অভিযান- অন্নপূর্ণা মরিস হারজগ অনুবাদ তাপস মৌলিক বসন্ত ২০২১

আগের পর্বগুলো একত্রে এই লিংকে

ট্রেন ছাড়তেই আইজ্যাক, নোয়েল, অডট আর আমি লম্বা সিটে শুয়ে পড়লাম। ফ্যানের ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ আরাম লাগছিল। শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলাম। ক্রমে অন্ধকার নামল বাইরে।

চব্বিশ ঘণ্টা আরামদায়ক ট্রেনযাত্রার পর ভারত-নেপাল সীমান্তে রক্সৌল পৌঁছলাম। সরকি আর পানসির তদারকিতে চটপট আমাদের মালপত্র নেপালের স্টেশনে নিয়ে আসা হল। এই দুজন শেরপা আমাদের সঙ্গে কাঠমান্ডু চলেছে। সেই অন্নপূর্ণা ছেড়ে নামার সময় থেকে সরকি এক মুহূর্তও আমার কাছছাড়া হয়নি। এক নম্বর শিবির থেকে তুকুচায় আমার চিঠি পৌঁছে দিতে ওর সেই অসম্ভব যাত্রাটার কথা মাঝে মাঝেই ভাবি আমি, মাত্র ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে ও সেই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছিল। ওই চিঠিটার ওপর সম্পূর্ণ অভিযানের ভাগ্য নির্ভর করছিল, তাই সরকির সেই অসাধ্যসাধনের মূল্য ভুলি কী করে! কাঠমান্ডু সরকির কাছে এক স্বপ্নের শহর, কোনোদিন সশরীরে সেখানে যাবে সেটা হয়তো সে ভাবতেও সাহস করেনি। অভিযানে সরকির যা অবদান, তাতে এই পুরস্কারটা অবশ্যই তার প্রাপ্য। একই কথা পানসির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হিমালয় অভিযানে তার বিপুল অভিজ্ঞতা, সেই সঙ্গে সে খুবই ভালোমানুষ, সকলেরই খুব প্রিয়পাত্র। শেরপাদের সর্দার আংথারকে অবশ্য আমাদের সঙ্গে আসতে পারেনি। তার জেলায় প্রবল বন্যার খবর পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল সে, তাই আমাদের অনুমতি নিয়ে সোজা দার্জিলিং রওনা দিয়েছে।

গোরখপুরে শেরপাদের কাছ থেকে বিদায়ের মুহূর্তটা বেশ আবেগঘন হয়ে উঠেছিল। শেরপারা তাদের পারিশ্রমিক ছাড়াও বেশ ভালোরকম বকশিস পেয়েছে সবাই। তার ওপর অভিযানে ওদের ব্যবহার করা পাহাড়ে চড়ার সাজসরঞ্জাম ওদেরকেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ওদের কাছে বিরাট পাওনা, কেননা আমাদের সমস্ত সাজসরঞ্জাম অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এবং সত্যিই আন্তর্জাতিক মানের ছিল। খুশি হয়ে একে একে সবাই ভারতীয় কায়দায় হাতজোড় করে আমায় নমস্কার জানিয়ে গেল। ফুথারকের মতো কেউ কেউ আবার কোমর থেকে শরীরটা নুইয়ে মাথা নিচু করে এক হাতে আমায় স্পর্শ করে বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়ল, তারপর কপালটা আমার বিছানায় ছোঁয়াল। অভিযান শেষে সবাই যে বেশ সন্তুষ্ট, তা বোঝা যাচ্ছিল। বিদায়লগ্নে তাই বিষণ্ণ সকলে।

আমাদের যত্নআত্তি করে কাঠমান্ডু নিয়ে যাবার জন্য মহারাজা একজন অফিসার পাঠিয়েছেন। কিন্তু নেপালের ট্রেন শুনলাম পরদিনের আগে ছাড়বে না! হতাশ হলাম ঠিকই, কিন্তু অবাক হলাম না, কারণ সারা নেপালে সাকুল্যে তিনটি রেল ইঞ্জিন আছে! তবে নোয়েল, জি বি রানা আর এই নতুন নেপালি অফিসারটির উদ্যোগে যাত্রার সময় কিছুটা হলেও এগোনো গেল। নেপালের বিদেশমন্ত্রী জেনারেল বিজয়, যিনি আবার মহারাজার এক পুত্রও বটে, টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আমাদের জন্য একটা ডিল্যুক্স কামরার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, বগিটা একটা মালগাড়ির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে আর মালগাড়িটা ছাড়বে কাল ভোর তিনটেয়।

ঝিঁঝিঁ-ডাকা মাঝরাতে উঠে সেই বিলাসবহুল রেল কামরায় গুছিয়ে বসলাম সবাই। ট্রেন যখন ছাড়ল আমি ছাড়া বাকি সব দেখি ঘুমে কাদা। আমি ঘুমোব কী, সে এমন ঝাঁকুনি যে মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেলাম সিট থেকে! দু-ফিটের ন্যারো-গেজ লাইনে সেই ছোট্ট রেল কামরা দুলতে দুলতে এগিয়ে চলল, ঝাঁকুনির চোটে সারা রাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।

ঘন জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তা পেরিয়ে ভোরবেলা ট্রেন এসে পৌঁছল অন্তিম স্টেশনে। সেখানে নেপালি অফিসারটি আমাদের জন্য বেশ জম্পেশ জলখাবারের বন্দোবস্ত করেছিল। স্টেশনের বাইরে আমাদের মালপত্রের জন্য একটা শেভ্রলে ট্রাক অপেক্ষা করে ছিল, আর আমাদের জন্য ছিল একটা আমেরিকান স্টেশন ওয়াগন। আমায় বসানো হল গাড়ির সামনের সিটে। এক মাসের ভেতর এই প্রথম উঠে বসলাম, তবে শরীরের এমনই রুগ্ন হাড্ডিসার দশা যে আরামটা ঠিকঠাক উপভোগ করতে পারছিলাম না। গাড়ির এই রাস্তা গেছে ভীমফেদি অবধি, মাত্র উনিশ মাইল পথ। ভাবলাম ক’মিনিট আর লাগবে! বাস্তবে লাগল দু-ঘণ্টার ওপর। রাস্তা চওড়া না হলেও বেশ ভালো। পথে বেশ কয়েকটা নদী পড়ল, লোহার ব্রিজের ওপর দিয়ে পেরিয়ে এলাম সেগুলো। এটি নেপালের একমাত্র হাইওয়ে, নেপালিরা এর জন্য ভীষণ গর্বিত। বাস্তবিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এটি, রক্সৌলের দিক থেকে কাঠমান্ডু পৌঁছনোর একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ি চড়াই বেয়ে উঠতে শুরু করল। পেছন পেছন আসছে আমাদের ট্রাক, আর ট্রাকের ছাদে উৎসাহে ডগমগ শেরপারা। হেয়ারপিন বেন্ড বা চুলের কাঁটার মতো বাঁক ঘুরে ঘুরে রাস্তা উঠে গেছে ওপরে। মাঝে মাঝে পড়ছে ছোটো ছোটো গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলির বেশিরভাগের ছাদই করোগেটেড টিনের। পশ্চিমি শিল্পায়নের এ এক কুৎসিত উপহার, পাহাড়ের মনোরম সৌন্দর্যের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

বেলা এগারোটায় পৌঁছলাম ভীমফেদি। সেখানে ঘোড়া আর ডান্ডি অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। গাড়ির রাস্তা এ পর্যন্তই। এরপর কাঠমান্ডু অবধি পাহাড়ি পথ গাড়ি চলার উপযুক্ত নয়। অডট খুব ক্লান্ত, তার দু-পায়ে বড়ো বড়ো ফোস্কা। তাই আমার মতো সেও ডান্ডিতে যাওয়াই মনস্থ করল। বাকিরা রওনা হল ঘোড়ায় চড়ে। কাঠমান্ডু পৌঁছোতে শুনলাম সন্ধে হয়ে যাবে।

খাড়া চড়াই বেয়ে বাঁক ঘুরে ঘুরে রাস্তা উঠে গেছে ওপরে। তবে ডান্ডিবাহকরা খুবই দক্ষ, তাই বিন্দুমাত্র ঝাঁকুনি লাগছিল না। না থেমে, এমনকি একটুও গতি না কমিয়ে বাহকরা কাঁধ বদলাবদলি করছিল। সারাদিন ধরে সেই ডান্ডি-মার্চ চলল। বসার জায়গাটা আমার পক্ষে অবশ্য খুবই ছোটো, হাত-পার ক্ষত বাঁচিয়ে কোনোরকমে কুঁজো হয়ে বসেছিলাম। বেশিক্ষণ ওইভাবে বসে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, তাই অডট আমায় ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দিয়ে দিল একটা। কিছু দূর অন্তর বিভিন্ন বিশ্রামাগারে মহারাজার মাননীয় অতিথিদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করা ছিল। দুপুর একটায় গোর্খা সৈন্যদের একটা সুন্দর দুর্গে পৌঁছলাম। দুর্গের মাথায় এক বিশ্রামাগারে চটজলদি দুপুরের খাওয়া সেরে ফের রওনা দেওয়া গেল। কাঠমান্ডু এখনো অনেক রাস্তা, দুটো উঁচু গিরিপথ পেরোতে হবে। ৬৫০০ ফিট উঁচু প্রথম পাসটার মাথায় পৌঁছলে কাঠমান্ডু উপত্যকার দৃশ্য দেখা যাবে। রাস্তার সমান্তরালে দূর দিয়ে দেখি মোটা কেবল-এর একটা লাইন চলেছে, কিছু দূর অন্তর বিরাট উঁচু উঁচু টাওয়ার। ভাবছিলাম এটা কি কোনো রোপওয়ের কেবল? শুনলাম সত্যিই তাই। এটা নাকি পৃথিবীর দীর্ঘতম রোপওয়ে, প্রায় উনিশ কিলোমিটার লম্বা। এই রোপওয়ের মাধ্যমেই কাঠমান্ডু এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের জন্য রসদ সরবরাহ করা হয়।

ঘোড়ায় চড়ে যারা রওনা দিয়েছিল তারা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আমাদের জন্য ওরা গাড়ির রাস্তার মুখে অপেক্ষা করবে। গাড়ির রাস্তা? হ্যাঁ, আমাদের নাকি গাড়ি করে কাঠমান্ডু নিয়ে যাওয়া হবে! বিস্মিত হলাম শুনে। যে দুর্গম রাস্তায় চলেছি, সে পথ পেরিয়ে ওখানে গাড়ি পৌঁছল কী করে?

“কুলিরা নিয়ে এসেছে।” বলল কেউ একজন।

“কী করে সম্ভব সেটা? সামনের চড়াইটা শুধু দেখো একবার।” অডটের দিকে ফিরে বললাম।

কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা তো পাশাপাশি দুজন ভালো করে হাঁটার মতো চওড়াও নয়! যে লোহার সেতুটা এক্ষুনি পেরোলাম, সেটা খুব জোর পাঁচ ফিট চওড়া হবে। এ রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাবে কীভাবে?

“সাহেব, ঠেলে ঠেলে নয়, পিঠে করে নিয়ে এসেছে কুলিরা।”

অবিশ্বাস্য! কাঠমান্ডুতে এমনকি ট্রাকও আছে শুনলাম। কিন্তু গাড়ি পিঠে বয়ে ছ’হাজার ফিটের চেয়েও উঁচু দু-দুটো পাস পেরোলো কী করে কুলিরা? তখন ব্যাপারটা আমার কাছে বিশদে ব্যাখ্যা করা হল। চাকা খুলে ফেলে গাড়িগুলো বিরাট বিরাট পাটাতনে বাঁধা হয়, তারপর পঞ্চাশ থেকে সত্তর জন কুলির একেকটা দল সেই পাটাতন বয়ে নিয়ে যায়। আমরা যে রাস্তায় চলেছি সে পথে ওরা যায় না। ওরা যায় নদীখাত ধরে, খালি পায়ে। গিরিপথের যে অংশটা বেশ চওড়া, সেখান দিয়ে পার হয়। পিঠের বিপুল বোঝার ভারে কুঁজো হয়েও গান গাইতে গাইতে তালে তালে পা ফেলে দুর্গম এই পথ পেরিয়ে যায় ওরা। এভাবেই কাঠমান্ডু শহরের প্রায় বারো মাইল পাকা রাস্তার জন্য শ’খানেক গাড়ি নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

সন্ধে হয়ে এল। দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত পদক্ষেপে কুলিরা ধীরে ধীরে পাসের দিকে উঠে চলেছে। ওরা বলল, পাসের ওপর থেকে হিমালয়ের অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। নীচে দেখা যায় প্রায় সমতল কাঠমান্ডু উপত্যকা, শত শত মন্দির, বৌদ্ধ স্তূপ আর প্রাসাদ বুকে নিয়ে বিছিয়ে রয়েছে। দৃশ্যটা নিঃসন্দেহে মনোরম হত, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা যখন পাসের ওপর পৌঁছলাম তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কুলিরা রাস্তা দেখছে কী করে তাই বুঝছিলাম না। এরকম পরিস্থিতিতে খামোখা পাসের ওপর দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, তাই এগিয়ে চললাম।

একটু পরে নীচে দূরে বিজলি বাতির আলো দেখা গেল। পরদিন জেনেছিলাম, এখানে বাগমতী নদীর ধারে একটা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। ডান্ডি চলছে তো চলছেই, বাতিগুলি কাছে আর আসে না! ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একের পর এক ঘুমন্ত গ্রাম পেরিয়ে চললাম। এত ক্লান্ত লাগছিল যে কথা বলারও শক্তি পাচ্ছিলাম না।

প্রায় মাঝরাতে একটা ছোটো গ্রামে এসে উপস্থিত হলাম। লোকজনের কথাবার্তায় মনে হল ডান্ডি যাত্রার এখানেই ইতি। ঠিকই ধরেছি। দেখলাম একটু দূরে একটা পুরোনো আমেরিকান গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কুলিদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেওয়া হল। আমাদের মালপত্র চাপানো হল একটা ট্রাকে। আমায় তোলা হল গাড়িতে, অডটের পাশে। ঠিক সেই সময় আবিষ্কার হল গাড়ির একটা চাকা পাংচার! চাকা পালটাতে গেল আরো মিনিট পনেরো, তারপর ফের শুরু আমাদের যাত্রা। রাস্তায় প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। গাড়ির ছাদে ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজ। একে জঘন্য রাস্তা, তার ওপর গাড়িটার অ্যাক্সেলের স্প্রিং মনে হয় সবগুলোই ভাঙা! ঝাঁকুনিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত।

চড়াই পথ ধরে গাড়ি চলল। রাস্তায় পড়ল গোর্খা সৈন্যদের একটা চেকপোস্ট। অবশেষে রাত একটায় পৌঁছলাম আমাদের জন্য নির্দিষ্ট মহারাজার রেস্ট হাউসে। আমাদের জন্যই সবাই অপেক্ষা করছিল, চিৎকার করে অভ্যর্থনা জানাল তারা। আইজ্যাক, নোয়েল আর জি.বি রানা বেরিয়ে এল বাইরে। ভারতে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মঁসিয়ে ক্রিশ্চিয়ান বেল সশরীরে এখানে উপস্থিত হয়েছেন দেখে খুব খুশি হলাম। নেপালের সঙ্গে ফ্রান্সের বৈদেশিক সম্পর্ক দপ্তরও মঁসিয়ে বেল-এরই অধীন। আমরা কাঠমান্ডু আসছি শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনিও চলে আসবেন, যাতে নিজে সঙ্গে করে আমাদের মহারাজার কাছে নিয়ে যেতে পারেন। দেখা গেল আমাদের অভিযান সম্পর্কে উনি বেশ ভালোরকম ওয়াকিবহাল। তবে স্বচক্ষে আমার এই রুগ্নদশা দেখে খুব আঘাত পেয়েছেন মনে হল।

বেশ কয়েক মাস পর অবশেষে এখানে ক’দিন বিশ্রাম পাওয়া যাবে! রেস্ট হাউসটি বেশ সুসজ্জিত, টেবিল চেয়ার ফ্রিজ সবই আছে। এমনকি বাথরুম অবধি আছে! কিন্তু সব চমকের সেরা চমক, ডাইনিং টেবিলের ওপর দেখলাম বহুমূল্য এক বোতল মদ রাখা আছে! জিভ দিয়ে প্রায় জল ঝরছিল আমার, তর সইছিল না আর, কিন্তু পাগড়ি মাথায় সম্ভ্রান্ত চেহারার খানসামা যেভাবে নিখুঁত আদবকায়দা মেনে পরিবেশন করছিল তাতে নিজেকে বহু কষ্টে সংযত রাখতে হল। জেনে বিস্মিত হলাম, আমার জন্য একটি নরম শয্যাও নির্দিষ্ট আছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে এগারোই জুলাই অবধি থাকছি আমরা, যার অর্থ আমার কাছে তিনদিনের বিশ্রাম এবং ভুরিভোজ, দলের অন্যদের কাছে তিনদিন ধরে পর্যটকদের মতো কাঠমান্ডুর প্রাণচঞ্চল নগরজীবন উপভোগ করা এবং সমস্ত দর্শনীয় স্থান ঘুরে ঘুরে দেখা।

পরদিন সকালে সবাই শহর ঘুরতে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। যাবার আগে অডট অবশ্য আমার ক্ষতস্থানগুলির শুশ্রূষা করতে ভুলল না। ব্যান্ডেজগুলো খুলে দিয়ে সে বলল, “এগুলো খোলা থাক এখন, একটু হাওয়া-বাতাস লাগুক।”

আমার পক্ষে ব্যাপারটা যদিও বেশ ঝকমারি, কারণ ব্যান্ডেজ খোলা থাকা মানে হাত দিয়ে কিছু স্পর্শ করতে পারব না, পায়ের পাতা দুটো উঁচু করে রাখতে হবে সবসময়, আবার খেয়াল রাখতে হবে খোলা ক্ষতস্থানগুলিতে যেন মশা-মাছি না বসে। কাঁহাতক এভাবে শুয়ে থাকা যায়! সময় যেন আর কাটতেই চায় না।

সন্ধেবেলা শহর ঘুরে হইহই করতে করতে দলবল ফিরল। অনেক মন্দির-টন্দির ঘুরেছে ওরা, দেখে এসেছে দরবার স্কোয়ারের অপরূপ কাঠের কাজ করা স্থাপত্য। শিল্পকলা একসময় নেপালে চূড়ান্ত উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

পরদিন মহামান্য মহারাজার দরবারে আমাদের আমন্ত্রণ। নোয়েল বলল, অনুষ্ঠানটা দুটো ভাগে হবে, পুরোটাই বিকেলে। প্রথম দফায় পুরোদস্তুর সরকারি অভ্যর্থনা, আর দ্বিতীয় ভাগটা অনেকটাই অন্তরঙ্গ, খোলামেলা। মহারাজার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগ থাকবে দ্বিতীয় ভাগে। দলের সকলেই খুব উত্তেজিত। রাজদরবার সম্বন্ধে কত গল্পই না শুনেছি এতদিন! একেবারে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় হাজির হতে হবে আমাদের, এক মিনিট আগেও নয়, পরেও নয়। দরবারের নিয়মকানুন ভীষণ কড়া। মঁসিয়ে ক্রিশ্চিয়ান বেলও উপস্থিত থাকবেন আমাদের সঙ্গে, তাঁর সরকারি উর্দিতে। আমরা সবাই পরে যাব সাদা ডিনার জ্যাকেট, এরকম কোনো অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রেখে সুদূর প্যারিস থেকে যা বয়ে আনা হয়েছে। রোখাচোখা পর্বতারোহীর পোশাক ছেড়ে এখন ফ্যাশনদুরস্ত সভ্যভব্য সাজার পালা আমাদের।

সময়মতো আমাদের নিয়ে দুটো গাড়ি রাজপ্রাসাদের সিংহদুয়ার দিয়ে প্রবেশ করল। সশস্ত্র গোর্খা সৈন্যরা ঢোকার সময় অভিবাদন জানাল আমাদের। রাজবাড়ির সামনেটা অসাধারণ, মাঝখানে এক সরোবর ঘিরে চারদিকে ফুলের বাগান, সে বাগান বেড় দিয়ে প্রাসাদে ঢোকা ও বেরোনোর পথ। সে রাস্তায় ধীরে ধীরে চলে আমাদের গাড়ি উপস্থিত হল রাজপ্রাসাদের সামনে বিরাট এক চৌকোনা বাঁধানো চত্বরে। লাল পোশাক পরা অশ্বারোহী সৈন্যদের এক বাহিনী এগিয়ে এল আমাদের দিকে, তাদের প্রত্যেকেরই বড়ো বড়ো ঝোলা গোঁফ, হাতে বর্শা। অন্যরা গাড়ি থেকে নেমে বলল যে আমায় একটা চেয়ারে বসিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে হবে ভেতরে। সৈন্যরা তাড়াতাড়ি ছুটে এসে সব ব্যবস্থা করল, আমায় তুলে নিয়ে চেয়ারে বসতে সাহায্য করল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ওঠার পর দেখি মহারাজা নিজে দাঁড়িয়ে আছেন, নেপালের মহামান্য মহারাজা মোহন সামশের জং বাহাদুর রাণা। তিনি এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে সাদরে আমাদের গ্রহণ করলেন। তাঁর রাজকীয় সাদা পোশাকে মহামূল্য সব মণিরত্ন ঝলমল করছে। শুধু পাগড়িতেই যে কতগুলো বড়ো বড়ো রত্ন! মাঝখানে প্রায় চার ইঞ্চি ব্যাসের একটা হিরে বসানো! জাঁদরেল গোঁফ ও গালপাট্টায় মহারাজার চেহারা আরো সম্ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।

সহৃদয় ভঙ্গিতে মুখে পিতৃসুলভ হাসি নিয়ে মহারাজা আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি ব্যান্ডেজ করা হাতদুটো জড়ো করে ভারতীয় কায়দায় সসম্মানে তাঁকে নমস্কার জানালাম। তিনি বললেন, আমাকে ও আমার বন্ধুদের তাঁর প্রাসাদে আমন্ত্রণ করে অভ্যর্থনা জানাতে পেরে তিনি খুবই খুশি। বাকি কয়েক ধাপ সিঁড়ি একসঙ্গে উঠে আমরা আলো ঝলমল বিরাট রাজসভায় প্রবেশ করলাম। রাজসভায় শয়ে শয়ে সভাসদ উপবিষ্ট ছিলেন, সবাই দাঁড়িয়ে উঠে আমাদের সম্মান জানালেন। পুরো সভাগৃহ পার করে আমাদের নিয়ে আসা হল একেবারে সামনে, যেখানে রাজসিংহাসনের খুব কাছেই আমাদের জন্য আসন সংরক্ষিত ছিল। আমার চেয়ারটা উপযুক্ত জায়গায় নামানোর জন্য মহারাজা স্বয়ং নির্দেশ দিলেন যাতে আমি সভার কার্যপ্রণালী ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারি। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে চারদিকে তাকালাম আমি। সভাসদদের প্রত্যেকের পোশাক মহারাজার মতোই, অবশ্য তাদেরগুলি সমমূল্যের রত্নখচিত নয়। হিরে-চুনি-পান্নার দ্যুতিতে ঝলমল করছে চারদিক। এ যুগেও আমাদের এই পৃথিবীতে এরকম সম্পদশালী রাজদরবার আছে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিলাম।

অনুষ্ঠান শুরুর নির্দিষ্ট সময়ের অল্প আগেই পৌঁছে গেছিলাম আমরা, তাই রাজসভার চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখার একটু ফুরসত ছিল। সামনে পদমর্যাদা অনুযায়ী স্থির নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন প্রায় পনেরো জন রাজপুত্র; বাবর, কাইজার ইত্যাদি… সবার নামের শেষেই অবশ্য ‘সামশের জং বাহাদুর রাণা’ বসবে। সরকারিভাবে বর্তমান মহারাজা মোহনের আসন প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদার। সুনির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী এই দায়িত্ব বংশানুক্রমে ভাই, ছেলে বা ভাইপোদের ওপর বর্তায়। নেপালের আসল মহারাজা ত্রিভুবন সামশের জং বাহাদুর রাণা বৃদ্ধ হয়েছেন, এখন আর জনসমক্ষে আসেন না। তাঁর নামে দেশ চালান তাঁর উত্তরাধিকারীরা। সভার ডানদিকেও রাজপুত্রদের আসন। একই বেশে একইভাবে বসে আছেন রাজবংশের পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা। তাঁদের পেছনে একে একে মন্ত্রী, সামরিক প্রধান এবং অন্যান্য বিশিষ্ট পদাধিকারীদের আসন।

“কেমন বুঝছ?” পাশে বসা আইজ্যাক ফিসফিস করে বলল আমায়।

“খুব সুবিধের নয়! এভাবে সোজা হয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকা খুবই যন্ত্রণাদায়ক আমার পক্ষে।”

বসে বসে বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার ক্ষতস্থানগুলি থেকে পুঁজ-রক্ত বেরিয়ে আসছে। আইজ্যাকও কেবলই উশখুশ করছিল। ছবি তোলার জন্য ওর হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু এখানকার আদবকায়দা বড়োই কড়া, একজন অতিথির পক্ষে রাজসভার ভেতরের ছবি তোলা উচিত কি না বোঝা যাচ্ছিল না। তবে এ-দেশে ফোটোগ্রাফির কদর আছে। দেখলাম সভার ছবি তোলার জন্য কয়েকজন সরকারি ফোটোগ্রাফার রয়েছে। ট্রাইপডের ওপর বিরাট বিরাট ক্যামেরা বসিয়ে গভীর মনোযোগে তারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত, যেন ছবি ঠিকঠাক না এলে ওদের গর্দান যাবে! আদবকায়দা ভুলে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে উঠে আইজ্যাক ছবি তোলা শুরু করল। দেখা গেল বিদেশি অতিথির এই সামান্য পদস্খলনে সভাসদরা কেউ তেমন বিচলিত হলেন না। তাই কিছুক্ষণ পর পরই আইজ্যাকের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠতে লাগল। সরকারি ফোটোগ্রাফাররা অবশ্য আইজ্যাককে পাত্তাই দিল না। তাদের হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আইজ্যাককে তারা অপেশাদার ছেলেমানুষ হিসেবে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে। এভাবে ধুমধাড়াক্কা ফটাস ফটাস করে ভালো ছবি তোলা যায় নাকি!

অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে দেখে আইজ্যাক ফের ভদ্রসভ্যভাবে নিজের আসনে বসে পড়ল। মঁসিয়ে ক্রিশ্চিয়ান বেল উঠে দাঁড়িয়ে মহারাজাকে উদ্দেশ করে ইংরিজিতে তাঁর ভাষণ শুরু করলেন। নেপালের অভ্যন্তরে অভিযানের বিশেষ অনুমতি দেবার জন্য ফ্রান্সের হয়ে তিনি মহারাজাকে ধন্যবাদ জানালেন। নেপাল এখন গর্ব করে বলতে পারে, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাঁদেরই দেশে যার চূড়ায় মানুষের পা পড়েছে। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে মহারাজাকে তিনি সুন্দর একটি ট্যাপেস্ট্রি উপহার দিলেন। জিনিসটা এ-দেশে অপরিচিত। আমরা যখন ব্যাখ্যা করলাম যে জিনিসটা কার্পেটের মতো দেখতে হলেও আদপেই তা নয়, বরং হাতে বোনা নকশিকাঁথার মতো, ছবি হিসেবে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার জন্য, সভার সকলেই বেশ তারিফ করলেন। সভাসদদের প্রশংসাসূচক সম্মিলিত গুঞ্জনে রাজদরবারের নিস্তব্ধতা কিছুক্ষণের জন্য ভঙ্গ হল।

এরপর মহারাজা উঠে দাঁড়ালেন মঁসিয়ে বেল-এর ভাষণের প্রত্যুত্তরে কিছু বলার জন্য। সভার সকলে ফের চুপচাপ হয়ে গেল। মহারাজা বললেন, অভিযানের অনুমতি দিতে পেরে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং আমরা সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছি। এই বিশেষ অনুমতি, যা সচরাচর দেওয়া হয় না, প্রমাণ করে তিনি নেপাল এবং ফ্রান্সের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করার জন্য কতটা আগ্রহী। একসময় তাঁর বাবা এবং ফ্রান্সের বিখ্যাত পণ্ডিত ও সংস্কৃত ভাষাবিশারদ সিলভেইন লেভির মধ্যে বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে এই দু-দেশের সুসম্পর্কের সূচনা হয়েছিল। তিনি আশা করেন, ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরো মজবুত হবে এবং দুই দেশই তার ফলে আরো সমৃদ্ধ হবে।

মহারাজার বক্তৃতার সময় দেখি সামনে বসে থাকা রাজপরিবারের লোকেরা বার বার ঘড়ি দেখছেন এবং নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। নির্ঘণ্ট অনুযায়ী সভা শেষের আর যে মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি! মহারাজা নিজেই কি রাজদরবারের সময়ানুবর্তীতার ঐতিহ্য ভুলে যেতে বসেছেন? না। দেখা গেল, সময়ের মধ্যেই মহারাজা তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। তারপর সামান্য কিছু সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সভা ভঙ্গ হল। সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো সভার অত লোকজন যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল!

কয়েক মিনিটের মধ্যেই দ্বিতীয় দফার অনুষ্ঠান শুরু হবে। ইতিমধ্যেই অনেকে চলে এসেছেন। তাঁদের পোশাক এখন বদলে গেছে। সকলের পরনেই এখন কালো স্যুট, মাথায় ফারের টুপি, বুকে কেবলমাত্র গোর্খা সামরিক বাহিনীর ব্যাজ¾দুটো সোনালি কুকরির ক্রস। মহারাজাও কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন। তাঁর বুকেও এখন একটামাত্র ব্যাজ, জ্বলজ্বল করছে ফ্রান্সের দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মান ‘লিজিয়ঁ অফ অনার’। এই অনুষ্ঠানটার চরিত্র পুরোপুরি আলাদা। একটা বড়ো টেবিলের ওপর মঁসিয়ে বেল-এর উপহার দেওয়া ট্যাপেস্ট্রিটা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। টেবিলটা ঘিরে রাজপরিবারের লোকজন সেটার সমাদর করছেন। মন্ত্রীরা এবং আমাদের দলের অন্যান্য সদস্যরাও আছেন সেখানে, টুকরোটাকরা আলাপ-আলোচনা চলছে তাঁদের মধ্যে। মহারাজা আমার দিকে এগিয়ে এলেন। কয়েক মিনিট তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ হল। তাঁর দেশকে যে আমি ভালোবেসে ফেলেছি সে কথা মহারাজাকে জানালাম, বাইরের দুনিয়া এই অসাধারণ সুন্দর দেশটার কথা তেমন জানেই না। জি.বি রানা যে কীভাবে প্রতি পদে আমাদের সাহায্য করেছেন সে-কথাও বললাম তাঁকে। শুনে মহারাজা তৎক্ষণাৎ জি.বি রানাকে পদোন্নতি দিয়ে লেফটেন্যান্ট করে দিলেন, জি.বি-র মাইনেও বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল! জি.বি আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে গেল একেবারে। দূর থেকেই আমার দিকে চেয়ে নমস্কার জানাতে লাগল বার বার, তারপর মহারাজার সামনে এসে কোমর ঝুঁকিয়ে মাথা নুইয়ে ওর সেই বিচিত্র কায়দায় স্যালুট করল।

রোখাচোখা যুদ্ধবাজ গোর্খা সৈন্যদের কঠিন বহিরাবরণের ভেতরে যে একটা নরম মন লুকিয়ে আছে, আমার প্রতি ওদের সহৃদয় ব্যবহার দেখে সেটা বুঝতে পারছিলাম। হঠাৎ সবাই কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। কয়েকজন রাজকর্মচারী খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে গয়নার বাক্সের মতো ছোটো ছোটো কয়েকটি সুদৃশ্য বাক্স হাতে নিয়ে সভায় ঢুকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী হতে চলেছে এখন? মহারাজা উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে সেই বিশাল সভাঘরের একেবারে মাঝখানে নিয়ে এসে বসানো হল। সবাই আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। গ্রেট ব্রিটেন এবং ভারতের রাষ্ট্রদূত দুজনও যোগ দিয়েছেন এই অনুষ্ঠানে। মহারাজা একে একে সেই ছোট্ট বাক্সগুলি খুললেন, তারপর আমার দিকে ফিরে বলতে শুরু করলেন, “বৃদ্ধ মহারাজা ত্রিভুবন রাণা অসুস্থ, তাই এই অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। তাঁর নির্দেশে আপনাকে আমি বীরত্বের জন্য গোর্খা সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মান ‘দ্য গোর্খা রাইট হ্যান্ড’ প্রদান করছি।” আবেগঘন গলায় মহারাজ যোগ করলেন, “আপনি একজন প্রকৃত বীর, বীর হিসেবে আমরা আপনাকে স্বাগত জানাই।”

আমি বাকরুদ্ধ ও আপ্লুত হয়ে গেলাম। বিখ্যাত গোর্খা সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ বীরের মর্যাদা! এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে? চেয়ারে সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছিলাম না আর, তাও কষ্ট করে দু-এক কথা বললাম। আশাতীত এই সম্মানের জন্য ধন্যবাদ জানালাম মহারাজাকে। বললাম, এ সম্মান আমাদের সম্পূর্ণ অভিযানকেই সম্মানিত করল, দলের প্রতিটি সদস্যই এ সম্মানের অংশীদার, আমি দলনেতা হিসেবে আমার কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আমার বক্তব্য শেষ হতে একে একে মহারাজা, রাজপরিবারের সদস্যরা, মন্ত্রী এবং অন্যান্য সভাসদরা আমায় তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন। তারপর সবাই আবার ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব শুরু করলেন। মাঝে মাঝেই মহারাজা কিংবা তাঁর ছেলে জেনারেল বিজয় আমার কাছে এসে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক আছি কি না। অভিযান নিয়েও নানান প্রশ্ন করছিলেন। আমাদের অভিযান হিমালয়ের চিরতুষারাবৃত অঞ্চল এবং সুউচ্চ শৃঙ্গগুলি সম্বন্ধে তাঁদের বেশ কৌতূহলী করে তুলেছে। পবিত্র শৃঙ্গগুলি স্থানীয় ধর্মমতে ঈশ্বরের বাসস্থান, মানুষের পদার্পণ বহুকাল নিষিদ্ধ ছিল সেখানে। এরপর কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে আশা করি এঁরা আমাদের দায়ী করবেন না!

অনুষ্ঠান শেষে সবার কাছে বিদায় নেবার পর মহারাজা এবং তাঁর পুত্র জেনারেল বিজয় এগিয়ে দিতে এলেন আমাদের, পেছন পেছন এলেন অন্য সভাসদরা। আর বসে থাকতে পারছিলাম না আমি, গাড়িতে উঠে কতক্ষণে শুয়ে পড়ব তার জন্য প্রাণ ছটফট করছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামছি, এমন সময় কারো একটা নির্দেশ কানে এল। আমাদের গাড়ি দুটো এগিয়ে আসছিল সিঁড়ির কাছে, সে দুটোও হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। একটা বাজনার সুর শুনলাম। আরে! এ যে ওয়ালজ-এর সুর, আমাদের ফরাসি কান এতে খুবই অভ্যস্ত। আশ্চর্য! সবাই দেখি সাবধান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। গানটা শেষ হতে বিস্মিত হয়ে বিদেশমন্ত্রী জেনারেল বিজয়কে বলতে যাচ্ছিলাম, ‘আমাদের জন্য ফরাসি সংগীত বাজালেন বলে অনেক ধন্যবাদ।’ ভাগ্যিস বলিনি! আমার কানের পাশে ঝুঁকে জেনারেল বিজয় নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের জাতীয় সংগীত কেমন লাগল আপনার?”

“ওহ্‌! দারুণ দারুণ! বিশেষ করে আমাদের দেশের লোকেদের সুরটা খুবই ভালো লাগবে!”

সেই সময় বেজে উঠল ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত ‘মার্সেইলেজ’। এই দূর বিদেশে ব্যাপারটা যেমন বিস্মিত করল, তেমনই গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেল আমাদের। রেকর্ড নয়, লাইভ অর্কেস্ট্রায় বাজানো হচ্ছে সুরটা। এদের নিশ্চয়ই বহুদিন অভ্যাস করতে হয়েছে!

স্তব্ধ নিশ্চল হয়ে গেছিলাম আমরা সকলে। গান শেষ হতে মহারাজা আমাদের উদ্দেশে অন্তিম বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। আমরাও বিদায় নমস্কার জানিয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে। সিঁড়ির ধাপে ধাপে মন্ত্রী ও সভাসদরা সবাই পদমর্যাদা অনুযায়ী সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। গাড়ি চলতে শুরু করল। সেই সময় ফের একবার বেজে উঠল ‘মার্সেইলেজ’।

সন্ধেবেলা দলের অন্য সদস্যরা ব্রিটিশ দূতাবাসে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেল। পরদিন, বিশ্রাম নিয়ে চাঙ্গা হয়ে তারা গেল নেপালের এক প্রাচীন রাজধানী ভাদগাঁও ঘুরতে। সেখানে আশ্চর্য কিছু হিন্দু মন্দির আছে। কাঠমান্ডুর কেন্দ্রস্থলে, মন্দিরের পাশের চত্বরে মা কালীর মূর্তিটাও দেখার মতো। আরেক দ্রষ্টব্য স্থান হল শহরের পাশে এক পাহাড়ের মাথায় স্বয়ম্ভূনাথের বিখ্যাত বৌদ্ধ স্তূপ।

পরদিন ১২ জুলাই আমরা কাঠমান্ডু ছাড়লাম। স্থানীয় রীতি অনুযায়ী রেস্ট হাউস থেকে বিদায় নেবার সময় আমাদের সবাইকে সুগন্ধি ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হল। আমাদের যাতে কোনো অসুবিধে না হয় সেদিকে সবসময় মহারাজার তীক্ষ্ণ নজর ছিল। আমার জন্য আট বাহকের বিশেষ একটি আরামদায়ক ডান্ডির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি।

জি.বি রানা আমাদের এগিয়ে দিতে কিছুদূর সঙ্গে এল। ওর পরিষেবা এবং আনুগত্যের কথা ভুলতে পারব না কখনো। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দীর্ঘদিনের সঙ্গী আমার রিভলবারটা ওকে উপহার দিলাম। খুব খুশি সে। অস্ত্রটা এ-দেশে পরিচিত নয়। বাকি জীবন ওটা দেখলেই আমাদের কথা রানার মনে পড়বে। কিছুতেই আমাদের ছাড়তে চাইছিল না জিবি। বিষণ্ণ মুখে অনেকক্ষণ আমার পাশে পাশে হেঁটে এল, তারপর ক্রমশ পিছিয়ে পড়ল। তার দু-গাল বেয়ে তখন অশ্রুধারা গড়িয়ে নামছে। ধীরে ধীরে চড়াই পথে উঠে আমাদের রাস্তা জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল। গলায় পরানো ফুলের মালার সুগন্ধ আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। দূর দিগন্তে দেখা যাচ্ছিল হিমালয়ের তুষার শৃঙ্গরাজি, স্বর্গের দিকে মাথা উঁচিয়ে রাজসিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

অন্যরা অনেক এগিয়ে গেছে। ডান্ডিতে বসে বসে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম, দেশে ফিরে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটা ঠিক কেমন হতে পারে। বাস্তবে যে প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা পেয়েছিলাম তার কথা তখন ধারণাই করতে পারিনি। অভিযানের ভয়ংকর দিনগুলি আমাদের স্নায়ুকে অবশ করে রেখেছিল। মাঠে-ঘাটে অডটের সব অপারেশন, যা দেখে অশিক্ষিত গ্রাম্য স্থানীয় লোকজন পর্যন্ত ঘাবড়ে যেত, ক্রমশ আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। এই ঘচাং করে কাঁচি দিয়ে পায়ের একটা আঙু্ল কেটে ফেলল, বেকার জিনিস বলে ছুড়ে ফেলে দিল ডাস্টবিনে, পুঁজ-রক্তের ছড়াছড়ি, পচা ঘায়ের দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না তাঁবুতে—সবই কেমন স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছিলাম আমরা। সভ্য জগতের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতে মনের এই লৌহকঠিন আবরণটা এক ঝটকায় খুলে গেছিল।

ফ্রান্সের ওরলি বিমানবন্দরে নামার আগে ল্যাচেনাল ও আমার ক্ষতস্থানগুলির ড্রেসিং বদলে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে বিমানের লোহার সিঁড়ি দিয়ে আমাদের নামিয়ে আনা শুরু হল, চোখাচোখি হয়ে গেল প্রিয় আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। ব্যস! যেন প্রাণপণে আঁকড়ে থাকা লৌহমানবের মুখোশটা এক টানে ছিঁড়ে গেল! ওঁদের চোখে, আধুনিক নগরসভ্যতার চোখে, দেখলাম আমাদের প্রতি করুণা! আমাদের অসহায় রুগ্ন চেহারার প্রতি করুণা! না, আমরা করুণার পাত্র নই! আমরা অন্নপূর্ণাজয়ী বীর! কিন্তু আত্মীয়স্বজনের চোখের ভাষা, অশ্রুজল দেখে আমাদের চোখের জলও আর বাঁধ মানল না। তাঁরা আমাদের রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। যেন চোখের দৃষ্টি দিয়ে চিৎকার করে তারা বলছিল, হতে পারো তোমরা বিশ্বজয়ী বীর, কিন্তু এখন আমাদের কাছে তোমরা করুণার পাত্র, অসহায়। বাস্তব বড়োই নির্মম!

যাই হোক, বরং অভিযানের দিনগুলির স্মৃতিতে ডুব দেওয়া যাক। সে-সব দিনের কথা ভাবলে মনে প্রশান্তি নেমে আসে। হিমালয় আমাদের দু-হাত উপুড় করে দিয়েছে। এই স্মৃতি রোমন্থন করেই বাকি জীবন কেটে যাবে সবার। যৌবনে পাহাড়ই ছিল আমাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। প্রেম-প্রণয়ের রোমান্টিসিজম কিংবা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ, কোনোটাই আমাদের আকর্ষণ করতে পারেনি। পাহাড় ছিল আমাদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র। জীবন-মৃত্যুর সীমান্তে নিজেদের ছুড়ে ফেলে আমরা আস্বাদন করেছি স্বাধীনতার রোমাঞ্চ। শিশুর সারল্যে ছুটে গেছি পাহাড়ের কাছে, তপস্বীর মতো শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে। তাই আমাদের কাছে পাহাড় ছাড়া আর কিছুতেই কিছু যায়-আসে না!

অন্নপূর্ণা আমাদের সবার কাছেই জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘জীবনের লক্ষ্য’ জিনিসটা কী? ব্যাপারটা অনেকটা খুড়োর কলের মতো! যার সন্ধানে নিরন্তর ছুটে চলার প্রেরণা পাওয়া যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না কখনো। অন্নপূর্ণা আমরা জয় করেছি। তার কথা এখানেই শেষ করি। এবারে অবিলম্বে অন্য কোনো লক্ষ্য স্থির করা যাক! নইলে পথ চলব কী করে? জীবন সুবিশাল। বিস্তীর্ণ ও বিচিত্র তার ক্ষেত্র। সেখানে অন্য কোনো অন্নপূর্ণার খোঁজ করা যাক বরং!

খেলার পাতার সমস্ত লেখার লিংক একত্রে এইখানে

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s