TOYঢাক-সহজ গল্প- ঘুমোই আর ঝিমোই-সুস্মিতা কুণ্ডু-বসন্ত২০২৩

toydhaksahajgalpo84

এক পাড়ায় থাকত দুই বেড়ালছানা। একজনের নাম ঘুমোই, আরেকজনের নাম ঝিমোই। ঝিমোই হল কুচকুচে কালো ঝাপুস ঝুপুস ছানা আর ঘুমোই হল ধবধবে সাদা নাদুস নুদুস ছানা। নাম শুনেই বুঝতে পারছ যে ঝিমোই সারাদিন শুধু বসে বসে ঝিমোয় আর ঘুমোই দিনরাত পড়ে পড়ে ঘুমোয়। তাই অমনধারা নাম ওদের। তাতে যদিও ওদের দুটির কিছু আসে যায় না।

একদিন হয়েছে কী পাড়ায় নাকি কীসের উৎসব তাই টানা তিনদিন সারাবেলা ধরে ইয়া বড়ো বড়ো ধুতরো ফুলের মত দেখতে চোঙা লাগিয়ে সব ধাঁইধপাধপ গান বাজনা বাজছে। চারপাশের এত এত লোক গিজগিজ করছে আর বকম বকম করছে যে কান পাতাই দায়। সেইসব শুনতে শুনতে ঝিমোই আর ঘুমোই কিছুতেই পাঁচিলে বসে আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। সবে ঢুলটা ধরে এসেছে কি আসেনি, সবে ঝিমটা লেগেছে কি লাগেনি, ওমনি কেউ না কেউ কানের কাছে হাঁকডাক করছে আর বেচারা বেড়ালছানাদের ঘুমের রেশটুকুও চটকে একশা।

একদিন যায় দুদিন যায় শেষমেশ তিন দিনের দিন ঘুমোই বেড়ালছানা ঝিমোই কে বললে, “ভাই ঝিমোই, এভাবে তো আর পারছিনাকো। দু’দিন হল একটুকুনিও ঘুমুইনি। শরীর তো আর চলে না। এই বুঝি পাঁচিল থেকে ডিগবাজি খেয়েই পড়ে যাব এমন মাথা ঘুরছে ভনভন করে।”

ঝিমোই বলে, “ঠিক বলেছ ভাই ঘুমোই। আমারও তো একই দশা। চুপটি করে যে পড়ে পড়ে একটু ঝিমুবো তার জো নেইকো। এই মানুষগুলো কী ঝকমারি বাঁধালে বল দেখি! সেই কবে থেকে এ-পাড়ায় বাস করছি এমনধারা উৎসবের তো নামও শুনিনি কখনও। এবার দেখছি এতদিনকার ঠাঁই ছেড়ে বিদেয় নিতে হবে।”

ঘুমোই বেড়াল কোনওমতে চোখদুটি পিটপিট করে খুলে ঘাড় চুলকে বলে, “কথাটা খুব একটা ভুল বলোনি ভাই। আমারও মনে হয় এইটেই শেষ উপায়।”

যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দুই বেড়াল ঝিমোই আর ঘুমোই চলল নতুন নিরিবিলি জায়গার খোঁজে যেখানে দুটিতে কোনওরকম ডামাডোল শোরগোল ছাড়া একটু আয়েশ করে ঘুমোতে ঝিমোতে পারবে।   

চলতে চলতে অনেকটা পথ পার হল দু’জনায়। পা টনটনায় লেজ কনকনায়। গায়ে ধুলোমাখা। চুপিচুপি তোমাদের বলে দিই আসলে তারা পাড়ার বাইরেই বেরোতে পারেনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আর ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে দুই বেড়াল ভারি আলসে হয়েছে কিনা। তাই এক পা চলে আর ভাবে বুঝি এক মাইল পথ পেরিয়েছে। পাড়ার শেষমাথায় ছিল একটা বিশাল বড়ো আম জাম কাঁঠালের বাগান। তিনতলা চারতলা বাড়ির সমান উঁচু উঁচু গাছ সব সেখানে। সেই বাগানের ইট ফোকলা পাঁচিল গলে ভেতরে সেঁধোল দুই বেড়াল। এদিক সেদিক খুঁজে একটা সাফসুতরো জায়গা পেল দুজনে। দুটো বড় বড় আমগাছের গুঁড়ির মাঝের বেশ খানিকটা জায়গা কে যেন ঝাঁটপাট দিয়ে রেখেছে। গাছের গুঁড়ি দুটো বেড় দিয়ে  একটা দোলনা টাঙানো। এতেই শেষ নয়, দোলনার ওপর আবার দুটো গাবদাগোবদা বালিশ রাখা। তবে বেশ ধুলো সবকিছুর ওপর। আরাম করে কেউ ঘুমোত মনে হয় এই আমবাগানে। যাই হোক গে, আপাতত এখানেই ঝিমোই আর ঘুমোই বেড়াল ঘাঁটি গাড়বে ঠিক করল।

তুড়ুক করে লাফ মেরে দোলনাটায় উঠে দুটো বালিশের ওপর জায়গা দখল করল দুটিতে। আহা, নরম নরম বাতাস বইছে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে, দোলনা একটু একটু দুলছে। এমন জায়গাতেই তো খাসা ঘুম ধরবে। কয়েক পল যেতে না যেতেই ঘুমোই বেড়াল চিতপটাং হয়ে শুয়ে নাক ডাকতে শুরু করলো আর ঝিমোই বেড়াল লোম ফুলিয়ে ঘাড় ঝুঁকিয়ে ঢুলতে লাগল।

কতোটা সময় না জানি এমনি করে কেটে গেল। দিন গড়িয়ে রাত নেমে এলো। আমবাগানের চারিদিকে ঝুপুস করে কে যেন কালো চাদর ঢাকা দিয়ে দিল। ঘুমোই আর ঝিমোই এর সেদিকে হুঁশ নেই। তারা তাদের ঘুমেই মজে আছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা দিল বাঁকা চাঁদটা। সেই সাথে একটা আমগাছের কোটর থেকে একটা বুড়ো পেঁচা আর আরেকটা আমগাছের গোড়া থেকে একটা মেঠো ইঁদুরও উঁকি দিল।

দোলনার ওপর দুইখানা বেড়ালকে ঢুলতে দেখে মেঠো ইঁদুর কোটরের পেঁচার দিকে চেয়ে বলল, “ও পেঁচাদাদু। দেখেছ কী কারবার? দুটো বেড়াল এসে জুটল আমাদের আমবাগানে আবার কোথা থেকে?”

বুড়ো পেঁচা বলে, “তাই তো রে! এ তো মহা উৎপাত হল। এবার বেড়ালের পেছু পেছু কুকুর আসবে। দিনরাত কুকুর বেড়ালে ঝগড়া বাঁধাবে। আমরা যে দিনের বেলাটুকু আরাম করে ঘুমিয়ে রাতে জাগি তার তো দফারফা করবে রে। গোটাকতক মানুষদের ছেলেপিলে এসে এইসব দোলনাটোলনা বেঁধে কিসব পিকনিক করে কদিন কী ভোগানটাই না ভোগালে। তারা বিদেয় হতে না হতেই এখন আবার এরা এসে জুটল। ওই দেখ দেখ কেমন মানুষগুলোর ফেলে রেখে যাওয়া দোলনায় রাজার মত শুয়ে নাক ডাকছে। রোসো! মজা দেখাব তোমাদের।”

বুড়ো পেঁচা আর মেঠো ইঁদুর মিলে মতলব ভাঁজে। কী করে তাড়ানো যায় দুই বেড়ালকে। যা নাক ডাকিয়ে ঘুম লাগিয়েছে দুটোয়! ইঁদুর বললে, “পেঁচা দাদু, আমরা ঘুমনোর সময় কেউ আওয়াজ করলে যেমন রেগে যাই ওরাও তো তেমনই রেগে যাবে, তাই না? আমরা চলো বেশটি করে উৎপাত করি, তাহলেই ওরা এই আমবাগান থেকে দূর হবে।”

যেমনি ভাবা তেমনি কাজ!

পেঁচা দাদু গাছের কোটর থেকে উড়ে দোলনার দড়িটার ওপর এসে বসে গোলার লোম ফুলিয়ে চোখ বড় বড় করে ডাকতে শুরু করল,

– “হুট হুট হুটুর হুটো

  সাদা কালো বেড়াল দুটো,

  গমগমিয়ে ডাকছে নাক

  হুটুর হুট ভাগ রে ভাগ!”

তার সাথে তাল মিলিয়ে মেঠো ইঁদুর করল কী দোলনা বেয়ে উঠে নিজের সরু লেজটা দিয়ে দুই বেড়ালের নাকে বেজায় সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। এই রকম দু তরফা উৎপাতের ভেতর আর কীকরেই বা ঘুমোয় বেড়ালদুটো। একটু পরেই হাঁচতে হাঁচতে উঠে বসল দুজনায়। আর ওমনি পেঁচা আর ইঁদুর লুকিয়ে পড়লও যে যার কোটরে।

ঘুমোই আর ঝিমোই চোখ রগড়ে এ ওর মুখের দিকে চায়।

-কে যেন ‘ভাগ ভাগ’ বলে তাড়ালো।

-কে যেন সুড়সুড়ি দিয়ে হাঁচালো!

চারিদিকের এমন কালো আঁধার আর বড় বড় ডালপালার খসখস আওয়াজ, নানারকম ডাক শুনে তো দুই বেড়ালের বুক কাঁপে, ভয়েই হাল খারাপ। এ তো আমবাগান নয়, ভুতেদের খাস তালুক। মানুষের পাড়ায় বাস করা দু’টো আদুরে নরম সরম ঘুমকাতুরে বেড়াল, তারা কি আর পারে এইসব ভুতুড়ে জায়গায় বাস করতে!

এমন সময় বুড়ো পেঁচা ফের ডেকে উঠল। ইঁদুর ফের খচমচিয়ে উঠল।

দুই বেড়াল ওমনি ঘুমটুম ঝিমুনিটিমুনি ভুলে ধড়মড়িয়ে হড়বড়িয়ে পা জড়িয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল দোলনা থেকে সটান মাটিতে। আর কেউ দাঁড়ায় সেই এলাকায়! পাঁই পাঁই করে দৌড় লাগাল দুটিতে। সোওওওজা গিয়ে থামল নিজেদের পুরনো পাড়ায়, পুরনো পাঁচিলের কাছে পৌঁছে।

হোক গে একটু আওয়াজ, হোক গে একটু উৎসব, করুক গে সব বকম বকম। তবু তো মানুষদের পাড়া, ভূতেদের বাস নয়। একটু নাহয় ঘুম কমই হবে কদিন। ছেলেপিলে একটু উৎসব-টুৎসব করলে করুক।

হাই তুলে ঘুমোই আর ঝিমোই মিলে উঠে বসল পাঁচিলের ওপর। আর তো ক’টা দিন!

খুদে স্রষ্টাদের সমস্ত কাজের লাইব্রেরি

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s