গল্প মিন্টু যখন গোয়েন্দা-অরূপ দাস-শীত ২০২০

অরূপ দাসের আগের গল্প পথের পথিক, নিয়তি

প্রথমে শুঁড় তুলে প্রণাম জানাল। এরপর মিউজিকের তালে শরীর দোলাচ্ছে। মজার খেলনা হাতি। ছোট্ট সুমনের জন্মদিনে খেলনাটা উপহার দেওয়া যেতেই পারে। দোকান থেকে উপহার কিনে সাইকেল চালিয়ে মিন্টু সোজা সুমনদের বাড়ি চলে এল।

বেলুন আর রঙিন কাগজে উঠোনের আকাশ ঢেকেছে। পাঁচিলের গায়ে টুনি লাইটগুলো তারাদের মতো মিটমিট করে জ্বলছে। এদিকে দু-দিক থেকে দুটি মেটালের নীল আলো ঝরে পড়ায় উঠোন হয়ে উঠেছে রূপকথার দেশ।

বাপিদা ফোটো তোলার দায়িত্বে। মিন্টু-অমিয়-রতন-মানিকদের একসঙ্গে পেয়ে বাপিদা একটা ফোটো তুলে নিল।

কেক কাটার আগে সুমনের কাকু বড়ো বেলুনের গায়ে সেফটিপিন ফোটাতেই ফটাস করে ফেটে গেল। বেলুনের ভিতর মুঠো মুঠো লজেন্স ছিল। বেলুন ফাটামাত্র সেই লজেন্সগুলো হরিলুটের বাতাসার মতো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। হুড়োহুড়ির ভিড়ে মিন্টু চারটে লজেন্স কুড়িয়ে পেল।

এবার কেক কাটার পালা। সুমন কেক কাটার সময় সবাই তাকে চারদিক থেকে ঘিরে জন্মদিনের গান গাইছে।

এই পর্যন্ত সব ঠিক চলছিল। অনুষ্ঠানে ব্যাঘাত ঘটল মিউজিকাল চেয়ার খেলার সময়। গোল করে রাখা চেয়ারগুলোর চারদিকে সবাই ঘুরছে। আর অপেক্ষা করছে মিউজিক বন্ধ হওয়ার। মিউজিক বন্ধ হওয়ামাত্র সবাইকে চেয়ারে বসতে হবে। শুধু একজন বসতে পারবে না। তাকে বাদ দিয়ে এবং একটা চেয়ার কমিয়ে বাদবাকি জন আবার ঘুরতে শুরু করবে। খেলা সেই নিয়মে এগোছিল। হঠাৎ সুমনের ছোটো পিসি খ্যান্তাপিসি চিৎকার করে উঠলেন। মিউজিক বন্ধ হল। কিন্তু কেউ চেয়ারে বসল না। সবাই খ্যান্তাপিসির সম্মুখ জড়ো হল। খ্যান্তাপিসি প্রায় কেঁদে বলতে লাগলেন, “আমার গলার সোনার হারটা চুরি হয়ে গেছে। কেউ খুঁজে দাও আমায়। আমার কাছে মায়ের এই একটাই স্মৃতি রয়েছে।”

খ্যান্তাপিসি খুব একটা জায়গা থেকে নড়েন-চড়েননি। হার ছিঁড়ে নীচে পড়লে তা সহজেই পাওয়া যেত। তাই ধরে নেওয়া হচ্ছে, হার চুরি গেছে। চোর ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন। সুমনের বাবা গম্ভীর হয়ে বলে উঠলেন, “কেউ যখন স্বীকার করছে না, তাহলে পুলিশ ডাকতে হবে। পুলিশ এসে জেরা করবে।”

পুলিশের কথা শোনামাত্র সবার মুখ উচ্ছের মতো হয়ে গেল। টিলুর মা তিলকে তাল বানানোর ক্ষেত্রে অস্তাদ। তিনি গা জ্বলানো সুরে বলে উঠলেন, “দোষ না করেও সবাইকে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হবে, এ ভারি অন্যায়। কার দোষ কার ঘাড়ে পড়বে কে জানে!”

বটকৃষ্ণ দত্ত স্কুল শিক্ষক। তিনি কুন্ঠাবোধ করে বলেন, “উটকো ঝামেলায় পড়লাম দেখছি।”

আরো কতজন যে কত কথা বলছেন। এদিকে মিন্টু তাকিয়ে দেখল সুমনের মুখ বেলুনের মতো চুপসে গেছে, চোখ ছলছল করছে। এর তার কথা শুনে কতই না দুঃখ পাচ্ছে সুমন। তা দেখে মিন্টু ভাবল, সুমনের জন্য কিছু একটা করতে হবে। জন্মদিনে সুমন এভাবে কষ্ট পাবে তা হতে দেওয়া যায় না। যেই করে হোক চোরকে খুঁজে বের করতে হবে। কে গলার হারটা চুরি করতে পারে?

প্লেটে প্লেটে কেক, চানাচুর, লজেন্স সাজানো আছে। কিন্তু অধিকাংশ অতিথি নিচ্ছে না। সবাই ছোটো ছোটো জটলা করে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। এদিকে মিন্টু বন্ধুদের নিয়ে মিটিং সেরে নিল। প্ল্যান অনুযায়ী মিন্টুর মতো অমিয়-রতন-মানিকরাও উঠোনের চারদিকে ছড়িয়ে গেল। কারো কথা বা অন্য কিছু সন্দেহজনক দেখলে তারা মিন্টুকে জানাবে।

মিনিট পাঁচেক পর অমিয়-রতন-মানিকরা ফিরে এসে মিন্টুকে জানিয়ে দিল তারা এই কাজে সাহায্য করতে পারবে না। সবার মনমেজাজ খারাপ, এমন সময় কারো কথা আড়ি পেতে শুনতে গিয়ে ধরা পড়লে পিটুনি ছাড়া কপালে আর কিছু জুটবে না।

মিন্টু এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিতে নারাজ। যতক্ষণ না পুলিশ আসে একটা মরিয়া চেষ্টা চালানো যেতেই পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যে মিন্টুর সন্দেহের তালিকাতে একজন সন্দেহভাজন চলে এলেন। সন্দেহভাজনের নাম হচ্ছে গিয়ে রামকিঙ্কর মুখার্জি। রামকিঙ্করবাবু যেমন লম্বা, তেমনি রোগা। সারাজীবন ওই একটা ধুতি-পাঞ্জাবিতে কাটিয়ে দিলেন। বহু যুগ আগে কেনা কলাপুরি জুতোজোড়া তাপ্পি দিতে দিতে পাম্প শু আকারে বানিয়ে ফেলেছেন। যাকে বলে হাড়কিপটে। এর জন্য রামকিঙ্করবাবুকে কম হ্যাপা সামলাতে হয় না।

মাস চারেক আগের কথা। রামকিঙ্করবাবুর বাড়িতে বিরাট বড়ো কুলদেবতার পুজো হয়ে গেল। এই পুজোকে কেন্দ্র করে ঘটেছিল মজার ঘটনা। কুলদেবতার পুজো উপলক্ষে দুশো জনকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন রামকিঙ্করবাবু। পুজো শেষ হলে সবাই লাইন দিয়ে খেতে বসল। সবাই ভাবল পঁচিশ বছর পর বাড়িতে কুলদেবতার পুজো, ভোজের উত্তম ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর রামকিঙ্করবাবু হাতে করে থার্মোকলের ছোটো ছোটো বাটি নিয়ে এলেন। পিছনে দুজন ধরে আছে এক ডেকচি খিচুড়ি।

সবাই ভাবল, রামকিঙ্করবাবু এগুলো রাস্তায় পথচলতি মানুষদের দেবেন। কিন্তু তা নয়। যারা বসে ছিল তাদেরকেই বাটি করে খিচুড়ি দিতে শুরু করলেন রামকিঙ্করবাবু। ঠাকুরের প্রসাদ বলে কথা, তাই কেউ বাটি রেখে উঠতে পারছে না। কেউ কোনো মন্তব্যও করতে পারছে না। এদিকে ভক্তি মনে খেতে হবে।

গুপ্লাই হচ্ছে এই পাড়ার ডেঁপো ছোকরা। কুলদেবতা আর লোক পেল না, শেষে কিনা গুপ্লাইয়ের উপর ভর করল! গুপ্লাই মুখে খিচুড়ি তুলতেই ভিরমি খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। গুপ্লাইয়ের মুখে জলের ছিটা দিলে জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফেরামাত্র সে রুষ্ট হয়ে বলল, “ওহে রামকিঙ্কর, আমি কুলদেবতা বলছি। তোর ব্যবহারে রুষ্ট হয়েছি। তুই লোকদের ভোজ খাওয়ানোর নামে ডেকে এনে শেষে কিনা বাটি করে খিচুড়ি দিচ্ছিস? তোর তো টাকার কোনো অভাব নেই। তাহলে এমনটা করলি কেন? তোর মৃত্যু আসন্ন।”

রামকিঙ্করবাবু ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, “ক্ষমা করুন কুলদেবতা। আর এমন ভুল হবে না।”

“তোকে একটা শর্তে ক্ষমা করতে পারি। যাদের যাদের তুই নিমন্ত্রণ করে ডেকেছিস, তাদের সবাইকে পাঁচদিনের মধ্যে খাসির মাংসের বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে। তা না হলে…”

“তাই হবে কুলদেবতা।”

শেষের কথাটা ইংলিশে ঝাড়ল কুলদেবতা, “ওকে, বাই।”

পাঁচদিন নয়, তিনদিনের মাথায় সেই দুশো জনকে আবার নিমন্ত্রণ করে খাসির মাংসের বিরিয়ানি খাওয়ালেন রামকিঙ্করবাবু। তবে গুপ্লাই সবার শেষে খেয়েছিল। গুপ্লাই খাওয়াদাওয়ার পর রামকিঙ্করবাবুর কানে ফিসফিস করে বলল, “উত্তমকুমারের মতো অভিনয় না করতে পারলেও খুব একটা খারাপ অভিনয় করি না। ভরে পড়ার অভিনয় করে কত সহজে আপনার টাকা খসালাম।”

বেচারা রামকিঙ্করবাবু। গুপ্লাইকে সেদিন কোনোরকম শাস্তি দিতে পারেননি। তাহলে যে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়ে তিনি সবার কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠতেন।

কিপটেমো যার রক্তে মিশে গেছে, সে কোনোমতেই শোধরায় না। আজকে যদিও রামকিঙ্করবাবুকে কিপটেমোর জন্য মিন্টু সন্দেহ করছে না। মিন্টু সন্দেহ করছে রামকিঙ্করবাবুর কিছু মতিগতি দেখে। এক, রামকিঙ্করবাবুকে দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ ঘাবড়ে রয়েছেন। কপালে জ্বলজ্বল করছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দুই, বাড়ির সদর দরজার সামনে ঘুর ঘুর করছেন। যেন দেখে মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ম্যারাথন দৌড় দেবেন। তিন, তিনি কুঁজো হয়ে আছেন। আর কিছুক্ষণ পরপর পেটে হাত বুলাচ্ছেন। স্যান্ডো গেঞ্জির ভিতরে সোনার হারটি লুকিয়ে রাখেননি তো!

রামকিঙ্করবাবুর সামনে গিয়ে মিন্টু দাঁড়াল। মিন্টু প্রথমে ভাবল, রামকিঙ্করবাবুর পেটে হাত বুলিয়ে দেখলে কেমন হয়। কিন্তু তারপর মিন্টু ভাবল, সোনার হার যদি না থাকে, তাহলে আর রক্ষে নেই। অযথা পেটে হাত বুলানোর অপরাধে রামকিঙ্করবাবু ঢ্যাঁড়সের মতো আঙুল দিয়ে না আবার বেশ করে মিন্টুর কান মুলে দেন!

দেখো কাণ্ড, এবার রামকিঙ্করবাবু পায়চারি করতে শুরু করলেন। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি কিছু একটা ভাবলেন। কিন্তু ভাবনাটা মনের মতো হল না। তাই আবার পায়চারি করছেন। এবার পায়চারি করতে করতে আবার কিছু একটা ভাবছেন। মুখে যেন ঘোর চিন্তা নেমে এল। তিনি গিয়ে চেয়ারে বসলেন। রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছলেন।

রামকিঙ্করবাবুকে লেজেগোবরে পড়তে দেখে মিন্টুর মন আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠল। মিন্টু এখন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত, রামকিঙ্করবাবুই চুরি করেছেন। পুলিশ আসার কথা শুনে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে এমন অবস্থা।

রামকিঙ্করবাবু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এদিক সেদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছেন। নিশ্চয়ই ওঁর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত আছে। রামকিঙ্করবাবু উঠোনের পূর্বদিকে হাঁটা দিলেন। মিন্টুও পিছু নিল। রামকিঙ্করবাবু কয়েক পা হেঁটে সুমনের বাবার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মুখ থেকে যেন শব্দ বেরোতে চাইছে না রামকিঙ্করবাবুর। তিনি খুব কষ্টে বলে উঠলেন, “একটা কথা বলতে পারি?”

সুমনের বাবা বললেন, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”

“আমার খুব পেট ব্যথা করছে। চাপতে পারছি না। আপনাদের বাথরুমটা ব্যবহার করতে পারি?”

“হ্যাঁ, ব্যবহার করতে পারেন। কিছু মনে করবেন না, তার আগে আপনার তল্লাশি করে নিতে চাই।”

রামকিঙ্করবাবুকে তল্লাশি করে কিচ্ছু পাওয়া গেল না।

মিন্টু ভীষণ হতাশ হল। বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বন্ধুদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রতন বলে ওঠে, “কী রে মিন্টু, মাথা থেকে গোয়েন্দা হওয়ার ভূত নেমেছে?”

মিন্টু কোনো উত্তর না দিয়ে চেয়ারে বসল। এমন সময় পাশ দিয়ে বাপিদা গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে যাচ্ছিল। বাপিদার উদ্দেশ্যে মানিক বলে ওঠে, “বাপিদা, তুমি তো সবার ফোটো তুলে বেড়াচ্ছ, ক্যামেরাটা দাও, তোমার একটা ফোটো তুলি।”

ক্যামেরা শব্দটা মিন্টুর কানে সুচের মতো বিঁধল। কিছু একটা ভাবল মিন্টু। ভাবনা থেকে কোনো ইঙ্গিত পেয়ে হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে মিন্টু চনমনে হয়ে বলল, “বাপিদা, ক্যামারাটা আমাকে দাও।”

এদিকে কেউ আর গুনগুনিয়ে কথা বলছে না। বাড়িতে দারোগাবাবু আসামাত্র সবাই দারোগাবাবুকে ঘিরে তারস্বরে বিক্ষোভ জানাচ্ছে। দারোগাবাবু এতে বেজায় চটে গেলেন। দারোগাবাবু ধমকে উঠলেন, “চুপ, একদম চুপ। কারো মুখে যদি এবার একটাও কথা শুনি, সোজা লক-আপে।”

দারোগাবাবুর ভয়ে বাঘে হরিণে একঘাটে জল খায়। তিনি একবার যেকথা বলে ফেলেন, তার নড়চড় হয় না। সেই কথা এখানে উপস্থিত সবাই ভালো করে জানে। তাই সবাই সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল। সুমনের বাবা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, “বসুন স্যার।”

চেয়ারে বসে দারোগাবাবু রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলেন, “খ্যান্তাদেবী কে?”

খ্যান্তাপিসি নেতানো মুড়ির মতো সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্যানপ্যানে স্বরে এরপর খ্যান্তাপিসি বলেন, “আমি।”

দারোগাবাবুর মাথার সামনের দিকে হাতে গোনা কয়েকটা চুল। তাছাড়া পুরো মাথায় টাক। প্যান্টের পকেট থেকে চিরুনি বের করে সামনের চুলগুলো পিছনের দিকে টেনে আঁচড়াতে আঁচড়াতে দাড়োগাবাবু বলে উঠলেন, “আপনার গলার হার চুরি হয়েছে?”

খ্যান্তাপিসি জবাব দিলেন, “হ্যাঁ।”

“কখন মনে হল আপনার গলার হার চুরি গেছে?”

“যখন সবাই মিউজিকাল চেয়ার খেলছিল তখন। কেক কাটার সময়ও হারটা গলায় ছিল।”

এমন সময় মিন্টু ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলে উঠল, “খ্যান্তাপিসি মিথ্যে কথা বলছেন। ওঁর কোনো হার চুরি হয়নি। কেক কাটার সময় থেকে ওঁর গলায় হারটা ছিল না।”

দারোগাবাবুর ভ্রূ বেঁকে গেল। “তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে ছোকরা?”

দৃঢ়ভাবে মিন্টু বলল, “আছে। এই দেখুন, বাপিদা ক্যামেরাটা দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু থেকে ফোটো তুলেছে। ফোটোগুলো দেখলেই বোঝা যাবে, অনুষ্ঠানের শুরু থেকে খ্যান্তাপিসির গলায় হার ছিল। কিন্তু কেক কাটার সময় ওঁর গলায় হারটা দেখা যাচ্ছে না।” দারোগাবাবুকে ক্যামেরাটা হাতে ধরিয়ে মিন্টু আবারও বলল, “মানিক তখন বাপিদার ফোটো তুলবে বলে ক্যামেরাটা চাওয়ার সময় হঠাৎ আমার মাথায় বিষয়টা নাড়া দিল। ভাবলাম, ক্যামেরার ফোটোগুলো একবার দেখলে কেমন হয়। কোনো ক্লু পেলেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কে জানত, ক্যামেরার ভিতর পুরো কেসটার সমাধান হয়ে রয়েছে!”

“এদিকে খ্যান্তামণিদেবী বলছেন কেক কাটার সময় হারটা ওঁর গলায় ছিল। হুম, কথার মধ্যে অসঙ্গতি। তার মানে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!” এই বলে দারোগাবাবু ড্যাবড্যাবে চোখে ক্যামেরার স্ক্রিনে ভেসে থাকা একের পর এক ফোটোগুলো দেখতে লাগলেন।

এমন সময় খ্যান্তাপিসি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি মিথ্যে কথা বলেছি। আমার গলার হার চুরি যায়নি।”

সুমনের বাবা অবাক হয়ে বলেন, “দিদি, তুই এমন কাজ করতে গেলি কেন?”

খ্যান্তাপিসি চোখের জল মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, “তোদের উপর প্রতিশোধ নিতে। চার বছর আগেকার সেই ঘটনার কথা মনে করে দ্যাখ। আমার স্বামী হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আমি তোদের কাছে সামান্য টাকা চাইতে এসে ছিলাম। তোরা মুখের সামনে বলেছিলি টাকা দিবি না। মা মরার আগে তোদের কত টাকা, সোনা-গয়না দিয়ে গেছে। তোদের উচিত ছিল না সেই সময় সামান্য টাকা দিয়ে আমায় সাহায্য করার? তাই তোদের আজ অপমানিত করতে চেয়েছিলাম।”

সুমন কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এসে খ্যান্তাপিসি হাত ধরে কান্না জড়ানো স্বরে বলল, “পিসি, তুমি আর রাগ কোরো না।”

খ্যান্তাপিসি সুমনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই বিশ্বাস কর, রাগের বশে ঘটনাটা ঘটিয়ে এতক্ষণ সেই অনুতাপের আগুনে জ্বলছিলাম।”

কথা শেষ হতে না হতেই দারোগাবাবু বলে উঠলেন, “শুধু ওর কাছে নয়, আইনের কাছেও আপনি অপরাধী। তবে আপনাকে শাস্তি দেবে খুদে গোয়েন্দা মিন্টু। বলো মিন্টু, কী শাস্তি দেবে।”

মিন্টু তৎক্ষণাৎ কিছু একটা ভেবে বলে উঠল, “খ্যান্তাপিসি যেন আমাদের সঙ্গে এখন হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠেন।”

মিন্টুর কাছে দারোগাবাবু এমন একটা শাস্তি শোনার আশাই করে ছিলেন। তিনি গোঁফের সামনে আলতো আবেগময় হাসি জমিয়ে বলে উঠলেন, “উচিত শাস্তি।”

দারোগাবাবু মিন্টুর পিঠ চাপড়ে চলে গেলেন।

শিক্ষক বটকৃষ্ণবাবু ঘোষণা করলেন, মিন্টু গোয়েন্দাগিরিতে সফল হয়েছে বলে তাকে উপহার দেবেন।

এদিকে খ্যান্তাপিসি প্রথমে কিন্তু কিন্তু করছিলেন। অবশেষে খ্যান্তাপিসি মিন্টুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বলেন, “মিন্টু, তোর কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম। পাপ করা থেকে তুই আমায় বাঁচালি।”

সুমনের বাবা ধরা গলায় বললেন, “পাপ তুই একা নয়, আমিও করেছি। তুই আমাকে ক্ষমা করেদে দিদি। আসলে লোভ মানুষকে হিংস্র করে তোলে। যার ফলে সম্পর্কের দায়দায়িত্বের আর কোনো মূল্য থাকে না।”

“আয় ভাই, সবকিছু ভুলে গিয়ে সুমনের জন্মদিনে আনন্দে মেতে উঠি।” এই বলে খ্যান্তাপিসি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গেয়ে উঠলেন, “আজ আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও… আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধূলার ঢাকা ধুইয়ে দাও…”

সুমনের দিকে মিন্টু তাকাল। মিন্টু দেখে, সুমন আনন্দে রীতিমতো নাচতে শুরু করেছে। তা দেখে মিন্টুর খুব ভালো লাগছে। এর চেয়ে বড়ো উপহার মিন্টু কী আর পেতে পারে।

অলঙ্করণ:সায়ন মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s