উপন্যাস -তিন পলাতক-সুমন মহান্তি-বসন্ত ২০২১

দুপুর শেষ হয়ে আসছে, রোদের তেজ কমে গিয়েছে, সমুদ্র এখন অনেক শান্ত। একটার পর একটা মাছধরার নৌকো সমুদ্র থেকে ফিরে আসছে। একটা নৌকো বাকি নৌকোদের পেছনে ফেলে সাঁ সাঁ করে এগিয়ে তীরের কাছে পৌঁছে গেল।

গণেশ বালির চরে বসে মন দিয়ে ছেঁড়া জাল সেলাই করছিল একটু আগে। শরীরটা ভালো ছিল না বলে সে আজ সকালে নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে বেরোয়নি সমুদ্রে। গণেশ মুখ তুলে বলল, “কী ব্যাপার মধুদা, নৌকো যে এক্সপ্রেস ট্রেনের মতন ছুটিয়ে নিয়ে এলে! অত জোরে কেউ আসে?”

মধুর আসল নাম মধুময় মাজি, সমুদ্রে নৌকোয় পাড়ি দিয়ে মাছধরাই তার জীবিকা। বয়স বিয়াল্লিশ, শক্তসমর্থ চেহারা, সারা গা ভিজে আছে সমুদ্রের নোনাজলে। মধু বলল, “বড়ো আনন্দ হচ্ছিল। তর সইছিল না।”

গণেশ হেসে বলে, “তা বুঝতেই পারছি। নৌকো এক্কেবারে মাছে ভরা।”
মধু খুশির গলায় বলে, “এই ক’দিন মাছ উঠছিল না একদম। মাছগুলো কিছুতেই আমার জালে ধরা দেয় না। আজ যেখানেই জাল ফেলি, প্রচুর মাছ উঠে আসছে।”
গণেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তাহলে দেখতেই হচ্ছে একবার কেমন মাছ পড়েছে!”
নৌকোয় উঠে গণেশের চোখ গোল হয়ে গেল, “উরিব্বাস! এত মাছ!”
মধু বলল, “তুই ক’টা পছন্দের মাছ নিয়ে যাস। এখনই বেছে নে। বিক্রির সময় সরাতে পারব না।”
দুজনে তীরে ভেড়া সমস্ত নৌকো ঘুরে ঘুরে দেখল। গণেশ মাথা নেড়ে বলল, “সব্বাই বলাবলি করছে আজ সাগরের জলে মাছ কম ছিল। শুধু তোমার নৌকোটায় দেখছি অন্যরকম।”
মধু হেসে কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, “ছোঁড়াটাকে দেখেছিস আজ?”
“কোন ছোঁড়া?”
“ওই যে বেশ মিষ্টি দেখতে একটা ছেলে, কোঁকড়ানো চুল, বাটিকের জামা পরেছিল। দেখিসনি আজ সকালে?”
“তুমি কি নারানের ছোটো ছেলের কথা বলছ?”
“না। ওই যে মুখের কাছে হাতদুটো নিয়ে গিয়ে চোঙের মতো করে জোরে জোরে কিছু বলে।”
“ও! একটা ছেলে আজ একটু আগে আজেবাজে বকছিল। নারান আর বাকিরা তাড়িয়ে দিয়েছে।”
“কেন তাড়াল?”
গণেশ বলল, “সাগরে নৌকো নামানোর আগে ছেলেটা খারাপ কথা বলছিল চেঁচিয়ে। আজ রাতে ঝড় হতে পারে, নৌকো নিয়ে কেউ তোমরা যেয়ো না সাগরে—এইসব বকছিল। অলক্ষুণে কথা শুনে নারানের মাথা গরম হয়ে গেল। বিচ্ছু ছোঁড়া।”

মধু জানতে চাইল, “ছোঁড়াটা কখন এসেছিল?”
গণেশ উত্তর দিল, “এই আধঘণ্টা আগে।”
মধু উঠে পড়ল। “আমি দেখে আসি। পুরোনো দিঘা বাজারের কাছেই ছেলেটাকে আগে ঘুরঘুর করতে দেখেছি।”
গণেশ অবাক হল। “ওই ছেলেটাকে নিয়ে পড়লে কেন তুমি?”
মধু বলল, “ছেলেটাকে খুঁজে পেতে হবে। ক’টা মাছ দেব ওর হাতে।”
“কী যে বলছ আর ওই বিচ্ছুটাকে খুঁজবেই কেন, কিছুই ঢুকছে না মাথায়।”
মধু মৃদু হেসে বলল, “পরে বলব। ওটাকে দেখতে পেলে মন শান্ত হবে।”
গণেশ ভেবলুর মতো চেয়ে থাকল; জাল গুটিয়ে মেলে রাখল বালির ওপরে। কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

***

ঋভু সাইকেলে ঝড় তুলে ছুটছে। থানা, বালিয়াড়ি, ঝাউবন পেরিয়ে সাঁই সাঁই চলছে তার সাইকেল। তাকে দিঘা মোহনায় যেতে হবে। ওল্ড দিঘার সমুদ্রতটে জেলের দল তেড়েমেড়ে আসতেই সে একছুটে বালিচর পেরিয়ে উঠে এসেছে।

মোহনার কাছে পৌঁছে একটা ঝাউগাছের পাশে সাইকেল রাখল ঋভু। বালির ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল খুব জোরে। মোহনার কাছে যেখানে একটার পর একটা নৌকো বালিতে রাখা আছে, সেখানে গিয়ে দুটো হাতের তালু জড়ো করল ঠিক শাঁখ বাজানোর ভঙ্গিতে, মাঝখানের ফাঁকে মুখ রেখে খুব জোরে, প্রায় চেঁচিয়ে বলা শুরু করল, “আজ মাঝরাতে সাগরে ঝড় আসবে গো দাদাবাবুরা! মাঝ-সমুদ্দুরে ঘূর্ণি দেখা দেবে। আজকের রাতটা দেখে কাল ভোরে রওনা দিয়ো সকলে।”

তিনবার একই কথা বলে ঋভু থামল।
“কে রে তুই, ভয় খাওয়াচ্ছিস আমাদের?”
কালো পেশিবহুল একটি মাঝবয়সী মানুষ ঋভুর সামনে এসে দাঁড়াল।
ঋভু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “মনে হল, তাই বললাম।”
আরেকটি লম্বাচওড়া লোক এল কাছে। “কোথায় থাকিস তুই?”
“কেয়াবনি।”
“সে গ্রাম তো দিঘা থেকে সাইকেলে কম করে দশ মিনিটের রাস্তা। সেখান থেকে সাইকেল ঠেঙিয়ে তুই এদ্দুর এসেছিস?”

ঋভু সরল চোখে তাকাল। “আমার সাগর খুব ভালো লাগে। নোনাজল আর বাতাস আমার বড়ো ভালো লাগে। কিছুক্ষণ বসে থাকলে মনে হয় মস্ত সাগরটাকে দেখতে পাচ্ছি। তখনই যা মনে আসে বলে ফেলি।”

“আর এমন বলবি না কখনো। সমুদ্দুরে যাওয়া কাকে বলে বুঝিস? প্রাণ হাতে নিয়ে বেরোই, কখন যে সে কী রূপ ধরবে কেউ জানে না। পরের বার এমন আজেবাজে বকলে পা ভেঙে ঝাউগাছে ঝুলিয়ে দেব।”

ঋভু ঘাড় নেড়ে বলল, “আচ্ছা, আর বলব না। আমার যে খুব ভয় লাগে তোমাদের জন্য।”
“তোকে ভাবতে বলেছে কে?”
“কোথাও না শুনে না জেনেই বলি। আর বলব না।” ঋভু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।
লোকটি তার পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কোন ক্লাসে পড়িস?”
“এইট।”
“বাড়িতে কে কে আছে?”
“মা আর ঠাকুমা।”
“বাবা?”
ঋভু মাথা নাড়ে। “নেই। মারা গেছে।”

“এই সমুদ্দুর, আঁশটে গন্ধ, নোনাজল নিয়ে মাথা ঘামাস না বাপু। মাছ যারা ধরতে যায়, নৌকোয় চেপে পাড়ি দেয়, বড়ো কষ্টের জীবন তাদের। তুই বুঝবি না। খবরদার, আর কখনো অমন কুকথা বলবি না জেলেদের সামনে। বুঝেছিস?”

ঋভু মাথা হেঁট করে বালিচর পেরিয়ে ঝাউবনে আসে, সাইকেলে ওঠে। তার বাবাও এমন কথা বলত। ঋভুকে বড়ো হতে হবে, লেখাপড়ায় ভালো হতে হবে। কয়েক পুরুষ ধরে তারা সাগরে যাচ্ছে, কষ্ট করছে। তার পড়াশোনায় মন বসে না, সমুদ্র যেন ডাকে। সমুদ্রের ঢেউ আর তটে আছড়ে পড়া ফেনা তার রক্তে দোলা দিতে থাকে।

“ঋভু, কোথায় গেছলি এখন?”
বিশুকে দেখতে পেয়ে সাইকেল থামাল ঋভু। “মোহনায় গেছলাম। তুই এখন এখানে? ফুটবল খেলতে যাসনি আজ?”

দিঘা বিদ্যাভবনের সামনে ওদের স্কুলের একটা দল ফুটবল খেলে রোজ বিকেলে। মাঠটা ভারি সুন্দর, সবুজ গালিচা পাতা আছে—এমন মনে হবে দেখলে। বিশুর খেলার নেশা খুব। কোনোদিন সে মিস করে না।

বিশু বলে, “আজ বড্ড টেনশন হচ্ছে। পেট গুড়গুড় করছে খালি। বাবা দশদিন বাদে ঘর আসছে আজ।”
ঋভু অবাক হল। “টেনশনের কী হল তাতে!”
বিশু মুখ চুন করে বলে, “তুই আর কী বুঝবি! পরীক্ষায় জিরো পেলেও তোকে কেউ কিছুটি বলবে না।”
“কেউ কিছু বলেও না। মা সামান্য বকাঝকা করে। ঠাকুমা অত বোঝেই না।”

“তুই খুব লাকি। বাবা এমনিতে ভালো, রেজাল্ট খারাপ দেখলে ক্ষেপে যায়। দশদিন বাদে আসছে, মাকে ফোন করেছে ইউনিট টেস্টের খাতা যেন গুছিয়ে রাখি—এসেই দেখবে। মনেও থাকে কীভাবে বুঝি না।”

“তার জন্য তুই খেলতে পর্যন্ত যাসনি?”

“এখানে এসে লোকজন দেখছি, দোকানে ঘুরছি, টেনশন কম হচ্ছে। মন্দিরে পাঁচ টাকা প্রণামী দিলাম। মারধোর যেন কম পড়ে।” বিশু শুকনো মুখে বলল।

“মাত্র পাঁচ টাকায় কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।” ঋভু হেসে বলল, “তুই হেঁটে এসেছিস এতটা?”
বিশু বলল, “সাইকেলের টায়ার পাংচার হয়েছে। কপাল ভালো নয় আজ।”
ঋভু বলল, “আমার সাইকেলে উঠে পড়।”
বিশু দোনোমনা করল, “পারবি অতটা ডবল রাইড করতে?”
“কেন পারব না?”
“আচ্ছা, সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে যদি আঘাত লাগে?”
“ফেলব না। তুই একটা ভিতুরাম।”

বিশু জোরে মাথা নাড়ল। “ভিতু লোকেরা ভূ-পর্যটক হবার স্বপ্ন দেখে না। দম লাগে, বুঝলি? আমি ঘুমের মধ্যে কত অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখি জানিস? একবার আমি মাউন্ট এভারেস্টে ঘোড়ায় চড়ে উঠেছিলাম স্বপ্নে।”

সন্ধে সাতটায় যখন বাবার ঘরে ডাক পড়ল, বিশু খাতাগুলো গুছিয়ে বিড়বিড় করল, “জয় মা বটেশ্বরী, রক্ষে করো আমাকে।”

একটি ছাগলকে যখন বলির জন্য হাড়িকাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় সে কাঁপতে থাকে ঠকঠক। বিশুর অবস্থাটা ঠিক সেরকম। বাবার পোস্টিং এখন পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর থানায়, সেখানকার মেজবাবু। মাসে একবার কি দু-বার বাড়ি আসে। সেকেন্ড ইউনিট টেস্টের খাতা বেরোনোর খবর অত দূরে বসেও বাবা কীভাবে পেল? নিশ্চয়ই প্রণবস্যার ফোনে বলেছে!

ইজি-চেয়ারে অবনীশ বসে ছিলেন। বিশুকে দেখে বললেন, “সময় নষ্ট করবি না। এমনিতেই আমি টায়ার্ড। খাতাগুলো বের কর।”

বিশু চুপচাপ খাতার বান্ডিলটা এগিয়ে দিল। অবনীশ বললেন, “হুম। বাংলায় চার, ইংরেজিতে তিন, সংস্কৃতে পাঁচ। অঙ্কে দশ, সায়েন্সে তিন। অঙ্কে দশ পেলি কীভাবে?”

“অঙ্ক করে।”
“অনেক ক্রিমিনাল চরিয়ে খাই। যার সায়েন্সে তিন, কোন ম্যাজিকে অঙ্কে দশ হয়ে গেল?”

বিশু চুপ করে থাকল। আসল কথা হল, সামনের বেঞ্চে বসা সায়নের খাতা থেকে পুরো উপপাদ্যটা টুকতে পেরেছিল।

ইতিহাস খাতায় চোখ রাখার পরেই অবনীশের বাঁ চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করল। বিশু অভিজ্ঞতায় জানে, এ হল বিপদের সংকেত। প্রচণ্ড রেগে গেলে বাবার চোখের পাতা নাচে। তখন ব্যাট, ঝাঁটা, কাঠের রুল—যা হাতের সামনে পায়, তা দিয়েই পেটায়।

“ইতিহাসে এক নম্বর মাত্র!”

মা বটেশ্বরীর নাম জপ করতে থাকে বিশু। একমাত্র ভূগোল খাতাটাই বাকি রয়েছে। ইচ্ছে করেই সবার শেষে রেখেছে ওটা। বাবার রাগ ভূগোলের খাতা দেখলে কিছুটা ঠান্ডা হবে—এই আশায় আছে বিশু।

“ভূগোলে বাইশ! কীভাবে হল? টুকেছিস?”
“না।”
“বই খুলে বা পকেটের পুরিয়া বের করে টুকেছিস নিশ্চয়ই?”
বিশু মাথা নেড়ে বলল, “প্রণবস্যার গার্ড দিচ্ছিলেন।”

প্রণবস্যার বাবার বাল্যবন্ধু, লাইফ সায়েন্স পড়ান। বন্ধুর ছেলে বলে তাকে খাতির একটুও করেন না, বরং স্পেশাল ট্রিটমেন্টে রাখেন। বাবা নাকি নির্দেশ দিয়েছে, ‘ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখিস। বেগড়বাই দেখলেই চাবকাবি।”
“তাহলে?”
সাহসে ভর করে বিশু মুখ খোলে, “ভূগোল পড়তে আমার দারুণ লাগে। ক্লাসে ছেলেরা আমাকে অ্যাটলাস নামে ডাকে। ভূগোলে ক্লাসে আমি সেকেন্ড। ইচ্ছে আছে ভূ-পর্যটক হব।”
“সেটা কী, আদৌ জানিস ঠিকমতো?”
“সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব, নতুন নতুন দেশ দেখব।” বুক ফুলিয়ে বলল বিশু।

অবনীশ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলেন, “খাবি-দাবি, ঘুরে বেড়াবি? খাওয়াবে কে? নিজের রোজগার না থাকলে সাধ বেরিয়ে যাবে। ফাইনাল পরীক্ষায় কম মার্কস হলে দু-দিন ধরে তোকে পেটাব বলে দিলাম। এখন যা।”
নিজের রুমে গিয়ে স্বস্তিতে লম্বা শ্বাস নিল বিশু।

***

রাত ন’টার দিকে বাড়ি ফিরতে গিয়েও থমকে গেল মধু। বাড়ি তার বেশিদূর নয়, দু-কিমি সাইকেলে গেলেই তার গ্রাম। সমুদ্রের রূপ দেখে আশ্চর্য হল সে। সমুদ্র ফুলে উঠেছে, রাগী দানবের মতো ফুঁসছে। বড়ো বড়ো ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। মধুর ভয় হল, মাঝ-সমুদ্রে ঘূর্ণি দেখা যেতে পারে। নৌকোগুলো পারবে তো সামলাতে?

চিন্তায় ছটফট করতে থাকল সে। যারা সন্ধেয় পাড়ি দিয়েছে সমুদ্রে, অনেকেই তার চেনা। একরাশ চিন্তা নিয়ে পাড়ে বসে রইল মধু।

রাত এগারোটার দিকে একটা নৌকো ফিরে এল। কিছুক্ষণ বাদে বাকি নৌকোরাও একে একে ফিরে আসতে শুরু করল। আচমকা ঘূর্ণি এসেছিল, নৌকো টালমাটাল হয়ে যাচ্ছিল। খুব গভীরে যায়নি বলেই বাঁচা গেছে এ-যাত্রায়।

মধু গণেশকে বলল, “ওই ছেলেটা কী বলেছিল?”
“কোন ছেলের কথা বলছ?”
“কোঁকড়া চুলের সেই ছেলেটা। সমুদ্দুরে যেতে মানা করায় যাকে সবাই তেড়ে মারতে গেছিল।”
গণেশ বলল, “যেতে মানা করেছিল। বলেছিল বিপদ আছে।”

মধু বলল, “ও আমাকে দক্ষিণদিকে যেতে বলেছিল, তারপর সোজা কিছুটা। গেলেই নাকি প্রচুর মাছ পাব। ফচকেমি করছে ভেবে পাত্তা দিইনি। কিছুদূর যাবার পরে মনে হল, গিয়েই দেখি। বুঝলি গণেশ, ছেলেটার কথা মিলে গেল এক্কেবারে। তাই ফিরে এসেই ছেলেটাকে খুঁজছিলাম।”

গণেশ অবিশ্বাসে মাথা নাড়ে। “ও তোমার মনের ভুল মধুদা।”
মধু হাত নেড়ে বলে, “তাহলে এই বিপদের কথা? মাছ ধরতে যেতে মানা করা? সেটাও তুক!”
গণেশ মাথা চুলকে বলল, “কী জানি! মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”
মধু বলল, “কাল সন্ধেয় নৌকা নিয়ে বেরোব। তার আগে ছেলেটাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”
গণেশ বলে, “আমিও কাল ওই সময়ে নৌকা নামাব।”

***

ঋভু ঢেউ থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাছধরার নৌকোগুলো আছে কয়েক হাত তফাতে, একমনে সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে সে। তার বাবারও এমন একটা নৌকো ছিল, হালকা নীল রঙে নাম লেখা ছিল ‘ময়ূরপঙ্খী’।

ঋভু তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। বেশ মনে আছে, ভুলে যায়নি কিছুই। গালে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে। জামার কোনায় মুছে নিল সে। ঋভু দেখল, একটা লোক তার দিকেই এগিয়ে আসছে। দূর থেকেই লোকটা চিৎকার করে ডাকল, “এই ছোঁড়া, ওখানেই বসে থাক। পালাবি না বলছি!”

ঋভু অবশ্য পালানোর চেষ্টা করল না। আজ তার মন ভালো নেই, বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। আজ সন্ধে না হওয়া অবধি সে এখানেই বসে থাকতে চায়। সমুদ্র আজ শান্ত, ঢেউগুলো ছোটো ছোটো, আকাশ ভীষণ পরিষ্কার। নোনা বাতাস আর জলের ছিটে বেশ লাগছে তার।

লোকটা কাছে এসে পড়েছে। ভয়ে ভয়ে তাকাল ঋভু।
“কী নাম তোর?”
“ঋভু।”
“থাকিস কোথায়?”
“কেয়াবনি।”
“বাবা কী করে?”
খানিকক্ষণ চুপ করে ঋভু উত্তর দেয়, “নৌকোয় করে মাছ ধরতে যেত।”
“যেত মানে?”
ঋভু বলল, “চার বছর আগে বাবার নৌকো ডুবে যায় রাতের বেলা। অনেক দূর চলে গেছিল। তুফান উঠেছিল, ফিরতে পারেনি আর।”
“শুনে খারাপ লাগল। কী নাম ছিল বাবার?”
“রতন মাজি।”
“বলিস কী! তুই রতনের ছেলে! রতন মোহনা থেকেই নৌকা নামাত, এদিকে কম আসত। আমার আবার এই পুরাতন দিঘাতেই সব। রতনকে চিনতাম, তবে অত ভাব ছিল না। বলছিলাম, আজ কোনদিকে যাব?”

ঋভু বলল, “যদি না মেলে, মারবে না তো!”
“তোকে কি মারতে পারি?”
ঋভু বলল, “আজ তাহলে উত্তরদিকে যেও। তারপর সোজা কিছুটা গিয়ে ডানদিকে বাঁকবে। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আছে ওখানে।”
“কাল সন্ধেতে যে বলেছিলি সমুদ্দুরে না যেতে, কী ভেবে বলেছিলি?”
ঋভু মাথা নাড়ে, “মনে হয়েছিল, তাই বলেছিলাম।”
“ঘূর্ণি কিন্তু এসেছিল। জেলেরা পালিয়ে এসেছে অনেকে।”
ঋভু খুশির চোখে তাকাল। “সত্যিই তেমনটা হয়েছিল?”
“হ্যাঁ। কীভাবে তোর কথা ফলে যাচ্ছে বল তো!”
ঋভু বলে, “আমি সত্যিই জানি না। বিশ্বাস করো।”
“করেছি বলেই জানতে চাইলাম। আমাকে মধুকাকা বলে ডাকবি। কাল বিকেলে তোকে দুটো মাছ দেব বলে খুঁজছিলাম।”
ঋভু বলে, “বাবা মারা যাবার পর থেকে আমরা কেউ মাছ খাই না।”

মধু বারমুডার পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে ঋভুর হাতে গুঁজে দিল। “খেয়ে নিস কিছু। তোকে কিছু না দিয়ে যাত্রা শুরু করলে মনে খুঁত থেকে যাবে।”

***

ঋভু এখন রোজ আসে, কখনো ভোরে কখনো বিকেলে। দু-হাত মুখের কাছে নিয়ে এসে আগের তুলনায় দ্বিগুণ উৎসাহে চেঁচিয়ে বলে। আবহাওয়া নিয়ে বলে, ঘূর্ণি বা ঝড় নিয়ে সাবধান করে—কেউ আর তেড়ে আসে না। মধুর দেখাদেখি গণেশও ঋভুর ঘোষণায় বিশ্বাস করে, তার পরামর্শ মেনে নৌকো ভাসার সমুদ্রের জলে। পাঁচ বারের মধ্যে তিন বার ঋভুর কথা ফলে গিয়েছে। মধু ঋভুকে নিয়ে গদগদ, চুপিচুপি সে পরামর্শ নেয়।

আজ বিকেলে মধু জানতে চাইল, “কোনদিকে যাব?”
ঋভু ভেলপুরি খেতে খেতে বলল, “আজ না যাওয়াই ভালো। এবারটা যেও না।”
গণেশ এসে তাড়া দিল, তার নৌকো নামানোর সময় হয়েছে—একই সময়ে অনেক নৌকো সমুদ্রে পাড়ি দেয়।
মধু বলল, “তুই যা গণেশ। আজ যেতে মানা করেছে।”
ঋভু গণেশকে বলল, “তুমি যাও গো দাদা। আজ তোমার নৌকো ভরে যাবে মাছে।”

পরের দিন দুপুরে মাছভর্তি নৌকো নিয়ে তীরে নামল গণেশ। সে সবাইকে বলে বেড়াতে লাগল ঋভুর কথা কেমন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। ক্রমশ সেই গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল বাকি জেলেদের মধ্যে। ঋভু নামের ছেলেটা জাদু জানে, ওর বাপ ছিল চোস্ত জেলে, সাগর-মা টেনে নিয়েছে অকালে। এই ছেলের ওপর কৃপা আছে তাঁর। ওর কথা শুনেই মধুর অবস্থা ফিরছে। ওল্ড দিঘার জেলেরা কয়েকজন মিলে টিনের একটা চোঙা বানিয়ে ঋভুর হাতে দিল।

টিনের চোঙায় মুখ রেখে শুরু হল ঋভুর ঘোষণা। ওল্ড দিঘার প্রায় সমস্ত জেলে যারা মাছধরার নৌকো আর জাল নিয়ে মাঝ-সমুদ্রে পাড়ি দেয়, তারা সমুদ্রে পাড়ি দেবার আগে ঋভুর জন্য অপেক্ষা করে।

আজ ওল্ড দিঘা থেকে সাইকেলে করে মোহনার দিকে যাচ্ছিল ঋভু। পাশ থেকে ভেসে এল চিৎকার, “চোর! চোর! ধর ব্যাটাকে।”

একদল লোক চিৎকার করতে করতে ছুটছে। ঋভু এদের মোটামুটি চেনে—ওল্ড দিঘার পাড়ে দোকান আছে এদের। তাড়া খেয়ে এঁকে-বেঁকে একটি বেঁটে, গোলগাল ছেলে ছুটছে। হাতের মুঠোয় ডিম একটা। ওই অবস্থাতেই এক মুহূর্ত থেমে ডিমটা গলায় পুরে নিল ছেলেটা। আবার দৌড় লাগাল। একজন ছেলেটার কলার ধরে ফেলল। ছেলেটাকে আরো তিনজন জাপটে ধরেছে। একজন সপাটে থাপ্পড় কষাল গালে। ছেলেটার ঢোলা প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল আরেকজন। কী আশ্চর্য, একসঙ্গে অনেকগুলো ডিম বেরিয়ে পড়ল!

ঋভুর খুব মায়া হল ছেলেটার জন্য। আহা, বেচারা, নিশ্চয়ই ওর খুব খিদে পেয়েছিল। বাবা চলে যাবার পরে বেশ কিছুদিন ঠিকঠাক খাবার জুটত না তাদের। অনেকদিন আধপেটা খেয়েই কেটেছে। সেলফ-হেল্প গ্রুপে মা কাজ পাওয়ার পরে কষ্ট কিছুটা কমেছে।

সে কাছে গিয়ে বলল, “ওকে মেরো না তোমরা।”
“মারব না মানে? ছ’টা ডিম চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিল। ওকে ল্যাম্প-পোস্টে বেঁধে পিটব। এমন মারব যে আর ওর সাহস হবে না কক্ষনো।”
ভিড়ের মধ্যে গণেশদাকে দেখতে পেল ঋভু। সে কাছ গেল। “ও গণেশদা, ওকে বাঁচাও।”
“কেউ আমার কথা শুনবে না। দেখছিস না, সবাই কেমন ক্ষেপে আছে!”
ঋভু মরিয়া হয়ে বলে, “আমি দাম দিয়ে দেব।”
“তুই?”
“আচ্ছা, দেখছি।”
ঋভু দেখল, গণেশদা একজনের কানে কানে কিছু বলল।
গণেশদা এসে শোনাল, “ওরা ফাইন চাইছে। মারবে না, ছেড়ে দেবে। একশো টাকা চাইছে। ব্যাবসা ছেড়ে ব্যাটাকে ধরার জন্য ওদের টাইম নষ্ট হয়েছে।”

জেলেরা সমুদ্রে নৌকো ভাসানোর আগে তার হাতে পাঁচ টাকা, দশ টাকা গুঁজে দেয়। সেগুলো জমিয়ে রাখে ঋভু। টাকাটা নিয়ে ওরা শান্ত হল, কিন্তু সহজে ছাড়ল না। চুরির অভ্যেস খুব খারাপ, তাই শাস্তি পেতেই হবে।

‘আর কখনো চুরি করব না’ বলতে হল পাঁচ বার আর কান ধরে উঠ-বোস করতে হল দশ বার।
ভিড় ফাঁকা হতেই ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল ঋভু, “চুরি করেছিলি কেন?”
“ইচ্ছে হল।”
“খেতে পাসনি আজ?”
“ধুর! কিছুক্ষণ আগে চিকেন রোল খেয়েছি।”
ঋভু অবাক, “তাহলে? ডিম নিয়ে পালাচ্ছিলি কেন?”

ছেলেটা হাসল। “ইচ্ছে হল বললাম যে! সেদ্ধ ডিম দেখে জিভে জল চলে এল। লোভ সামলাতে পারলাম না। পকেটের টাকাও শেষ। পাঁচটা তুলে নিয়ে পকেটে পুরেই ছুট দিয়েছিলাম। ব্যাটারা টের পেয়ে গেল।”
ঋভু সন্দেহের গলায় জানতে চাইল, “টাকা শেষ মানে?”
ছেলেটা উত্তর দিল, “বাবা আশি টাকা দিয়েছিল সকালে। খেয়েদেয়ে সব শেষ। এত খাবার চারদিকে! ক’টা আর খেতে পেরেছি। ওই টাকায় পেট ভরে কিছু হয়?”
“ঘরে কিছু খাসনি?”

“কাতলা মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে স্কুলে গেছি। মিড-ডে মিল খেয়েছি। ঘরে ফিরে কিছু খাইনি। স্কুল থেকে ফেরার পথে চারখানা তেলেভাজা আর দুটো শিঙারা খেয়েছি। সারাদিন এটা সেটা কিনে খেয়েছি।”
ঋভু জানতে চায়, “তোর বাবা কী করেন?”
“বাস চালায়। দিঘা-হাওড়া রুটের বাস, সাগরকন্যা নাম। দেখেছ কখনো?”
“দেখেছি মনে হচ্ছে।”
“বাবা বাস চালিয়ে প্রতিদিন সাতশো পায়। আমাকে রোজ সকালে আশি টাকা দিয়ে যায়। কুলোয় না।”

ঋভুর খুব রাগ হচ্ছিল। এই ছেলেটাকে মারধোর থেকে বাঁচানোর জন্য সে কষ্ট করে জমানো টাকা থেকে একশো খরচ করেছে! কোনো লজ্জা নেই, দাঁত বের করে হাসছে, ঠোঁটে ডিমের টুকরো লেগে আছে। ঋভু রাগত গলায় বলে, “তুই কি পিপে?”

“আমার দিদাও তাই বলে। কখনো কলসি বলে, কখনো ধাবার উনুন বলে, স্কুলে বন্ধুরাও পেটুক বলে রাগায়। আমি রাগিই না।”
বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল ঋভু। “আসল নাম কী?”
“সুনন্দ বেরা। ডাকনাম গজা। তুমি ওই নামেই ডেকো। আজ থেকে আমি তোমার চেলা। খুব বাঁচালে। না-হলে কী যে পেটাত! গালটা ভারি ব্যথা করছে।”
ঋভু বলল, “আমার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বোস।”
“কোথায় যাবে?”
“নিউ দিঘার মোড় পর্যন্ত যাব। ডিম খাওয়াব তোকে। দেখি ক’টা খেতে পারিস।”
গজা চোখ গোল করে। “মাইরি! তোমার দেখছি অনেক টাকা। কীভাবে হল? বাপ খুব বড়োলোক?”
ঋভু হেসে বলল, “কাল বিকেলে ওল্ড দিঘার বিচে চলে আসবি। দেখবি।”

সাতখানা ডিম সাবাড় করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পেটে হাত বোলাল গজা। একটানা বকে গেল। গড়গড় করে বলে দিল সব। ক্লাস সেভেনে পড়ে, দিঘাতেই বাড়ি, পাকাবাড়ি আর টালির ছাদ। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ে মা মারা যায়। তারপর থেকে মামাবাড়ির দিদা এখানে এসে থাকে, তাদের দেখাশোনা করে। দিঘার স্কুলেই পড়ে, বই পরীক্ষার আগে ছাড়া কখনো খোলে না, তবে রোজ যায়। মিড-ডে মিল খেলে পেটটা কিছুক্ষণের জন্য ঠান্ডা হয়। ঘুড়ি ওড়ানো আর ফুটবল খেলা তার নেশা। বন্ধুরা কখনো তাকে ‘কাদামেসি’ নামেও ডাকে।

“কেন?”

“ফুটবল মন্দ খেলি না। তবে বৃষ্টি হলে, মাঠ কাদা থাকলে নাকি আমাকে ধরা যায় না। ওই সময়ে নাকি আমি এক্কেবারে মেসির মতন খেলি। তাই কাদামেসি।”

ঋভুর বিশ্বাস হল না। এই গোলগাল, ফুটবলের মতো চেহারা নিয়ে এই ছেলেটা আদৌ নড়তে পারে মাঠে? মেসির মতো খেলা দূরের কথা, ফুটবলে শট মারতে পারবে কি না সন্দেহ।

গজা একগাল হেসে বলে, “আমার চেহারা দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না? চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায়? মারাদোনাকে দেখেছ?”
“হ্যাঁ।”
“মারাদোনা যখন খেলত, কী এমন চেহারা ছিল? বেঁটে, গাবলু-গুবলু। ওই চেহারা নিয়েই কামাল করত। টিভিতে দেখেছিলাম একদিন আগের খেলা।”
ঋভু বলল, “আমার বন্ধু বিশু ভালো ফুটবল খেলে। একদিন নিয়ে আসব।”
গজা বলল, “ফুটবল আমি ভালো খেলি। ওসব বিশু-টিশু আমার কাছে শিশু। তবে মাঠ পিছল হতে হবে।”

বিশু শুনে বলল, “ফু। কোথাকার এক বিটকেল বলেছে, বিশু ওর কাছে শিশু! ও যদি মেসি হয়, আমি তবে রোনাল্ডো। কাদা-মাঠে খেলতে পারে শুধু, এ কেমন কথা! ও কি পাঁকাল মাছ যে কেউ ধরতে পারবে না, ফসকে যাবে?”
ঋভু বলে, “অত আমি জানি না।”
“যে ছেলে রাক্ষসের মতন খায়, সে কখনো ফিট থাকে? ফুটবলে গায়ের জোর লাগে, ফিটনেস লাগে। আমার ল্যাং খেলে ও সাতবার ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পড়ে থাকবে।”
ঋভু বলল, “তুই অত রেগে যাচ্ছিস কেন?”
“ঠিক বলেছিস। বুঝলি ঋভু, একবার অ্যাডভেঞ্চারে যাব। না গেলে মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে। চল, একদিন কারো নৌকায় চেপে মাঝ-সমুদ্রে চলে যাই।”
ঋভু বলে, “ঠাকুমাকে কথা দিয়েছি কোনোদিন মাছধরা নৌকায় চাপব না, ট্রলারে উঠব না। তুই যা বরং।”
“তাহলে আজারবাইজান চলে যাই দুজনে।”
“সেটা কোনদিকে?”
“এশিয়া মহাদেশেই। কাল স্বপ্নে দেখছিলাম আজারবাইজান চলে গেছি, বেদের তাঁবুতে বসে ঢোল বাজাচ্ছি।”
“স্বপ্নে দেখলি আর অমনি ইচ্ছে হল!”
“তুই দেখছি বাবার মতো কথা বলছিস। একদিন দেখবি কলম্বাসের মতো বিখ্যাত হয়ে যাব। কম করে পাঁচটা নতুন দ্বীপ, চারটা নতুন দেশ আর একটা মহাদেশ আমি আবিষ্কার করবই।”
ঋভু চমকে ওঠে। “মহাদেশ! আর মহাদেশ কোত্থেকে তৈরি হবে!”
বিশু হাসল। “কোপার্নিকাসের আগে কেউ জানত যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে? জানত না। আমিও তেমন জলের তলায় ঘাপটি মেরে থাকা কোনো মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেলব।”
বিশু খেলতে চলে গেল মাঠে; ঋভু সাইকেল চালিয়ে ওল্ড দিঘার বিচে পৌঁছল। এখানে এসে সে টিনের চোঙটা বের করে প্রতিদিন।

বেরোনোর সময়ে চারদিক নজরে রেখে পা টিপে টিপে সাইকেলে চোঙাটা ঝুলিয়ে সাঁই সাঁই ছোটে সে। মায়ের নজরে পড়ে গেলে অনেক প্রশ্ন। দিঘা সে যায়, মা জানে না।

চোঙায় মুখ রেখে ঋভু বলল, “আজ রাতে বৃষ্টি হবে। তবে ঝড় হবে না, সাগরে কোনো ভয় নাই। মাছ অল্প উঠবে কিন্তু। ‘সাগরপাখি’ নৌকোর আজ শুভ খুব।”

ঋভুর হাতে যে যা পারে টাকা গুঁজে দিল। শুরুটায় বেশ অস্বস্তি হত, লজ্জা লাগত। এখন দিব্যি নিয়ে নেয় সে। খিদে পেলে মশলা মুড়ি, ভেলপুরি, বাদামভাজা কিনে খায়। বাকি টাকা লুকিয়ে রাখে ঋভু—বিছানার নীচে, খাতার ভেতরে।

ঘাড় ঘোরাতেই ঋভু গজাকে দেখতে পেল। গজা হাসিমুখে বলে, “আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। বেশ তো! এভাবে তুমি টাকা পাও?”
“হ্যাঁ।”
“কেন দেয় ওরা?”
ঋভু অল্প রাগে বলল, “যা বলি তা মিলে যায় বলেই খুশি হয়ে ওরা দেয়।”
গজা কুতকুতে চোখে তাকাল, “তুমি কি জ্যোতিষী?”
“না।”
“কীভাবে বলো তাহলে?”

ঋভু মনে মনে বিরক্ত হল। “অতসব জানি না। যা মনে হয় বলে দিই। কেউ যেন আমাকে কানে কানে বলে দেয়।”
“কিন্তু যেদিন মিলবে না, সেদিন কিন্তু ভারি বিপদ হবে।”
ঋভু গম্ভীর হয়ে বলে, “যা অঙ্ক করতে বসিস, সব মেলে?”
গজা মাথা চুলকে বলে, “ঝামেলা! অঙ্কের নামে জ্বর আসে, খিদে বেড়ে যায়। একদম অঙ্কের কথা বলবে না।”
ঋভু জানতে চায়, “খেয়েছিস?”
“হ্যাঁ। এইমাত্তর দোকানে চারখানা কচুরি খেলাম, সঙ্গে দু-খানা রসগোল্লা। তবে খাবার ব্যাপারে আমি কখনো অরাজি হই না।”

ঋভু জামার প্যাকেট থেকে দুটো কুড়ি টাকার নোট বের করে গজার হাতে দিল। “যা, দু-প্লেট ভেলপুরি নিয়ে আয়। চট করে নিয়ে আসবি, খিদে পেয়েছে খুব।”

ভেলপুরি খেতে খেতে দুজনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গল্প করতে লাগল। বড়ো বড়ো ঢেউগুলো পাড়ের বোল্ডারের ওপরে আছড়ে পড়ছে।

গজা বলল, “তোমার পড়াশোনা ভালো লাগে?”
“না।”
“আচ্ছা ঋভুদা, তুমি কী হতে চাও?”
ঋভু আনমনা হয়ে পড়ল। তার খুব ইচ্ছে সাগরের বুকে নৌকো নিয়ে ভাসার, নোনাজল বাতাস আর আঁশটে গন্ধে জড়িয়ে থাকার। মা আর ঠাকুমা তেমনটা চায় না। বাবাও তাকে বার বার মানা করত।

সাতদিন পরে নিউ দিঘার বালিয়াড়ির কাছে ঝাউবন ঘেঁষা এক ঝুপড়িতে ঋভুর বসার বন্দোবস্ত হল। তালপাতার ছাউনি, ছিটেবেড়ার ছোটো ঘর—দু-খানা ছোটো তক্তপোশ রাখা আছে। রাতে-ভিতে বা খারাপ আবহাওয়ায় জেলেরা এখানে বিশ্রাম করে, সময় কাটায়। সেই ঘরে বিকেল হলেই বসে ঋভু। গজা প্রায়ই পাশে এসে বসে গল্প করে। বিশুও মাঝেমধ্যে আসে। মোহনা থেকে, ওল্ড দিঘার বিচ থেকে, এমনকি উদয়পুর তালসারি থেকেও অনেকে আসে। আবহাওয়ার খবর নিয়ে যায়, নৌকো ভাসানোর আগে জেনে যায়।

ঋভু এখন মধুকাকা আর গণেশকাকুর কাছ থেকে কিছু নেয় না। বাকিদের জন্য তার রেট কুড়ি টাকা। রোজগার তার মন্দ হচ্ছে না। অনেকে বেশি মাছ পেলে খুশিতে পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে যায়। একজন নৌকো-ভর্তি ইলিশ পাওয়ার খুশিতে একশো টাকা দিল, আর একটা গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে দিল গলায়। ঋভুর লজ্জা হল খুব।

ঘরে টাকাকড়ি রাখার সাহস পায় না ঋভু, জায়গা কম। একদিন খাতার ভাঁজে লুকোনো টাকা দেখে ফেলেছিল মা। টাকাপয়সা তাই সে গজাকে দিয়ে দেয়। গজার হিসেবের মাথা নিখুঁত, তার মাথায় যেন টাকাপয়সার অঙ্ক ধরে রাখা থাকে। বেশ কিছু টাকা জমলেই সে ঘুরতে বেরিয়ে পড়বে একদিন।

বিশুর সঙ্গে গজার ওই ঝুপড়িতে বারকয়েক দেখা হলেও কথা কিছুই হয়নি। গজাকে দেখলেই বিশু চোখ কটমট করে তাকায়। গজার অবশ্য কোনো হেলদোল দেখা যায় না। তার মুখ চলতেই থাকে। বিশুর দিকে একবারে একখানা সিঙ্গাপুরি কলা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিশু মুখ বাঁকিয়ে বলেছে, “হনুমান গপগপ করে কলা খায়। আমি হনুমান নই, খাইখাই করি না। ফুটবল খেলি, ক্রিকেট খেলি, কম খেয়ে শরীর ফিট রাখি। এমন ছিপছিপে শরীর রাখা কোনো পেটুকের কম্মো নয়।”

গজা কোনো উত্তর দেয়নি। ঋভুও মনে মনে বিরক্ত হয়েছে। এই দুটোর কি কখনো ভাব হবে না?

***

দীপেনস্যার ফার্স্ট পিরিয়ডের শেষে বললেন, “ঋভু, স্কুল শেষ হলে আমার সঙ্গে স্টাফ রুমে দেখা করবি।”

স্কুলে সারাক্ষণ সে ভেবেই চলল। দীপেনস্যার তাদের ক্লাস টিচার। সে পড়াশোনায় ভালো নয়, তবে দুষ্টুমি করে না। কেন ডেকেছেন স্যার বুঝে উঠতে পারল না সে।

স্কুল ছুটি হলে সে স্টাফ রুমের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। দীপেনস্যার দরজার কাছে এসে ডাকলেন, “আয়, ভেতরে আয়।”

যেতেই দীপেনস্যার বললেন, “দিঘা যাস প্রায়ই?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“গিয়ে কী করিস? সমুদ্রের শোভা দেখিস?”
“হ্যাঁ।”
“মিথ্যে বলা শিখেছিস খুব?” দীপেনস্যার ধমকে ওঠেন, “সব খবর পেয়েছি আমি। তুই নাকি ফোরকাস্ট করিস? হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিস কী? তুই যেটা করিস সেটাকে ফোরকাস্ট করা বলে, প্রেডিকশন বলে। তুই কবে থেকে এই বিদ্যায় পারদর্শী হলি?”
ঋভু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কড়া চাউনি দীপেনস্যারের। “তোর বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। আমার বাবা মাঝি ছিলেন। তোর মা কত কষ্ট করে সংসার চালান আমি জানি। তুই পড়াশোনা না করে বাবাজি সেজেছিস এখন!”
ঋভুর হাঁটু কাঁপে। সর্বনাশ! বাড়িতেও খবর যাবে এবার।
দীপেনস্যার বলেন, “আমার কানে সব এসেছিল। তোকে ফলো করে ঝুপড়ি পর্যন্ত গেছিলাম গত পরশু। কীর্তিকলাপ উঁকি মেরে দেখলাম। খোঁজখবর নিলাম।”
“না, মানে ওরা…”
দীপেনস্যার গর্জে উঠলেন, “চোপ! আমাকে বোঝাতে আসবি না। তোর মায়ের স্বপ্ন কত তোকে নিয়ে। আর তুই জেলের ছেলে জেলে হবে, মাছ ধরবে, কষ্ট করবে—সেই লাইনেই হাঁটছিস? আমার বাবা মাঝি ছিলেন, কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে আজ আমি স্কুলে পড়াচ্ছি। মানুষ উন্নতি আশা করবে না?”
ঋভুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এল।
“তুই যা বলছিস লেগে যাচ্ছে। তাই না? যেদিন মিলবে না, সেদিন কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস? সরল মানুষগুলো তোর কথা বিশ্বাস করছে। একদিন দেখা গেল ভুল বলেছিস। মাঝ-সমুদ্রে তুফান এল, নৌকো ডুবে কেউ মারা গেল। তুই নাকি পীর, জ্যোতিষী, মছলিবাবা! সাগর দেবতা ভর করে। তোর বাণী শুনে অকালে যদি কিছু মানুষ মারা যায়? তখন?”

ঋভু আর শুনতে পারছিল না। সে বসে পড়ে স্যারের পা জড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “মাকে বলবেন না স্যার। জানতে পারলে মা খুব দুঃখ পাবে, ঘর ছেড়ে চলে যাবে।”

দীপেনস্যার নরম গলায় বলেন, “আমি না জানলেও কেউ ঠিক জানতে পারত একদিন, বলে দিত তোর মাকে। কত সম্ভাবনা আছে তোর মধ্যে জানিস? আর ভুলেও ওসব ঠকানো বিদ্যে দেখাস না। এই বয়সে কাঁচা টাকা হাতে এলে জীবনে আর কিচ্ছু হবে না। মনে থাকবে?”

ঘাড় নেড়ে ঋভু বলে, “হ্যাঁ, স্যার।”

ঋভুর ঘুম আসছিল না। দীপেনস্যারের কথাগুলো যেন ছুরির ফলা হয়ে বিঁধে চলেছে সন্ধে থেকে। স্যার ভুল কিছু বলেননি। তার বাবাও চেয়েছিল জলের জীবন ছেড়ে ছেলে যেন অন্য কিছু হতে পারে।

রাত বাড়তেই তুমুল বজ্রপাতের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির এমন দাপট বাড়তে লাগল যে ঋভুর ভয় হল, তাদের মাটির বাড়িটাই বুঝি ভেসে যাবে।

সকালে উঠে দেখল বৃষ্টি থামেনি, একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বেলা দশটার দিকে বৃষ্টি কমতেই ঠাকুমাকে বলে বেরোল সে, “দিঘা যাচ্ছি। স্কুল যাব না আজ।”

মা অনেকক্ষণ কাজে বেরিয়ে গেছে। ঠাকুমা কিছুতেই বাধা দেয় না। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঋভু। চোঙাটা সেই ঝুপড়িতেই রাখা থাকে। আজ ওটা মধুকাকাকে ফেরত দিয়ে দেবে।

শেষ দুপুরে আবার কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। চারদিক অন্ধকার হয়ে এল। তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। বিকেলের দিকে বৃষ্টি থামতে বেরিয়ে পড়ল সে। ওল্ড দিঘার পাড়ে এসে দেখল সমুদ্র শান্ত হয়ে গেছে, ঢেউয়ের জোর নেই, দেখলে নদী বলে মনে হবে।

বিশু অবশ্য সঙ্গে এসেছে। বিশুর সাইকেলে নেটে ফুটবল ঝোলানো আছে। সে অস্থির হচ্ছিল। “তোর চেলা গজা কোথায় গেল? সে নাকি কাদামাঠে মেসির মতন খেলে! ডাক তাকে। আজ ফয়সালা হয়ে যাবে। মাঠ ভেজা, জল জমে থাকবে—এমন সুযোগ আর পাব? ডাক তাকে।”

ঋভু বলল, “কীভাবে ডাকব?”

বিশু নাছোড়। “বাড়ি চিনিস। ওখানে গিয়েই ডেকে নিয়ে আয়। আমি এই ঝাউতলায় ওয়ার্ম-আপ করে নিই।”
গজাকে অবশ্য ডাকার দরকার হল না। দেখা গেল সে হেলেদুলে ছাতা মাথায় করে এদিকেই আসছে।
চারদিক ঘুরে দিঘা স্টেশন যাবার আগে ডানদিকে বড়ো একটা হোটেলের পাশে একফালি মাঠ খুঁজে পাওয়া গেল। চারদিকে ঝাউগাছ, কেয়া ঝোপ, মাঠ পেরোলেই বালিয়াড়ি।
ঋভু মাঠের দু-প্রান্তে দু-জোড়া চপ্পল রেখে বলল, “ইট পাওয়া গেল না। এটাই গোল পোস্ট ভাবতে হবে।”
“রেফারি?”
“আমিই রেফারি, লাইনসম্যান সব কিছু। বল কুড়িয়ে আনব আমি। বাঁশি যখন নেই, আমিই মুখে বলব। কখনো শিস দেব, শুনতে হবে কিন্তু।”
বিশু কাছে এসে ফিসফিস করল, “একটা ভ্যানরিকশাকে বলে রাখলে হত না?”
ঋভু হতভম্ব, “কেন?”
“মেরে ওর টেংরি খুলে নেব। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে যে!”
ঋভু বলল, “বাজে ফাউল করলে লাল কার্ড দেখাব। পকেটের রুমালটা আমার লাল কার্ড ভাববি।”
গজা জিজ্ঞাসা করল, “কতক্ষণ টাইম? ঘড়ি নেই। কীভাবে হবে?”
ঋভু হাসল, “রেফারির টাইমই শেষ কথা।”
“বেশিক্ষণ খেলিও না। খিদে পাচ্ছে।”
বিশু বলল, “গোলের মালা পরাব তোকে। ওতেই পেট ভরে যাবে।”
মাঠের মাঝখানে ফুটবলকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে ঋভু বলল, “খেলা শুরু হল।”
গজা বল ড্রিবল করে পাশ কাটাতে যেতেই পা চালাল বিশু। সরে গেল গজা, বিশু আছাড় খেল মাটিতে। পায়ে বল রেখে দাঁড়িয়ে রইল গজা। উঠে বিশু ছুটে গেল, বল সে কেড়ে নেবেই। গজা এঁকে-বেঁকে ছুটছে, মোচড় দিচ্ছে, তাল সামলাতে না পেরে বিশু আবার মাটিতে পড়ে গেল। হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে টেনে তুলল গজা। বিশু কিছুতেই বলে পা লাগাতে পাচ্ছে না। গজা বিশুর সরু পা জোড়ার ফাঁকে বল গলিয়ে দিয়ে ইঁদুরের ভঙ্গিতে ছুটে গেল। ধীরেসুস্থে বলটা রাখল চপ্পল জোড়ার মাঝে। ঋভু ঘোষণা করে, “এক গোলে এগিয়ে গেল গজা।”

কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরে দেখা যাচ্ছে বিশু ক্লান্ত হয়ে গেছে। এক জায়গায় জল জমে ছিল, সেখানে গজাকে আটকাতে গিয়ে পিছলে গেল সে, ধপাস করে পড়ে গেল। গজা আবার বল চপ্পলের মধ্যে ঠেলে দিল। দু-গোলে এগিয়ে গেল গজা।

ঋভু বিশুর কাছে গিয়ে নীচু গলায় বলল, “খেলা শেষ করে দিই। আর ক’বার আছাড় খাবি? এবার কিন্তু কোমরটা ভাঙতে পারে।”

বিশু ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, “তাহলে বাবা বাকি হাড়গুলো আস্ত রাখবে না। তুই খেলা শেষ করে দে।”

ঋভু দু-হাত তুলে বলল, “আজকের খেলা এবার শেষ। এবার স্পোর্টিং স্পিরিটে দুজন ফুটবলার একে অপরকে জড়িয়ে ধরবে।”

মজা করেই বলেছিল ঋভু। বিশু হয়তো হাতই মেলাবে না, রাগে গরগর করবে। ঋভু অবাক হয়ে দেখল যে বিশু গজার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, এমনকি গাল টিপে দিচ্ছে।

বিশু বলল, “সত্যিই তুই ফাটাফাটি খেলিস।”

গজা বলে, “ধুর, আমি মাঠ ভেজা থাকলেই পারি। অন্য সময় আমাকে টেনে আটকে দেয়, ল্যাং মেরে ফেলে দেয়। বেশি ছুটতেও পারি না। দম থাকে না। আমার খুব খিদে পাচ্ছে। ছুটে খিদে আরো বেড়ে গেল।”

বিশু বলল, “আজ আমি তোকে খাওয়াব। মামা এসেছিল, একশো টাকা দিয়ে গেল কাল। ওই টাকায় তোর খাওয়া হবে তো?”

গজা লজ্জা পেল। “কী যে বলো! আমি রাক্ষস নই, তাছাড়া কমই খাই। সবাই মিলেই খাবো। ঋভুদার পঞ্চাশ টাকা আমার কাছে আছে।”

তিনজনে একটা দোকানে তিন প্লেট এগ চাউমিনের অর্ডার দিল। ঋভুর মন খুব মেঘলা ছিল কাল থেকে। এখন সে খুশি, ভীষণ খুশি। দিঘা স্টেশন থেকে ট্রেনের হর্ন ভেসে আসছে। ওরা কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ল। দূরের পৃথিবী যেন তাদের ডাক দিয়ে যাচ্ছে।

বিশু ঘাড় নেড়ে বলল, “আমরাও তিনজনে একদিন ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব। দেখিস, আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না।”

গজা বলল, “ধুর, কখনো যাওয়া হবেই না।”
বিশু জিজ্ঞাসা করে, “কেন হবে না?”
“বাড়িতে ছাড়বেই না।”
“বাড়িতে জানাচ্ছে কে? না জানিয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে পড়ব।”
গজা চাউমিন মুখে পুরে বলল, “ঘুরতে গেলে টাকা লাগবে। কে দেবে? কোথায় পাব টাকা?”
বিশু ঋভুর দিকে তাকাল। “তুই কিছু বল ঋভু।”
ঋভু উদাস গলায় বলে, “তোদের কথা শুনে আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছে। সমুদ্র বার বার ডাকে, মনে হয় কোথাও চলে যাই। ঘুরতে যাওয়ার জন্যই টাকা জমাচ্ছি।”
বিশু খুশিতে বলল, “তাহলে আর চিন্তা কী? বেরিয়ে পড়ব।”
গজা জিভে শব্দ করে তৃপ্তিতে। “কিন্তু বাড়িতে না জানিয়ে কীভাবে যাব?”
বিশু বিরক্ত হল। “তোর শুধু বাড়ি নিয়ে মাথাব্যথা। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। বইতে পড়িসনি?”

***

ঋভু ভেবেছিল, সে আর কখনো পূর্বাভাস করবে না। তবু সে সমুদ্রের পাড়ে যায়, ঝুপড়িতে বসে, হাতে টাকা কিছু হলেও আসে। দীপেনস্যার মানা করলেও অভ্যেস ছাড়তে পারছে না সে। যেদিন থেকে ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠেছে, ঋভুর মাথায় একটাই চিন্তা—টাকা দরকার। ঘুরতে গেলে টাকা লাগবেই। ঘোরা হয়ে গেলে আর কখনো সে এই কাজ করবে না। দশদিনে টাকা মন্দ হল না। গজাকে জিজ্ঞাসা করল, “কত হল?”

“পাঁচ হাজার।”

রাতে স্বপ্নে ঋভু দেখতে পেল, নীল সমুদ্রে বিরাট বিরাট ঢেউ উঠেছে। একটা নৌকো এগিয়ে চলেছে ঢেউগুলো কেটে। তার বাবা বসে আছে নৌকোতে, দাঁড় বাইছে, হাত নেড়ে তাকে ডাকছে, ‘ঋভু, আয়। কাছে আয়।’

সে তীরে দাঁড়িয়ে দেখছে, ঢেউগুলো মুহূর্তেই পাহাড় হয়ে গেল। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা জলের পাহাড়ের মধ্যে নৌকোটা হারিয়ে গেল। এটা তার চেনা নৌকো, আকাশনীল নাম। পালে বসে রয়েছে মধুকাকা। পাহাড়ের মতো উঁচু ঢেউ একটার পর একটা আছড়ে পড়ল মধুকাকার নৌকোর ওপরে। নৌকোটা উলটে গেল, ছিটকে পড়ল মধুকাকা। আরেকটা ঢেউ এসে টেনে নিয়ে গেল তাকে। মধুকাকা ডুবে যাচ্ছে।

আঁতকে উঠল ঋভু। উঠে বসল, বুক ধড়ফড় করছে ভীষণ। আজ বিকেলে মধুকাকা তার কাছে এসেছিল। সে বলেছিল, ‘যেদিকেই যাবে সব শুভ।’

মধুকাকার কি কোনো বিপদ ঘটল? বাবা এসেছিল নৌকো নিয়ে, তারপরেই মধুকাকা। মানে, মধুকাকাও কি তবে বাবার মতোই না ফেরার দেশে চলে গেল?

বাকি রাতটা আর ঘুম এল না তার। অস্থির হয়ে সে অপেক্ষা করছিল কখন ভোর হবে।

ভোরের আলো ফুটতেই ঋভু বেরিয়ে পড়ল ঋভু। দোকানপাট এখনো খোলেনি, লাইট পোস্টের হলুদ আলো জ্বলছে, সমুদ্র একেবারে শান্ত। বালির ওপর হেঁটে একেবারে জলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ঋভু। পায়ের পাতা জল আর ফেনাতে ভিজে গেল। সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখবে বলে ট্যুরিস্টরা চলে এসেছে—কেউ হাঁটছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

নৌকো কিছু রাখা আছে বালির ওপরে, ঋভু দৌড়ে কাছে গেল। কই, আকাশনীল নৌকো তো বাঁধা নেই! সারি সারি নৌকো রয়েছে, শুধু ওই নৌকোটা নেই। জেলেদের একজন তাকে দেখে বলল, “এত সকাল?”

“তোমরা কখন ফিরেছ?”
“ভোরবেলা। চারটা নাগাদ।”
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ টের পেতেই সে ঘাড় ঘোরাল। মধুকাকা কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
“ক-কখন এলে?” উত্তেজনায় ঋভুর কথা জড়িয়ে গেল।
“কাল আর যাওয়া হয়নি রে। খবর এল ছেলের শরীর খুব খারাপ, বাড়ি চলে গেলাম। সারারাত জ্বর ছিল, এখন অনেকটা ভালো আছে।”
“কিন্তু তোমার নৌকা দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
“গণেশ আমারটা নিয়ে বেরিয়েছে। আজ বিকেলে আসবি?”
“না।”
“সে কি!” মধু মুখ চুন করে বলে, “আজ বিকেলে মাঝ-দরিয়ায় নৌকা ভাসাব। বেরোবার আগে তুই আসবি না, কিছু বলবি না?”
ঋভুর গলা ধরে এল, “আজ আসব না। পারব না, ওসব বলতে আমি আর পারব না গো।”

ঋভু দৌড়ে পালায়, সাইকেলে ওঠে, পেছনে আর তাকায় না। সে আর কখনো মাছ ধরতে যাওয়া মানুষগুলোকে নিয়ে, নৌকো নিয়ে কিছুই বলবে না। দীপেনস্যার আরেকবার তাকে ডেকেছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়েছেন, ‘শোন ঋভু, অলৌকিক বলে কিছু হয় না। সমুদ্রের কাছে অভিজ্ঞ জেলে, বছরের পর বছর ঢেউ কেটে, লড়াই করে নৌকো নিয়ে পাড়ি দেয় সেও শিশু। বুঝলি?’

বুদ্ধিটা স্যারের কথা শুনেই তার মাথায় এসেছে। এখন সে দিঘায় যায়, পাড়ে বসে, গর্জন আর উচ্ছ্বাস দেখে সাগরের—একটি শব্দ বলে না আর। মধুকাকা তাকে ধরেছিল একদিন। “তুই কিছু বলিস না কেন?”

“স্বপ্নে সাগরের দেবী এসেছিলেন। এখন কিছু বলতে মানা করেছেন।”

গজা শুনে ব্যাজার মুখে বলে, “কী ঝামেলা! ঘুরতে তাহলে কীভাবে যাব? টাকা কোত্থেকে জোগাড় হবে?”

ঋভু বলল, “পাঁচ হাজার টাকা কম নয়। ওতেই যা হবার হবে। গজা, টাকাগুলো গুছিয়ে রেখেছিস?”
“চিন্তা কোরো না। এমন জায়াগায় রেখেছি, কেউ টের পাবেই না।”
“কোথায় রেখেছিস?”
“খেলার জন্য একজোড়া বুট কিনে দিয়েছিল বাবা। তার মধ্যে রেখেছি।”
বিশু আঁতকে ওঠে, “করেছিস কী! ইঁদুরে কেটে দেবে যে!”
ঋভু কটমট চোখে তাকায়। “বাড়ি গিয়ে এখনই টাকাটা নিয়ে আয়। টাকা কুচিকুচি হলে সব খতম। আমি ভাঁড় কিনে তার মধ্যে রাখব।”
বিশু বলল, “আমার আর তর সইছে না। প্ল্যান কবে হবে? পুজোর দেরি নেই। কবে যাব, কোথায় যাব কিছুই ঠিক হল না।”
ঋভু বলল, “গোপালপুর গেলে কেমন হয়?”
বিশু রেগে গেল। “এখানেও সাগর, সেখানেও সাগর।”

অনেক তর্কবিতর্কের পরে ঠিক হল, তিনজনের পছন্দমতো যাওয়া হবে। ঋভুর সাগর, গজার পাহাড় আর বিশুর জঙ্গল—কোনোটাই বাদ যাবে না। ম্যাপ দেখে, আরো কয়েকজনের কাছে কিছু ভালো ঘোরার জায়গা জেনে বিশু রুট তৈরি করবে। মোদ্দা কথা হল, তাদের যাওয়া হচ্ছেই। স্কুলে কেউ কাশ্মীর, কেউ দার্জিলিং, কেউ সিমলা, কেউ রাজস্থান এই পুজোর ছুটিতে ঘুরতে যাচ্ছে। শুধু কি শুনেই যাবে তারা? বিশুর বাবার পুজোর সময়ে খুব চাপ, পুলিশের ছুটি থাকে না। গজার বাবার বাস চালানোর ডিউটি, পথেই কাটে সারাদিন, ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে না তাই। ঋভুর মা-ঠাকুমা বাসে করে ট্যুরে যান, তীর্থ করাতেই তাঁদের আনন্দ, তাও তিন-চার বছরে একবার। কষ্ট করে দিন চলে, ঘোরার টাকা পাবেন কোথায়?

বিশু বলল, “বড়ো হলে আমরাই ঘরের লোকদের নিয়ে যাব। কিন্তু তার আগে আমাদের বেরোতেই হবে। বিখ্যাত হলে দেখবি লেখা হবে, বিশ্বজিত কর দু-হাজার আঠারো সালে দুই বন্ধুদের নিয়ে প্রথম অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলেন, সঙ্গে ছিল দুই বালক। ভূ-পর্যটক হিসেবে সেটি ছিল তাঁর প্রথম যাত্রা।”

ঋভু বলল, “আমার খুব কাতুকুতু লাগছে।”
গজা বলল, “শুনে আমার খিদে পাচ্ছে খুব।”

***

মহালয়ার বিকেলে ঋভু বলল, “এবার প্ল্যান ফাইনাল করে ফেলতে হবে।”
বিশু বলল, “ভেবে ফেলেছি। বিকেলে গজার সঙ্গে দেখা করে সব ফাইনাল হবে।”
গজার দেখা মিলল দিঘা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। বেডে শুয়ে আছে, স্যালাইন চলছে।
“কীভাবে হল?”

গজার বাবা রথীনবাবু বসে ছিলেন বেডের পাশে, “ডায়েরিয়া হয়েছে। রাত থেকে বমি আর পায়খানা। বাইশ বার ছোটো ঘরে ঢুকেছে। দু-দিন ধরে রাজ্যের বাজে খাবার খেয়ে এই হাল।”

গজা মিনমিন করে বলে, “বেশি কিছুই খাইনি। দু-প্লেট কাঁকড়া, এক প্লেট চিংড়ি, তিনটা পমফ্লেট ভাজা, চার পিস ইলিশ। কাল দুপুরে শুধু এইটুকু খেয়েছিলাম। বেশ সস্তায় দিচ্ছিল হোটেলে।”

“সস্তায় তো দেবেই। বেড়াতে আসা লোক কমে গেছে, মাছ জমে আছে, তোর মতো হ্যাংলা খেয়ে বেড়িয়েছে। একে বাজে আবহাওয়া, তায় ওই রাক্ষুসে খাওয়া! তোমরা কথা বলো, আমি বাইরে ঘুরে আসছি।” রথীনবাবু বললেন।
বিশু হাসল। “আগের জন্মে তুই কি বেড়াল ছিলি?”
ঋভু হালকা গলায় বলে, “বেড়াল নয়, বকরাক্ষস। বাইরে ঘুরতে গিয়ে এমন হলে কী হবে? সেখানে পেট গণ্ডগোল হলে ঘোরাটাই মাটি।”
বিশু বলল, “তুই বাদ। তোর পেটের জ্বালা মেটাতেই সব টাকা শেষ হয়ে যাবে।”
গজা প্রায় কেঁদেই ফেলবে এমন অবস্থা। “আর লোভ করব না। মাইরি বলছি, আধপেটা খেয়েই থাকব। আমাকে নিয়ে না গেলে ভারি অন্যায় হবে কিন্তু!”
ঋভু হাত ধরে বলল, “শান্ত হয়ে শুয়ে থাক। তিনজনেই যাব, নইলে যাবই না। তবে যাওয়ার আগে পেট ঠিক রাখিস।”
গজা বলল, “মা কালীর দিব্যি। এ ক’দিন শুধু জল-মুড়ি খেয়েই থাকব।”

পরিকল্পনা ছিল বিজয়া দশমীর দিন ওরা টুক করে বেরিয়ে পড়বে। মুশকিল হল, গজার বাবা সেদিন ঘরেই থাকলেন। বাস চালানোর ডিউটি তাঁর নেই, ছুটি নিয়েছেন। বাবার চোখকে ফাঁকি দেওয়া গজার পক্ষে অসম্ভব। দিঘায় তিনজনে মিলে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখল ওরা। ঠিক হল, আর দেরি করা চলবে না। আগামীকাল ভোরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রথমে ঠিক ছিল কাঁথিতে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে বলে বেরিয়ে পড়বে। গজা আপত্তি জানাল, “অত মিথ্যের দরকার কী!”

“তাহলে?”

“বাড়িতে চিঠি লিখে রেখে যাব। না-হলে বাড়িতে কান্নাকাটি করবে।” বিশু প্রস্তাব দিল।

ভারি ব্যাগ নিয়ে বেরোনো চলবে না। স্কুলের ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। বাড়িতে সন্দেহ করবে না। একটাই উত্তর হবে, টিউশন পড়তে যাচ্ছে স্যারের কাছে। দিঘা বাস স্ট্যান্ডে এসে বাঁকুড়ার বাস ধরবে তারা।

প্ল্যানমতো কাজ হল, সকাল সাড়ে আটটার দিঘা-বাঁকুড়া বাসে চেপে বসল তারা। বিশু বলল, “ফিরে এলে বাবা আড়ংধোলাই দেবে। ভাবতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

ঋভু বিরক্ত হল। “এখনো সময় আছে। বাস থেকে নেমে পড়। এত যদি ভয় তবে এলি কেন? আমার বাড়িতে বকাঝকা করবে। গায়ে হাত তুলবে না।”

গজা সায় জানাল, “আমারও। বাবা সন্ধেয় ফিরে এসে চিঠিটা দেখবে। তবে ফিরে আসার পরে মারধোর করবে না। বাড়ি থেকে বেরোনো হয়তো বন্ধ করে দেবে ক’দিন।”

বিশু জোর গলায় বলে, “আমি ভয় পাব না। অত ভয় পেলে অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়া যাবে না।”

বাস ছেড়ে দিতেই ওরা আনন্দে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে পড়ল। এতদিন ধরে মনের মধ্যে থাকা ইচ্ছেটা সত্যি হতে চলেছে তাহলে! কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।

***

অবনীশ চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। “হোয়াট! ঘুরতে বেরিয়েছে? ঘর থেকে পালিয়ে?”

কেয়া বললেন, “তাই লিখেছে চিঠিতে। এইমাত্র নজরে এল।”

“বলছ আটটার সময়ে বেরিয়েছে, আর বেলা এগারোটায় তোমার চোখে পড়ল? ছেলে পড়তে যাবার নাম করে বেরিয়ে ফিরল কি না সে খেয়াল ছিল না?”

“এতক্ষণ চারদিকে খুঁজলাম। পেলাম না। ঠাকুরঘরে বেদির নীচে চিঠিটা দেখতে পেলাম এখন।”
“তুমি থাকতে ছেলেটা জেল ভেঙে পালিয়ে গেল?”
কেয়া ফোঁস করে ওঠেন, “ভুলভাল বকছ কেন? বিশু কি কয়েদি যে জেল থেকে পালাবে?”
অবনীশ বলেন, “ওই হল। একবার ধরি। তারপর এই থানার লক-আপে পুরে ফ্যান থেকে ঝুলিয়ে পেটাব।”
কেয়া ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলেন, “ছেলেটার কী হল তার ঠিক নেই, তোমার মারধোরের চিন্তা খালি। খুঁজে বের করো আগে।”
“ওর সঙ্গে যে দুটো গেছে তাদের নামধাম, ঠিকানা পাঠিয়ে দাও। মোবাইলে ছবি পাঠাও। না-হলে কীভাবে খুঁজব?”
“একজন ঋভু, আর একজন গজা। ঋভুকে তো চেনো। ছবি কীভাবে পাঠাব ফোনে?”
অবনীশ বিরক্ত হয়ে বলেন, “বিশুর ক্লাসমেট ঋভুকে চিনি। কিন্তু এই গজার নাম আগে তো শুনিনি। কতবার বলেছি দিনরাত টিভি না দেখে ফোনের কারিকুরি শেখো। সামান্য ছবি পাঠাতে পারবে না?”
“ওদের ছবি আমি কোথায় পাব?”
“তোমাকে বলে কিছু লাভ নেই। প্রণবকে বলি। দেখি কিছু করতে পারে কি না।”

অবনীশ বাল্যবন্ধু প্রণবকে ফোন করলেন। প্রণব এখন  দিঘা বিদ্যাভবনের টিচার। বিশু আর ঋভু ওই স্কুলেই পড়ে।

প্রণব শুনে হাসলেন। “বলিস কী! খোদ পুলিশের ঘর থেকে চোখে ধুলো দিয়ে ছেলে গায়েব? ভারি অন্যায়।”

অবনীশ ক্ষিপ্ত হলেন। “মজা করার টাইম এটা নয়। তুই খোঁজ করে বাকি দুটোর ছবি পাঠা তাড়াতাড়ি। তিনটাকে ধরে ফুটন্ত তেলের কড়াইতে না চোবাতে পারলে শান্ত হব না।”

“ছেলে তিনটে বেশ বিপদে ফেলল দেখছি। আমার কিন্তু শুনে মজাই লাগছে। একবার আমি আর তুই দার্জিলিং যাব বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম, মনে আছে তোর?”

“মনে আছে। বাবা চলন্ত বাস থামিয়ে কান ধরে টেনে আমাদের নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।”

প্রণব হাসলেন। “তোর ছেলে সেই ধারা বজায় রেখেছে। শান্তিতে ক’টা দিন ঘুরতে দে ওদের। নিজে তো ছেলেটাকে কখনো ঘুরতে নিয়ে যাসনি।”

অবনীশ বলেন, “বুঝেছি। টিচার হয়ে তুই প্রশ্রয় দিয়েছিস ওকে? ঘুরতে দেব মানে? দিনকাল ভালো নয়, রাস্তাঘাটে বিপদ হলে কী হবে তখন? কিডন্যাপ করে যদি কেউ? যা বলছি তাই কর।”

প্রণব জিজ্ঞাসা করেন, “ছেলে তিনটের নামে মিসিং ডায়েরি করে দেব দিঘা থানায়?”

অবনীশ ধৈর্য হারালেন। “যা বলছি সেটা তাড়াতাড়ি কর। পুলিশের ছেলের নামে মিসিং ডায়েরি! আমার কোনো প্রেস্টিজ নেই?”

***

বাঁকুড়া বাস স্ট্যান্ডে দুপুর দেড়টায় ওরা নামল। খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি জ্বলছে। বাস স্ট্যান্ডের হোটেলে খেয়ে নিল তিনজন। ভাত, মুগের ডাল, আলুপোস্ত আর মাছভাজা। পেট পুরে খেয়েদেয়ে হোটেলের বাইরে এসে বিশু বলল, “বড়ো ঘুম পাচ্ছে।”

গজা হাই তুলে বলল, “আমারও।”

ভাতের হোটেলে ঋভু জিজ্ঞাসা করে নিয়েছে শুশুনিয়া এখান থেকে কতদূর, কীভাবে যেতে হবে। বাসে একঘণ্টা লাগবে। আজ গিয়ে লাভ নেই, বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। সেখানে থাকার জায়গা পাওয়া মুশকিল। একটি সরকারি গেস্ট হাউস আছে, আগে থেকে বুক করে যেতে হবে।

ঋভু বলল, “আজকে যাব না। লজে থেকে যাব। কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়ব।”

বিশু সায় জানিয়ে মাথা নাড়ে। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে একটি লজের সন্ধান পাওয়া গেল। মা তারা লজ, ভাড়া কম। ওখানেই থাকবে ভেবে নিল ঋভু।

লজের সাইনবোর্ড দেখে তিনজনে ঢুকে পড়ল। রংচটা টেবিলের ওপাশে কাঠের চেয়ারে ভুঁড়িওলা গোলগাল এক বয়স্ক মানুষ বসে ছিলেন। ঋভু কাছে গিয়ে বলল, “এখানে রুম পাওয়া যাবে?”

“হ্যাঁ।” পেপার থেকে মুখ তুললেন না তিনি।
“আমরা থাকব।”
“সঙ্গে বড়ো কেউ আছে?”
“না।”
“তাহলে রুম দেওয়া যাবে না।”
বিশু বলল, “কেন?”
এতক্ষণে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। “আধার কার্ড আছে?”
“না। আনিনি।”
“কোত্থেকে আসা হচ্ছে?”
বিশু বলে দিল, “কেয়াবনি থেকে আসছি আমরা।”
“সেটা কোথায়?”
ঋভু বিশুকে পাশে সরিয়ে দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মিথ্যে উত্তর দিল, “খড়গপুরের কাছেই।”
“তা কোথায় আসা হয়েছে?”
“বন্ধুর বাড়ি। শুশুনিয়ার কাছে।”
“হোটেলে থাকতে হবে কেন? বাসে চেপে গেলে ঘণ্টা খানেক লাগে। কী মতলব?”
ঋভু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কোনো মতলবে নয়।”
তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, “একুশ বছর লজ চালাচ্ছি। আমিই মালিক। মাথার চুল এমনি পাকেনি। ঘর থেকে পালিয়ে এসেছিস?”
ঋভু চুপ করে থাকল।
“নামঠিকানা বল। ভজা, ওরে ভজা, এই বাচ্চাগুলোকে রুমে আটকে রেখে দে। আমি থানায় ফোন লাগাচ্ছি। হয় ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে, না-হয় কোনো হোম থেকে ভেগেছে। অনাথ আশ্রম, হোম, স্কুলের হস্টেল থেকে বাচ্চারা খুব পালাচ্ছে আজকাল।”

ঋভু নিমেষেই পেছন ঘুরে ফিসফিস করে, “পালিয়ে চল। এখনই। দরকারে ছুট লাগা।”
তিনজনে পড়িমড়ি করে ছুটে বেরিয়ে এল রাস্তায়। টোটো আসছিল একটা, উঠে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে ঋভু বলতে পারল, “স্টেশন যাব।”
“প্রত্যেকের কুড়ি টাকা করে লাগবে।”
বিশু বলল, “তাই দেব।”
স্টেশনের কাছে নেমে গজা চিন্তিতভাবে প্রশ্ন করে, “এখন কী হবে?”

বিশু বলল, “বলেছিলাম, আধার কার্ড নিয়ে আসতে। শুনলি আমার কথা? দিঘার লজে আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড না দেখালে থাকতে দেয় না। পাশের বাড়ির নির্মলকাকু সপ্তর্ষি লজে কাজ করে। সে বলেছিল একবার। জানি আমি।”

ঋভু মুখ বাঁকাল। “কী বুদ্ধি! আধার কার্ড থাকলে আমাদের সব জেনে ফেলবে। ধরিয়ে দেবে একটা ফোনেই। আমাদের কোনো লজেই থাকতে দেবে না। সন্দেহ করবে। ইস, এটা মাথায় আসেনি আগে।”

বিশুর মুখ সাদা হয়ে এল ভয়ে। “কোথায় থাকব আমরা? ঘোরা আর আমাদের হল না। কী হবে?”

ঋভু বলল, “আচ্ছা, রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে দেব। কী বলিস?”
গজা মাথা চুলকে বলল, “সবদিন রাতে স্টেশনে?”
ঋভু ঘাড় নাড়ে। “আর কোনো উপায় নেই মনে হচ্ছে। তোরা ভাব। ভাবা আর প্ল্যান কি শুধু আমার কাজ? মাথায় কিছু আসছে না যে!”
বিশু বলে, “আজ রাতটা কাটাই, সকালে শুশুনিয়া যাব। ওখানে ঘুরে-টুরে ভাবা যাবে।”
গজা আশ্বস্ত হল। “বিশুদার বুদ্ধি খুলছে। শুশুনিয়া যাই আগে। আচ্ছা, লজের ওই বুড়োটা যদি পুলিশ ফোন করে দেয়? পুলিশ আমাদের খুঁজে ধরে নিয়ে যাবে তখন।”
ঋভু ঠোঁট কামড়াল। “হতে পারে। কী আর করা যাবে? থানাতে রাত কাটবে।”
বিশু বলল, “আমার পেট গুড়গুড় করছে। ওর’ম বলিস না।”
“অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছিস, ভয়ে এর মধ্যেই পেট গুড়গুড় করছে! এভাবে ঘুরতে বেরোনোর জন্য তুই-ই আমাদের তাড়া দিচ্ছিলি। আমরা কি চোর নাকি যে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াব?”

স্টেশন চত্বরেই ওরা সময় কাটাল। সন্ধে নামল। ওভার-ব্রিজ পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে বেঞ্চে বসে থাকে তিনজন। ক্লান্ত লাগছে, ঘুম পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়তে, উপায় নেই। ঋভুর মাথায় এল, ওয়েটিং রুমেই রাতটা কাটিয়ে দেবে। সেখানে প্রচুর ভিড়, বসার জায়গা থাকলেও শুয়ে পড়া যাবে না।

ঋভু বলল, “হোটেলে খেয়ে আসি। রাতে নিশ্চয়ই শোবার জায়গা হবে, না পেলে মাটিতেই শুয়ে পড়তে হবে।”
বিশু করুণ সুরে বলে, “মাটিতে! আমরা ঘুরতে এসেছি। রাজ্যের পাগল আর ভিখিরিদের সঙ্গে রাত কাটাতে হবে!”
গজা হেসে বলল, “আমার কিন্তু ভারি মজা লাগছে।”
***
অবনীশ বললেন, “গুড। সব ক’টার ছবি পেলাম এইমাত্র ফোনে। ওদিকের খবর কী?”

“তিন বাড়িতেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। গজার বাবা রথীন দাস বাস চালান। ডিউটি থেকে ফিরে শুনেছেন সব। বলছেন, মিসিং ডায়েরি করবেন।”
অবনীশ বলেন, “নিজের ছেলের নামে মিসিং ডায়েরি করতেই পারেন। তবে চব্বিশ ঘণ্টা না কাটলে ওটা করা যায় না। আর কিছু খবর?”
“না। রথীনবাবু স্ট্যান্ডে গেছেন এইমাত্র। বাসে করে গেলে ঠিক খোঁজ পেয়ে যাবেন ভাবছেন। ট্রেনে গেলে আলাদা ব্যাপার।”
অবনীশ বলেন, “কাল ওদের ছবি সমস্ত থানায় সার্কুলেট করে দেব। ভেবে দেখলাম, মিসিং ডায়েরি করতেই হবে।”
“এতক্ষণে তোর বুদ্ধি খুলেছে।”
রাত দশটায় প্রণবের ফোন এল আবার।

“একটা সূত্র পাওয়া গেছে। দিঘা-বাঁকুড়া বাসের কন্ডাক্টর ছবি দেখে চিনতে পেরেছে। তিনজন ছিল। বাঁকুড়াতে দুপুর দেড়টায় নেমেছে। কন্ডাক্টর রথীনবাবুর ছেলে সুনন্দ ওরফে গজাকে চিনত। জিজ্ঞাসা করেছিল। গজা জানিয়েছে, তিন বন্ধু মিলে বাঁকুড়ায় বন্ধুর বাড়ি ঘুরতে যাচ্ছে। ঘরে না জানিয়ে যে বেরিয়েছে তা আর সে কীভাবে বুঝবে?”

অবনীশ হাতে চাঁদ পেলেন যেন। “বাহ্‌, রথীনবাবু কাজের কাজ করেছেন। বাছাধনেরা আমার এলাকার দিকেই এসেছে। আমি এখনই গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি। বাঁকুড়া থানার ইনচার্জকে জানিয়ে দিচ্ছি সব। আজ রাতেই তিনমূর্তিকে ধরে ফেলব।”

“ধরা আবার কী! ওরা কোনো ক্রিমিনাল নয়। ওদের পেলে বাঁকুড়া আর পুরুলিয়ার ভালো ভালো স্পটগুলো বরং গাড়িতে ঘুরিয়ে দিস।”

অবনীশ রেগে গেলেন। “হ্যাঁ, ওদের চব্যচোষ্য খাইয়ে, দামি হোটেলে রেখে, আদর-খাতিরে রাখব। আগে ব্যাটাদের ধরে নিয়ে আসি।”

***

কার্তিক টুলে বসে ঢুলছিল। কলিং বেলের শব্দে সে ধড়মড় করে জেগে উঠল। চেম্বারে ঢুকে স্যালুট মেরে বলল, “ইয়েস স্যার।”

সুখেন্দু রক্ষিত আদেশ দিলেন, “তিনটে ছেলে ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে। তার মধ্যে একজন আবার রঘুনাথপুর থানার মেজবাবুর ছেলে। তিনজন করে দুটো টিম করেছি। একটাতে তুমি থাকবে।”

“হ্যাঁ, স্যার।”

“এই নাও ছেলে তিনটের ফোটো। মোবাইলে নিয়ে নাও ছবিগুলো। একটা টিম শহরের হোটেলগুলো সার্চ করে দেখবে, তোমার টিম যাবে বাস স্ট্যান্ড আর স্টেশন। এস.আই সাহাবাবু অন্য টিমে থাকছেন। বুঝেছ? ইনফরমেশন অনুযায়ী, ছেলে তিনটে বাঁকুড়াতেই বাস থেকে নেমেছে।”

“পেলেই ধরে নিয়ে আসব।”

“খুঁজে বেড়াবে চারদিকে। কোনো ঢিলেমি চলবে না।”

কার্তিক খুশি হল মনে মনে। অ্যাদ্দিনে দৌড়ঝাঁপের কাজ পেয়েছে। এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে হলে তার হাই ওঠে, ভীষণ ঘুম পায়। চার বছর হল কনস্টেবলের চাকরি করছে। ভেবেছিল চোর-ডাকাতদের ধাওয়া করবে, অ্যাকশন করবে—কোথায় কী! শুধু বসে বসে বড়োবাবুর রুমের সামনে ডিউটি চলছে চার মাস। উত্তেজনা এসেছে মনে, ঘুম কেটে গিয়েছে।

বাস স্ট্যান্ডে বেশ ক’বার চরকিপাক দিল কার্তিক আর দুজন হোম গার্ড। ঘুমন্ত লোকদের টর্চ মেরে দেখল—সব ভবঘুরে আর ভিখিরি, বাসগুলোতে উঁকি মেরে দেখল। সারাদিনের পরিশ্রমের পরে বাসের স্টাফেরা অকাতরে ঘুমোচ্ছে।

ফোন বাজতেই সে ধরে বলল, “ইয়েস স্যার।”
সাহাবাবু জিজ্ঞাসা করেন, “পেলে?”
“না, স্যার।”
“মা তারা লজের মালিক জানালেন যে বাচ্চাগুলো তার হোটেলে রুম খুঁজতে এসেছিল। জেরা করতেই কেটে পড়েছে। তুমি কোথায়?”
“বাস স্ট্যান্ডে।”
“এতক্ষণ ধরে? প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। ওখানে কী করছ?”
“চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছি স্যার।”
সাহাবাবু ধমক দিলেন, “ইডিয়ট! ছেলেগুলো যেন তোমার জন্যই বসে আছে ওখানে। স্টেশনে দেখো, সমস্ত যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে দেখো, রাস্তার মোড়গুলো ওয়াচ করো। আমি ধর্মশালায় যাচ্ছি। বি কুইক।”
“ইয়েস স্যার।” কার্তিক ঢোঁক গিলে মোবাইল পকেটে রাখে।
ওয়েটিং রুম ছেড়ে তিনজনেই বাইরে বেরিয়ে এল। ঘুম ভেঙে গেছে, মশা কামড়াচ্ছে মাঝেমধ্যে। স্টেশনের ঘড়িতে তিনটা বাজে।
গজা বলল, “খিদে পাচ্ছে।”
বিশু বলে, “হোটেলে পেট ভরে খেয়েছিস, এর মধ্যেই খিদে! জল খেয়ে থাক। এখন খাবার কোথায় পাব?”
গজা ট্যাপ থেকে প্লাস্টিকের বোতলে জল ভরে নিয়ে সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চে বসল। বিশু বিরক্তিতে বলে, “মশা খাচ্ছে খুব। শান্তিতে ঘুমোনো গেল না।”
স্টেশনের মাইকে ঘোষণা হল, চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার আসছে।
ঋভু প্রশ্ন করে, “চক্রধরপুর কোথায় রে?”
বিশু হাই তুলে বলে, “জানি না।”
প্ল্যাটফর্মে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগপত্র নিয়ে। ঋভু একজনের কাছে গিয়ে জানতে চাইল, “ট্রেনটা চক্রধরপুর যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
“শুশুনিয়া যাবে ট্রেনটা?”
“ট্রেন পাহাড়ে ওঠে না।” লোকটি হাসল, “ছাতনা স্টেশনে নেমে শুশুনিয়া যেতে হয়।”
“ছাতনা যাবে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু এত রাতে ওখানে গিয়ে কী করবি?” লোকটি সন্দেহের চোখে তাকাল।
বিশু বলল, “ট্রেকিং করব।”
“কী করবি?”
“গ্লোব নিয়ে নাচ করব।” বিশু রাগতভাবে বলে, “যা খুশি করব। তাতে আপনার কী!”
“আমার কাজ আছে। তাই এখানে এসে তোদেরকে ওয়াচ করছি। এতক্ষণে শিওর হলাম তোরা সেই তিন বিচ্ছু।” লোকটি হাসল। “আমি কার্তিক হালদার। পুলিশের লোক। ভুল করে আমাকে প্যাসেঞ্জার ভেবে নিজেরাই ধরা দিয়েছিস।”
গজা আঙুল মুখে পুরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে আঙুল ছেড়ে বলল, “বললেই হল আপনি পুলিশের লোক! ড্রেস কোথায়? আপনি ছেলেধরা।”
“চোপ! সিভিল ড্রেসেই বেরিয়েছি তোদের পাকড়াও করতে। না হলে পালাবি।” কার্তিক বলল।
ঋভু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে কার্তিক জিজ্ঞাসা করে, “দেখছিস কী?”
“আপনাকে।”
“কেন?”
“আপনি কী দারুণ দেখতে! পুলিশ বলে মনেই হচ্ছে না। আপনার সামনে খুব বিপদ। ঘূর্ণিঝড় আসবে।”
“বিপদ মানে?”
“ছ’মাস আগে আপনার বিপদ হয়েছিল খুব।” ঋভু শান্তভাবে বলে।
কার্তিক ঘাবড়ে গেল। “তুই কীভাবে জানলি?”
“আমি সব জেনে যাই।” ঋভু বলে, “এই যেমন আপনাকে দেখেই কত কিছু মনে হচ্ছে। আপনি সিনেমায় নামবেন। অবশ্যই নামবেন। প্রচুর মাছ পাবেন।”
কার্তিক ভুরু কুঁচকে বলে, “মাছ!”
ঋভু জিভ কেটে বলে, “টাকা পাবেন। নাম হবে। ইয়া ইয়া পোস্টার বেরোবে আপনার।”
কার্তিক ঘাড় নেড়ে বলে, “আমাকে আরেকজনও একই কথা বলেছিলেন। গঙ্গাসাগর মেলায় বালতিবাবাও বলেছিলেন যে আমি সিনেমার হিরো হব।”
“বিপদের কথা ঠিক বলেছি?”
“একদম।”
“আমাদের ধরলে কিন্তু সাংঘাতিক বিপদ হবে! মেছোভূত আপনার ইউনিফর্ম কেড়ে নেবে।” ঋভু চোখ পাকিয়ে বলল।

কার্তিক চমকে ওঠে। একবার সুপারসাহেব তার ইউনিফর্ম কেড়ে নেবার হুমকি দিয়েছিলেন। যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়া তার অভ্যেস। এক মন্ত্রী আসবেন, সার্কিট হাউসের বারান্দায় চেয়ারে বসেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পুলিশ সুপার রাউন্ডে এসে দেখতে পেলেন। রেগেমেগে সাসপেন্ড করে দিয়েছিলেন তাকে। ক্ষমা চেয়ে-টেয়ে দু-মাস পরে আবার চাকরিতে জয়েন করেছিল।

কার্তিক ঢোঁক গিলে বলে, “মেছোভূত!”
“হ্যাঁ, জলের আশেপাশে গেলেই মুশকিল।”
“তাহলে?”
“চোখ বন্ধ করে বসে বসে ভাবুন আমাদের ধরবেন কি না। আমরা এখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। ইচ্ছে হলে ধরে নিয়ে যাবেন।” ঋভু শান্তভাবে বলল।

ভাবতে ভাবতে ঝিমুনি চলে এসেছিল কার্তিকের। ট্রেনের শব্দ পেতেই সে চোখ খোলে। প্ল্যাটফর্মে চক্রধরপুর লোকাল এসে গেছে। ছেলে তিনটা গেল কোথায়?

লাফিয়ে ট্রেনে উঠল কার্তিক। উঠে এগোতে পারল না, সাংঘাতিক ভিড় কামরায়। নেমে পড়ে সে আরেক কামরায় ওঠে। সেখানেও ভিড়, লোকজন ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতি করছে। হতাশ হয়ে নেমে পড়ল কার্তিক। ম্যাজিক জানে নাকি ছেলেগুলো, ভ্যানিশ হয়ে গেল দু-মিনিটেই!

“ইয়েস স্যার।” ফোন আসতেই ধরল কার্তিক।
“পেলে স্টেশনে?”

কার্তিক বলতে গিয়েও থেমে যায়। বিচ্ছু তিনজন যে তার হাতের নাগালে এসেও ফসকে গেল অল্পের জন্য, সেটা বলাই চলবে না। ধমক তো শুনতে হবেই, সাসপেন্ডও হয়ে যেতে পারে আবার। কার্তিক বলল, “না, স্যার। পাইনি ওদের।”

হোম গার্ড দুজনকে স্টেশনের বাইরে রেখে একা এসেই ভুল করেছে। তাদের চা তেষ্টা পেয়েছে। একটা দোকান খোলা মাত্র তার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। এই ভোররাতে চা না খেলে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে দুই বাবুর! কীভাবে আর জানবে যে ছোঁড়া তিনটা স্টেশনেই থাকবে? সাহাবাবুর বুদ্ধিরও বলিহারি! হুকুম দিলেন যে পুলিশের ইউনিফর্মে কার্তিক যেন না যায়, সিভিল ড্রেসেই যেন বেরোয়। তাতে ছেলেগুলো কিছু টের পাবে না, ধরতে সুবিধা হবে। সাহাবাবুও তার মতোই বড়োবাবু রক্ষিতস্যারের কাছে বকাঝকা খান। ড্রেসে দেখলে ছেলেগুলো ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত, আর সে ওদের খপাৎ করে ধরে নিত।

কী যেন বলছিল ছেলেটা? হতেও তো পারে। এইটুকু ছেলে, কীভাবে বলল সব! না, পুকুর বা নদীর আশেপাশে যাবে না সে কিছুতেই।

স্টেশনের সামনের দোকানে চা খেতে খেতে ঘুমের ভাবটা কেটে গেল। মাথায় বুদ্ধিটা খুলল। ধুর, ছেলেটা আস্ত একটা পাজি। তাকে উল্লু বানিয়েছে। সকাল হলেই সে শুশুনিয়া যাবে, ব্যাটাদের ধরবে। বড়োবাবুকে কী বলবে ভেবে নিল কার্তিক। স্টেশনের লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে যে তিনটি ছেলে শুশুনিয়া কীভাবে যাওয়া যাবে তা জিজ্ঞাসা করছিল। সে স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই চক্রধরপুর লোকালে উঠে ছেলেগুলো চলে গেছে।

থানায় ফিরে সে বড়োবাবুকে বলল সাজিয়ে গুছিয়ে।

রক্ষিত বললেন, “মেজবাবুকে নিয়ে আর একঘণ্টা বাদেই বেরিয়ে পড়ো। অবনীশবাবু একঘণ্টার মধ্যেই এখানে এসে পড়বেন। তিনজনে মিলে অপারেশন করবে।”

ঘণ্টা খানেক বাদে বাঁকুড়া থানায় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন অবনীশ। পথে ঘন জঙ্গলের মাঝখানে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে ঝামেলার একশেষ, না হলে আরো আগে পৌঁছে যেতে পারতেন। ভোর সাড়ে পাঁচটায় বোলেরো গাড়িতে তিনজনে বেরিয়ে পড়লেন।

কার্তিক বলল, “স্যার, ছাতনা স্টেশনে আগে একবার সার্চ করে নিলে হয় না?”
“কেন?”
“মন বলছে যে ছেলেগুলো ছাতনা স্টেশনেই নামবে। অত রাতে শুশুনিয়া যেতে পারবে না। স্টেশনেই ঘোরাঘুরি করবে।”
অবনীশ প্রশংসার চোখে তাকালেন। “বাহ্‌! ঠিক বলেছ তুমি।”

সাহাবাবু বলেন, “কার্তিক খুব বুদ্ধিমান। শুধু ঘুম চলে এলে ওর বুদ্ধি লোপ পায়। একবার এক ডাকাতের দলকে ছদ্মবেশ ধরে ফলো করেছিল। ধরাও পড়েছিল তারা। ওই ভালো কাজের জন্যই এস.পি সাহেব ওর শাস্তি কমিয়ে দিয়েছিলেন।”

কার্তিক বিরক্ত হল। অন্য থানার মেজবাবুর সামনে সাসপেন্ড হবার গল্প না শোনালে চলছিল না?

ছাতনা স্টেশনে নেমে খবর নিতেই জানা গেল, তিনটা ছেলে নেমেছিল। একজনের কোঁকড়ানো চুল, গায়ের রং কালো, আর একজন চিনাদের মতো দেখতে, মাথায় ছোটো ছোটো চুল। আর একটা ছেলে বেশ লম্বা, সরু সরু পা, মাথাভর্তি চুল। ছেলেগুলোর কাছে টিকিট ছিল না। চেকার সাহেব ধরেছিলেন। অবনীশ প্রায় দৌড়ে টি.টি ভদ্রলোকের খোঁজে গেলেন।

“হ্যাঁ, এসেছিল। টিকিট ছিল না বলে ধরেছিলাম।”
“কোথায় সেগুলো?”
“ছেড়ে দিয়েছি।” টি.টি হেসে বললেন।
অবনীশ রাগে ফেটে পড়লেন। “ছেড়ে দিয়েছেন মানে? বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া যাত্রীদের ছেড়ে দেন আপনি? এই ডিউটি করছেন আপনি?”
টি.টি রেগে বললেন, “আমাকে কাজ শেখাতে আসবেন না। বাচ্চা ছেলে সব, চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। এমন কাকুতি মিনতি করছিল যে মায়া হচ্ছিল। একজন খিদের চোটে আঙুল চুষছিল।”
“লম্বা, রোগা ছেলেটা কী করছিল?”
“মশার কামড়ে গাল ফুলে গেছে তার। ট্রেনে উঠতে গিয়ে ডান পা-তে লেগেছে বলল। খোঁড়াচ্ছিল বেশ।”
অবনীশের গলা ধরে গেল, “বলেন কী! ওটা আমার ছেলে। তার এমন কাহিল অবস্থা! ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে ওরা।”
টি.টি বললেন, “আপনি যা রাগী, ছেলের আর পালানোয় দোষ কী?”
অবনীশের তর্ক করার সময় নেই, ইচ্ছেও নেই। গাড়িতে উঠে পড়লেন জোরে পা চালিয়ে। হুকুম দিলেন, “স্টার্ট। গো কুইক। শুশুনিয়া যেতে হবে।”
***
মুকুটমণিপুর যাওয়ার রাস্তাটা যেন একখানা সুন্দর ছবি। বাসের জানালা থেকে অবাক হয়ে দেখছিল ঋভু। রাঙামাটির বুক চিরে মসৃণ কালো পিচ-রাস্তা চলে গেছে, দু-পাশে শাল, পলাশ, শিমুল। গজা দু-খানা কেক বাসে বসেই সাবাড় করে ফেলল। ছাতনা স্টেশনের আশেপাশে ঘুরে একটা দোকান খোলা পেয়েছিল, সেখান থেকে দশখানা কেকে কিনে নিয়েছে ওরা। কখন আবার খাবার জুটবে বলা মুশকিল।

স্টেশনে নেমে ঘোরাঘুরি করতে করতে ঋভু বলেছিল, “এখান থেকে ট্রেকার শুশুনিয়া যায়। দোকানের মালিক জানাল।”

গজা মাথা দুলিয়ে বলেছিল, “না, শুশুনিয়া যাব না।”
“সে কি! পাহাড় তোর পছন্দ, ঘোরার লিস্টেও এক নম্বরে ছিল। তাই শুশুনিয়া পাহাড় সবার ফার্স্টে যাওয়া হবে ঠিক ছিল।”
গজা বুঝিয়েছিল, “পুলিশ একবার আমাদের দেখতে পেয়েছে। জেনেও গেছে আমরা শুশুনিয়া যাব। পুলিশ কি আমাদের খুঁজে শুশুনিয়া যাবে না?”
ঋভু পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল। “এটা আমাদের মাথাতে আসেনি। ভাগ্যিস তুই বললি।”
বিশু বলেছিল, “তোকে যারা গোবরগণেশ বলে, তারা নিজেরাই গাধা।”
ঋভু বলেছিল, “বিশু, তুই ট্রেনে উঠতে গিয়ে পায়ে ঠোকা খেলি যে! এই তোর ফিটনেস!”
“অত কুইক যে ছুটে ট্রেনে চড়তে হবে বুঝতে পারিনি।”
“আমাদের এটাই অ্যাডভেঞ্চার। শুরু থেকেই বাধা। পুলিশ খুঁজছে। সবসময় রেডি থাকতে হবে। এখন তাহলে কোনদিকে যাব?”
বিশু বলেছিল, “মুকুটমণিপুর। ওটা লিস্টে দু-নম্বরে ছিল।”
পিচ-রাস্তায় এসে ওরা বাস পেয়ে গিয়েছিল।
বিশু ঢুলছিল। “ঘুম না হলে এনার্জি আসে? হতচ্ছাড়া মশারা কামড়েছে সারারাত। বড়ো হয়ে আমি মশা মারার ওষুধ আবিষ্কার করব।”
“তোমার রক্ত বেশি মিষ্টি, তাই বেশি কামড়েছে।” গজা বলল। দু-খানা কেক খেয়ে তার মন ফুরফুরে, পাহাড় আপাতত বাদ যাচ্ছে বলে কোনো দুঃখ নেই।
সকাল সাড়ে সাতটায় মুকুটমণিপুরে পৌঁছে গেল ওরা।
বাস থেকে নেমেই বিশু একটি দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ল, “আর পারছি না। একটুকুন বিছানা দরকার। শুতে হবে।”
“কোথায় পাবি বিছানা?”
“কেন, এখানেও থাকতে দেবে না কেউ?” বিশুর মুখ ফ্যাকাসে দেখাল, “আজ রাতটা কোথায় কাটাব?”
“অ্যাডভেঞ্চার করতে এসে অত আরাম চাইলে হবে? তুই এখানে বসে থাক। আমি আর গজা দেখছি।” ঋভু বলল।
বিশু শুকনো মুখে বলে, “রাতে থাকার জায়গা না পেলে ঘোরা বন্ধ। বাস ধরে দিঘায় ফিরে যাব। ঘরে দু-চারটা থাপ্পড় মারবে, তাও ভালো। এইভাবে কষ্ট করা যাবে না।”
কোনো উত্তর না দিয়ে ঋভু গজাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। সুন্দর বাঁধানো রাস্তা, দু-পাশে লাইট পোস্ট, অনেক ট্যুরিস্টে সরগরম।
গজা আঙুল দেখায়, “ওই দেখো, ঋভুদা।”
ঋভু দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ে। নীল জলরাশি, বিস্তার অনেক, সকালের আলোয় উজ্জ্বল, ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে কষ্ট করে বেরিয়ে পড়া সার্থক হল। পুরো ড্যামের চারপাশটা হেঁটে দেখতে বহুক্ষণ লাগবে। শান্ত, সুন্দর জলধারা দেখে মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। ঋভু বলে উঠল, “অপূর্ব! এখানে দু-দিন থাকব।”
“থাকব কোথায়?”
“চল আগে খুঁজি। পরে তিনজনে সারাদিন ধরে দেখব আর ঘুরব।”

ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ল দুজন। ছোটো জায়গা, লজ কম, সব জায়গা ভর্তি, কোথাও খালি নেই। কোথাও অবশ্য হোটেলের সেই বুড়ো মালিকের মতো জেরা করেনি, সন্দেহে তাকায়নি। হতাশ হয়ে ফিরে বেঞ্চে বিশুর পাশে বসে পড়ল ঋভু।
“পেলাম না।”
বিশু হাসল। “এই কাকুকে বলেছি। দোকানের পেছনে রুম আছে একটা। মেঝেতে শুতে হবে।”
ঋভু জানতে চাইল, “থাকা যাবে কাকু?”
“আমার লজ বা হোটেল নয়। মাটির ঘর। ট্যুরিস্ট পার্টির সঙ্গে আসা ড্রাইভাররা থাকে। রেট সস্তা। তোমাদের পোষালে থাকো। এই সিজনে ওই মাটির বাড়িই ফাঁকা থাকবে না।”
ঋভু জিজ্ঞাসা করে, “কত লাগবে?”
“পাঁচশো।”
“দু-দিন থাকব।”
“হাজার টাকা দাও এখন।” দোকানদার খুশির গলায় বলে, “বাচ্চাছেলে সব, ঘুরতে এসেছ। তোমাদের জন্য কম ভাড়াই নিচ্ছি।”
টালির চাল, একতলা মাটির বাড়ি, সামনে কুয়ো রয়েছে। একটা ঘরের দরজা খুলে দেখিয়ে দিল দোকানদার, “এইখানে কাটাতে হবে। সামনে কুয়ো, ঘরে বালতি আছে। জল তুলে স্নান করে নিতে হবে। বিছানা গোটানো আছে। পেতে নেবে। কারেন্ট চলে গেলে মোমবাতি জ্বেলে কাটাতে হবে।”

ঋভু চোখ কুঁচকে তাকাল। “দিঘা থেকে এসেছি বলে দিয়েছিস?”
“কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। সব বলতে মন গলল।” বিশু অসহায়ভাবে বলে।
“পুলিশে যদি জানিয়ে দেয়?” গজা প্রশ্ন করে।
ঋভু বসে পড়ল মাদুরের ওপরে। “তখন ধরে নিয়ে যাবে।”
মাদুরের ওপরে তোষক আর চাদর পেতে তিনজনে শুয়ে পড়ল। ভ্যাপসা গন্ধ উঠছে চাদরের গা থেকে, নাকে লাগল কিছুক্ষণ গন্ধটা। আস্তে আস্তে বদ গন্ধটা সহ্য হয়ে গেল। অঘোরে ঘুমে ঢলে পড়ল একসময়।
***
অবনীশ রাস্তায় পায়চারি করছেন বার বার। দশটা বেজে গিয়েছে, রোদ উঠেছে ঝলমল—ছেলেগুলোর দেখা নেই। শুশুনিয়াতে এখনো ওদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না।

অবনীশের দুশ্চিন্তা হচ্ছে এবার। তাঁর গুণধর ছেলেটি লেংচে হাঁটছিল শুনেছেন। পায়ের চোট কেমন কে জানে। সেই জন্যই কি আসতে দেরি হচ্ছে? তাঁর সতর্ক চোখে ধরা পড়বেই, যাবেটা কোথায়?

কার্তিক বলল, “স্যার, পাহাড়ে উঠে যায়নি তো ওরা?”
“পাহাড়ে উঠলে নামবে একসময়। এতক্ষণ বসে আছি কী জন্য?” অবনীশ রেগে তাকালেন।
“তাছাড়া আমরা আসার আগে ওরা পৌঁছয়নি, ড্যাম শিওর। কেউ দেখেনি ওদের।” সাহাবাবু বলেন।
পাহাড়ে ওঠার রাস্তা যেখানে তার কাছেই একটি অশ্বত্থগাছের নীচে তিনজন বসে আছেন। পাহাড়ে যে বা যারা উঠছে তাদের বলে রেখেছেন অবনীশ, তিনটে বাচ্চাকে দেখতে পেলে এসে যেন জানায়।
চারজনের একটা দল নেমে হাঁপাচ্ছিল।
“দেখতে পেলে?”
“না। কেউ বেশি দূর উঠতে পারছে না। বেশ খাড়া, তার ওপর হায়েনার ডাক শোনা যাচ্ছে বলল অনেকে। কিছুটা গিয়েই নেমে এসেছি।”
কার্তিক বলল, “আমি গিয়ে দেখে আসব?”
“না। ওরা এখানে আসেইনি মনে হচ্ছে।”
“তাহলে স্নান করে আসি। পাহাড় থেকে জলের ধারা নেমে আসে মন্দিরের পাশে। এই জল শুনেছি সারাক্ষণ থাকে। সারারাত জাগা, অস্থির লাগছে।”
অবনীশ বললেন, “যাও। স্নান করবে কীভাবে? দুটো গামছা কিনে নিয়ে এসো। আমিও স্নান করে ফ্রেশ হব। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে তারপর। সাহাবাবু, আপনি কী করবেন?”
“আমিও স্নান করে নিই। একযাত্রায় পৃথক ফল কেন?”
স্নান করে তিনজনের শরীর-মন জুড়িয়ে গেল। অবনীশ বললেন, “বেশ এনার্জি পাচ্ছি। কখনো এই পাহাড়ে উঠেছ কার্তিক?”
“না, স্যার। এলেও উঠিনি। তবে অযোধ্যা পাহাড়ে হেঁটে হেঁটে উঠেছিলাম।”
অবনীশ থমকে গেলেন। “ব্যাটারা অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে চলে যায়নি তো?”
“যেতে পারে। তবে চট করে অদ্দূর যাবে না মনে হচ্ছে।”
“মনে সন্দেহ রেখে চলে যাব? না, চলো, পাহাড়েই উঠি। বলা যায় না, অন্য কোনো রাস্তা ধরে হয়তো উঠেছে পাহাড়ে। বলছিল দু-মাইল লম্বা পাহাড়, ভূতগুলো ঝোপঝাড়ের মধ্যে অন্যদিক দিয়ে উঠে পড়তে পারে। হায়েনা আছে বলছিল, বনশেয়াল আছে শুনলাম। বিপদে পড়বে, চিন্তা হচ্ছে।”
“কোনো হায়েনা বা শেয়াল ওদের কিছু করতে পারবে না।”
“কীভাবে জানলে কোনো ক্ষতি হবে না?” অবনীশ ঘুরে দাঁড়ালেন।
“ইয়ে, এমনিই বলছিলাম। অশুভ চিন্তা না করাই ভালো।” আমতা আমতা করে কার্তিক। ছেলেগুলো যে বেজায় বিচ্ছু সেটা সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
***
ঘুম থেকে উঠে কুয়ো থেকে জল তুলে ওরা তিনজন স্নান সেরে ফেলল। খিদে পাচ্ছে খুব, বেরিয়ে একটা হোটেলে খেল। গজা ভাতের পাহাড় করে ফেলল, বেড়াল টপকাতে পারবে না এমনই পরিমাণ। তরকারি আর মাছের ঝোল চেটেপুটে খেল ওরা।

টাকা দেবার সময়ে কাউন্টারের লোকটি বললেন, “অনেকের খাওয়া দেখেছি, কিন্তু আজ দেখে চোখ সার্থক হল।”
বিশু বলল, “ও কমই খেয়েছে।”
লোকটি বললেন, “রাতে আসবে তোমরা?”
“হ্যাঁ, এই দোকানের খাবার বেশ ভালো।”
গজা বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “রাতে আসব কি না জানতে চাইছিল কেন?”
“তুই একা তিনটে মিল খেয়েছিস হিসেব করলে। তোর মতো খদ্দের পেলে ওর হোটেলে খাবার আর পড়ে থাকবে না।”
ঘুরতে ঘুরতে ড্যামের কাছে পৌঁছল তিনজন।
বিশু বলল, “বাহ্‌! এতক্ষণে মনে হচ্ছে ঘুরতে এসেছি।”
গজা বলল, “নৌকোতে চড়লে কেমন হয়?”
ঋভু বলল, “দারুণ হবে।”
এক মাঝির সঙ্গে কথা হল। পুরো ড্যামটা নৌকোয় করে ঘুরিয়ে দেবে।
সুনীল জলরাশি ছুঁয়ে নৌকো এগিয়ে চলল। ঋভু গল্প শুরু করে দিল, “এটা কুমারী নদী?”
“না। কংসাবতী নদী। মাঝখানে কংসাবতী আর কুমারী নদীর মিলনস্থল। ড্যাম ওখানেই তৈরি হয়েছে।”
“আমার বাবা নৌকা চালাত।”
“তাহলে তিনি আমাদেরই লোক। কোথায় চালাতেন?”
“দিঘার সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত। একদিন নৌকো ডুবে যায়, বাবা আর ফেরেনি।”
“শুনে খারাপ লাগল। তুমি শিখেছ নৌকা চালাতে?”
ঋভু মাথা নেড়ে বলে, “না। মা বলেছে একদম ওসবে মন না দিতে। দিঘায় থাকলেও কখনো নৌকোয় উঠিনি। আজ উঠলাম।”
অরণ্যে ঘেরা তিনদিক। জায়গাটা সমতল নয়, উঁচুনীচু, পাহাড়ের অংশ বলেই মনে হচ্ছে। নীল আকাশ আর নীল জল যেন দু-হাত মেলে ডাকছে তাদের।
ঋভু বলল, “কী সুন্দর! এই একটা জায়গায় এসে সব দেখতে পেলাম।”
গজা বলে, “জল, জঙ্গল, পাহাড়। আমরা যেমনটা চেয়েছিলাম।”
বিশু বলে, “মুকুটমণিপুরকে তাই সবাই বলে বাঁকুড়ার রানি। কী দারুণ স্পট! এখানেই থেকে যাই।”
গজা ঘাড় নেড়ে বলল, “অ্যাঁ, একটা জায়গা ঘোরার জন্য এত কষ্ট করে এলাম! কী ঝামেলা!”
ঋভু হাসে, “বাড়ি থেকে একবার যখন বেরিয়েছি, অনেক জায়গা ঘুরব। চিন্তা করিস না।”
“কাল তাহলে শুশুনিয়া যাচ্ছি?”
“হ্যাঁ, গিয়ে এখানেই ফিরে আসব সন্ধেবেলা। অন্য কোথাও আমাদের যে থাকতে দেবে না।”
সুবল-মাঝি বলল, “ওই যে পাহাড় দেখছ, ওর চূড়ায় পরেশনাথ মন্দির আছে। ওখান থেকে পুরো মুকুটমণিপুর দেখতে পাওয়া যায়, নীল জল আর কংসাবতীর ছবি দেখতে পাবে। পারলে যেও।”
***
অবনীশ আর কার্তিক পাহাড় থেকে নেমে এসেছেন। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছেন, ইউনিফর্ম ভিজে গিয়েছে ঘামে।
কার্তিক বলল, “পায়ে বেশ আরাম পাচ্ছি। বসে বসে ডিউটি করে পায়ে খিল লেগে গেছিল।”
অবনীশ বললেন, “তুমি ছোকরা মানুষ, তোমার কথা আলাদা। পাজি তিনটা গেল কোথায়?”
কার্তিক বলল, “খিদেয় পেট জ্বলছে স্যার। পেটে কিছু না পড়লে মাথা কাজ করছে না।”

হোটেলে গোগ্রাসে খাচ্ছিলেন অবনীশ। মোবাইল বাজতেই ধরলেন, “হ্যালো।”
“পেলি ওদের?”
“পেলে জানাতাম না তোকে? পুরো শুশুনিয়া পাহাড়টা তন্নতন্ন করে দেখলাম।”
“পাহাড়ে উঠেছিলি?” প্রণব প্রশ্ন করেন।
অবনীশ রেগে গেলেন। “এতক্ষণ শুনে কী বুঝলি তাহলে?”
“তাহলে ছেলের কারণে এই ছেচল্লিশ বছর বয়সে তোর পাহাড়ে ট্রেকিং করা হয়ে গেল। তা কেমন লাগল?”
অবনীশ ভেংচে ওঠেন, “কেমন লাগল! কাহিল অবস্থা। নড়ার ক্ষমতা নেই, পা-দুটো ছিঁড়ে যাচ্ছে।”
“এইজন্য বলি, মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে হিমালয়ে ট্রেকিং করতে যেতে। যাই হোক, ওরা কোথায় গেছে জানতে পারিসনি এখনো? বুদ্ধি আছে বলতে হবে, পুলিশকেও ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে।” প্রণবের হাসির শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল।
অবনীশ ফোনটা কেটে দিয়ে ভরপেট খেয়েদেয়ে হাই তুললেন। “শোবার জায়গা হবে একটু?”
“হ্যাঁ, স্যার। রান্নার জায়গার পাশে দড়ির খাটিয়া আছে। কষ্ট করে ওখানেই বিশ্রাম নিতে পারেন।”
অবনীশ ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুম থেকে যখন উঠলেন বিকেল হয়ে গিয়েছে।
কার্তিক বলল, “চা আনতে বলি স্যার?”
চায়ে চুমুক দিয়ে ঘুমের ঘোরটা কাটল। হাই তুলে অবনীশ জানতে চাইলেন, “সাহাবাবু কোথায়?”
“আজ্ঞে, তিনি দোকানে দোকানে ইনফর্ম করছেন। তিনটে ছেলে এদিকে এলে যেন পুলিশে জানিয়ে দেওয়া হয়।”
“বাহ্‌। সাহাবাবু কাজের কাজ করছেন। মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

বিকেল সাড়ে পাঁচটায় জিপে করে বাঁকুড়া শহরের উদ্দেশ্যে তিনজনে রওনা দিলেন। অবনীশ প্রণবকে ফোন করলেন, “একটা বিজ্ঞাপনের লেখা রেডি কর কুইক। তিন পাজির ছবি তোর মোবাইলেই আছে। যে বা যারা ওদের সন্ধান দিতে পারবে, তাদের তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আমার ফোন নম্বর দিবি। বুঝলি?”

প্রণব বললেন, “ছেলেগুলোর পেছনে এবার লোক লেগে যাবে। পুলিশ অলরেডি উঠেপড়ে লেগেছে। বেচারারা আর শান্তিতে ঘুরতেও পারবে না।”

অবনীশ ধৈর্য হারালেন। “যা বলছি তাই কর। কাল যেন দু-খানা পেপারে বিজ্ঞাপনটা  দেখতে পাই।”

“কোনো ছেলেধরার গ্যাং যদি ওদের ধরে নিয়ে যায়? কেউ যদি কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ চায়? মুম্বাইতে এরকম কত ছেলেমেয়েকে জোর করে ভিক্ষা করায় জানিস? বিশাল র‍্যাকেট।”

অবনীশ বলেন, “কল্পনাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না? কাল পেপারে বিজ্ঞাপন বেরোবে, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া সংলগ্ন এলাকায় ওরা আছে, এটা লেখা থাকবে। শান্তি হয়েছে?”

কার্তিক আমতা আমতা করে, “স্যার, বলছিলাম, ইয়ে মানে, পুলিশের লোক ধরলে টাকাটা পাবে?”

“অবশ্যই। ওদের ধরিয়ে দিতে পারলে তিরিশের বদলে চল্লিশ হাজার দিতে পারি।”
***
শেষ বিকেলে মুসাফিরানা ভিউ পয়েন্ট থেকে ওরা সূর্যাস্ত দেখল। মন জুড়িয়ে গেল সেই অপরূপ ছবি দেখে। সন্ধেতে পুরো রাস্তাটা হাঁটল ওরা। সন্ধের মুকুটমণিপুর আলো ঝলমল, স্বপ্নের মতো সুন্দর।

বিশু বলল, “কাল আরেকবার নৌকোয় চেপে চারদিক দেখব। একটা আইল্যান্ডে ডিয়ার পার্ক আছে। নেমে হেঁটে যেতে হবে।”
ঋভু বলে, “তাই হবে। আজ খুব ক্লান্ত লাগছে।”
গজা বলে, “কাল আরো অনেক কিছু দেখা যাবে। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
হোটেলে খেয়েদেয়ে রাত ন’টায় রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল তিনজন।
“ও মা গো, মরে গেলাম।”

চমকে জেগে উঠল ঋভু। বিশুর কাতর আর্তনাদ শুনে গজাও জেগে উঠেছে। ঋভু জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে? অমন চিৎকার করছিস কেন?”

“আমাকে কিছু একটা কামড়েছে!” বিশু প্রচণ্ড ভয়ের গলায় বলল।

তড়িঘড়ি উঠে হাতড়ে সুইচ অন করল ঋভু। আলো জ্বলতেই দেখল, বিশু ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে বসে আছে। কাছে গিয়ে ঋভু ভালো করে দেখল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিশুর আঙুল। খুঁটিয়ে দেখে ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল ঋভুর। দুটো দাগ সামান্য ব্যবধানে, মনে হচ্ছে দাঁত বসিয়েছে কিছু একটা। সর্বনাশ! কী হবে এখন?

গজা দেখে বলল, “কীসে কামড়েছে ঋভুদা?”
ঋভু বলল, “জানি না। আমি কি দেখেছি?”
“আমার যে সাপের কামড় বলে মনে হচ্ছে গো!”
বিশু শোনামাত্র ডুকরে কেঁদে উঠল, “অ্যাঁ, কী হবে আমার? ও বাবা গো, ও মা গো, তোমাদের না বলে এসেছিলাম কেন? আর তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না যে!”
গজা ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ঋভু মৃদু ধমকে বলল, “তুই কাঁদছিস কেন? তোকে কী কামড়েছে?”
গজা বলল, “বিশুদা আর বাঁচবে না, কাঁদব না?”
দরজায় ধাক্কা পড়তেই ঋভু খুলে দিল। ভোলা জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে? এত কান্নাকাটির শব্দ কেন? কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি।”
বিশু পেনাল্টি শট বাঁচানোর ভঙ্গিমায় একেবারে ডাইভ দিল ভোলার পায়ে, “সাপে কামড়েছে যে! আমাকে বাঁচাও কাকু।”
ভোলা হকচকিয়ে গেল শুনে। “সাপ! কই দেখি।”
বিশু করুণ সুরে বলে, “আমাকে হাসপাতাল নিয়ে চলো এখনই।”

ভোলা মাদুরে বিশুকে বসিয়ে খুঁটিয়ে দেখে শান্তভাবে বলে, “ধুর! সাপ কেন হবে? সাপে কামড়ালে এত রক্ত কখনো বেরোয়? এটুকুন ফোঁটা রক্ত পড়ে, রক্তমুখ হয়।”

গজার ফোঁপানি থামে। “তাহলে?”
ভোলা আশ্বস্ত করে, “ও মেঠো ইঁদুরের কামড়। ছুঁচো হলেও ভয়ের ছিল। যন্তনা হবে একটু। চিন্তার কিছু নেই।”
বিশু চোখ মুছে তাকাল। “বলছ?”
“হ্যাঁ। এবার ঘুমিয়ে পড়। টর্চ আছে সঙ্গে?”
“না।”
“আমার একখান টর্চ দিয়ে যাচ্ছি। সকালে দেখি সন্তোষ ডাক্তারকে বলে একটা টেটভ্যাক ইঞ্জেকশন দেওয়াব।”
বিশু আঁতকে ওঠে, “টেটভ্যাক নিলে বড়ো ব্যথা থাকে!”
“সাপে কামড়েছে ভেবে মড়াকান্না জুড়েছিলি। এখন সামান্য ইঞ্জেকশনের নামে ভয়?” ভোলা বিরক্ত হল।
***
কার্তিক বেলা আটটায় ঘুম থেকে উঠে বসে আছে। একটু আগে সে স্বপ্নে এক হরিণকে কচি পাতা খেতে দিচ্ছিল। নৌকো থেকে নেমে একটা চরে কিছুটা হেঁটে হরিণের দেখা পেয়েছে। কার্তিকের মাথা কাজ করল। হুম, মুকুটমণিপুরে ড্যামের মাঝখানে নৌকো থেকে নেমে ডিয়ার পার্কে যেতে হয়। সে মোবাইলে ফোন করে, “স্যার, মু-মু!”
অবনীশ বলেন, “তোতলাচ্ছ কেন? ভূতে ধরল নাকি?”
কার্তিক ঘাবড়ে গিয়ে ভাবল, সত্যিই কি তাকে মেছোভূতে ধরল? সে বলল, “স্যার, মুকুটমণিপুর যেতে পারে ওরা।”
অবনীশ বলেন, “গুড সাজেশন। এই স্পটের নাম মাথায় আসেনি কাল। তবে শিওর না হয়ে ছুটে লাভ নেই। আমি খাতড়া থানায় জানাচ্ছি। টিম পাঠাতে বলছি।”
“আমি যাব?”
“কেন, তুমি গিয়ে এক্সট্রা কী করবে শুনি?”
চল্লিশ হাজার টাকার পুরস্কার যে তার কপালে জুটতে পারে তা আর বলল না কার্তিক।
খাতড়া থানার ইনচার্জ কমল কুণ্ডু শুনে বললেন, “আপনার ছেলে? হ্যাঁ, ফোটো পেয়েছি ওই তিনজনের। আচ্ছা, আমিই বেরোচ্ছি। ওদের ফোটো সমস্ত থানায় সার্কুলেট করেছেন?”
“বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পূর্ব আর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সব থানায় দিঘা থানা থেকে ছবি আর মিসিং ডায়েরির কপি পাঠানো হয়েছে।”
দশটা নাগাদ মুকুটমণিপুরে পৌঁছলেন কুণ্ডুবাবু। কয়েকটা দোকানে খোঁজ নিতেই খবর পেলেন, তিনটে ছেলে একসঙ্গে ঘুরছিল। ভোলার দোকানের আশেপাশে দেখা গিয়েছে। কুণ্ডুবাবু ভোলার দোকানের সামনে গাড়ি থামালেন।
“তিনটে ছেলে এসেছিল?”
“কোন তিনটা ছেলে?” ভোলা যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“চালাকি করবি না। জেলহাজতে যাবার শখ হয়েছে? কোথায় আছে ওরা?” কমল কুণ্ডু গর্জে উঠলেন।
ভোলা ফ্যাকাসে মুখে বলল, “আমার রুম ভাড়া নিয়েই ছিল স্যার।”
“ছিল মানে?”
“আজ সকালে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।”
“কোথায় গেছে?”

ভোলা চিন্তা করল কিছুক্ষণ। দু-দিনের ভাড়া নিয়ে নিলেও ছেলে তিনটা যাবার সময়ে টাকা আর ফেরত নেয়নি। ভোলাকাকু নাকি ওদের জন্য অনেক করেছে, সামান্য টাকা ফেরত নেবে না। সাহসী ছেলেগুলো ঘর থেকে পালিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। সাহসী ছেলে, দম আছে। ওদের ধরিয়ে দিতে সে সাহায্য করবে না।

ভোলা মিথ্যে বলল, “ঝিলিমিলি যাবে বলল।”
“আচ্ছা,” কুণ্ডুবাবু চলে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ালেন, “বিশেষ কিছু বলতে পারবি ওদের সম্বন্ধে?”
“বিশু নামের একজনকে মেঠো ইঁদুরে কামড়েছিল পায়ে মাঝরাতে। ডেটল, তুলো লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সকালে টেটভ্যাক ইঞ্জেকশন করিয়েছি বাইকে নিয়ে গিয়ে।” ভোলা বলল।
“গুড। তা ওদের কাছ থেকে টাকাকড়ি নিয়েছিস কিছু? মাটির রুম, ইঁদুরের উৎপাত—বাচ্চা ছেলেগুলোর কাছে নিয়েছিস কত?” কুণ্ডুবাবু গর্জে ওঠেন।
ভোলা জিভ কাটে। “বাচ্চা তিনটাকে কেউ থাকতে দিচ্ছিল না। রাতে কোথায় থাকবে বলুন? দয়া হল দেখে। ওদের কাছে ভাড়া নিতে পারি?”
অবনীশ শুনে বলেন, “হোয়াট? আমার বিশুকে ইঁদুরে কামড়েছে!”

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তাঁর। মশা কামড়ে গাল ফুলিয়ে দিয়েছে, খুঁড়িয়ে হাঁটছে, ইঁদুরে কামড়েছে—ছেলেটার ওপর বড্ড অত্যাচার হচ্ছে। এখন পাকড়াও করে ঘরে নিয়ে যেতে পারলে মন ঠান্ডা হবে। হতচ্ছাড়ার ভূ-পর্যটক হবার সাধ ঘুচবে।
***
ছাতনা স্টেশনের বাইরে একটি দোকানের বেঞ্চে বসে ছিল তিনজন। গজার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, শালপাতার ঠোঙায় গরম কচুরি খেয়েই চলেছে।
“আটখানা হল এই নিয়ে। সকালে ভোলাকাকার দোকানে ডিম-টোস্ট খেয়ে বেরিয়েছিস। আমার চারখানা খেয়েই পেট ফুলে গেল।”
গজা হাসে। “পেট খালি হলে আমার বুদ্ধি কাজ করে না। এখন কোথায় যাচ্ছি?”
“বিষ্ণুপুর।”
“প্রথমে শুশুনিয়া যাব ঠিক করেছিলাম। শুশুনিয়াতে পুলিশ আমাদের ধরার জন্য থাকতে পারে। কে বলেছিল?” গজা কচুরি চিবোতে চিবোতে তাকাল।
ঋভু হাসে। “তুই বলেছিলি।”
গজা বলল, “আমার কপালে পাহাড় দেখা নেই।”
বিশু বলে, “দুঃখ করিস না। সব ঠিক থাকলে অযোধ্যা পাহাড় চলে যেতে পারি।”
ঋভু বলে, “বিষ্ণুপুরে যে কোথায় থাকব!”
বিশু হাসে। “রাতে থাকবই না। রাত হলেই কোনো ট্রেনে উঠে পড়ব।”
ঋভু বিশুর হাতে আলতো থাপ্পড় দিল। “এই প্রথম একটা ভালো বুদ্ধি দিলি রে অ্যাটলাস।”

আধঘণ্টা বাদে আদ্রা-খড়গপুর লোকালে উঠে বসল ওরা। বাঁকুড়া স্টেশনে দাঁড়াল ট্রেন।
গজা নামতে যেতেই আটকাল ঋভু। “একদম নামবি না। পুলিশ আমাদের খোঁজে থাকতে পারে এখানে।”
বিশু ফিসফিস করে, “অনেক পুলিশ দেখছি কিন্তু প্ল্যাটফর্মে!”
“এদিকেই আসছে যে!”
“সর্বনাশ! কী করবি এখন?” বিশুর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল।
ঋভু নীচু গলায় বলে, “বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি চল।”
ট্রেনের বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে লাগিয়ে ওরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকল। গজা চাপা গলায় বলে, “কী হবে গো ঋভুদা?”

ঋভু নীচু গলায় উত্তর দেয়, “কী আর হবে! আমাদের ঘোরা এখানেই শেষ।”

ধ্বস্তাধ্বস্তি, চেঁচামেচির শব্দ কানে এল কিছুক্ষণ পরেই। গজা সাহস করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে উঁকি মেরে বলল, “কাকে যেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে।”

বিশু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, “আমাদের ধরতে আসেনি তাহলে।”

ছিটকিনি খুলে আস্তে আস্তে ওরা সিটে এসে বসল। পাশের এক বয়স্ক মানুষ হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা মনে হল ভয় পেয়েছিলে পুলিশ দেখে। তাই বাথরুমে লুকিয়ে পড়েছিলে?”
গজা ঘাড় দোলাল। “হ্যাঁ দাদু। পুলিশ দেখলেই ভয় লাগে আমাদের।”
“কীসের ভয়? তোমরা কি কোনো খারাপ কাজ করেছ?”
“না।”
মানুষটি হাসলেন। “এক কুখ্যাত ডাকাতকে খুঁজছিল পুলিশ। বাঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল। পুলিশের কাছে খবর ছিল, ওঁত পেতে ধরেছে। তা তোমরা যাচ্ছ কোথায়?”
বিশু বলে, “বিষ্ণুপুর।”
“কেন?”
“ঘু-ঘুরতে।”
“বাড়ি কোথায়?”
“ছাতনা।” ঋভু উত্তর দিল, “আমাদের এক বন্ধু বিষ্ণুপুরে থাকে। তার বাড়িতেই যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”

ট্রেন এগিয়ে চলেছে ঝমঝম শব্দে, ওদের বুকে হাতুড়ি বাজছে। ভয় করছে খুব। তারা কোনো অপরাধ করেনি, তবু পুলিশের ভয়ে চোর-ডাকাতের মতো সিঁটিয়ে থাকতে হচ্ছে।

বিশু ফিসফিস করে, “বাবা আমাদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিয়েছে মনে হচ্ছে।”
গজা চাপা স্বরে বলে, “কী ঝামেলা! ঋভুদা, আমরা ঘরেই ফিরে যাই চলো।”
বিশু ঘাড় নাড়ে। “একদম না। আমাদের অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাবে?”
***
ওরা দলমাদল কামানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কলকাতা থেকে পাঁচজনের একটি দল বিষ্ণুপুর ঘুরতে এসেছে। দলটার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে ঋভু। দলের একজন হল শমিত রায়। ওরা তিনজনে দলটার সঙ্গেই ঘুরছে। শমিতদা বলল যে এই কামান ১৭৪২ সালে মল্লরাজা গোপাল সিং মারাঠা আক্রমণ রোখার জন্য তৈরি করিয়েছিলেন। দলমাদল কামান লোহা দিয়ে বানানো হলেও এখনো মরচে পড়েনি, রোদে-জলে পড়ে থেকেও একইরকম আছে।

বিশু বলল, “একটা ছবিও থাকবে না ঘোরার!”
গজা শোনামাত্র লুফে নিল কথাটা। “আমারও খুব ইচ্ছে করছে। ওদের বলি?”
শমিতদার কাছে গিয়ে গজা বলে, “দাদা, আমাদের একটা ছবি তুলে দেবে?”
“ছবি একটা কেন, যতগুলো ইচ্ছে তুলে দেব। তোদের দেখে ভালো লাগছে। কেমন তিনজনে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিস! আমাদের সময়ে ঘরে পারমিশন দিতই না।”
গজা দাঁত বের করে হাসে। “আমাদেরও দেয়নি। পুলিশ আমাদের খুঁজছে।”
ঋভু চাপা স্বরে বলে, “গজা, তুই পথে বসাবি দেখছি। সব বলে দিচ্ছিস?”
শমিতদা চোখ কপালে তোলে। “বলিস কী! শুনে বেশ থ্রিলিং লাগছে। আমরা কাউকে বলব না। নিশ্চিন্ত থাক। নে, এবার কামানটার সাইডে তিনজনে পোজ দিয়ে দাঁড়া।”
শমিতদা মোবাইলে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে বলে, “ছবি তুলে নিলাম। কিন্তু তোরা পাবি কীভাবে?”
বিশু ঋভুকে জিজ্ঞাসা করে, “কার নম্বর দেব? বাবা আর প্রণবস্যারের নম্বর জানি।”
“উঁহু, কাকুর নম্বর দিস না।”
বিশু প্রণবস্যারের নম্বর দিল। ফোনে সেভ করে নিয়ে শমিতদা হাসে। “সব ছবি পরে হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দেব। এখন পাঠালে তোরা ধরা পড়ে যাবি।”

জোড়বাংলা মন্দির, মদনমোহন মন্দির ঘুরল ওরা। শমিতদা বোঝাল, দুটো মন্দিরই ল্যাটেরাইট ইটের তৈরি আর অপূর্ব টেরাকোটা কাজের নিদর্শন হিসেবে বিখ্যাত।

ঘুরতে ঘুরতে দলটার সঙ্গে রাসমঞ্চ পৌঁছল ওরা। শমিতদা বলল, “৬০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি এটা। মল্লরাজা বীর হাম্বির করিয়েছিলেন।”
বিশু বলে, “তেরোশো আঠেরো বছর আগে তৈরি!”
ঋভু হাসে। “এই প্রথম ফটাফট একটা বিয়োগ ঠিকমতো করলি।”
রাসমঞ্চ দেখে মন ভরে গেল তিনজনের। শমিতদা বলল, “দেখ ভালো করে। ল্যাটেরাইট মাটির প্ল্যাটফর্ম। পিরামিডের মুকুট, ঢালু ছাদ। এত সুন্দর স্থাপত্য ভূ-ভারতেও খুঁজে পাবি না। এই রাসমঞ্চ ভারতবিখ্যাত।”
“রাসমঞ্চ নাম কেন?” ঋভু জানতে চাইল।
“রাস উৎসবের সময়ে বিষ্ণুপুরের সমস্ত মন্দির থেকে দেবদেবীর মূর্তি এখানে নিয়ে আসা হত। এখনো তেমনটি করা হয়। মানে এই সুন্দর গ্যালারি-ঘেরা মঞ্চ ছিল রাস উৎসবের জায়গা। বুঝলি?”
“হ্যাঁ।”
“রাসমঞ্চের সামনে তোদের ছবি থাকা দরকার।” শমিতদা বলল, “তোরা ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস। স্মাইল।”
রাধাকৃষ্ণ মন্দিরেও ঘুরল ওরা।
শমিতদা জিজ্ঞাসা করল, “রাতটা কাটাবি কোথায়?”
ঋভু উত্তর দেয়, “জানি না।”
“আমাদের সঙ্গে চল। ম্যানেজ করে লজের একটা রুম তোদের দিয়ে দেব।”
ঋভু মাথা নাড়ে। “আমদের সব দেখা হয়ে গেছে। আর এখানে থাকব না।”
“বুঝেছি,” শমিতদা হাসে, “তোরা তিনজনে স্বাধীন থাকতে চাস। এবার যাবি কোথায়?”
“অযোধ্যা পাহাড়।”
“এবারে বল, তোদের আসল বাড়ি কোথায়? ছাতনা বলেছিলি তখন।”
ঋভু বলে, “দিঘার কাছে।”
“সাবধানে আয় তোরা। আমার নম্বরটা লিখে রাখ। দরকারে, বিপদে পড়লে ফোন করবি। ফোনবুথ পাবি না সহজে, তবু বুদ্ধি করে করিস ফোন। তোদের আটকাব না। হিংসে হচ্ছে তোদের দেখে।” শমিতদা ও দলের বাকিরা হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিল।
বিশু গজগজ করে, “অযোধ্যা পাহাড়? মানে পুরুলিয়া। রঘুনাথপুর পুরুলিয়ায়। বাবার এলাকায় আমি যাবই না।”
ঋভু হাসে। “কোথায় যাব, কোথায় যাচ্ছি তা আমরা তিনজন ছাড়া কেউ জানবে না।”
বিশুর মুখে হাসি দেখা গেল। “তাহলে এবার কোথায়?”
গজা তাড়া দিল, “আগে খাব। পেট চোঁ চোঁ করছে।”
তিনজনে একটি হোটেলে খেতে ঢুকে পড়ল।
***
কেয়া বললেন, “পেলে?”
অবনীশ গম্ভীর গলায় বললেন, “পেলে জানতে না?”
কেয়ার গলা ধরে আসে, “ক’দিন হল বিশু ঘরে নেই। রাতে ঘুম আসছে না। এদিকে তুমি দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছ!”

রাগ সামলে অবনীশ বলেন, “দিনরাত এক করে ছেলে তিনটাকে খুঁজে চলেছি। পাহাড়ে চড়তে হল এই বয়সে। পেপারে বিজ্ঞাপন দিতে বলেছি। তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছি। আর কী করব?”
“বিশু আমার কী অবস্থায় আছে কে জানে। খেতে পাচ্ছে?”

পায়ে চোট, ইঁদুরের কামড় ইত্যাদি বলতে গিয়েও থেমে গেলেন অবনীশ। শুনলে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে, নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে বিশুর মা। কথা ঘোরালেন অবনীশ, “বাকি দুটো ছেলের ঘরে কী অবস্থা?”
“ঋভুর মা এসেছিলেন। কী মনের জোর! বলছেন যে ঋভু ঠিক ফিরে আসবে।”
“বুঝেছি। ও হচ্ছে দলের পান্ডা। আচ্ছা, ওরা বেড়ানোর টাকা পেল কোথায়? ঘরে টাকা চুরি করে বেরোয়নি। ঋভুদের অবস্থা ভালো নয়। গজার বাবা ফোনে জানালেন, প্রতিদিন আশি টাকা দিতেন খেতে।”
“তুমি বড়ো কিপটে। আমার বিশুর খোঁজ দিলে মাত্র তিরিশ হাজার পুরস্কার!”
রেগেমেগে ফোনটা কেটে দিলেন অবনীশ। তর্কে সময় নষ্ট করলে চলবে না, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।
প্রণবকে ফোন করে অবনীশ জানতে চাইলেন, “বিজ্ঞাপন কাল বেরোবে?”
“হ্যাঁ।”
“অ্যামাউন্ট বাড়াতে চাই। ওটা তিরিশের বদলে পঞ্চাশ হাজার করতে চাই।”
“গত পরশু রাতে বিজ্ঞাপন রেডি করে জমা দিয়েছি। চেঞ্জ করা যাবে কি না দেখি।” প্রণব বলেন, “বলছি, অত উতলা হবার কিছু নেই। ওদের ঘুরতে দে। পকেটের টাকা ফুরোলে নিজেরাই ফিরে আসবে।”
ঝাড়গ্রাম থানায় ফোন করলেন অবনীশ। বিষ্ণুপুর থানাতেও ফোন করলেন। ফোটো সব থানায় দেওয়া থাকলেও ফোনে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। কুইক অ্যাকশন হতে পারে।

***

রাত সাড়ে আটটায় বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে উঠল ওরা। বিশু প্রথমে মৃদু আপত্তি জানিয়েও মেনে নিয়েছে। মাত্র দুটি জায়গা ঘোরা হয়েছে এই তিনদিনে। শুশুনিয়া পাহাড়ে যাওয়া মানে সেই একই জায়গায় ফিরে যাওয়া। তার চেয়ে অযোধ্যা পাহাড় যাওয়াই ভালো। অত ভয় করলে চলবে না। তাছাড়া বাঁকুড়া স্টেশন ছাড়া কোথাও তাদের পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়নি।

পুরুলিয়া স্টেশনে যখন নামল, এগারোটা বাজে। প্ল্যান ছিল স্টেশনেই রাতটা কাটিয়ে দেবে। ভোরে অযোধ্যা পাহাড় রওনা দেবে।
ওয়েটিং রুমে ওরা তিনজন শুয়ে পড়ল। ব্যাগে কেক আর কলা মজুত আছে, খিদে পেলে সমস্যা হবে না।
বিশু বলল, “ঠান্ডা লাগছে।”
ঋভু বলে, “আমারও একটু শীত করছে। ব্যাগ ভারী হবে বলে বেশি কিছু আনিনি।”
গজা বলল, “আমার আবার সারাক্ষণ গরম লাগে। শীতকালেও ফ্যান চালাতে হয়।”
বিশু চোখ গোল করে। “তোকে মিউজিয়ামে রাখা উচিত।”
ঋভুর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। সকালে ছাতনা থেকে ট্রেন, সারাদিন বিষ্ণুপুর ঘোরা, আবার ট্রেন—বড্ড পরিশ্রম হয়েছে। ব্যাগটা মাথার নীচে রেখে সে শুয়ে পড়ে।
বিশু বলে, “আজ লক্ষ্মীপূজা। ঘরে থাকলে প্রসাদ, খিচুড়ি ভোগ—কত কিছু খেতাম!”
গজা বলে, “পাশের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে পূজায়। মা চলে যাবার পর আর পূজা কে করবে?”
ঋভু ঘুম জড়ানো গলায় বলে, “আমাদের বাড়িতে পূজা হয়। এই একবারই থাকলাম না।”
কে যেন তাকে বার বার ঠেলছে। বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শোয় ঋভু। কেমন অস্বস্তি লাগছে, ঘাড়ের নীচে কঠিন কিছু ঠেকছে। চোখ খুলেই ঋভু দেখতে পেল গজা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
“কী হল? আবার রাক্ষুসে খিদে? কেক আর কলা তোর ব্যাগেই আছে। ঘুমোতে দে।” ঋভু বলল।
গজা বলল, “আমি শুধু খিদের কথাই বলি? তোমার ব্যাগ কোথায় গেল? দেখতে পাচ্ছি না যে!”
ঋভু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ব্যাগটা মাথার নীচে রেখে শুয়েছিল, এখন নেই।
“তাই তো রে! কোথায় গেল?” ঋভু প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।
“আমি বাথরুম গেছলাম। খেয়াল করলাম হঠাৎ। নীচে, পায়ের কাছে, চারদিকে খুঁজেই যাচ্ছি। কোথাও নেই।” গজার গলায় উদ্বেগ।
ঋভু কিছুক্ষণ চুপ থেকে উদভ্রান্তের মতো তাকাল। “ব্যাগ তাহলে কেউ নিয়ে পালিয়েছে। চুরি হয়ে গেছে। এখন কী হবে?”
টাকা সব নিজের ব্যাগেই রেখেছিল ঋভু। বিশু অঘোরে ঘুমোয়, গজা ঘন ঘন বাথরুম যায়, তাই নিজের জিম্মাতেই টাকা রেখেছিল সে। নিজেই অঘোরে ঘুমোচ্ছিল, সেই সুযোগে কেউ ব্যাগ নিয়ে কেটে পড়েছে।
বিশুকে ডেকে তুলল ঋভু। “বিশু, ওঠ। আমার ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে।”
বিশু বিড়বিড় করে, “আমি চুরি করিনি। তবু ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন পুলিশকাকু?”
গজা চিমটি কাটতেই চমকে চোখ খোলে বিশু। গজা বলে, “কী ঘুম রে বাবা! এদিকে যে বড়ো বিপদ!”
চোখ কচলে ধাতস্থ হয়ে বিশু বলে, “স্বপ্ন দেখছিলাম যে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। কী হয়েছে?”
শোনার পরে বিশু ফ্যাকাসে মুখে বলল, “সব্বনাশ! কী হবে আমাদের?”
ঋভু ম্লান মুখে বলে, “ট্রেনের টিকিট কাটার পরে যা ফেরত দিয়েছিল, সেটাই প্যান্টের পকেটে আছে শুধু।”
বিশু আশাভরা গলায় জিজ্ঞাসা করে, “কত আছে?”
হাতে থাকা চারখানা দশ টাকার নোট দেখিয়ে ঋভু বলে, “এই আছে পড়ে।”
গজার জিভ শুকিয়ে গেল। “মাত্র চল্লিশ!”
মেঝেতেই ধপাস করে বসে পড়ল গজা। কারো মুখে কথা নেই কোনো, একে অপরের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে প্রশ্ন। তিনজনের বুকের ভেতর আশঙ্কা আর উদ্বেগ—কী হবে এবার?
ঋভু বিব্রতভাবে বলে, “খুব বোকামো করেছি। টাকাপত্র প্যান্টের পকেটে রাখতে হত।”

***
গতকাল রাত আটটা নাগাদ স্টেশনের সামনে একটি হোটেলে খেয়ে ট্রেনে উঠেছিল। কলা আর কেক শেষ হয়ে গিয়েছে ভোরবেলায়। সবার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। সস্তা খাবারের খোঁজে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল ওরা। হাফ ডিম-টোস্টের দাম চোদ্দ টাকা। তাতে পেট আর কতটুকু ভরবে?

ফুটপাতে ছাতুর শরবত বিক্রি হচ্ছে। গজা বলে, “বাবা কলকাতায় প্রায়ই ছাতুর শরবত খায়। পেট অনেকটা ভরে যায়।”

তিনজনে এক গ্লাস করে ছাতুর শরবত খেয়ে ঢেকুর তোলে।
ঋভু চিন্তিত স্বরে বলে, “সকালটা এটাতেই চলে যাবে। দুপুরে কী হবে?”

বিশু বলে, “আমরা ফিরেই যাই বরং।”

“কীভাবে ফিরব? ফেরার টাকাও নেই যে!”

বিশু ঠোঁট কামড়ে বলল, “বাবাকে ফোন করে দিই। এসে নিয়ে যাবে।”

ঋভু সায় দেয়, “হুম। ঘোরা যখন হবে না, কষ্ট করে লাভ কী?”

গজাকে হতাশ দেখাল। “কষ্ট করেই ঘুরছিলাম। বেড়ানো তেমন হলই না। কাকুই ভরসা এখন। না-হলে অনাহারে মরতে হবে।”

বিশু রেগে বলল, “একদিন না খেতে পেলে কেউ মরে যায় না।”

কোনো ফোনবুথ খুঁজে পেল না ওরা। এক স্টেশনারি দোকানে জিজ্ঞাসা করল ঋভু, “ফোনবুথ আছে আশেপাশে?”

“ফোনবুথ! সে তো ঐতিহাসিক আমলের ব্যাপার। সারা শহর খুঁজলে পাবে কি না সন্দেহ।”

ঋভু বলেই ফেলল সাহসী হয়ে, “আপনার মোবাইল থেকে একটা ফোন করতে দেবেন, কাকু? বাড়িতে করব।”

“নম্বর বল।”

মোবাইল বিশুর হাতে ধরিয়ে তিনি বলেন, “নে। রিং হচ্ছে।”

“হ্যালো, কে?”

“বাবা, আমি বিশু।”

“কে বিশু?”

“ইয়ে, এটা কোথায়?”

“মানকুণ্ডু।”

মাথা চুলকে বিশু বলে, “নম্বরটা ভুল বলেছি। আরেকবার বলছি।”

এবার ও-প্রান্তে শোনা গেল, “হ্যালো, কে?”

“বাবা, আমি বিশু।”

“এই হতচ্ছাড়া, আমি তোর বাবা হলাম কোত্থেকে? দু-দিন কাজে আসিসনি। গ্যারেজে একগাদা গাড়ি পড়ে আছে। ঢং করে অন্য নম্বর থেকে আবার ফোন করা হচ্ছে!”

বিশু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “এটা কোন জায়গা?”

“গায়ে নেংটি ইঁদুর ছেড়ে দেব তোর। নিজে কোন গ্যারেজে কাজ করিস জানিস না?”

বিশু ফোন রেখে দিল। দোকানের মালিক ফোনটা নিয়ে বললেন, “দূর হয়ে যা। আর ফোন করা যাবে না।”

বেরিয়ে এসে কাঁচুমাচু মুখে বিশু বলে, “নম্বরটা মনে হচ্ছে ঠিক মনে নেই।”

“কাকুর ফোন নম্বর মনে নেই!” ঋভু অবাক হল।

“ছিল। প্রণবস্যারের নম্বর মনে ছিল। একটাও ঠিক মনে পড়ছে না।”

“ফাটাফাটি স্মৃতি!” গজা হাসে।

বিশু রেগে গেল। “টেনশনে সব ভুলে যাচ্ছি। গজা, তুই তো স্মৃতি বানানটাও ভুল লিখবি, আমাকে নিয়ে মজা করছিস যে!”

গজা দাঁত বের করে হাসে। “লেখাপড়ায় আমি জিরো। আমার বাবাকেই করি। বাবা আবার বাস চালাতে চালাতে কখনো ফোন ধরে না। কিন্তু কে ফোন করতে দেবে?”

আধঘণ্টা একে ওকে অনুরোধ করেও লাভ হল না। কেউ কেউ বলল, নিজের ফোন থেকে অন্যকে ফোন করতে দেওয়া ঠিক নয়। ঝামেলা হতে পারে।

বিশু গরগর করে, “বুঝলি ঋভু, দেশে উপকারী লোক আর নেই।”

একজন মোবাইল দিতে রাজি হলেন। গজা নম্বর বলল, ঋভু ফোন করল। হতাশ হয়ে তাকাল ঋভু, “সুইচড অফ বলছে।”

“তোর মাকে ফোন কর।” বিশু বলল।

মোবাইল ফোন ফেরত দিয়ে ঋভু বলল, “মা অ্যাদ্দুর কীভাবে আসবে একা?”

“কাউকে নিয়ে আসবে। আমার বাবাও আসতে পারে। বাবার ডিউটি সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় শেষ হয়ে যায়।” গজা বলে।

ঋভু হাত নেড়ে বলে, “তার চেয়ে চল থানায় চলে যাই। মারধোর করবে না, আটকে রাখবে। ওখান থেকেই কাকুকে জানাবে।”

বিশু মুখ কুঁচকে বলে, “থানা? তার চেয়ে না খেয়ে রাতে স্টেশনে থাকব। তোরা যা। আমি মরে গেলেও যাচ্ছি না।”

অনেকক্ষণ কথা বলে ঠিক হল, সন্ধ্যায় গজা তার বাবাকে ফোনে জানাবে। ততক্ষণে একটা ফোনবুথের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। কোনো উপায় না দেখলে আগামীকাল সকালে তারা থানায় চলে যাবে। এই অবস্থায় কাটানোর চেয়ে যে-কোনোভাবে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।
একটি পুকুরে স্নান করল তিনজনে, গামছা মেলে দিল গাছের ডালে। হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায়, এখানেই বিশ্রাম করা ভালো। কোথায় আর যাবে?
গজা মুখ চুন করে। “খুব খিদে পাচ্ছে।”
বিশু ঘাড় নাড়ে। “আমারও পাচ্ছে।”
ঋভু মাথা নীচু করে। “আমার জন্যই এই হাল। খিদে আমারও প্রচণ্ড পাচ্ছে।”
গজা অস্থির হল। “স্টেশনের কাছেই চলো। যদি কিছু উপায় পাই!”
“উপায়?”
“ভিক্ষে করব। খাবারের জন্য ভিক্ষা করায় লজ্জা নেই।”
ঋভু গম্ভীর হল। “একবেলার খিদেয় তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল!”
গজার জেদ চেপে গেছে। খাবার জোগাড় করতেই হবে। শুধু তার জন্য নয়, বাকি দুজনের জন্যও কিছু করতে হবে। টিনের ছাউনি দেওয়া একটি দোকানের সামনে দাঁড়াল সে। বয়ামে বিস্কুট আছে, তেলেভাজা রাখা আছে টিনের থালায়। হাঁড়িতে ঘুগনি, নেতিয়ে যাওয়া লুচিও রয়েছে সামনে, ডিমসেদ্ধও রয়েছে। গজা জুলজুল চোখে তাকিয়ে বলে, “সারাদিন কিছু খাইনি। কিছু দাও কাকু।”

“যা ভাগ।”
মরিয়া হয়ে গজা বলে, “কাজ করে দেব। কাজ করে দিলে খেতে দেবে?”

দোকানদার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “তাহলে আয়। কাজের ছেলেটা ডুব মেরেছে। আমার শরীরটা ভালো নেই।”

দোকানের পেছনে রাজ্যের আগাছা, পাথর রাখা আছে একটা। পাশে ডাঁই করা আছে কেটলি, হাঁড়ি, ডেকচি, প্রচুর স্টিলের প্লেট। সেগুলো দেখিয়ে বলল, “মেজে দে এগুলো।”

গজা চুপ করে আছে দেখে দোকানদার বলল, “কী হল? পারবি না?”

“পারব। আমার দুই বন্ধু দোকানের বাইরে আছে। ওদেরকেও খেতে দিতে হবে কিন্তু।”

মশার কামড় খেয়ে গজা বাসনপত্র মাজতে শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ বাদে এসে ঋভু আর বিশুও হাত লাগাল। মিনিট দশের মধ্যে কাজ হয়ে গেল।

হাত ধুয়ে গজা বলল, “দাও এবার। সব চকচকে করে ফেলেছি।”

শালপাতায় মুড়ে ছ’খানা চপ আর একটি স্টিলের প্লেটে ছ’খানা লুচি টেবিলে নামিয়ে রাখতেই তিনজনে গোগ্রাসে শেষ করে ফেলল।

ঋভু বলল, “ঠান্ডা চপ।”
“হাঁড়ির তলানির ঘুগনি। শুধু জল।” গজা শ্বাস নিল।
“লুচিগুলো শুকিয়ে কাঠ একেবারে।” বিশু বলে।
“জুটেছে, এই অনেক। কিন্তু রাতে কী হবে?”

ওরা বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ। টোটোতে বসে একজন পেপার পড়ছেন আর তাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছেন।

বিশু বলে, “দোকানে ঢোকার সময় থেকেই লোকটা আমাদের দেখছে।”
ঋভু বলে, “হ্যাঁ। আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল আর হাতে রাখা পেপারটা দেখছিল বার বার।”
গজা ভয় পেয়ে বলল, “লোকটা আমাদের দিকেই আসছে। ছুটে পালাব?”
বিশু নারাজ। “এই পা নিয়ে ছুটতে পারব না। ওই তো খাবার জুটল। এনার্জি নেই।”
লোকটি কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, “কোথায় যাবি তোরা?”
“কোথাও না।”
“বাড়ি কোথায় তোদের?”
ঋভু উত্তর দিল, “ছাতনা।”
“এখানে কোথায় এসেছিস?”
“বন্ধুর বাড়ি এসেছিলাম।”
“বন্ধুর বাড়ি কোথায়?”
ঋভু বলল, “কাছেই।”
“যেখানে তোদের বন্ধুর বাড়ি সেই জায়গার নাম কী?”

ঋভু চুপ করে থাকে। লোকটি মৃদু ধমক দিলেন, “মিথ্যে বলছিস! এইটুকু সব ছেলে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে ঘুরছিস, রবির দোকানে বাসন মাজছিস, কিছু আমি বুঝি না? ঘর থেকে পালিয়ে এসেছিস?”

তিনজনের মুখে কোনো কথা ফুটল না।

“রাকেশ মণ্ডলের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়, বুঝলি? তা পেট ভরে খাওয়া হল?”

“না,” গজা বলে ফেলে, “চিমড়ে লুচি আর চপ। খাটিয়ে নিয়ে ভালো করে খেতেও দিল না। তোমার কোনো কাজ করে দিতে হবে? শুধু পেট ভরে খেতে দিতে হবে।”

রাকেশ বলেন, “কোনো কাজ করতে হবে না তোদের। আমার বাড়িতে চল। পেট ভরে খাওয়াব। আমার ছেলের বয়স তোর মতোই হবে। দেখে মনে হল তোরা বিপদে পড়েছিস। কিন্তু সত্যি কথাটা বলতে হবে। বাড়ি কোথায় তোদের?”

ঋভু ইশারায় মানা করলেও বিশু সত্যিই বলল, “দিঘার কাছে।”
“বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস কেন? বকাবকি করেছিল?”
“না।”
“তাহলে?”
“পালাইনি। ঘুরতে বেরিয়েছি তিনজনে।” ঋভু অস্থির হল, “এত জানতে চাইছ কেন?”

রাকেশ হাসেন। “তিনজনে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, কখন ফাঁদে পড়ে যাবি বুঝতেই পারবি না। ধরে নিয়ে গিয়ে পাচার করে দেবে।”

“তুমি ফাঁদে ফেলছ না তো?”
রাকেশ থমকে যান। “ছেলের বুদ্ধি আছে। নাম কী তোর? বানিয়ে নাম বলবি না।”
“ঋভু।”
“স্কুলে পড়িস?”
“হ্যাঁ।”
“কোন ক্লাস?”
“এইট।”
রাকেশ বললেন, “আমার ছেলেও এইটে পড়ে। বেশি কথায় কাজ নেই। তোরা বাড়িতে গেলে রান্না বসবে, তারপর খাওয়া। টোটোতে উঠে পড়।”

ঋভু মাথা নেড়ে বলে, “তার আগে একটা ফোন করতে দিতে হবে।”
“কোথায় করবি?”
গজাকে দেখিয়ে ঋভু বলল, “ওর বাবাকে।”

রাকেশ কঠিন গলায় বলেন, “ফোনটা আমিও করতে পারি থানায়। ধরে নিয়ে যাবে। চুপচাপ টোটোয় চেপে আমার বাড়িতে চল। পালানোর চেষ্টা করবি না।”

টোটোয় কিছুটা পথ যাবার পরে ঋভু জানতে চায়, “কীভাবে জানলে যে আমরা ঘর থেকে চলে এসেছি?”
রাকেশ হেঁয়ালি করেন, “মিলিয়ে নিয়ে বুঝলাম। তা পকেটে টাকা নেই, এদিকে ঘুরতে বেরিয়েছিস!”
বিশু বলল, “টাকা ব্যাগে ছিল। চুরি হয়ে গেছে।”

গড়গড় করে ব্যাগ চুরির গল্প বলতে শুরু করে দিল বিশু। ঋভু হতাশ ভঙ্গিতে বসে থাকে। এই দুটো সব বলে দিচ্ছে যে!

দু-কামরার পাকাবাড়ি, টালির চাল, একফালি উঠোন, সামনে টিউবওয়েল আছে। হাতমুখ ধোয়ার পরে ওদের একটি রুমে নিয়ে গিয়ে বসালেন রাকেশ।

“রাজু দেখ, কাদের নিয়ে এসেছি!” রাকেশ তক্তপোশে শুয়ে থাকা একটি ছেলেকে ডাকলেন, “এই তিনজন আমাদের গেস্ট। আজ এখানেই থাকবে, খাবে-দাবে।”

মাথায় অল্প চুল ছেলেটির, ভীষণ রোগা, চোখদুটো কেমন নিষ্প্রভ। ছেলেটির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ওরা।

রাকেশ বললেন, “আমার ছেলে অনির্বাণ। ডাকনাম রাজু। তোমরা ওর সঙ্গে গল্প করো, রাজুর ভালো লাগবে।”

রাজু উঠে বসল। “কোথায় থাকো তোমরা?”
“দিঘা।”
“কী ভালো গো তোমাদের! আমি দিঘায় একবার গিয়েছিলাম। দারুণ লেগেছিল।”
“কখন?”
“ক্লাস ফাইভে পড়তাম তখন। সমুদ্রে খুব স্নান করেছিলাম।” রাজু বলে, “আবার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
গজা বলে, “আমাদের সঙ্গে চলো। আমার বাড়িতে থাকবে।”
“এখন যাওয়া হবে না। অপারেশন করতে হবে।”
“অপারেশন?” ঋভু চমকে ওঠে, “কেন?”
“বাবা জানে। আমাকে সব বলেনি। একমাস হল স্কুলে যাইনি। খুব দুর্বল লাগে, মাথা-যন্তন্না হয়, বমি পেত আগে।” রাজু ক্লান্তভাবে হাসে, “দিঘার গল্প বলো, স্কুলের গল্প বলো।”

গল্প জমে গেল। ঋভু মাছধরা নৌকো, মধুকাকা, টাকা জমানোর কথা বলে। বিশু খেলার গল্প করে, গজা অবশ্য দিঘায় কী কী ভালো খাবার পাওয়া যায় তার গল্পই বেশি করে।

রাকেশ উঁকি মেরে ডাকেন, “বাহ্‌, ধুম গল্প হচ্ছে দেখছি। একঘণ্টার ওপর হয়ে গেল। রান্না হয়ে গেছে, খেয়ে নিবি চল।”

গজা বলে, “রাজু?”

“ও বারোটার মধ্যে খেয়ে নেয়। এখন সাড়ে তিনটা বাজে।” রাকেশ বলেন, “এসে আবার গল্প করবি।”

টানা বারান্দায় আসনে বসে তাকাল ওরা। থালায় ধোঁয়া ওঠা ভাত, শাক ভাজা, বড়ি ভাজা, বাটিতে মুসুর ডাল, আর প্লেটে ডিম ভাজা।

রাকেশ হাসেন, “এত বেলায় এর বেশি কিছু করা গেল না। ও-বেলা হবে। তোদের কাকিমা তাড়াহুড়ো করে রাঁধল। চেয়ে নিবি, লজ্জা করবি না।”

বিশু প্রশ্ন করে, “রাজুর কী অপারেশন হবে?”
রাকেশের ঠোঁট কেঁপে গেল উত্তর দিতে গিয়ে, “ব্রেন টিউমার।”
ওরা তিনজনই চমকে ওঠে। কথা জিভে আটকে যায়। চুপচাপ ভাতের গ্রাস তোলে মুখে।
তিনজনের যখন ঘুম ভাঙল, সন্ধে হয়ে গিয়েছে। গজা মুখ গোমড়া করে বলে, “বাবার জন্য মনখারাপ লাগছে।”
বিশু হাই তোলে। “আমারও মনখারাপ করছে। বাইরে ঘুরছিলাম, নতুন জায়গা দেখছিলাম, মজা লাগছিল। এক জায়গায় বসে আর ভালো লাগছে না।”

ঋভু স্বপ্নে একটি নৌকোয় চেপে মাঝ-সমুদ্রে পৌঁছেছিল, সঙ্গে ছিল মধুকাকা। একটা ডলফিন তাদের নৌকোর খুব কাছে ভেসে উঠেছিল। তারও মনখারাপ করছে এখন।

গজা বলল, “বাবাকে ফোন করতে হবে, ভুলে যাচ্ছ ঋভুদা?”
“কাকুর কাছ থেকে মোবাইলটা চাইব এবার।” ঋভু বলল, “রাজুর অসুখের খবর শোনার পর থেকে আরো খারাপ লাগছে।”
রাজু বিষণ্ণ হাসিতে বলল, “মনখারাপ কেন হবে? আমার একটা টিউমার হয়েছে। ভালো হয়ে যাবে। বাবা টোটো নিয়ে বেরিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে।”
বিরস মুখে ওরা বসে থাকল।

একটু পরে রাজু ঘরে এসে প্লেট বাড়িয়ে দিল, “নাও। মা ভেজ পকোড়া বানিয়েছে তোমাদের জন্য। তোমরা বাড়িতে না বলে বেরিয়েছ কেন? খুব খারাপ। বাবা-মার বুঝি মনখারাপ হয় না?”

টিভি চালিয়ে দিল রাজু। “ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওয়ান ডে হচ্ছে। আমি ক্রিকেট খুব পছন্দ করি। তোমরা দেখবে?”

এক বিছানায় চারজন বসে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে লাগল।
গজা অস্থির হল। “বাবাকে ফোন করব যে! রাজু, তোর মায়ের ফোন নেই?”
“আছে।”
“নিয়ে আসবি? খুব দরকার।”
রাজু কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলে, “মা বলল ফোনে পয়সা নেই। ফোন করা যাবে না।”

ঘড়িতে আটটা বাজে। রাকেশ ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলেন। “তোদের জন্য বড়ো সাইজের কাতলা কিনে আনলাম। দেখি, কত খেতে পারিস!”
বিশু বলে, “কাকু, বাবাকে ফোন করব একবার।”
রাকেশ হেসে বলেন, “ফোনে যে একদম চার্জ নেই। আচ্ছা, ঘণ্টা খানেক পরে দিচ্ছি।”
খেলার মাঝে বিজ্ঞাপন চলছে। ঋভু বাইরে বেরিয়ে এল, বাথরুম যাবে সে। কানে চাপা গলায় কিছু কথা ভেসে আসতেই সে কান পেতে দাঁড়াল।
“কী হল? এবার ফোন করো!” রাজুর মায়ের গলা।
“করব। একটু ভাবি।” রাকেশের গলা।
“কখন করবে? এতগুলো টাকা পাবার সুযোগ হাতছাড়া করবে? ভাবার কী আছে শুনি? আমার রাজুর চিকিৎসার টাকা কিছুটা জোগাড় হবে।”
“কাল সকালে করব। থাকুক আজকের রাতটা। ভালো লাগছে।” রাকেশ বলছেন।
“তোমার কী হল বলো তো? টাকা পাবে বলে ছেলেগুলোকে ঘরে নিয়ে এলে। টাকার টানাটানি, এতসব কিনে নিয়ে এলে, খাওয়াবে ওদের। পাখি উড়ে যেতে কতক্ষণ? ওরা মোটেই বোকা হাঁদা নয়। ওদের হাতে তুলে দাও এবার।”

ঋভু ফিরে এসে শ্বাস নিল। কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। টাকা, ধরিয়ে দেওয়া, এসব আবার কী? তাহলে কি ভুলিয়ে-ভালিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে তাদের পাচার করে দেবার মতলব আছে? আচ্ছা! তাই কিছুতেই মোবাইল দিচ্ছে না তাদের! ফোন করার সুযোগ দিতে চায় না আসলে।

রাজু ঘুমিয়ে পড়েছে। বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না বলছিল। এই সুযোগ। সে ফিসফিস করে বোঝাল, “পালিয়ে যাব। রেডি হয়ে নে। ব্যাগে চটপট জামাপ্যান্ট ভরে নে।”

“এখন?”
“যখন সুযোগ পাব।”

গজা অনিচ্ছা দেখাল। “বড়ো কাতলা মাছ এনেছে। চাটনি, পাঁপড় কত কিছু হবে। বেশ খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। কী ঝামেলা! পালিয়ে গেলে উপোস করে কাটাতে হবে।”

বিশু কিড়মিড় করে, “তুই থাক। আচ্ছা করে তিন-চার পিস মাছ খাবি।”
গজা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ঋভুদা, তুমি মনে হচ্ছে ভুল করছ।”
মিনিট দশেক বাদে লোডশেডিং হতেই বিশু ফিসফিস করল, “এই সুযোগ।”
ঋভু বলে, “হ্যাঁ, ঘরের বাইরে বেরিয়েই আমরা দৌড় মারব।”
পা টিপে টিপে তারা বারান্দায় এসে দরজা দেখতে পেল। বাহ্‌, দরজা খোলাই আছে। বাইরে পা রাখা মাত্রই কানে ভেসে এল, “পালিয়ে যাচ্ছিস তোরা?”
একহাত তফাতে রাকেশকাকু দাঁড়িয়ে আছে। কেউ আর এক পা নড়তে পারল না।
রাকেশ স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলেন, “আমার এখানে কী অসুবিধা হচ্ছে?”
তাদের নিশ্চুপ দেখে রাকেশ মৃদু স্বরে বলেন, “কাল সকালে যাবি। তোদের আটকাব না। এখন রাতে তোদের ছেড়ে দিতে পারি না। ঘরে চল।”

যন্ত্রের মতো তারা রাকেশের নির্দেশ মেনে ঘরে ঢোকে। এটা অন্য রুম, আকারে ছোটো। তাদের রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিলেন রাকেশ। খোলা জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন রাকেশ। “অচেনা লোককে সন্দেহ করা খারাপ নয়। তবে কে কেমন তোদের সেটা বোঝার মতো জ্ঞান আদৌ হয়েছে? এখানেই থাক। রাতের খাওয়া দিব্যি পাবি। এত কষ্ট করে কিনে এনেছি, রান্না হচ্ছে, খেতেই হবে তোদের। কিন্তু পালানোর চিন্তা করিস না।”

তিনজনেই মুষড়ে পড়ল। হতভম্ব দেখাল বিশুকে। “কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। যেমন সিনেমায় দেখায়, কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ, তেমন ব্যাপার মনে হচ্ছে।”

ঋভু শুকনো গলায় বলে, “মাথায় কিছু ঢুকছে না।”
গজা গজগজ করে, “এরপর আর ভালো করে খেতে দেবে? জেলের বন্দিদের ভালোমন্দ খাওয়ায়?”
একটুক্ষণ বাদে খোলা জানালা দিয়ে রাকেশকে দেখতে পেয়ে বিশু ফোঁস ফোঁস করে, “তুমি  আমাদের কিডন্যাপ করেছ?”
রাকেশ রাগে চেঁচিয়ে ওঠেন, “কী বললি? কিডন্যাপ? আমি কি ক্রিমিনাল? তাই মনে হল তোদের? আসছি দাঁড়া।”
গজা বলল, “এইবার আমাদের ধোলাই দেবে মনে হচ্ছে।”

রাকেশ রুমে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। হাতে থাকা পেপারটা বিছানার ওপর ছুড়ে দিয়ে উঁচু গলায় বললেন, “দেখে নে এবার। দু-নম্বর পাতায় বড়ো করে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। তোদের ছবি আছে। সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেবে।”

বিজ্ঞাপনটা দেখার পরে তিনজনে অবাক হয়ে গেল। তাদের খোঁজে পেপারে ছবি সহ বিজ্ঞাপন! গজা দেখে নাক কোঁচকায়, “ছ্যা, এটা আমি? দেখে মনে হচ্ছে মেনি বেড়াল। বিশুদাকে আস্ত মেছোভূত দেখাচ্ছে।”

বিশু বলে, “এতক্ষণে মনে পড়েছে দেখে। বাবার মোবাইল ফোনের নম্বর এটা।”

রাকেশ ধীর গলায় বলেন, “চাইলে অনেক আগেই ফোনটা করতে পারতাম, বুঝলি? কেন করিনি কে জানে। মনে হল তোরা আমার গেস্ট। অতিথি বলেই ভেবেছি। সামান্য টাকার জন্য এমন করব? তবু তোদের রেখেছি, সকাল হলেই পুরুলিয়া থানার সামনে টোটোতে ছেড়ে চলে আসব। আমার ছেলের বয়সী তোরা। তোদের বিপদ বা খারাপ কিছু ঘটতে দেওয়া যাবে না।”

ওরা তিনজন মুখ নীচু করে বসে রইল।

রাকেশ ধরা গলায় বলেন, “টাকার খুব দরকার, অনেক খরচ হয়েছে। রাজুর অপারেশনে বেশ খরচ আছে। দক্ষিণ ভারতের হাসপাতালে অপারেশন হবে। একুশ দিন পরে ডেট আছে অপারেশনের। টোটো চালিয়ে দিব্যি চলে যায়, কিন্তু এত চিকিৎসার খরচ পাব কোথায়? ধার-দেনা করছি, চারদিকে ছুটছি। বিজ্ঞাপনটা দেখে লোভ হয়েছিল প্রথমে। এখন আর লোভ করব না।”

কয়েক মুহূর্ত থেমে রাকেশ তাকালেন ঋভুর দিকে। “তুই নাকি সাগরে ঝড় ওঠা, মাছ পাওয়া সব আগেভাগে বলে দিতিস! রাজু বলছিল তোর গল্প। একটিবার শুধু বলে যা, আমার রাজু ভালো হয়ে যাবে তো অপারেশন করালে? বাঁচবে তো?”

ঋভুর চোখ ভিজে এল। “আর ওসব বলব না কাকু। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি। আমার মন বলছে রাজু ঠিক হয়ে যাবে, ভালো হয়ে উঠবে।”

রাকেশের মুখে হাসির আলো ছড়িয়ে পড়ে। “তাই যেন হয়। দরজা খুলে দিলাম। রাজুর কাছে, রাজুর বিছানায় গিয়ে বোস।”

রাকেশ বারান্দায় হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন, ঋভু পেছন থেকে ডাকে, “কাকু, কথা ছিল।”

রাকেশ ঘাড় ঘোরালেন। “বল।”

আমতা আমতা করে ঋভু, “কাকু, বলছিলাম কী, আমাদের বাড়ি ফিরে যেতেই হবে। ঘোরা আর হবে না। টাকা নেই। বিশুর বাবা পুলিশ ইনস্পেক্টর, ওঁকেই ফোন করে বলতে চেয়েছিলাম। বিশু নম্বর ভুলে গেছিল। আপনি একবার জানিয়ে দেবেন?”

রাকেশ বললেন, “দিচ্ছি। তোদের সেফটির জন্যই জানাচ্ছি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে, বাবা-মায়ের কাছে এর চেয়ে বড়ো আনন্দ আর কিছুই হতে পারে না।”

ওরা তিনজনে রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাজুর সঙ্গে গল্প করছিল।

রাত দশটায় বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। দরজায় টোকা দিতেই রাকেশ খুলে দিলেন, “আসুন।”

ঋভু দেখল, চারজন পুলিশ বারান্দায় ঢুকল, আর পেছনে অবনীশকাকু। বিশু ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। অবনীশ রাকেশের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “সবই বলেছেন আপনি। বুদ্ধি করে এখানে না নিয়ে এলে খারাপ কিছু হতে পারত।”

রাকেশ হাসেন। “ওরা আমাকেই খারাপ ভেবেছিল।”

“হুম, তিনটে শয়তান এই ক’দিন খুব ছুটিয়েছে আমাদের। বেশি সাহস ভালো নয়। এই তো মিস্টার পাত্র, পুরুলিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার, মাস ছয়েক আগে এক শিশু পাচারকারী দলের পান্ডাকে ধরেছিলেন। বিপদ চারদিকে। তাই না, মিস্টার পাত্র?” পাত্রবাবু হাসেন। “হ্যাঁ, পুরো দলটাই জালে ধরা পড়েছিল শেষে।”

অবিনাশ এগিয়ে গেলেন বিশুর দিকে। ভয়ে মুখ নামিয়ে কাঁপতে শুরু করেছে সে। অবিনাশ কড়া চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন বিশুকে। বললেন, “দেখি, তোর পায়ের বুড়ো আঙুল দেখি।”

“কিছু হয়নি। ঠিক হয়ে গেছে।” বিশু লজ্জা পাচ্ছিল।

অবনীশ প্রচ্ছন্ন ধমকের স্বরে বলেন, “বাইরে বেড়ানোর শখ যদি ছিল, আমাকে বলতে পারতি! আমি কি বাঘ-ভালুক?”

বিশু আলতো হাসে। “তিনজন একসঙ্গে ঘোরা হত না।”

গজা হাসে। “বিশুদার খুব অ্যাডভেঞ্চারের শখ যে!”

আবার একপ্রস্থ ধন্যবাদ জানিয়ে তিনজনকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবেন, এমন সময় বিশু থেমে গেল। “বাবা, তুমি কিছু ভুলে যাচ্ছ।”

“কী ভুলছি বল তো?” অবনীশ অবাক হলেন।

বিশু ইতস্তত করছে দেখে ঋভু বলেই ফেলল, “কাকু, আপনি পুরস্কার দেবেন বলেছিলেন। পেপারে যে লেখা ছিল!”

রাকেশ হাতজোড় করে বললেন, “ও-টাকা আমি নিতে পারব না।”

অবনীশ বললেন, “তা হতে পারে না। রাজুর ট্রিটমেন্টের অনেক খরচ। আপনি রেখে দিন।”

রাকেশ ঠোঁট চেপে বলেন, “প্লিজ, এভাবে বলবেন না। আপনাদের শুভেচ্ছায় রাজু ভালো হলেই আমার সব পাওয়া।”

অবনীশ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “বেশ। তাই হোক। আপনার নম্বরটি আমার মোবাইলে সেভ করা থাকল। যে-কোনো প্রয়োজনে আমাকে মনে হলে কল করবেন। সাহায্য করতে পারলে খুশি হব।”

গজা বলল, “বাবার ফোন থেকে আমি মাঝে-সাঝে ফোন করে জানব।”

ঋভু বলল, “রাজু সুস্থ হলেই আমরা তিনজনে এসে ওকে নিয়ে যাব। দিঘায় একসঙ্গে ঘুরব, আমাদের কাছে থাকবে কিছুদিন। ওর খুব ইচ্ছে নৌকোয় চেপে সমুদ্রে যাবে। মধুকাকাকে  আমি বললেই নিয়ে যাবে।”

বিশু আর গজা জড়িয়ে ধরল রাজুকে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল। ওরা তিনজনে মুখ বাড়িয়ে হাত নাড়ল রাজুর উদ্দেশে। রাজুও একটানা হাত নেড়ে চলেছিল।
গাড়িতে বসে ঋভু প্রার্থনা করে অস্ফুটে, “সাগর দেবতা, রাজুর এই ইচ্ছে যেন পূরণ হয় একদিন। সেই সুযোগ দিও।”
গজা অবাক গলায় জানতে চায়, “বিড়বিড় করে কী বলছ, ঋভুদা?”
“কিছু না।”
অবনীশ বললেন, “বড়োদিনের সময় তিনজনকে অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে নিয়ে আসব।”
বিশু অবিশ্বাসে তাকাল। “সত্যি?”
“প্রমিস করছি সবার সামনে। আর কিছু বলবি?”
বিশু হাসল। তখনই ফোন এল।
“হ্যালো।”
“কার্তিক হালদার বলছি স্যার। ওদের কিছু খবর পেলেন?”
“ধরে হাতকড়া পরিয়ে লক-আপে নিয়ে যাচ্ছি।”
“কোথায়? মানে কোন থানায় নিয়ে যাচ্ছেন স্যার?”
অবনীশ প্রশ্ন করেন, “এত জানতে চাইছ কেন বলো তো?”
“ওই কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটাকে ঘা কতক দিলে মনের জ্বালা মিটত।”
অবনীশ গলা গম্ভীর করে বললেন, “তাহলে তোমাকে দিঘায় আসতে হবে যে! ওদের নিয়ে ওখানেই যাচ্ছি।”
“আচ্ছা, রাখছি স্যার।” কার্তিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
ওরা তিনজনে জেগে থেকেই স্বপ্নে বিভোর ছিল। দেখছিল সাগর থেকে পাহাড়ের দিকে এক আনন্দ অভিযানে আবার ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে তারা।

অলঙ্করণ- শিমূল

জয়ঢাকের গল্পঘর

1 thought on “উপন্যাস -তিন পলাতক-সুমন মহান্তি-বসন্ত ২০২১

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s