জয়দীপ চক্রবর্তীর আগের লেখাঃ নিবারণ চক্কোত্তির হাতঘড়ি, গোলমেলে গন্ধ, আলোর কাছে ফেরা, পরিদাদুর সঙ্গে বহরমপুরে
এক
সুছন্দা এককথায় বলে দিলেন, “না না, এখনও ঘুরে বেড়ানোর মতো পরিস্থিতিতে মোটেই পৌঁছইনি আমরা। সংক্রমণ খানিক কমেছে ঠিকই, কিন্তু সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ যে অবশ্যম্ভাবী, সে-কথাও তো পই পই করে বলছেন বিজ্ঞানীরা।”
“তোমার কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, এ-কথা হাজার বার মানছি। কিন্তু এইভাবে ঘরে বসে কতদিনই-বা কাটানো যায় বলো!” অরুণাংশু দু-দিকে মাথা নাড়তে থাকেন প্রবল বেগে, “গত মাস খানেক ইনফেকশন রেট নেগলিজিবল স্মল। তাছাড়া ফেসবুক খুললেই এ, ও, সে, পাহাড়, সমুদ্রে বেড়াতে যাওয়ার ছবি সাঁটছে দেখতে পাচ্ছি। কাঁহাতক সহ্য করা যায় এইভাবে?”
অরুণাংশু এমনভাবে কথাটা বললেন যে পরিদাদু হেসে উঠলেন হো হো করে।
পরিদাদুকে হাসতে দেখে অরুণাংশু যেন আরও উৎসাহ পেলেন। তাঁর দিকে চেয়ে বলেন, “আচ্ছা পরি, তুমিই বলো, এই কি একটা জীবন? তাছাড়া শানুটার শাস্তির কথা ভাবো একবার! বছর ঘুরে গেল। ইশকুল নেই, পাঠশাল নেই। খেলার মাঠ খাঁ খাঁ করছে। সারা দিন রাত্তির হাঁ করে বসে আছে ল্যাপটপের সামনে। ভার্চুয়াল ক্লাস, ক্লাসের পরে অনলাইন স্টাডি মেটেরিয়াল, এগজাম…”
“ঠিক।” মাথা নাড়লেন পরিদাদু, “শানুটার জন্যে এক-দুটো দিনের জন্যে অন্তত একটু ঘুরে-টুরে আসতে পারলে সত্যিই ভালো হত। এমন চললে ছেলেটা ক’দিন পরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বে।”
“তোমার বন্ধুর না-হয় মাথায় ছিট আছে, তাই বলে তুমিও ওর হুজুগে সায় দিচ্ছ পরিকাকু?” সুছন্দা রাগ রাগ গলায় বলে উঠলেন পরিদাদু আর অরুণাংশুর সামনে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে।
“দেখ খুকু, তোর কথা যেমন একশো ভাগ সত্যি, আবার অরুণাংশুর কথাটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়।”
“মানে?”
“দীর্ঘদিন চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকতে থাকতে ছোটোদের মানসিক অবসাদ আসছে, এটা পরীক্ষিত সত্য। বড়োরা তবু লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অফিস-কাছারি-বাজার-হাট যাচ্ছে। কিন্তু শানুর মতো যারা, ওদের এখনও স্কুল বন্ধ। একবার ভেবেছিস ওদের মনের অবস্থাটা? মনে রাখিস, স্কুল শুধুমাত্র পড়াশোনার জায়গাই নয়, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে স্কুল দম ফেলে বাঁচবারও জায়গা। স্কুলই ওদের ধীরে ধীরে সামাজিক করে তোলে। তাছাড়া পারস্পরিক মত বিনিময়ের এমন সুযোগ আর কোথায় পায় ওরা বল? বাড়িতে এমন করে মুখ বুজে ল্যাপটপ, মোবাইলে ডুবে থেকে ওদের মনের সঠিক বিকাশ কি সম্ভব?”
“তাহলে? কী উপায় তুমিই বলো। অরুণের কথা শুনে এখন কি ট্রেনের রিজার্ভেশন করতে ছুটব সবাই মিলে?”
“মোটেই নয়। এ-বিষয়ে আমি তোর মতকেই সমর্থন করছি। দূরে বেড়াতে যাওয়ার সময় এখনও আসেনি।”
“কাছাকাছির মধ্যে কোথায় যাবে বলছ? শান্তিনেকেতন? তারাপীঠ?” অরুণাংশু বলে উঠলেন।
“উঁহু।”
“তাহলে কি পুরুলিয়া, অযোধ্যা পাহাড়? নাকি গড়বেতা?”
“কোথাও নয়। দল বেঁধে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অ্যাভেল করার পক্ষপাতি আমি আপাতত নই।”
“কী হেঁয়ালি শুরু করলে বলো দেখি?” অরুণাংশু চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বলেন, “এ যেন সুকুমারের সেই ছড়ার মতো—খাচ্চি, কিন্তু গিলচি না… বেড়াতে যাব, কিন্তু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অ্যাভেল করব না।”
“একটা গাড়ি ভাড়া করে একদিন চিড়িয়াখানা বা বোটানিক্যাল গার্ডেন যাওয়া যায়।” এতক্ষণ চুপ করে শোনার পর এইবার কথা বলে উঠল শাওন।
“তা যাওয়া যায়,” অরুণাংশু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেন, “কিন্তু দুটো জায়গাই তো তোর আগে ঘুরে আসা। আবার গিয়ে ভালো লাগবে?”
“আমি বলি কী, একদিনে ভিড়-ভাড়াক্কার মধ্যে টো টো করে ঘুরে আসা নয়। হাতে দুটো তিনটে দিন নিয়েই ঘুরে আসি বরং। ফাঁকায় ফাঁকায়। লোকজনের ভিড় এড়িয়ে। রোগের ভয় থাকল না, আবার দু-দিনের একটা ছোট্ট টুরও হয়ে গেল।” পরিদাদু চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা ডিশের ওপরে নামিয়ে দিয়ে বললেন।
“কোথায়?” অরুণাংশু, সুছন্দা দুজনেই বলে উঠলেন একসঙ্গে।
“ক্যানিং, গোসাবা।”
“ধ্যাত, ক্যানিং একটা বেড়াতে যাওয়ার মতো জায়গা হল?” সুছন্দা চোখ কুঁচকে বললেন, “মাছের ভেড়ি ছাড়া আর কী আছে সেখানে? তবু যদি বলতে সুন্দরবন তাহলে বুঝতাম।”
“এই মুহূর্তে তো দল বেঁধে সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর কথা ভাবছিলাম।” পরিদাদু গম্ভীর মুখে বললেন, “ক্যানিং গেছিস আগে?”
“একবার গিয়েছিলাম বোধ হয়।” অরুণাংশু মাথা চুলকে বললেন, “আমার এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে।”
“পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির কুঠিবাড়ি দেখা হয়েছে?”
“সে আবার কী?” চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলেন অরুণাংশু।
পরিদাদু লম্বা করে শ্বাস ছাড়লেন, “কত টাকা খরচ করে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস খুঁজতে যাই আমরা, অথচ ঘরের পাশের যে ইতিহাস, সে-সম্পর্কে না আছে আমাদের সচেতনতা, না আছে সে-ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনবোধ। তা যদি থাকত তাহলে নীলকুঠি আর গোলকুঠি এমন অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যেত না।”
“সেগুলোও ওই ক্যানিংয়েই ছিল বুঝি?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ। পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট রিক্ল্যামেশন অ্যান্ড ডক কোম্পানি তিনটি কুঠি তৈরি করেছিল ওই অঞ্চলে। তার মধ্যে পড়ি পড়ি করেও ওই একখানিই দাঁড়িয়ে আছে এখনও পর্যন্ত। ক’দিন থাকবে তা অবিশ্যি বলতে পারি না। আমার বন্ধু অসিত রায় অনেকদিন থেকেই একবার যেতে বলছে ওখানে। গত পরশুও ফোন করে বলছিল খুব দ্রুত একবার তার কাছে যাওয়ার জন্যে। যাবও হয়তো আমি দু-একদিনের মধ্যে। তাই ভাবছিলাম, রাজি থাকলে তোমাদেরও আমার সঙ্গী করে নিই।”
“অসিতবাবু ক্যানিংয়েই থাকেন বুঝি?”
“হ্যাঁ। মিঠেখালিতে। যে জীর্ণ কুঠিবাড়িটা পড়ি পড়ি করেও দেড়শো বছর অতিক্রম করেও কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে এখনও, অসিতের বাড়িটা সে কুঠির কাছেই।”
“আরিব্বাস, সে তো দারুণ ব্যাপার হবে তাহলে!” অরুণাংশু বলে উঠলেন।
“মিঠেখালি নামটাও কী মিষ্টি, বলো!” সুছন্দা বললেন।
“ওদিকের জায়গাগুলোর অমনই নাম। নামের শেষে একটা করে খালি জুড়ে দেওয়া। নদীনালা, খালবিলের দেশ তো! তাই বোধ হয় অমন নাম। ঝড়খালি, সজনেখালি, মিঠেখালি…” অরুণাংশু বললেন শাওনের দিকে চেয়ে।
“তাহলে আমার সঙ্গে তোমাদের যাওয়ার ব্যাপারটা পাক্কা তো?”
“নিশ্চয়ই।”
“অসিত আমার অনেকদিনের বন্ধু। ভারি সজ্জন মানুষ। আশা করি তার আতিথ্য তোমাদের খুব একটা খারাপ লাগবে না।”
“কী যে বলো পরিকাকু!” সুছন্দা লজ্জা পাওয়া গলায় বলেন।
“তাহলে অসিতকে কী বলব? তোমরা যাচ্ছ আমার সঙ্গে?”
“আলবাত যাচ্ছি।” অরুণাংশু শাওনের দিকে তাকান, “কী বলিস রে শানু?”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।” হাততালি দিয়ে বলে ওঠে শাওন।
“আমরা পরশু বেরোচ্ছি তাহলে।” পরিদাদু বললেন, “একটা গাড়ি ঠিক করে নেব, ক্যানিং পৌঁছে দেবে আমাদের। ফেরার বন্দোবস্ত অসিতের।”
অরুণাংশু সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
শাওনের মন বলছিল, এইরকম বেয়াড়া সময়ে, যখন অতিমারি পুরোপুরি শেষ হয়নি, পরিদাদুর এমন তাড়াহুড়ো করে বন্ধুর বাড়িতে যাওয়াটা নিছক বেড়ানোর জন্যে হতেই পারে না। নিশ্চিত অন্য কিছু একটা কারণ আছে। পরিদাদু নিজে থেকে সে কারণ বলেননি মানে তাঁকে জিজ্ঞেস করেও কোনও লাভ নেই এই মুহূর্তে। শাওন জানে। কাজেই কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতেই হবে তাকে এখন উৎকণ্ঠা নিয়ে।
দুই
অসিতদাদু সত্যিই ভারি অমায়িক মানুষ। তাঁর বাড়ির অন্যেরাও তাঁরই মতো দিলদরিয়া আর হুল্লোড়প্রিয়। অসিতদাদুর মেয়ে মেঘলীনাদিদি ক্লাস নাইনে পড়ে। শাওনের থেকে মাত্রই এক ক্লাস উঁচুতে। মেঘলীনার সঙ্গে খুবই ভাব জমে গেল শাওনের। মেঘলীনাদিদি খুব ভালো ছাত্রী। ইতিহাস শানুর তেমন ভালো লাগে না, কিন্তু মেঘলীনা দিদির ওইটাই সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। বিশেষ করে স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কে দারুণ উৎসাহ ওর।
মেঘলীনার কাছ থেকেই শাওন জানল, উনিশ শতকের মাঝামাঝি লর্ড ক্যানিং-এর নামেই এই এলাকার নাম হয়েছিল ক্যানিং। পরিদাদু সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “লর্ড ক্যানিং কে ছিলেন জানা আছে তোর, শানু?”
“হুঁ।” মাথা নাড়ে শাওন, “ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম ভাইসরয়।”
“ভেরি গুড।” শাওনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন অসিতদাদু, “এই ক্যানিং সাহেবের আমলেই মাতলা নদীর তীরবর্তী আমাদের এই অঞ্চল হুগলী বন্দরের বিকল্প হিসেবে নির্বাচিত হয়। আর সেই বন্দরের উন্নতি, ডক এবং ট্রাম লাইন তৈরি করার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠল পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট রিক্ল্যামেশন অ্যান্ড ডক কোম্পানি।”
“সে ডকে সত্যিই জাহাজ আসত?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন চোখ গোল গোল করে।
“আসতো বৈকি।” অসিত বলেন, “আঠারোশো পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি নাগাদ ছাব্বিশটা জাহাজ এই বন্দরে এসে ভিড়েছিল।”
“আরিব্বাস!” অরুণাংশু বলে উঠলেন।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আঠারোশো একাত্তরে বন্দরটি সরকারিভাবেই পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়।”
“যাহ্, কেন?” অরুণাংশু বললেন আবার।
“কে জানে!” ঠোঁট ওলটালেন অসিত রায়, “সায়েবসুবোদের খেয়াল…”
“এই কোম্পানিই তো কুঠিবাড়িগুলো তৈরি করেছিল, তাই না পরিদাদু? তুমি বলছিলে সেদিন?” শাওন বলল।
“হ্যাঁ।” পরিদাদু ঘাড় নাড়লেন।
“কিন্তু সেগুলো তো আমরা রাখতেই পারলাম না দাদুভাই।” অসিত রায় আক্ষেপের সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগলেন, “মানুষের লোভ যে বড়ো খারাপ জিনিস ভাই। সে ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত বোঝে না। তা নইলে ভাবো, যে গোলবাড়িতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসে রাত কাটিয়েছিলেন, সেই বাড়িটা পর্যন্ত প্রোমোটারের গ্রাসে চলে গেল! নিজেদের এত সংস্কৃতিমনস্ক জাত বলে অহংকার করি আমরা, অথচ এই বিচ্ছিরি ঘটনাগুলো কি আটকাতে পারছি কেউ? আসলে মুখে বড়ো বড়ো কথা বললে কী হবে, সত্যি-সত্যিই আমরা একটা আত্মঘাতী জাত।”
“রবীন্দ্রনাথ এখানে রাত কাটিয়ে গেছেন!” অবাক হয়ে বলে শাওন।
“হ্যাঁ।” মেঘলীনা বলে হাসতে হাসতে, “আমাদের ক্যানিং খুব ফেলনা জায়গা নয় শাওন। ড্যানিয়েল হ্যামিলটন সাহেবের আমন্ত্রণে উনিশশো বত্রিশ সালের দিকে একবার তাঁর গোসাবার বাংলোয় বেড়াতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শীতে। গোসাবা যাওয়ার পথে এই গোলকুঠিতেই রাত্রিবাস করেছিলেন তিনি।”
“ইশ, এমন একটা ঐতিহাসিক ভবনের সংরক্ষণ হল না?” সুছন্দা বিরক্ত হয়ে বললেন।
“ইতিহাস এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতাই আমাদের অতীতটাকে মুছে ফেলছে মিসেস…”
“খুকু, ব্যস। ও আমার ভাইঝি মানে তোমারও ভাইঝি। অমন ফরম্যালিটি করার দরকার নেই ওর সঙ্গে।” অসিতবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন পরিদাদু।
“আচ্ছা আচ্ছা, তাই।” অসিত রায় হাসলেন, “এরপর আর ভুল করব না।”
সুছন্দাও হাসলেন।
অরুণাংশু বললেন, “যে কুঠিটা এখনও টিকে আছে সেইটাকে অন্তত দেখে আসা যাক, কী বলো পরি?”
“নিশ্চয়ই।” পরিদাদু মাথা নাড়লেন, “সেটাও ক’দিন থাকবে আর কে জানে। পলেস্তরা খসে যা জীর্ণ দশা হয়েছে বাড়িটার! সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ার আগে তোমাদের ওই ঐতিহাসিক বাড়িটা দেখানোর জন্যেই তো টেনে নিয়ে এলাম এখানে।”
“কখন যাব পরিদাদু?” শাওন জিজ্ঞেস করল উৎসাহের সঙ্গে।
“ওখানে তো যখন খুশি যাওয়া যায়।” মেঘলীনা বলল হাসতে হাসতে, “আমাদের বাড়ির কাছেই তো। হেঁটে বড়োজোর মিনিট পাঁচেক।”
“চলো, তাহলে এখনই ঘুরে আসি।” শাওন বলে।
“না, এখন নয়।” অসিতদাদু হেসে শাওনের পিঠে হাত রাখলেন, “দুপুরের খাওয়াদাওয়া হলে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিও। মেঘলীনা তোমাদের সঙ্গে যাবে’খন। অসুবিধা হবে না। চারপাশটা ঘুরে দেখে-টেখে নিয়ে সন্ধের আগে ফিরে এসো।”
“তুমি যাবে না?” শাওন জিজ্ঞেস করল তাঁকে।
“আমি আর কতবার দেখব দাদু?” অসিত হাসলেন, “আমি আর তোমার পরিদাদু না-হয় ওই সময়টা বসে খানিক গল্পগাছা করে নেব’খন।”
“পরিদাদুও যাবে না!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল শাওন।
“তোমরাই ঘুরে এসো না!” অসিত হাসলেন, “আমাদের টানাটানি করে লাভ কী? দুই বন্ধুর কতদিন পরে দেখা হল। চুটিয়ে আড্ডা মেরে নিই বরং দুটো দিন। তাছাড়া আজ আমার কাছে মিস্টার পাণিগ্রাহী আসার কথা আছে। আমি চাইছিলাম ওই সময়টা পরিমল আমার সঙ্গে থাকুক।”
“মিস্টার পাণিগ্রাহী কে?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন চোখ সরু করে।
“মস্ত বিজনেসম্যান।” অসিত রায় বললেন, “কলকাতায় নানান রকমের ব্যাবসা আছে শুনেছি। সম্প্রতি এদিকে নিজের বিজনেস এক্সটেন্ড করতে চাইছেন।”
“কী বিজনেস?”
“আমার একটা জমি আছে নদীর কাছেই। ওই রাজার লাট-এ। ওই জমিটা ভদ্রলোক কিনতে চাইছেন। আমার জমি সংলগ্ন জমি নাজির মণ্ডলের। তাঁর সঙ্গেও নাকি কথা বলেছেন তিনি। এক লপ্তে অনেকখানি জমি নিয়ে তিনি ভেড়ি, সঙ্গে একটা বাংলো টাইপ বাড়ি বানাতে চাইছেন বেশ বাগান-টাগান করে। বলছেন, শহরের ধুলোবালির জীবনে অনেক তো থাকা হল। এখন একটু ফাঁকা জায়গায় থাকতে চাইছেন। মাঝেসাঝে এখানে এসে কয়েকদিন থেকে ফুসফুসে অক্সিজেন বাড়িয়ে নিতে চাইছেন নাকি।”
শাওন চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। কথা বলেনি কোনও। কিন্তু অসিতদাদুর কথা শুনতে শুনতে মনের মধ্যে তার একটা খটকা তৈরি হচ্ছিল। অসিতদাদু পৈতৃক জমি বিক্রি করবেন কি করবেন না, এ সিদ্ধান্ত তো তাঁর নিজেরই। তাহলে এই আলোচনায় তিনি পরিদাদুকে সঙ্গে চাইছেন কেন? তাহলে ব্যাপারটার মধ্যে কি কোনও রহস্য আছে? আড়চোখে পরিদাদুর দিকে চাইল সে। দেখল পরিদাদুও তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। শাওনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মিটিমিটি হাসলেন তিনি। তারপর শাওনকে আশ্বস্ত করেই বলে উঠলেন, “উঁহু, আমি শাওনদেরই সঙ্গী হতে চাইছি অসিত। ওই বাড়িটা তো দেখতে চাইছিই, তার আগে তোর জমিটাও নিজের চোখে দেখে নিতে চাইছি একবার। এমন সুযোগ আমিই-বা ছেড়ে দিই কেন? চাই কি, দরদাম পোষালে জমিটা আমি নিজেও তো কিনে নিতে পারি!”
“তুই!” অসিতদাদু অবাক হয়ে বললেন।
“অবাক হবার কী আছে?” পরিদাদু হাসলেন, “আমি কিনতে পারি না?”
“তা পারবি না কেন?” অসিতদাদু মাথা দোলালেন দু-দিকে, “কিন্তু কিনে করবিটা কী?”
“অক্সিজেন আমারও তো দরকার, নাকি? বয়স বাড়ছে। ফুসফুস আমারও তো কমজোরি হচ্ছে ক্রমাগত।”
“তোর অক্সিজেনের জোগান দেওয়ার জন্যে তো আমরাই রয়েছি।” অসিত রায় পরিদাদুর পিঠের ওপরে হালকা চাপড় মেরে বলেন, “তার জন্যে পয়সা খরচা করে জমি কেনার কী আছে!”
পরিদাদু হেসে উঠলেন, “তা ঠিক, তা ঠিক।” তারপরেই কবজি উলটে ঘড়ি দেখে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “নাহ্, আর একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না। চল শানু, আমরা বেরিয়ে পড়ি। ছানবিন করে আসি আশপাশটা। আর শোন, মাস্ক পরে নিস সবাই। পকেটে স্যানিটাইজারের ছোট্ট বোতলটা নিতেও ভুলে যাস না যেন। সবসময় মনে রাখবি, সাবধানের মার নেই।”
তিন
পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির কুঠিবাড়িটার অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। প্রায় পড়ি পড়ি করেই দাঁড়িয়ে আছে মস্ত বাড়িটা। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান চৌকো বাড়িটার ওপর নীচ মিলিয়ে এগারোটা ঘর। তার প্রায় পুরোটাই পরিত্যক্ত। বাড়িটার মধ্যে মাটির নীচের ঘর-টরও কিছু রয়েছে, যদিও সেগুলোতে ঢোকার এখন আর উপায় নেই কোনও। শাওন বলছিল, “ওই মাটির নীচের ঘরগুলোয় যাওয়া গেলে বেশ হত, বলো পরিদাদু? বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যেত।”
সুছন্দা অমনি ধমকে উঠলেন, “আর অ্যাডভেঞ্চার করে লাভ নেই। অনেক অ্যাডভেঞ্চার করেছ, আর আমাকে চিন্তায় চিন্তায় আধমরা করে ফেলেছ। পুরো মেরে ফেলার প্ল্যান এক্ষুনি আর করার দরকার নেই। দুটো দিন শান্তিতে ঘুরতে দাও বাপু।”
সুছন্দা এমনভাবে কথাগুলো বললেন সকলে হেসে উঠলেন হো হো করে।
এত বড়ো বাড়িটা শুনশান, একা একা দাঁড়িয়ে আছে আকাশে মাথা ঠেকিয়ে। মস্ত কুঠিবাড়ির একটা ছোট্ট অংশেই শুধু মানুষের বাস রয়েছে এখনও।
মাত্র দোতলা হলে কী হবে, বাড়িটা বেজায় উঁচু। অরণাংশু বলছিলেন, “বাড়িটার যা হাইট, এ-কালের চারতলার সমান হয়ে যাবে প্রায়।”
“তা হবে।” পরিদাদু মাথা নেড়ে সায় দিলেন তাঁর কথায়।
পরিদাদুদের অমন উৎসাহ নিয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখে একজন বৃদ্ধ মানুষ এগিয়ে এলেন। মাথায় কাঁধ পর্যন্ত লম্বা অবিন্যস্ত পাকা চুল। গায়ে হাফ হাতা ফতুয়া। পরনে চেক লুঙ্গি। মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। তাঁর চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন অদ্ভুত মনে হল শাওনের।
পরিদাদুর দিকে চেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “শহর থেকে আসচেন বুঝি?”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন পরিদাদু।
কলকাতা থেকে আসছেন শুনে পরিদাদুর দিকে কিছুক্ষণ স্থির ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন বৃদ্ধ। তারপর কর্কশ গলায় বললেন, “প্রতাপাদিত্যের সম্পদ খুঁজতে এসেছেন বুঝি?”
“মানে!” অবাক হয়ে বললেন পরিদাদু।
“একদল লুটেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ। জানেন তো এককালে এইসব খাঁড়ি অঞ্চলে মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের উৎপাত ছিল খুব?”
“শুনেছি।” পরিদাদু মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বৃদ্ধ লোকটির কথাবার্তার ধরন অস্বাভাবিক। খানিক অসংলগ্নও। শাওনের অস্বস্তি হচ্ছিল। সুছন্দাও একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন ইচ্ছে করে। শাওনকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, “এদিকে আয় শানু।”
শাওন অবশ্য পরিদাদুর পাশ থেকে নড়ল না।
“এরা তাদের থেকেও মারাত্মক। এরা শেকড়বাকড়সুদ্ধ এখানকার মাটিটাকেই তুলে নিয়ে যেতে চাইছে। আমি পাহারা দিচ্ছি সারাদিন সারারাত। কিন্তু তাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারব কি?”
“আপনি এখানেই থাকেন?” পরিদাদু খুব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“এই পাশেই।” বৃদ্ধ কোমরের কাছ থেকে একটা কৌটো বের করে তার থেকে দু-আঙুলে নস্যি নিয়ে নাকে দিলেন। নিজের ফতুয়ার খুঁট দিয়েই নাকটাকে মুছে নিয়ে একটু নাকি সুরে আবার বলতে শুরু করলেন, “শহর থেকে মাঝেমধ্যে দু-একজন আসেন। ছবি-টবি তোলেন। তারপর চলে যান। কিন্তু বাড়িটার কোনও উন্নতি নেই। সরকারের নজর পড়ল না এদিকে অ্যাদ্দিনেও। সবই শেষ হয়ে যাবে এমনি করে। পুরোনো স্মৃতি আর কিছুই বোধ হয় থাকবে না। তার ওপরে দস্যুদের আসাযাওয়া…”
“খুবই দুঃখের ব্যাপার।” পরিদাদু বৃদ্ধের কথায় সায় দিলেন।
“কী জায়গা ছিল এ অঞ্চল, আর কী হল।” মাথা নেড়ে আক্ষেপ করতে লাগলেন বৃদ্ধ, “বাপ-পিতামোর কাছে শুনেছি, রাজা প্রতাপাদিত্যর রাজ্যের মধ্যে ছিল এইসব এলাকা। এ ছিল তাঁর খাস তালুক।”
“রানা প্রতাপের নাম শুনেছি, কিন্তু এই প্রতাপাদিত্য আবার কে?” হালকা গলায় বললেন সুছন্দা। দূর থেকেই। তাঁর ভয় বোধ হয় খানিক কাটছে এইবার।
“সে কি রে খুকু, সত্যি-সত্যিই প্রতাপাদিত্যের নাম শুনিসনি?” পরিদাদু বললেন।
“উঁহু।”
“তিনি তো মস্ত জমিদার ছিলেন, বারো ভুঁইয়ার একজন। যশোরের রাজাও ছিলেন।” মেঘলীনা বলে উঠল।
“সাবাশ।” বলে উঠলেন পরিদাদু।
সেই বৃদ্ধ মানুষটার দু-চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। মেঘলীনার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম মা তোমার?”
“মেঘলীনা।”
“তুমিও কলকাতা থেকেই এসেছ বুঝি এঁদের সঙ্গে?”
“উঁহু, আমার এখানেই বাড়ি তো, মিঠেখালি।”
“ও, তাই নাকি? কার মেয়ে তুমি?”
“আমার বাবার নাম অসিত রায়।”
একটু চোখ বুজে ভাবলেন তিনি। দু-দিকে মাথা নাড়লেন, “চিনতে পারছি না। ঠাকুদ্দার নাম?”
“রমেশচন্দ্র রায়।”
“ওরে বাবা, আগে বলবে তো! তুমি আমাদের রমেশদাদার নাতনি। বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন। এলাকার মানুষজনের জন্যে খুব করতেন। বড়ো ভালো লাগল তোমায় দেখে। তাহলে চিন্তা নেই। তোমরা ডাকাতদের দলে থাকতেই পারো না। তোমাদের বিশ্বাস করা যায়।”
পরিদাদু বলতে শুরু করলেন, “প্রতাপাদিত্য সামান্য রাজা ছিলেন না। ষোড়শ শতকের বাংলার স্বাধীনতার প্রতীক তিনি। কাউকে পরোয়া করেননি। মুঘল সম্রাটের অধীনতা অস্বীকার করে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিলেন। ট্যাঁকশাল তৈরি করিয়েছিলেন নিজের মুদ্রা তৈরি করার জন্যে। দিল্লির সম্রাট ভালো চোখে দেখেননি এসব। যথারীতি সেনা পাঠিয়েছিলেন তাঁকে দমন করতে। নিজের দাপট ধরে রাখতে কী লড়াইটাই না লড়েছিলেন দিল্লির মোগল সম্রাটের সৈন্যের সঙ্গে।”
“কিন্তু ফল তো গোল্লাই হল। হার স্বীকার করতে হল তাঁকে শেষপর্যন্ত। আর হবে নাই-বা কেন? পাপের ফল সকলকেই ভোগ করতে হয় হে। যত বড়ো তালেবর হও না কেন, একজনের কাছে কিছুতেই নিস্তার নেই কারও। একটা কথা আছে না, পাপ বাপকেও ছাড়ে না? প্রতাপেরও হল তাই।” বৃদ্ধকে এখন অনেকটাই সহজ মনে হল। তাঁর দু-চোখে যে সন্দেহ আর ভয় ভয় ভাবটা ছিল, সেটা কেটে গেছে এখন।
“কী পাপ?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন অবাক হয়ে।
“জ্ঞাতিহত্যা।” বৃদ্ধ বললেন, “আগ্রায় গিয়ে আকবরের আনুকূল্য নিয়ে ফিরে এসেছিলেন প্রথমে প্রতাপ। আর সেই বলে বলীয়ান হয়েই, দেশে ফিরেই পরিবারের সক্কলকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করলেন তিনি। সক্কলকে বললাম বটে, কিন্তু একজন বেঁচে গেল ফাঁকতালে। সে তাঁর খুড়তুতো ভাই।”
“আশ্চর্য!” পরিদাদু বলে উঠলেন।
“তারপর?” শাওন আর মেঘলীনা দুজনেই প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল। একটা হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের রোমাঞ্চকর গল্প তাদের কিশোর মনে শিহরন জাগিয়ে তুলছিল সেই অপরাহ্নে।
“সেই পাপেই ছারখার হয়ে গেল প্রতাপের বিশাল সাম্রাজ্য। তাঁর মৃত্যুর পর সেনাপতি রুদ্রাদিত্য দেশান্তরী হলেন।” বলেই গলাটাকে খাদে নামিয়ে আনলেন তিনি, “রাজা প্রতাপের কত সোনা-দানা ধনসম্পদ যে ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনের এই অঞ্চল জুড়ে তার ইয়ত্তা নেই।”
“গুপ্তধন?” শাওন বলে উৎসাহের সঙ্গে।
“তা বলতে পারো।” বৃদ্ধ বললেন, “এ অঞ্চলে একাধিক দুর্গ বানিয়েছিলেন প্রতাপাদিত্য। সেইসব দুর্গ বানাতে মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে এসেছিল ঘড়া ঘড়া সোনার মোহর।”
“অ্যাঁ, বলেন কী! মোহর? সোনার?” অরুণাংশু অবিশ্বাসী গলায় বলে ওঠেন।
“আজ্ঞে হ্যাঁ। মোহর। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা। তাছাড়া দুর্গে তাঁর নিজস্ব সোনাদানা তো ছিলই। রুদ্রাদিত্য আদিগঙ্গা ধরে চলে গিয়েছিলেন মোগল সেনাপতিদের চোখের আড়ালে। আদিগঙ্গার সে-সব অঞ্চলে তখন গহিন অরণ্য। আর বাকি সম্পদ পড়ে রইল এই জল-জঙ্গলের দ্বীপরাজ্যেই। ভাগে ভাগে, নানা দুর্গে গোপন জায়গায় তাদের লুকিয়ে ফেলা হল। মাঝে মারী এল। মড়ক হল। এ অঞ্চল শ্মশান হয়ে গেল। নদী গ্রাস করে নিল দুর্গ, প্রাসাদ। জঙ্গলও মুড়ে ফেলল সব। কালের পলির নীচে হারিয়ে গেল সেই রত্নভাণ্ডার। লোভে পড়ে ইদানীং কত লোকই তো এল। কত খোড়াখুঁড়ি করল এই দ্বীপভূমি জুড়ে। কিন্তু সেই বিশাল ঐশ্বর্যের কিছুই প্রায় উদ্ধার হল না।” বৃদ্ধ পরিদাদু এবং অরুণাংশুর এক্কেবারে কাছে সরে এলেন। তারপর খুব গোপন কথা বলার ঢঙে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “আপনাদের দেখে আমার ভালো লোক বলেই মনে হচ্ছে। তাই চুপি চুপি বলছি, খুব সাবধান। এখনও অনেকেই সেই সম্পদ হাতিয়ে নেবার তালে এই অঞ্চলে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা লোক সুবিধের নয়। তাদের হাতে এইসব সম্পদ পড়লে খুব মুশকিল। আমি তাই গোপনে সম্পত্তি পাহারা দিচ্ছি। কিছু কিছু গচ্ছিত রাখছি ব্যাঙ্কের ভল্টের মধ্যে।”
“ইন্টারেস্টিং!” অরুণাংশু বললেন, “আপনি এতসব জানলেন কী করে সেইসব লোকের সম্বন্ধে?”
“তারা যে আমার কাছেও এসেছিল।”
“আপনার কাছে কেন?”
“রাজকোষের নাগাল পেতে।” বলে রহস্যময় হাসি হাসলেন বৃদ্ধ।
“আপনার নাম জানতে পারি?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন তাঁকে।
“আমার নাম?” একটু থামলেন বৃদ্ধ। তারপর আবার বললেন, “প্রতাপাদিত্যের পরে তাঁর কাকার ছেলেকে সিংহাসনে বসতে রাজি করানো যায়নি। কে শেষপর্যন্ত বসল জানেন?”
“কে?”
“ভবানন্দ মজুমদার।”
“তিনি কে?”
“ছেলেটা একসময় রাজবাড়িতে পুরোহিতের কাজ করত।” বৃদ্ধ হাসলেন, “কপালে থাকলে কী না হয়! কিন্তু একটা কাজে ভেজে গেলেই তো হয় না। সে কাজে অধিকারী হতে হয়। তা না হলে যা হবার আমার পূর্বপুরুষটির তাই হল। ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল সব।”
“আপনার পূর্বপুরুষ?” পরিদাদু অবাক হয়ে বললেন।
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, “এই প্রায় ভিখিরি উমানাথ মজুমদারেরই পূর্বপুরুষ তিনি।” বলতে বলতেই একবার পিছন দিকে চাইলেন উমানাথ। তারপরেই ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “ওই সম্রাটের পেয়াদা ধরতে আসছে আমায়। আমি চলি।”
আর একবারও পরিদাদুদের দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন উমানাথ মজুমদার। কুঠিবাড়ি পেরিয়ে নদীর দিকে।
পরিদাদু কয়েক মুহূর্ত উমানাথবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিজের মোবাইলটা নিয়ে পরপর কয়েকটা ছবি তুলতে শুরু করলেন কুঠিবাড়িটার আর তার আশেপাশের এলাকার।
তখনই ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন পরিদাদুদের সামনে। নিপাট ভালোমানুষের মতো চেহারা। পরনে শার্টপ্যান্ট। একটু লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, “মাস্টারমশাই খুব বোর করছিলেন নিশ্চয়ই আপনাদের?”
“মাস্টারমশাই!” পরিদাদু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনারা কি বাইরে থেকে এসেছেন? এখানকার স্থানীয় লোক নন?”
“না, আমরা এখানে থাকি না।”
“ওহ্, ওইজন্যে। এখানকার একটু বয়স্ক লোকেরা ওঁকে চেনেন। একসময় স্কুলে পড়াতেন। কী ভূত মাথায় ঢুকল কে জানে! এ অঞ্চলের ইতিহাস খুঁড়ে বের করবেন। সেই করতে গিয়ে মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল।”
“উনি পাগল!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন অরুণাংশু, “কথা শুনে তেমন মনে হয় না কিন্তু।”
“অতীত আর বর্তমান গুলিয়ে তালগোল করে ফেলেন। উমানাথকাকু আজকাল মনে করেন তিনি রাজপরিবারের সদস্য। সেইমতো নানান কথা বলে যান নিজের খেয়ালে। সে-সব অসংলগ্ন কথা শুনলে আপনারাও বুঝবেন তাঁর মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না।”
“আমাদেরও বলছিলেন।” সুছন্দা বললেন।
“কী বলছিলেন?” ভদ্রলোক হাসলেন।
“ওই তিনি ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর… রাজপরিবারের ঐশ্বর্য রক্ষা করার চেষ্টা করছেন তিনি প্রাণপণে…”
“এইটাই সমস্যা, বুঝলেন।” ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, “এমনিতে চট করে কিছু বুঝবেন না। অন্যান্য অনেক পাগলের মতো উনি অ্যারোগ্যান্ট নন। কিন্তু ওই একটা কল্পনার রাজত্বে বাস করেন। সেখানে কাউকে কাউকে শত্রু ভেবে ফেলেন, কাউকে মনে করেন আপনার লোক। তাঁর ধারণা, একদল লোক তাঁর সম্পদ হাতিয়ে নেবার জন্যে নাকি সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর পিছন পিছন। কী আর বলি আপনাদের! হাসির কথাই মশাই। ওঁর সম্পত্তি বলতে ঘরের একটা পুরোনো তক্তপোষ, কিছু পোকায় খাওয়া বই আর কিছু ইট-পাটকেল-নুড়ি-পাথর।”
পরিদাদু হাসলেন, “আপনার পরিচয়?”
“আমার নাম তড়িৎ সেনগুপ্ত।” ভদ্রলোক দু-হাত বুকের কাছে জড়ো করে নমস্কার জানালেন, “উমানাথবাবু আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন। কাকা ডাকি ওঁকে। ওঁর বাড়ির পাশেই থাকি। যতটকু সম্ভব দেখাশুনো করি। অন্যদিন আপিস থাকে। আমি একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করি। এসপ্ল্যানেডের দিকে। আজ ছুটি নিয়েছিলাম। কাকার সঙ্গেই ক্যানিং এসেছিলাম। কিন্তু মানুষটা কিছুতেই আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চান না।”
পরিদাদু সেদিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “অদ্ভুত মানুষ তো!”
“আমার হয়েছে জ্বালা।” ভদ্রলোক আবার হাসলেন, “আসি। দেখি কোথায় গেলেন মানুষটা। যদি বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি। নইলে রাতে-ভিতে পথে ঘাটে কোথায় যে পড়ে থাকবেন।”
তড়িৎ সেনগুপ্তও দ্রুত হাঁটা লাগালেন। উমানাথ মজুমদার যে পথে হেঁটে গেছেন একটু আগে, সেইদিকেই।
“কী বুঝছ?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন হাসতে হাসতে, “রহস্যের গন্ধ উড়তে শুরু করল নাকি তোমার নাকের কাছে?”
পরিদাদুও হাসলেন। জবাব দিলেন না এ-কথার। বরং তাড়া দিয়ে বললেন, “চলো মেঘলীনা, নদীর পাড়ে তোমাদের জমিটার দিক থেকে ঘুরে আসা যাক। হাতে সময় নেই বেশি। যে-কোনো সময় অসিতের ফোন এসে যেতে পারে। তখন ফিরতে হবে আমাদের।”
“চলুন।” মেঘলীনা মিষ্টি করে হাসল, “এই মানুষটার কথা শুনেছি মনে হয়।”
“কে, উমানাথবাবু?”
“হ্যাঁ।”
“কে ভদ্রলোক?”
“সত্যিই উনি রাজার বংশধর কি না জানি না, তবে আমাদের স্কুলের ইতিহাসের স্যার ওঁর কথা বলেছিলেন একবার। নামটা শুনে মনে পড়ল।”
“কী বলেছিলেন?” হাঁটতে-হাঁটতেই উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন পরিদাদু।
“একসময় গোসাবার একটি স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন উমানাথ মজুমদার। সুন্দরবনসহ গোটা দক্ষিণবঙ্গের ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ব নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা ছিল তাঁর। সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপে ঘুরেছেন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শ সংগ্রহের জন্যে। এই অঞ্চলের অতীত ইতিহাস খুঁজে বেড়ানোই ছিল তাঁর নেশা। এই নেশাতেই মাঝবয়সে পৌঁছে চাকরিবাকরি ছেড়ে দেন।”
“আশ্চর্য!” পরিদাদুর কপালে ভাঁজ পড়ল।
“এই অঞ্চলে কিছু জায়গায় মাটি খোঁড়ানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন উদ্যোগী হয়ে। বাবা জানে। কুমড়োখালি থেকে বহু পুরোনো কালো পাথরের একটা বিষ্ণুমূর্তি বেরিয়েছিল তখন। মূর্তিটা পাল-সেন আমলের সম্ভবত।”
“তারপর?” পরিদাদু উৎসাহিত হয়ে বলেন।
“সাত নম্বর দিঘির পাড়ে একটা নারায়ণ মন্দির আছে। সেই মন্দিরে এখনও মূর্তিটার পুজো হয়।”
“কিন্তু আজ উমানাথবাবুকে যে অবস্থায় দেখলাম…”
“খুবই বাজে ব্যাপার।” পরিদাদুর কথার মাঝখানেই বলে ওঠে মেঘলীনা, “পরের দিকে ওঁর কিছু সাইকোলজিক্যাল ডিস-অর্ডার ধরা পড়ে। অসংলগ্ন কথা বলতেন। ক্রমশই সে অবস্থার অবনতি হয়। একা মানুষ ছিলেন। চিকিৎসা কিছুই হয়নি বলতে গেলে। এখন পাগলের মতো ঘুরে বেড়ান আর আজব সব কথা বলেন। এদিকের বয়স্ক মানুষেরা বলেন, তিনি নাকি নদীর পাড়ের দুগ্গা ঢিবি খুঁড়তে গিয়েছিলেন। সেই অভিশাপেই এই অবস্থা তাঁর।”
“সে জায়গাটা কোথায়?”
“আমরা ওইদিকেই যাচ্ছি এখন।”
“তুমি এত কিছু জানলে কীভাবে মেঘলীনা? তুমি তো ছোটো। এত কথা তোমার তো জানার কথাই নয়।” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
মেঘলীনা মিষ্টি করে হাসল, “আমার এই অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ আছে বলে আমাদের ইতিহাস-স্যার ওঁর কথা গল্প করেছিলেন। বাবার কাছেও শুনেছি কিছুটা পরে। স্যার একদিন দুঃখ করে বলছিলেন, উমানাথ মজুমদার সুস্থ থাকলে এই অঞ্চলের ইতিহাস আজ হয়তো নতুন করে লেখা হত।” মেঘলীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আমাদের এখানকার মানুষের দুর্ভাগ্য। এমন একজন প্রতিভাবান মানুষ উন্মাদ হয়ে গেলেন। ওঁকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। আজ যখন নিজের পরিচয় দিলেন, খুব ইচ্ছে করছিল আর একটু কথা বলার, কিন্তু মানুষটা আর দাঁড়ালেনই না।”
“ভদ্রলোক থাকেন কোথায়?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“বাসন্তী। নারায়ণতলা স্কুল থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে। কিন্তু মুশকিল হল, বাড়িতে তো থাকেন না তিনি। নিজের খেয়ালে পুরো তল্লাট ঘুরে বেড়ান। আমি একবার খুব বায়না করে গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে। দেখা হয়নি। বাড়ি বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল।”
“ভদ্রলোকের কথাবার্তার মধ্যে কিছুটা অসংলগ্নতা আছে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে উন্মাদ বলে মনে হল না আমার।” পরিদাদু গম্ভীর গলায় বললেন, “ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাদা করে খানিক কথা বলতে পারলে ভালো হত।”
চার
অসিতদাদুদের জমিটা মাতলা নদীর কাছাকাছিই। মেঘলীনা বলল, “এ জায়গাটা রাজার লাটের অংশ।”
“রাজার লাট? এমন অদ্ভুত নাম কেন?” শাওন জিজ্ঞেস করল, “এই লাট শব্দটার মানে কী, মেঘলীনাদিদি?”
“মানে?” মেঘলীনাকে খানিক অপ্রতিভ মনে হল, “লাট তো জমি-জায়গাকেই বলে। এসব অঞ্চল একসময় রাজারই ছিল তো। তাই হয়তো…”
“কোন রাজা? প্রতাপাদিত্য?” আবার জিজ্ঞেস করে শাওন।
“বোধ হয় নয়।” পরিদাদু বললেন হালকা গলায়, “লাট শব্দটা ইংরেজি ‘lot’ শব্দ থেকে এসেছে। যার মানে হল জমিদারির অংশ। ব্রিটিশ আমলে লাট বলতে জমিদারির এমন অংশ বোঝাত, যা বকেয়া খাজনার দায়ে কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্য নিলামে বেচে দিতে পারতেন।”
“তাহলে আমরা যে লাটসাহেব বলি কথায় কথায়, বা ধরো বড়োলাট, তখন তো তোমার এই শব্দার্থ মিলছে না হে?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন চোখ সরু করে।
“ও অর্থটা এসেছে ইংরেজি ‘lord’ শব্দের অপভ্রংশ হিসেবে। রাজ্যপাল-টাজ্যপাল জাতীয় উচ্চপদের কোনও মানুষজন বোঝাতে।” পরিদাদু হালকা হাসলেন, “অবিশ্যি লাটসাহেব কথার অর্থের অপকর্ষ হয়েছে ইদানীং।”
অরুণাংশু আবার কী একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলে সামনে এসে দাঁড়াতে চুপ করে গেলেন তিনি।
ছেলেটার হাতে পায়ে ধুলো মাটি। নোংরা ছেঁড়া পোশাক। মাথায় জট পড়া উসকোখুসকো চুল। দেখলেই বোঝা যায় সে-চুলে তেল পড়েনি বহুদিন। সুছন্দার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডান হাতের মুঠোটা খুলল সে। “এটা কিনবে?”
“কী এটা?” সুছন্দা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“টাকা। মাটির নীচে থেকে পেয়েছি।” ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “মাটির নীচ থেকে পাওয়া জিনিস অনেকেই তো দাম দিয়ে কিনে বাড়িতে সাজিয়ে রাখতে চায়। এটা রাখো না মাসি। ধনুক হাতে একটা কী ঠাকুরের ছবি খোদাই করা আছে টাকাটায়। বাড়িতে রেখো। ভালো হবে।”
সুছন্দা হেসে ফেললেন, “দারুণ কথা বলিস তো তুই। আচ্ছা দে দেখি।”
অরুণাংশু বাধা দিলেন বিরক্ত গলায়, “একদম নয়। আজকাল এই ব্যাবসাটা খুব চালু হয়েছে। আমাদের পাড়াতেও ঘুরঘুর করত কয়েকজন। একই ডায়ালগ। বাবু, আমি রাজমিস্তিরির জোগাড়ের কাজ করি। অমুক জায়গায় ফ্ল্যাট উঠছে। ভিতের মাটি খোঁড়ার সময় এই টাকাটা পেয়েছি। রামসীতার ছাপ দেওয়া। আপনাদের ঠাকুর, ভাবলাম যদি কিনে নেন… বেশি নয়, শ’দুই টাকা দিলেই দিয়ে দেব। আমি একবার একটা কিনেওছিলাম। ভেবেছিলাম অ্যান্টিক জিনিস। আমার এক বন্ধু আছে। কলকাতায় কিউরিও শপ আছে ওর। ওকে দেখাতে বলল নকল অ্যান্টিক। ফালতু জিনিস…”
“মাসি, নাও না।” ছেলেটা আবার বলল ঘ্যানঘেনে গলায়, “বেশি দাম দিতে হবে না। একশো টাকা দিলেই হবে।”
“একশ টাকা? বলিস কী?” সুছন্দা হাসি হাসি মুখ করে বললেন।
“কী বলছ?” ছেলেটা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “মাটির নীচের জিনিসের অনেক দাম!”
“কী করে জানলি?” পরিদাদু এগিয়ে এসে ছেলেটার সামনে দাঁড়ালেন এইবার।
“কিছু ভাঙা কলসি আর থালার টুকরো পেয়েছিলাম একদিন। আর একটা ভাঙা মূর্তির মুণ্ডু। ছোট্ট। কালো রঙের। তাই একজন বাবু দেখতে পেয়ে ছুট্টে আমার কাছে এসে দুশো টাকা দিয়ে কিনে নিল।”
“বলিস কী? সে কোন বাবু, চিনিস?”
“না।” ছেলেটা দু-দিকে মাথা নাড়ে, “কলকাতা থেকে এসেছিল। খুব ফর্সা। মাথায় টাক। চোখে গোল সোনালি ডাঁটির চশমা। দু-হাতে প্রায় খান পাঁচ-ছয় আংটি, নানা রঙের পাথরের।”
“সেই বাবুর সঙ্গে কোথায় দেখা হল তোর?”
“এইখানেই। সেই বাবু এইখানেই ঘুরছিল। সঙ্গে আরও দু-তিনজন লোক ছিল। কীসব মাপামাপি করছিল। সামনেই একটা ঢিবিমতো আছে। সেখানে গিয়ে খুব খুঁটিয়ে দেখছিল। হাত-পা নেড়ে অন্য লোকগুলোকে কীসব বলছিল।”
“তুই ওগুলো কোথায় পেয়েছিলি?”
“ওই ঢিবির পিছন দিকে। খানিকটা দূরে। নদীর এক্কেবারে গায়ের কাছে গত্ত খুঁড়ছিলুম…”
“কেন?”
“আমি ওরকম গত্ত খুঁড়ে রাখি নদীর জলের কাছাকাছি। জোয়ারে জল এসে গত্তে পড়ে। আবার জল সরে যায় যখন, অনেক সময় ওই গত্তে মাছ থাকে, কাঁকড়া থাকে…”
“এই গর্ত কোথায় করেছিলি দেখা।”
ছেলেটা যেখানে নিয়ে গেল সেটা অসিত রায়েরই জমির পিছন দিক দিয়ে নদীর কাছে নেমে গিয়ে। পরিদাদু চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন একটুক্ষণ। জমিটার পাশেই বেশ উঁচু ঢিবি। গাছপালায় ঢেকেছে তার মাথা। কিছু বাণীগাছ ঢিবির ওপর থেকে হেলে আছে নদীর দিকে।
মেঘলীনা বলল, “এই ঢিবিটাকে লোকে বলে দুগ্গা ঢিবি। আশেপাশের অনেকেই ওখানে পুজো দেয়। ঢিবির গায়ে সিঁদুর লেপে দিয়ে সেই সিঁদুর মাথায় পরে।”
ঢিবিটা অনেকখানিই লম্বা। বিস্তার উত্তর-দক্ষিণে। পরিদাদুকে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘলীনা বলল, “ওই ঢিবিটার গায়ে কেউ পা দেয় না। ঢিবির মাথাতেও ওঠে না কেউ ওইজন্যে। মাঝেমধ্যে গরু-ছাগল উঠে পড়ে অবশ্য। ও জায়গাটাও আমাদেরই।”
“পাণিগ্রাহী এই জমিটাই কিনতে চাইছেন? তুমি কিছু জানো মেঘলীনা?”
“হ্যাঁ।”
“আই সি।” পরিদাদুর কপালে ভাঁজ পড়ল। ছেলেটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “দে টাকাটা, দেখি।”
“কিনবে কাকু?”
“আগে দে দেখি।”
ছেলেটা মাটিমাখা টাকাটা পরিদাদুর হাতে দিল। পরিদাদু সেটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই যে মূর্তির মাথাটা বাবুকে দিয়েছিলি সেটা কেমন দেখতে মনে আছে?”
“একটা মাথা। মাথায় জটার মতো। টানা টানা চোখ, বন্ধ। কান দুটো লম্বা…”
“বুদ্ধমূর্তির মাথা!” শাওন বলে উঠল।
“একশোয় একশো।” পরিদাদু বলে উঠলেন। তারপর নিজের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে বললেন, “এই টাকাটাও কি ওই নদীর পাড়ের গর্ত থেকেই পেয়েছিস?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“কুঠিবাড়ির নীচের গর্ত থেকে।”
“মাটির নীচের ঘরে ঢুকেছিলি নাকি?”
“না না, সে-সব ঘর তো বুজে গেছে। ঢোকা যায় না আর।”
“তবে মাটির নীচের কোন গর্ত আবার?”
“ওই বাড়িটার নীচের দিকে বড়ো বড়ো ফোকর আছে।”
“হ্যাঁ গো কাকু,” মেঘলীনা বলল, “ওই বাড়ির পিছনদিকে মানে যেদিকটা ওদের শৌচালয়গুলো ছিল, সেখানে এমন বন্দোবস্ত ছিল যে জোয়ারের সময় নদীর জল ঢুকে পড়ত আবার ভাটার টানে সেই জল সব পরিষ্কার করে ফিরে যেত নদীতে।”
“অদ্ভুত তো!” অরুণাংশু বললেন। “এখনও অমন ব্যবস্থা আছে?”
“এখন তো নদীর পাড় অনেক উঁচু হয়ে গেছে। অত জল আর আসতে পারে না। তবে একটা জল আসাযাওয়ার সরু স্রোত বওয়া খাল এখনও আছে কুঠিবাড়ি থেকে নদী পর্যন্ত।”
“কিন্তু ওদিকটা তো জঙ্গল হয়ে আছে। সাপখোপের আড্ডা। ওখানে কী করতে ঢুকেছিলি তুই?”
“পাগলাদাদুকে দেখে ভয় পেয়ে লুকিয়েছিলুম।”
“কোন পাগলাদাদু, উমানাথ মজুমদার?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“নাম তো জানি না। ওই যে একটু আগে ওই বাড়ির দিক থেকেই এদিকে এলেন। পাগল গো। দিন নেই রাত নেই, নদীর চরে ঘুরে বেড়ায়। মাটির ওপরে কান পেতে শুয়ে পড়ে কীসব শোনে। এই জমিতে, ওই দুগ্গা ঢিবিতেও প্রায়ই আসে। এমনকি রাতের বেলাতেও।”
“রাতের বেলা আসেন, তুই কী করে জানলি?”
“একদিন কাকভোরে এসেছিলুম এদিকে কাঁকড়া ধরতে। দেখি কী, ঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে বসেই ঘুমোচ্ছে পাগলাদাদু।”
“তারপর?”
“আমি ওর গায়ে ঠেলা দিয়ে বললাম, এই যে বুড়ো, তোমার ভয়ডর নেই? এই দুগ্গা ঢিবিতে মরতে রাত কাটাতে এসেছিলে?”
“উনি কী বললেন?”
“ওরেব্বাবা,” ছেলেটা হেসে উঠল, “বুড়োর কী রাগ! একেবারে খ্যাঁকম্যাক করে উঠল আমার ওপর। বলল, এখেনে এই জলাজঙ্গলে মশার কামড়ে কি আর এমনি এমনি পড়ে আছি? আমি গড় পাহারা দিচ্ছি।”
“সে কী?”
“মাথাটা তো গেছে।” ছেলেটা আবারও হাসতে থাকে হো হো করে।
“তুই ওঁকে ভয় পাস কেন?” পরিদাদু একটুও না হেসে প্রশ্ন করলেন।
“যেদিন ওই ভাঙা থালার টুকরোগুলো আর ওই মাথাটা বিক্কিরি করছিলুম, বুড়ো দেখে ফেলেছিল। আর তাই দেখে আমার ওপরে কী রাগ!”
“কী বললেন?”
“চিৎকার করতে লাগল, ঘরের জিনিস পরকে দিচ্ছিস কেন রে হতভাগা? এসব যে সোনার চেয়েও দামি! সব কি বেচে দিবি একে একে? তারপর আরও কত কী!”
“সেই বাবু ছিলেন তখন?”
“হ্যাঁ।”
“তিনি কিছু বললেন না?”
“একদৃষ্টে দেখছিলেন পাগলাদাদুকে। খুব রেগে গিয়েছিল মনে হল। আমিই বললাম, ছেড়ে দিন। ওর কথা ধরবেননি। পাগল-ছাগল মানুষ…”
পরিদাদু অন্যমনস্কভাবে একটা একশো টাকার নোট বের করলেন। ছেলেটার হাতে দিয়ে বললেন, “তুই থাকিস কোথায়?”
“ক্যানিং স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শেডের নীচে। টিকিট কাউন্টারের কাছে।”
“তোর বাড়িঘর নেই?”
“উঁহু।”
“তোর নাম?” পরিদাদুর গলা নরম হয়ে গেল।
“বিলু।”
“কার সঙ্গে থাকিস? মা-বাবা?”
“কেউ নেই আর। আমি একা।” বিলু হাসে, হলুদ দাগ ধরা দাঁত বের করে।
“এরপর যদি অমন কিছু পাস দু-একদিনের মধ্যে, কাউকে দিবি না। রেখে দিবি নিজের কাছে। আমি নেব। ভালো দাম দেব তোকে।” পরিদাদু বললেন।
“আচ্ছা।”
“আমি কাল হয়তো তোর কাছে যেতে পারি। বিকেলের দিকে। প্ল্যাটফর্মেই থাকিস। যাস না কোথাও।”
“আচ্ছা।”
বিলু শাওনের দিকে চাইল, “তোমরা কোথায় থাকো?”
মেঘলীনাই জবাব দিল, “ওরা তো অনেকটাই দূরে থাকে। ওর নাম শাওন, তোমার শাওনদাদা। আর আমি মেঘলীনাদিদি। আমি কাছেই থাকি। মিঠেখালি। ওখানে আমার নাম বললেই যে কেউ আমার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। ওরা আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে কয়েকদিনের জন্যে।”
“ও।” বিলু হাসল।
মেঘলীনাও হাসল মিষ্টি করে, “ইচ্ছে হলে আমার বাড়ি এসো। তোমার সঙ্গে গল্প করব। আমার কাছে নীচু ক্লাসের গল্পের বই আছে। দেব তোমাকে।”
“আমি তো পড়তেই পারি না।”
“আমার এখন ছুটি। তোমাকে আমি পড়তে শিখিয়ে দেব।”
বিলু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই পরিদাদুর ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। অসিত রায় ফোন করছেন। পরিদাদু বললেন, “আমি আসছি এক্ষুনি। ভদ্রলোককে বসা। আর শোন, জমিটা কিছুতেই বিক্রি করা যাবে না কিন্তু।”
অসিত কী বললেন শোনা গেল না। পরিদাদুর মুখ গম্ভীর হল একটু। তিনি আবার বললেন, “দাম যতই চড়াক না কেন, তুই অনড় থাকিস। তোর সত্যিই তো এই মুহূর্তে টাকার দরকার নেই। জানবি টাকার চেয়েও আরও বড়ো সম্পদ ধরে রেখেছে এই মাটি। তা হল আমাদের ইতিহাস। সেই ইতিহাস যদি খুঁড়ে বের করতে পারি, তা সোনার চেয়েও দামি রে অসিত। অর্থ দিয়ে তার পরিমাপ হয় না।”
***
অসিতদাদুর বসার ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন ভদ্রলোক। চোখে পড়ার মতোই লম্বাচওড়া চেহারা। টকটকে ফর্সা রঙ। মাথায় টাক। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। দু-হাতের আঙুলগুলোর অধিকাংশেই রঙবেরঙের পাথর বসানো আংটি। মিস্টার পাণিগ্রাহীকে দেখেই পরিদাদুর হাত ধরে আলতো টান দিল শাওন।
পরিদাদু চোখের ইশারায় বোঝালেন তিনিও চিনতে পেরেছেন এই মানুষটির কথাই বিলু বলছিল একটু আগে।
পরিদাদুকে দেখেই অসিতদাদু পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এই যে আমার বন্ধু, পরিমল চট্টোপাধ্যায়। ওর কথাই বলছিলাম আপনাকে।”
“নমস্কার।” পরিদাদু দুই হাত বুকের কাছে তুলে আনলেন।
পাণিগ্রাহীও প্রতি-নমস্কার জানালেন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে।
পরিদাদু খুব আন্তরিকভাবে বললেন, “বসুন, বসুন।”
মেঘলীনা শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো শানু, আমরা ঘরে যাই।”
শানুর ঘরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। পরিদাদু পাণিগ্রাহী নামের লোকটাকে কী বলেন জানতে ইচ্ছে করছিল খুব। শানু বেশ বুঝতে পারছিল, এই মানুষটা সুব সহজ মানুষ নন। আর অসিতদাদুর জমিটা কেনার পিছনেও নিশ্চিত অন্য কোনও গোপন উদ্দেশ্য আছে তাঁর। কিন্তু পরিদাদুও মেঘলীনার কথায় সায় দিয়ে বললেন, “সেই ভালো। তোরা বরং ঘরে গিয়ে গপ্প-সপ্প কর। আমাদের বুড়োদের মধ্যে থেকে তোদের কাজ নেই।”
পাঁচ
কাল যতক্ষণ জেগে ছিল, শাওন দেখেছে পরিদাদু কেমন যেন অস্থির। নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে নিজেই নিজের মাথার চুল চেপে ধরছে। হাতের তালুতে থুতনি রেখে কী যেন ভাবছে একমনে। শাওন একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “কী এত ভাবছ পরিদাদু?”
“যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে মারাত্মক ব্যাপার হবে রে শানু।”
“কীরকম?”
“বুঝতে পারছিস না, অসিতের এই জমিটা প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ? যেসব জিনিসপত্র উঠে আসছে এখানকার মাটির তলা থেকে সেগুলো সাধারণ জিনিস নয়। অত্যন্ত প্রাচীন প্রত্নবস্তু।”
“ওই ভাঙা থালা-বাটি, বুদ্ধমূর্তি সব?”
“অবশ্যই। তা না হলে কি আর এমনি এমনি রতন পাণিগ্রাহী অত দাম দিয়ে জমিটা কিনতে চান? দেখলি তো ভদ্রলোক কতটা মরিয়া এ ব্যাপারে!”
“উনিও তার মানে এই প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের ব্যাপারটা জানেন।”
“জানেন তো বটেই। নইলে বিলুর থেকে ওগুলো কিনে নেন পয়সা খরচা করে?”
“ওগুলো খুব দামি বুঝি?”
“হুঁ। প্রত্নবস্তু যত প্রাচীন হয়, তার দামও তত বেশি হয়।”
“কত বছরের পুরোনো হলে প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু বলা যায়?”
“অন্তত একশো বছর।”
“এ-ক-শো?”
“হুঁ।”
“ওই ভাঙা টুকরোগুলো কি তার চেয়েও বেশি পুরোনো?”
“অনেকই বেশি।” পরিদাদু হাই তুললেন, “যা ভাবছি তা সত্যি হলে এগুলো অন্তত ষোলো সতেরোশো বছরের পুরোনো।”
“অ্যাঁ!” অবাক হয়ে বলে শাওন।
“আর ওই টাকাটা?”
“টাকাটা যে-সে জিনিস নয় শানুবাবু। একেবারে যাকে বলে মোহর।”
“মানে?”
“স্বর্ণমুদ্রা।”
“ওটা সোনার?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“কোনও রাজার মুদ্রা নিশ্চয়ই?”
“সে তো বটেই।”
“কোন রাজার?”
“আমি ঠিক শিওর নই। শশাঙ্ক বা জয়নাগ এমনকি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রাও হতে পারে। তমোঘ্নকে ছবি তুলে মেইল করেছি। ফোনে একটা ব্রিফও দিয়েছি। দেখা যাক কী বলে ও।”
তমোঘ্ন ভট্টাচার্যের সঙ্গে গতবছরে বহরমপুরে আলাপ হয়েছিল শাওনের। খুব ভালো মানুষ। আর কী প্রচণ্ড পড়াশোনা! খুব ভালো লেগেছিল ওঁকে।
শাওন জিজ্ঞেস করল, “পরিদাদু, তমোঘ্নদাদু কি এখানে আসবেন?”
“দেখা যাক।”
“মুদ্রাটা সত্যি-সত্যিই যদি চন্দ্রগুপ্তের হয় তাহলে দারুণ ব্যাপার হবে, বলো?”
“এখন ঘুমিয়ে পড়। কয়েকটা বিষয় চুপ করে একটু ভাবতে দে আমায়।” বলে শাওনের উলটোদিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন পরিদাদু।
শাওন ঘুমিয়ে পড়ল একটু পরে।
***
সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিদাদুকে দেখতে পেল না শাওন। সুছন্দা বললেন, “পরিকাকুর যা স্বভাব। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই বলল, কীসব কাজ আছে। বেরোতে হবে। কখন ফিরবে ঠিক নেই। অসিতকাকুকে বলল একটা অটো ব্যবস্থা করে দিতে। উনি বললেন একটু ওয়েট কর। ড্রাইভারকে ফোন করে ডেকে নিচ্ছি। আমার গাড়িটা নিয়ে বেরোস। তা সে-কথা তার পছন্দ হল না। মানুষটা চিরকাল একইরকম গোঁয়ারগোবিন্দ রয়ে গেল।”
শাওন মনে মনে উত্তেজনা বোধ করছিল। পরিদাদুর এই আচরণ তার জানা। যে বিষয়গুলো নিয়ে ধন্দে ছিলেন পরিদাদু, নিশ্চিত তার জট অনেকটাই কাটিয়ে ফেলেছেন তিনি। দু-একদিন পরেই তাদের ফিরে যাওয়ার কথা। তার আগেই সম্ভবত কিছু একটা ঘটতে চলেছে এদিকে।
মেঘলীনা এগিয়ে এসে নীচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “এই শানু, কী ভাবছিস রে?”
“কিছু না।” শাওন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
“কিছু না বললে হবে? নিশ্চিত পরিকাকু আর তুই মিলে কিছু একটা প্ল্যান করেছিস। আমাকে বলতে চাইছিস না।”
“আমি বেশি কিছু জানি না। শুধু এইটুকু জানতে পেরেছি, তোমাদের ওই জমিটা খুব দামি। পরিদাদু বলছিলেন কাল।”
“ওই রতন পাণিগ্রাহী অনেক দাম দিয়েই কিনতে চাইছে তো জমিটা।”
“সেই দাম নয়।” শানু হাসল, “এই জমি প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিদাদু বুঝতে পেরেছেন।”
“সত্যি!” মেঘলীনা উত্তেজিত হয়ে বলল, “এখানে তাহলে এক্সকাভেশন হবে? দারুণ ব্যাপার হবে তাহলে। বইতে পড়েছি, নেটে দেখেছি আগে। এখন চোখের সামনে দেখব মাটির নীচের চাপা পড়া ইতিহাস কেমন ধীরে ধীরে ওপরে এক্কেবারে চোখের সামনে উঠে আসছে।”
“অত কিছু আমি জানি না।”
“এক কাজ করবি?” মেঘলীনা ফিসফিস করে বলে।
“কী?”
“চল দুজনে গিয়ে আমাদের জমি আর দুগ্গা ঢিবিতে একটা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ চালিয়ে আসি।”
“কখন যাবে?”
“খেয়ে উঠে। দুপুরবেলা।”
“আচ্ছা।”
“আমাদের বাড়িতে একটা ছোট্ট শাবল আছে আর একটা হাত কোদাল। সঙ্গে নিয়ে যাব?”
“যাহ্, ওইভাবে মাটি খুঁড়ে কিছু পাওয়া যায় নাকি?”
“যেতেও তো পারে। দেখলি না বিলু কেমন পেয়ে গেল! ওই ভাঙাচোরা টুকরোগুলো নিশ্চয়ই দামি। নইলে পাণিগ্রাহী-আঙ্কল ওগুলো কিনলেন কেন?”
স্বর্ণমুদ্রাটার কথা বলতে গিয়েও চেপে গেল শাওন। শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল মেঘলীনার কথায়।
“দুজনে মিলে তখন থেকে কী এত পরামর্শ চলছে শুনি?” মেঘলীনার মা অঞ্জনা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন।
“কিছু না।” বলে নিজের ঘরে চলে গেল মেঘলীনা।
***
পরিদাদু যখন ফিরলেন, বেলা গড়িয়ে গেছে। মাঝে একবার ফোন করে বলে দিয়েছিলেন ওঁর জন্যে যেন কেউ অপেক্ষা করে বসে না থাকে। ফিরতে দেরি হলে দুপুরের খাওয়া যেন সেরে ফেলে সবাই। কিন্তু বড়োরা কেউই সে-কথা শোনেননি। শাওন আর মেঘলীনাও তাই খেতে চাইছিল না। অনেকক্ষণই ‘খাবে না’ বলে জেদ ধরে বসেছিল। শেষপর্যন্ত জবরদস্তিই ওদের খাইয়ে দিয়েছেন সুছন্দা এবং অঞ্জনা।
খাওয়াদাওয়া সেরে সবে উঠেছে ওরা, পরিদাদু ঢুকলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, বিস্তর ঘোরাঘুরি করেছেন। মাথার চুল উসকোখুসকো।
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?” পরিদাদু ঘরে ঢুকতেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সুছন্দা, “বয়স হচ্ছে। এত দস্যিপনা শরীরে সইবে আর?”
“বলছি বলছি।” পরিদাদু বললেন, “আগে হাত-পা ধুই, স্নান সারি, জামাকাপড় পালটাই।”
“সেই সাত সকালে বেরিয়ে গেলি। সারাদিনে পেটে কিছু পড়েছে?” অসিতদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“নাহ্।”
“ইশ।” সুছন্দা আবার বললেন।
“কিন্তু যে কাজে বেরিয়েছিলাম সে কাজগুলো হয়েছে।” পরিদাদু হাসলেন, “যা ভেবেছিলাম তার বেশিই হয়েছে।”
“হেঁয়ালি না করে গিয়েছিলে কোথায় সেইটে বলো দিকিনি।” অরুণাংশু বললেন।
“কোথায় নয়?” পরিদাদু বললেন, “ফ্রম কলকাতা টু বাসন্তী।”
“বাসন্তী!” অবাক হয়ে বললেন অসিত রায়।
“ইয়েস স্যার।”
“কোথায়?”
“উমানাথ মজুমদারের বাড়ি।”
“অ্যাঁ! সেখানে কেন?”
“তিনিই যে রাজ-ঐশ্বর্যের পাহারাদার। তাঁর কাছে না গেলে সে-সম্পদের হদিশ পাব কী করে?”
“মানে?”
“মানেটা পেটে একটু তেল কয়লা দেবার পরে বলছি।” পরিদাদু সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন একটা টাওয়েল টেনে নিয়ে।
মেঘলীনা ফিসফিস করে শানুকে বলল, “আমাদের অভিযানটা একটু পিছিয়ে দিই, কী বল শানু? পরিকাকুর কথা না শুনে চলে যাওয়ার মানেই হয় না।”
“একদম।” মেঘলীনার কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিল শাওন।
ছয়
পরিদাদুর দুপুরের খাওয়া সারতে বিকেল হয়ে গেল। অন্যদেরও তাই। খেতে-খেতেই পরিদাদু ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “দক্ষিণবঙ্গের এই অঞ্চল প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে অত্যন্ত ইম্পরট্যান্ট। জল-জঙ্গলে ঘেরা এই যে শ্বাপদসঙ্কুল দ্বীপভূমি, আপাতভাবে মনে হতেই পারে যে এইসব অঞ্চলে মানুষের বসবাস বহু শতাব্দী আগে কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না।”
“সত্যিই তাই।” অসিত রায় বললেন, “মাতলা নদীর ও-পাড়ের অনেক দ্বীপই তো মানুষের বসবাসযোগ্য ছিল না। ওসব ছিল সুন্দরবনের অংশ। গহিন জঙ্গলে বাঘ ঘুরে বেড়াত। বিশ শতকের গোড়ায় হ্যামিলটন সাহেব জঙ্গল হাসিল করে গোসাবা দ্বীপের পত্তন করলেন। সুন্দরবনের অভাবী মানুষদের কল্যাণের কথা ভেবে সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন হ্যামিলটন সাহেব।”
“আরিব্বাস!” অরুণাংশু বললেন।
“সে সমবায় ব্যবস্থা এমনই সার্থক রূপ নিল, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তা দেখতে এলেন।”
“উনিশশো তিরিশ সালে। তাই না বাবা?” মেঘলীনা বলে উঠল।
“হ্যাঁ, ডিসেম্বরের শেষে।” অসিত মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
“কিন্তু এইখানে আমার কিছু কথা থেকে যাচ্ছে যে।” পরিদাদু বললেন।
“কী কথা?” অসিত রায় চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন।
“এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন সকলেই জানেন, হ্যামিলটন সাহেব জঙ্গল হাসিল করে গোসাবা পত্তন করার প্রায় হাজার দুয়েক বছর আগে থেকেই ও-অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল।”
“দু-হাজার?” সুছন্দা চোখ বড়ো বড়ো করে বলেন।
“প্রায়।” পরিদাদু বলতে থাকেন, “হ্যামিলটনের বাংলোর সামনে যে দিঘিটা, তার নীচে সাবেকি ইটের চাতাল, সিঁড়ি এবং ঘাটের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। লোক না থাকলে কারা বানিয়েছিল এইসব? তাছাড়া এই গোসাবা অঞ্চল থেকেই গুপ্তযুগের বিষ্ণুমূর্তি এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রাও…”
“বলিস কী!” অসিতদাদু বললেন বিস্মিত কণ্ঠে, “এটা জানা ছিল না তো!”
“গাঙ্গেয় বঙ্গভূমির একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল গুপ্ত রাজাদের অধীন ছিল। পাল-সেন রাজাদের হাত ঘুরে যা পরে প্রতাপাদিত্যের রাজত্বের মধ্যে আসে।” পরিদাদু বলতে শুরু করলেন আবার, “এই সময়টাই আমাদের কাছে সবথেকে বেশি দরকারি এই মুহূর্তে।”
“কেন?”
“রাজকার্যের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্যে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে প্রতাপাদিত্য কিছু দুর্গ নির্মাণ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি দুর্গ হল ‘হায়দরগড়’ বা ‘হায়দর দুর্গ’। মাতলা নদীর গায়ে এই দুর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে প্রতাপের এই দুর্গটিকে অনেকে ‘মাতলা দুর্গ’-ও বলেন।”
“প্রতাপাদিত্যের তৈরি দুর্গের নাম হায়দরগড় হল কী করে?” এতক্ষণ চুপ করে পরিদাদুর কথা শুনছিল শাওন। এইবার কৌতূহলী জিজ্ঞেস করল সে।
পরিদাদু হাসলেন, “দুর্গের নামকরণটা হয়েছিল হায়দর মানক্লির নামে।”
“সেটা আবার কে?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
“হায়দর মানক্লি ছিলেন প্রতাপের বিখ্যাত সেনাপতি।” খেয়েদেয়ে উঠে মস্ত একটা ঢেঁকুর তুলে অসিত রায়ের স্ত্রীর কাছ থেকে মুখে দেওয়ার জন্যে ভাজা যোয়ান আর মৌরি চেয়ে নিলেন পরিদাদু। তারপর বিছানায় মৌজ করে বসে বলতে লাগলেন, “সেই ছিল মাতলা দুর্গের অধ্যক্ষ। এই দুর্গ খনন করার সময় মাটি থেকে কয়েক কলসি সোনার মোহর ওঠে।”
“অ্যাঁ!” সকলের মুখ হাঁ, “কয়েক কলসি সোনার মুদ্রা?”
“হ্যাঁ। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলের।”
“উমানাথ মজুমদার তো এমন কথাই বলছিলেন, পরিদাদু?” শাওন অবাক হয়ে বলে।
“তিনি ঠিকই বলছিলেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই অনেক কথাই তিনি পাগলের খেয়ালে বলেন, তবু এ-কথা মানতেই হবে, ইতিহাস তিনি একটুও ভোলেননি।”
“তার মানে সত্যি সত্যিই হায়দরগড়ের অন্দরে সেই ঘড়া বোঝাই স্বর্ণমুদ্রা রয়ে গেছে?”
“সবটা কি আর আছে?” পরিদাদু হাসলেন, “তার কিছু রুদ্রাদিত্য নিয়ে পালিয়েছিলেন সে-কথা তো উমানাথবাবুর মুখেই শুনলি।”
“সত্যি?”
“হলফ করে তো বলা যায় না।” পরিদাদু শাওন আর মেঘলীনার মাথার ওপরে আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন আদর করে, “কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হবি, আদিগঙ্গার তীরেই, এখন যেখানে কালীঘাট, হেস্টিংসের আমলে মাটির নীচ থেকে সত্যি-সত্যিই পাওয়া গিয়েছিল গুপ্ত যুগের স্বর্ণমুদ্রা। এক-আধটা নয়, দুশোটারও বেশি।”
“মাই গড!” অসিত রায়ের হাঁ-মুখ বন্ধই হতে চাইছে না আর।
“তাহলে বাকি ধনসম্পদ তো হায়দরগড়েই থেকে গেল কোনও গোপন জায়গায়?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“উমানাথবাবুর কথা সত্যি হলে শুধু হায়দরগড় নয়, এই অঞ্চলের আরও কিছু দুর্গে সেগুলো ভাগ করে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল।”
“হায়দরগড় তো মাতলার গায়েই বলছিলে?” সুছন্দা আবার জিজ্ঞেস করলেন।
“হুঁ।”
“সে জায়গাটা ঠিক কোথায়? সে-গড়ের কোনও অস্তিত্বই কি আর নেই এখন?”
“উঁহু, কিছুই নেই।” পরিদাদু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন, “এমনকি হায়দরগড়ের সঠিক অবস্থান যে কোথায় ছিল, আজ পর্যন্ত বুঝে ওঠা যায়নি। শুধু একটা অনুমান…”
“কী অনুমান?” অসিত পরিদাদুর কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন।
“জায়গাটা ক্যানিংয়ের উত্তর-পূর্বে। মাতলা ও বিদ্যাধরীর মোহনার কাছে।”
“এও তো শুধু অনুমান।” অরুণাংশু বললেন।
“হ্যাঁ।”
“সে অনুমান তো ভুলও হতে পারে।”
“পারে।”
“কিন্তু ইতিহাসের ইঙ্গিত, অনুমান আর কিছু চান্স ফাইন্ডিংস-এর ওপরে ভিত্তি করেই আমাদেরকে সত্যের কাছে পৌঁছতে হয়। তেমনই একটা সত্যের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি আমরা এই মুহূর্তে।”
“কীরকম?” ভীষণ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন অসিত রায়।
“তোমার জমির কাছাকাছি জায়গা থেকে এমন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উঠে এসেছে, যা বহু প্রাচীন। তার কিছু গুপ্ত যুগের, কিছু পাল-সেন যুগের। সেগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। আর যে জিনিসটি এই অঞ্চল থেকেই পাওয়া গেছে তা সোনার জিনিস হলেও আসলে তা সোনার চেয়েও দামি।”
“কী জিনিস?” শাওন আর মেঘলীনা ছাড়া প্রায় সকলেই একই সঙ্গে বলে উঠলেন।
“দাঁড়াও, জিনিসটা দেখাই তোমাদের।” পরিদাদু উঠে তাঁর ব্যাগ থেকে মুদ্রাটা বের করে এনে নিজের হাতের চেটোর ওপরে রেখে হাত মেললেন, “দেখে নাও, এ-জিনিস এত কাছ থেকে আর কখনও দেখার সৌভাগ্য হয়তো হবে না।”
“এ তো সেই ছোঁড়াটার দেওয়া টাকাটা!” অরুণাংশু বললেন।
“হ্যাঁ।” পরিদাদু মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
“এটা কি সত্যিই অ্যান্টিক নাকি?”
“শুধু প্রাচীন নয়, মারাত্মক মূল্যবান।”
“এটা কবেকার?”
“চতুর্থ শতাব্দীর।”
“বলেন কী! এ যে হাজার বছরেরও বেশি আগের সময়!” এতক্ষণে হাতের কাজ সামলে নিয়ে অঞ্জনাও এসে যোগ দিলেন আলোচনার মধ্যে।
“এতক্ষণ যে স্বর্ণমুদ্রাদের কথা হচ্ছিল, ইনি তাদেরই একজন।”
“আরিব্বাস!” অঞ্জনা আবার বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
“ওই কুঠিবাড়ির নীচেই কি তাহলে সেই দুর্গটা, যেখানে…” শাওন জিজ্ঞেস করল চোখ গোল গোল করে।
“না।” পরিদাদু কথা শেষ করতে দিলেন না তাকে, “ওখানে এই মুদ্রাটা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।”
“কে রাখতে পারে?”
“উমানাথ মজুমদার। তিনিই পেয়েছিলেন এই মুদ্রাটা। এই একটাই পেয়েছিলেন, নাকি একটার বেশি তা অবিশ্যি আমি জানি না এখনও।”
“ওই কুঠিবাড়ির নীচে একসময় নিয়মিত নদীর স্রোত বইত জোয়ারের সময়। তখন কোনোভাবে এটা…” অসিত একটা যুক্তি খাড়া করতে চাইছিলেন। পরিদাদু মাঝপথে থামিয়ে দিলেন তাঁকে, “সম্ভবত না।”
“উমানাথের ব্যাপারটায় এতখানি নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
“মনে করে দেখ, তিনি আমাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, যে রাজ-সম্পত্তি পাহারা দিচ্ছিলেন তিনি, তা দখল নেবার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। তিনি তাই সেই গচ্ছিত সম্পত্তির কিছু কিছু ব্যাঙ্কের ভল্টে সরিয়ে রাখছেন।”
“হ্যাঁ, বলেছিলেন। কিন্তু এ-কথার তো মানেই হয় না। তিনি কি সত্যিই সেগুলো ব্যাঙ্কের লকারে-টকারে…” অসিত দু-দিকে মাথা নেড়ে বলার চেষ্টা করলেন।
“উঁহু উঁহু,” পরিদাদু মাঝপথে থামিয়ে দিলেন তাঁকে, “উনি আসলে আমাদের বিশ্বাস করে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আমরা সেই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি।”
“কী ইঙ্গিত?” অরুণাংশু রীতিমতো উত্তেজিত।
পরিদাদু হাসলেন, “কুঠিবাড়ির নীচে যে খিলানের মতো স্ট্রাকচার দেখেছিলে, যার নীচে দিয়ে মাতলার জল আসত জোয়ারের সময়, ওটি আসলে একটি টিপিকাল ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতি। কুঠি নির্মাণে এই পঞ্চ খিলান পোর্টিকোর ব্যবহার এবং ব্যারেল ভল্ট স্থাপত্যরীতি উমানাথ মজুমদারের মতো পণ্ডিত মানুষের অজানা নয়। এই ব্যারেল ভল্ট বা টানেল ভল্ট শব্দটাকেই ঘুরিয়ে ব্যাঙ্কের ভল্ট করে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক।”
কলিং বেলের উপর্যুপরি আওয়াজে কথা থামালেন পরিদাদু। অসিত বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “কার এত তাড়া বাপু, বার বার বেল বাজাচ্ছে এমন করে?”
মেঘলীনা বলল, “তোমরা বসো, আমি দেখছি।”
বাইরে বেরিয়েই বিস্ময় মাখা গলায় বলে উঠল মেঘলীনা, “কী রে, তুই!”
বাইরে থেকে বিলুর উদ্বিগ্ন গলা পাওয়া গেল, “পাগলাদাদুর খুব বিপদ। কারা যেন পাগলাদাদুকে মেরে ফেলে দিয়ে গেছে দুগ্গা ঢিবির পিছন দিকের ঝোপের মধ্যে।”
পরিদাদু, অরুণাংশু, অসিত সকলেই বেরিয়ে এসেছিলেন। পরিদাদু চিৎকার করে উঠলেন, “কী বলছিস রে তুই? উনি বেঁচে আছেন তো এখনও?”
“মনে হয় বেঁচে আছে।”
“চল, আমি এক্ষুনি আসছি।”
অসিত বললেন, “আমিও যাব তোর সঙ্গে। দেখি একটা টোটো পাওয়া যায় যদি। তেমন হলে হসপিটালাইজড করতে হবে ভদ্রলোককে এক্ষুনি।”
অরুণাংশু বললেন, “আমিও যাব?”
“নাহ্,” পরিদাদু বললেন, “দরকার নেই। তোমরা বাড়িতেই থাকো।”
ওঁরা বিলুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাইরে সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে ততক্ষণে।
সাত
দুপুরে তড়িৎ আজ বেশ তরিবত করে খাওয়াল। কেন, কে জানে। ছেলেটার মায়াদয়া আছে। তাঁকে দেখভাল করে। খেতে দেয়। বোতলে করে জল রেখে যায় রাতে। তবে বাইরে বেরোতে গেলেই আজকাল বড্ড বকাবকি করে ছেলেটা। কাল রাতে বাড়ি ফেরার পর খুব চেল্লামেল্লি করেছে। বলেছে, দরজায় তালা মেরে রাখবে এবার থেকে। কথাটা বিশ্বাস হয়নি প্রথমটা। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে উমানাথ বাড়ির মূল দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখলেন, সেটা বাইরে থেকে বন্ধ। মনে মনে খুব রাগ হয়ে গেল উমানাথের। তাঁর কি ঘরে বসে থাকলে চলে! মস্ত কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন। রাজ-সম্পদের পাহারাদারির ভার নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এ-কাজে ঝুঁকি আছে। শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে সম্পদের ঠিকঠাক সংরক্ষণ করা চাই। তাছাড়া অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ পৃথিবীতে কে কার? স্বয়ং প্রতাপাদিত্যই কি রেয়াত করেছিল রক্তের সম্পর্ককে?
লোভ বড়ো বিচ্ছিরি জিনিস। দু-দিকে মাথা নাড়াতে থাকেন উমানাথ। সামলাতে না পারলেই সর্বনাশ। কাল তোমাকে সেই লোভের শাস্তি দেবেই দেবে। মহাকালের দণ্ড প্রতাপকেও ছাড়েনি।
ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকেন উমানাথ। তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। একটা বাচ্চা ছেলে তাঁর ইচ্ছে, তাঁর চলাফেরার ওপরে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে!
সাধারণত নিজের কাছে ইদানীং রাজ-সম্পত্তি তিনি তেমন বেশি কিছু রাখেন না। সামান্যই কিছু গচ্ছিত ছিল এই বাড়িতে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে তাতেও কার যেন হাত পড়েছে। কেউ যেন গোপনে সরিয়ে ফেলতে চাইছে সেই সম্পদ। কোথায় কী যে ঘটে যাচ্ছে অগোচরে ঠিক বুঝতে পারছেন না উমানাথ। আজকাল সবকিছু মাথায় ঢুকতে চায় না ঠিকমতো।
পুরোনো টালি, পাতলা ইট, ভাঙা থালা-কলসির কিছু টুকরো এখনও আছে বাড়িতে। তাদের সঙ্গে রোজ রাতে একলা একলা কথা কন তিনি। তাদের মধ্যে ইদানীং কী একটা যেন কষ্ট বাজছে। সঙ্গী হারানোর কষ্ট। কে চলে গেছে তাদের মধ্যে থেকে? কারা চলে গেছে? আজকাল মাথা ঘামতে চায় না। জুত করে কিছু ভাবতে বসলে মাথা ঝিমঝিম করে। কষ্ট হয়। তখনই মনে হয়েছিল, রাজ-সম্পদ দ্রুত লুকিয়ে ফেলা দরকার। সুরক্ষার অভাবে সেগুলো শত্রুর হাতে পড়ে গেলে অনর্থ হতে বাকি থাকবে না আর কিছু। দিন কয়েক আগে কিছু মূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে রেখে এসেছেন ব্যারেল ভল্টের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায়। আর যা কিছু অতি মূল্যবান বলে মনে হচ্ছিল, তা ফিরিয়ে দিয়ে এসেছেন গড়ের ভেতরেই। যেখানকার জিনিস সেখানে রাখাই ভালো। কিন্তু তাই বলে নজরদারি তো বন্ধ করা চলে না। তাই দিনে রাতে ওই অঞ্চলে নজর রাখতে হচ্ছে তাঁকে। বার বার ফিরে ফিরে যেতে হচ্ছে কুঠিবাড়ির নীচে। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে মিলিয়ে নিতে হচ্ছে কোষাগারের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদ। তারপর গড়ে ফিরে গিয়ে রিপোর্ট জমা করা। অনেক কাজ, অনেক।
তক্তপোষের নীচে ঢুকে পুরোনো টিনের ট্রাঙ্কটাকে বের করে আনলেন উমানাথ। এক টানে তার ডালাটাকে খুলে ফেললেন। ট্রাঙ্কটা অদরকারি কাগজপত্রে ঠাসা। একবার ফাঁকা ঘরেই চারদিকে নজর বুলিয়ে নিলেন উমানাথ। তারপর সেই পুরোনো কাগজপত্র ছেঁড়া ন্যাকড়া সরিয়ে সন্তর্পণে বের করে আনলেন কালো পাথরের একটা ইঞ্চি চার-পাঁচ লম্বা আর ইঞ্চি তিনেক চওড়া মূর্তি। মূর্তিটা পেয়েছিলেন সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তর্গত লোথিয়ান দ্বীপ থেকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পৌঁছেছিলেন সেখানে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে মৃত্যুকে পাশ কাটিয়েছিলেন একটুর জন্যে। সেইখানেই একটি অংশে লক্ষ করেছিলেন, বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে গাছপালা নেই। একটু অনুসন্ধান করতেই একটি বহু প্রাচীন পাতলা ইটের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়েছিল। সেইখানে পেয়েছিলেন মূর্তিটাকে। কাউকে কখনও বলেননি এটার কথা। অনেকদিন ধরে যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। মূর্তিটার ওপরে মায়া পড়ে গিয়েছিল ভীষণ। কতবার মনে হয়েছে, গড় থেকে নাই-বা পেলাম, এ অঞ্চলের সব সম্পদই রাজ-সম্পত্তি। মূর্তিটা গড়ে রেখে আসাই ভালো। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। চোয়াল শক্ত করলেন উমানাথ। যে-কোনো সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে। শত্রুর চর ঘোরাফেরা করছে সর্বক্ষণ। বাইরের দরজায় আওয়াজ হতেই দ্রুত মূর্তিটা আবার লুকিয়ে ফেললেন উমানাথ। ট্রাঙ্কটা ঠেলে দিলেন তক্তপোষের নীচে।
তড়িৎ ঢুকে তাঁর দিকে চেয়ে হাসল, “কী, কেমন জব্দ? বাইরে বেরোনো কিন্তু একদম বন্ধ আপনার।”
“কেন?”
“কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ান পাগলের মতো। ওসব চলবে না।”
“আমি কি এমনি ঘুরি?” উমানাথ বিরক্তি প্রকাশ করেন, “রাজকার্যে কি ফাঁকি দেওয়া যায় হে?”
“কোন রাজা?”
“আমার পূর্বপুরুষ, ভবানন্দ।”
“আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়েও আপনি সেই রাজার হয়ে কাজ করছেন?” তড়িৎ হো হো করে হেসে ওঠে।
“গড়ের মধ্যে সময় থমকে আছে। আমি জানি। তোমরা এসব বুঝতে পারো না।”
“গড় কোথায়?”
“আছে।”
“এখানেই? মানে আমাদের কাছাকাছিই?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি জানেন জায়গাটা?”
“জানি।”
“কোথায়?”
“বলব না।”
“কেন?”
“যদি সেনা নিয়ে গিয়ে গড় লুঠ করো তোমরা?”
“কী এমন আছে সেখানে? সেনা-টেনা নিয়ে লুঠ করে পোষাবে তো আদৌ?”
“যা আছে তা সোনার চেয়েও দামি।” বলেই চুপ করে যান উমানাথ।
“আমি আসি। লক্ষ্মী হয়ে থাকবেন। আমি নিজেই আপনাকে নিয়ে বেরোব না-হয়। একা একা বেরতে যাবেন না খবরদার।”
দুপুরে খাবারদাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল তড়িৎ। নিজে এসেও দেখে গেল একবার। বলল, “বিকেলে বেরোবেন আমার সঙ্গে? চলুন একসঙ্গে আপনার গড়ে ঘুরে আসি না-হয়। আপনার সঙ্গে আমিও লেগে পড়ি পাহারাদারির কাজে।”
উমানাথ চুপ করেই রইলেন।
তড়িৎ হেসে বলল, “কী, প্রস্তাবটা পছন্দ হল না বুঝি?”
উমানাথ দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “রাজকোষের পাহারাদার হওয়া কি এতই সহজ? রাজার কাছে কত পরীক্ষা দিতে হয়। কতভাবে বাজিয়ে দেখে নেন তিনি পাহারাদারের বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি, কতটা নির্লোভ সে।”
“আপনিও পরীক্ষা দিয়েছেন?”
“আলবাত। দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা দিয়েছি। এখনও সে পরীক্ষা শেষ হয়নি।”
“বলেন কী!”
“তাহলে আর বলছি কী?”
“কে পরীক্ষা নিচ্ছে?” লঘু গলায় জিজ্ঞেস করে তড়িৎ।
“বলব না, আর কিচ্ছু বলব না।” রেগে গিয়ে বলেন উমানাথ।
উমানাথকে রেগে যেতে দেখে তড়িৎ উঠে পড়ল। “আচ্ছা আমি আসছি। আবার বলছি, একা একা বেরিয়ে পড়বেন না যেন।”
“তুমি আমাকে বন্দি করতে চাইছ?”
“ছি ছি, কী যে বলেন মাস্টারমশাই,” তড়িৎ লজ্জা পেয়ে যায়, “আপনার সেফটির জন্যেই… কোথায় যেতে কোথায় চলে যাবেন। দিনকাল ভালো নয়।”
তড়িৎ বেরিয়ে যাওয়ার পরে একটুক্ষণ অপেক্ষা করলেন উমানাথ। তারপর ধীরে ধীরে বাইরের দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন, দরজাটা এখনও খোলাই আছে। বাইরে থেকে তালা লাগানো হয়নি এখনও। দ্রুত ফিরে এসে ট্রাঙ্ক থেকে ছোট্ট মূর্তিটা বের করে নিয়ে কাপড়ে মুড়ে কাঁধ-ব্যাগে ভরলেন উমানাথ। তারপর সেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘরের বাইরে পা রেখেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন বড়ো রাস্তার দিকে।
নারায়ণতলা হাই স্কুল পেরতেই একটা টোটো উমানাথের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। উমানাথ রাস্তার আরও ধারে সরে এসে দাঁড়ালেন। চালক মুখ বাড়িয়ে হেসে বলল, “মাস্টারমশাই, কোথায় যাবেন? ক্যানিং?”
“হ্যাঁ।”
“আসুন। উঠে পড়ুন। আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”
“আমার কাছে টাকা নেই।”
“আপনাকে আমি চিনি। আসুন। টাকা লাগবে না।”
উমানাথ গাড়িতে উঠে পড়লেন। টোটো চলতে শুরু করল। ফুরফুর করে হাওয়া লাগছিল গায়ে। বেশ আরাম লাগছিল উমানাথের। চোখ বুজে আসছিল। সামনে বসে ছেলেটা গাড়ি চালাতে-চালাতেই ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে নীচু গলায়। কী বলছে উমানাথের কানে এল না। একধারে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। চোখে ঘুম নামল তাঁর।
ছেলেটার ডাকেই ঘুম ভাঙল। গাড়ি থেমেছে। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “যাবেন কোথায় এখন?”
“মিঠেখালির দিকে।”
“চলুন দিয়ে আসি।”
“না থাক।” বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন উমানাথ। কাঁধের ব্যাগটার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একবার দেখে নিলেন ভালো করে। তারপর হনহনিয়ে হাঁটা দিলেন কোনোদিকে না তাকিয়ে।
কুঠিবাড়ির কাছে যখন পৌঁছলেন, বিকেল সন্ধের দিকে গড়াতে শুরু করেছে। চারদিকটা একবার দেখে নিলেন উমানাথ। না, কেউ নেই আপাতত এই চত্বরে। দ্রুত কুঠিবাড়ির পিছন দিকে চলে গেলেন তিনি। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপ-জঙ্গল সরিয়ে ঢুকে পড়লেন একটা নির্দিষ্ট খিলানের মাঝখানের ফাঁকটার মধ্যে। কিছুদূর এগিয়ে একটা জায়গায় তিনি থামলেন। স্থির চোখে চাইলেন মাটির দিকে। দু-চোখের ভ্রূ কুঁচকে উঠল তাঁর। মাটি ঝুরো ঝুরো কেন এখানে? কেউ কি মাটি খুঁড়েছিল তাহলে? কে? রাজার সম্পদ কি লুঠ হল তাহলে সত্যি-সত্যিই? ব্যাগ থেকে ছোট্ট হাত শাবলটা বের করে উন্মাদের মতো মাটি খুঁড়তে লাগলেন উমানাথ। আর তখনই ভারী গমগমে কণ্ঠস্বরটা কানে এল তাঁর, “কী খুঁজছেন ওখানে, উমানাথবাবু?”
যেটুকু মাটি খোঁড়া হয়েছিল, তাড়াতাড়ি গর্তের মুখে চাপা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন উমানাথ। লোকটা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। বড়সড় চেহারা। ফর্সা। মাথায় চকচকে টাক। হাতের আঙুলে অনেকগুলো আংটি। উমানাথের বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে উঠল। শত্রুসৈন্য পৌঁছে গেছে তাঁর কাছে। আর রক্ষা নেই। এই লোকটাই স্টেশনের ওই ছোঁড়াটার কাছ থেকে রাজার সম্পদ লুটে নিচ্ছিল একদিন। এরা লোভী। সবাই লোভী।
গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠছে উমানাথের। খুব শিগগিরই একটা যুদ্ধ বাধতে চলেছে। দু-এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন উমানাথ। তারপর চকিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এক্ষুনি লোকটাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে লাভ নেই। বরং এখন গড় সামলানো বেশি জরুরি।
সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা ফর্সা লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুদ্দাড় দৌড় লাগালেন উমানাথ দুগ্গা ঢিবির দিকে। একবারও থামলেন না আর।
দুগ্গা ঢিবির পিছন দিকে নদীর পাড় যেদিকে, সেই আড়ালমতো জায়গার কাছে এসে যখন দাঁড়ালেন উমানাথ, তখন হাঁপরের মতো ওঠা নামা করছে তাঁর বুক। এমন হাঁপিয়ে গেছেন মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস সব ফেটে যাবে এক্ষুনি। উমানাথ হাঁ করে খানিক প্রশ্বাস নিলেন। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে জঙ্গলে মোড়া ঢালু পথ ধরে ধীরে ধীরে উঠে পড়তে শুরু করলেন দুগ্গা ঢিবির ওপর দিকে। এই ঢিবিটা তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। দিনে রাতে কতবার যে এটা ঢুঁড়ে বেড়িয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ উঠে যাওয়ার পরে ঢিবিটার গায়ে একটা গভীর খাঁজ আছে। সেই খাঁজের নীচে ঢুকে গিয়ে তিনি একটু বসলেন। জিরিয়ে নিলেন মিনিট পাঁচ-সাত। তারপর একটা আকন্দগাছের কোনাকুনি ফুট তিনেক তফাতে গর্ত করতে শুরু করলেন।
গর্তটা খোঁড়া হয়ে গেলে ব্যাগ থেকে মূর্তিটা বের করলেন উমানাথ। সন্তর্পণে শুইয়ে দিলেন গর্তের মধ্যে। আর তখনই কী একটা ভারী জিনিসের আঘাত নেমে এল তাঁর মাথার ঠিক নীচে ডান কাঁধের পাশটিতে। উমানাথ টাল সামলাতে পারলেন না। পড়ে গেলেন। কাঁধের পাশে, পিঠে টনটন করে উঠল। ঝোপ-জঙ্গলে ঠোক্কর খেতে খেতে গড়িয়ে নেমে এলেন অনেকখানি। উমানাথ বুঝতে পারছেন হাত-পা ছিঁড়ে যাচ্ছে, কেটেকুটেও যাচ্ছে খানিক। গায়ের জামাটা বোধ হয় ছিঁড়েও গেল। গড়িয়ে পড়তে পড়তেই একটা বড়ো গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেলেন উমানাথ। মাথা ঠুকে গেল। চরাচর জুড়ে আঁধার নামছে তখন। সে অন্ধকারের চেয়েও আরও ঘন অন্ধকার নেমে এল তাঁর চোখ জুড়ে।
আট
পরিদাদুরা যখন ফিরলেন তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। মাঝে হসপিটাল থেকে অসিতদাদু একবার ফোন করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, উমানাথের যথেষ্ট চোট লেগেছে ঠিকই, কিন্তু এই মুহূর্তে প্রাণসংশয় আর নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা হয়েছে। শরীরের কাটাছেঁড়া জায়গাগুলোয় ড্রেসিং করে ওষুধ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্টিচ করতে হয়নি কোথাও। তাঁকে ক্যানিং সাব-ডিভিশনাল হাসপাতালেই ভর্তি করে দিচ্ছেন তাঁরা আপাতত। পুলিশকেও পুরো বিষয়টা ইনফর্ম করা হয়েছে। তাঁরাও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন যা তাঁদের নেবার। শাওনরা খানিক নিশ্চিন্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু উৎকণ্ঠা ছিলই। পুরো ব্যাপারটা শোনার জন্যে মন আনচান করছিল শাওনের। মেঘলীনার অবস্থাও তথৈবচ।
শাওনের দিকে চেয়ে সুছন্দা রাগ দেখিয়ে বলছিলেন, “এসব ঘটনার কথা শুনলে আমার ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। আর শানুটাকে দেখো, ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট দেখল তো আহ্লাদে আটখানা। পরিকাকুর যোগ্য নাতি। রহস্য দেখল তো নাচতে শুরু করল।”
“সঙ্গে আরও একজন জুটেছে এখন।” অঞ্জনাও তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন হাসতে হাসতে।
পরিদাদু ফিরেই বললেন, “এক কাপ চা খাওয়াও।”
অঞ্জনা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে অসিতের দিকে চেয়ে বললেন, “এত রাতে চা? একেবারে রাতের খাবার খেয়ে নিলেই তো পারো সবাই। যা ধকল গেল সন্ধে থেকে!”
অসিত বললেন, “ওইজন্যেই তো চা দরকার এক রাউন্ড।”
“আচ্ছা বেশ, আমি চায়ের জল চড়িয়ে দিচ্ছি। তোমরা হাতমুখ ধুয়ে নাও তাড়াতাড়ি।” অঞ্জনা অরুণাংশুর দিকে তাকালেন, “আপনিও খাবেন নাকি এক কাপ?”
“আলবাত। এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে নাকি?” অরুণাংশু হাসলেন।
পরিদাদু আর অসিতদাদু চায়ের টেবিলে এসে বসতেই অরুণাংশু বলে উঠলেন কৌতূহলী গলায়, “কী ব্যাপার বলো দেখি পরি? কেস কি গোলমেলে নাকি?”
“পরিকাকু উপস্থিত রয়েছে অথচ কেস গোলমেলে হবে না? তুমিও যেমন! এমন হয়েছে কখনও আজ পর্যন্ত? বুঝতে পারছ না, পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে ব্যাপারটা! কেস গোলমেলে না হলে থানাপুলিশ আসবে কেন এর মধ্যে?”
“আহ্, থামো না!” সুছন্দাকে থামিয়ে দিলেন অরুণাংশু, “পরিকে বলতে দাও।”
“ব্যাপারটা সত্যিই খুব সরল নয়।” পরিদাদু হাসলেন, “একটা অন্তর্ঘাত, একটা ষড়যন্ত্র তো আছেই। নইলে বৃদ্ধ উমানাথকে আঘাত করে ঢিবির ওপর থেকে কারও ফেলে দেবার দরকার হবে কেন?”
“আচ্ছা, তুই এ বিষয়ে এত নিশ্চিত হচ্ছিস কী করে বল তো?” অসিত রায় বললেন, “উমানাথ মজুমদার ভদ্রলোক তো ওই দুগ্গা ঢিবির দিকে প্রায়শই যাতায়াত করতেন। ওই ঢিবির ওপরে উঠতেনও। অন্যেরা মা দুর্গার স্থান বলে ঢিবিটাকে এড়িয়ে গেলেও উনি ওসব মানতেন না। মাথা খারাপ থাকলে যা হয়। তখন তো আর এইসব জ্ঞানগম্যি থাকে না মানুষের, গোঁ ভরে ঢিবির ওপরে উঠতে গিয়ে বয়স্ক মানুষ, নিজেই হয়তো পড়েছেন পা-ফা পিছলে গিয়ে।”
“আজ্ঞে না স্যার।” পরিদাদু মাথা নাড়লেন, “ওই ঢিবিতে অন্য লোক ছিল।”
“কী করে জানলে?” মেঘলীনা জিজ্ঞেস করল।
“আমি ঢিবিতে উঠেছিলাম। সেখানে মোবাইলের টর্চের আলোয় দেখেছি গুটখার প্যাকেট পড়ে আছে। টাটকা। তাছাড়া ওখানে আরও এমন কিছু সূত্র আমি পেয়েছি…”
“কী ভয়ানক!” মেঘলীনা ডান হাতের চেটো নিজের মুখের কাছে তুলে আনল আতঙ্কে। পরিদাদুকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “তুমি দুগ্গা ঢিবিতে পা দিলে? তোমার ভয় করল না?”
“ভয় করবে কেন?” পরিদাদু মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।
“ওটা যে দুগ্গা ঢিবি, মা দুর্গার থান! ওখানে পা দেওয়া বারণ। ওখানে ওঠার জন্যেই তো উমানাথদাদু পাগল হয়ে গেলেন।” মেঘলীনা আবার বলে।
“ওটা দুর্গা ঢিবি নয় মেঘলীনা।” পরিদাদু মিটিমিটি হাসছেন এখন।
“নয়! কী বলছেন? সবাই তো বলে…” অঞ্জনা বলে উঠলেন।
“একটা কথা দীর্ঘদিন ধরে মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে খানিক বদলে গেছে। অবিশ্যি বদলে গেছে বলেই রক্ষে। নইলে সবই লুঠপাট হয়ে যেত এতদিনে।”
“তুইও যে উমানাথবাবুর মতো কথা বলতে শুরু করলি, পরি!” অসিত রায় বললেন।
“মানে?” অরুণাংশু অবাক হয়ে বললেন।
“জ্ঞান ফেরার পরে উমানাথবাবুকে যতবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে তিনি পড়লেন কীভাবে আর কেনই-বা ওখানে উঠেছিলেন তিনি, ততবারই ক্ষীণ কণ্ঠে একটাই কথা বলেছেন তিনি, গড় লুঠ হয়ে যাচ্ছে, গড় রক্ষা করতে পারলেন না তিনি।”
“আশ্চর্য!” অঞ্জনা, সুছন্দা দুজনেই বললেন একসঙ্গে, “দুগ্গা ঢিবির কাছে আবার গড় কোথায়?”
“আছে। তিনি ঠিকই বলেছেন।” পরিদাদু গম্ভীর মুখে বললেন।
“আছে?” এবারে অসিত নিজেও অবাক।
“আছে বলেই তো তোমার জমিটার অমন আকাশছোঁয়া দাম হয়ে গেছে হঠাৎ করে। বাড়ি এসে পাণিগ্রাহী এমনি এমনি কি খোশামোদ করছেন তোমায় জমিটা তাঁকে বেচে দেবার জন্যে?”
“মানে?”
“ওই যে একটু আগে বলছিলাম, একটা শব্দ কালের স্রোতে খানিক বদলে গিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে এখন, আর সেই ভুল উচ্চারণই আড়াল করে রেখেছে এই অঞ্চলে থাকা প্রতাপাদিত্যের প্রাচীন দুর্গটাকে।”
“একটু খুলে বলো না পরিকাকু!” সুছন্দা অস্থির গলায় বললেন।
“দুর্গা ঢিবি নয়, ওটা দুর্গ ঢিবি।” পরিদাদু বললেন, “দুর্গটা ধ্বংস হবার পর গাঁয়ের লোকেরা ওটাকে দুর্গ ঢিবিই বলত নিশ্চিত একসময়। পরে সেটা মুখে মুখে দুর্গা ঢিবি বা দুগ্গা ঢিবিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।”
“তাই তো, তাই তো!” লাফিয়ে উঠলেন অসিত রায়, “এই সামান্য কথাটা আমার নিজের মাথাতেই তো আসা উচিত ছিল এতদিনে! আমি সত্যিই গবেট রে পরি।”
“নিজের সম্পর্কে এতদিনে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে অবশেষে।” অঞ্জনা ফুট কাটলেন, “থ্যাঙ্ক ইউ পরিমলদা।”
হো হো করে হেসে উঠলেন সুছন্দা, পরিদাদু এবং অরুণাংশু। এমনকি অসিত নিজেও।
“উমানাথদাদুর ওপরে অ্যাটাকটা ওই রতন পাণিগ্রাহীই করেনি তো পরিদাদু?” শাওন বলে উঠল।
“হতেই পারে। রতন পাণিগ্রাহীকে এ অঞ্চলে দেখাও গেছে বিকেলের দিকে। বিলু বলেছে আমাকে। ওর সঙ্গেও দেখা করেছিল লোকটা।”
“তাহলে ওই লোকটাকে ডেকে পুলিশকে দিয়ে যদি জেরা করানো যায়…” অরুণাংশু বললেন।
“দেখছি।” পরিদাদু মাথা নেড়ে সায় দিলেন, “তমোঘ্নকে জানিয়েছি সব। প্রতিদিনই ফাইন্ডিংসগুলোকে ব্রিফ করে যাচ্ছি ওকে। কাল ও আসছে। সকাল দশটার মধ্যে। আমাকে বলেছে তার মধ্যে আমি নিজে থেকে আর কিচ্ছুটি যেন না করি। সেইজন্যেই। না হলে…”
“না হলে কী, পরিদাদু?” শাওন বলে। তার খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, পরিদাদুর হাত থেকে রহস্যের শেষ মোড়ক খোলার কাজটা যেন তমোঘ্নদাদুর হাতে চলে যাচ্ছে ক্রমাগত। ব্যাপারটা তার ভালো লাগছিল না একটুও।
নয়
পরিদাদু যথারীতি সক্কালবেলা ঘুম থেকে উঠে এক রাউন্ড ঘুরে এসেছেন বাইরে থেকে। ফিরে এসে বললেন, “কতকগুলো বিষয়ে ডাউট ক্লিয়ার করার দরকার ছিল।”
অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন, “ডাউট ক্লিয়ার হল?”
“হল।” পরিদাদুকে বেশ ফুরফুরে লাগছিল, “আমার যে বয়স হচ্ছে তা বেশ মালুম হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই মাথার ঘিলুটা গোবরে পরিণত হচ্ছে আজকাল।”
“সত্যিই যদি এই উপলব্ধিতে পৌঁছও তো বাঁচি বাপু।” সুছন্দা বললেন, “এইসব রহস্য-টহস্যের পিছনে দৌড়নো বন্ধ হয় তাহলে।”
অরুণাংশু হাত নেড়ে বললেন, “বাজে কথা রাখো।” তারপর পরিদাদুর দিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা পরি, তোমার এই ডাউট ক্লিয়ারিংয়ের জন্যে সকাল থেকে কোথায় কোথায় যেতে হল?”
“স্টেশনে বিলুর কাছে, হাসপাতালে উমানাথ মজুমদারের কাছে আর বাসন্তীতে তড়িৎ সেনগুপ্তের কাছে।” পরিদাদু হাসলেন।
“তড়িৎ সেনগুপ্তের কাছে কেন?”
“ওঁকে আজ এখানে আসার জন্যে নেমন্তন্ন করলাম।” পরিদাদু বললেন, “বিলুকেও আসতে বলেছি। আর তমোঘ্ন তার এক বন্ধুকে নিয়ে আসছে বলল। অঞ্জনার আপত্তি নেই তো? আজ কিন্তু সকলেই আমাদের অতিথি। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত কিন্তু সকলের এখানেই।”
“আরে দারুণ ব্যাপার! অনেকদিন পর বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব আসছে। যাই, আমি তাহলে একপ্রস্থ বাজার থেকে ঘুরে আসি।” বলে উঠে পড়লেন অসিত রায়।
“কখন আসছেন তাহলে আমাদের অতিথিরা?” অঞ্জনা জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে তো সেইভাবেই তৈরি থাকতে হবে। আতিথ্যে ত্রুটি হলে যে আপনার বদনাম, পরিমলদা। সে বদনাম আমি কি হতে দিতে পারি?”
“তমোঘ্ন বেরিয়ে পড়েছে ভোরবেলাতেই। এতক্ষণে ক্যানিং পৌঁছেও গেছে হয়তো।”
“ওঁকে কি তোমায় আনতে যেতে হবে?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“না, দরকার হবে না। আমি এ-বাড়ির ডিটেইল দিয়ে দিয়েছি। অসুবিধা হবে না।”
“তাহলে এসেই তো পড়বেন উনি এক্ষুনি।” অঞ্জনা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
“অত ব্যস্ততার দরকার নেই।” পরিদাদু ঘড়ি দেখলেন, “এখন সোয়া ন’টা। ওর আসতে আসতে সাড়ে দশটা-এগারোটা হবে। বিলুকেও ওইরকম সময়েই আসতে বলে দিয়েছি আমি। তড়িৎ আসবে আর একটু পরে। এই ধরো সাড়ে বারোটা-একটা নাগাদ।”
“তমোঘ্নবাবু এতক্ষণ কোথায় কাটাবেন? দুগ্গা ঢিবি ঘুরে আসবেন নাকি?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
“সে সম্ভাবনা তো আছেই।”
“আর ওঁর বন্ধু? একসঙ্গেই আসছেন তো?”
“বন্ধু আপাতত ক্যানিংয়েই আছেন। তাঁর কাছেই এসে উঠছে তমোঘ্ন। ওরা একসঙ্গেই আসবে এখানে।”
“বন্ধু ক্যানিংয়ে? এখানেই বাড়ি? কে পরিকাকু? আমরা চিনি?” মেঘলীনা আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আপাতত এর বেশি বলছি না কিছু। সাসপেন্স।” পরিদাদু হাসলেন, “বাকিটা নাটকের শেষ দৃশ্যে।”
***
তমোঘ্ন ভট্টাচার্য ঢুকলেন এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট নাগাদ। কলিং বেলটা বাজতেই দৌড়ে গেল শাওন আর মেঘলীনা। দ্রুত দরজা খুলল। আর দরজা খুলেই বেজায় চমকে গেল দুজনেই। তমোঘ্ন ভট্টাচার্যের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি তাঁকে বিলক্ষণ চেনে তারা। ফর্সা, বড়সড় সুগঠিত চেহারা। দু-হাতের আঙুলে অনেকগুলো আংটি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
পরিদাদু উঠে এসে অভ্যর্থনা জানালেন, “ওয়েলকাম তমোঘ্ন। ওয়েলকাম এগেইন মিস্টার বোস।”
“মিস্টার বোস?” অবাক হয়ে পরিদাদুর দিকে চাইল শাওন। মেঘলীনাও একেবারে অবাক।
ঘরে ঢুকেই তমোঘ্ন বললেন, “সময়টা অন্যরকম। ফর সেফটি, আমরা আগে হাতমুখটা ধুয়ে নিই। তারপর কথা।”
ঘরে সকলে বসার পরে পরিদাদু পরিচয় করিয়ে দিলেন, “তমোঘ্ন, এই আমার বাল্যবন্ধু অসিত, তার বেটার হাফ অঞ্জনা আর কন্যা মেঘলীনা। বাকিদের তুমি তো চেনো।”
“হ্যাঁ, বহরমপুরে আলাপ হয়েছিল।” মাথা নাড়লেন তমোঘ্ন ভট্টাচার্য।
“আর আমার বন্ধু তমোঘ্ন।” পরিদাদু তমোঘ্ন ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের একজন হোমরাচোমরা।”
“আর এই আমার বন্ধু রজতাভ বসু।” তমোঘ্ন আলাপ করিয়ে দিলেন, “গোয়েন্দা বিভাগের অত্যন্ত করিৎকর্মা মানুষ। সারা ভারতবর্ষ জুড়েই আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের স্মারকগুলিকে পাচার করার একটা দুষ্টচক্র ছড়িয়ে আছে। বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বেআইনি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত এরা। রজতাভরা সেই চক্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয়। ওর মতো সৎ এবং সাহসী মানুষদের জন্যেই আমরা আমাদের ইতিহাসকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখতে পারছি।”
“এটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আমি বাড়তি কিছুই করিনি।” লাজুক গলায় বললেন রজতাভ।
“আর কী আশ্চর্য, আমরা তো আপনাকেই পাচারকারী ভেবে বসেছিলাম প্রথম থেকে! বিলুর কাছ থেকে পুরাতাত্ত্বিক জিনিস কেনা, আমার জমির দিকে ডবল দাম দিয়ে হাত বাড়ানো…” অসিত লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন।
“আর আমি সন্দেহ করেছিলাম আপনাকে।” হো হো করে হেসে উঠলেন রজতাভ, “ভেবেছিলাম ওই তড়িৎ সেনগুপ্তদের সঙ্গে নিশ্চিত যোগ আছে আপনারও। আপনার জমির কাছ থেকে অ্যান্টিক জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে, টুকটাক বিক্রিও হচ্ছে তা, সে-বিষয়ে আপনার হাত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রতন পাণিগ্রাহী সেজে তাই আপনাকে টোপ দিয়ে দেখলাম। কথাবার্তা বলে আপনাদের মোটিভ বোঝার চেষ্টা করলাম। দ্বিতীয় দিনে কথা বলার সময় পরিমলবাবুকে দেখে সন্দেহ বাড়ল বৈ কমল না। কিন্তু হিসেব গোলমাল হয়ে গেল পরিমলবাবুর ছবি তমোঘ্নকে হোয়াটস অ্যাপ করার পরেই।”
“আমার ছবি কখন কীভাবে তুললেন!” পরিদাদু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“ঠিক যেমন আমার ছবি তুলেছিলেন আপনি, আমাকে জানতে না দিয়ে। আর সে-ছবি ওই তমোঘ্নকেই পাঠিয়েছিলেন খোঁজখবর করার জন্যে। আপনার এক বন্ধুকেও তো পাঠিয়েছিলেন। কলকাতায়। কিউরিও শপ আছে যাঁর।” রজতাভ হেসে ফেললেন।
পরিদাদু লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে ফেললেন।
অরুণাংশু বললেন, “তড়িতের ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন?”
“হ্যাঁ, তড়িৎ।” রজতাভ অসিতের দিকে চাইলেন, “শুরুতেই একটা ইনফর্মেশন আপনাদের দেওয়া উচিত ছিল আমার। আমি সামহাউ মিস করে গেছি।”
“কী বলুন তো?” অসিত জিজ্ঞেস করলেন অবাক হয়ে।
“আজকের লাঞ্চে আপনাদের অতিথিদের তালিকায় কিন্তু তড়িৎ সেনগুপ্ত থাকছে না।”
“সে কি, তাকে যে দরকার!”
“দরকারটা আমি মিটিয়েই এসেছি পরিমলবাবু।” রজতাভ হাসলেন, “তড়িৎ এখন পুলিশ কাস্টডিতে। উমানাথবাবুর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কিছু বহু প্রাচীন মৃৎপাত্র, তামার মাদুলি এবং একটি প্রাক-বঙ্গলিপিযুক্ত মৃৎফলক বিভিন্ন সময় সরিয়ে ফেলে তড়িৎ। এগুলিই কলকাতায় বিক্রি করার সময় আমাদের নজরে আসে সে। বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর নিয়ে আমরা তার ওপরে নজরদারি করতে শুরু করি।”
“বাপ রে!” অঞ্জনা অবাক হয়ে বলেন।
“আসলে প্রথমটা সে এত বুঝে কাজটা করেনি। একটা জিনিস গোপনে সরিয়ে নিয়ে কলকাতায় পুরোনো জিনিসের দোকানে বিক্রি করতে গিয়ে ভালো দর পেয়ে গিয়ে মাথা ঘুরে যায় ছেলেটার।” পরিদাদু বলেন।
“এগজ্যাক্টলি।” রজতাভ সায় দেন তাঁর কথায়, “তড়িতের ফোন নাম্বার হাতে এসে যাওয়ার পর আমি ক্রেতা সেজে ওকে ক্রমাগত টোপ দিতে থাকি। নিজেও চলে আসি এই এলাকায়। তদন্ত করে এই এলাকার প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তমোঘ্নকে ইনফর্ম করি আমি। উমানাথবাবুর সঙ্গে বার বার কথা বলে আমি বুঝতে পারছিলাম, শুধু কিছু মৃৎপাত্র বা তাম্র মাদুলি নয়, তাঁর সন্ধানে আরও মূল্যবান কিছু বস্তু রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কী, তা আমি জানতে পারছিলাম না কিছুতেই। যে-কোনো কারণেই হোক, তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না। এর মধ্যেই পরিমলবাবু পুরো বিষয়টির মধ্যে ইনভলভড হলেন।”
“ব্যাপারটা যে তলে তলে এত দূরে গড়িয়ে গেছে তা আমি বুঝতেই পারিনি। তমোঘ্নও কিচ্ছুটি বলেনি আমায় আগে।” পরিদাদু বললেন।
“আমিই বারণ করেছিলাম।” রজতাভ হাসলেন, “তবে এ-কথা মানতেই হবে, আপনি সঙ্গে থাকায় আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। আর সত্যি-সত্যিই যদি এই কেসে ম্যান অফ দা ম্যাচ কাউকে বাছতে হয় সে হল…”
ডিং ডং ডিং ডং শব্দে কলিং বেল বেজে উঠল অনভ্যস্ত হাতে।
মেঘলীনা বলল, “বিলু।”
“ম্যান অফ দা ম্যাচ কে বলছিলেন যেন?” অরুণাংশু রজতাভের কথার খেই ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
“ওই যে তিনি এসে গেছেন।” রজতাভ হাসলেন, “কী বলেন, পরিমলবাবু?”
“বিলু!” অবাক হয়ে বলে শাওন।
“ইয়েস, বিলু।” ওপর-নীচ মাথা নাড়েন রজতাভ, পরিদাদু দুজনেই, “মূলত ওর জন্যেই উমানাথবাবুর কাছে গচ্ছিত সবচেয়ে মূল্যবান দুটি বস্তুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে আমাদের পক্ষে।”
“তার মধ্যে গুপ্তযুগের একটি স্বর্ণমুদ্রা। আর অন্যটি?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
“স্বর্ণমুদ্রা একটি নয়, পাঁচটি।” রজতাভ তাঁর ব্যাগ খুলে পরপর চারটি মুদ্রা টি-টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রাখলেন, “আরেকটি আছে পরিমলবাবুর কাছে।”
“কোথায় পেলেন এগুলো, কুঠিবাড়ির টানেল ভল্টে? মাটির নীচে?”
“হ্যাঁ।” রজতাভ বলে চললেন, “উমানাথবাবু বুঝতে পারছিলেন, কে বা কারা তাঁর সঞ্চিত প্রত্নবস্তুগুলো সরিয়ে ফেলছে ঘর থেকে। মাথা পুরোপুরি কাজ না করলেও এই বস্তুগুলো যেহেতু তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ছিল তাই চুরির হাত থেকে বাঁচাতে এগুলো একটা সেফ কাস্টডিতে রাখতে চাইছিলেন তিনি।”
“আমাকেও এ-কথা তিনি বলেছিলেন। ইন ফ্যাক্ট আজ সকালে আমি ব্যারেল ভল্টের মাটি খুঁড়েওছিলাম। পাইনি কিছু। ভেবেছিলাম মুদ্রা তাহলে বোধ হয় একটাই ছিল।” পরিদাদু বললেন।
“আমি এই কাজটা কালই সেরে ফেলেছিলাম। তারপরেই দেখলাম উমানাথবাবু মুদ্রাগুলো না পেয়ে পাগলের মতো ছুটলেন দুগ্গা ঢিবি, আই মিন দুর্গ ঢিবির দিকে। আমার মনে হয়েছিল, নিশ্চিত সেখানেও কিছু লুকোনো সম্পদ আছে তাঁর। আমি তড়িৎকে ফোন করি। তখনও জানতাম না, সে উমানাথবাবুর পিছনে লোক লাগিয়েছে। রাতে উমানাথবাবুর দুর্ঘটনার খবর পেলাম তমোঘ্নর কাছ থেকে। তার কিছুক্ষণ পরেই তড়িতের ফোন, ভালো মাল আছে।”
“তারপর?” শাওন জিজ্ঞেস করে।
“আজ সকালে বিলুর কাছে গিয়ে জানতে পারলাম দুগ্গা ঢিবিতে খোঁড়াখুঁড়ির কথা।”
“তুই কী করে জানলি?” মেঘলীনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল বিলুকে।
“কাল বিকেলে স্টেশনের বাইরের চা দোকানে তড়িৎদার সঙ্গে কয়েকজনের শলাপরামর্শ হচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন টোটো চালায়। সে বলছিল, ঠিক সময়েই পৌঁছে দিয়েছি প্ল্যান মতন। ব্যাগে একটা কিছু ছিল। শিওর। আমায় বলেছিল মিঠেখালি যাবে। কিন্তু খানিক পিছু নিয়ে দেখলাম দুগ্গা ঢিবির দিকে ছুটল। শুনেই কাদের যেন ফোন করল তড়িৎদা। বলল, মনে আছে তো, যেমন বলেছিলাম?”
“কই, কাল আমাদের কিছু বলিসনি তো?” অসিত বললেন বিরক্ত হয়ে।
“কাল বিকেলে যখন কথাগুলো শুনেছিলাম, বুঝতে পারিনি ওরা পাগলাদাদুকে নিয়ে কথা বলছে। তারপর সন্ধেবেলায় ওই কাণ্ড ঘটে গেল। তখন আর মাথার ঠিক ছিল না। আজ সকালে মাথায় এল ঘটনাটা। আপনাদের দুজনকেই তো বললাম সে-কথা সকালবেলা।” বিলু পরিদাদু আর রজতাভর দিকে তাকাল।
“ঠিক আছে। দারুণ কাজ করেছিস।” অসিত বললেন, “কিন্তু রজতাভবাবু, উমানাথ কী যেন একটা নিয়ে দুগ্গা ঢিবিতে রাখতে গিয়েছিলেন…”
“আমার টোপ গিলে সেইটে বিক্রি করতে এসেই তো বেচারা তড়িৎ অ্যারেস্ট হয়ে গেল আজ।”
“জিনিসটা কী, দেখতে পাওয়া যাবে একবার?”
“নিশ্চয়ই।” রজতাভ তমোঘ্নকে ইশারা করলেন।
তমোঘ্ন তুলোর প্যাডের মধ্যে খুব যত্ন করে রাখা একটা ছোট্ট কালো পাথরের মূর্তি বের করলেন ব্যাগ থেকে। লম্বায় চার-পাঁচ ইঞ্চি, চওড়া তিন ইঞ্চিমতো।
সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন, “মূর্তিটা কোন দেবতার?”
“বিষ্ণু।”
“কতদিন আগের?”
“সম্ভবত পাল-সেন আমলের।” তমোঘ্ন বললেন, “আর একটু স্টাডি করে তবে নিশ্চিত হতে পারব।”
সুছন্দা বললেন, “একবার আমার হাতে দেবেন? কপালে ঠেকাব।”
দশ
তমোঘ্ন এবং রজতাভ ফেরার সময় পরিদাদু এবং অসিত দুজনেই জিজ্ঞেস করলেন, “দুর্গ ঢিবির কী হবে তাহলে?”
“আমরা এখনও পর্যন্ত যা পেয়েছি তার সবটাই চান্স ফাইন্ডিং। অর্থাৎ হঠাৎ করেই প্রত্নবস্তুগুলো আমাদের হাতে এসেছে, যা প্রমাণ করছে জায়গাটির প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে। এইবার সরকারিভাবে আমরা চেষ্টা করব যাতে এই অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎখননের কাজ শুরু হয়।”
“সে-কাজ শুরু হতে কতদিন?”
“তা তো বলতে পারি না,” তমোঘ্ন হাসলেন, ‘বোঝেনই তো সব। সরকারি কাজ…”
“আপাতত দুটো কাজ করা যায়। ভেবে বলো তো।” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“কী কাজ?” তমোঘ্ন বললেন।
“উমানাথের সঠিক চিকিৎসা আর বিলুর জন্যে একটা সঠিক পুনর্বাসন।”
“হুঁ।” মাথা নাড়লেন তমোঘ্ন, “আমরা নিশ্চিত চেষ্টা করব।”
“যতদিন সে ব্যবস্থা না হয় বিলু আমার কাছেই থাকুক।” অঞ্জনা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “কী রে থাকবি তো? আমি তোকে পড়াব। স্কুলে ভর্তি করে দেব তোকে।”
বিলু উত্তর দিল না। মাথা নীচু করল সে। তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপ টপ করে ঝরে পড়তে লাগল মেঝের ওপরে।
অলঙ্করণ- উপাসনা ও শ্রীময়ী
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
উফফফফ, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। সবশেষে বিলুর পুরস্কার প্রাপ্তি স্বরূপ পড়াশোনা শেখার নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যাপারটা পড়ে আনন্দে দু চোখ ভিজে উঠল।
LikeLike