আগের সহজ গল্প- পুঁচকে গাছের কথা
রোবোটোপিয়াতে থাকত তিন রোবট। লালু নীলু আর ভুলু। নীলুর রঙ নীল, লালুর রঙ লাল। তোমরা ভাবছ বুঝি ভুলুর নাম তাহলে ভুলু কেন? ওর রঙ তো হলুদ। আসলে ভুলু কিনা বেজায় ভোলামন। সব ভুলে যায়। এই যেমন ধরো সেদিন সকালে লালুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলল, বাড়ি ফিরল, তারপর নাইল খেল। মানে ওই শরীরটা একটু তেল পালিশ করে চকচকে করে নিল আর কী! রোবটরা তো আর তোমার আমার মত পুকুর জলে ডুবে বা কলের জল বালতিতে ভরে অথবা মাথার ওপর শাওয়ার খুলে চান করে না। আর খাওয়া বলতে ওই একটু তেল চেটে নাও তারপর তার লাগিয়ে বিজবিজ করে ‘কারেন’ খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলো। তা সেই সব সব সেরে দুপুরে বসে বসে ভুলু ভাবতে শুরু করল ওবেলা বুঝি নীলুর সঙ্গে ধরাধরি খেলেছিল। বোঝো!
তারপর গতপরশুর ঘটনাখানাই ভাবো না একবার। নীলুর বাড়িতে চড়ুইভাতি ছিল সেদিন দুপুরবেলায়। এদিকে ভুলু ভুল করে গিয়ে হাজির হল লালুর বাড়ি। ওদিকে লালুও তো ঘরের দরজায় ইয়াবড় তালা ঝুলিয়ে চলে গেছে নীলুর বাড়ি চড়ুইভাতি করতে। ভুলু দোরগোড়ায় বসেই থাকে বসেই থাকে, বসে বসে কোমর কনকন করে। ভাবে এই বুঝি চড়ুইভাতি শুরু হবে, মজা হবে খুব। বেলা গড়িয়ে বিকেল নামে, দম দেওয়া কলের পাখিরা বাসায় ফেরে, লালু আর ফেরে না। শেষমেষ ভুলুই বাড়ি ফিরে গেল।
পরের দিন বিকেলে খেলতে গিয়ে নীলু শুধোয়, “কী রে ভুলু চড়ুইভাতি করতে এলি না যে আমার বাড়ি? আমরা সবাই কত শত মজা করলুম!”
ভুলু তখন ঠং করে লোহার হাতে লোহার কপাল চাপড়ে বললে, “এই যাহ্! আমি ভাবি চড়ুইভাতি বুঝি লালুর বাড়ি। সেথায় গিয়ে বসেই রইলুম, বসেই রইলুম। কী বোকা আমি!”
লালু নীলু মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ভুলুর। বলে, “আহা রে, মন খারাপ করিসনে। চড়ুইভাতি আবার হবে’খন। তুই বোকা না রে ভাই বোকা না। তুই হলি গিয়ে ভুলোমন। সাধে কি আর তোকে ভুলু বলে ডাকি আমরা?”
এরকমভাবেই দিন চলছিল। কিছু ভুলে কিছু খেলে কিছু হেসে। তারপর একদিন রোবোটোপিয়াতে শুরু হল বিশাল বড় একটা মেলা। যে সে মেলা নয়। রোবটদের জন্য নতুন নতুন কল, পালিশ করার জন্য নানারকম তেল, ‘জং থেকে বাঁচার একশ উপায়’ নামওয়ালা বই, নাগরদোলা, তামার তার দিয়ে তৈরি বুড়ির চুল। কী নেই সেখানে! কতরকমের খেলা দেখানো, জাদু দেখানো রোবটও এসেছে।
রোবোটোপিয়ার সব রোবট তো দল বেঁধে ছুটল মেলা দেখতে। লালু নীলুও জোরকদমে আলোচনা করছে কবে মেলা যাবে, কী কিনবে, কীসে চাপবে, কী খাবে, কোন শো দেখবে। শুধু ভুলুই একেবারে চুপটি করে বসে আছে। কেমন যেন মুষড়ে আছে। আসলে ছোটোবেলায় ভুলু একবার বাবা মায়ের সঙ্গে মেলায় গিয়েছিল। তারপর কী যে বিপদ হয়েছিল! ভুলুর তো ভোলামন। হাঁ করে নাগরদোলা কেমন করে ঘুরছে দেখতে দেখতে বাবার আর মায়ের হাতদু’খানি দিল ছেড়ে । আর ওমনি গেল হারিয়ে। নাগরদোলা থামতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে মা কোথাও নেই। বাবাও নেই আশেপাশে। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল। তারপর অনেক ঝামেলার পর রোবোপুলিশ এল তাদের গাড়িতে ‘নিঁ নঁ নিঁ নঁ’ আওয়াজ তুলে। ভুলুকে তারা যত শুধোয় “তোমার নাম কী?, বাবার নাম কী? মায়ের নাম কী?, কোথায় থাকো?” ভুলু তত গলা ফাটিয়ে কাঁদতে থাকে। শেষমেষ যে কত ঝামেলি করে ভুলুকে ফেরত পাওয়া গেল! ভুলু অনেক কিছু ভুলে গেলেও এই ঘটনাটা ভোলেনি।
কাজেই মেলার নামেই তো ভুলুর ভয়ে দুই হাঁটুর লোহার বলে খটখটানি ঠঙঠঙানি লাগে। এদিকে লালু নীলুর মন খারাপ। ভুলুকে ছাড়া যেতে কি আর ভালো লাগে ওদের! সেই কোন ছোটোবেলা থেকে খেলুড়ে ওরা। একই রোবোকারখানায় পাশাপাশি গড়েছে ওদের কারিগর। তারপর রোবো বাবামায়েদের কোলে চেপে যে বাড়ি এল, সে-ও তো একই পাড়ায় পাশাপাশি বাস। আসলে হয়েছিল কী ভুলু তো ছোটোবেলায় বেজায় ছটপটে ছিল কিনা। কারখানাতেই একদিন ছোটাছুটি করতে গিয়ে মাথার ভেতরের একটা কল খুলে পড়ে যায় ভুলুর। তাই ওর এমনধারা ভোলামন। কারিগর অনেক কসরৎ করেছিল ভুলুকে ঠিক করার তবে সেই যে কলটা হারিয়ে গেল, অমনটি আর মিললই না।
তবে কি ভুলুর আর কোনওদিন মেলায় যাওয়া হবেই না?
অনেক ভেবে ভেবে লালু নীলু মাথা খাটিয়ে একটা উপায় করল। দু’জনায় ছুটল সেই কারখানার কারিগরের কাছে। সারা সকাল কারিগর আর লালু নীলু মিলে খুটুর খাটুর ঘুটির ঘাটুর করল। তারপর দুপুরবেলায় লালু নীলু ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল ভুলুর বাড়ি।
“ভুলু রে!”
“ও ভুলু!”
ভুলু তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসতেই লালু আর নীলু ওর দুইহাতে দুটো গোল গোল লাল আর নীল রঙের কী যেন পরিয়ে দিল। ভুলু হকচকিয়ে বললে, “এই হাতকড়ার মত জিনিসগুলো কী রে? আমায় পরালি কেন? শিগগির খোল!”
লালু নীল হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “খবরদার খুলবিনেকো!এগুলো তোর ভুলোমনের দাওয়াই, মেলায় যাওয়ার টিকিট।” ভুলুর মুখে তো একগাল মাছি। বলে কী এরা দুটোতে!
লালু নীলু বলে, “দেখ ভুলু মেলায় বা ভিড়ে আর কোথাও তোর হারাবার বিপদ নেই। তুই সব ভুলে গেলেও আমাদের নাম তো ভুলবি না। লালু আর নীলু মনে থাকলেই হাতের এই লাল আর নীল চাকতিদুটোর এই বোতাম দুখানা টিপে দিবি। ওমনি আমাদের মাথায় খবর চলে আসবে তুই কোথায় আছিস। আমাদের থেকে কয় পা দূরে, ডাইনে নাকি বাঁয়ে, সব জেনে যাব আমরা। ওমনি চলে আসব তোর কাছে। তুই যতই হারিয়ে যাস আমরা তোকে ঠিক খুঁজে পেয়ে যাব! কী? কেমন উপায় বল দিকি!”
ভুলু একগাল হেসে, এক পাক নেচে ঘুরে বললে, “তাহলে আর দেরি কীসের? চল আজ বিকেলেই মেলায় যাই! তামার ফিনফিনে তারের বুড়ির চুল কতদিন খাইনি!”
তারপর… তারপর মেলায় লালু নীলু আর ভুলু তিন ইয়ারে মিলে কী করল সে কাহিনী আরেকদিন শোনাব’খন।
(শেষ) ছবি : ঐশিক
মজার, বেজায় মজার। কী ভালো ছবি! ঐশিককে আদর।
LikeLike
সেই গল্পটা তুমি মনে হচ্ছে ভুলে গেছ সেইজন পরের বারএর জন্য তুলে রাখলে । তুমি এককাজ কর গল্প লিখে সেটা নিমো বাবুকে দিয়ে দাও । সে ভুলবে না ।
LikeLike