বিদ্যালয়: সারদা শিশু তীর্থ সারদা বিদ্যামন্দির, পূর্ব খাগরাবাড়ি কোচবিহার,ষষ্ঠ শ্রেণি
সমাজ এখনও কুসংস্কার থেকে মুক্তি পায়নি। দু-হাজার চোদ্দ সালের ২৬ জানুয়ারি আমরা চার বন্ধু—আমি, ব্রাভো, আকাশ, সৃজনী ঘুরতে বের হয়েছি। আমরা চারজন ছোটবেলায় বন্ধু। আমাদের গ্রামে ভালো স্কুল নেই বলে আমাদের মা-বাবারা আমাদের কলকাতা বোর্ডিংয়ে পড়াশোনা করান। বড়ো হয়ে আমি চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম। হঠাৎ আমি বিমানবাহিনীতে পাইলটের চাকরি পেয়ে গেলাম। আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করলাম। আমারা গ্ৰামে থাকতে পারি, কিন্তু এই গ্ৰামে আমাদের চারজনের বাড়িই ছাদ পিটানো। আমাদের মায়েরা চার বান্ধবী ছিলেন আর আমাদের বাবারাও চার বন্ধু ছিলেন। ব্রাভো ক্যারটের টিচার, ক্যারাটে শেখায়; সৃজনী বড়ো গায়িকা; আর আকাশ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। আমরা বিভিন্ন সময় ছুটিতে একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। এবারে আমরা এসেছি মফস্সল গ্ৰাম মাঘপালাতে। প্রথম দিন আমরা ওখানে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছি। হঠাৎ করে আকাশ বলল, “দেখ, মেয়েটিকে ঘিরে কত লোক জড়ো হয়েছে।”
আমরা ওদিকে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম একজন কুৎসিত লোক, পরনে লম্বা কুর্তা ছোটো পাজামা মাথায় কালো কাপড় বাঁধা, গলায় ঝুলছে তিন-চারখানা বড়ো বড়ো তাবিজ, হাতে একগোছা ময়ূরপুচ্ছ। লোকটা ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে মেয়েটার গায়ে বোলাচ্ছে এবং আরবি অথবা ফারসি ভাষায় কী যেন বলেই চলছে। হঠাৎ করে লোকটা ময়ূরপুচ্ছ ছেড়ে মেয়েটির গায়ে ঠান্ডা জল ঢালছে। চারপাশে সবাই বাকরুদ্ধ এবং একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ অঝোরে কেঁদেই চলেছে। হঠাৎ লোকটি মেয়েটিকে নারকেলের ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করা শুরু করে। এর সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয় মেয়েটির আর্তনাদ। এই দেখে ব্রাভো নিজের ধৈর্য রাখতে না পেরে বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলল, “থামুন!” বলেই দৌড়ে গিয়ে ওই কুৎসিত লোকটিকে এক ধাক্বা দিয়ে মাটিতে ফেলে মেয়েটিকে উঠিয়ে নিয়ে এল। এই ঠান্ডাতেও মেয়েটার গা থেকে ঘাম ঝরছে, সারা গায়ে ক্ষত।
আকাশ যেখানেই যায়, ওর কিছু দরকারি ওষুধপত্র সঙ্গে রাখে। ব্রাভো বলল, “আকাশ, ওকে ওষুধ লাগিয়ে দে তো।”
আকাশ বলল, “মাধুরী, আমার ব্যাগটা দে তো।”
আমি দিলাম। আকাশ মেয়েটির গা ভালো করে মুছিয়ে গায়ে তারই একখানি জ্যাকেট জড়িয়ে দিয়ে ক্ষত জায়গাটি পরিষ্কার করে দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিল। আস্তে আস্তে সব লোক চলে যাচ্ছিল। কুৎসিত লোকটা এদিকে এসে বলল, “আপনারা কাকে সেবা করছেন জানেন? এই মেয়েটার শরীরে জিন বাসা করেছে।”
ব্রাভো ওর কথা শুনে বলল, “চুপ করুন! আপনি কি মূর্খ?”
সৃজনী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন লোকটার কথা শুনে বলল, “আপনি যদি আর একটা কথা বলেন তাহলে আমরা পুলিশে ফোন করব।”
শুনে লোকটা বলল, “ভুল করেছেন আপনারা।” বলে চলে গেল।
লোকটা যাওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা ছেলে এসে বলল, “আপনাদের আল্লা পাঠিয়েছেন।”
আমরা বললাম, “তুমি কে?”
ও বলল, “আমার নাম নাসির। ও আমার বোন নুসরত। আমরা খুব গরিব। আমি রঘুদার চায়ের দোকানে কাজ করি। আমার আব্বাজান কিছু কাজ করে না, সারাদিন মোল্লা-মৌলবিদের ফাইফরমাস মতো কাজ করে। আমার আম্মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে। আমার বোনের যে কি হল—ঠিকমতো খায় না, চুপ করে বসে থাকে। একদিন মোল্লা সাহেব আমার বোনকে দেখে বলল ওকে নাকি জিনে ধরেছে।”
সৃজনী বলল, “ওকে কয়েকটা বিস্কুট দে।”
আমি ওকে দুইটি বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে বললাম, “এখন বোনকে নিয়ে যাও। ওই কুয়োটার পাশে আমাদের তাঁবু। যদি ওই লোকটি আবার কিছু করে বা কিছু বলে, তাহলে আমাদের এসে বলবে।”
তারপর আমরা বাকি সময় ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দিলাম।
***
সকালে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছি, নাসির নামের ছেলেটা দৌড়ে এসে ভয়ার্ত মুখে বলল, “ওরা আবার আমার বোনকে মারছে।”
চা খাওয়া মাথায় উঠল। আমরা ওকে অভয় দিয়ে বললাম, “কিছু হবে না, তুমি আমাদের ওখানে নিয়ে চলো।”
ও আমাদের নিয়ে এল। আমার ওখানে গিয়ে যা দেখলাম তা শুনলে তোমাদের মাথা গরম হয়ে যাবে। আজকেও লোকটি মেয়েটিকে ঝাড়ু দিয়ে মারছে আর চিৎকার করে বলছে, “যা যা, বোতলের ভিতরে গিয়ে ঢোক।”
মেয়েটার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এবার লোকটি মেয়েটিকে আবার ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করা শুরু করল। লোকটি এত জোরে জোরে মারছিল যে এবার মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেল। এটা দেখে ব্রাভো দৌড়ে গিয়ে লোকটিকে একটা সাইড কিক মেরে দিল। লোকটি লুটিয়ে পড়ল।
আকাশ বলল, “ওকে এখনই হসপিটালে ভর্তি করতে হবে, না-হলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না।” বলেই ও মেয়েটাকে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে আমাকে আর সৃজনীকে গাড়িতে উঠে বসতে বলল।
ব্রাভো বলল, আমি এখানেই থাকছি। পুলিশকে খবর দিয়েছি, ওঁরা এখনই আসছেন।”
মেয়েটিকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। মেয়েটির না খাওয়ার কারণ জানা গেছে তার মুখে ও গলায় ঘা।
ওই লোকটির শিশুর ওপর অত্যাচারের মামলায় চোদ্দ বছরের জেল হয়েছে। আজকে দু-হাজার পনেরোর ২৬ জানুয়ারি। একই তারিখ, একই মাস, শুধু বছরটা এক বছর এগিয়েছে। চা খেতে খেতে এগুলোই গল্প করছি।
হঠাৎ আকাশ বলল, “কুসংস্কারও মানুষের বিপদ ডেকে আনে!”
খুদে স্রষ্টাদের সমস্ত কাজের লাইব্রেরি