লোককথা-টিম্মার দুরন্ত অভিযান –রাখি পুরকায়স্থ-শীত ২০২২

এই লেখকের আগের লোককথা- বুড়ি ও শূকরের গল্প, আইওই বৃক্ষের কিংবদন্তি

GOLPOTIMMA01

টিম্মা একজন পাখিওয়ালা। সকলে তাকে টিম্মা পাখিওয়ালা বলেই ডাকে। বনে-জঙ্গলে ফাঁদ পেতে পাখি ধরে টিম্মা। তারপর হাটে-বাজারে গাঁয়ে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে পাখি বেচে। এতে যা আয় হয় তা দিয়েই টেনেটুনে দিন গুজরান হয় তার।

রোজকার মতো একদিন সকালে বনে গিয়ে ফাঁদ পাতল টিম্মা। তারপর যথারীতি একটা মোটা গাছের গুঁড়ির পেছনে লুকিয়ে বসে রইল। তার নজর অবশ্য আটকে ছিল ওই ফাঁদের দিকেই। সময় বয়ে যাচ্ছিল। আকাশছোঁয়া উঁচু গাছপালার ঘন ডাল-পাতার ফাঁক গলে নেমে আসছিল রোদের নরম হলদে আলোর স্রোত, ভেসে যাচ্ছিল বনভূমি। একসময় সূর্য মধ্যগগন ছাড়িয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়তে লাগল ধীরে ধীরে। টিম্মা বুঝতে পারছিল, ওর ভাগ্যের শিকে সেদিন ছিঁড়বে না সহজে, নইলে সারাদিনে একটাও পাখি এসে ফাঁদে ধরা দিল না কেন!

দিনের আলো কমে আসছিল দ্রুত। সুজ্জি পাটে যেতে বসেছে। হয়তো খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হবে টিম্মাকে। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল তার। একটানা অপেক্ষা করতে করতে সে যখন প্রায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে, ঠিক তক্ষুনি কোথা থেকে একখানা টিয়াপাখি উড়ে এসে ফাঁদে পড়ল। বর্ষার জলে ভিজে-নেয়ে বন-জঙ্গলের তরতাজা গাছপালার রঙ ঠিক যেমনটা হয়ে ওঠে, টিয়াপাখিটার রঙ তেমনই কলাপাতা-সবুজ। টুকটুকে লাল ঠোঁট পাখিটির, গলাতেও যেন একখানা লাল ফিতে বাঁধা।

অবাক টিম্মা আপন মনেই বলে উঠল, ‘কী আশ্চর্য! টিয়াপাখি! কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছি আজ!’ তারপর তড়িঘড়ি ছুটে গেল ফাঁদের দিকে। কিন্তু যেই না সে টিয়াপাখিকে খাঁচায় পুরবে বলে দু-হাত বাড়িয়েছে, অমনি সে-টিয়াপাখি মানুষের গলায় মিনতি করে উঠল, “দয়া করে আমায় ছেড়ে দাও বন্ধু!”

টিম্মা চমকে উঠল—“ওমা, সে কি! তুমি কথা বলতে পার?”

পাখি তার ছোট্ট মাথাটা একপাশে হেলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তোমাদের ভাষায় কথা বলতে পারি তো আমি।” তারপর জালে জড়ানো ডানা দুটো ঝাপটে বলল, “বিশ্বাস করো বন্ধু, আমায় মুক্তি দিলে তোমার মঙ্গল হবে।”

টিম্মা হেসে বলল, “আমায় কি বোকা পেয়েছ? ফাঁদে পড়া পাখি ছেড়ে দিলে আমি খাবটা কী? হাটে-বাজারে পাখি বেচেই তো আমার দু-বেলা দু-মুঠো জোটে। তোমায় মুক্তি দিলে আমার চলবে?”

টিয়াপাখি চুপ করে রইল। খানিক পিটপিট করে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে টিয়াপাখির দু-চোখ ভরে উঠল জলে।

পাখিওয়ালা হলে কী হবে, টিম্মার মনটা খুব নরম। বড্ড মায়া হল তার পাখিটার জন্যে। “আহা, অমন করে কেঁদো না তো সবুজ বন্ধু, আমি তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি।” এই বলে টিয়াপাখিটাকে উড়িয়ে দিল টিম্মা।

উড়ে যেতে যেতে টিয়াপাখি বলে গেল, “এখানে আর-একটু সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো বন্ধু। দেখোই না কী হয়!”

ততক্ষণে সূর্যের আলো প্রায় নিভে এসেছে। গগনচুম্বী ঘন গাছেদের ডালে ডালে ফিকে অন্ধকার ক্রমেই জমাট বেঁধে মিশকালো হচ্ছে। টিম্মা কিন্তু টিয়াপাখির কথা শুনে বনেই থেকে গেল। চুপচাপ বসে রইল সেই গাছের গুঁড়িটার পেছনে। কিছুক্ষণ বাদেই বেলাশেষের নিভু নিভু আলোয় সে দেখতে পেল এক অবাক করা দৃশ্য। কোত্থেকে একটা তোতাপাখি হঠাৎ উড়ে এসে পড়ল ফাঁদের জালে! আধো-অন্ধকার ছেয়ে আসা আলতো আলোতেও টিম্মা স্পষ্ট দেখতে পেল, তোতাপাখিটার সারা শরীরে রামধনুর সাত রঙের ঝিলিক। কেন যেন টিম্মার মনে হল, পাখিটা ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছে।

তা সে যাই হোক না কেন, টিম্মা কিন্তু বেজায় খুশি হল। তোতাপাখিটাকে যত্ন করে ভরে নিল খাঁচায়। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি ফিরবার পথে সে মনে মনে ভাবল, ‘এমন আশ্চর্য পাখি কেবলমাত্র রাজপ্রাসাদেই মানায়। রাজামশাইকে পাখিটা দিলে তিনি নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন। রাজরাজড়ার মেজাজ-মর্জি বলে কথা, সন্তুষ্ট হলে আমাকে শুধু টাকাকড়ি কেন, কাঁড়ি কাঁড়ি সোনাদানাও দিয়ে দিতে পারেন।’

ভবিষ্যতের অপার সুখ-স্বাছন্দ্যের কথা কল্পনা করে টিম্মার মনপ্রাণ আনন্দে নাচতে লাগল। রাতে বিছানায় শুয়ে উত্তেজনায় দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না সে। ভোর হতেই টিম্মা সোজা পৌঁছে গেল রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের সামনে। তার সঙ্গে বাঁশের খাঁচায় ভরা সেই সাতরঙা তোতাপাখি।

বহুক্ষণ ধরে কাকুতিমিনতি করাতেই হয়তো বল্লমধারী তাগড়াই দ্বাররক্ষীদের পাষাণ হৃদয় খানিকটা বিগলিত হয়েছিল, তাই তারা টিম্মাকে রাজপ্রাসাদ চত্বরে ঢুকতে দিল। কিন্তু রাজসভায় ঢুকতে পারা কি আর এতই সহজ! যেই না টিম্মা রাজসভার দরজার সামনে এসে পৌঁছেছে, অমনি মন্ত্রীমশাই এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। সামনে ঝুঁকে মন্ত্রীমশাইকে নমস্কার জানাল টিম্মা। তারপর বিনীত কণ্ঠে অনুরোধ করল, “হুজুর, আমি একবারটি মহারাজের দর্শন পেতে চাই। দয়া করে আমায় রাজসভার ভেতরে যেতে অনুমতি দিন।”

“মহারাজ এখন খুব ব্যস্ত। যার-তার সঙ্গে দেখা করবার সময় নেই তাঁর।” পাখিটার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে গম্ভীর কর্কশ গলায় উত্তর দিলেন মন্ত্রীমশাই।

“ঠিক আছে হুজুর। দয়া করে যদি বলেন কখন এলে তাঁর দর্শন পেতে পারি?।” কাতর গলায় জানতে চাইল টিম্মা।

ঘৃণা-মাখা দৃষ্টিতে টিম্মার মাথা থেকে পা অবধি দ্রুত মেপে নিলেন মন্ত্রীমশাই। তারপর রুক্ষভাবে বললেন, “তোমার আস্পর্ধা দেখে আমি তাজ্জব বনে যাচ্ছি। কোথা থেকে একটা তোতাপাখি বগলদাবা করে চলে এসেছ মহারাজকে বিরক্ত করতে! স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, সামান্য এক পাখিওয়ালার সঙ্গে মহারাজ কখনোই দেখা করবেন না। শিগগির দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে।”

হাতে ধরা বাঁশের খাঁচাটা খানিকটা ওপরে তুলে ধরে টিম্মা নরম গলায় বলল, “আমি এই আশ্চর্য পাখিটা মহারাজকে দেখাতে এসেছিলাম।”

মন্ত্রীমশাই এবার খেঁকিয়ে উঠলেন, “পাখি দিয়ে মহারাজ করবেনটা কী, শুনি? বাজারে যাও, সেখানে অনেক খদ্দের জুটবে।”

“বিশ্বাস করুন মন্ত্রীমশাই, এমন আশ্চর্য পাখি এ-রাজ্যে কেন, কেউ কোত্থাও দেখেনি।”

ঠিক সে-সময় রাজদরবারের বাইরে বেরিয়ে এলেন রাজামশাই স্বয়ং। হাসিমুখে এগিয়ে এলেন টিম্মার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললে তুমি, আশ্চর্য পাখি? কই, দেখাও তো!”

রাজামশাইয়ের প্রশ্রয় পেয়ে টিম্মা তো আহ্লাদে আটখানা। খাঁচাখানা মহারাজের সামনে তুলে ধরে সে বলল, “নমস্কার মহারাজ, আপনার জন্যেই এনেছি এই আশ্চর্য তোতাপাখি।”

পাখি দেখে শিশুর মতো উল্লসিত হয়ে উঠলেন রাজামশাই। চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে বললেন, “এ কী দেখছি! তোতাপাখির গায়ে যে রামধনুর সাত রঙ খেলে বেড়াচ্ছে!”

উৎসাহ পেয়ে টিম্মা বলল, “এ তো যে-সে পাখি নয়, মহারাজ। এ হল গিয়ে সাতরঙা তোতাপাখি।”

রাজামশাই খুশি হয়ে বললেন, “তা, এই পাখি কথা-টথা বলবে তো?”

“আজ্ঞে মহারাজ, শেখালে নিশ্চয়ই মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারবে।” সবিনয়ে উত্তর দিল টিম্মা।

“সে তো বুঝলাম, কিন্তু শেখাবে কে?” রাজামশাইকে খানিকটা চিন্তিত দেখাল। তারপর উৎসুক মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি পারবে শেখাতে?”

“নিশ্চয়ই পারব মহারাজ। তবে পাখিকে কথা বলতে শেখানো বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ। তাই আপনি যদি দয়া করে কিছু সময় দেন তো ভালো হয়।” টিম্মার চোখে-মুখে উৎসাহ।

রাজামশাই খুশি হয়ে মন্ত্রীকে বললেন, “মন্ত্রীমশাই, পাখিওয়ালাকে আপাতত একশত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দিন, আমি এই সাতরঙা তোতাপাখিটা কিনলাম।” তারপর টিম্মার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “পাখিওয়ালা, তোমার নাম কী?”

“মহারাজ, এ অধমের নাম টিম্মা।”

রাজামশাই বললেন, “তাহলে শোনো টিম্মা, এই তোতাপাখিটা আপাতত তোমার কাছেই থাক। পাখিটা যখন ঠিকমতো কথা বলতে শিখবে, তখন আমায় দিয়ে যেও। কেমন?”

“মহারাজের আদেশ শিরোধার্য। আমি আজ থেকেই পাখিকে মানুষের ভাষায় কথা বলা শেখাতে শুরু করব।” টিম্মার গলায় আনন্দ ঝরে পড়ছিল।

“কোনও অসুবিধে হলেই আমার কাছে চলে আসবে। ভয় নেই, কেউ তোমায় বাধা দেবে না।” রাজামশাই টিম্মাকে আশ্বস্ত করলেন।

কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ল টিম্মা; হাত জড়ো করে রাজামশাইকে নমস্কার জানাল।

রাজামশাই এবার মন্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, “শুনুন মন্ত্রীমশাই, আমি এখনি নির্দেশ জারি করছি, টিম্মার জন্যে রাজসভার দরজা সবসময় খোলা থাকবে। কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই ওর। যখন ইচ্ছে হবে তখন সে রাজসভায় আসবে।”

মুখে প্রতিবাদ না করলে কী হবে, মন্ত্রীমশাই কিন্তু মোটেই ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখছিলেন না। সব দেখেশুনে তিনি গজগজ করতে লাগলেন—“একটা তোতাপাখির দাম একশত স্বর্ণমুদ্রা! এভাবে চললে রাজকোষ শূন্য হতে বেশি দেরি নেই। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না, একটা সাধারণ পাখিওয়ালাকে কেন এত প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলছেন মহারাজ!”

এদিকে রাজামশাইয়ের কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়ে টিম্মা প্রায়ই তোতাপাখি নিয়ে হাজির হতে লাগল রাজসভায়। তোতাপাখি কতটুকু কথা বলা শিখল তা রাজামশাই ও সভাসদদের দেখিয়ে যেত। রাজামশাইও দেখেশুনে বেজায় খুশি হতেন। শুধুমাত্র মন্ত্রীমশাই-ই টিম্মাকে দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। সবার সামনে রাগ প্রকাশ করতে না পেরে একপাশে সরে গিয়ে বিড়বিড় করে বলতেন, ‘ওই যে আবার চলে এসেছে শয়তান পাখিওয়ালাটা। খেয়েদেয়ে কোনও কাজ নেই, তোতাপাখিকে কথা বলা শেখানো হচ্ছে। উফ্, কোত্থেকে যে এই আপদটা এসে জুটল! মহারাজের হাবভাব দেখেও বলিহারি যাই। এসব লোককে কখনও তোল্লাই দিতে আছে?’

একদিন সকাল সকাল টিম্মা তোতাপাখিটিকে সঙ্গে করে দৌড়ে এল রাজসভায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “মহারাজ, সুখবর। পাখি স্পষ্ট উচ্চারণে মানুষের ভাষায় কথা বলছে!”

তোতাপাখিও তক্ষুনি শরীরে সাত রঙের ঢেউ তুলে বলে উঠল, “মহারাজের জয় হোক! মহারাজের মঙ্গল হোক!”

রাজামশাই আনন্দের চোটে হাততালি দিয়ে উঠলেন। তারপর দ্রুত পায়ে রাজসিংহাসন থেকে নেমে এসে টিম্মার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “অসাধ্য সাধন করেছ টিম্মা!”

এমন সময় মন্ত্রীমশাই আচমকা পাশ থেকে জোরে জোরে গলা খাঁকরে উঠলেন। তারপর চাপা কর্কশ গলায় বললেন, “মহারাজ, একটা জরুরি কথা ছিল।”

রাজামশাই বিরক্ত মুখে তাঁর দিকে তাকালেন। বললেন, “এখন কথা বলতে পারব না মন্ত্রীমশাই। দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমার এই বন্ধুটির সঙ্গে জরুরি কথা বলছি। আপনি না-হয় একটু পরে আসুন।”

মন্ত্রীমশাই যারপারনাই অপমানিত হলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে রাজসভা থেকে তৎক্ষণাৎ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তারপর নিজের কক্ষে প্রবেশ করেই ভীষণ রাগে ফেটে পড়লেন—“রাজামশাইয়ের আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচি না। একটা আকাট মুখ্যু পাখিওয়ালা কখনও প্রবল প্রতাপশালী মহারাজের বন্ধু হতে পারে? কস্মিনকালেও শুনিনি এমন আজব কথা! আর এই পাখিওয়ালাটার সঙ্গে অকেজো কথাবার্তা বলবার জন্যে আমাকে, রাজ্যের মন্ত্রীকে কিনা তাড়িয়ে দিতে হল?”

মন্ত্রীমশাই এই অপমান সহজে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক এর একটা বিহিত করতে হবে। টিম্মা পাখিওয়ালাকে এ-রাজ্য থেকে তাড়াতেই হবে। এমন জায়গায় ওকে পাঠাতে হবে যেখান থেকে ও হাজার চেষ্টা করলেও আর ফিরে আসতে পারবে না। মন্ত্রীমশাই জানেন, বুদ্ধিঃ যস্য বলং তস্য। তাই বুঝতে পারলেন, কেবল বুদ্ধি কাজে লাগিয়েই টিম্মা পাখিওয়ালাকে শায়েস্তা করা সম্ভব। কারণ, গায়ের জোর খাটিয়ে সবক্ষেত্রে সাফল্য মেলে না।

রাজামশাইয়ের বিশ্রামকক্ষের একপাশে সোনার খাঁচায় রাখা হয়েছে সাতরঙা তোতাপাখিকে। সোনার দাঁড়ে বসে রয়েছে পাখি, আর দুলে দুলে নানান মজাদার বলি আওড়ে চলেছে। পাখিকে খেতে দেওয়া হচ্ছে রঙবেরঙের সুস্বাদু ফল। তার দেখভালের জন্যে মোতায়েন করা হয়েছে একদল বিশ্বস্ত দাসদাসী। এতসব আয়োজন দেখেশুনে রাজামশাই ভীষণ আমোদিত ও মুগ্ধ।

ভালোয় মন্দে এভাবেই দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল। রাজামশাই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন রাজকার্য নিয়ে। ক্লান্ত অবসরে তোতাপাখির বুলি শুনে তাঁর মনপ্রাণ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

তেমনই একদিন দুপুরে রাজসভার কাজকর্ম মিটিয়ে পরিশ্রান্ত রাজামশাই ফিরে এসেছেন তাঁর বিশ্রামকক্ষে। গুরুভোজনের পর মখমলের সাদা চাদর বিছানো সোনার পালঙ্কে গা এলিয়ে দিয়ে সবে তিনি রূপার তবকে মোড়া একখানা সুগন্ধী মিষ্টি পান মুখে পুরেছেন। সামনেই সোনার খাঁচায় বসে রয়েছে সাতরঙা তোতাপাখি। থেকে থেকে বলে উঠছে, ‘মহারাজ দীর্ঘজীবী হোন’ ‘মহারাজের জয় হোক’—এমন আরও কত মজাদার কথা। রাজামশাই পান চিবোতে চিবোতে মুচকি হাসছেন। তাঁর হাসি দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, পাখির কথা শুনে শুনে খুশিতে তাঁর প্রাণমন কানায় কানায় ভরে উঠছে।

ঠিক এমন সময় বিশ্রামকক্ষের দরজা থেকে কার যেন গলা খাঁকরি দেওয়ার আওয়াজ এল। রাজামশাই তাকিয়ে দেখলেন, মন্ত্রীমশাই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রাজামশাইকে তাকাতে দেখে মন্ত্রীমশাই দ্বিধা জড়িত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “মহারাজ, আ-আসতে পারি?”

সোনার সুতোয় ফুল-পাতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নকশা তোলা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে তোতাপাখিকে দেখছিলেন রাজামশাই। মন্ত্রীমশাইয়ের দিকে আর না তাকিয়ে বিছানার পাশে রাখা গদি আঁটা চৌপায়াটি দেখিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, “আসুন মন্ত্রীমশাই। বসুন এখানে। বলুন, কী বলতে চান।”

আশ্বস্ত হয়ে মন্ত্রীমশাই চৌপায়াটিতে ধপ করে বসে পড়লেন। তারপর গদগদ গলায় বললেন, “মহারাজ, এ তোতাপাখি সত্যিই বড়ো আশ্চর্য পাখি। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই অপূর্ব তার বুলি। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, গোটা পৃথিবী তন্নতন্ন করে খুঁজলেও এর জুড়ি মিলবে না। সেই সঙ্গে এ-কথাটিও না বললে অন্যায় হবে, এমন আশ্চর্য সুন্দর পাখি কেবল আমাদের মহারাজের প্রাসাদেই শোভা পায়।”

রাজামশাই খুশি হয়ে বললেন, “সত্যি কথা বলেছেন মন্ত্রীমশাই। এমন পাখি আর দ্বিতীয়টি নেই। যে দেখছে সে-ই অবাক হয়ে যাচ্ছে।”

“পাখির সৌন্দর্য আর গুণ দুই-ই যে অতুলনীয় তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই মহারাজ। তবে একটা ব্যাপার ঠিক মানানসই হচ্ছে না, মনটা খুঁতখুঁত করছে। যেন সব হয়েও কী যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।” বলতে বলতে মন্ত্রীমশাইয়ের মুখখানা কালো হয়ে গেল।

রাজামশাই খুব অবাক হলেন।—“কী ব্যাপার মন্ত্রীমশাই? আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

মন্ত্রীমশাই কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, “মহারাজ, অভয় দেন তো বলি।”

“নির্ভয়ে বলুন। আপনার বক্তব্য শুনতে আমি আগ্রহী।” রাজামশাইয়ের কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ পড়ল।

“সত্যি কথা বলতে কী মহারাজ, এমন সাধারণ সোনার খাঁচায় এই অসাধারণ পাখিকে একেবারেই মানাচ্ছে না। তাছাড়া যে-কোনো সাধারণ রাজপ্রাসাদে গেলেই এমন সাধারণ সোনার খাঁচা চোখে পড়ে। আপনার সঙ্গে অন্য রাজ্যের মহারাজাদের কি তুলনা চলে? আপনি হলেন গিয়ে মহারাজাধিরাজ! তাই আপনার মানসম্মানের কথা ভেবেই কথাগুলো বলছি। ভুল কিছু বলে থাকলে আমায় ক্ষমা করবেন।” গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে মন্ত্রীমশাই বললেন।

“না না, আপনার আবার কী দোষ! আপনি তো ভালো কথাই বলছেন। তা, এ-বিষয়ে আপনার কী মতামত? সমাধান কী?” গম্ভীর গলায় রাজামশাই জানতে চাইলেন।

মন্ত্রীমশাই উৎসাহিত হয়ে বললেন, “মহারাজ, এই তোতাপাখির জন্যে এমন একখানা খাঁচা প্রয়োজন, যা দেখে রীতিমতো তাক লেগে যাবে সকলের। এমন কিছু বানাতে হবে যা পৃথিবীর কোত্থাও নেই।”

“আপনি কী যে বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না, যা বলবার স্পষ্ট করে বলুন।”

“মহারাজ, যাকে যেখানে মানায় তাকে সেখানেই রাখা উচিত। এ-পাখিকে কেবলমাত্র গজদন্তী মিনারেই মানায়।” মন্ত্রীমশাই ঝটপট উত্তর দিলেন।

“সে কি! গজদন্তী মিনার! তাও আবার তোতাপাখির জন্যে! অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন আপনি!” রাজামশাই যেন খানিকটা বিরক্তই হলেন।

মন্ত্রীমশাই শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “মহারাজ, আমি যদি ভুল কথা বলে থাকি, দয়া করে আমার দোষ মার্জনা করবেন। আমার কি আর আপনার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? তবে কী জানেন, এই পাখি তো আর যে-সে পাখি নয়, এ হল গিয়ে সাতরঙা তোতাপাখি। পৃথিবীতে এ-পাখি দুর্লভ। তাই বলছিলাম কী, এমন কথা-বলা রামধনু রঙের তোতাপাখি কেবল গজদন্তী মিনারেই শোভা পায়। তাছাড়া চোখ-ধাঁধানো কারুকাজ করা গজদন্তী মিনারের মধ্যে অমন কথা-বলা সাতরঙা তোতাপাখি দেখে দুনিয়ার সবাই তো আপনার নামেই ধন্য ধন্য করবে মহারাজ। সে-কথাটা ভুলে গেলে চলবে কেন?”

রাজামশাই চিন্তিত মুখে বললেন, “সবই তো বুঝলাম মন্ত্রীমশাই। আপনার কোনও কথাই ভুল নয়। তবে ব্যাপারটা তেমন সহজও নয়। গজদন্তী মিনার বানাতে প্রচুর হাতির দাঁত লাগবে। এত হাতির দাঁত পাব কোথায়? খুঁজে আনবেই-বা কে?”

মন্ত্রীমশাই হেসে বললেন, “আপনি অযথা চিন্তা করছেন মহারাজ। আমাদের বন্ধু টিম্মা পাখিওয়ালা তো আছেই। ও ঠিক পারবে হাতির দাঁত জোগাড় করে আনতে।”

“ঠিক বলেছেন, টিম্মা করিৎকর্মা লোক। ও ঠিক পারবে এই অসাধ্য সাধন করতে। আপনি এখনই ওর সঙ্গে কথা বলুন।” রাজামশাই এবার যেন খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করলেন।

নিজের কক্ষে গিয়েই টিম্মাকে ডেকে পাঠালেন মন্ত্রীমশাই। তলব পেয়ে ছুটে এল টিম্মা। মন্ত্রীমশাই তখন ঘরময় এদিক থেকে ওদিক লম্বা লম্বা পা ফেলে পায়চারি করছিলেন। টিম্মাকে দেখে থামলেন। বললেন, “এই যে টিম্মা, এসে পড়েছ? বেশ, বেশ।” তারপর কয়েক মুহূর্ত টিম্মার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললেন, “শোনো, একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তোমায়। মহারাজ ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, সাতরঙা তোতাপাখির জন্যে একখানা গজদন্তী মিনার তৈরি করাবেন। বুঝতেই পারছ, কী বিপুল পরিমাণ হাতির দাঁত লাগতে পারে! যাক গে, যে-জন্যে তোমায় ডেকে আনা—হাতির দাঁত খুঁজে আনবার দায়িত্ব কিন্তু তোমার।”

টিম্মা চমকে উঠল।—”একসঙ্গে এত হাতির দাঁত আমি কোথায় পাব মন্ত্রীমশাই? আপনি তো ভালো করেই জানেন, হাজার চেষ্টা করলেও রাতারাতি কারও পক্ষেই এত হাতির দাঁত সংগ্রহ করা সম্ভব নয়!”

“ওসব আমি শুনতে চাই না। মহারাজ আদেশ করেছেন, হাতির দাঁত জোগাড় করে নিয়ে আসতে হবে তোমায়। মহারাজের আদেশের ওপর আর কোনও কথা হতে পারে না।”

টিম্মা হাত নেড়ে কী যেন একটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সে কিছু বলে উঠবার আগেই মন্ত্রীমশাই চেঁচিয়ে বললেন, “চুপ! আর কোনও কথা নয়। এখনই রওনা হও। ও হ্যাঁ, মনে থাকে যেন চার সপ্তাহ সময় দিলাম। আশা করি বুঝতে পারছ, খালি হাতে ফিরে এলে তোমার মুণ্ডুটি আর ধড়ের ওপর থাকবে না।” ক্রূর হাসি হাসলেন মন্ত্রীমশাই।

টিম্মা বেচারা আর কী করে! হাতির দাঁতের সন্ধানে সে বেরিয়ে পড়ল। বলা ভালো, বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হল। তার কাঁধে একখানা লাঠি, লাঠির ডগায় একখানা ছোট্ট পুঁটুলি বাঁধা। পুঁটুলিতে সামান্য গুড়-চিঁড়ে বাঁধা রয়েছে। যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই হাঁটতে লাগল টিম্মা। আসলে তো সে জানেই না কোথায় পাওয়া যাবে এত হাতির দাঁত, তাই বলতে গেলে একপ্রকার নিরুদ্দেশের পথেই হাঁটছিল সে।

রাজ্যের সীমানা পেরোতেই বন। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় টিম্মার পা দুটো আর চলতে চাইছিল না। তাই একটা বড়ো আশ্বত্থগাছের নীচে বসে পড়ল সে। চিঁড়ে-গুড় খাবে বলে যেই না সে পুঁটুলি খুলতে যাবে ঠিক সে-সময় ওপর থেকে কে যেন বলে উঠল, “বন্ধু, তোমায় বড্ড চিন্তিত দেখাচ্ছে। কী হয়েছে বলবে আমায়?”

চমকে উঠে ওপরের দিকে তাকিয়ে টিম্মা দেখল সেই কলাপাতা রঙের টিয়াপাখিটা বসে আছে অশ্বত্থগাছটার একখানা ডালে। সে যারপরনাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী আশ্চর্য! তুমি এখানে কী করছ সবুজ বন্ধু?”

টিয়াপাখি ফিক করে হাসল। তারপর বলল, “তুমি আমাকে হাসালে বন্ধু। বনে এসে বনের পাখিকেই কিনা জিজ্ঞেস করছ, সে এখানে কী করছে! সে যাক, এবার খুলে বলো তো শুনি কী হয়েছে তোমার।”

টিম্মা আগাগোড়া সবটুকু টিয়াপাখিকে জানাল। বলল, “আমার পক্ষে এত হাতির দাঁত সংগ্রহ করা অসম্ভব। এদিকে আবার মন্ত্রীমশাই বলেছেন, খালি হাতে রাজ্যে ফিরে গেলে আমার নাকি গর্দান যাবে। মহা মুশকিলে পড়েছি গো আমি!”

সব শুনে টিয়াপাখি বলল, “একটুও চিন্তা কোরো না বন্ধু। আমি তোমায় একখানা দারুণ উপায় বাতলে দিচ্ছি। আমি এখন তোমায় যা-যা বলব, ঠিক তাই তাই করবে। কেমন?”

টিম্মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

টিয়াপাখি এবার ফুড়ুৎ করে নেমে এল টিম্মার সামনে। বলল, “শোনো মন দিয়ে। বনের পুবদিক বরাবর সোজা হাঁটবে। একটু হাঁটলেই দেখবে বন ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। তা দেখে তুমি আবার অন্যদিকে চলে যেও না, একই দিকে সোজা হাঁটতে থাকবে। যেতে যেতে একসময় তোমার চোখে পড়বে একটা বিশাল সরোবর। সেই সরোবরের জল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, মিছরির মতো মিষ্টি। হাতিরা সব দল বেঁধে আসে সে-সরোবরের জল পান করতে। সরোবরের আশেপাশে অনেক বড়ো বড়ো পাথর ছড়িয়ে পড়ে আছে। তুমি একটা পাথরের পেছনে চুপটি করে বসে হাতির দলের জন্যে অপেক্ষা করবে। ওরা এলে সুযোগ বুঝে হাতির রাজাকে তোমার বিপদের কথা জানাবে। বলবে, তাঁর সাহায্য পাওয়ার আশাতেই এত দূর এসেছ। বাকিটা হাতির রাজার মর্জি আর তোমার ভাগ্য। বুঝলে বন্ধু?”

টিয়াপাখির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে টিম্মা আবার হাঁটতে শুরু করল। টিয়াপাখি যেভাবে বলেছিল ঠিক সে-পথেই হাঁটছিল সে। কয়েকদিন বাদে টিম্মা এসে হাজির হল সেই বিশাল সরোবরের সামনে। সূর্য তখন একদম মাথার ওপর। সরোবরের জলের ওপরটা দেখে মনে হচ্ছিল কে যেন তা সোনার পাতে মুড়ে দিয়েছে। সেখানে ফুটে রয়েছে নীল-লাল-গোলাপি রঙের অগুনতি পদ্ম ফুল। তাদের ওপর উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙবেরঙের প্রজাপতি। তারই মাঝে একদল হাতি জলকেলি করছে। টিম্মা ঝটপট লুকিয়ে গেল একখানা বিরাট পাথরের পেছনে। লুকিয়ে লুকিয়ে হাতিদের দিকে নজর রাখতে লাগল।

কালচে সবুজ গাছপালার ওপরে সিঁদুরে রঙের গোল সূর্য যখন পশ্চিম আকাশকে রক্তিম করে তুলতে শুরু করেছে, ঠিক সে-সময় হাতিরা একে একে জল থেকে উঠে আসতে লাগল ডাঙায়। টিম্মা খেয়াল করল, এক বৃদ্ধ হাতিকে অন্যসব হাতিরাই মান্য করছে। সে-হাতিটি যেন গোটা হাতির দলটিকেই নিয়ন্ত্রণ করছে। টিম্মা বুঝতে পারল, ইনিই হলেন হাতিদের রাজা। সঙ্গে সঙ্গে এক ছুটে সেই বৃদ্ধ হাতির সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তারপর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।

“হে মহান হস্তীরাজ, দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন। কেবলমাত্র আপনিই পারেন আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে।” হাতির রাজার পা জড়িয়ে ধরে কাতর অনুরোধ জানাল টিম্মা।

“করছটা কী মানুষের পো? উঠে দাঁড়াও। কে তুমি? কী বিপদ তোমার?” টিম্মাকে অবাক করে দিয়ে হাতির রাজা মানুষের ভাষাতেই কথা বললেন।

তাঁকে সবকথা বিস্তারিত জানাল টিম্মা। শুনে হাতির রাজা বললেন, “বুঝলাম মানুষের পো। দেখি তোমায় কীভাবে সাহায্য করতে পারি। তবে আমিও কিন্তু তোমার কাছে সাহায্য চাই।”

টিম্মা রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, “আপনি মহাবলশালী, আর আমি হলাম গিয়ে নগণ্য মানুষ। আমার কাছে কিনা সাহায্য চান আপনি?”

“হ্যাঁ মানুষের পো, তোমার কাছেই সাহায্য চাইছি। মানুষের বুদ্ধি যে আমাদের চাইতে অনেক বেশি।”

টিম্মা বলল, “আপনাদের সাহায্যে আসতে পারলে আমি কৃতার্থ হব হস্তীরাজ। দয়া করে বলুন, কীভাবে সাহায্য করতে পারি।”

হাতির রাজা বললেন, “শোনো তবে। এই গভীর বনে একটা ভয়ংকর হিংস্র সিংহ থাকে। সে নিজেকে এ-বনের রাজা বলে দাবি করে। তাতে অবশ্য কোনও ক্ষতি ছিল না, যদি না সে যখন-তখন হাতিদের ওপর আক্রমণ করত। সমস্যাটা হল, আমরা কিছুতেই তার সঙ্গে লড়াইতে পেরে উঠছি না। ওর হাতে ইতিমধ্যেই বহু হাতির প্রাণ গিয়েছে। তুমি যদি সিংহটাকে এই বন থেকে তাড়িয়ে দিতে পার, আমরা হাতিরা একটু স্বস্তিতে বাঁচতে পারি। তারপর তুমি যা-যা চাইবে সব দেব তোমায়। আমার কথার নড়চড় হয় না।”

কথাগুলো বলে হাতির রাজা ধীরে ধীরে বনের গভীরে চলে গেলেন। অন্য হাতিরাও তাঁকে অনুসরণ করল। টিম্মা কিন্তু সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো। গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে। মহাপরাক্রমশালী সিংহের সঙ্গে কি কখনও যুদ্ধে জেতা সম্ভব? যে-সিংহ অনায়াসে একটি বিশালাকৃতির হাতিকে বধ করবার ক্ষমতা রাখে, সেই সিংহের সঙ্গে কিনা লড়বে এক সামান্য মানুষ! যুদ্ধে জেতা তো অনেক দূরের কথা, শেষমেশ নিজের পৈতৃক প্রাণটাই না খোয়াতে হয়! তবে কি খালি হাতেই ফিরে যেতে হবে?

এসব নানান প্রশ্ন টিম্মার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, কিন্তু আকাশপাতাল ভেবেও টিম্মা তার কোনও কূলকিনারা পেল না। এভাবে একটানা দাঁড়িয়ে থেকে একসময় তার খেয়াল হল, পিপাসায় গলা-বুক সব শুকিয়ে গিয়েছে। তাই জল পান করবে বলে সে এগিয়ে গেল সরোবরের দিকে। সরোবরের পাড়ে একখানা পাথরের ওপর বসে যেই না সে সরোবরের আয়নার মতো ঝকঝকে জলের ওপর ঝুঁকেছে, অমনি ওর মাথায় খেলে গেল এক দুর্দান্ত বুদ্ধি। মুহূর্তের মধ্যে টিম্মার চোখে-মুখে ফুটে উঠল আত্মবিশ্বাসের হাসি। সে আপন মনেই বলল, ‘সত্যি কথা, মানুষের বুদ্ধি সবচাইতে বেশি। কেবলমাত্র বুদ্ধি জোরেই আমি ওই হিংস্র সিংহটাকে জব্দ করব।’

সরোবরের জলে তৃষ্ণা মিটিয়ে টিম্মা তড়িঘড়ি উলটো পথ ধরে রওনা দিল।

কয়েকদিন পরেই সে আবার ফিরে এল সেই বনে। সঙ্গে করে নিয়ে এল দুখানা বিশাল মাপের আয়না। বনের মধ্যে ঘুরেফিরে সে এমন একটি সমতল খালি জায়গা বেছে নিল যার দু-দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি বিরাট পাথুরে টিলা। টিম্মা এবার আয়না দুটিকে পরস্পরের মুখোমুখি রেখে টিলা দুটির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করাল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, “বনের রাজাকে স্বাগত জানাবার জন্যে আমি প্রস্তত। এখন দেখা যাক কার ক্ষমতা বেশি—বুদ্ধির, না বলের!”

সময় বয়ে যাচ্ছিল। ধৈর্য ধরে সিংহের অপেক্ষা করতে লাগল টিম্মা। সিংহের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে সে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তাই সে মোটেই কোথাও লুকিয়ে পড়ল না, বরং আয়না দুটির মধ্যিখানের ফাঁকা জমিতে গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। সিংহের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তার মূল উদ্দেশ্য, তাই হেঁড়ে গলায় দু-এক কলি গানও ধরল।

অল্প কিছু সময় পরেই একটা বড়ো ঝোপের পেছন থেকে বেরিয়ে এল সে। কেশর ফুলিয়ে বিকট গর্জনে কাঁপিয়ে দিল আকাশপাতাল। মানুষের গন্ধ পেয়েছে বনের রাজা সিংহ। টিম্মা কিন্তু একটুও নড়াচড়া করল না। ওখানেই বসে বসে গলা ছেড়ে গান গাইতে লাগল যেন কিছুই দেখেনি, কিছুই হয়নি।

টিম্মার অমন নির্বিকার হাবভাব দেখে সিংহ অবাক হয়ে গেল। অপমানিতও হল খুব। সেও দিব্যি মানুষের ভাষায় হেঁকে বলল, “ওহে মানুষের পো, বড্ড সাহস বেড়েছে দেখছি তোমার। আমাকে দেখলে তাবড় তাবড় সিংহ শিকারির কালঘাম ছুটে যায়, আর তোমার দেখছি কোনও হুঁশই নেই! কোথায় পড়িমরি করে পালিয়ে নিজের সাধের প্রাণটি বাঁচাবে, তা নয়, ঠায় বসে রয়েছ! বোকা নাকি? আমায় দেখে ভয় লাগছে না তোমার?”

টিম্মা খুব জোরে হেসে উঠল। তারপর অতিকষ্টে হাসি সামলে বলল, “কে ভয় পাবে বললে? আমি? তাও আবার তোমায়? উফ্, দারুণ বলেছ! হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে যাচ্ছে।” এটুকু বলে টিম্মা আবারও অট্টহাস্য করতে লাগল। খানিক বাদে সামলে উঠে আবার বলল, “একটা সামান্য সিংহকে দেখে ভয় পাব আমি? কার সঙ্গে কথা বলছ কোনও ধারণা আছে তোমার? আমি একজন নামি সিংহ শিকারি। সারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যত সিংহ আছে, সবাই আমার নাম শুনলেই থরথর করে কাঁপে। হাজার হাজার সিংহকে জ্যান্ত ধরে খাঁচায় পুরেছি আমি। সে-খবর রাখ?”

সিংহ রাগে ফুঁসতে লাগল। সে বনের রাজা। তার সঙ্গে এমন বেয়াদপি করবার সাহস কেউ দেখায়নি আজ অবধি। তাই সে চোখ লাল করে মাটিতে পা ঠুকে হুংকার দিয়ে বলল, “মিথ্যেবাদী কোথাকার! ছোটো মুখে বড়ো কথা আমি একদম বরদাস্ত করতে পারি না! ভেবেছ আজগুবি গল্প ফেঁদে আমায় ভয় দেখাবে, তাই না? দাঁড়াও, আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন।”

“ঠিক আছে, আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না। এদিকে এসে নিজের চোখেই দেখে যাও না আমি কত সিংহকে খাঁচায় পুরে রেখেছি।” মিচকে হাসি হেসে আঙুল দিয়ে আয়না দুটিকে দেখাল টিম্মা।

সিংহ মুখে গরগর আওয়াজ তুলে বলল, “দেখছি দাঁড়াও!” তারপর টিম্মাকে লক্ষ্য করে দিল এক বিরাট লাফ। টিম্মা তখনও আয়না দুটির মধ্যেকার সমতল জমিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সিংহকে আচমকা লাফ দিতে দেখে সে বিদ্যুৎ গতিতে সরে গেল একদিকে। সিংহ গিয়ে পড়ল দুই আয়নার মাঝখানে। সামনের আয়নায় তাকিয়ে সে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে সে যা দেখল তাতে তার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালাবার জোগাড়। তার সামনে আর পেছনে রাখা আছে দুটি বিরাট লম্বাটে খাঁচা। দুটোতেই পোরা রয়েছে অগুনতি সিংহ! এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখলে কার না আতঙ্কে পাগুলো সব পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চায়? হোক না সে বনের রাজা, তাতে কী?

সিংহের করুণ দশা দেখে টিম্মা তো হেসেই কুটিপাটি। কষ্টেসৃষ্টে হাসি থামিয়ে সে বলল, “কী হে, তোমার বন্ধুদের দেখলে? যাবে নাকি ওদের কাছে? আহা, এত অস্থির হলে চলে? একটু সবুর করো, তোমাকেও শিগগিরি খাঁচায় চালান করব।”

ভয়ে-আতঙ্কে ঘেমে-নেয়ে সিংহ তখন একশা। টিম্মার কথা শুনে সে তীব্র আর্তনাদ করে উঠল, “না-আ-আ-আ!” তারপর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে লেজ গুটিয়ে দিল ছুট। তাকে পাগলের মতো ছুটে আসতে দেখে হাতিরা ভয় পেয়ে এদিক ওদিক দুড়দাড় করে পালাল। কিন্তু সিংহ তাদের দিকে ফিরেও চাইল না; পড়ি কি মরি করে ছুটতে লাগল বনবাদাড়-খানাখন্দ-নদীনালা পেরিয়ে। আসলে সিংহ ভালো করেই জানে, ‘য পলায়তি, স জীবতি’।

ততক্ষণে বৃদ্ধ হাতির রাজা এসে দাঁড়িয়েছেন টিম্মার সামনে। টিম্মা তাঁকে আভূমি প্রণাম করে বলল, “হস্তীরাজ, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। সিংহ ভুলেও আর এ-পথ মাড়াবে না। ও চিরকালের মতো এ-বন ছেড়ে পালিয়েছে। আপনারা নিশ্চিন্ত মনে এখানে বাস করুন।”

হাতির রাজা খুব খুশি হয়ে বললেন, “মানুষের পো, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। তোমার উপকারের কথা হাতিরা চিরকাল মনে রাখবে। আমরা কোনোদিনও তোমার এ-ঋণ শুধতে পারব না। তবু আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব তোমাকে সাহায্য করতে। এখন তুমি তাড়াতাড়ি চল আমার সঙ্গে।”

হাতির রাজা টিম্মাকে নিয়ে এলেন একটি গুহার সামনে। টিম্মা গুহার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল, সেখানে প্রচুর হাতির কঙ্কাল স্তূপীকৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

“সিংহটা এই গুহাতেই ঘাঁটি গেড়েছিল, বুঝলে মানুষের পো? এতদিন ধরে আমাদের যতজনকে সে মেরেছে সবার শেষ চিহ্ন এখানেই জমা রয়েছে। দেখো, অজস্র হাতির দাঁত পড়ে রয়েছে এখানে। সবটাই তোমার।”

সেই কঙ্কালের স্তূপ থেকে অনেক হাতির দাঁত বেছে নিল টিম্মা। তারপর সেগুলিকে আলাদা আলাদা গোছা করে বাঁধল। কিন্তু এত হাতির দাঁত যে তার একার পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। বড্ড অসহায় দেখাল টিম্মাকে।

টিম্মার মুখের ভাব হাতির রাজার চোখ এড়িয়ে যেতে পারল না। স্নেহমাখা গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার মানুষের পো, মুখ কালো করে বসে রয়েছ যে বড়ো?”

“হস্তীরাজ, হাতির দাঁত পেয়ে আমি আপনাদের কাছে চিরঋণী রইলাম। কিন্তু এত হাতির দাঁত আমি বয়ে নিয়ে যাব কী করে, কিছুতেই তা বুঝে উঠতে পারছি না।”

“ওহো, এই ব্যাপার? আমায় বলবে তো সে-কথা! কোনও চিন্তা নেই তোমার। আমার হাতির দল ঠিক জায়গামতো সব পৌঁছে দেবে।”

শুনেই একের পর এক হাতি সার বেঁধে সামনে এগিয়ে এল; আর হাতির রাজা নিজে সেই বোঝাগুলি চাপিয়ে দিতে লাগলেন তাদের পিঠে। সব বোঝা ঠিকমতো চাপানো হলে শুরু হল হাতিদের সারিবদ্ধ যাত্রা। আর সবার আগে টিম্মাকে পিঠে নিয়ে চললেন হাতির রাজা স্বয়ং।

দিন কয়েকের যাত্রা শেষে হাতিদের দল এসে থামল একেবারে রাজপ্রাসাদের সামনে। খবর পেয়ে রাজামশাই ছুটে এলেন টিম্মাকে স্বাগত জানাতে। টিম্মা হাতির পিঠ থেকে নামতেই রাজামশাই ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। টিম্মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “স্বাগতম, বন্ধু!”

সব দেখেশুনে মন্ত্রীমশাই তো হতবাক। কীভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করল টিম্মা! কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। তাঁর সব হিসেবনিকেশ যে এলোমেলো হয়ে গেল!

হাতির রাজা-সহ গোটা হাতির দলকে রাজামশাই অনেক আদর-আপ্যায়ন করলেন। কয়েকদিন পরে হাতিরা বিদায় নিল। রাজামশাই খুশি হয়ে ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে টিম্মা আমার রাজ্যের মাহুত সর্দার।”

বলাই বাহুল্য, টিম্মার পদন্নোতির খবর শুনে মন্ত্রীমশাই হিংসায় জ্বলতে লাগলেন।

রাজ্যে হাতির দাঁত এসে পৌঁছতেই গজদন্তী মিনার নির্মাণের তোরজোড় শুরু হল। ভিনদেশ থেকে আনানো হল বিখ্যাত সব শিল্পীদের। তাঁদের বহুদিনের প্রচেষ্টায় অবশেষে তৈরি হল এক অপূর্ব গজদন্তী মিনার। সে-মিনারের গায়ে চোখ জুড়নো ফুল-লতা-পাতার রঙিন কারুকাজ। সুদূর আকাশে গিয়ে মিশেছে মিনারের চুড়ো। সবশেষে ওই শ্বেতশুভ্র মিনারের ভেতরে যত্নে রাখা হল সাতরঙা তোতাপাখিকে।

একদিন রাজামশাই ঘটা করে এলেন গজদন্তী মিনার দেখতে। সঙ্গে এলেন মন্ত্রীমশাই। মিনারের সৌন্দর্য দেখে রাজামশাই তো আনন্দে আত্মহারা। বললেন, “অতি চমৎকার মিনার হয়েছে মন্ত্রীমশাই। এর সৌন্দর্যকে টেক্কা দিতে পারে এমন আর কোনও মিনার পৃথিবীতে আছে বলে আমার জানা নেই। তবে এ-কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই, এতে আপনারও অনেকখানি অবদান রয়েছে। ভাগ্যিস আপনার মাথায় বুদ্ধিটা এসেছিল!”

মন্ত্রীমশাই গদগদ গলায় বললেন, “না না মহারাজ, ওসব বলে আমায় লজ্জা দেবেন না। আমি আমার কর্তব্যটুকু করেছি মাত্র। আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত—এমন গজদন্তী মিনারের জুড়ি মেলা ভার। তবে কী জানেন, আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে সবিশেষ চিন্তিত। অভয় দেন তো বলি।”

“বলুন মন্ত্রীমশাই। আবার কী নিয়ে এত ভাবছেন?” রাজামশাইয়ের কণ্ঠস্বরে কৌতূহল ঝরে পড়ল।

মন্ত্রীমশাই একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মহারাজ, আমি ভাবছি তোতাপাখিটার কথা। অমন সুরম্য গজদন্তী মিনারে এত যত্ন-আত্তির মধ্যে থেকেও ওর মনে কিন্তু ছিটেফোঁটাও আনন্দ-ফুর্তি নেই।”

“আপনার এমন মনে হওয়ার কারণ?” রাজামশাই রীতিমতো অবাক।

“মহারাজ, মনে ভরপুর আনন্দ থাকলে পাখিরা গান গায়। ওকে কখনও গান গাইতে শুনেছেন? ও তো কেবল শেখানো বুলি আওড়ায়। সে-সব মোটেই ওর মনের কথা নয়। আসলে কী জানেন মহারাজ, পাখিটা বড্ড দুঃখী।” বলতে বলতে মন্ত্রীমশাইয়ের চোখ দুটো জলে ভিজে গেল।

“ঠিক বলেছেন। আমি তো এভাবে ভেবেই দেখিনি!” রাজামশাই চিন্তামগ্ন হলেন। খানিকক্ষণ পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কী যে ঝামেলায় পড়লাম! এখন কী করি বলুন তো মন্ত্রীমশাই?”

বেশ বোঝা যাচ্ছিল, রাজামশাই বেশ আতান্তরে পড়েছেন, অথচ কিছুতেই সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।

মুখখানা কুঁচকে, চোখ দুটো সরু করে, মাথা চুলকে মন্ত্রীমশাই বললেন, “মহারাজ, আমার মনে হয় এই পাখিটি এর আগে অন্য কারও পোষা ছিল। হয়তো সেই পুরোনো মালিকের কথা ভেবে-ভেবেই ও এমন বিমর্ষ হয়ে পড়ছে দিন-কে-দিন।”

রাজামশাইয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর হল। বললেন, “সে না-হয় বুঝলাম, কিন্তু পাখির আগের মালিককে খুঁজে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? কোথায় পাব তাঁকে?”

“মহারাজ, আপনি আবারও অযথা দুশ্চিন্তা করছেন। ব্যাপারটা খুবই সহজ। পাখিটাকে তো টিম্মা নিয়ে এসেছে, সে নিশ্চয়ই জানে পাখির আগের মালিকের পরিচয়। আমি নিশ্চিত, টিম্মাকে জিজ্ঞেস করলেই এ-সমস্যার সমাধান মিলবে।”

রাজামশাইয়ের চোখে-মুখে আশার আলো ফুটল। তিনি বললেন, “বেশ তো! তবে আর দেরি কেন? এক্ষুনি টিম্মার সঙ্গে কথা বলুন।”

নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে মন্ত্রীমশাই আবার টিম্মাকে জরুরি তলব করলেন।

খবর পেয়ে ছুটে এল টিম্মা। অবশ্য সে আর এখন সেই আগের টিম্মা নেই; না পোশাকে পরিচ্ছদে, না হাবেভাবে। এখন সে মাহুত সর্দার টিম্মা। আগের মতো খাটো ধুতি আর ময়লা জামা সে আর পরে না। এখন তার পরনে ঝকঝকে রঙিন কামিজ ও কালো পেড়ে সাদা ধুতি। কোমরে জড়ানো কোমরবন্ধ।

মন্ত্রীমশাই তাকে দেখেই গলা তুলে বললেন, “এই যে টিম্মা, একটা দরকারি কাজ করতে হবে তোমায়। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, তোতাপাখিটা কেমন যেন মনমরা হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে আগের মালিকের জন্যে মনকেমন করে তোতাপাখির। তাই হয়তো সে গান গায় না। তা, পাখির সেই পুরোনো মালিককে খুঁজে আনতে হবে তোমায়।”

মন্ত্রীমশাইয়ের কথা শুনে টিম্মা আকাশ থেকে পড়ল।—“পাখিটা আগে কার কাছে ছিল আমি কী করে জানব বলুন তো মন্ত্রীমশাই? আপনাদের তো আগেই বলেছি, ওকে বন থেকে ধরে নিয়ে এসেছি। বিশ্বাস করুন, পাখিটার অতীত সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”

মন্ত্রীমশাই এবার যেন রীতিমতো রেগে উঠলেন। তড়াক করে তাফিয়ে উঠে বললেন, “দেখো টিম্মা, কাজ ফাঁকি দেওয়ার বাহানা কোরো না। এসব কৈফিয়ত শুনতে রাজামশাই মোটেই আগ্রহী নন। তিনি কাজ করবার আদেশ দিয়েছেন, তাই কেবল কাজটাই দেখতে চান।”

প্রত্যুত্তরে টিম্মাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে মন্ত্রীমশাই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দরজার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে চেঁচিয়ে বললেন, “এখনি যাও। সেই লোককে যেখান থেকে পারো ধরে নিয়ে এসো। পনেরো দিন সময় দিলাম। খালি হাতে ফিরলে তোমার কী গতি হবে তা আশা করি নতুন করে বলে দিতে হবে না!” মন্ত্রীমশাইয়ের ঠোঁটের কোণে এবার দেখা দিল একটা বিশ্রী হাসি।

উপায় না দেখে টিম্মা বনে চলে গেল; খুঁজতে লাগল তার সেই পুরোনো টিয়াপাখি বন্ধুকে। সে জানে, এই বিপদে যদি কেউ তাকে বাঁচাতে পারে, তবে সে হল ওই কলাপাতা রঙের টিয়াপাখি। টিয়াপাখিকে খুঁজতে খুঁজতে সে যখন শ্রান্ত দেহে ও হতাশ মনে একটি আমগাছের নীচে এসে বসেছে, ঠিক আগের বারের মতোই টিয়াপাখি সেই গাছের ডাল থেকে বলে উঠল, “কী গো বন্ধু? আবার কী মনে করে এ-পথে এলে?”

পুরোনো বন্ধুকে দেখে টিম্মা তো ভীষণ খুশি। সে উত্তেজিত গলায় বলল, “আবার মহা বিপদে পড়েছি সবুজ বন্ধু। একমাত্র তুমিই পারো আমায় বাঁচাতে। এত যত্ন-আত্তির মধ্যে থেকেও সাতরঙা তোতাপাখি গান গায় না। আগের মালিকের কথা মনে পড়ে পাখির। এতে পাখির নাকি খুব মনখারাপ। তাই রাজামশাইয়ের আদেশ, পাখির পুরোনো মালিককে খুঁজে আনতে হবে আমায়। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে তোমার সাহায্য চাই বন্ধু!”

টিয়াপাখি বলল, “বেশ, এসো আমার পেছন পেছন।”

আগে আগে টিয়াপাখি উড়তে লাগল, আর তার পেছনে দৌড়তে লাগল টিম্মা।

অনেক বনজঙ্গল পেরিয়ে একসময় তারা দুজন এসে পৌঁছল একটি নদীর তীরে। সে-নদীর কূল-ঘেঁষা প্রাচীন অশ্বত্থ-বটের গভীর জঙ্গলে ঢাকা রয়েছে এক প্রাচীন পরিত্যক্ত মন্দির। টিয়াপাখির পেছন পেছন টিম্মা এসে দাঁড়াল সে-মন্দিরের ভাঙাচোরা চাতালে। মন্দিরের দেওয়ালের চুন-সুরকির প্রলেপ খসে পড়েছে কবেই। কালচে দেওয়াল বেয়ে গজিয়ে ওঠা গাছগাছালি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে মন্দিরকে। অযত্ন আর অবহেলায় মন্দির চত্বরটি আগাছা ও কাঁটা ঝোপে ভরা। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হল, মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঠের তৈরি কলের ঘোড়া। টিয়াপাখি ফুড়ুৎ করে এসে বসল সেই কলের ঘোড়ার পিঠে।

টিম্মা এসে কলের ঘোড়ার সামনে দাঁড়াতেই টিয়াপাখি সোৎসাহে বলল, “বন্ধু, এটি হল পক্ষীরাজ ঘোড়া। এই দেখো, ওর পিঠে একখানা চাবি আছে। চাবি ঘোরালেই পক্ষীরাজের দু-পাশে ডানা বের হবে। তখন সে নিজে থেকেই আকাশে উড়বে। তোমার নির্দেশও মেনে চলবে।”

টিম্মাকে চিন্তিত দেখাল। তার ওপর এতখানি পথ দৌড়ে এসে বড্ড হাঁপাচ্ছিল। একটু দম নিল সে। তারপর বলল, “আমি যে কোনোদিনও পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে আকাশে উড়িনি সবুজ বন্ধু! আমি কি পারব?”

টিয়াপাখি হেসে বলল, “পারবে, পারবে। অবশ্যই পারবে। তোমায় যে পারতেই হবে বন্ধু। এখন আমি যা-যা বলছি মন দিয়ে শোনো।” তারপর একটা ডানা দিয়ে পশ্চিমদিকটা দেখিয়ে বলল, “আকাশ পথে সোজা পশ্চিমদিকে যাবে। কিছুটা পথ গেলেই সামনে পড়বে সমুদ্র। এমন সাতটা সমুদ্র আর তেরোটা নদী পার হলেই চোখে পড়বে সবুজ গালিচায় মোড়া এক অপূর্ব দ্বীপ, নাম সবুজ দ্বীপ। ওই দ্বীপে গেলেই তোমার সমস্যার সমাধান হবে বলে আমার বিশ্বাস। বাকিটা তোমার ভাগ্য। বুঝলে বন্ধু?”

টিয়াপাখিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে টিম্মা চড়ে বসল কলের ঘোড়ার পিঠে। আর যেই না সে ঘোড়ার পিঠে বসে চাবিখানা ঘুরিয়েছে, অমনি ঘোড়া ডানা মেলে শোঁ করে উঠে গেল আকাশে। ওপর থেকে টিয়াপাখির দিকে হাত নাড়িয়ে টিম্মা চিৎকার করল, “বন্ধু, তোমার উপকার ভুলব না। আবার দেখা হবে আমাদের।”

ততক্ষণে পক্ষীরাজ ঘোড়া দ্রুত মেঘ কেটে উড়ে চলেছে পশ্চিমদিকে। দ্রুত বনজঙ্গল-পাহাড়-উপত্যকা ছাড়িয়ে পক্ষীরাজ এসে গেল সমুদ্রের ওপর। তবে এই পথে তো কেবল একখানা সমুদ্র পেরোলেই হবে না। সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হলে তবেই না সে পৌঁছবে সেই সবুজ দ্বীপে! ব্যাপারটা কি আর অতই সহজ? তাই ধৈর্য ধরে গুনে গুনে পার হতে হল সাতখানা সমুদ্র আর তেরোখানা নদী। শেষমেশ টিম্মা দূর দিগন্তে দেখতে পেল একখানা মনোহরা সবুজ দ্বীপ, ঠিক যেমনটা টিয়াপাখি বলেছিল। দ্বীপের কাছে আসতেই সে তড়িঘড়ি পক্ষীরাজকে নির্দেশ দিল দ্বীপে নামতে।

এদিকে সে-দ্বীপের রাজকন্যা সুবর্ণলতা তখন রাজ-উদ্যানে সখীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সখীরা হেসে খেলে ফুল তুলছিল, মালা গাঁথছিল। রাজকন্যা নিজের খেয়ালে খোঁপায় গুঁজে নিচ্ছিলেন লাল-নীল-সাদা সুগন্ধী ফুল। কখনও আবার আনন্দের আতিশয্যে হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছিলেন সখীদের ওপর। রাজ-উদ্যানে এমনই একটি আনন্দঘন পরিবেশের মাঝে আচমকা টিম্মাকে পিঠে করে নেমে এল সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া।

প্রথমটায় রাজকন্যা ও তাঁর সখীরা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। এতে অবশ্য তাদের মোটেই দোষ দেওয়া যায় না, রোজ রোজ কি আর আকাশ থেকে ঘোড়সওয়ার-সহ ঘোড়া নেমে আসে নাকি! তাই ‘উড়ন্ত ঘোড়া, উড়ন্ত ঘোড়া, পালাও, পালাও’ বলে চিৎকার করতে করতে সভয়ে আশেপাশে ছিটকে গেল তারা। কেউ কেউ আবার ছুটে গিয়ে গাছপালার পেছনে লুকোল। খানিক বাদে তারা যখন বুঝতে পারল টিম্মা মোটেই ক্ষতিকারক কেউ নয়, তখন তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন সাহস করে এগিয়ে এল সামনে। টিম্মা তাদের দিকে তাকিয়ে হাসতেই এক কন্যে হাত-মুখ নাড়িয়ে বলল, “অদ্ভুত ব্যাপার তো! ঘোড়া আবার ওড়ে নাকি?”

বাকিরা কোনও কথা না বলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ঘোড়ার দিকে। দূর থেকে কেউ কেউ আবার টিম্মাকে সন্দেহের চোখে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখছিল।

কন্যেদের হাবভাব দেখে টিম্মা মনে মনে হাসছিল। তবে সেসব ওদের একদম বুঝতে দিল না সে। বরং অবাক হওয়ার ভান করে সেই কন্যেটিকে বলল, “বলছেন কী! এমন ঘোড়া জীবনেও দেখেননি? এ তো পক্ষীরাজ ঘোড়া! পক্ষীরাজের পিঠে চেপে আকাশে উড়ে বেড়াননি কখনও? ক্ষমা করবেন আমায়, আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।”

কন্যেটি মুখ কালো করে বলল, “তবে আর বলছি কী আপনাকে? এমন উড়ুক্কু ঘোড়া যে এ-দুনিয়ায় আছে তা-ই তো জানি না আমরা!” তারপর সে তার পাশে দাঁড়ানো আরেক কন্যেকে দেখিয়ে বলল, “আমাদের দুজনকে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চাপিয়ে আকাশে উড়িয়ে আনবেন?”

টিম্মা হেসে বলল, “অবশ্যই। আসুন আপনারা।”

কন্যে দুটিকে পক্ষীরাজে চাপিয়ে আবার আকাশে উড়ল টিম্মা। আকাশে উড়তে পেরে দুই কন্যের প্রাণে যেন আর আনন্দ ধরে না। তারা খিলখিল করে হাসতে লাগল। খানিকক্ষণ আকাশে এলোমেলো উড়োউড়ি করে তারা তিনজন আবার ফিরে এল যথাস্থানে।

রাজকন্যা সুবর্ণলতা এতক্ষণ একটি গাছের গুঁড়ির পেছনে লুকিয়ে সব দেখছিলেন। এবার সেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন টিম্মার দিকে। খানিকক্ষণ উশখুশ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে সলজ্জ গলায় বললেন, “আমিও আকাশে উড়তে চাই। আমাকে কি পক্ষীরাজে চাপিয়ে আকাশে উড়িয়ে আনবেন?”

রাজকীয় বেশভূষা দেখে টিম্মা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল, ইনিই হলেন সবুজ দ্বীপের রাজকন্যা। সে তাকে সাদরে আহ্বান জানাল। রাজকন্যা ও টিম্মাকে নিয়ে চোখের নিমিষে পক্ষীরাজ উড়ে গেল আকাশে। একে একে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে পক্ষীরাজ উড়ে চলল নির্বিঘ্নে, সবুজ দ্বীপে ফিরে আসবার নামটিও করল না।

প্রথম দিকে রাজকন্যা আনন্দেই ছিলেন। আকাশ থেকে পৃথিবীর অসামান্য রূপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলেন। তবে খানিক বাদে তিনি বুঝতে পারলেন, পক্ষীরাজ অন্যদিকে নিয়ে চলেছে তাঁকে। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় টিম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছেন?”

টিম্মা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানাল, “দয়া করে আমার ওপর ভরসা রাখুন রাজকুমারী। যার সঙ্গে বহুদিন আপনার দেখা হয়নি, তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।”

টিম্মার কথায় এমন একটা কিছু ছিল যাতে রাজকন্যা সত্যিই ভরসা খুঁজে পেলেন। তিনি কোনও প্রতিবাদ করলেন না।

অবশেষে দূরে দেখা গেল গজদন্তী মিনারের চুড়ো। সূর্যের আলো পড়ে তার রূপ যেন শতগুণে ঠিকরে বেরোচ্ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই গজদন্তী মিনারের সামনের জমিতে পক্ষীরাজ ঘোড়া এসে নামল।

টিম্মা আগে নেমে রাজকন্যাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে সাহায্য করল। তারপর মিনারের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলল, “মিনারের ধারে যান রাজকুমারী, ভালো করে দেখুন তো মিনারের ভেতরে যে আছে তাকে চেনেন কি না!”

রাজকন্যা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মিনারের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পরেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “আমার আদরের সাতরঙা তোতাপাখি! কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই?”

টিম্মা মিনারের ভেতর থেকে তোতাপাখিকে বের করে এনে রাজকন্যার হাতে দিল। পাখিকে কোলে নিয়ে রাজকন্যার দু-গাল বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। আর কী আশ্চর্য! এবার কিন্তু সত্যি-সত্যিই তোতাপাখির গলায় শোনা গেল অসামান্য সুরেলা গান। সেই গানের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্য জুড়ে। খবর পেয়ে রাজামশাই ছুটে এলেন হুড়মুড় করে।

রাজামশাইকে নমস্কার জানিয়ে টিম্মা মহানন্দে বলল, “মহারাজ, তোতাপাখির আগের মালিককে খুঁজে পেয়েছি।” তারপর রাজকন্যাকে দেখিয়ে বলল, “ইনিই হলেন তোতাপাখির পুরোনো মালকিন, সবুজ দ্বীপের রাজকুমারী সুবর্ণলতা।”

তখন আরেক বিপদ সামনে এল—সাতরঙা তোতাপাখি থাকবে কার কাছে? সবুজ দ্বীপের রাজকন্যা তাঁর সাধের তোতাপাখিকে কাছছাড়া করতে নারাজ। রাজামশাইও তোতাপাখিহীন গজদন্তী মিনারের কথা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারছেন না। শেষমেশ অনেক ভেবেচিন্তে দিন কয়েকের মধ্যেই একখানা জবর উপায় বেরোল। রাজ্য জুড়ে বেজে উঠল সানাইয়ের ধুন। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, অনেক লোকজন খাইয়ে, বহু দান-দক্ষিণা করে সবুজ দ্বীপের রাজকন্যার সঙ্গে রাজামশাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। সাতরঙা তোতাপাখি রয়ে গেল তাঁদের দুজনেরই কাছে। সে-বিয়েতে টিম্মা মনের খুশিতে নাচল। তোতাপাখিও মহানন্দে গাইল মনমোহিনী সুরের গান।

মাস দুই ধরে চলা বিয়ের উৎসবের রেশ মনেপ্রাণে জড়িয়ে রাজ্যের সকলেই সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল। একমাত্র মন্ত্রীমশাইয়ের মনে এক ফোঁটাও শান্তি ছিল না। থাকবে কী করে? রাজামশাই যে খুশি হয়ে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন—‘আজ থেকে টিম্মা আমার রাজ্যের প্রধান সেনাপতি!’

বলাই বাহুল্য, টিম্মার কাছে দ্বিতীয় বার হেরে যাওয়াটা মন্ত্রীমশাই কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

না, সুখের দিন কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সুখের পর অবধারিতভাবে আসে দুঃখ। সেজন্যেই তো বলে ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি’—সুখ ও দুঃখ চক্রের ন্যায় ঘুরছে। তা, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। নতুন রানি কঠিন অসুখে পড়লেন। রাজবদ্যি-কবিরাজ কেউই কিছু করতে পারলেন না। ভিনদেশ থেকে বহু খরচাপাতি করে আনানো হল নামজাদা কবিরাজ-বদ্যিদের। তাঁরা আসা-যাওয়া করতে লাগলেন, চিকিৎসার নানা বিধান দিতে থাকলেন, কিন্তু যাঁর জন্যে এত কিছু করা সেই নতুন রানির অসুখ কিছুতেই সারল না। তিনি দিন দিন মিশে যেতে লাগলেন বিছানায়।

শেষে বৃদ্ধ রাজবদ্যিমশাই চোখের জল ফেলে বললেন, “মহারাজ, আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা চেষ্টার কোনও ত্রুটি করিনি। আসলে এ দুরারোগ্য ব্যাধির কোনও ওষুধই যে নেই!”

অসহায় গলায় মহারাজ বললেন, “এ কী বলেছেন রাজবদ্যিমশাই! এত বড়ো দুনিয়ায় এমন কেউ কি নেই যিনি মহারানির অসুখ সারাতে পারবেন? রানির অসুখ যিনি সারাতে পারবেন তিনি যা চাইবেন আমি তাঁকে তা-ই দেব।”

রাজবদ্যিমশাই অনেক ভেবে বললেন, “একটাই মাত্র পথ খোলা আছে মহারাজ। আগে যিনি রানিমার চিকিৎসা করতেন, তাঁকে খুঁজে আনতে পারলে হয়তো রানিমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে পারে। সেই বিদেশি বদ্যিকে খুঁজে আনতে যত শীঘ্র সম্ভব লোক পাঠানো হোক রানিমার দেশ সবুজ দ্বীপে।”

সুযোগ বুঝে মন্ত্রীমশাই এগিয়ে এসে বললেন, “রাজবদ্যিমশাই ঠিক কথা বলেছেন মহারাজ। এটাই একমাত্র উপায়। এই কাজটা করবার দায়িত্ব দেওয়া হোক আমাদের টিম্মা সেনাপতিকে। রানিমার দেশের ঠিকানা ওর ভালো করে জানা। আমাদের মধ্যে কেবল ও-ই তো গিয়েছে সেখানে।”

সরল মুখ করে যা-ই বলুন না কেন, মন্ত্রীমশাইয়ের মাথায় খেলছিল দুষ্টু বুদ্ধি। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, ‘সবুজ দ্বীপের রাজার অনুমতি না নিয়েই তাঁর কন্যাকে এখানে তুলে নিয়ে এসেছে টিম্মা। সে-রাজ্যের লোকেরা কি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গিয়েছে সেসব অপমানের কথা? হতেই পারে না! ওই দেশের লোকজন টিম্মাকে হাতের নাগালের মধ্যে পেলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। যাক না একবার ওখানে, আর ফিরে আসতে হবে না ওকে।’ এসব ভেবে মন্ত্রীমশাই বড্ড আনন্দ পাচ্ছিলেন। তিনি নিশ্চিত, এবার তাঁর উদ্দেশ্য সফল হবেই।

এদিকে রাজামশাই, রাজবদ্যি আর মন্ত্রীমশাইয়ের সব কথাবার্তাই নতুন রানির কানে যাচ্ছিল। তিনি হঠাৎ দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মহারাজ, অযথা বদ্যির সন্ধানে আমার দেশে লোক পাঠাবেন না। আমার অসুখ সহজে সারবার নয়। যিনি আমার অসুখ নিরাময় করতে পারতেন তাঁকে খুঁজে বের করবার সাধ্যি কারও নেই। আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে।”

রাজামশাই এগিয়ে গিয়ে নতুন রানির শিয়রের পাশে বসলেন। তারপর তাঁর মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “এভাবে বললে তো হবে না মহারানি। তাঁকে যে খুঁজে বের করতেই হবে আমায়। শিগগির বলো তাঁর নাম-পরিচয়। বাকি দায়িত্ব আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হও।”

“ঠিক আছে, শোনো তবে।” এটুকু বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন রানি। তারপর মৃদু স্বরে বললেন, “সে আমার ছোট্টবেলার বন্ধু, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। একসঙ্গে হেসে খেলে বেড়ে উঠেছি আমরা। একদিন সামান্য কারণে তার সঙ্গে ভীষণ ঝগড়াঝাঁটি হল। কারণটা আজ আর স্পষ্ট মনে নেই। তবে খুব সম্ভবত আমার সাধের মাটির টিয়াপাখিটা ভেঙে ফেলেছিল সে।”

দম নেওয়ার জন্যে একটু থামলেন রানি। তারপর আবার বলতে লাগলেন, “সেদিন কী যে হয়েছিল আমার, রেগেমেগে ওকে শাপ দিলাম—পাখি হয়ে যা! কী আশ্চর্য ব্যাপার, আমার কথা ফলে গেল! আমার চোখের সামনে ও একটা কলাপাতা রঙের টিয়াপাখি হয়ে গেল! আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই ও যে কোথায় ডানা মেলে উড়ে চলে গেল, আজও জানতে পারিনি। বড্ড অভিমানী ছিল সে। আর ফিরে আসেনি আমার কাছে।” নতুন রানির দু-চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।

মন্ত্রীমশাই আবার নাক গলালেন। পাশ থেকে চাপা গলায় বললেন, “মহারাজ, টিম্মা সেনাপতি খুব কাজের মানুষ। একমাত্র টিম্মাই পারবে রানিমার বন্ধু সেই টিয়াপাখিকে খুঁজে বের করতে। আপনি আদেশ দিলে আমি ওর সঙ্গে…”

দুশ্চিন্তায় জর্জর রাজামশাই বললেন, “হ্যাঁ, টিম্মার সঙ্গেই না-হয় কথা বলুন। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় তো আর দেখছি না!”

মন্ত্রীমশাই তৎক্ষণাৎ টিম্মাকে ডেকে পাঠালেন। তলব পেয়ে ছুটে এল টিম্মা। মন্ত্রীমশাই বললেন, “তোমাকে আবার একখানা দায়িত্ব দেব। রানিমা অসুস্থ, জানোই তো তুমি। এখন ব্যাপারটা হল, রানিমার নাকি এক টিয়াপাখি বন্ধু আছে। সেই টিয়াপাখি আবার বহুদিন হল নিখোঁজ। তাকে ফিরে না পেলে রানিমা সুস্থ হবেন না। তাই রাজামশাই আদেশ দিয়েছেন, যেভাবেই হোক তোমায় খুঁজে আনতে হবে সেই টিয়াপাখিকে।”

“পৃথিবীর এত এত টিয়াপাখির মধ্যে থেকে রানিমার বন্ধু টিয়াপাখিকে আমি কীভাবে চিনব মন্ত্রীমশাই?”

মন্ত্রীমশাই হাত তুলে টিম্মাকে থামিয়ে দিলেন। তারপর কড়া গলায় আদেশ দিলেন, “আজেবাজে কথা শুনবার সময় নেই আমার। সময় নষ্ট না করে এখনি যাও, ওই টিয়াপাখিকে যেখান থেকে পারো খুঁজে নিয়ে এসো। দেখি কেমন সেনাপতি তুমি! আর হ্যাঁ, মনে থাকে যেন, খালি হাতে ফিরলে গর্দান যাবে।” মন্ত্রীমশাইয়ের মুখে বক্র হাসি ফুটে উঠল।

বাধ্য হয়ে টিম্মা রওনা হল নতুন রানির বন্ধু টিয়াপাখির খোঁজে। তবে টিম্মা এখন রাজ্যের সেনাপতি, তাই এবার সে তেজি ঘোড়ায় চেপে বেরিয়েছে। কিন্তু তাতে কী লাভ? রানিমার বন্ধু টিয়াপাখির সন্ধানে সে কোথায় যাবে, সেটাই তো সে জানে না। যথারীতি পুরোনো বন্ধুর কথা মনে পড়ল টিম্মার। কেবল সেই বন্ধুই পারবে এ-বিপদ থেকে রক্ষা করতে, জানে টিম্মা। সত্যিকারের বন্ধু বলতে তো একজনকেই বোঝে সে, সেই কলাপাতা রঙের টিয়া পাখি, টিম্মার সবুজ বন্ধু। টিম্মা তার সেই সবুজ বন্ধুর কাছেই ছুটে গেল।

বনের ভেতর গিয়ে টিম্মা তন্নতন্ন করে টিয়াপাখিকে খুঁজতে লাগল। প্রতিবারের মতো এবারও সেই টিয়াপাখি নিজে থেকে এসে টিম্মাকে দেখা দিল। বলল, “কী গো বন্ধু! মুখ কালো করে রেখেছ কেন? না হাসলে তোমায় মোটেই ভালো দেখায় না। একটু হাসো তো দেখি।”

টিম্মা মুখ ব্যাজার করে বলল, “এখন আমার হাসবার মতো পরিস্থিতি নয় সবুজ বন্ধু। কী যে বিপদে পড়েছি কী বলব তোমায়। সব কথা জানলে তুমি আমায় হাসবার কথা বলতে পারতে না।”

টিয়াপাখি এতক্ষণ বসে ছিল একটি গাছের ডালে। আচমকা সে উড়ে এসে বসল টিম্মার ডান কাঁধের ওপর। তারপর টিম্মাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “রানিমার অসুখের ওষুধ আমার জানা। আমায় তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো তাঁর কাছে। দেখি তো, তাঁর অসুখ সারে কি না!”

রাজামশাইয়ের অনুমতি নিয়ে পাখি কাঁধে টিম্মা এসে দাঁড়াল নতুন রানির সোনার পালঙ্কের পাশে। আশেপাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রাজামশাই, রাজবদ্যি-সহ আরও অনেকেই। নতুন রানির স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছে। কিন্তু এ কী! পাখির ওপর দৃষ্টি পড়তেই রানি চট করে উঠে বসলেন কেন? কোথায় তাঁর অসুস্থতা! বিস্ফারিত চোখে পাখির দিকে তাকিয়ে রইলেন রানি। তাঁর রোগজীর্ণ মুখ থেকে বেরিয়ে এল কেবল দুটি শব্দ—“মিতু, তুই?”

টিয়াপাখি সঙ্গে সঙ্গে টিম্মার কাঁধ থেকে উড়ে এসে বসল নতুন রানির হাতে। রানি আদর করে হাত বোলাতে লাগলেন টিয়ার নরম গলায়। সকলে অবাক হয়ে দেখল, নতুন রানি আর টিয়াপাখি দুজনেরই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। তবে এ-কথা না বললেও স্পষ্ট বোঝা যায়, সে-জলে মিশে আছে অপার খুশির ধারা।

তারপর কী থেকে যে কী হয়ে গেল বোঝা গেল না। অমন ভোজবাজির মতো কাণ্ডকারখানা কেউ কক্ষনও দেখেনি! কোথায় গেল সেই কলাপাতা রঙের টিয়াপাখি? টিয়াপাখির পরিবর্তে নতুন রানির সামনে বসে রয়েছে লাল পেড়ে কলাপাতা-সবুজ শাড়ি পরা এক রূপসী কন্যে!

উপস্থিত সকলে অবাক চোখে দেখল, নতুন রানিমা সেই কন্যেকে জড়িয়ে ধরেছেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে চলেছেন, “মিতু রে, কতদিন পরে তোকে দেখছি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস বন্ধু। তোর প্রতি ভীষণ অন্যায় করেছি। ভুলেও আর কক্ষনও তোকে কাছছাড়া করব না। আমার সঙ্গেই থাকবি তুই।”

নতুন রানির বন্ধু মিতু কিন্তু একটিও কথা বলতে পারল না। কান্নায় তার গলা বুজে এসেছে। কেবল তাঁর দু-চোখ উপচে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছিল জল।

নতুন রানির অসুখ সত্যিই সেরে গেল। রাজা-রানির উৎসাহে টিম্মার সঙ্গে মিতেনির, ওরফে মিতুর বিয়ে হয়ে গেল। সেই বিয়েতে রাজ্যবাসী খুব আনন্দ-ফুর্তি করল। কত যে লোক সে-বিয়েতে ভোজ খেয়েছিল তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এক মাস ধরে বিয়ের উৎসবে মেতে ছিল গোটা রাজ্য।

সবশেষে রাজামশাই খুশির চোটে ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে টিম্মা আমার রাজ্যের মহামন্ত্রী।” এখন রাজসভায় রাজামশাইয়ের বিরাট সিংহাসনটির ডান পাশে যে মাঝারি সিংহাসনখানা পাতা রয়েছে, তাতেই বসে টিম্মা।

ওহো, রাজ্যের পুরোনো মন্ত্রীমশাইয়ের কথা বলা হয়নি, তাই না? আসলে তাঁর কথা ও-রাজ্যের কেউই জানে না। এক কথায় বলতে গেলে, তিনি নিরুদ্দেশ। মাঝেমধ্যে অবশ্য কানাঘুষো শোনা যায়, তিনি নাকি টিম্মার কাছে একের পর এক পরাজয় স্বীকার করতে না পেরে মনের দুঃখে বনবাসী হয়েছেন। তবে এমন কত কথাই তো হাটে-বাজারে লোকেদের মুখে মুখে ফেরে। ওসব কথাবার্তা কি বিশ্বাস করতে আছে? কক্ষনও না। তাই গুজবে কান দেবে না। বরং কেউ যদি সত্যিই মন্ত্রীমশাইয়ের খোঁজ পাও, দয়া করে মহামন্ত্রী টিম্মাকে জানিও। আমাদেরও জানাতে ভুলো না যেন!

GOLPOTIMMA02

(কানাড়া লোককথা অবলম্বনে লেখা)

অলঙ্করণ-মৌসুমী রায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s