মূল: থর হেয়ারডাল
আগের কথা
রাত গভীর হলে অন্ধকারে সমুদ্রের ভেতর থেকে কারো গলা ভেসে এল। অভিযাত্রীরা উত্তেজনায় টানটান। ন্যুট ফিরে এসেছে। সঙ্গী ছ’জন পলিনেশীয় লোক। ক্যানোয় চেপে। সময় বেশি ছিল না, তাড়াতাড়ি ওদের উপহার-টুপহার দিয়ে রওনা করিয়ে সকলে ঘিরে বসল ন্যুটের গল্প শুনবে বলে। ন্যুট ডাঙায় পৌঁছনোর পর ভেলায় ফিরে আসতে চাইলে আবার উত্তাল সমুদ্রে ভাসতে কেউ রাজি ছিল না। ওরা ভেবেছিল বাকিরা অমনিই এসে পড়বে। বহু চেষ্টার পর ন্যুট তাদের রাজি করাতে পারে। পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবার সময় স্থানীয়রা ওদের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েছিল খুব। আরো তিনদিন সমুদ্রে ভেসে চলল কনটিকি। ডাঙার দেখা নেই। ভেলাটা এইবারে টাকুমে আর রারোরিয়া প্রাচীরের দিকে চলেছে, আন্দাজ করতে পারল অভিযাত্রীরা। বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রবালপ্রাচীরে ধাক্কাটা এবার অনিবার্য জেনে সকলে তৈরি হল। বিশাল বিশাল ঢেউ উঠে আসছে ভেলার ওপর। ততদিনে সমুদ্রে একশো দিন পেরিয়ে গেছে। রারোরিয়া প্রবালপ্রাচীরের পেছনদিকে মুক্তোর মালার মতো ছড়ানো দ্বীপমালা দেখা গেল। বাতাসের ধাক্কায় আর সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ে ভেলা ওপর-নীচ করতে থাকল। অভিযাত্রীরা এইবারে অন্তিম-পর্বের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। সেন্টার বোর্ডের দড়ি কেটে দিয়ে সেগুলো তুলে ফেলা হল। পাল খুলে, মালপত্র কেবিনে ঢুকিয়ে ক্যানভাসে ঢেকে দড়ি দিয়ে যতটা সম্ভব শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল। রারোটাঙ্গায় শেষ মেসেজটা পাঠানোর পর রেডিও সেটটাকেও মুড়ে ফেলা হল জলনিরোধক আবরণে। তারপরেই প্রবালপ্রাচীরে আছড়ে পড়ল কনটিকি। বেশ খানিক্ষণ সমুদ্রের ঢেউ আর কনটিকির মধ্যে চলল দুরন্ত লড়াই। অভিযাত্রীরা যে যেমন করে পারলেন ভেলার কোনো না কোনো অংশ আঁকড়ে রইলেন। অবশেষে কনটিকি উঠে এল প্রাচীরের ওপরে। অভিযাত্রীরাও। ক্রমশ ধাতস্থ হয়ে মালপত্র নামিয়ে হ্রদের জল ঠেলে ঠেলে সামনের দ্বীপটায় উঠে এলেন ওরা। ভাঙাচোরা কনটিকি রইল প্রাচীরের ওপরেই। অবশেষে অভিযান সম্পূর্ণ হল। অভিযাত্রীরা দেখলেন এক নতুন পৃথিবী। একটুকরো স্বর্গ।
পলিনেশীয়দের মাঝখানে
আমাদের ছোট্ট দ্বীপটায় কোনো বসতি নেই। প্রত্যেকটা নারকেলগাছ, গোটা সৈকতটা আমাদের পরিচিত হয়ে গেল; দ্বীপটা ছোট্ট, মাত্রই দুশো গজ চওড়া। সবচেয়ে উঁচু জায়গাটাও হ্রদের জল থেকে মাত্র ফুট উঁচু।
মাথার ওপরে সবুজ পাতায় ছাওয়া নারকেলের কাঁদিগুলো; ভেতরের শাঁসজল রোদ্দুরের থেকে ভালোমতোই আড়াল করা, ফলে বেশ কয়েক সপ্তাহ তৃষ্ণার্ত থাকার কোনো প্রশ্নই নেই। ঝুনো নারকেল ছিল, গাদা গাদা সন্ন্যাসী কাঁকড়া, আর হ্রদের নানারকম মাছ—ভালোমতোই চলে যাবে আমাদের।
দ্বীপের উত্তরদিকে আমরা একটা রঙ না করা কাঠের ক্রুশের অংশবিশেষ খুঁজে পেলাম, ওটা প্রবালচূর্ণের বালিতে অর্ধেকটা পোঁতা ছিল। এদিক থেকে, প্রবালপ্রাচীর বরাবর উত্তরের দিকটা নজরে আসে, আমরা ভেসে আসার সময় ওদিকটাতেই প্রথম ভাঙাচোরা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ কাছ থেকে নজর করেছিলাম। আরো উত্তরদিকে আমরা নারকেলগাছে ছাওয়া আরেকটা ছোটো দ্বীপের নীলচে আভাস খেয়াল করলাম। দক্ষিণের দ্বীপটা, যেটায় জঙ্গল বেশি ঘন, সেটা অপেক্ষাকৃত কাছে। আমরা ওতেও কোনো প্রাণের চিহ্ন দেখতে পাইনি, কিন্তু আপাতত আমাদের মাথা ঘামাবার অন্যান্য অনেক বিষয় ছিল।
রবিনসন ক্রুশো হ্যাসেলবার্গ খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলেন একটা বড়ো খোড়ো টুপি মাথায় দিয়ে, হাতভর্তি সন্ন্যাসী কাঁকড়া। ন্যুট কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালল এবং আমরা দুপুরে খাবারের জন্য কাঁকড়া, নারকেলের দুধ আর কফি নিয়ে বসলাম।
“পাড়ে উঠে দিব্যি লাগছে, না? কী বলো ছোকরারা?” ন্যুট বেশ খুশি খুশি স্বরে জিজ্ঞেস করল।
এর আগেও ওর এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ও একবার জাহাজে আঙ্গাটাউ এসেছিল। কথা বলতে বলতে ও হোঁচট খেয়ে আধ কেটলি গরমজল উপুড় করে দিল বেঙ্গটের পায়ের ওপর। প্রথমদিন ডাঙায় আমরা সবাই একটু লগবগ করছিলাম, ১০১ দিন সমুদ্রে ভেলায় ভেসে থাকার পর হঠাৎ করে ডাঙায় গাছের গুঁড়িগুলোর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, পা ফেলে তাল সামলানোর মতো কোনো ঢেউ যে ছিলই না!
বেঙ্গট হাতে হাতে মেসটিন ধরিয়ে দিলে এরিক আকর্ণ হাসল। আমি মনে করতে পারি, ভেলায় শেষ খাবারটা খাওয়ার পর আমি ভেলার একপাশে শুয়ে পড়ে রোজকার মতো বাসন ধুয়েছিলাম আর ওদিকে এরিক প্রবালপ্রাচীরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলছিল, “আমার মনে হয় না আজ আর বাসন ধুতে হবে।”
পরে রান্নার বাক্সের মধ্যে যখন বাসনকোসনগুলো দেখা হল, ও দেখল ওরটা আমার মতোই পরিষ্কার।
খাওয়াদাওয়ার পর মাটির ওপরেই চমৎকার একপ্রস্থ গড়িয়ে নেওয়ার পর আমরা ভিজে যাওয়া রেডিও সেটটা ঠিকঠাক করতে বসলাম। এটা আমাদের দ্রুত করে ফেলতে হবে যাতে রারোটাঙ্গার লোকটা আমাদের দুঃখজনক পরিণতির বার্তা পাঠিয়ে দেবার আগেই টরস্টাইন আর ন্যুট যোগাযোগ করতে পারে!
বেশিরভাগ রেডিওর যন্ত্রপাতিই তীরে নিয়ে আসা হয়েছিল। যেগুলো প্রাচীরের ওপরে ভাসছিল, তার মধ্যে বেঙ্গট একটা বাক্স পেয়ে তাতে হাত দিয়েছিল। অমনি ও ইলেকট্রিক শক খেয়ে শূন্যে ছিটকে পড়েছিল; কোনো সন্দেহ ছিল না জিনিসগুলো রেডিওরই যন্ত্রপাতি। অপারেটররা ওগুলো খুলে জোড়া লাগিয়ে আবার ট্রান্সমিটার তৈরি করতে করতে আমরা বাকিরা ক্যাম্পটা গুছিয়ে ফেলতে শুরু করলাম।
ধ্বংসস্তূপের ভেতর জলে ডুবে থাকা ভারী পালটা পেলাম, ওটাকে পাড়ে টেনে আনলাম। দুটো বড়ো নারকেলগাছের মাঝে ওটাকে টানটান করে আটকানো হল। গাছদুটোর মাঝের ফাঁক দিয়ে হ্রদ দেখা যায়; ভাঙা ভেলা থেকে ভেসে আসা দুটো বাঁশের খুঁটিতে বাকি কোণদুটো আটকানো হল। চারপাশের বুনো ফুলের ঘন ঝোপঝাড় থাকায় পালটা জায়গামতো রয়ে গেল, ফলে আমরা তিনদিক ঘেরা ছাদওয়ালা একটা জায়গা পেলাম যেখান থেকে সামনের ফাঁকা অংশ দিয়ে উজ্জ্বল হ্রদটা পরিষ্কার দেখা যায়। বাতাসে মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভাসছিল। দারুণ লাগছিল জায়গাটা। সকলেই বেশ খুশি খুশি, আরাম উপভোগ করছিল। বালির মধ্যে থেকে নুড়ি, প্রবালের টুকরো-টাকরা সরিয়ে, সবুজ নারকেল পাতা বিছিয়ে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বিছানা পেতে নেওয়া হল। রাত নেমে আসার আগেই খুবই আরামদায়ক বিশ্রাম হল যাহোক; মাথার ওপরে দেখতে পাচ্ছিলাম বুড়ো কনটিকির দাড়িওয়ালা বিরাট মুখ। পুব বাতাসে সে আর বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। এখন ও নিশ্চল, চিত হয়ে পলিনেশীয়ার আকাশের মিটমিটে তারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
চারপাশের ঝোপে ভিজে পতাকা আর স্লিপিং ব্যাগগুলো মেলে দেওয়া, বাকি ভিজে জিনিসগুলো শুকোনোর জন্য বালির ওপরে ফেলা। আরেকটা দিন এই দ্বীপে রোদ্দুর পেলেই সবকিছু শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাবে। রেডিওর লোকেদেরও যন্ত্রপাতি পরদিন রোদ্দুর উঠলে ফেলে রাখতে হবে যাতে যন্ত্রের ভেতরটা শুকনো হয়ে ওঠে। আমরা স্লিপিং ব্যাগগুলো গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে ভেতরে সেধিঁয়ে গেলাম, একচোট তক্কাতক্কি হল কারটা সবচেয়ে শুকনো এই নিয়ে। বেঙ্গট জিতল কারণ ও যখন পাশ ফিরল, স্লিপিং ব্যাগটা জলে প্যাচপ্যাচ করে উঠল না। আহা, ঘুমোতে পারার কী যে সুখ!
পরদিন সূর্য উঠলে ঘুম ভেঙে দেখি পালটা ঝুলে এসেছে আর তাতে পরিষ্কার ঝকঝকে বৃষ্টির জল। বেঙ্গট জলটার ব্যবস্থা করল, তারপর হেলেদুলে হ্রদের দিকে গিয়ে বালিতে খাল কেটে টোপ দিয়ে অদ্ভুত দেখতে কয়েকটা মাছ তুলে আনল প্রাতরাশের জন্য।
সেদিন রাতে হারম্যান বলল যে লিমা থেকে আসার আগে যে চোটটা লেগেছিল, ঘাড়ে আর পিঠে, সেখানটায় ব্যথা করছে। এদিকে এরিকের কোমরের পেছনের ব্যথাটাও ফিরে এসেছে। তা বাদে, প্রবালপ্রাচীরটা আমরা আশ্চর্যজনকভাবে কেটে ছড়ে যাওয়ার মতো হালকা চোট আঘাত নিয়েই পেরিয়ে আসতে পেরেছি, কেবল বেঙ্গট বাদে। মাস্তুল ভেঙে পড়ায় ওর কপালে প্রচণ্ড আঘাত লাগে, অল্পক্ষণ অজ্ঞানও হয়ে গেছিল। আমারটাও অদ্ভুত, দড়ির চাপে সারাটা হাতে পায়ে নীল-কালো কালশিটে পড়ে গেছে।
কিন্তু আমরা কেউই এতখানি খারাপ ছিলাম না যে অমন চমৎকার ঝকঝকে হ্রদের জলে প্রাতরাশের আগে হালকা সাঁতারের লোভ এড়াতে পারব। বিশাল একটা হ্রদ। দূরে হালকা নীল জল, তিরতির বাতাসে ঢেউ দিচ্ছে জলে। হ্রদটা এত চওড়া যে অন্য পাড়ের প্রবালপ্রাচীরের বাঁক বরাবর বাকি দ্বীপগুলোর নারকেলগাছের মাথা আবছা নীল রেখার মতো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এদিকে দ্বীপের এইপাশে, খুব আস্তে আস্তে বাতাস বইছে, পাতাগুলো কাঁপছে, গাছের মাথাগুলো অল্প অল্প দুলছে, হ্রদের জল শান্ত স্থির আয়নার মতো, তাতে এই সমস্ত কিছুর সুন্দর ছায়া পড়েছে। সমুদ্রের জল এতটাই পরিষ্কার আর স্বচ্ছ যে ন’ফুট গভীর জলের নীচের রঙবেরঙের প্রবালগুলো মনে হচ্ছিল হাতের নাগালে, যেন সাঁতরাতে গেলে ওতে আঙুল কেটে যেতে পারে। জলে অসংখ্য সুন্দর সুন্দর রঙিন মাছ। অসাধারণ একটা জায়গা যেখানে যে কেউ মহানন্দে থাকতে পারে। সুন্দর ঠান্ডা আরামদায়ক জল, চমৎকার রোদ্দুর, হালকা বাতাস। কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি জল ছেড়ে উঠে পড়তে হবে। আজকের মধ্যে খবর না পেলে রারোটাঙ্গা সতর্কতা বার্তা ছড়িয়ে দেবে।
কয়েল আর রেডিওর অংশগুলো প্রবালখণ্ডের ওপর রোদে শুকোচ্ছিল। টরস্টাইন আর ন্যুট ওগুলো স্ক্রু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে ফেলল। হু হু করে দিন ফুরিয়ে আসছে, আমাদের অবস্থা ক্রমশ অস্থির থেকে অস্থিরতর। সক্কলে অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে রেডিওর পাশে জড়ো হয়েছি যাতে কোনোরকম সাহায্য করা যায়। রাত দশটার আগে বেতার সংকেত পাঠাতেই হবে। ওই সময়ের পর ছত্রিশ ঘণ্টার সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে আর রারোটাঙ্গার রেডিও অ্যামেচারটি, এরোপ্লেন আর উদ্ধারকারীদলের জন্য আমাদের আবেদনটা পাঠিয়ে দেবে।
দুপুর এল, বিকেল এল, সূর্য অস্ত গেল। রারোটাঙ্গার লোকটা যদি একটু ধৈর্য ধরে! সাতটা বাজল, আটটা, ন’টা। উত্তেজনা চরমে। বেতার-প্রেরক যন্ত্রে কোনো প্রাণের লক্ষণ নেই। কিন্তু একটা গ্রাহকযন্ত্র, এনসি ১৭৩, হঠাৎ একবার ক্ষীণ সাড়া দিয়ে উঠল, আর আমরা ওটায় একটা হালকা আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু ওটা কোনো অ্যামেচার তরঙ্গ নয়। ওটা ক্রমশ একদিক থেকে বাড়ছিল, সম্ভবত, ভেজা তারের কুণ্ডলী ভেতরে ভেতরে একদিক থেকে শুকিয়ে উঠছিল। বেতার-প্রেরক, তখনো এক্কেবারে চুপচাপ, নিঃশব্দ—শর্ট সার্কিট আর স্ফুলিঙ্গ উঠছে সর্বত্র, থেকে থেকে।
আধঘণ্টা মতো বাকি। আর হবে না। নিয়মিত বেতার-প্রেরক যন্ত্রটা জবাব দিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধের সময় গোপনে ব্যবহার করা হত এরকম আরেকটা প্রেরক যন্ত্র ছিল, সেটায় আবার চেষ্টা করা হল। দিনেরবেলা অনেকবার তাতে চেষ্টা করা হয়েছিল। এখন মনে হয় ওটা আর একটু শুকনো হয়ে উঠেছে। ব্যাটারিগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে, এখন একটা ছোটো হাতে চালানো জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। ওটা বেশ ভারী, আর আমরা চারজন যারা রেডিওর ব্যাপারে একেবারেই কিছু জানি না, পালা করে করে ওটা চালাতে থাকলাম।
ছত্রিশ ঘণ্টা সময়সীমা শিগগিরি শেষ হয়ে যাবে। আমার মনে আছে, কেউ একটা ফিসফিস করে বলেছিল, “আর সাত মিনিট মাত্র,” “আর পাঁচ মিনিট,” এরপর আর কেউ নিজের ঘড়ির দিকে তাকায়নি। প্রেরকটা একইরকম নিশ্চুপ, কিন্তু গ্রাহকযন্ত্রের আলোটা ডানদিকের তরঙ্গ বরাবর ক্রমশ বাড়ছিল। হঠাৎ ওটা রারোটাঙ্গার লোকটার তরঙ্গে বেজে উঠল এবং আমরা জানতে পারলাম, ও তাহিতির টেলিগ্রাফ স্টেশনের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযোগ রেখে চলেছে। খুব শিগগিরই আমরা রারোটাঙ্গা থেকে যে বার্তা গেছে তার ভাঙা ভাঙা অংশ উদ্ধার করতে পারলাম, আর সেটা এইরকম—
‘…সামোয়ার এইদিকে কোনো বিমান নেই, আমি নিশ্চিত…’
তারপর ওটাও চুপ হয়ে গেল। উত্তেজনাটা আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না। কী যে চলছে ওখানে? ওরা কি উদ্ধারকারী দল আর বিমান ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছে? এখন, সন্দেহ নেই, চতুর্দিকে আমাদের ব্যাপারে সংবাদ চালাচালি হচ্ছে।
দুই অপারেটর জোর কদমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ওদের মুখ থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল, আমাদেরও, যারা বসে বসে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে চলেছিলাম। বেতার-প্রেরক যন্ত্রের এরিয়ালে খুব ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ আসছিল আর টরস্টাইন মর্স-কী টিপতেই হঠাৎ খুব উল্লসিত হয়ে একটা তিরচিহ্নের দিকে দেখাল যেটা প্রেরকযন্ত্রের স্কেলের ওপরে এক ধাপ ওপরে উঠল। এইবারে আসছে।
আমরা পাগলের মতো হ্যান্ডেল ঘোরাতে থাকলাম আর টরস্টাইন রারোটাঙ্গাকে বার্তা পাঠাতে থাকল। কেউ শুনল না। আরেকবার করা হল। এইবারে গ্রাহকযন্ত্র আবার সচল হল, কিন্তু রারোটাঙ্গা আমাদের কথা শুনতে পায়নি। আমরা লস অ্যাঞ্জেলিসে হ্যাল আর ফ্র্যাঙ্ককে বার্তা দিলাম, লিমার নৌসেনা স্কুলেও, কিন্তু কেউই শুনল না।
তখন টরস্টাইন একটা সিকিউরিটি বার্তা পাঠাল; তার মানে ও পৃথিবীর সমস্ত রেডিও স্টেশনের জন্য বার্তা পাঠাল যারা আমাদের বিশেষ অ্যামেচার তরঙ্গ ধরলে শুনতে পাবে।
ওটা খানিক কাজ করল। এবারে বেতারে একটা ক্ষীণ স্বর শোনা গেল, খুব ধীরে আমাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। আমরা আবার সংকেত দিলাম, বললাম যে ওর কথা শুনতে পাচ্ছি। ক্ষীণ আওয়াজটা ও-পাশ থেকে সারা দিল, “আমার নাম পল, আমি কলোরাডোয় থাকি। তোমার নাম কী? কোথায় থাকো তুমি?”
এটাও একজন রেডিও অ্যামেচার। টরস্টাইন চাবি টিপতে থাকে, আমরা হ্যান্ডেল ঘোরাতে থাকি, উত্তর দিই, “কনটিকি থেকে বলছি। আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের একটা জনমানবশূন্য দ্বীপে এসে ঠেকেছি।”
পল বিশ্বাস করেনি। সে ভেবেছিল পাশের পাড়ার কোনো রেডিও অ্যামেচার ওর সাথে ঠাট্টা করছে এবং ও আর সংযোগ রাখল না। আমরা হতাশায় মাথার চুল ছিঁড়ছিলাম। এখানে আমরা একটা জনমানবশূন্য দ্বীপে ফুটফুটে তারাভরা আকাশে, নারকেলগাছের পাতার নীচে বসে আছি, আর কেউ সে-কথা বিশ্বাস করছে না।
টরস্টাইন হাল ছাড়েনি। ক্রমাগত চাবি টিপে টিপে অনবরত পাঠাতে লাগল, “সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে।”
যে-কোনো মূল্যে প্রশান্ত মহাসাগরে উদ্ধারকার্যটা চালু হওয়াটা আমাদের বন্ধ করতে হবে।
তখনই গ্রাহকযন্ত্রে শুনলাম, খুব ক্ষীণভাবে, “যদি সব ঠিক থাকে, ভাবনা কীসের?”
তারপর আবার সব চুপচাপ। ওইটুকুই কেবল।
আমরা বাতাসে লাফালাফি করতে পারতাম এবং চূড়ান্ত হতাশায় সমস্ত নারকোলগুলো ঝেঁকে ফেলতে পারতাম আর ভগবান জানেন রারোটাঙ্গা আর পুরোনো বন্ধু হ্যাল যদি আচমকা আমাদের বার্তাটা না শুনে ফেলত, আমরা কী যে করতাম! এল-আই-টুবি তরঙ্গে আবার আমাদের কথা শুনে হ্যাল আনন্দে কেঁদে ফেলল। সমস্ত উৎকণ্ঠাটা নিমেষে উবে গেল। আবার আমরা একলা, দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপে নিরুপদ্রবে, পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়ে, পাতার বিছানায় পড়ে রইলাম।
পরদিন আমরা আবার খুব সহজ হয়ে চুটিয়ে উপভোগ করতে থাকলাম। কেউ স্নান করছিল, কেউ মাছ ধরছিল অথবা প্রবালপ্রাচীরের দিকটা দেখতে গেল, যদি কোনো অদ্ভুত সামুদ্রিক জীবের দেখা পাওয়া যায় আর সবচেয়ে সক্রিয় লোকটা ক্যাম্পটা গুছিয়ে গাছিয়ে চারপাশটা খুব সুন্দর করে রাখল। যেদিকে কনটিকিকে দেখা যাচ্ছে, ক্যাম্পের সেদিকে গাছের সারির কাছে গর্ত খুঁড়ে চারপাশে পাতার বেড়া দিয়ে, পেরু থেকে আনা নারকেল-চারা পুঁতে দিলাম আমরা। পাশে প্রবাল দিয়ে একটা কেয়ার্ন বানানো হল, কনটিকি যেদিকে এসে ভিড়েছিল ঠিক তার উলটো পাড়ে।
রাতের বেলা কনটিকি আরো খানিকটা ভেসে ভেতরে ঢুকে এসেছিল। প্রাচীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে প্রবালখণ্ডে ঘেরা কয়েকটা ছোটো ছোটো জলাশয়ের মাঝে প্রায় শুকনোই হয়ে ছিল।
বালিতে শুয়ে বেশ খানিকটা রোদে পুড়ে ভাজা ভাজা হয়ে এরিক আর হারম্যান আবার সতেজ ও ঝরঝরে হয়ে উঠেছিল, ওরা প্রবালপ্রাচীর ধরে দক্ষিণের দিকে বড়ো দ্বীপটাতে যেতে খুবই উদগ্রীব ছিল। আমি ওদের হাঙরের চেয়েও ইল মাছ সম্বন্ধে বেশি সতর্ক করলাম, তাতে ওরা ওদের কোমরের বেল্টে বড়ো ম্যাশেট ছুরি গুঁজে নিল। আমি জানতাম প্রবালপ্রাচীরই হল ভয়ানক ইল মাছেদের বাসস্থান, বড়ো বড়ো বিষাক্ত দাঁতে ওরা অনায়াসে মানুষের পা ছিঁড়ে নিতে পারে। এঁকে-বেঁকে বিদ্যুৎগতিতে এসে আক্রমণ করে ওরা; স্থানীয় যে লোকেরা হাঙরের পাশে সাঁতার কাটতে ভয় পায় না তাদের কাছেও এরা আতঙ্ক বিশেষ।
ওরা দুজন লম্বা প্রবালপ্রাচীর বরাবর জল ঠেলে ঠেলে দক্ষিণদিকে চলল। মাঝে মাঝে এক-একটা খাঁড়ি পড়লে ওদের সাঁতরে পার হতে হচ্ছিল। ওরা নিরাপদেই বড়ো দ্বীপটায় পৌঁছে জল ঠেলে ঠেলে ডাঙায় উঠল। দ্বীপটা সরু আর লম্বাটে, নারকেলগাছে ছাওয়া, আরো খানিকটা দক্ষিণ বরাবর বিস্তৃত, প্রবালপ্রাচীরের দিকটায় চমৎকার রোদভাসা বেলাভূমি। ওরা দুজন দ্বীপের দক্ষিণতম বিন্দু অবধি হেঁটে গেল। ওখান থেকে দেখা যায় প্রবালপ্রাচীরটা সাদা ফেনায় ঢাকা, আরো দক্ষিণে আরেকটা দূরবর্তী দ্বীপের দিকে চলে গেছে। ওরা ওখানে একটা বড়ো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছিল; সেটাতে চারটে মাস্তুল, পাড়ের ওপর দু-আধখানা হয়ে পড়ে ছিল। একটা পুরোনো স্প্যানিশ পালতোলা জাহাজ, রেলের লাইনে ভর্তি; গোটা প্রবালপ্রাচীর বরাবর জংধরা লাইনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ফেরার সময় ওরা দ্বীপের অন্যপাশ দিয়ে এসেছিল, সেদিকটায় বালিতে কোনো চলাচলের রাস্তা অবশ্য ওরা পায়নি।
প্রবালপ্রাচীর দিয়ে ফেরবার পথে ওরা একের পর এক অদ্ভুত অদ্ভুত মাছ দেখতে পাচ্ছিল আর তার মধ্যে কয়েকটা ধরতেও চেষ্টা করছিল, এমন সময় হঠাৎ আটখানা বড়ো বড়ো ইল মাছ ওদের আক্রমণ করে বসল। পরিষ্কার জলে মাছগুলো আসতে দেখেই একটা গোলাকার বড়ো প্রবালখণ্ডের ওপর লাফ দিয়ে উঠে পড়েছিল ওরা, ইল মাছগুলো ওটারই তলায় এসে ঘোরাঘুরি করছিল। ছিপছিপে শয়তানগুলো পায়ের গোছের মতো মোটা, গায়ে বিষাক্ত সাপের মতো সবুজ-কালো ছিট ছিট, ছোটো মাথায় কুঁতকুঁতে সাপের মতো চোখ, ইঞ্চি খানেক লম্বা ফোঁড়ানির মতো তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁত। একটা মাছ কাছাকাছি আসতেই আমাদের লোকেরা ওর ছোটো মাথাটা ছুরি দিয়ে দু-টুকরো করে দিল আর আরেকটাকে জখম করল। রক্তের গন্ধে এইবারে ছোটো ছোটো নীল হাঙরের ঝাঁক এসে মৃত আর জখম হওয়া ইল মাছদুটোকে আক্রমণ করল, এই ফাঁকে এরিক আর হারম্যান লাফিয়ে অন্য একটা পাথরে উঠে পালিয়ে এসেছিল।
সেদিনই জল ঠেলে ডাঙার দিকে ওঠার সময় কিছু একটা বিদ্যুতগতিতে এসে আমার গোড়ালির ওপরে দু-দিক থেকে শক্ত করে কামড়ে ধরল। ওটা একটা কাটল ফিশ ছিল। খুব একটা বড়ো নয় কিন্তু একটা ঠান্ডা আঁকশির মতো আটকে ধরায়, আর ওর নীলচে-লাল, চ্যাপটা ঠোঁটওয়ালা থলের মতো শরীরে শয়তানের মতো কুঁতকুঁতে চোখে চোখ পড়তে একটা শিরশিরে অনুভূতি হল। আমি যত জোরে পারি পায়ে একটা ঝটকা দিলাম; স্কুইডটা, মেরেকেটে তিন ফুট হবে, ওইরকমই আটকে রইল, ছাড়ল না। আমার পায়ের ব্যান্ডেজটা বোধ হয় ওটাকে আকৃষ্ট করেছিল। আমি ঝটকা দিতে দিতে পাড়ের দিকে এগোচ্ছিলাম, অসহ্য প্রাণীটা পা থেকে ঝুলছিল। শুকনো বালিতে পৌঁছতে তবে ওটা পা ছেড়ে গেল আর তারপর যদি আমি আক্রমণ করি এই ভেবে চোখদুটো পাড়ের দিকে রেখে, আস্তে আস্তে শুঁড়গুলো ছড়িয়ে অগভীর জলে নেমে গেল। আমি কয়েকটা প্রবালের টুকরো ছুড়তেই ওটা তিরবেগে দূরে সরে গেল।
দ্বীপে স্বর্গসুখে থাকার মধ্যে একটু বৈচিত্র্য এনেছিল কেবল প্রবালপ্রাচীর বরাবর আমাদের এইরকম নানান অভিজ্ঞতা। কিন্তু সারাজীবন তো এখানে কাটাতে পারব না, বাইরের পৃথিবীতে কীভাবে যাওয়া যায় তার উপায় ভাবতে হবে। এক সপ্তাহ বাদে কনটিকি ভেসে ভেসে প্রবালপ্রাচীরের মাঝামাঝি শুকনো জায়গায় এসে ঠেকেছিল। বিরাট গুঁড়িগুলো হ্রদের দিকে সরে আসার সময় মুখোমুখি প্রবালের বড়ো বড়ো খণ্ডগুলো ভেঙে দিয়েছিল, কিন্তু এখন ওটা নিশ্চল হয়ে পড়ল আর আমাদের বহু টানাহ্যাঁচড়াতেও কোনো ফল হল না। কোনোমতে ওটাকে হ্রদে এনে ফেলতে পারলে, যা-হোক করে মাস্তুলটা খাড়া করে শান্ত হ্রদে অনুকূল বাতাসে দিব্যি ভাসিয়ে নিয়ে অন্যপাশে কী আছে দেখা যেত। যদি কোনো একটা দ্বীপে জনবসতি থাকেও, সেটা পুব দিগন্তের দ্বীপগুলোর মধ্যেই হবে। প্রাচীরের দেওয়ালটা ওদিকে ঘুরে পাড়ের কাছে নীচু হয়ে এসেছে।
কয়েকদিন কেটে গেল।
তারপর একদিন সকালে আমাদের ক’জন বন্ধু হুড়দাড় করে এসে বলল, ওরা হ্রদের বুকে সাদা রঙের পাল দেখেছে। নারকেলগাছের ওপরে উঠে দেখা গেল নীল মরকত মণির মতো হ্রদে একটুখানি ছোট্ট সাদা ছিট। ওটা নিশ্চিতভাবেই উলটোদিকের পাড়ের কাছাকাছি কোনো নৌকোর পাল। ওটা মুখ ঘুরিয়ে ভেসে চলেছে। পাশে পাশেই আরেকটা দেখা গেল।
ক্রমশ ওগুলোর আকার বড়ো হতে থাকল, সকালবেলাটা পার হতে হতে ওগুলো আরো কাছে চলে এল। ওরা সোজা আমাদের দিকেই আসছে। আমরা একটা নারকেলগাছে ফরাসি পতাকা বেঁধে দিয়ে, একটা লাঠির ডগায় নরওয়ের পতাকা নিয়ে নাড়তে থাকলাম। একটা নৌকো ততক্ষণে এতটাই কাছে এসে গেছে যে বুঝতে পারলাম ওটা একটা পলিনেশীয় সামুদ্রিক ক্যানো। ক্যানোটা বেশ আধুনিক। দুটো বাদামি চামড়ার লোক সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকেই দেখছে। আমরা হাত নাড়লাম। ওরাও উত্তরে হাত নাড়ল আর সোজা হ্রদের অগভীর অঞ্চলটায় চলে এল।
“লা-ওরা-না।” পলিনেশীয় ভাষায় আমরা অভ্যর্থনা জানালাম।
“লা-ওরা-না।” ওরা সমস্বরে বলে উঠল আর একজন লাফ দিয়ে জলে নেমে ক্যানোটা পেছনে টেনে টেনে জল ঠেলে ঠেলে পাড়ের দিকে সোজা আমাদের দিকেই নিয়ে এল।
দুজন লোকের সাদা চামড়ার লোকেদের মতো পোশাক, কিন্তু গায়ের রঙ বাদামি। খালি পা, সুঠাম চেহারা, রোদ থেকে বাঁচতে ঘরে বোনা বাঁশের টুপি মাথায়। ওরা নেমে আমাদের দিকে একটু ইতস্তত করে এগোল, কিন্তু আমরা হাসিমুখে হাত মেলাতেই ওদের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, ঝকঝকে দাঁতের সারি কথার চেয়েও অনেক বেশি বলে দিচ্ছিল।
পলিনেশীয় ভাষায় আমাদের অভ্যর্থনা ক্যানোর লোকদুটোকে যেমন অবাক করেছিল তেমনি উৎসাহিতও করেছিল, ঠিক যেমন আঙ্গাটাউয়ে ওদের বন্ধুদের ‘গুড নাইট’ শুনে আমাদের হয়েছিল, এদিকে পুরোটাই যে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারার আগেই ওরা ওদের ভাষায় হু হু করে আরো একগাদা কথা বলে গেল। এরপর আর কিছু বলার ছিল না ওদের, শুধু হাসছিল আর অন্য ক্যানোটার দিকে দেখাচ্ছিল।
ওটায় তিনটে লোক ছিল। ওরা যখন পাড়ে এল আর অভ্যর্থনা জানাল আমাদের, আমরা বুঝতে পারলাম ওদের মধ্যে একজন খানিকটা ফরাসি বলতে পারে। জানলাম হ্রদের অন্য পাড়ে দ্বীপগুলোর একটাতে স্থানীয়দের একটা গ্রাম আছে, আর ওখান থেকেই ওরা কয়েকদিন আগে আমাদের জ্বালানো আগুন দেখতে পেয়েছিল। রারোরিয়া প্রবালপ্রাচীর ডিঙিয়ে হ্রদের ভেতরে গোল হয়ে থাকা দ্বীপগুলোতে যাবার জন্য প্রাচীরে একটাই ভেতরে ঢোকার রাস্তা আছে আর সেটা ঠিক ওদের গ্রামের কাছ দিয়েই গেছে ফলে প্রাচীর পেরিয়ে কেউ ভেতরের দ্বীপে এলে গ্রামের লোকের দেখতে পাবে না তা হয় না। সুতরাং পুবের দিকে প্রাচীরের ওপরে আলো দেখে গাঁওবুড়োরা সিদ্ধান্তে এসেছিল যে ওটা মানুষের কীর্তি নয়, নিশ্চিত অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাপার। ফলে হ্রদ পেরিয়ে বিষয়টা দেখার ইচ্ছে ওদের চুপসে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর একটা বাক্সের অংশ হ্রদের জলে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পড়ল ওপারে, ওটার ওপরে কিছু লেখা-টেখা ছিল। স্থানীয়দের মধ্যে দুজন ওটা পড়তে পেরেছিল। তাহিতিতে একসময় থাকত বলে তাদের অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল, তাই কাঠের পাটার ওপরে কালো বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘টিকি’ কথাটা ওরা পড়তে পারল। এর ফলে তাদের আর সন্দেহ রইল না যে প্রাচীরের ওপরে অশরীরীর ব্যাপার-স্যাপারই ছিল, কারণ ওরা সকলেই জানত যে ‘টিকি’ অর্থাৎ তাদের পূর্বপুরুষ, বহু আগেই মরে ভূত হয়ে গেছেন। কিন্তু আবার টিনভর্তি রুটি, সিগারেট, কোকো আর পুরোনো জুতো সহ একটা বাক্স হ্রদের জলে ভাসতে ভাসতে এল। এইবারে তারা বুঝতে পারল, পূর্বদিকে, প্রবালপ্রাচীরে নিশ্চয়ই কোনো জাহাজডুবি হয়েছে। সর্দার এইবারে জাহাজডুবিতে বেঁচে যাওয়া লোকেদের খোঁজে দুটো ক্যানোয় লোক পাঠালেন এই ভেবে, যে তাঁদের জ্বালানো আগুনই ক’দিন আগে গ্রাম থেকে দেখা গিয়েছিল।
বাকিদের পীড়াপীড়িতে বাদামি চামড়ার যে লোকটা ফরাসি ভাষা জানত, সে প্রশ্ন করল, কাঠের যে টুকরোটা হ্রদের ওপাশে ভেসে চলে গিয়েছিল তাতে ‘টিকি’ লেখা ছিল কেন। আমরা ওকে বোঝালাম যে আমাদের সমস্ত কিছুর ওপরেই ‘কন-টিকি’ লেখা ছিল আর যাতে করে আমরা ভেসে এসেছিলাম, ওটা সেই জলযানটারই নাম।
আমাদের নতুন বন্ধুরা ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেল যখন শুনল, ভেলাটা এসে প্রাচীরে ঠেকে যাবার পরও সকলেই বেঁচে গিয়েছি আর ওই যে প্রবালপ্রাচীরের ওপর ভাঙাচোরা বস্তুটা দেখা যাচ্ছে ওটাই প্রকৃতপক্ষে আমাদের জলযান, যাতে করে আমরা এসেছি। ওরা আমাদের তক্ষুনি ক্যানোয় বসিয়ে গ্রামে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমরা ওদের ধন্যবাদ দিলাম, কিন্তু প্রস্তাবটা নাকচ করলাম, কারণ প্রাচীরের ওপর থেকে কনটিকিকে নামানো অবধি আমরা দ্বীপটায় থাকতে চাইছিলাম। ওরা প্রাচীরের ওপরে ভাঙাচোরা বস্তুটায় খুব আতঙ্কিত হয়ে তাকাল। নিশ্চিতভাবেই আমরাও ওটাকে আবার জলে ভাসাতে পারব স্বপ্নেও ভাবিনি! শেষমেশ ওদের মুখপাত্রটি আমাদের খুব করে বলল, যাতে ওদের সঙ্গে যাই; সর্দারের কড়া নির্দেশ ছিল যাতে আমাদের সঙ্গে না নিয়ে ওরা ফিরে না যায়।
তখন আমরা ঠিক করলাম আমাদের একজন, প্রতিনিধি হিসেবে ওদের সঙ্গে গিয়ে সর্দারের সাথে দেখা করবে আর তারপর ফিরে এসে অন্যান্য দ্বীপগুলোর অবস্থাটা আমাদের জানাবে। ভেলাটাকে প্রবালপ্রাচীরের ওপর ফেলে রেখে আর সমস্ত জিনিসপত্র আমাদের ছোট্ট দ্বীপে ফেলে রেখে তো আমরা চলে যেতে পারব না। স্থানীয়দের সঙ্গে গেল বেঙ্গট। ক্যানোদুটোকে বালি থেকে ঠেলে দেওয়া হল জলে আর অনুকূল বাতাসে ওরা পশ্চিমদিকে দ্রুত মিলিয়ে গেল।
পরদিন দিগন্ত সাদা সাদা পালে ছেয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল স্থানীয়রা তাদের যত নৌকো আছে সমস্ত নিয়ে সদলবলে আমাদের নিতে আসছে।
পুরো দলবল দাঁড় বাইতে বাইতে আমাদের দিকেই আসছিল; কাছাকাছি হতে দেখতে পেলাম আমাদের প্রিয় বন্ধু বেঙ্গট প্রথম ক্যানোটা থেকে আমাদের দিকে ওর টুপিটা নাড়ছে আর ওর চারপাশে বাদামি চামড়ার লোকজন। ও চেঁচিয়ে বলল, সর্দার ওর সঙ্গেই আছে, ফলে ওরা যেখানটায় এসে ভিড়বে আমরা পাঁচজনেই সসম্ভ্রমে নীচে গিয়ে সেখানে বালির ওপর গিয়ে দাঁড়ালাম।
বেঙ্গট সর্দারের সঙ্গে আমাদের বেশ আনুষ্ঠানিকভাবেই পরিচয় করাল। বেঙ্গট বলল, সর্দারের নাম টেপিউরাইয়ারি টেরিফাটু, কিন্তু ওকে টেকা নামে ডাকলেই ও বুঝবে। আমরা ওকে টেকাই বললাম।
টেকা লম্বা, ছিপছিপে পলিনেশীয় মানুষ, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, যা সাধারণত দেখা যায় না। লোকটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তাহিতির পুরোনো রাজঘরানার উত্তরাধিকারী, রারোরিয়া আর টাকুমে দ্বীপপুঞ্জের প্রধান। ও তাহিতির স্কুলে পড়াশোনা করেছে, ফলে ফরাসি জানে আর লিখতে ও পড়তে পারে। ও আমায় বলল, নরওয়ের রাজধানীর নাম ক্রিস্টিয়ানিয়া, আর আমায় জিজ্ঞাসা করল যে বিং ক্রসবিকে চিনি কি না। ও আরো বলল যে গত দশ বছরে মাত্র তিনটে বিদেশি জাহাজ রারোরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু গ্রামে প্রতিবছরই বেশ কয়েকবার তাহিতি থেকে মালপত্র নিয়ে মালবাহী জাহাজ, স্কুনার আসে আর নারকেলের শাঁস নিয়ে যায়। কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল স্কুনারটার চলে আসার কথা, সুতরাং যে-কোনো মুহূর্তেই ওটা চলে আসতে পারে।
বেঙ্গট যা রিপোর্ট দিল সংক্ষেপে তা এইরকম, রারোরিয়াতে কোনো স্কুল নেই, রেডিও নেই, কোনো সাদা চামড়ার মানুষও নেই কিন্তু গ্রামের ১২৭ জন পলিনেশীয় মানুষ যথাসাধ্য ব্যবস্থা করেছে আমাদের সুবিধের জন্য আর আমরা ওখানে পৌঁছলে সক্কলে দারুণ একটা অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
সর্দারের প্রথম অনুরোধ ছিল, যে নৌকোয় করে আমরা সশরীরে তীরে এসে পৌঁছেছি সেটা সে দেখবে। আমরা জল ঠেলে ঠেলে কনটিকির দিকে গেলাম, পেছন পেছন একদল স্থানীয় লোক। আমরা যখন কাছাকাছি এসেছি, স্থানীয়রা হঠাৎ থেমে গেল আর হৈ হৈ করে উঠল, সব্বাই একসঙ্গে কথা বলছিল। আমরা তখন কনটিকির কাঠের গুঁড়িগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। একজন স্থানীয় লোক চেঁচিয়ে উঠল, “ওটা তো নৌকো নয়, একটা পে-পে!”
“পে-পে!” সবাই একসঙ্গে হৈ হৈ করে উঠল।
জল ছিটিয়ে লাফাতে লাফাতে সক্কলে প্রাচীরের দিকে ছুটে গেল আর কনটিকির চারপাশে ভিড় করে এল। কনটিকির গুঁড়িগুলো, বাঁশের বেড়াগুলো, দড়িগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে একেবারে বাচ্চাদের মতো এখানে ওখানে ঘুরতে লাগল ওরা। সর্দারও বাকিদের মতো খুব উল্লসিত, সে বার বার এসে বেশ অনুযোগের সুরে বলতে লাগল, “টিকি তো নৌকো নয়। এটা একটা পে-পে।”
পলিনেশীয় ভাষায় ‘পে-পে’ মানে ভেলা বা প্ল্যাটফর্ম আর ইস্টার দ্বীপে স্থানীয়দের ক্যানো বোঝাতেও এই শব্দটা ব্যবহৃত হয়। সর্দার আমাদের বলল, এরকম ‘পে-পে’-র আর কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই, কিন্তু গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকেরা এই পুরোনো ঐতিহ্যের কথাটা জানে। স্থানীয়রা বড়ো বড়ো বালসা কাঠগুলো দেখে উচ্চৈঃস্বরে নিজেদের মধ্যে খুবই প্রশংসা করতে লাগল, কিন্তু দড়িগুলো দেখে নাক কুঁচকাচ্ছিল। এই ধরনের দড়ি সমুদ্রের নোনা জলে আর রোদ্দুরে কয়েকমাসের বেশি টেকে না। অন্যদিকে ওরা খুব গর্ব করে ওদের ক্যানোর দড়ির বাঁধনগুলো দেখাচ্ছিল; ওগুলো নারকেলের ছোবড়ার থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে ওদের নিজের হাতে বানানো। এই ধরনের দড়ি সমুদ্রে পাঁচ বছর অবধি নতুনের মতো থাকে।
আমরা আবার জল ঠেলে-ঠুলে আমাদের ছোট্ট দ্বীপে ফেরত এলাম, এটার নাম রাখা হয়েছিল, ‘ফেনুয়া কনটিকি’ অথবা ‘কনটিকি দ্বীপ’। এ-নামটা আমরা সকলেই উচ্চারণ করতে পারছিলাম কিন্তু আমাদের ছোটো নর্ডিক খ্রিস্টান নাম উচ্চারণ করতে নতুন বন্ধুদের খুব অসুবিধে হচ্ছিল। যখন আমি বললাম যে ওরা আমায় টেরাই মাটিইয়েটা বলে ডাকতে পারে, তখন ওরা খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল, কেননা প্রথমবার ওখানে থাকার সময় তাহিতির বুড়ো সর্দার আমাকে তার ছেলে বলে স্বীকার করে ওই নামটা দিয়েছিল। স্থানীয়রা তাদের ক্যানো থেকে মুরগি, ডিম আর ব্রেড ফ্রুট নিয়ে এল, তেকোনা ট্যাটা দিয়ে হ্রদ থেকে বড়ো একটা মাছ ধরে আনল এবং তারপর সকলে মিলে আগুন ঘিরে মহাভোজ হল। সমুদ্রের বুকে ‘পে-পে’-তে আসার সময় আমাদের যাবতীয় অভিজ্ঞতার গল্প ওদের বলতে হল আর ওরা বার বার তিমি-হাঙরের গল্পটাই শুনতে চাইছিল। প্রতিবারই যখন ওটার মাথায় এরিকের হারপুন গেঁথে দেবার কথাটা হচ্ছিল, ওরা একইরকম উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠছিল। যে-ক’টা মাছের ছবি ওদের দেখানো হল, তৎক্ষণাৎ সেটা ওরা চিনে ফেলছিল আর পলিনেশীয় ভাষায় তার নামটাও বলে দিচ্ছিল। কিন্তু ওরা তিমি-হাঙর কিংবা জেমপিলাসের কথা কখনো শোনেনি।
সন্ধ্যা হলে আমরা রেডিওটা খুললাম, গোটা জমায়েতটা তাতে মহা খুশি। গির্জার প্রার্থনা সংগীত ওদের পরিচিত, কিন্তু আমরা নিজেরাই আশ্চর্য হয়ে গেলাম, আমেরিকা থেকে যেটা ধরা হল সেটা সত্যিকার হুলা সংগীত। শুনেই স্থানীয়দের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত লোকগুলো মাথার পেছনে হাত জড়ো করে দুলতে লাগল, আর অচিরেই গোটা দলটা দাঁড়িয়ে পড়ে সংগীতের তালে তালে হুলা-হুলা নাচতে লাগল। রাত নামলে বেলাভূমির ওপরেই সকলে আগুনের চারপাশে শুয়ে পড়ল। এটা স্থানীয়দের কাছে যতটা, আমাদের কাছেও ঠিক ততটাই অ্যাডভেঞ্চার ছিল।
পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল, ওরা ততক্ষণে উঠে পড়ে সদ্য ধরা মাছ ভাজতে আরম্ভ করেছে, আর ছ’টা টাটকা নারকেল ভাঙা রয়েছে আমাদের তেষ্টা মেটাবে বলে।
সেদিন প্রবালপ্রাচীরে স্বাভাবিকের চেয়ে ঢেউয়ের গর্জন একটু বেশিই। বাতাসের জোর বেড়েছে আর ঢেউগুলোও ভাঙা ভেলাটার ওপাশে অনেক বেশি উঁচু হয়ে আছড়ে পড়ছে।
“টিকি আজকে ভেসে চলে আসবে।” সর্দার ভাঙাচোরা ভেলাটার দিকে দেখিয়ে বলল, “আজকে জোয়ার আসবে।”
এগারোটা নাগাদ জল উপচে হ্রদে এসে পড়তে লাগল, বড়ো একটা গামলার মতো ভরে উঠতে লাগল সেটা আর দ্বীপের চারপাশেই জলস্তর বেড়ে গেল। বেলা বাড়লে দেখা গেল সত্যিকার সমুদ্রের জলের স্রোত, একের পর এক, মুহুর্মুহু ঢেউ এসে এসে ক্রমশ প্রবালপ্রাচীরটাকে ডুবিয়ে দিতে লাগল। দ্বীপের দু-পাশ থেকেই জল ঢুকতে লাগল। বড়ো বড়ো প্রবাল-পাথরকে ভাসিয়ে, একদিক থেকে বালির ঢিবি উড়িয়ে দিল জলের তোড়, যেন হাওয়ায় ময়দার গুঁড়োর মতো উড়ে গেল, আবার অন্যদিকে বালির ঢিবি গড়ে উঠল। ভাঙাচোরা ভেলা থেকে আলগা বাঁশগুলো ভেসে ভেসে চলে এল, আর কনটিকিও এইবারে নড়ে উঠল। হ্রদের পাড়ে বালিতে যে-সমস্ত জিনিস পড়ে ছিল সেগুলো টেনে এনে দ্বীপের ভেতরের দিকে রাখা হল যাতে জোয়ারের জলের পাল্লায় না পড়ে যায়। শিগিগিরিই প্রাচীরের কেবলমাত্র সবচেয়ে উঁচু পাথরটাকেই জলের ওপরে দেখা যেতে লাগল, দ্বীপের চারপাশের বেলাভূমি উধাও আর জল ছোট্ট দ্বীপটার আগাছার জঙ্গলের সীমানা অবধি উঠে এল। বেশ ভয় লাগছিল। গোটা সমুদ্রই যেন আমাদের গিলে খাবে বলে এগিয়ে আসছে। কনটিকি ডানদিকে ঘুরে ভাসতে ভাসতে আরেকটা প্রবালের চাঁইতে এসে আটকে রইল।
স্থানীয়দের কয়েকজন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে খানিক সাঁতার, খানিক জল ঠেলে, পাড়ে পাড়ে হেঁটে কনটিকির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। ন্যুট আর এরিকও ওদের পেছন পেছন গেল। ভেলার ওপরে দড়ি-টরি সব বাঁধাই ছিল, ওটা শেষ প্রবালখণ্ডটার ওপর দিয়ে গড়িয়ে ভেসে প্রবালপ্রাচীর থেকে নেমে আসতেই, স্থানীয়রা লাফ দিয়ে ওর ওপরে উঠে বাগে আনবার চেষ্টা করতে লাগল। ওরা কনটিকিকেও জানত না, আর ওর নিয়ন্ত্রণরহিত পশ্চিমা গতির ব্যাপারেও জানত না, ফলে অসহায়ের মতো ওর সঙ্গেই ভেসে চলল। কনটিকি একটু পরেই যথেষ্ট গতি নিয়ে প্রবালপ্রাচীর থেকে হ্রদের জলে এসে পড়ল। শান্ত জলে এসে কেমন যেন খেই হারানোর মতো অবস্থা হল তার, যেন ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা জরিপ করে নিতে চাইল। আবার চলা শুরু করে দেবার আগে এবং হ্রদের থেকে বেরিয়ে যাবার মুখটা আবিষ্কার করে ফেলার আগেই স্থানীয় লোকজন ঝটপট ওতে লাগানো দড়ির অন্য প্রান্তগুলো ডাঙায় একটা নারকেলগাছে বেঁধে ফেলল। এবারে কনটিকি ওখানেই বাঁধা অবস্থায় হ্রদের জলে ভেসে রইল। ভেলাটা ডাঙায় এসে ঠেকেছিল, জল আবার তাকে রারোরিয়ার ভেতরের দিকে প্রাচীরের বাধা টপকে হ্রদের মধ্যে এনে ফেলল।
হেইও জোয়ান, প্রবল উৎসাহে স্থানীয়রা চেঁচিয়ে উঠল, “কে-কে-টে-হুরু-হুরু”; আর এভাবে আমরা সবাই মিলে কনটিকির নিজের নামে নাম দেওয়া দ্বীপের ওপর তাকে টেনে তুললাম। জোয়ারের জল স্বাভাবিকের চেয়ে চার ফুট উঁচুতে এসে ঠেকেছে। আমরা ভাবছিলাম, আমাদের চোখের সামনেই বুঝি গোটা দ্বীপটা ডুবে যাবে এইবার। বাতাসের ঝাপটায় হ্রদের চারদিকে ঢেউ ভেঙে পড়ছে। ভিজে ক্যানোর অল্প জায়গায় আমরা খুব বেশি মালপত্র তুলতে পারিনি। স্থানীয়দের চটপট গ্রামে ফিরে যেতে হবে, গ্রামে একটা বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চা মরতে বসেছিল। বেঙ্গট আর হারম্যান ওদের সঙ্গে গেল, ওকে দেখতে। বাচ্চাটার মাথায় একটা ফোঁড়া হয়েছিল, আর আমাদের কাছে পেনিসিলিন ছিল।
পরদিন কনটিকি দ্বীপে আমরা মাত্র চারজন, একলা। এবারে কনটিকির নীচে ডুব দিয়ে দেখা গেল ন’টা লগই ঠিকঠাক আছে, প্রাচীরের আঘাতে এক-দু ইঞ্চি ক্ষয়ে গেছে মাত্র। দড়ির বাঁধনগুলো এতটা গভীর হয়ে বসে গেছে যে অসংখ্য দড়ির মধ্যে কেবল চারটে দড়ি প্রবালে ঘষা লেগে কেটেছে। ভেলার ওপর থেকে ভাঙাচোরা জিনিসগুলো সরাতেই আমাদের গর্বের ভেলাটা আবার দিব্যি লাগছিল। চুপসে যাওয়া কেবিনটা আবার খাড়া করে তোলা হল, ভাঙা মাস্তুলটা আবার দাঁড় করানো গেল।
বেলার দিকে দিগন্তে আবার নৌকো দেখা দিল। স্থানীয়রা আমাদের এবং বাকি মালপত্র নিয়ে যেতে ফিরে আসছে। হারম্যান ও বেঙ্গট ওদের সঙ্গেই ছিল, বলল, গ্রামবাসীরা বিরাট উৎসবের আয়োজন করেছে। আমরা যখন অপর পাড়ে দ্বীপটায় পৌঁছব, সর্দার নির্দেশ না দেওয়া অবধি যেন ক্যানো থেকে দ্বীপে না নামি।
হ্রদটা সাত মাইল চওড়া, ওটা পেরোনোর পর পালে বাতাস পেল। খুব মনখারাপ লাগছিল যখন কনটিকি দ্বীপের চেনা নারকেলগাছগুলো হাওয়ায় দুলে দুলে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল। ক্রমশ ওটা ছোটো হতে হতে পুবের প্রবালপ্রাচীরের অন্যান্য দ্বীপগুলোর মতো আরেকটা ছোট্ট দ্বীপ হিসেবে রয়ে গেল, আলাদা করা আর যাচ্ছিল না। কিন্তু আমাদের সামনে বড়ো বড়ো দ্বীপগুলো আরো চওড়া ও স্পষ্ট হচ্ছিল। আর সেগুলোর একটায় আমরা একটা জেটিঘাট দেখতে পেলাম; দেখলাম নারকেলগাছের ফাঁকে কুটিরের ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছে।
গ্রামটা কেমন মরা মরা, একটা লোকেরও দেখা নেই। কী ঘটতে চলেছে? পাড়ে, প্রবাল পাথরে তৈরি জেটির পেছনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে, একজন লম্বা ছিপছিপে, আরেকজন বিরাট, পিপের মতো চেহারা। আমরা কাছাকাছি হতে দুজনকেই অভিবাদন করলাম। ওরা ছিল প্রধান সর্দার টেকা আর উপসর্দার টুপুহো। টুপুহোর আন্তরিক হাসিটা আমাদের বড়ো ভালো লাগল। টেকার মাথা খুব পরিষ্কার আর ও বেশ কূটনীতিকও, কিন্তু টুপুহো একেবারে শিশুর মতো, চমৎকার স্বভাবের, একাধারে আমুদে আর আদিম, কালেভদ্রে এমন লোকের দেখা পাওয়া যায়। ওর শক্তসমর্থ চেহারা আর রাজকীয় লক্ষণ দেখে বলাই যায় পলিনেশীয় সর্দার ঠিক এমনিই হওয়া উচিত। টুপুহোই দ্বীপের আসল সর্দার ছিল, কিন্তু ক্রমশ টেকা সর্বোচ্চ জায়গাটা নিয়ে নেয়, কেননা ও ফরাসি বলতে পারত আর লিখতে ও গুনতেও জানত, ফলত তাহিতি থেকে মালবাহী জাহাজ নারকেলের জন্য এলে ওদের ঠকাতে পারত না।
টেকা আমাদের বুঝিয়ে দিল যে আমাদের সার বেঁধে গ্রামের সভাঘরে যেতে হবে। সেইমতো সবাই ডাঙায় নামলে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে লাইন দিয়ে রওনা হলাম। হারম্যান প্রথমে, হারপুনের ডগায় পতাকা লাগিয়ে, তারপর আমি দুই সর্দারের মাঝে।
গ্রামের সঙ্গে তাহিতির নারকেলের ব্যাবসার ছাপ সর্বত্র স্পষ্ট। মালবাহী জাহাজে পাটাতন আর করোগেটেড টিনের দুটোরই আমদানি করা হয়েছে। কয়েকটা ঘরবাড়ি অবশ্য প্রাচীন শৈলীতে তৈরি, গাছের ডাল আর নারকেল পাতায় বানানো, বাকি সবই বানানো পেরেক দিয়ে কাঠের পাটাতন জুড়ে জুড়ে, ছোটো ছোটো নিরক্ষীয় অঞ্চলের বাংলোর মতো। নারকেল গাছের সারির মধ্যে একটা বাড়ি বেশ বড়ো, একটেরে, কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো, গ্রামের নতুন সভাঘর। ওখানেই আমাদের ছ’জনের থাকার ব্যবস্থা। আমরা পতাকা নিয়ে এক-দো-তিন-এক করতে করতে একটা ছোটো দরজা দিয়ে ঢুকে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের সামনে উঠোনে গ্রামের সব্বাই জড়ো হয়েছে, যারা হাঁটতে পারে কি হামাগুড়ি দিতে পারে, মহিলা থেকে শিশু, বৃদ্ধ থেকে জোয়ান সব্বাই। সবাই খুব সিরিয়াস, এমনকি কনটিকি দ্বীপ থেকে আমাদের সঙ্গে আসা হাসিমুখ বন্ধুরাও ভিড়ের মধ্যে রয়েছে, তারা অবধি গম্ভীর, চিনতে পর্যন্ত পারছে না আমাদের।
আমরা সবাই মিলে এসে সিঁড়িতে জড়ো হলে, গোটা জমায়েতটা একসঙ্গে মিলে ‘মারসেইলেইজ’ গাইতে শুরু করল। টেকা, কথাগুলো জানত, ওই ছিল প্রধান গায়ক, বাকিরা কোরাসে। ভালোই গাইছিল সকলে, যদিও কয়েকজন বয়স্কা মহিলা উঁচু পর্দায় উঠে গিয়েছিল, তবুও। এটার জন্য খুব মহড়া দিয়েছে সকলে। সিঁড়ির সামনেটায় ফরাসি আর নরওয়ের পতাকা তোলা হয়েছিল আর তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে টেকা আমাদের স্বাগত জানাল। এরপর ও পিছিয়ে যেতেই টুপুহো ঝটপট সামনে এসে গোটা অনুষ্ঠানটা পরিচালনা আরম্ভ করল। টুপুহো চট করে কী একটা ইশারা করল আর তক্ষুনি গোটা দলটা একটা নতুন গান আরম্ভ করল। এবারে এটা আরো ভালো, কেননা সুরটা ওদের নিজেদেরই তৈরি আর কথাটাও, ওদের নিজেদেরই ভাষায়—ওরা যা পারে, নিজেদের সেই হুলা গানই গাইছিল। সুরটা এত অসাধারণ, এত সহজ সরল, যে আমরা শিহরন অনুভব করছিলাম, দক্ষিণ সমুদ্র আমাদের দিকে ধেয়ে আসার সময় যেমন হয়েছিল। কয়েকজন গাইছিল, বাকিরা এক তালে গলা মেলাচ্ছিল; গানে, সুরের বিভিন্নতা ছিল, কিন্তু কথাটা একই।
“স্বাগতম, টেরাই মাটেয়াটা আর তোমার লোকেদের, যারা ভেলায় ভেসে ভেসে এসেছ, আমাদের কাছে, এই রারোরিয়ায়; হ্যাঁ, স্বাগত তোমাদের, আমাদের কাছেই অনেকদিন থেকে যাও আর আমাদের সঙ্গেই স্মৃতি ভাগ করে করে নাও, যাতে আমরা একত্রে থাকতে পারি, এমনকি তোমরা অনেক দূরের দেশে চলে গেলেও। স্বাগতম।”
আমরা আবার ওদের গাইতে বললাম, আর গোটা জমায়েতে অমনি আরো আরো জীবন্ত হয়ে উঠছিল গানটা, কেননা ওদের বাধো বাধো ভাবটা ক্রমশ কেটে যাচ্ছিল। তারপর টুপুহো আমাকে বলল, কেন আমরা ‘পে-পে’-তে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছি, সেকথা ওর লোকেদের সামনে বলতে; সকলেই একথা জানার জন্য আগ্রহী। আমি ফরাসিতেই বললাম, টেকা একটু একটু করে সেটা অনুবাদ করে দিল।
জমায়েতটা অশিক্ষিত কিন্তু সকলেই বেশ বুদ্ধিমান, আমার কথার শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। আমি ওদের বললাম যে এখানে, এই দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপে আমি এর আগে তাদের লোকেদের সঙ্গে থেকে গিয়েছি, আর তখনই আমি ওদের প্রথম সর্দার ‘টিকি’-র নাম শুনি। তিনিই ওদের পূর্বপুরুষদের এক রহস্যময় দেশ থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে আসেন, সেই দেশ যে কোথায় তা কেউ জানত না। কিন্তু অনেক দূরে পেরু বলে একটা দেশে, আমি বলে চলি, এক বিরাট রাজা ছিল, তার নাম টিকি। লোকেরা তাকে বলত কন-টিকি, বা সান-টিকি কারণ তিনি ছিলেন সূর্যের বংশধর। টিকি এবং তার দলবল শেষ অবধি তাদের দেশ থেকে একটা বড়ো ‘পে-পে’-তে উঠে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তাই আমরা ছজন ভেবেছিলাম, যে উনিই সেই ‘টিকি’ যিনি এই দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলেন। যেহেতু কেউই বিশ্বাস করেনি, যে একটা ‘পে-পে’-তে করে সাগরপাড়ি দেওয়া সম্ভব, আমরা ঠিক করি যে আমরাই পেরু থেকে একটা ‘পে-পে’-তে করে ভেসে পড়ব, আর এই যে আমরা এখানে, তার মানে এটাই সম্ভব হয়েছিল।
আমার ছোট্ট ভাষণটা টেকা অনুবাদ করে দিতেই টুপুহো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রচণ্ড উত্তেজিতভাবে লাফ দিয়ে সকলের সামনে এসে পড়ল। হাত-পা ছুড়ে, আকাশের দিকে একবার, আমাদের দিকে একবার দেখিয়ে পলিনেশীয় ভাষায় হুড়মুড় করে বন্যার মতো তোড়ে কত কিছু বলে যেতে লাগল, তার মধ্যে বার বার ‘টিকি’ নামটা উচ্চারিত হচ্ছিল। ও এত দ্রুত বলে চলেছিল যে আমাদের পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, কিন্তু সামনের ভিড়টা তার প্রতিটা কথা গিলছিল আর রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। অন্যদিকে টেকা সেটা অনুবাদ করে দেবার সময় দৃশ্যত একটু বিব্রতই হয়ে পড়েছিল।
টুপুহো বলেছিল, ওর বাপ-ঠাকুর্দারা আর তাদেরও বাপ-ঠাকুর্দারা ‘টিকি’র কথা বলে গেছেন, আর বলেছেন টিকিই ওদের প্রথম সর্দার, যিনি এখন স্বর্গে বাস করেন। কিন্তু তারপর সাদা চামড়ার লোকেরা এসে ওদের বলেছে যে পূর্বপুরুষদের সেই যুগ যুগ ধরে বলে আসা কথা মিথ্যে! টিকি ছিলেনই না কখনো। স্বর্গে তার কোনো জায়গাই নেই, কেননা সেখানে জিহোবা ছিলেন। টিকি একজন লৌকিক দেবতা, তাকে আর অত না মানলেও চলে। কিন্তু এখন এই ছ’জন লোক, মানে আমরা, ভেলায় চড়ে সমুদ্র পেরিয়ে ওদের কাছে এসেছি এবং আমরাই প্রথম সাদা চামড়ার লোক যারা স্বীকার করেছে যে ওদের পূর্বপুরুষেরা সঠিক কথাই বলেছিলেন। টিকি সত্যিই ছিলেন, রক্তমাংসের, কিন্তু এখন তিনি মৃত এবং স্বর্গে আছেন।
মিশনারিদের কাজকর্ম সব ওলটপালট করে দিচ্ছি এই আশংকায় আমি তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়ে ব্যাখ্যা করে বোঝালাম যে টিকি সত্যিই ছিলেন এবং বহাল তবিয়তেই ছিলেন এবং এখন তিনি আর নেই। কিন্তু এখন তিনি কোথায় আছেন, স্বর্গে না নরকে, সেটা কেবল জিহোবাই জানেন, কেননা, টিকি যখন মর্তে ছিলেন, জিহোবা তখনো স্বর্গেই ছিলেন, আর টিকি, টেকা বা টুপুহোর মতোই অসাধারণ নেতা ছিলেন, হয়তো এদের চেয়ে অনেক বড়োই।
এই কথা স্থানীয়দের সকলকে বেশ আশ্বস্ত আর খুশি করল মনে হল, ওরা যেভাবে ঘাড় নাড়তে নাড়তে, নিজেদের মধ্যে গুনগুন করছিল, তাতে পরিষ্কার, ব্যাখ্যাটা যথাযথ জায়গায় পড়েছে। টিকি বেঁচে ছিলেন, এটাই হল মূল প্রতিপাদ্য। এখন যদি তিনি নরকেও থাকেন, তাতে তার ছাড়া আর কারো খারাপ লাগার মতো কিছু নেই; বরং উলটোদিকে টুপুহো বলল, নরকে থাকলে তাকে আরেকবার দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
তিনজন বুড়ো মানুষ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইলেন। কোনো সন্দেহ নেই এই বৃদ্ধ মানুষেরাই স্থানীয়দের মধ্যে টিকিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন; সর্দার আমাদের বলল, এদের মধ্যে একজন পুর্বপুরুষদের সময় থেকে চলে আসা অসংখ্য প্রাচীন রীতিনীতি আর পুরোনো দিনের গল্পগাথা সব জানেন। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ওঁদের প্রাচীন কাহিনিতে কোথাও এমন কোনো ইঙ্গিত আছে কি না যে ‘টিকি’ ঠিক কোনদিক থেকে এসেছিলেন! না, বৃদ্ধদের কেউই এমন কিছু শুনেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে গভীর চিন্তাভাবনা করে ওদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধটি বললেন, টিকির সঙ্গে ওর এক সঙ্গী, ওরই আত্মীয় ছিলেন, নাম মাউই আর মাউইয়ের প্রাচীন গল্পগাথায় আছে যে তিনি পুরা থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে আসেন। আর পুরা হল আকাশের সেই অংশের নাম যেখান থেকে সূর্য ওঠে। বৃদ্ধ লোকটি বললেন, মাউই যদি পুরা থেকে এসে থাকেন, তাহলে টিকিও তাই, কোনো সন্দেহ নেই তিনিও পুরা থেকেই এসেছিলেন, আর আমরা ছ’জনও ভেলায় চড়ে সেই পুরা থেকেই এসেছি—তা এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আমি স্থানীয় লোকগুলোকে বললাম, ইস্টার দ্বীপের কাছে একটা একলা দ্বীপ, মঙ্গারেভার লোকেরা এখনো ক্যানোর ব্যবহার জানে না, তারা সমুদ্রের বুকে আজকের দিন অবধি এই বড়ো বড়ো ‘পে-পে’-ই ব্যবহার করে। এটা বৃদ্ধেরা জানতেন না, কিন্তু জানতেন যে ওদের পূর্বপুরুষেরা এমন বড়ো ‘পে-পে’ ব্যবহার করতেন। যা-হোক, ক্রমশ কালে কালে তার ব্যবহার কমে যায়, আর এখন শুধু নামটা আর সেই ঐতিহ্যটুকুই রয়ে গেছে। সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, সেই প্রাচীনকালে এগুলোকে বলা হত রোঙ্গো-রোঙ্গো, কিন্তু এখন আর ওই শব্দটাই ভাষায় নেই। প্রাচীনতম বহু কিংবদন্তিতে রোঙ্গো রোঙ্গো-র কথা আছে।
নামটা আকর্ষণীয়। কোনো কোনো দ্বীপে রোঙ্গো-কে উচ্চারণ করা হয় লোনো বলে, পলিনেশীয়দের উপকথার সবচেয়ে পরিচিত পূর্বপুরুষটির নাম। তাকে বর্ণনা করা আছে সাদা চামড়া এবং সোনালি চুলের বলে। ক্যাপ্টেন কুক যখন প্রথম হাওয়াইতে আসেন, ওকে দ্বীপবাসীরা দু-হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানায়, কেননা ওরা ভেবেছিল, উনিই তাদের সাদা চামড়ার স্বজন, লোনা, কয়েক পুরুষের অনুপস্থিতির পর তাদের পূর্বপুরুষদের স্বভূমি থেকে বিরাট জাহাজে চড়ে ফেরত এসেছেন। ইস্টার দ্বীপে রহস্যময় হায়ারোগ্লিফগুলিকে রোঙ্গো-রোঙ্গো নামে ডাকা হত। এগুলোর মানে এখন আর জানা নেই, লম্বা কানওয়ালা মানুষদের সঙ্গে সঙ্গেই তা হারিয়ে গেছে, কেননা কেবলমাত্র তারাই এটা পড়তে জানত।
(আগামি সংখ্যায় সমাপ্য)
খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে
কনটিকি অভিযান শেষ হবার পর–
“দি শাইনিং মাউন্টেন।”
১৯৭৬ সালে দুই ব্রিটিশ পর্বতারোহীর চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গের পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের রোমাঞ্চকর কাহিনি। যাকে আরেক বিখ্যাত ব্রিটিশ পর্বতারোহী স্যর ক্রিস বনিংটন বলেছিলেন, হিমালয় পর্বতে সবচেয়ে দুরূহতম আরোহণ। পরের সংখ্যা থেকে জয়ঢাক-এর পাতায় সেই অভিযানের বাংলা অনুবাদ। ইন্দ্রনাথ-এর কলমে।