আগের এপিসোড- ঝিয়ের গল্প্ , ডাকাতের কবলে, প্রাণ বাঁচাল ভালুকে, অকারণে, দুই চিনা ডাকাত
কয়েক বছর আগের কথা। মফস্সলে, কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়, এক বাঙালি ভদ্রলোক বসবাস করতেন। লোকটি বয়স্ক। তাঁর বিরাট পরিবার—ছেলেরা, নাতিপুতিরা, তাঁর ভাইয়েরা, তাদের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা আর বেশ কয়েকজন দুঃস্থ আত্মীয়স্বজন—সবাই মিলে পিতৃপুরুষের ভিটেয় সুখেই বসবাস করতেন।
বাড়িটা পুরোনো ধাঁচের, বারান্দা ও উঠোন-সহ অনেকগুলো ঘর। বড়ো দালানে বাড়ির পুজো-টুজো হত। এখানেই বাড়ির মেয়েদের বিয়েশাদিও হত; পুরুষানুক্রমে পুরোনো দেয়ালগুলো এই পরিবারের মিলনোৎসব আর জড়ো হবার সাক্ষী হয়ে ছিল।
বাড়ির চারপাশে অনেকটা জায়গা। অন্দরমহলের প্রায় লাগোয়া এক বিরাট সবজি বাগান। ওখান থেকেই বাড়ির নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সবজির জোগান হত। এতই ফলন হত যে ঝাঁকা ভর্তি করে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন আর কাছাকাছি মন্দিরেও পাঠানো হত।
কিছুটা দূরে একটা ফলের বাগান। বসন্তে সেখানে অসংখ্য আমগাছে চোখজুড়োনো বোল আসত। সেখানে কাঁঠাল, জাম, পেঁপে আর পেয়ারা গাছ ছিল অগুনতি। পাশাপাশি সারবাঁধা কলা, নারকেল আর সুপুরি।
এত বড়ো জায়গাতে যথেষ্ট জলের জোগানের জন্য বাগানে ফলের বাগিচায় আর আস্তাবলে একাধিক পুকুর এবং কুয়ো ছিল। বাড়ির সামনের দিকে পাড় বাঁধানো দিঘি বা ঝিল; তার পাড় থেকে জল অবধি শ্বেতপাথরের সিঁড়ি। এখানে বাড়ির বয়স্ক পুরুষ এবং কমবয়সি ছেলেরা জড়ো হয়ে গপ্পগাছা করত আর ঠান্ডা দখিনা বাতাস উপভোগ করত। কখনও পাড়াপ্রতিবেশীরাও আসত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্বেতপাথরের সিঁড়িতে আমোদে কাটত।
দু-পাশে গাছের সারি দেওয়া পথ, উঁচু বেড়া বাড়িটাকে বেশ আড়াল দিয়ে রেখেছিল আর বাড়ির ছাদটা ছিল পরিবারের পর্দানশীন মহিলা-মহলের চমৎকার আমোদ-প্রমোদের জায়গা।
বুড়ো কর্তার ধনসম্পত্তি জোর আলোচনার বিষয় ছিল, মহিলাদের দামি দামি জামাকাপড়, গয়নাগাঁটি নিয়েও কথাবার্তা হত। একদিন বুড়ো কর্তা এক ডাকাতদলের একটা আগাম চিঠি পেলেন যে সে-রাতেই তারা বাড়িতে চড়াও হবে। তড়িঘড়ি শলাপরামর্শ করে পরিবারের লোকেরা সমস্ত ধনরত্ন, দামি জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করে পালিয়ে অন্যত্র আস্তানা নিল। ঠিক হয়েছিল রাতটা কাটানো হবে বেশ কিছু মাইল দূরে এক জায়গায়।
উত্তেজনার চোটে এক তরুণী মায়ের ছেলেটা তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে পড়ল। বাচ্চাটার বয়স তিন কি চার বছর মতো। মা ভাবল ছেলে নিশ্চয়ই কারও না কারও সঙ্গে কোনও না কোও গাড়িতে উঠেছে, তাই সে অত গা করেনি। কিন্তু আশ্রয়স্থলে পৌঁছোনোর পর দেখা গেল ছেলে কারও সঙ্গেই নেই।
মায়ের মনের দুর্দশা আরও ঘনিয়ে উঠেছিল। সে তার ছেলের জন্য ফিরে যেতে চাইছিল, কিন্তু তখন অন্ধকার নেমে আসছে আর ডাকাতের মুখোমুখি হবার ভয়। সুতরাং তার ইচ্ছের আমল দেওয়া হল না আর সারারাত ধরে মনে মনে তার ছোট্ট ছেলেটার নানান পরিণতির কথা ভেবে সে ভয়ানক উৎকণ্ঠায় কাটাল।
এদিকে হয়েছে কী, ছেলেটা তো দিব্যি মায়ের ঘরে নিজের বিছানায় আরাম করে শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল। খেলাধূলা করে ক্লান্ত হয়ে এসে সবার অজান্তে কখন ঘরে ঢুকে সে ওখানে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রাত বারোটার সময় ডাকাতেরা এসে দরজা ভেঙে ঢুকল বাড়িতে। খালি ঘরে ঢুকে তারা খুঁজে-পেতে নিয়ে যাবার মতো দামি কোনও কিছুই না পেয়ে ভয়ানক চটে গেল। শেষে তারা এসে পড়ল সেই ঘরে যেখানে ছোটো ছেলেটা ঘুমিয়ে ছিল। তাদের হাঁকডাকে ছেলেটার ঘুম গেল ভেঙে। সে উঠে বসে অজানা-অচেনা মুখ দেখে আর জ্বলন্ত মশাল দেখে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। তাদের মধ্যে একজন ওকে শাসাল, যদি চুপ না করে তাহলে সে ওকে মেরেই ফেলবে। আরেকজন আবার বিছানার কাছে এগিয়ে এসে ছোটো ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “কেঁদো না খোকা, কেউ তোমায় মারবে না।”
বাচ্চাটা ওর বাপের চাকরের গলা চিনতে পেরে কচি কচি হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল। বাকি ডাকাতেরা এই দেখে হেসে উঠে ছেলেটাকে তাদের স্যাঙাতের কাছে রেখে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
দিনের আলো ফুটলে বাড়ির লোকেরা সকলে ফিরে এলে তরুণী মা পড়িমরি বাড়ির ভেতরে ছুটল ছেলেকে খুঁজতে। বিস্ময়ে এবং আনন্দে মা দেখল তার নিজের ঘরে ছেলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তার পাগলের মতো আদরের ঠেলায় ছেলে জেগে গেল, কিন্তু সে বুঝতে পারল না মায়ের হয়েছেটা কী!
“রাতে কিছু ঘটেনি, হ্যাঁ রে খোকা?” শুধোল মা, “কিছু বা কাউকে দেখিসনি? ও খোকা!”
ছোটো ছোটো হাতের মুঠি চোখের ওপর ডলতে ডলতে ঘুম-জড়ানো গলায় ছেলে বলল, “ ও, হ্যাঁ, তুমি কোথায় ছিলে মা? অনেকগুলো লোক এসেছিল। কেউ কেউ আমাকে মারতে চাইছিল। কিন্তু –(চাকরটির নাম নিয়ে) ছিল ওদের সঙ্গে, ওই ওদের ভাগিয়ে দেয়। তারপর আমায় মিষ্টি খেতে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।”
চাকরটাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আর সে সব কবুলও করেছিল যে যারা চিঠি পাঠিয়েছিল, সেই ডাকাতদলে ও-ও ছিল আর ওরাই বাড়িতে চড়াও হয়। প্রায় গোটা ডাকাতের দলটাই ধরা পড়ে।
জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে