উপন্যাস-ছিরুচোর ও গদাইদারোগা-দেবদুলাল কুণ্ডু শরৎ ২০২২

দেবদুলাল কুণ্ডুর আগের উপন্যাস- সোনালি ভেড়ার লোমের খোঁজে

।। এক।।

পিতলের ঘটি

uponyaschiruchor (2)

সিঁদকাঠিটা জোরে বাগিয়ে ধরে ছিরু ধীরে ধীরে একটু সময় নিয়ে দাওয়ার মাটিটা কাটল। কাটার আগে মাটিটা পরীক্ষা করে নিয়েছে এঁটেল, দো-আঁশ না বালিমাটি। একেক ধরনের মাটির জন্য একেকরকম কাঠি। এই কাঠিগুলো মেধো ঠাকুরের তৈরি। ফালতুগর্তপুর এলাকায় সে-ই হল চোরেদের পান্ডা।

ছিরুর ভালো নাম শ্রীদাম, অপভ্রংশে ছিদাম। সে মেধো সর্দারের দূরসম্পর্কের ভাইপো। বয়স কুড়ি-পঁচিশ হবে। কৈশোরে বাপ-মাকে হারিয়ে ছিরু মেধোর কাছেই মানুষ। আজ রাতে ওর প্রথম পরীক্ষা। মেধোর অধীনে প্রায় কুড়ি-বাইশ জন চোর আছে। তারাই চুরির মালের হিসসা দেয় মেধোকে। মেধোই তাদেরকে তৈরি করেছে। সিঁদকাঠিগুলোও তার। কাজ শেষ করে তারা ভোররাতে সিঁদকাঠি বা অন্য জিনিসগুলো জমা দেয় মেধোর কাছে।

এদিন সন্ধ্যায় মেধো পই পই করে বলে দিয়েছে ছিরুকে, ‘ধরা পড়লেও আমার নাম মুখে নিবি না। নির্বিকার চিত্তে মার খাবি, কান মুলবি আর দোষ স্বীকার করবি। এক গ্রামে একবারের বেশি দু-বার যাবি না। সিঁদ কাটার অন্তত দু-দিন আগে টার্গেট করবি বাড়িটাকে, খোঁজখবর নিয়ে তারপর একরাতে অপারেশন করবি। আরেকটা কথা, সিঁদ কাটতে যাবার আগে সারা গায়ে ভালো করে সরষের তেল মেখে নিবি।’

সিঁদ কাটতে অন্তত দশ মিনিট সময় লাগল ছিরুর। ওর পরনে একটা মাত্র হাফ প্যান্ট। গর্তের ভেতর দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতরে তাকাল সে। দেখল একটা মাত্র হ্যারিকেন জ্বলছে। মসীমাখা কাচের আবছা আলোতে ঘরের ভেতরটাকে ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছে না। মেঝে থেকে উঠতে গিয়ে ঠং করে মৃদু শব্দ হল; মেঝেতে রাখা স্টিলের বাসনের উপর বে-খেয়ালে পা লেগেছে ছিরুর।

“ওরে রামু, একটু তো দেখে শুনে চলাফেরা করতে পারিস! দেখিস, আমার ঘটির জল যেন ফেলে দিস না বাছা।” পাশের শয্যা থেকে একটা বুড়ি খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল।

যাক বাবা, জোর বাঁচা বেঁচে গেছি। বুড়িটা বুঝতে পারেনি, এই যা রক্ষে। ছিরু চারপাশে চোখ বোলাল। অপ্রশস্ত ঘর। দক্ষিণদিকে একটা ছোট্ট চৌকি। বেড়ার পাশে দড়িতে ঝুলছে কয়েকটা কাপড়। মেঝেতে পরিপাটি করে সাজানো কয়েকটা বাসন। আর চৌকির ঠিক নীচে বুড়ির মাথার কাছে একটা পেতলের ঘটি। ঘটিটা দেখে লোভে চকচক করে উঠল ছিরুর চোখ।

“কী রে রামু, আর কোন সাড়া নেই যে তোর?” বুড়িটা আবার বলল।

ঠিক তখনই একটা ‘মিউ’ ডাকে চমকে উঠল ছিরু। ভালো করে চেয়ে দেখল বুড়িটার ঠিক পায়ের কাছেই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল বিড়ালটা।

“ওহ্‌, তুই এখানে, রামু!” বুড়িটা বলল।

যাক বাবা! বাঁচা গেল! রামু তাহলে বুড়ির পোষা বিড়াল। এবারে ঘটিটা নিয়ে সটকে পড়ি। যখনই ছিরু হাত বাড়াল ঘটিটার দিকে, ঠিক তখনই বুড়ি নীচু হয়ে মেঝে থেকে ঘটিটা ধরতে গেল জল খাবে বলে। দুজনেই একসঙ্গে ঘটিটা ধরল।

“কে?” চমকে গিয়ে বুড়ি চেঁচিয়ে উঠল। দুজনেই ঘটিটা ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। ঘটিটা মেঝেতে পড়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

“আ-আমি ছিরু।” ধরা পড়ে গিয়ে গলার স্বর কাঁপতে লাগল।

“তুমি ঘরে ঢুকলে কী করে?”

“সিঁদ কেটে। আমি চলে যাচ্ছি। দোহাই লোক ডাকবেন না।”

“চোখে দেখতে পাইনে। আমার কাছে দিনরাত সমান। এই রাতে কাকে আবার ডাকব বাবা?”

“চোখে দেখতে পান না?”

“না গো বাছা। তোমাকে বাছা বলেই ডাকলাম। গলা শুনে মনে হচ্ছে তুমি খুব ছোট্ট ছেলে হবে।”

“কী হয়েছিল আপনার?”

“বছর চারেক আগে মায়ের দয়া হয়েছিল; ওই তোমরা যাকে পক্স না কী যেন বলো। আর তাতেই চোখ দুটো নষ্ট হয় গেল আমার।”

ছিরু এবারে সাহসে ভর করে সামনে এগিয়ে এসে বুড়ির মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল। হ্যাঁ, বুড়ির সারা মুখে বসন্তের দাগ আছে বটে।

“বুড়িমা, তোমরা আর কেউ নেই?”

“আছে বাছা, আছে। তোমরা মতো সোমত্ত ছেলে আছে আমার। গত বছর বিয়ে করে পাশের গাঁয়ে উঠে গেছে, ঘরজামাই থাকে। দেখো তো আমার ঘটিটা কোথায় পড়ল। একটুও কি জল আছে ঘটিতে?”

“হ্যাঁ, কিছুটা আছে। এই নিন।” ছিরু ঘটিটা কুড়িয়ে বুড়ির হাতে দিল। বুড়ি ঘটিটা উঁচু করে জলটুকু খেল। বুড়ির করুণ অবস্থা দেখে ছিরুর চোখে জল এসে গেল।

“সব বেচে বেচে খেয়েছি। ঘটিটা ছাড়া। শ্বশুরের জিনিস। তুমি এটা নিয়ে যাও, বেচে ভালো দাম পাবে।”

এবারে সত্যি-সত্যিই ছিরুর চোখে জল চলে এল। সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “না না, দরকার নেই মা। এটা আপনারই থাক। আপনি বরং এই পঞ্চাশ টাকার নোটটা রেখে দিন।”

রাহাখরচ বাবদ মেধোকাকা যে টাকাটা তাকে দিয়েছিল, সেটা বুড়ির হাতে তুলে দিয়ে ছিরু হাতের চেটোয় চোখের জল মুছতে মুছতে পালিয়ে গেল।

টাকাটা হাতে নিয়ে বুড়ি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, “রামু, কালকে তুই আর আমি মৌরলামাছ কিনে জমিয়ে খাব। যাই, দাওয়ার গর্তটা বুজিয়ে দিই, নইলে আবার শিয়াল ঢুকবে।”

মেঝেতে নেমে অনায়াসে হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে মেঝের গর্ত বুজিয়ে, থালাবাসন গুছিয়ে, ন্যাতা দিয়ে মেঝের জল মুছতে মুছতে বলল, “এহ্‌! আর একটু হলেই আমার কাশীদাসি রামায়ণখানা ভিজে যেত! বইটা আর একটু সরিয়ে রাখি। কাল দুপুরে আবার পড়তে হবে তো!”

।। দুই।।

সিন্দুকের চাবি

ছিরু প্রথমদিকে ছিল বড্ড আনাড়ি। কিন্তু এখন ওর বুদ্ধি যেমন শার্প হয়েছে তেমনি হাতের কাজেও এসেছে পেশাগত নৈপুণ্য। আগে সে ছিল কেবলমাত্র সিঁধেল চোর। কিন্তু এখন বন্যার ভয়ে গলিঘুঁজিতেও মানুষ পাকা ঘর দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তার মতো সিঁধেল চোরেরা হয়ে পড়েছে বেকার। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছে ছিরু। বেশি দূর পড়াশোনা না শিখলেও ছিরু জানে পৃথিবীতে যোগ্যতম ব্যক্তিরাই টিকে যায়। তাই গুরু কাম কাকা মেধো সর্দারের কাছ থেকে শিখে নিয়েছে চুরির আরও কত কায়দা-কৌশল।

গত পরশু দিনের ঘটনা। এক বিয়েবাড়িতে ঢুকে পড়েছিল ছিরু হাতসাফাইয়ের কাজে। কিন্তু খাবারের জায়গায় গিয়ে ওর চক্ষু তো ছানাবড়া। কত কী আইটেম খাওয়াচ্ছে মাইরি, বাপের জন্মে খাইনি। গলদা চিংড়ি, কলার কোপ্তা, ইলিশ ভাপা, সর্বোপরি কচি পাঁঠার ঝোল! সুরুত করে মুখের ভিতরে লালারস টেনে নেয় ছিরু। রইল তার চুরি করা, সুযোগ বুঝে বসে পড়ল বরযাত্রীদের সঙ্গে পঙক্তি-ভোজনে। কিন্তু কথায় আছে, কাঙালের পেটে ঘি-ভাত সয় না। যা হবার ছিল, তাই ঘটল। ভোররাতে শুরু হল বমি আর জলের মতো পায়খানা। মেধো সর্দার বলল, “লক্ষণ ভালো ঠেকছে না। তুই বরং গুবরেপোতার হাসপাতালে ভর্তি হ গে যা।”

গুবরেপোতা হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিরু ভাবতে থাকে দু-দিনের হাতসাফাইয়ের রোজটাই লস হয়ে গেল তার। বৌ তার কাছে কয়েকদিন ধরে ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ি বায়না করছে। বিয়েবাড়িতে না হল হাতসাফাই, উলটে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাতে হচ্ছে তাকে। ঠিক সেই সময় পাশের বেড থেকে এক বুড়ো তাকে জিজ্ঞেস করল, “নাতির ঘর কোথায়?”

“আমাকে জিজ্ঞেস করছেন?”

“হ, পাশে আর তো কেউ নাই।”

ছিরু ভাবল সত্যি কথা বলবে না। মাধাই সর্দারের বারণ আছে।

“আজ্ঞে, বনগাঁর পাশে চাঁদপাড়া।”

“তোমরা কাছে একটা বিড়ি হবে নাতি?”

“না দাদু, আমি ওসব ছাইপাঁশ খাই না।”

“তা ভালো, বেশ ভালো। দেখছ না বিড়ি খেয়ে খেয়ে আমার শ্বাসের দোষ এসে গিয়েছে? কিন্তু ওই যে বলে নেশা…”

ছিরু দেখল, অল্পতেই বুড়ো হাঁপাতে লাগল। বুড়োর কণ্ঠাতেই যেন প্রাণটা আটকে আছে। মরতে বসেছে, তবুও সুখটানের নেশা ছাড়বে না।

বুড়ো এবারে উঠে বসল। বলল, “এই সামনেই একটা দোকান আছে। সেখানে বিড়ি পাওয়া যায়। তুমি আমার একটা উপকার করবে?” বলেই কোমরের কাছ থেকে একটা ছোট্ট থলে বের করল। থলের মুখ খুলতেই ছিরুর চোখ লোভে চকচক করে উঠল। থলেটাকে আবার যথাস্থানে রেখে বুড়ো ছিরুর হাতে দশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিল বুড়ো। ছিরু এক ফাঁকে উঠে গিয়ে পাঁচ টাকার এক প্যাকেট বিড়ি আর নিজের জন্য কয়েকটা বিস্কুট কিনে আনল।

শেষরাতের দিকে বুড়োর শ্বাসটান উঠল। নার্স এসে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিল বুড়োর মুখে, কিন্তু ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ইহজগতের মায়া কাটাল।

সকালবেলা ঘুম ভেঙেই বুড়োর দেহের উপর সাদা কাপড় দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল ছিরুর। সে চোর বলে কি মায়া-মমতা-দুঃখ-কষ্ট থাকতে নেই? কাল রাতেই তো কত কথা হল বুড়োর সঙ্গে। বুড়োর বাড়ির ঠিকানাটাও জেনে নিল সে। একটু পরেই ডিসচার্জ হয়ে গেল ছিরুর। শেষবারের মতো সাদা কাপড়ে ঢাকা বুড়োর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে সে বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে।

ছুটি পেয়েই ছিরু ফুলিয়ার বাস ধরল। সেখানে দুপুরে গঙ্গাস্নান সেরে হোটেল থেকে ভরপেট খেয়ে বৌয়ের জন্য একটা তাঁতের শাড়ি কিনে বাড়ির রাস্তা ধরল। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। সূর্য পাটে বসেছে অনেকক্ষণ। গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি শোনা যাচ্ছে। ফালতুগর্তপুর যেতে হলে দু-পাশের ধেনোজমির মাঝখানে সরু মেঠোপথ ধরতে হয়। পাণ্ডববর্জিত এই গাঁ-গ্রামে তখনও ইলেকট্রিক আলো আসেনি। ফুরফুরে মেজাজে গান গাইতে গাইতে ফিরছিল সে। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস দিল। ঝড় উঠবে নাকি? আকাশের দিকে তাকাল সে। নাহ্, সেরকম কোনও লক্ষণ তো দেখছি না। বরং একটা দুটো করে তারা ফুটছে আকাশে।

“নাতি…”

“কে?” চমকে পিছনে তাকাল সে। কই, কেউ তো নেই। তাহলে মনের ভুল।

“ও নাতি!”

এবারে আরও স্পষ্ট এবং ঘাড়ের কাছেই। ছিরু ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল একটা বুড়ো লোক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। লোকটাকে খুব চেনা চেনা লাগল।

“চিনতে পারছ না? বিড়ি কিনে খাওয়ালে, হাসপাতালে…”

ছিরুর চলৎশক্তি হারিয়ে গেল। কেমন যেন শীত শীত করতে লাগল। সে কোনোরকমে বলল, “কি-কিন্তু তুমি তো অক্কা…”

“মরেও কি শান্তি আছে নাতি? আমার ছেলেরা যে সিন্দুকের চাবির জন্য লড়াই করে মরছে।”

“চাবি? তা আমার কাছে কে-কেন এসেছ?”

“চাবিটা তো তোমার কাছে রয়েছে।” শান্ত গলায় বলল বুড়োর ভূত।

“আ-আমার কাছে?”

“আমি ঘুমিয়ে পড়লে রাতে আমার কোমর থেকে টাকার থলিটা তুমি হাতসাফাই করেছ। সেই টাকাতে গঙ্গাস্নান করে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে বৌয়ের জন্য ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছ। তা ভালো, ও-টাকা আমি আর চাইছি না। ওর ভেতরে একটা চাবি আছে, আমার সিন্দুকের। আমার ছেলেরা চাবিটা খুঁজে খুঁজে হয়রান। তুমি ভাই ওটা আমার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বলবে হাসপাতালের বেডে পেয়েছ।”

ছিরু থলিটা খুলে দেখল হ্যাঁ, থলির ভেতরের একটা ছোট্ট পকেটে একটা পেতলের চাবি আছে। চাবিটা হাতে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল কোথায় কী? সব ভোঁ-ভা। বুড়ো যেন মুহূর্তে উবে গেছে। শুধু একরাশ ঠান্ডা বাতাস পাশের অশ্বত্থগাছের পাতা কাঁপিয়ে চলে গেল।

।। তিন।।

গদাই দারোগার আগমন

গাঁ-গঞ্জে ছিরু চোরের এখন বড্ড নামডাক। হবেই-বা না কেন? ছিরু তো যে-সে চোর নয়; সে মেধো সর্দারের ভাইপো। সেই মেধো সর্দার, যার নামে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। পুলিশ পর্যন্ত মেধোকে ঘাঁটাতে সাহস পায় না। কিন্তু লোকে ঠারেঠোরে বলে ছিরু নাকি কলাকুশলীতে মেধোর মতো হয়নি; বরং একটু নরম ধাঁচের। পুলিশ চাইছে মেধোকে ধরতে। কিন্তু তার আগে ছিরুকে ধরতে হবে। কথায় আছে, কান টানলে মাথা আসে।

গুবরেপোতা থানায় নতুন দারোগা এসেছেন, নাম গদাই দারোগা। ভীষণ রাশভারী চেহারার মানুষ। লোকে কানাঘুষো করছে, এইবার এলাকার চোর-ডাকাতেরা শায়েস্তা হবে; মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে রাতে। গদাই দারোগা থানায় ঢুকেই প্রথমে পুরোনো ফাইলপত্তরগুলো বের করেছেন। কবে কোথায় ক’টা কেস ঘটেছে এইসব হিসাব করতে লেগেছেন। হঠাৎ মেজো দারগা লখাইবাবুকে ডেকে বললেন, “এই ছিরু চোরটা কে? ওর নামেই তো বেশিরভাগ কেস ফাইল হয়েছে দেখছি।”

লখাইবাবু পুরোনো মানুষ, ছাপোষা মধ্যবিত্ত। আর বছর খানেক চাকরি আছে তাঁর। এই ক’টা দিন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে চান। তাই বড়োবাবুকে খুশি করার জন্য বলে ওঠেন, “খুব ডেঞ্জারাস চোর স্যার। অনেকবার আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওকে ধরেছি, প্রতিবার পালিয়েছে। এর আগে যিনি আপনার জায়গায় ছিলেন, তিনি ছিলেন সাত্ত্বিক বৈষ্ণব। পিঁপড়ে পর্যন্ত মারতে দিতেন না। বলতেন লখাই, সবাই কৃষ্ণের জীব; খেয়াল রাখিস, থার্ড ডিগ্রি যেন দিসনি। আমি একা আর কী করব স্যার?”

“লখাইবাবু, আপনার আর ভূতপূর্ব বড়ো সাহেবের মধ্যে কোনও পার্থক্য তো দেখি না। যত্তসব ঘুষখোর…”

“স্যার আপনি পুলিশের লোক হয়েও বলতে পারলেন কথাটা?”

“বেশ করেছি। একশোবার বলব। আলবাত বলব। যদি বৃদ্ধ বয়সের পেনশনটুকু নষ্ট করতে না চান, তবে আমার কথা শুনে চলবেন।”

“আমি ছুটি নেব স্যার। আমার অনেক ছুটি পাওনা হয়ে আছে।”

“লখাইবাবু, আপনি দেশসেবা করছেন। এখন কিছুতেই ছুটি নিতে পারবেন না। আগে ছিরু তারপর মেধো; এই দুইজন ধরার পর একেবারে ছুটি নেবেন।” মিটি মিটি হাসতে থাকেন গদাই দারোগা।

“স্যার, আপনার মায়া-দয়া একটু কম।”

“হা হা হা! বড়ো ভালো কথা বলেছেন। শুনুন, লখাইবাবুসহ সকলকেই বলছিম পুলিশকে হতে হবে নারকেলের মতো; বাইরেটা কঠিন, ভেতরে নরম। এই সামান্য টিপস মেনে চলবেন। তাহলে শুরু করা যাক ‘মিশন ছিরু’।”

ওদিকে ছিরুর হাতসাফাইয়ের কাজকর্ম লাটে উঠতে বসেছে। মেধোকাকা সেদিন সবাইকে ডেকে বলল, “সবাই কিছুদিন আত্মগোপন করে কাটাও। হুড়মুড় করে কোনও কাজ করে বোসো না। আমাদের ইনফর্মার খবর এনেছে, নতুন দারোগা খুব কড়া ধাতের লোক। রোজ রাতে হাই রোড ধরে টহল মারে আর বলে, রাতে রাস্তায় কোনও মাই কা লালকে যেন না দেখি; কেবল আমি থাকব আর থাকবে কুকুর।”

“আগের দারোগাটা ছিল ভালো, বৈষ্ণব ছিল। না খেত ঘুষ, না করত টর্চার।” ছিরু বলল।

“যত গর্জায়, তত বর্ষায় না রে ছিরু। দেখিস আবার সুদিন আসবে।” দলের ভেতরে একজন বর্ষীয়ান চোর বলল।

“তাহলে আমাদের কী কাজ?” আরেকজন চোর বলল।

“বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমো।” মেধো সর্দার নির্দেশ দিল।

কিন্তু ছিরু হল কাজের মানুষ। সে কি কারও কথা শোনে? সে ভাবল এবারে দারোগাকে একটু অন্যভাবে ঢিট করা যায় কি না দেখি।

চৈত্রের শেষাশেষি। গ্রামবাংলায় এখন গাজনের প্রস্তুতি চলছে। তারই অনুষঙ্গরূপে ‘পাট-বাণ’ মাথায় করে ঢাক-কাঁসি সহকারে পাড়ায় পাড়ায় ‘বাবা-আ-আ-আ মহাদেবের সেবা লাগি—শি-বো শি-বো মহাদেব’ বলে সন্ন্যাসীরা মাঙ্গনে বেরিয়েছে। আবার কোথায় বা শিব-দুর্গা ইত্যাদির সঙ সেজে বহুরূপীরা বেরিয়েছে।

গুবরেপোতার সরকারি হাউসিংয়ের বাইরের লনে একটা টুলে বসে রাস্তার দিকে পেছন ফিরে বসে দাড়ি কামাচ্ছিলেন গদাই দারোগা। হঠাৎ মহাদেববেশী এক বহুরূপীর আবির্ভাব ঘটল সেখানে। পেছনে বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে হল্লা করছে। শব্দ শুনে গদাই দারোগা অসন্তুষ্ট হলেন। হাতের আয়নার ভেতর দিয়ে দেখে নিলেন রাস্তার দৃশ্য। ভালো করে দেখলেন বহুরূপীর মুখ। তারপর বিরিক্তি সহকারে বললেন, “ভাগ, ভাগ হিয়াসে!”

“বাবু, আগের বড়োবাবু হলে এভাবে ফিরিয়ে দিতেন না।”

“আমি পারব না দিতে। থানায় যাবি, সবাই থাকবে; একসঙ্গে দেব। এখন মেলা করিস না। চলে যা।” পুনরায় দাড়ি কাটায় মন দিলেন গদাই দারোগা।

মহাদেব ফিরে যাচ্ছিল। কী মনে হতেই গদাই ডাকলেন, “এই দাঁড়া তো একটু।” এবারে তিনি টুল থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্ধানী চোখে তাকালেন বহুরূপীর দিকে। কেমন যেন সন্দেহ হল তাঁর। হাঁকলেন তিনি, “ছকু পাঁড়ে, ইধার আও।”

ছকু পাঁড়ে হল হাউসিংয়ের দারোয়ান। ততক্ষণে মজা দেখার জন্য চারপাশের কামরাগুলো থেকে অনেকেই বেরিয়ে এসেছে। ছকু কাছে আসতেই তিনি নির্দেশ দিলেন লোকটার ফলস দাড়িগোঁফ টান মেরে খোলার জন্য। তারপর বিস্ময় ও আনন্দে ফেটে পড়লেন গদাই।—“হা হা হা! এ যে দেখছি মেঘ না চাইতেই জল! পুলিশের চোখকে ফাঁকি! তোর ছবি মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় আছে রে। চোখ-নাক দেখেই আমি ধরেছি, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়! শিবের মধ্যে ছিরু চোর লুকিয়ে আছে। এত সাহস! আমার ডেরায় উঁকি দেওয়া? ছকু, জোরসে পাকড়ো শালাকো।”

গদাই প্রথমেই ঠাসিয়ে এক চড় মারলেন ছিরুকে। তারপর ঘর থেকে একটা দড়ি এনে শক্ত করে বাঁধলেন। ছিরু লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এমন বিপদ যে আসতে পারে, কখনও সে ভাবেনি। চোখ ফেটে জল এল তার। তারপর কোমরে দড়ি বেঁধে পাড়ার লোকেদের সামনে দিয়ে ছিরুকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে থানায় নিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। দড়ির অপর প্রান্ত রাখলেন নিজের হাতে।

হাউসিং থেকে থানার দূরত্ব দেড় কিলোমিটার হবে। রাস্তার দু-পাশে কিছুটা জায়গায় চাষের জমি আর কয়েকটা পুকুর আছে। পুকুর বলতে ভেড়ি, সেখানে মাছ চাষ হয়। আর তার অনতিদূরে পাটক্ষেত। এতক্ষণ ছিরু কোনও কথা বলেনি। হঠাৎ দারগাকে সে বলল, “ছার, বেজায় জলতেষ্টা পেয়েছে।”

“থানায় গিয়ে খাবি।”

“না ছার, এখানেই খাব। আপনি আমার কোমরে দড়ি বেঁধে পেস্টিজ পাংচার করলেন, আমি তো বাধা দিইনি। শুধু এক আঁজলা জল খেতে চেয়েছি মাত্র। পুকুরের পাশে একটু দাঁড়ান। দড়ি আপনার হাতেই থাকুক। আমি জল খাব আর উঠে আসব।” মিনতি করে ছিরু।

“ঠিক আছে, চালাকি করবি না। আমি দড়ি ধরেই দাঁড়াচ্ছি।”

ছিরু জল খেতে নামল। হুড়মুড়িয়েই নামল। আর দড়ির হ্যাঁচকা টানে টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে জলে পড়লেন গদাই দারোগা। দড়ির খুঁট ছিটকে গেল তাঁর হাত থেকে। ছিরু সেই যে জলে ডুব দিল আর উঠল না। কিছুক্ষণ পরে অদূরের পাটক্ষেতের মধ্যে কয়েক সারি পাটগাছ ক্ষণিকের জন্য আন্দোলন করে উঠল মাত্র।

একদম বোকা বনে গেলেন গদাই দারোগা। সহকর্মীদের বললেন, “পুকুরে নেমে ছিরু পালাল কী করে? মেজোবাবু, দেখুন তো পুকুরের নীচে কোনও সুড়ঙ্গ আছে নাকি।”

গদাই দারোগার নির্দেশে পুকুরের জল শ্যালো মেশিন দিয়ে ছেঁচে ফেলা হল। দেখা গেল এই পুকুরের নীচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ বা মোটা পাইপ চলে গিয়েছে পাশের পুকুরে। পুকুর দুটো আসলে মাছের ভেড়ি। দ্বিতীয় পুকুরের পাশেই রয়েছে পাটক্ষেত। ছিরু প্রথম পুকুরে ডুবসাঁতার দিয়ে পাশের পুকুরে গিয়েছে; তারপর পুকুরপাড়ে উঠে পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে পালিয়েছে। হতাশ গদাই দারোগা মাথায় হাত দিয়ে পুকুরপাড়ে বসে রইলেন।

।। চার।।

সোনার হার

গুবরেপোতা স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠল ছিরু। বাসে ভিড় থাকলে ছিরুর হাত দুটো বড্ড নিশপিশ করে। সে ইতিউতি তাকাতে থাকে; দেখে কার গলায় হার অথবা কানে সোনার দুল ঝুলছে। মাঝে মাঝে লোকের পকেট থেকে হাতিয়ে নেয় মানিব্যাগ। মেধোকাকা তাকে শিখিয়েছে একটা লাউয়ের উপর কাপড় রেখে কাপড়টাকে কীভাবে ব্লেড দিয়ে চিরতে হয়। কিন্তু লাউতে যেন দাগ না পড়ে। বড়ো কঠিন কাজ। কিন্তু অল্পদিনেই সেই কাজটা শিখে নিয়েছিল সে। চুরি-ছিনতাইয়ের এরকম নানা পরীক্ষায় সে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে।

এখন বিকেলবেলা। যারা বাসে করে ফিরছিল, তাদের বেশিরভাগ কুলি-কামিন। তাই এদের কাছে দামি জিনিস আশা করা যাবে না। তাছাড়া এদের কাছ থেকে চুরি-ছিনতাই করার প্রবৃত্তিও নেই তার। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সে এক বয়স্কা মহিলাকে দেখল; কাপড়চোপড় দেখে তাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা বলেই মনে হল। ছিরু দেখল, মহিলার গলায় একটা সোনার চেন ঝুলছে। লোভে চকচক করে উঠল ছিরুর দুই চোখ।

কিছুক্ষণ পরে সেই বুড়ি চিৎকার করে উঠল, “ওরে বাবা রে, আমার গলার হার গেল—চোর, চোর…”

কন্ডাক্টর ও ড্রাইভার বাস থামিয়ে দিল। ঠিক সেই সময় ভিড় ফুঁড়ে মাথা তুললেন গদাই দারোগা। হেঁড়ে গলায় বলে উঠলেন, “এই, সবাই নীচে নেমে দাঁড়া। সার্চ করে তারপর বাসে তুলব।”

অগত্যা ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর দারোগার কথা মেনে নিল। একে একে বাস থেকে নামিয়ে সকলের জামাকাপড়, পকেট ও ব্যাগ সার্চ করে বাসে তোলার নির্দেশ দিলেন গদাই। সবশেষে এল ছিরু।

“খুব চেনা চেনা লাগছে—তুই ছিরু না?” চওড়া হাসি হেসে বললেন গদাই।

“ছার, আপনি আমাকে চিনেছেন ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয়…”

ছিরুর কথা শেষ না হতেই তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন তিনি। বললেন, “চোর আমি পেয়ে গেছি। এ-কাজ ছিরুর ছাড়া আর কারও নয়। তোরা বাস ছেড়ে দে। একে আমি থানায় নিয়ে যাচ্ছি। বুড়িমা, তোমার হার আমি আদায় করে পৌঁছে দেব। ঠিকানাটা দিয়ে যাও।”

বুড়ির কাছ থেকে তার ঠিকানা নিয়ে ছিরুকে একটা ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে থানায় চললেন গদাই দারোগা। থানায় ঢুকেই মেজোবাবুকে বললেন, “লখাইবাবু, ভালো করে একে সার্চ করুন। বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান…”

“না স্যার। কিছুই মিলল না ছিরুর জামাপ্যান্টের পকেট বা কোমর থেকে।” লখাইবাবু বললেন।

“ছিরু, হারটা কোথায় রেখেছিস? ভালো চাস তো ফেরত দে।” গদাই দারোগা হুমকি দিলেন।

“ছার, চোর বলে আমার দুর্নাম আছে, আমি জানি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি বুড়ির চেন চুরি করিনি।” করুণ মুখে ছিরু বলল।

“লখাইবাবু, বুড়ির চেন ও নির্ঘাত খেয়ে ফেলেছে। ওকে দুই ডজন সবরি কলা খাওয়ান। আর বড়ো বাইরে যেতে চাইবে যখন, তখন জগু-মেথরের হাতে সঁপে দিন।” গদাই দারোগা আদেশের সুরে বললেন।

দারোগাবাবুর হাতে-পায়ে ধরে ছিরু কাঁদতে লাগল।

“মায়াকান্না কাঁদবি না। যদি পেট থেকে বুড়ির চেন বার হয়, তবে থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করব।” গদাই দারোগার দু-চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে লাগল।

পরের দিন যথাসময়ে জগু-মেথর জানাল, ছিরুর বিষ্ঠা থেকে কিছুই মেলেনি। বাধ্য হয়ে ব্যাজার মুখে ছিরুকে ছেড়ে দিতে হল গদাই দারোগাকে। যাবার সময় ছিরুকে শাসালেন তিনি—“তোকে আমি কিন্তু চোখে চোখে রাখব।”

আনন্দের আতিশয্যে একটা পরিচিত সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ছিরু মেধো সর্দারের বাড়িতে এল। তাকে দেখে মেধো সর্দার মুখ কালো করে বলল, “তুই আর ওই থোবড়া দেখাস না আমাকে।”

“কেন, কী করেছি কাকা?”

“সেটা তুই ভালো করেই জানিস।”

“থানা থেকে ফিরে তো এসেছি!”

“থানাতে পচে মরলেও আমি ভাবতাম না। তুই যার হার ছিনতাই করেছিস, সে কে জানিস?”

“না! তা তো জানি না।” ছিরুর কণ্ঠে বিস্ময়।

“হতভাগা, তিনি আমার পিসিমা হন। অনেককাল পরে আমাদের দেখতে এসেছেন। পিসিমা, একটু বাইরে আসুন, আপনার হার ছিনতাইকারী এসেছে।”

যুদ্ধংদেহী মূর্তি নিয়ে বুড়ি বাইরে এল। তাকে দেখে ছিরু একেবারে মাটিতে মিশে গেল। তারপর দৌড়ে গিয়ে পিসিমার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইল সে—“খুব ভুল হয়ে গেছে পিসিমা। এ-যাত্রায় ক্ষমা করুন। আর এমন কাজ করব না। আপনার হার আমার কাছে আছে।” এই বলে মস্ত হাঁ করে দুই আঙুল ঢুকিয়ে গলার ভেতর থেকে ছিরু বার করল পিসিমার হার। এই দৃশ্য দেখে পিসিমার চক্ষু তো চড়কগাছ।

“সে কি রে? এ কী করে সম্ভব?” বুড়ি বলল।

“সব সম্ভব পিসিমা। এই জন্য ছিরুকে দীর্ঘ ছয়মাস কষ্ট করতে হয়েছে। গলার ভেতরে ওই থলি বানানোর জন্য একটা সীসার বল সবসময় মুখের একদিকে গলার কাছে রাখতে হয়েছে ছিরুকে। তারপর ঘা হয়ে সেই জায়গাটা একটা থলির আকার নিয়েছে। ঘা শুকোলেই ব্যস গলার মধ্যে লুকোনো পকেট তৈরি।” মেধো সর্দার বলল।

ছিরু জল দিয়ে হারটা ভালো করে ধুয়ে এনে পিসিমার হাতে দিতে গেল। তখন পিসিমা মিটিমিটি হেসে বলল, “ও-হার আমার চাই না। ওটা সোনার নয়, ইমিটিশন।”

“কী-ই-ই-ই!” ছিরু আর মেধো সর্দার বিস্ময়ে হাঁ হয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল।

।। পাঁচ।।

ধানের গোলা

একদিন দুপুরবেলা গদাই দারোগা রুটিতে খেজুরের গুড় মাখিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় হুড়মুড়িয়ে থানায় ঢুকল পঞ্চানন তালুকদার। সে এই গ্রামের সম্পন্ন মানুষ, মহাজনী ব্যাবসা আছে তার। থানায় ঢুকেই গদাই দারোগার সামনে বসে বলতে লাগল, “স্যার, বাঁচান আমাকে। ধনে-প্রাণে একেবারে মারা যাব স্যার!”

থেমে গেল গদাইয়ের খাওয়া। মুখ হাঁ করা অবস্থাতেই থেমে গেল তাঁর খাবার সমেত। দেখতে দেখতে চোখ দুটো রাঙা হয়ে উঠল তাঁর।—“মশাইয়ের আক্কেল-টাক্কেল কিছু আছে? এটা থানা, না গোয়ালঘর? যখন তখন হাফ টিকিট? দেখছেন না আমি খাচ্ছি! লখাইবাবু, এই লোকটা কাকে বলে ভেতরে এল দেখুন তো!”

পাশের টেবিলে লখাইবাবু ঝিমোচ্ছিলেন। বড়ো সাহেবের ধমকের চোটে তাঁর ঘুম গেল চটকে। তিনি অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ছুটে গিয়ে লোকটাকে টেনে নিয়ে গেলেন বাইরের ঘরে।

হাত-মুখ ধুয়ে মিনিট পাঁচেক পরে গদাই ডাক দিলেন লোকটাকে।—“কী হয়েছে বলুন।” বিরক্তি সহকারে বললেন গদাই।

“আজ্ঞে, আমার নাম পঞ্চানন তালুকদার।”

“স্যার, এই খেজুর-গুড়টা ওঁর আড়ত থেকেই…” লখাইবাবু বললেন।

“ও-হো! তা আগে বলতে হয় তো! বেশ বেশ, দারুণ নির্ভেজাল স্বাদ। তা বলুন আপনার আগমনের অভিপ্রায় কী।” গদাই দারোগার মুখে হাসি ফুটল।

“স্যার, আজ সকালে ঘুম ভেঙে উঠে ঘরের দাওয়ায় এই চিঠিটা পেয়েছি। তখন থেকেই আমার মাথা ঠিক নেই স্যার।” পঞ্চানন কাঁচুমাচু মুখ করে বলল।

“কই, দেখি।” চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলেন গদাই—“পঞ্চাননবাবু, পেন্নাম হই। গ্রামের শতাধিক চাষি ধান কেটেছে। সে-ধানের বেশিরভাগ অংশ কর্জের সুদাসল হিসেবে আপনার খামার বাড়ির গোলাগুলোতে জমা হল। সবখবরই আমার কাছে আসে। তো যাই হোক, পাঁচ গোলা ধান আমাদের জন্য যদি বরাদ্দ করেন, তবে আর কষ্ট করে আমাদের চুরি করে নিতে হয় না। আমার লোক শুক্রবার সন্ধের সময় আপনার খামার বাড়িতে যাবে। ইতি-আপনার সেবক ছিদাম ঠাকুর। পুনশ্চঃ পুলিশকে না জানালে ব্যাপারটা শান্তিতেই মিটে যাবে।”

পড়া শেষ করেই চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন গদাই। টেবিলে চাপড় মেরে বললেন, “এত সাহস ছিদামের! আমার নাকের ডগা থেকে পাঁচ গোলা ধান তুলে নিয়ে যাবে? লখাইবাবু, এই ছিদামটা আবার কে?”

“স্যার, ওই ছিরু চোরের ভালো নাম ছিদাম; মেধো ঠাকুরের ভাইপো।” লখাই বললেন।

“আরিব্বাস! এ তো মেঘ না চাইতেই জল! একবার ঘুঘু হাতের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। এবারে একেবারে দলবল সমেত ধরব। পঞ্চাননবাবু, আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি পুলিশ পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করছি।” গদাই আশ্বাস দিলেন।

“স্যার, এবারে আপনাকে পুকুরের মাছ খাওয়াব। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, শুধু আমার দিকটা একটু দেখবেন।” দু-হাত কচলাতে লাগল পঞ্চানন।

“আরে না না, আমি আইনের রক্ষক। আপনাকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। আমি দেখছি কী করা যায়। চিঠিটা রেখে যান।”

পরদিন থেকে পঞ্চাননের গোলাবাড়িতে কয়েকজন পুলিশকর্মী মোতায়েন করলেন গদাই। অন্তত শুক্রবার পর্যন্ত তো পাহারা দিতেই হবে। কিছু করার নেই। রাতে পালা করে লখাইবাবু আর গদাইবাবু টহল দেন।

বৃহস্পতিবার অবধি বেশ ভালোই কাটল। ছিরু চোর বা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের ছায়াটুকু দেখা গেল না। পঞ্চানন বেশ নিরুপদ্রবেই কাল কাটাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, এইবার ছিরু চোর বুঝতে পারবে এ বড়ো কঠিন ঠাঁই। তবে পুলিশকর্মীদের তিনবেলা খাই-খরচাবাবদ অনেক টাকা বেরিয়ে গেল পঞ্চাননের। মাঝে মাঝে আবার চা-পানীয় পাঠিয়ে দেয় পঞ্চানন গোলাবাড়িতে।

পাড়াগাঁয়ে খুব তাড়াতাড়ি শীত-সন্ধ্যা আসে জলে-স্থলে নিজের খোলা চুল বিছিয়ে দিয়ে। সন্ধে গড়িয়ে যত রাত হয়, ততই পঞ্চাননের বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে অজানা আশঙ্কায়। আজ কী হবে কে জানে। সে ঠাকুরঘরের সামনে বসে মালা জপ করতে থাকে, আর মনে মনে বলে, ‘ঠাকুর, রক্ষে করো—এ-যাত্রা যেন বেঁচে যাই আমি। পরেরবার গরিবদের আর ঠকাব না।’

“পঞ্চাননবাবু আছেন?”

“কে?” পঞ্চানন মুখ বাড়িয়ে দেখল পুলিশের এক কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে তার দরজায়।

“স্যার পাঠালেন আমাকে। জিরান-কাটের রস খেতে চাইলেন।” কনস্টেবল বলল।

পঞ্চানন ভুবন-ভোলানো হাসি ছুড়ে দিয়ে বললেন, “আছে তো অবশ্যই। আমি রুজু দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

“আমি অপেক্ষা করছি। একসঙ্গেই আপনার লোককে একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে যাব গোলাবাড়িতে।”

বাড়ির পরিচারকের হাতে এক ভাঁড় খেজুর-রস দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলেন পুলিশের সঙ্গে গোলাবাড়ির উদ্দেশ্যে।

গোলাবাড়ির চারপাশে গদাই দারোগা আর লখাইবাবুর নেতৃত্বে প্রায় জনা দশেক পুলিশকর্মী পাহারা দিচ্ছিল। সকলে একটা খড়ের চালার নীচে বসলে পরে পঞ্চাননের পরিচারক সকলের হাতে ধরিয়ে দিল এক এক গ্লাস জিরান-কাটের রস। আয়েশে সেই রসপানের অনতিকাল পরে চোখ দুটো বুজে এল গভীর ঘুমে।

ভোরবেলা নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পায়ে পায়ে গোলাবাড়ির দিকে এসেছিল পঞ্চানন। সে দেখল খড়ের চালার নীচে গদাই দারোগাসহ পুলিশকর্মীরা সব ঘুমে অচেতন। ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙে গেল তাদের। তারপর সকলে অবাক হয়ে দেখল, পঞ্চাননের দশ-দশটা গোলার কোনোটায় কণামাত্র ধান পড়ে নেই। গদাই ভালো করে চোখ কচলে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন। লখাইবাবু দেখেন গদাই গোয়েন্দার পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ উঁকি মারছে। গদাইয়ের অনুমতি নিয়ে কাগজটা খুলে পড়তে আরম্ভ করলেন, “স্যার, আমি জানি আমি অপরাধী। কিন্তু এই পদ্ধতি ছাড়া গরিব মানুষের ধান গরিবদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আর কোনও উপায় ছিল না। জিরান-কাটের রসে সামান্য ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছি মাত্র। ইতি- আপনার বিশ্বস্ত ছিদাম ঠাকুর। পুনশ্চঃ পেশায় চোর হয়েও একবারের জন্য পুলিশ সেজে নিলাম কাল সন্ধ্যায়। আর পঞ্চাননবাবুকে বলবেন ওঁর বাড়িতে চাকর ছদ্মবেশে যিনি ছিলেন, তিনি আমার পিতৃব্য স্বয়ং মেধো ঠাকুর।”

চিঠির বক্তব্য শুনে পঞ্চানন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। আর গদাই দারোগা পরাজিত সেনাপতির মতো শূন্যদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকলেন সামনের ধানহীন গোলাগুলির দিকে।

।। ছয়।।

বিয়েবাড়ি

গুবরেপোতা থানার অন্তর্গত একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম হল ফালতুগর্তপুর। এই গ্রাম থেকে হাঁড়িখালি শ্মশানের দূরত্ব ক্রোশ তিনেক হবে। শ্মশানের কালীমন্দিরের পেছনে ছিরুদের ডেরা। বেশ কয়েক মাস বিরতির পরে দলের অন্যান্যদের সঙ্গে এখানে মিলিত হয়েছে হয়েছে তারা।

“যাই বলো না কাকা, এই গদাই দারোগা আমাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলল।” ছিরু বলল।

“দেখ, পুলিশের কাজ পুলিশ করবে, আমাদের কাজ আমাদের করতে হবে। চিরকাল এই চোর-পুলিশ খেলা চলবে। তাই বলে কি আমাদের কাজকর্ম বন্ধ করে রাখতে হবে?” মাধাই সর্দার বলল।

“বাকিরা সব কী বলছিস?” ছিরু বলল।

“আমাদেরও ওই একই কথা। কিন্তু সাবধানের মার নেই। তাই যতটা সাবধানে থাকা যায়।” দলের একজন বলল।

এখন গরমের দুপুর। চূর্ণী থেকে ঝিরিঝিরি হাওয়া পাক খেয়ে উঠে আসছে। সেই হাওয়ায় উড়ে আসছে শুকনো বাঁশপাতা। পারতপক্ষে এই সময় শ্মশানে কেউ খুব একটা আসে না। ছিরুরা বসেছে কালীমন্দিরের পিছনে নদীর ধারে। এখানে বসেই তাদের শলাপরামর্শ চলছে।

“শিবচন্দ্রপুরের রাখহরি পোদ্দারকে চেনা আছে?” মাধাই বলল।

“কোন রাখহরি?” ছিদাম বলল।

“ওই যে শিবনিবাসের ঘাট ইজারা নিয়েছে যে।”

“ওহ্‌! ও তো টাকার কুমির।” দলের একজন বলল।

“হ্যাঁ, আগামী পরশুদিন ওর মেয়ের বিয়ে। ভারী ভারী সোনার গয়না বানিয়েছে গোবর্ধন স্বর্ণকারের দোকান থেকে। তাই বলছিলাম গয়নাগুলো…”

মাধাই সর্দারের মুখের কথা শেষ হবার আগেই এক ভিখারি মৃদু গলায় বলে উঠল, “বাবাঠাকুর, অনেকদিন আমাদের খাবার জোটেনি। কিছু ভিক্ষা মিলবে?”

ভিখারি কখন চুপিসারে তাদের ডেরার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা কেউ খেয়াল করেনি। ভিখারির কথা শুনে চমকে ওঠে সকলে। তারপরে সকলে তাকে এক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে থাকে। ভিখারির চোখ দুটো কোটরাগত; উসকো চুল, পরনে ছেঁড়া পোশাক।

“তুমি এই অসময়ে কোথা থেকে?” ছিরু জিজ্ঞেস করল।

“বাবু, ভিক্ষা করতে করতে এদিকে এসে পড়েছি।” ভিখারি উত্তর দিল।

“এখানে আশেপাশে তো কোনও লোকালয় নেই। তা তুমি এখানে অযাচিতভাবে এসে পড়লে যে?” মাধাই সর্দার বলল।

“ওই অনেক দূর থেকে হেঁটে হেঁটে আসছি বাবু।”

“তোমার বাড়ি কোথায়?” ছিরু জিজ্ঞেস করল।

“নদীর হুই পাড়ে। চন্দননগর ঘাটের কাছে।”

“তোমাকে দেখে তো আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে বাপু।” মাধাই বলল।

“আমি নিপাট ভিখিরি বাবুমশাই। আপনারা কিছু না দিলে আর কিছু করার নেই।” ভিখারি ফিরে যেতে উদ্যত হল।

“দাঁড়াও। এই টাকাটা নিয়ে যাও।” বলে ছিরু পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে লোকটার হাতে দিল।

“ভগবান আপনাদের মঙ্গল করুন।” বলে টাকাটা মাথায় ঠেকিয়ে ভিখারি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে।

থানায় বসে গদাই দারোগা আর লখাইবাবু গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। ছিদাম চোরের কাছে অপমানের ক্ষত এখনও শুকোয়নি। কীভাবে ছিদামকে ফাঁদে ফেলা যায়, সেটাই সর্বক্ষণ মাথায় ঘুরছে গদাইয়ের। এমন সময় সেই ভিখারিটা প্রবেশ করল থানার ভেতরে। দেখা গেল সত্যিই লোকটি পুলিশের একজন ইনফর্মার।

“তারপর হাবুচন্দ্র, কোনও খবর কি আনতে পারলে ছিদাম আর তার দলবলের?” গদাই বললেন।

“এবারে পাক্কা খবর আছে হুজুর। একটু আগেই হাঁড়িখালি শ্মশানের চালাঘরের নীচে ছিদাম, মাধাই সর্দার আর তাদের দলবলের ভেতরে জোর আলোচনা চলছিল; ওরা সামনের বেস্পতিবারে শিবচন্দ্রপুরের রাখহরি পোদ্দারের বাড়িতে লুট করার ধান্দায় আছে।

“রাখহরি পোদ্দার?” গদাই চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন।

“স্যার, রাখহরি হল ঘাটের ইজারাদার। দু-বছরে অনেক টাকাকড়ি করেছে।” লখাইবাবু বললেন।

“বেস্পতিবারে গোধূলি লগ্নে ওর মেয়ের বিয়ে। গহনাগুলো হাতানোর তালেই আছে ওরা।” হাবু বলল।

“যাক, এতদিনে এই একটা ভালো কাজ করেছিস। ব্যাটাকে বামাল ধরব।” গদাই বললেন।

“তোকে সন্দেহ করেনি তো?” লখাইবাবু বললেন।

“এমন নিখুঁত ছদ্মবেশ নিয়েছি যে চেনা তো দূরে থাক, উলটে দশ টাকা সাহায্য করতে বাধ্য হয়েছে।”

“বলিস কী রে? দেখি দশ টাকার নোটটা।” গদাই দারোগা বললেন।

হাবু পকেট থেকে সেই নোটটা বের করে গদাইয়ের হাতে দিল। গদাই ভালো করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নোটটা দেখতে থাকেন; ধীরে ধীরে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা কালো হয়ে যায়। তিনি বলেন, “নোটটা দেখেছিস? তোকে চিনিতে পারেনি? ব্যাটা এই দেখ—নোটে কী লেখা আছে?”

লখাইবাবু আর হাবু হুমড়ি খেয়ে পড়েন নোটের উপর। সেখানে লাল কালি দিয়ে স্পষ্ট লেখা আছে—‘স্যার, বেস্পতিবার সন্ধেয় দেখা হবে রাখহরি পোদ্দারের মেয়ের বিয়েতে। রাখহরির হয়ে আমরাই আপনাকে নিমন্ত্রণ করলাম।’

“এতদূর আস্পর্ধা? আমাকে চ্যালেঞ্জ? গদাই দারোগাকে চ্যালেঞ্জ? লখাইবাবু, আমি এটা হজম করতে পারছি না। এটা এখন আমার কাছে প্রেস্টিজিয়াস লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।” রাগে লাল হয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকেন গদাই দারোগা।

বৃহস্পতিবার। রাখহরি পোদ্দারের মেয়ের বিয়ে। সকাল থেকেই বাড়িতে সাজো সাজো রব; পুলিশ পোস্টিং রয়েছে বিয়েবাড়িতে। গদাই দারোগা সটান জানিয়ে দিয়েছেন, বিয়েবাড়ির এক ফোঁটা জল যেন কেউ মুখে না তোলে। এর আগে পঞ্চাননবাবুর বাড়িতে খেজুর রস খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সকলে। আর সেই সুযোগ নিয়েছিল ছিদাম চোর।

দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে এল। গোধূলি লগ্নে রাখহরির মেয়ের বিয়ে। ফটকের সামনে চারজন পুলিশকর্মী দাঁড়িয়ে বিয়েবাড়িতে আগত মানুষদের ভালো করে দেখে নিচ্ছে। আর বাড়ির চারপাশেও রয়েছে পুলিশ প্রহরা, যাকে পুরোপুরি নাকা-চেকিং। সমস্ত তদারকি করছেন মেজো দারোগা লখাইবাবু।

মেয়ের বিয়েতে কোনোপ্রকার ত্রুটি রাখেনি রাখহরি—বাজনদার, ফুলের সাজ, ফটোগ্রাফার, মেক আপ-আর্টিস্ট—সে এক এলাহি কাণ্ডকারখানা। গেটের সামনে দুটো সাউন্ড বক্স থেকে হিন্দি গান ভেসে আসছে। ইতিমধ্যে বুলেট হাঁকিয়ে সেখানে এলেন গদাই। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। সারি সারি ঝাড়লন্ঠনগুলি জ্বলে উঠেছে প্যান্ডেলে। রাখহরি গদাইকে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

“স্যার বসুন।” রাখহরি বলল।

“না, বসব না। সব ঠিকমতো চলছে তো?”

“হ্যাঁ স্যার, আপনার কথামতো সব চলছে।”

“আপনার মেয়ে কোথায়?”

“ওহ্‌, ওকে তো এখন সাজাতে এসেছে।”

“সাজাতে এসেছে! মানে মেক-আপ আর্টিস্ট এসেছে? কোথা থেকে এসেছে তারা?”

“কৃষ্ণনগর থেকে এসেছে। লোকাল বিউটিশিয়ান চলবে না। সবই তো বোঝেন, মেয়েদের ব্যাপার।”

“আমি একবার ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

গদাইয়ের কথামতো বিউটিশিয়ান দুজনকে তার সামনে হাজির করা হল। একজন অবিবাহিতা, অপরজন বিবাহিতা। অবিবাহিতা মেয়েটিই মূল বিউটিশিয়ান, আর বৌটি তার সঙ্গিনী। বৌটি ঘোমটা দিয়ে প্রায় ঢেকে রেখেছে নিজের মুখ। গদাই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। তাঁর যেন কেমন সন্দেহ হল।—“তুমি নিজে বিউটিশিয়ান হয়ে গ্রামের মহিলাদের মতো ঘোমটা দিয়ে রেখেছ কেন? তোমার বাড়ি কোথায়?”

“কেষ্টনগরে।” নীচু স্বরে বলল বৌটা।

uponyaschiruchor (1)

“তোমার ঘোমটা খোল তো!” আদেশের সুরে বললেন গদাই। বৌটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দেখে গদাই একজন মহিলা কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, “ওর ঘোমটা খুলে দাও তো!”

মহিলা কনস্টেবল বিউটিশিয়ান বৌটার ঘোমটা খুলতে গিয়ে অসাবধানে তার চুলের বিনুনিতে টান লাগল। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল তার পরচুলা, আর ঘোমটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ছিদামের শ্রীবদনখানি। গদাই খপ করে তার হাত ধরলেন চেপে, আর সঙ্গে সঙ্গে সারা বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শাড়ি খুলে এক দৌড়ে পাঁচিলের কাছে চলে এল। তারপরে লাফ দিয়ে পড়ল পাঁচিলের অন্যদিকে। বলা বাহুল্য, বিউটিশিয়ান মেয়েটিকেও সঙ্গে নিল সে। অন্ধকারের মধ্যে সারা বাড়ি হুটোপাটি লেগে গেল। মিনিট কয়েকের ভেতরে জেনারেটর চললে পরে আলো ঝলমল করে উঠল পুরো বাড়ি।

গদাই দারোগা থম মেরে বসে রয়েছেন বারান্দায়। রাখহরির অবস্থাও তথৈবচ। ইতিমধ্যে লখাইবাবু খবর নিয়ে এলেন, বিয়েবাড়ির পেছনের ট্রান্সফর্মারের ফিউজ কী করে যেন উড়ে গিয়েছে।

“ওটা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; ছিদামের লোকেদের কাজ।” গদাই বললেন।

রাখহরির স্ত্রী এসে বলল, “সব্বোনাশ হয়ে গেছে। খুকুর গহনাগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে ওরা। এখন কী হবে?”

“কাঁদবেন না বৌঠান। গহনা চুরি যায়নি।” গদাই বুক ফুলিয়ে বললেন।

“তাহলে?” বাড়িসুদ্ধ সবাই চিৎকার করে উঠল।

“রাখহরিবাবু, আপনিই বলুন।” গদাই বললেন।

“আসলে ছিদাম চোরের আজকের অপারেশনের কথাটা গত সপ্তাহেই স্যার জানিয়েছিলেন আমাকে। সেইমতো কিছু ঝুটা সোনার গহনা গড়িয়ে রেখেছিলাম আমি। গদাইবাবুর কথামতো সেই নকল গহনা পরাতে দেওয়া হয়েছিল সাজঘরে। আসলটা আমি সিন্দুকে রেখে দিয়েছিলাম। গদাইবাবু না থাকলে আজ মারা পড়তাম আমরা।” রাখহরি বলল।

গদাইবাবু তখন গর্বের সঙ্গে তাকাচ্ছেন লখাইবাবুর দিকে। লখাইবাবু ফিসফিসিয়ে বললেন, “স্যার, গহনা রক্ষা পেলেও ছিদাম কিন্তু চলে গেল আমাদের হাতের নাগালের বাইরে।”

সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করে অন্ধকার হয়ে গেল গদাই দারোগার মুখ। তিনি জোরে আদেশের সুরে বলে উঠলেন, “না! আমি ছাড়ব না। লখাইবাবু, গাড়ি রেডি করুন, এখনই বেরোব ছিদামের খোঁজে।”

।। সাত।।

সমাজসেবক ছিরু

দেখতে দেখতে এক ভয়ংকর অতিমারী গ্রাস করল পৃথিবীকে। একটা অদৃশ্য ভাইরাস সারা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিল কয়েক মাসের মধ্যে। এই ভাইরাসের নাম করোনা। কত যে মানুষ অকালে প্রাণ হারাল, তার ইয়ত্তা নেই। ফালতুগর্তপুরেও নেমে এল শ্মশানের নীরবতা। একসময় এই গ্রামকে কোয়ারেন্টাইন জোন ঘোষণা করা হল। সাধারণ মানুষ না পারল গ্রামের বাইরে যেতে, না পারল বাইরে থেকে গ্রামে ঢুকতে। কোয়ারেন্টাইন উঠে গেলেও লাগাতার লক-ডাউনে জেরবার হয়ে উঠল জনজীবন।

একমাত্র মুদিখানা আর ওষুধের দোকান বাদ দিয়ে সমস্ত দোকান বা ব্যাবসা বন্ধ করে দেওয়া হল। এই সরকারি নির্দেশে অসুবিধায় পড়ে গেল সকলে। কিন্তু অসুবিধায় পড়লে কী হবে, সরকারি নির্দেশ মানতেই হবে সকলকে। নার্স-ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ-দারোগাদের কাজও গেল বেড়ে। সরকারি নির্দেশ বা আইন রক্ষার জন্য তারা জনবহুল এলাকাতে চৌকি দিতে লাগল। দিন নেই, রাত নেই, লাঠি হাতে নিয়ে টহল দিচ্ছে বাজার-ঘাট-রাস্তা।

গদাই দারোগারও ঘুম ছুটে গেছে। বসে থেকে থেকে তিনি যে ভুঁড়ি বাগিয়েছিলেন, এই ক’দিনে চুপসে গেল সেই ভুঁড়ি। একবার বাজার পাহারা দেন, একবার ছোটেন হসপিটালে, আবার ছুটে যান মর্গে। আবার সেখান থেকে করোনায় মৃতদের বডি দাহ করতে ছুটে যান শ্মশানে।

একদিন সকালে থানায় বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলেন গদাই। ঠিক সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন সেখানে।

“কী চাই?” লোকটাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন গদাই।

“স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই দেখুন চিঠি।”

“দাঁড়ান, চিঠি দেখার আগে জিজ্ঞেস করি, আপনার নাম কী?”

“আমার নাম রসময় মান্না। ফালতুগর্তপুর গ্রামে থাকি, আমি রেশনের ডিলার। কাল স্পিড পোস্টে এই চিঠিটা এসেছে আমার কাছে।” রসময় চিঠিটা দিল গদাইয়ের হাতে।

গদাই চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে লাগলেন, “সুপ্রিয় রসময়বাবু, সারাবছর রেশনের চাল-চিনি কম দিয়ে এসেছেন মানুষকে। লোকে আপনাদের ফাঁকিবাজি না বুঝলেও আমরা বুঝি আপনাদের কারসাজি। কিন্তু এই অতিমারীর সময় মানুষকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবেন না। আরেকটা কথা, আগামী পরশুদিন রবিবার সকাল দশটার সময় পাঁচ বস্তা চাল, দু-বস্তা গম, আর এক বস্তা ডাল ফালতুগর্তপুর ইটভাটার সামনে রেখে আসবেন। এর অন্যথা ঘটলে করোনা রোগীর ব্যবহৃত পোশাক আপনার বাড়ির জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর বিছানায় ফেলে দেব। আর সেই সঙ্গে রাতারাতি ফাঁকা হয়ে যাবে আপনার রেশনের চাল-ডালের গুদামঘর। ইতি- আপনার বিশ্বস্ত ছিদাম।”

দু-দুবার খুঁটিয়ে পড়লেন গদাই দারোগা। তারপরে বলে উঠলেন, “ছিদাম, মানে আমাদের ছিরু চোর?” দাঁত কিড়মিড় করে পুনরায় বললেন, “বড্ড বাড় বেড়েছে ছিদামের। অনেকদিন চুপচাপ ছিল, ব্যাটাচ্ছেলে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেখছি।”

“বলুন স্যার, আমি এখন কী করি?”

“দেখুন, আমিও হাতেনাতে ধরতে চাই বাছাধনকে।”

“একটা ব্যবস্থা করুন স্যার। রেশনে চাল-গম কম দিলে তা দেখার জন্য সরকার আছে, আপনারা আছেন। কিন্তু এ তো দেখছি একদিকে যেমন আমাকে ধমকাচ্ছে, অন্যদিকে ধনে-প্রাণে মারতে চাইছে!” রসময় বলল।

“রসময়বাবু, ছিদাম খুব চতুর। ওর সঙ্গে ছলাকলায় পেরে ওঠা মুশকিল। আপনি পাঁচ বস্তা চাল, এক বস্তা ডাল আর দু-বস্তা গম নিয়ে ওখানে পৌঁছে যাবেন যথাসময়ে। আমরা আশেপাশেই থাকব ছদ্মবেশে। আপনার চিন্তার কোনও কারণ নেই। একেবারে বামাল ধরব বাছাধনকে।”

“স্যার, তাহলে ভরসা দিচ্ছেন?”

“হ্যাঁ, ভরসা দিচ্ছি।”

“ঠিক আছে, আপনাকে আমি খুশি করে দেব।”

“রসময়বাবু, এটা আমাদের ডিউটি।” একটু থেমে চাপা গলায় গদাই বললেন, “চলে যান, পরে কথা হবে। এখানে সিসিটিভি বসানো আছে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আসছি স্যার। তাহলে ওই কথাই রইল।”

রবিবার সকাল দশটা। ফালতুগর্তপুর ইটভাটার সামনে একটা মোটর এসে থামল। মোটর থেকে নেমে এল রসময় আর তার রেশনের দোকানের এক কর্মচারী। রসময় বার বার ঘড়ি দেখে আর রাস্তার দিকে তাকায়।

“হুজুর, কী করব?” কর্মচারীটি জিজ্ঞেস করল।

“আমার মাথা আর তোর মুণ্ডু কর। সেই দারোগা-ব্যাটারও কোনও খবর নেই। কেউ কথা রাখে না আজকাল। দে, নামিয়ে দে নীচে বস্তাগুলো।” রাগের সুরে রসময় বলল কথাগুলো। আর কর্মচারীটা গাড়ির ডালা খুলে বস্তাগুলো নামিয়ে রাখল ইটভাটার পাশে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ইটভাটার সমস্ত কর্মচারী জমা হল সেখানে। ছোটো ছোটো বাচ্চারাও বাদ গেল না। তাদের সকলের হাতে একটা করে ব্যাগ বা থলি। সকলে কিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইটভাটার বাইরে।

“কী ব্যাপার, তোদের কী চাই?” রসময় জিজ্ঞেস করল।

“কেন, আমাদের আপনি ফ্রিতে চাল-ডাল-গম দেবেন বলেছেন বলেই তো এসেছি।” একজন মহিলা বলল।

“তার মানে? মগের মুলুক নাকি?” রসময় তেড়ে গেল মহিলার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ভাটার কর্মচারীরা ঘিরে ধরল রসময়কে। সেই মুহূর্তে এখানে এসে থামল গদাই দারোগার গাড়ি। পুলিশের গাড়ি দেখে ভিড়টা সরে দাঁড়াল।

গদাই গাড়ি থেকে নেমে এসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী হচ্ছে এখানে, রসময়বাবু?”

“এই দেখুন, এইসব ভিখারির দল আমার মালপত্র সব কেড়ে নিচ্ছে।” রসময় বলল।

ঠিক সেই সময় ভিড়ের ভেতর থেকে এক ন্যুব্জ অশীতিপর বৃদ্ধ এগিয়ে এল গদাই দারোগার দিকে। সে হাতজোড় করে বলল, “ছার, আমরা মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, লেখাপড়ি কিছুই শিখিনি। আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু মানসম্মান আমাদেরও আছে।”

“হুহ্‌, তোদের আবার সম্মান!” রসময় বলল।

“ছার, গত সপ্তায় এই রসময়ের লোক এসেই বলে গেছে, আজ আমাদের চাল-ডাল-গম দান করবেন রসময়বাবু। আর সেইমতো আমরাও এসেছি তাঁর দান নেব বলে। কিন্তু এখন যদি তিনি আমাদের অপমান করেন, সেটা তাঁর ধম্মে সইবে না।” বৃদ্ধ লোকটা আবার বলল।

“কী?”

“স্যার, এই বুড়োটা মিথ্যে কথা বলছে। একদম বিশ্বাস করবেন না ওর কথা। আমার লোক যে এদের বলে গেছে, তার কোনও প্রমাণ আছে?”

“আলবাত আছে। এ-এই দেখেন ছার।” বলে লোকটা একটা কাগজ বের করে গদাইয়ের হাতে দিল। দারোগা কাগজের লেখাটা পড়ে গভীর দৃষ্টিতে রসময়ের দিকে তাকালেন। কাগজে লেখা আছে, ‘অতিমারীর পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আগামী রবিবার সকাল দশটার সময় ভাটার সমস্ত কর্মচারীকে চাল-ডাল-গম বিতরণ করা হবে। ইতি- দীনের সেবক রসময় মান্না।’

“কী, রসময়বাবু? এ তো দেখছি আপনিই আমাকে কেস খাওয়াচ্ছেন! আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই! এটা তো আপনারই সই?” গদাই দারোগা বললেন।

রসময় চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ে একেবারে চুপসে গিয়ে বলল, “সইটা আমার বটে, কিন্তু কাগজটা কিছুতেই আমি এদের লিখিনি বা পাঠাইনি।”

“ছার, আমরা তাহলে চলে যাই?” বৃদ্ধ লোকটা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল।

“স্যার, এ নিশ্চয় ছিদামের একটা চাল! ভাটার মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলুন।” রসময় বলল।

ভাটার মালিককে ডাকা হল। সে তো পুলিশ দেখে হকচকিয়ে গেল। তারপর হাতজোড় করে বলল, “স্যার, এই দু-বছর ধরে অনেক এনজিও এখানে এসে এদের হাতে নানাধরনের সাহায্য তুলে দিচ্ছে। গত পরশুদিন বাইকে করে একজন এসে আপনার নাম করে এই চিঠিখানি দিয়ে গেছে আমার হাতে। আমি চিঠিটা ওদের হাতে তুলে দিয়ে এর বিষয়বস্তু বলে দিয়েছিলাম। এদের কোনও দোষ নেই। আর রসময়বাবু, আপনার তো অনেক আছে। পুন্যি করার সুযোগ যখন এসেছে, তখন পুন্যি করুন।”

“নাহ্, আমি আর এর ভেতরে নেই। চল ফিরে যাই রামগোপাল, গাড়ি স্টার্ট দে। যত্তসব।” গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন গদাই দারোগা। আর রসময় ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল অপস্রিয়মাণ পুলিশ ভ্যানের দিকে।

“বাবু, তা’লে আপনার চাল-ডাল কি ফিরিয়ে নে যাবেন?” বৃদ্ধ লোকটি বলল।

“আর গোরুদান করতে হবে না। এসব নিয়ে এখন মোচ্ছব করো। চল রে, আমরাও ফিরে যাই। যেমন ছিরু চোর, আর তেমনি হয়েছে ওই গদাই দারোগা।” রাগে গজগজ করতে করতে গাড়িতে গিয়ে বসে রসময়।

রসময় ফিরে যেতেই ছেলে-জোয়ান-বুড়োর দল আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। তারপর রসময়ের নামে জয়ধ্বনি দেয়।

দিন দুয়েক পরে গদাই দারোগা সবে পাখা চালিয়ে দিয়ে থানায় বসে আমের শরবত খাচ্ছেন, অমনি পিওন এসে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি গদাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। দারোগা চিঠির খাম খুলে চোখ বোলাতে গিয়েই রেগে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার থেকে। তারপর মেজো দারোগাকে ডেকে চিঠিটা পড়তে দিলেন। মেজো দারোগা পড়তে লাগলেন, “মাননীয় দারোগাবাবু, প্রণাম নেবেন। গত রবিবারে ইটভাটার দরিদ্র মানুষদের মধ্যে চাল-ডাল-গম বিতরণের ক্ষেত্রে আপনার আর রসময়বাবুর ভূমিকায় আমি ভীষণ আনন্দিত। আমি কোনোদিনও ভাবিনি আপনার ভেতরে একজন পরোপকারী মানুষ লুকিয়ে আছে। ওই দরিদ্র কর্মচারী ও তাদের বৌ-ছেলেমেয়েরা সারাবছর আধপেটা খেয়ে দিন কাটায়। তাছাড়া লক-ডাউনের সময়ে তারা খুব কষ্টে আছে। তাই ওইটুকু জিনিস পেয়ে তারাও বেজায় খুশি। আরেকটা কথা, ওইদিন আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম। আপনি তো ভালোই জানেন আমি ছদ্মবেশ ধারণে পটু। ওখানে যে বৃদ্ধটি আপনার হাতে রসময়ের ভুয়ো চিঠিটা দিয়েছিল, সেই ব্যক্তি হল এই অধম। কী করব বলুন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে মাঝে মাঝে আঙুল বাঁকাতে হয়। সেই কারণে একটু ছলনার আশ্রয় নিতে হল। ওই চিঠিতে রসময়ের সইটা আমারই করা। কিন্তু দরিদ্র কর্মচারীরা এসবের বিন্দুবিসর্গ জানে না। আপনার রাগ আমার উপর, সেই রাগের প্রভাব যেন ওদের উপর না পড়ে। ভালো থাকবেন। ইতি- আপনার বিশ্বস্ত ছিদাম।”

চিঠিটা পড়ে গদাই দারোগা গুম হয়ে বসে রইলেন। সামান্য একটা চোরের কাছে এভাবে তাকে বারংবার হেরে যেতে হবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি।

মাস কয়েক পরের ঘটনা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে তখন নাজেহাল সারা দেশ। চিকিৎসক আর পুলিশকর্মীরা একেবারে সামনে থেকে সামলাচ্ছে এই প্যান্ডেমিক সিচুয়েশন। এর মধ্যে অনেক পুলিশকর্মী ও চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন; অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।

গুবরেপোতা থানাতেও থাবা বসিয়েছে করোনা ভাইরাস। গদাই দারোগা সহ অনেকেই আক্রান্ত। গদাই থানা থেকে বাড়িতে এসেছিলেন একদিনের ছুটিতে, কিন্তু বাড়িতে পৌঁছেই ধুম জ্বর। পরের দিন জ্বর ছাড়ল বটে, কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ল যে বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেললেন তিনি। থানায় খবর গেল; কাছের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরা এলেন ছুটে। টেস্ট করে যা ভাবা গিয়েছিল, তাই-ই ধরা পড়ল—পজিটিভ। দারোগার স্ত্রী কারও কথা না শুনে দিনরাত স্বামীর সেবা করতে লাগলেন। দিন দশেক পরে গদাই সুস্থ হয়ে উঠলেন বটে, কিন্তু ভাইরাস কামড় বসাল তাঁর স্ত্রীর দেহে। স্ত্রী এমনিতেই রুগ্ন প্রকৃতির, তারপরে অ্যানিমিয়ার পেশেন্ট। তাই ফল হল মারাত্মক। তার দেহের অক্সিজেনের মাত্রা নেমে গেল অনেক নীচে। দারোগাবাবুর স্ত্রীর রক্তের দরকার, রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’। এখন এই রক্ত কোথায় পাওয়া যায়? অনেক খুঁজে ব্ল্যাড ব্যাঙ্ক থেকে মাত্র এক পাউচ রক্ত মিলল, কিন্তু আরও এক পাউচ রক্ত দরকার। অথচ ‘ও নেগেটিভ’ রক্তের ডোনার মিলল না। সমস্যার কথা ডিপার্টমেন্টকে জানালেন গদাই, আত্মীয়স্বজনকেও জানালেন। কিন্তু এই অতিমারীর সময়ে উপযুক্ত রক্তদাতা মিলল না। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন গদাই, রাতে তাঁর ঘুম আসে না। টেনশনে বুক ধড়ফড় করে। এমন সময় হাসপাতাল থেকে খবর এল, একজন ডোনার পাওয়া গিয়েছে। আজ সকালেই রক্ত দেবে সে। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণে জল এল গদাইবাবুর। স্বস্তির শ্বাস ফেললেন তিনি। যাক, অবশেষে বোধহয় চিন্তার অবসান ঘটল। গদাই হন্তদন্ত হয়ে তৈরি হয়ে নার্সিং হোমে চলে এলেন।

তখন সকাল এগারটা। গদাই দারোগা নিজের স্ত্রীর কেবিনে ঢুকে দেখলেন স্ত্রীকে ব্লাড দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে রক্ত দিলেন ডাক্তারবাবু?”

“আপনি চিনবেন না। গ্রামের এক যুবক।” ডাক্তারবাবু বললেন।

ইতিমধ্যে এক কনস্টেবল এসে বলল, “স্যার, মেজোবাবু আপনাকে ডাকছেন। মনে হয় এতদিনে ছিদাম আমাদের জালে ধরা পড়েছে। একবার দেখতে বললেন আপনাকে।”

সিট থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন গদাই দারোগা। বললেন, “কই, চলো তো দেখি।”

কনস্টেবলকে অনুসরণ করে গদাই দারোগা হাসপাতালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে একেবারে ওয়েটিং রুমে চলে এলেন। দেখলেন মেজো দারোগা লখাইবাবু ছিদামের কোমরে দড়ি বেঁধে বসিয়ে রেখেছেন। ওর দু-পাশে দুজন কনস্টেবল। গদাই ছিদামের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত জরিপ করলেন ভালো করে। তারপর বিরাশি সিক্কা ওজনের একটা চড় কষিয়ে দিলেন ছিদামের কান-চোয়ালে। ঠিক সেই মুহূর্তে সেখান দিয়ে গদাইয়ের গিন্নির চিকিৎসক যাচ্ছিলেন; তিনি ব্যাপারটা লক্ষ করে এগিয়ে এলেন। গদাই তখন দ্বিতীয় চড়টা মারার জন্য হাতটা তুলেছেন, ডাক্তারবাবু গদাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “কী করছেন দারোগাবাবু! এঁকে অ্যারেস্ট করেছেন কেন মশাই? ইনিই তো আপনার মিসেসকে রক্ত দিয়েছেন। ইস্, আপনি এভাবে তার প্রতিদান দিলেন! বেচারা ব্লাড ডোনেট করে এমনিতেই দুর্বল।”

এই কথা শুনে গদাই থতমত খেয়ে গেলেন। ডাক্তারবাবুর সামনে আমতা আমতা করতে লাগলেন। তারপর মেজোবাবুকে বললেন, “মেজোবাবু, আপনি ভুল লোককে ধরেছেন। ছিদামের সঙ্গে দেখতে সাদৃশ্য আছে বটে, কিন্তু আমি হলফ করে বলছি এ ছিদাম নয়; আপনাদের ভুল হয়েছে।”

“কিন্তু স্যার?”

“কোনও কিন্তু নয়, আপনি ওকে ছেড়ে দিন।” তারপর ছিদামের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “সরি ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। আসলে স্ত্রীর শরীরটা ভীষণ খারাপ তো! তাই মেজাজটা ধরে রাখতে পারিনি। ক্ষমা করো আমাকে।” এই কথা বলে পকেট থেকে দু-হাজার টাকার একটা নোট বের করে ছিদামের হাতে দিতে গেলেন।

“ক্ষমা করবেন দারোগাবাবু, আমরা গরিব হতে পারি, ভিখারি নই। আরেকটা কথা। দিদির জন্য আবার রক্তের দরকার হলে ফালতুগর্তপুরে মেধো সর্দারের বাড়িতে গিয়ে বলে এলেই হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব। নমস্কার।”

ছাড়া পেয়ে ছিরু চোর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল হাসপাতাল চত্বর থেকে। গদাই দারোগা অন্যমনস্কভাবে নিজের গালে হাত বোলাতে লাগলেন, যেন থাপ্পড়টা ছিরু চোরই মেরে গেল তাঁকে।

অলঙ্করণ- জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s