গল্প- তুয়ার বন্ধুরা-অদিতি ঘোষ দস্তিদার-বর্ষা২০২৩

golpotuarbondhura

সকাল থেকেই মনটা খারাপ তুয়ার। মায়ের জ্বর। বাবা ট্যুরে। ফিরতে ফিরতে আরও তিনদিন। স্কুলে আসতে চায়নি ও। মা জোর করেই পাঠিয়েছিলেন। তুয়া মাকে উঠতে দেয়নি। দুধ-সিরিয়াল খেয়ে স্কুলে চলে এসেছিল। স্কুল-বাস দাঁড়ায় বাড়ির সামনেই, তাই সেদিকে কোনও অসুবিধে নেই।

মায়ের শরীর খারাপ হলে এমনিতেই মনখারাপ হয়, তার ওপর এই নতুন স্কুলে যেতে ওর একদম ভালো লাগে না। পড়াশোনা করতে যে ভালো লাগে না তা নয়, কিন্তু স্কুলে একটাও বন্ধু নেই যে! অথচ আগের স্কুলে কত কত বন্ধু ছিল তুয়ার। তাদের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়া, একসঙ্গে টিফিন খাওয়া, হাজার রকমের মজা আর গল্প করার স্মৃতি জ্বলজ্বলে। অ্যালব্যাম-ভরতি ছবি সেইসব মজার দিনের। তাই তো কলকাতা ছেড়ে সেই জায়গায় আসার পরও একটুও মনখারাপ করেনি। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, ভালো করে ইংরিজি বলতে না পারা—কোনও কিছুতেই কখনও কষ্ট হয়নি, টিচার আর বন্ধুরা কেমন যত্ন করে বুকে টেনে নিয়েছিলেন।

কলকাতা থেকে একেবারে কানাডার বর্ডারের কাছে একটা ছোট্ট শহরে বাবার কাজের জন্যে আমেরিকায় এসেছিল তুয়ারা। নায়াগ্রা ওদের বাড়ি থেকে গাড়িতে যেতে লাগত মাত্র দু-ঘণ্টা। থার্ড গ্রেড মানে ক্লাস থ্রি থেকে সিক্সথ গ্রেড—কী মজাতেই না কেটেছিল! জায়গাটা ছিল ভারি সুন্দর! সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা চারদিক, বড়ো বড়ো গাছ, মস্ত বড়ো আকাশ!

তারপরই বাবার নতুন চাকরি হল নিউ জার্সিতে। নিউ জার্সি এই আমেরিকার নাকি ‘গার্ডেন স্টেট’! ধুস! কোথায় কী! এই জায়গা একেবারেই আলাদা। চারদিকে বড়ো বড়ো বিল্ডিং। গাছপালা খুব কম—যাও-বা ছিল, আরও বিরাট বিরাট বাড়ি হচ্ছে গাছ কেটে কেটে। আসলে নিউইয়র্ক শহরের খুব কাছে এই জায়গাটা। ম্যানহ্যাটন মাত্র আধঘণ্টা দূরে। তাই প্রচুর লোক। বাবা অবশ্য বলেন, নিউ জার্সির উত্তরটা এমন নয়, কিন্তু তুয়া এখনও দেখে ওঠেনি সে-জায়গা।

এখানে সবই অন্যরকম। বড়ো শহর, ছাত্রছাত্রীদের সবারই প্রায় গ্ৰুপ আছে। ইন্ডিয়ান অনেক, কিন্তু বিভিন্ন স্টেটের ছেলেমেয়েরা নিজের নিজের ভাষার ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বেশি মেশে। অন্যান্য দেশের বন্ধুও তাদের আছে, কিন্তু সকলেই সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে একসঙ্গে পড়ছে, তাই নতুন কাউকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। খেলাধুলোর জন্যে দু-একজন অন্য সেকশনের ছেলেমেয়ের সঙ্গে চেনাশোনা হয়েছে তুয়ার, কিন্তু নিজের সেকশনে একটাও বন্ধু নেই। সবাই নম্বর, গ্রেড, পড়াশোনা নিয়ে খুব আলোচনায় মত্ত সারাক্ষণ। তুয়ার মা-বাবা অত চাপ দেন না, মোটামুটি ভালোই করে ও ক্লাসে, কিন্তু ক্লাসে বাকিদের রকমসকম দেখে একটু ভয়-ভয়ই করে। তাই এককোণে চুপচাপ বসে থাকে। হোমওয়ার্ক জমা দেয়, ক্লাসওয়ার্ক করে মন দিয়ে, ব্যস ওটুকুই। ক্লাস চলাকালীন অতটা কষ্ট হয় না। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগে লাঞ্চ ব্রেকে। একঘণ্টা সময় যেন একা একা কাটতেই চায় না। তাও যতদিন ঠান্ডা ছিল না একরকম ছিল। মাঠে যেত, দোলনা চড়ত, কিন্তু এখন এই দুর্দান্ত শীতে চারদিক যখন বরফে সাদা; একা একা তুয়ার ভীষণ কান্না পায়।

লাঞ্চ ব্রেকে ক্যাফেটেরিয়ার এককোণে বসল তুয়া। এই সময় অন্যদিন বই পড়তে পড়তে ও টিফিন খায়। আজ মা আর টিফিন বানিয়ে দিতে পারেননি। ওদের স্কুলে অবশ্য লাঞ্চ কিনে খাওয়া যায়, পয়সাও মা দিয়ে রেখেছেন, কিন্তু বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে তুয়ার লাঞ্চ কিনতে ইচ্ছে করল না। একটা চিপসের প্যাকেট বেরোবার সময় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিল, সেটা নিয়েই লাইব্রেরির দিকে পা বাড়াল।

লাইব্ৰেরি এ-সময় মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। সামনের টেবিলে কিছু উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা প্রজেক্টের আলোচনা করছে, তুয়া ভেতরের দিকে ঢুকে এল। স্কুলের চারপাশে যে গাছগুলো এখনও অবশিষ্ট আছে তারা এখন ন্যাড়া মানে পাতা নেই একটাও। তাই লাইব্রেরির এই পেছন দিকটা থেকে অনেক দূরের উত্তরের পাহাড়গুলো এখন স্পষ্ট দেখা যায়। এখানটায় বসতে তুয়ার ভারি ভালো লাগে। বাইরে বরফে রোদ্দুর পড়ে ঝলমল করছে। কয়েকটা পাখি ঘুরছে এদিক ওদিক। নতুন বাড়ির চারধারে কোনও পাখি দেখতে পায়নি তুয়া আসার পর। অথচ আগের বাড়িতে পেছনের বাগানে কত পাখি আসত—বাবা আর মা বই ঘেঁটে ঘেঁটে সব পাখিদের নাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন তুয়াকে। লাল কার্ডিন্যাল, নীল ব্লু জে—আরও কত কত! সারা শীতকাল বাগানে বার্ড ফিডার মানে পাখিদের খাবার ভরা বাক্সের মতো জিনিস ঝোলানো থাকত নানারকম দানা ভরে ভরে। সূর্যমুখীর বীজ, নানারকমের বাদামের টুকরো, নাম না জানা শস্যদানায় ভরা থাকত সেগুলো। পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে কাঠবিড়ালিরাও ল্যাজ তুলে খেত।

স্ন্যাক্সে বাদাম আর সূর্যমুখীর বীজ নিয়ে আসে তুয়া বেশি করে। রোজ যখনই লাইব্রেরিতে আসে; এই পেছনের দিকের জানালার কাচটা একটুখানি তুলে কয়েকটা বাদাম আর সূর্যমুখীর বীজ ছুড়ে দেয় পাখিদের। বরফের ওপরেই ওরা খুঁটে খুঁটে খায়।

খিদে পেয়েছিল খুব। তাড়াতাড়ি করে চিপসের প্যাকেটটা শেষ করে ডাস্টবিনে ফেলে বই দেখতে শুরু করেছিল তুয়া লাইব্রেরির তাকের সামনে দাঁড়িয়ে।

কাণ্ডটা ঘটল একটা সরুমতো বই টানতে গিয়ে। পাশের মোটা বইটা ডিগবাজি দিয়ে যেন হুমড়ি খেয়ে তুয়ার বাঁহাতের ওপর পড়ল। তাড়াহুড়ো করে ধরতে গিয়ে আটকাতে তো পারলই না, বরং বইটার একটা পাতা রয়ে গেল ওর হাতে আর বইটা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল।

কী হবে এবার? লাইব্রেরিয়ান নিশ্চয়ই খুব বকাবকি করবেন, ফাইন দিতে হবে, নাকি বইটা কিনে দিতে হবে? আচ্ছা, পাতাটা সাবধানে বইতে ঢুকিয়ে নিয়ে যদি বাড়ি থেকে আঠা লাগিয়ে আনা যায়—কিন্তু ঠিকঠাক জুড়বে কি?

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ বইয়ের ছেঁড়া পাতাটা প্রপেলারের মতো ঘুরতে শুরু করে দিল, আর কিছু বোঝার আগেই কোথায় লাইব্রেরি, কোথায় ছেঁড়া বই আর কোথায় কী—তুয়ার চারদিকে এখন শুধু সবুজ, সামনে বড়ো বড়ো বোল্ডারে ধাক্কা খেয়ে কুলু কুলু বয়ে চলেছে নদী, কত ফুল আর মৌমাছি, ভ্রমর—নানান সুরে পাখিরা ডাকছে।

মাথাটা ভনভন করছে। যদিও প্রথমটায় এমন সুন্দর জায়গা দেখে মন ভালো হয়ে গেছিল, কিন্তু একটু পরেই তুয়ার খুব ভয় করতে শুরু করল।

তবে কি এটাই স্বর্গ? এই নদী কি মন্দাকিনী—দিম্মা যার গল্প বলে! এত সুন্দর জায়গাও এখন মনে হচ্ছে বিশ্রী। স্বর্গে আসা মানে তো আর কোনোদিন মা, বাবা, দিম্মা কাউকে দেখতে পাবে না—একথা ভেবেই তুয়া ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

পিঠে কার হাত! চমকে উঠল তুয়া। এ কি! এ যে এক পরি! ইনিই কি সিন্ডারেলার পরি? তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল তুয়া। এঁর নিশ্চয়ই মনে দয়ামায়া আছে! জিজ্ঞেস করে দেখা যাক কীভাবে মায়ের কাছে ফেরা যাবে।

কিন্তু প্রশ্ন করতে গিয়েই থমকাল তুয়া। কোন ভাষায় কথা বলবে—ইংরিজি, না বাংলা?

না, দুটোতেই বলা যাক একে একে। ইংরিজি দিয়েই শুরু করল তুয়া।—“আপনি কি সিন্ডারেলার পরিরানি?”

তুয়াকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় পরি উত্তর দিল, “না, আমি ভুবনপরি।”

“ভুবনপরি? কিছু মনে করবেন না, এমন নামের পরি তো কখনও শুনিনি!”

“আমি এই ভুবনকে মানে পৃথিবীকে ভালো রাখার দায়িত্বে আছি, তাই আমার নাম ভুবনপরি! কিন্তু দিন দিন এত দৈত্য-দানো বেড়ে যাচ্ছে এই ভুবনে যে আমি আর সামলাতে পারছি না!”

“আমি কি কিছু অন্যায় করেছি বলে আপনারা আমাকে ধরে এনেছেন?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে তুয়া।

“না না! তোমাকে ধরে আনব কেন? আমাদের এই রাজ্যের পাখিরা তোমাকে ধন্যবাদ জানাবে বলে আবদার করেছিল, তাই আমি যাদুদণ্ড ঘুরিয়ে তোমায় আদর করে এখানে নিয়ে এলাম।”

আরে! বলতে না বলতেই কিচিরমিচির করে করে অনেক পাখি এসে তুয়ার চারদিকে হাজির। কয়েকটা ছাড়া প্রায় সব পাখিই তুয়ার চেনা। লাল টুকটুকে পুরুষ কার্ডিন্যাল পাশে পাটকিলে আর লাল রঙের তার গিন্নি, আর এক পাশে নীল রঙের বড়ো ব্লু জে, হলদে কালো গোল্ড ফিঞ্চ, ছাই রঙ আর চকচকে কালো মেশানো চিকাডি, খয়েরিরঙা শালিকের মতো চেহারার রবিন—সবাই হাজির। এরাই তো ওদের আগের বাড়ির বাগানে সবাই আসত!

ওমা! কী আশ্চর্য! ওদের সবকথা তুয়া বুঝতে পারছে যে!

“তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বন্ধু! তুমি আমাদের রোজ যে একটু একটু খাবার দাও, তাতে আমরা একটু শক্তি পাই।”

খাবার! ও হো, মনে পড়েছে। কিন্তু সে তো লাইব্রেরির জানালা থেকে ছোড়া একটুখানি দানা আর ক’টা বাদাম!

“ওইটুকুনি খাবারে কীই-বা হয় তোমাদের! আমি খুব দুঃখিত গো! আচ্ছা, এবার থেকে আমি বেশি করে খাবার নিয়ে আসব। তোমাদের কোথাও খাবার নেই না গো এই শীতকালে?”

ছোট্ট হলদে ফিঞ্চ বলে উঠল, “জানো তো, আমরা আর পারছি না। এই এলাকার সব গাছ কেটে, চারদিকে বিল্ডিং উঠছে—শীতে এমনিতেই খাবার থাকে না কোথাও, জল সব জমা। ঘাসও প্রায় নেই বললেই হয়। কী যে কষ্ট!”

ব্লু জের গলা বেশ খরখরে। খরখর করেই সে বলে ওঠে, “গাছের ভেতরে অনেক মরা পোকা বা তাদের শীতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া লার্ভা, শুকিয়ে যাওয়া ফল বা বীজ এইসব খেয়েই আমরা, চিকাডি, কাঠঠোকরা শীতকালটা কোনোরকমে কাটাতাম। এখন তো গাছও কেটে দিচ্ছে। উত্তরের দিকে অনেক সবুজ, আমাদের মন হয় পাততাড়ি গুটিয়ে ওদিকেই উড়ে যেতে হবে।”

রবিন পাখির গলাটা বড়ো মিষ্টি। নরম গলায় সে বলে, “এই শীতে আমাদের কী যে কষ্ট! দুর্বল হয়ে গেছি, জানি না বসন্ত আসা অবধি আর বেঁচে থাকব কি না। ঘাসের দানা খেয়ে থাকি, সেই ঘাসই উধাও! তোমার দেওয়া খাবার আমরা ভাগাভাগি করে খেয়েছি।”

তুয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। আহা রে! কীই-বা করতে পারে সে? বেশি করে খাবার না-হয় আনল, কিন্তু তাই-বা কতটুকু!

হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধির ঝিলিক।—“বন্ধুরা, আমি চেষ্টা করব আপ্রাণ বসন্তে যাতে তোমাদের গানে আকাশ ভরে যায়।”

ভুবনপরি এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিল। এখন বলে ওঠে, “তোমরা ছোটোরাই তো আমাদের ভরসা!”

***

“এই যে মেয়েটার ছবি কাগজে বেরিয়েছে, খুব চেনা চেনা লাগছে রে। দ্য ফেস লুকস ফ্যামিলিয়ার। কে এই প্রকৃতি বাসু?”

“অহ্‌ অর্ণব, রিপোর্টার লিখেছেন, এই স্কুলেই সেভেনথ গ্রেডে পড়ে। কে জানে! আমাদের সেকশনের নয় শিওর!”

সারা আর অর্ণবের কথা শুনে তুয়া হুডিটা আর-একটু মুখের ওপর টেনে নিল। থাক, ছ’মাসে যখন জানেনি, আর জেনে কাজ নেই ওদের কে প্রকৃতি বসু। তবে এ একরকম ভালোই হয়েছে। ক্লাসের বন্ধু ছিল না বলেই তো ওর আজ এত মিতে! ঠাকুমার যে মা, বড়মা বন্ধু না বলে বলেন মিতে। খুব মিষ্টি লাগে শব্দটা তুয়ার।

ক্লাসের কেউ তো বন্ধু করে নেয়নি ওকে, তাই চিনতে পারছে না। প্রকৃতি বসু বলে একটা মেয়ে যে নতুন ক্লাসে এল—সেই সেপ্টেম্বর থেকে আজ মার্চের মাঝামাঝি—কেউ প্রায় জানেই না, আসলে জানতে চায় না। আগে চোখ উপচে জল আসত তুয়ার। এখন সেসব অতীত।

দু’মাস আগের সেই লাইব্রেরির ঘটনাটার পর জীবনটাই যেন পালটে গেছে তুয়ার। আজও কেমন অবাক লাগে যেন। লাঞ্চ ব্রেকের সাইরেন বাজতেই সংবিৎ ফিরে পেয়েছিল ও। কোথায় কী! ও তো লাইব্রেরিতেই! সামনে পড়ে পাতা ছেঁড়া বইটা। পাতাটা হাতেই ধরা। বইটা নিয়ে লাইব্রেরিয়ানকে দেখাতে গিয়ে তুয়া দেখেছিল, ওটা একটা পাখিদের ডিকশনারি।

লাইব্রেরিয়ান বকেননি। হেসে বলেছিলেন, “ইটস অ্যান অ্যক্সিডেন্ট হানি! ভয় পাচ্ছ কেন?”

আঠা দিয়ে দিয়েছিলেন পাতাটা জোড়ার জন্যে। তুয়া বইতে আঠা লাগিয়েই ছুট্টে একবার জানালার কাছে গেছিল। পাখিরা তখনও খুঁটে খুঁটে ওর ছড়ানো দানা আর বাদাম খাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে ব্লু জে দেখল কি একবার?

সারাক্ষণ কানে বাজছিল পাখিদের সেই কষ্টের সংলাপ।

বাড়ি এসে দেখেছিল মায়ের জ্বর সেরে গেছে। খুশি মনে গুগল ঘেঁটে অনেক তথ্য বের করেছিল। সত্যি সত্যি পাখিদের শীতকালে খুব কষ্ট। খাবার না পেলে ওদের শরীরের তেল শুকিয়ে যায়, তাই পালক যায় খসে; পালক কমে গেলে শীত আটকাবার ক্ষমতা কমে যায়। তারপর সারা শীতে খেতে না পেয়ে দুর্বল হয়ে যাবার জন্যে বসন্তে বাসা বাঁধার শক্তি থাকে না তেমন, ফলে ছানাপোনাও কমে যায়। এই করে করে এদিকে পাখি অনেক কমে গেছে।

তুয়া অবাক হয়ে দেখেছিল, ওর মাথায় যে বুদ্ধি খেলেছিল সেরকম ধরনের সমাধান বাতলেছেন পক্ষিবিদরাও। তবে অনেক বড়ো মাত্রার। ও ভেবেছিল ওদের অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় ঝোলাবে দু-তিনরকমের বার্ড ফিডার। কিন্তু এখন বুঝছে, শুধু একলা করলে তো হবে না, আরও অনেককে এগিয়ে আসতে হবে।

ওদের বিল্ডিংয়ের ভারতীয়দের অ্যাপার্টমেন্টগুলো থেকেই শুরু করেছিল প্রথমে। মা একটু বলে দিয়েছিলেন সবাইকে। তুয়া চার্ট বানিয়ে, সুন্দর করে বুঝিয়েছিল সবাইকে। প্রতিবেশীরা সবাই বলেছিলেন, “আরে! ভাগ্যিস তুমি বললে! এ তো করতেই পারি! কিন্তু পাখির খাবার পাব কোথায়?”

তুয়া জানিয়েছিল—“সব গ্রসারি স্টোরে পাবেন, অনলাইন অর্ডার দিয়েও আনাতে পারেন।”

পুরোপুরি একশোভাগ সফল হয়েছিল তুয়া। শুধু ভারতীয়রাই নয়, দেখাদেখি বাকি বাসিন্দারাও বারান্দায় পাখির খাবার রাখতে শুরু করলেন। আর তুয়ার দলে ভিড়ে গেল অ্যাপার্টমেন্টের ছোটোবড়ো সব বাচ্চারা। সব বাবা-মায়েরা মিলেই নানারকমের ভাবনা-চিন্তা করে স্থির করেছিলেন যে শুধু এই একটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়েই নয়, আশেপাশের মানুষকেও সচেতন করতে হবে।

লোকাল লাইব্রেরির হলে ওরা একটা একজিবিশন করল। তাতে বাচ্চারা নানান ধরনের বার্ড ফিডারে রঙ করে তারপর আঁকল কতরকমের ডিজাইন। নানা ধরনের পাখির ছবি ক্যানভাসে এঁকে পাশে পাশে বাটিতে রাখল তাদের খাবার। এক আঙ্কল ফ্লায়ার বানিয়ে বেশ কিছু কপি প্রিন্ট করে দিলেন। স্কুলের পর লাইব্রেরিতে গিয়ে তুয়া আর বাকি বাচ্চারা সেগুলো লাইব্রেরিতে আসা লোকজনের হাতে বিলোতে লাগল।

মোটামুটি ভালোই প্রচার হল। একজিবিশনের দিন তো ওরা অবাক! ভাবতেই পারেনি এত মানুষ আসবেন। এমনকি লোকাল সংবাদপত্রের রিপোর্টারও এসে হাজির। যদিও তুয়া একদমই রাজি ছিল না ছবি বা ইন্টারভিউ দিতে। কিন্তু সবাই বললেন যে শুরুটা তো তুয়াই করেছে, তাই স্বীকৃতি ওর অবশ্যই পাওয়া উচিত, তখন ওর খুব লজ্জা করছিল।

আজ সেটা নিয়েই সারা আর অর্ণব কথা বলছে। থাক, ওদের আর জানতে হবে না কে প্রকৃতি বসু।

ক্লাসের বেল পড়তেই প্রিন্সিপাল আর ক্লাস টিচার ক্লাসে ঢুকলেন।—“প্রকৃতি বসু!”

তুয়া উঠে দাঁড়াতেই প্রিন্সিপাল জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নামের মানে ‘মাদার নেচার’ প্রকৃতি? দ্যাটস অ্যামেজিং! আমরা সত্যিই খুব প্রাউড যে আমাদের স্টুডেন্ট নতুন এসেই এমন এনভায়রনমেন্ট নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছে! আমরা ভেবেছি স্কুলে একটা বার্ড ক্লাব করব। প্রকৃতি, তোমাকে কিন্তু প্রেসিডেন্ট হতে হবে; ক্লাসের বন্ধুদের, বাকি ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করতে হবে।”

আরও কত কী বলে যাচ্ছেন প্রিন্সিপাল। তুয়া যেন কিছুই দেখছে না, কানেও আর কিছুই যেন ঢুকছে না। চোখ ভাসছে জলে আর কানে আসছে শুধু কিচিরমিচিরের কনসার্টের সঙ্গে শিস দিয়ে গান। ক্লাসে বন্ধু না থাকলেও তুয়ার আর এখন একটুও দুঃখ নেই।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a comment