন্তু আমরা তো ওই পথ চিনি না। ইন ফ্যাক্ট কোনও পথই চিনি না।” সন্তু বলল।

“চলুন, আমি সঙ্গে যাচ্ছি।”

লোকটার কথায় সবাই যেন হাতে চাঁদ পেয়ে পেল। সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল লোকটা। ওর পিছু পিছু সবাই হাঁটছিল। পকেট থেকে একটা টেপা ফোন বের করে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বেশ গাইডের মতো টুকটাক ইতিহাস বলছিল লোকটা।—“জানেন তো, এই মন্দির নবরত্ন মন্দির। কার্নিশের নীচে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ—সবারই মূর্তি আছে। তাছাড়া শিব কুঠির কথা জানেন তো, লোকে বলে ওখানে নাকি এখনও গুপ্তধন আছে!” ওর গলায় রহস্য ঘনিয়ে এল। লঘু গলায় বলল ও, “কুঠির চোরা কুঠুরির ধনসম্পদ নাকি এখনও লুঠ হয়। আর এই পথেই রাতের অন্ধকারে পালায় সেসব দেশি লুটেরারা। পুলিশ তো হামেশাই তাদের খোঁজে এই পথে আসে।”

“বলেন কী মশাই!” রহস্যের গন্ধ পেয়ে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল সন্তুর।

বড়ো বড়ো গাছের ছায়াঘন পথটাকে তখন সকলেরই কমবেশি রহস্যময় লাগছিল। এমন সময় অদূরে শুকনো পাতার উপর মরমর শব্দের আলোড়ন উঠল। সকলে মুহূর্তে সেদিকে চেয়ে দেখল, কে একজন যেন জঙ্গলের দিকে দৌড়ে দ্রুত আড়ালে মিলিয়ে গেল। সকলকে চমকে দিয়ে লোকটা ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে শ-শ শব্দ করে যথাসম্ভব লঘু গলায় বলল, “মনে হচ্ছে লুটেরা। দাঁড়ান একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি।”

“এবার কি দিনের আলোতে ডাকাতের পাল্লায় পড়লাম আমরা?” দ্বন্দ্বে, ভয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠল বেণু।

অণু ডাকসাইটে গলায় বলল, “ধুস, এত ভয় পাস কেন? দেখলি না লোকটা নিজেই ভয়ে পালিয়ে গেল!”

সাইকেল আরোহী লোকটা ততক্ষণে ওদেরকে ঝোপের দিকে ডাকছে। সকলে সেদিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা বলল, “দেখুন কাণ্ড, এ তো মনে হচ্ছে সোনার পাত। কোন জমিদারের আমলের কে জানে।”

গুলুদা চোখ সরু করে দেখল পারলে-জি বিস্কুটের সাইজের একটা সোনার চকচকে পাত ওর হাতে। আরও দুটো মাটিতে পেতে রাখা একটা রঙচটা প্লাস্টিকের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। মুহূর্তে বলে উঠল লোকটা, “আমি বাবা গরিব মানুষ, আমি তো এসব নেবই। আপনারা কেউ নেবেন নাকি? এগুলো নাকি আজকাল সোনার চেয়েও দামি। কী বলে যেন, অ্যান্টিক না কী!”

গুলুদা নীচু হয়ে মাটির উপর থেকে একটা তুলে নিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলেন, “এক পাও নড়বেন না। আমার হাতে বন্দুক আছে। এসব গুপ্তধন নিয়ে তাহলে আপনারাই ব্যাবসা ফেঁদেছেন? শহর থেকে আসেন আর এসব হাতিয়ে নিয়ে গরিব লোকদের লোভে ফেলেন!”

ভয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার অবস্থা তখন নেই কারও। সন্তুর মাথায় রহস্য গল্পের জীবন্ত প্লট কাঁপুনি তুলেছে। বেণুর হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছিল। দীপু আড়চোখে অণুর দিকে তাকিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ওর ইশারা বোঝার। ও জানে অণু শুধু শারীরিকভাবেই পোক্ত নয়, উপস্থিত বুদ্ধিতেও তুখোড়। এমন সময় গুলুদা নীচু হওয়া অবস্থাতেই সামনের লোকটার পা ধরে এক টান দিল। আর উঁচু গলায় বলে উঠল, “এগুলো গুপ্তধন নয়। তোরা ভয় পাস না।”

অমনি অণু পেছন ঘুরে দেখল একজন যুবক সাধারণ পোশাকে হাতে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় দেখাতে ও চোখ রাঙিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “জানিস, আমরা পুলিশের লোক! তোদের এসব চক্র ধরতে এসেছি। আমাদের লোকেশন ট্রেস করে এক্ষুনি পুলিশ ফোর্স এখানে এসে পড়বে।”

ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে পথের ধুলা উড়িয়ে সত্যি-সত্যিই পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল। চারজন উর্দিধারী পুলিশ ছুটে এল দ্রুত। গুলুদা খেয়াল করল, ভয়ে সন্তুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল সবার কাছে।

পুলিশ অফিসার জানালেন—“বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে ফরেনারদের ভিড় জমছিল। আমাদের দেশের স্থাপত্যের উপর অনেকেই আর্টিকেল লেখেন। এখানকার ইতিহাস প্রায় চারশো বছরের পুরোনো। তাছাড়া এসবের টানে শহর থেকেও কিছু ইতিহাসপ্রেমী মানুষ ছুটে আসেন। এদের সকলের পকেট লুট করার জন্য একটা দল তৈরি হয়েছে এখানে। এরা মূলত কিছু পিতলের পাতকে ঘষে সোনার আকার দেয়। তারপর সেগুলোকে ছড়িয়ে রাখে মাটির উপরে। এই দলের মধ্যে একজন সাইকেল নিয়ে ঘোরে। সে পর্যটকদের ভুলিয়ে ভালিয়ে এই জনহীন পথে নিয়ে এসে গুপ্তধনের লোভ দেখায়। শুরুতেই সেই লোভে পা দিলে, তাদের লুঠ করাটা সহজ হয়ে যায়। নইলে উলটো খেলে ওরা। পর্যটকদেরই চোরা পাচারকারী প্রমাণ করার ভয় দেখায়। অবশেষে মোটা টাকার বিনিময়ে তাদের ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয়। এদের দলে সম্ভবত চার-পাঁচজন লোক আছে। পুলিশ বহুদিন ধরেই এই অঞ্চলে তক্কে তক্কে ছিল। আমরা পরিচিত টোটোওয়ালা, রিকশাওয়ালা ফিট করে রেখেছিলাম পর্যটকদের উপর নজর রাখার জন্য। আজ শিবুর কাছে খবর পেয়েই ছুটে এসেছি।”

কথাগুলো শুনেই সন্তু বলে উঠল, “শিবু মানে আমাদের টোটোওয়ালা?”

মৃদু হেসে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেন পুলিশ অফিসার।

“সত্যিই কি এখন শিব কুঠিতে কোনও গুপ্তধন আছে?” গুলুদা প্রশ্ন করল।

“কুঠি মানেই আমাদের মনে পড়ে নীলকুঠির অত্যাচারের ইতিহাস।”

অফিসারের কথায় মাথা নেড়ে গুলুদা বলল, “সে তো জানিই, এই কুঠি তো তা নয়। এ তো দয়াবান সম্রাট মিশ্র আর তার ভাই অত্যাচারী শিব মিশ্রর কুঠি। সম্ভবত শিব মিশ্রর অত্যাচারে গ্রামবাসী মারমুখী হয়ে উঠেছিল বলেই তো ওরা এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।”

“আপনি দেখছি অনেককিছুই জানেন। তবে নীল সাহেবদের অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত না হলেও এই কুঠিটি তাদের পরিত্যক্ত কুঠিই ছিল।” মৃদু হেসে বললেন অফিসার।

“গুপ্তধনের ব্যাপারটা কি ওই সুড়ঙ্গকে কেন্দ্র করে কিছু…” আমতা আমতা করে বলছিল অণু।

অফিসার ওর দিকে ফিরে বললেন, “কতকটা সেরকমই। তবে ওই সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল ওই পথ দিয়ে মহিলাদের নদীতে স্নান করতে যাওয়ার জন্য। অন্য কিছুই নয়।”

“গুপ্তধন তাহলে নেই বলছেন?” বিখ্যাত লেখক জটায়ুর মতো মুখভঙ্গি করে প্রশ্ন করল সন্তু।

মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন অফিসার। রহস্যময় গলায় বললেন, “সেভাবে তো বলিনি।”

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অফিসারের মধ্যবয়স্ক কুতকুতে অভিজ্ঞ চোখের দিকে।—“এত বছরের ইতিহাস যেখানে এখনও পর্যটকদের টেনে নিয়ে আসতে পারে, তা গুপ্তধন না হলেও সংস্কৃতির সম্পদ তো বটেই।”

গুলুদার সঙ্গে বাকিরাও সম্মত হলেন অফিসারের কথায়। ঘোরার আমেজ ফিরে এল সকলের মনে। সন্তুর দিকে তাকিয়ে দীপু বলে উঠল, “কী গো দাদা, তোমার মাথায় গল্পের প্লট এখন কী বলছে?”

ভাবুক গলায় উত্তর দিল সন্তু, “Truth is stranger than fiction.”

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s