নভেম্বর, ১৬
যতদিন আলেক্সান্দ্রিয়ায় ছিলাম ততদিন কারও মনে পড়ল না, আর সেখান থেকে ফিরে মাস তিনেক বর্ধমানের মেঠো হাওয়া গায়ে লাগাতে না লাগাতেই আমাকে মনে পড়ে গেল। আশ্চর্য! আমি মিশরবিদ নই। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করাও আমার অভ্যাসে নেই। ভূ-পর্যটনের শখও আমার নৈব নৈব চ। যাঁরা আমাকে চেনেন তাঁরা নিশ্চয় জানেন, আমি স্বভাবে ঘরকুনো। এক পা হাঁটতে হলে আমার হাঁটুতে জং ধরে। আমি আদতে যুক্তিবাদী। আধুনিক ফলিত বিজ্ঞানের ওপর আমার এযাবৎ জীবনের কিছু চর্চা আছে। তাকে গবেষণা অবশ্যই বলা যায়। আর আদ্যন্ত দেশিয় প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আমার যা কিছু আবিষ্কার।
লোকে যে যাই বলুক, আবিষ্কারগুলি অবশ্য তেমন মারাত্মক কিছু না। খুবই সাধারণ কিছু গ্যাজেট। যেমন, সামনে থাকা মানুষটির মনের মধ্যে কী চলছে তা মুহূর্তে পড়ে নেবার চশমাযন্ত্র চিন্তামণি; কোনও শব্দকে লক্ষ্য করে পরিচালিত নির্ভুল নিশানার ন্যানো হাত বন্দুক শত্রুঘ্ন; আক্রমণকারীর যে-কোনো অস্ত্রকে মুহূর্তে অকেজো আর নিষ্ফলা করে দেবার যন্ত্র পাশুপাত; হাবল টেলিস্কোপের মতো অত শক্তিশালী না হলেও অন্তত দশ-বিশ কিলোমিটার দূরের বস্তুকে একেবারে হাতের কাছে দেখবার মতো দূরস্কোপ; পৃথিবীর হিংস্রতম জন্তু, এমনকি মানুষও বশ করার ছোট্ট যন্ত্রণাহীন যন্ত্র বশীপেন—এইরকম সব নানারকম টুকটাক কাজ কর্মের যন্ত্রপাতি। অবশ্য আদৌ তেমন কিছু কাজে লাগবে কি না তাও ভাবিনি। যন্ত্রগুলির পেটেন্ট নেওয়ারও তাই কোনও গরজ করিনি। তবে দেখেছি যন্ত্রগুলো বিভিন্ন সময়ে আমার প্রয়োজনে চমৎকার কাজ দেয়।
যদিও আমি হুগলি জেলার মানুষ, আমার মামার বাড়ি বর্ধমানে। আমার বাবা-মা হুগলিতে তাঁদের বসতবাটিতেই জীবনের সবক’টি স্বর্ণময় বছর কাটিয়েছেন। আমিও সেখানেই পৈতৃক ভিটেতেই সবিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি। তবে এবারে একটু মামার বাড়ি এসেছিলাম অন্য কারণে। সেটা আরও কিছুদিন আগেকার কথা। সেপ্টেম্বরের ১৭ থেকে সেবার সপ্তমী পুজোর দিন পড়েছিল। আমি মামার বাড়ি গিয়েছিলাম দু-দিন আগে। সেটা আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে ফিরেই।
আমার মামাতো দাদা পেশায় ডাক্তার। আমি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করেও চাকরিবাকরি কিছু না করে কীভাবে অবহেলায় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নিজের কেরিয়ার নষ্ট করছি, সেইটা আমাকে ঘাড় ধরে বোঝাবার জন্যই এই জরুরি তলব। যথারীতি পুজোর হই-হুল্লোড় নষ্ট করে আমার মগজ ধোলাইয়ের ঢালাও বন্দোবস্ত শুরু হয়ে গেল। এরই মধ্যে বর্ধমান রাজ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর অনিল মুখার্জী একদিন এসে উপস্থিত হলেন। বেশ হন্তদন্ত হয়েই। ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরা আদ্যন্ত ঝকঝকে মানুষটি। বয়সে মামার থেকেও বছর ছয়েকের বড়ো। চোখে সোনালি ফ্রেমের রিম দেওয়া চশমা। হাতে একখানা খবরের কাগজ। তাঁর মুখ থেকেই প্রথম সেই হরপ্পার যুগের একজোড়া রুপোর বালা আবিষ্কারের চাঞ্চল্যকর সংবাদটি শোনা গেল।
বাঁকুড়া-বর্ধমানের সীমান্তে দামোদরের তীরে কেনেতিতে সম্প্রতি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে যে খনন কার্য চলছে তাতে একটা অসাধারণ প্রত্নরত্ন উদ্ধার করা গেছে। সেটি একজোড়া রুপোর বালা। শুধু রুপোর বালা হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু খবরের কাগজে তার ছবি দেখে তাজ্জব বনে গেছি। তাতে নীলকান্ত, বৈদূর্য এবং রক্তিমাভাব মণি দিয়ে প্রজাপতির মতো অদ্ভুত কারুকার্য করা এবং সেটাও আজ থেকে প্রায় ৪৬০০ বছর আগেকার হরপ্পার যুগের। অর্থাৎ, আমাদের সিন্ধু-সরস্বতী নদীমাতৃক ভারত সভ্যতার যুগের এক অত্যুজ্জ্বল শিল্প নিদর্শন।
স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সকলের আলোচনা সেই অমূল্য প্রত্ন সম্পদটিকে ঘিরে চলতে থাকল। এরকম একটা কলাকৃতি দেখার লোভ সামলাতে না পারায় স্থির হল আগামীকালই ষষ্ঠীতে যাওয়া যাবে কেনেতির প্রত্নস্থলে। সেটিকে চাক্ষুষ করে কৌতূহল নিরসন করা যাবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই অমূল্য প্রত্ন নিদর্শনটিকে চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারিনি। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সাইট অফিসে গিয়ে জানা গেল, পঞ্চমীর রাতে সেটি খোয়া গিয়েছে। এমন অসাধারণ একটা প্রত্ন সম্পদ কীভাবে খোয়া যেতে পারে, সেটা অবশ্য পুলিশের তদন্ত সাপেক্ষ, তবে আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হল এর পিছনে বড়ো কোনও চক্র কাজ করছে।
যথারীতি পুলিশের বড়ো কর্তারা অকুস্থলে প্রবেশ করেই সমস্ত জায়গাটিকে সিল করে দিয়েছে। এখন সেখানে মাছি গলতে পারছে না। সেই বিধানেই আমাদেরও সেখানে যাওয়া নিষেধ। তবে ওরই মধ্যে সুরেন্দ্র উপাধ্যায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে উঠলেন, “হোয়াট আ প্লেসেন্ট সারপ্রাইস, ড. চন্দ্র! আপনাকে এখানে দেখব আশাই করিনি।”
আমিও আশা করিনি। সুরেন্দ্র আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। এই প্রজেক্টটা তার মানে তাঁরই তত্ত্বাবধানে চলছিল। সুরেন্দ্রর সঙ্গে আমার পরিচয় অন্য একটা ঘটনার সূত্রে। সে-কথা না-হয় পরে কোনও একদিন বলা যাবে।
কিন্তু কথায় কথায় যে তথ্যটা বেরিয়ে এল, সুরেন্দ্র বললেন, “আমরা সন্দেহ করছি এই চুরির ঘটনায় আন্তর্জাতিক চক্রের হাত থাকাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন সেখানেও নয়। এইধরনের এক-একটা নিদর্শন আমাদের চেনাজানা ইতিহাসটাকে ঘাড় ধরে নাড়া দিয়ে দিতে পারে। এমনকি বদলেও দিতে পারে। আপনি ভাবুন না, আজ থেকে ৪৬০০ বছর আগে আমাদের ভারতেই এইসব শিল্পকলার নির্মাণ হয়েছিল। তার অর্থ, এর প্রকৌশল আরও কমপক্ষে দু-দশ হাজার বছর ধরে চর্চিত হয়ে আসছে। যা সর্বতোভাবে প্রমাণ করে আমাদের ভারত সভ্যতার প্রাচীনত্ব এবং শ্রেষ্ঠতাও। একটা কথা যেটা মনে হয়, অসিরীয়, মিশরীয় সভ্যতাও হয়তো বয়সে আমাদের সভ্যতার সমসাময়িক।”
সেটা ঠিক। কেবল মিশরের পিরামিড দেখেই বিদেশের ইতিহাসবিদদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর কোনও সভ্যতার কথা তাদের মনে আসে না। অথচ আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের সুপ্রাচীন মন্দিরের স্টোন কার্ভিংগুলো তাদের চোখে পড়ে না। গ্রানাইট পাথরের ওপর কী অসম্ভব দক্ষতায় এক-একটা নিপুণ ভাস্কর্য ফুটে উঠেছে! সে কি এমনি এমনি? তার জন্য কোনও অসাধারণ প্রযুক্তির দরকার পড়েনি?
আমি সুরেন্দ্রর কথায় সমর্থন করি। আর তার পরেই ওঁর গলায় ফুটে ওঠে আপশোশের সুর—“ড. চন্দ্র, আপনি একটা দিন আগে এলে হয়তো এরকম একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হত না। আপনার মিনিয়েচার ইন্সট্রুমেন্টগুলো এই সময় দারুণ কাজে দিত। আমি নিশ্চিত। কারণ, আপনি যাদের মিনিয়েচার ইন্সট্রুমেন্ট বলেন, আসলে সেগুলো এক-একটা জায়ান্ট পারফর্মার।”
উনি আমার এই ছোটোখাটো আবিষ্কারের কথা সব জানেন। কিন্তু আমার দাদার সে-সব অজানা। তিনি আমার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। মিনিয়েচার ইন্সট্রুমেন্টের রহস্য তাঁর মাথায় ঢোকে না। আমিও সেদিকে মন না দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। পুলিশের কাজ পুলিশ করে নেবে’খন।
তা সেই সময়টা মামার বড়িতেই ছিলাম। আর তখনই এই ফোন। তাও একদিন রাত্রে। শোবার সময়। ফোনটা লুই গ্রাঁয়ের। লুই গ্রাঁ প্রখ্যাত মিশরতত্ত্ববিদ। এই ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোকটিকে সারা পৃথিবী একডাকে চেনে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এই প্রফেসর দীর্ঘদিন মিশর চর্চাতে নিয়োজিত করে রেখেছেন নিজেকে। আমার সঙ্গে অবশ্য এঁর সাক্ষাৎ-পরিচয় নেই। তবে আমার বন্ধু ফার্গুসন, যিনি কায়রোর মিউজিয়াম অফ ইজিপ্সিয়ান এন্টিক্যুইটিসের কিউরেটর এবং একজন প্রখ্যাত মিশরতত্ত্ববিদ, এই লুই গ্রাঁকে চেনেন। আমায় এঁর কথা বলেওছেন কয়েকবার। অবশ্যই তারিফ করে, শুধু ওঁর ওই কুসংস্কারের বাতিকটুকু ছাড়া। সম্ভবত ওঁর কাছেই আমার সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য পেয়েছেন লুই গ্রাঁ।
ফোনে আমার প্রাথমিক অভ্যর্থনাসূচক অভিবাদনটুকু বাদ দিলে আমাকে বিশেষ বলার সুযোগ তিনি দেননি। একেবারে প্রথম থেকেই ঝড়ের গতিতে তিনি বলে গেলেন, “ড. চন্দ্রা! আমাদের একটা এক্সপিডিশন টিমে আপনার সাহচর্য কামনা করি। অবশ্য এর জন্য আপনার যথাযোগ্য সাম্মানিকের কোনও অভাব হবে না। এখন আপনার মুখ থেকে শুধু হ্যাঁ-টুকু শোনবার অপেক্ষা।”
আমি বললাম, “সে না-হয় হবে। কিন্তু কীসের এক্সপিডিশন, কখন হবে, কী বৃত্তান্ত কিছুই তো জানি না। সব না জেনে কী করে মতামত দিই?”
লুই গ্রাঁ মনে হল কথা শোনবার মানুষ নন। স্বরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা নিয়ে তিনি বললেন, “আপনি শুধু দুটো অপশন পাবেন। হ্যাঁ, নয়তো না। আর বাকি যা জানার সব আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে যথাসময়ে।”
আমি তখনই বলে দিলাম, “না। আমার কিছু জানারও নেই। নমস্কার।”
ফোনটা নামিয়ে রাখতেই আবার ফোন। ও-পার থেকে লুই গ্রাঁ বলছেন, “আপনার সম্মতিটুকু আমি খুব আশা করেছিলাম। আপনাকে না পেলে আমার আক্ষেপ থেকে যাবে। আর-একবার ভাববেন, প্লিজ।”
আমি ফোন নামিয়ে রেখে শুতে চলে গিয়েছিলাম। ঘুম ভাঙল মোবাইল ফোনের আওয়াজে। এবার ফোন স্তেগার্টের। স্তেগার্ট ইতালিয়। অ্যাডভেঞ্চার ম্যানিয়াক। আর পেশায় বন্দুকবাজ। অদ্ভুত নিশানা। পাখির ডানার আওয়াজ শুনে গুলি ছুড়ে পাখির বুকে গুলি বিঁধে দিতে পারে। অর্জুনের মতো শব্দভেদী প্রকৌশলে সিদ্ধহস্ত। খুব মিশুকে। আর সে তো রয়েইছে আমার তালে তাল দেবার জন্য। কোথাও কিছু হচ্ছে শুনতে পেলেই হল। ছুটবে। কিন্তু মনটা ভারি সরল।
আমায় হ্যালো বলেই চলে এল মূল কথামুখে।—“তুমি নাকি শুনলাম আমাদের সঙ্গে এক্সপিডিশনে আসছ? লুই গ্রাঁ বলল।”
“লুই গ্রাঁ তাই বলেছে? তাহলে ভুল বলেছে। আমি না করে দিয়েছি।”
“সে কি, কেন?”
“ও আমাকে কিনতে চাইছিল।”
“ও পুওর চন্দ্রা! লুই গ্রাঁ সেরকম লোক নয়। তাহলে ফোনটা নিশ্চয় লুই গ্রাঁ করেনি। ওর ধনকুবের বন্ধু আবাশি আবুবাকরের হবে। আবুবাকর ওইরকম। ধনকুবের হলে যা হয়। হাঁ করলেই শুধু অহংকারের দুর্গন্ধ।”
“তা হবে। আমার কাছে দুটোই সমান। কারণ, আমি কাউকেই চিনি না।”
“কী তা হবে? তুমি কিন্তু যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে। আরে তুমি থাকলে আমিও স্বচ্ছন্দে যেতে পারি। জানোই তো, সবাই আমাকে তোমার ন্যাওটা বলে ক্ষ্যাপায়। তা বলুক, কিছু মনে করি না। তাছাড়া, ওরা সত্যিই তো বলে। আমি রিয়েলি তোমার ফ্যান। প্লিজ না কোরো না।”
“তুমি আমায় ফাঁসাবে।”
“কোনও ভয় নেই। আমি তোমার হয়ে লুই গ্রাঁকে হ্যাঁ বলে দিচ্ছি।”
“আরে শোনো।”
আমার কথার তোয়াক্কা না করে ফোনটা যাচ্ছেতাইভাবে কেটে দিল স্তেগার্ট। এই এক বাজে স্বভাব স্তেগার্টের। এখনও ছেলেমানুষি গেল না। নিজের মনে-মনেই বিড়বিড় করে বললাম, “যা ইচ্ছা হয় করো। আমি যাচ্ছি না।”
সেই ঘটনার পর থেকে আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি আমি। তারাও কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। অতএব এখন শুতে যাওয়ার আগে নিজেকে ভীষণ ভারহীন মনে হচ্ছে।
ডিসেম্বর, ১৬
ঠিক একমাস পর আবার ফোন। এবারের কণ্ঠস্বর আগে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। বেশ কর্কশ আর সাপের মতো হিসহিসে। আমি হ্যালো বলতেই ও-প্রান্ত থেকে সাপের হিসহিসানি ভেসে এল—“কনগ্রাচুলেশন, ড. চন্দ্রা! আপনার বিদেশি বন্ধুদের না বলে আপনি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। কেননা, আপনার এখানে নাক গলানো মানে অনর্থক নিজের বিপদ ডেকে আনা। আপনি যে এই অভিযানে নাক গলাননি, আপনি যে মৃত্যুভয়কে বোকাদের মতো অসম্মান করেন না, এটা ভেবে আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাই। আপনার দিন শুভ হোক, ড. চন্দ্রা।”
আমার কিছু বলার আগেই ইচ্ছা করে ফোন কেটে দিল লোকটা। ইচ্ছা করছে হাতের সামনে যা পাই তাই দিয়ে ছুড়ে মারি লোকটার মাথায়। অদ্ভুত একটা খুন চেপে যাচ্ছে মাথায়। আমাকে শাসাচ্ছে! মৃত্যুর হুমকি দিচ্ছে! স্কাউন্ড্রেল!
এবার আমিই উদ্যোগী হয়ে ফার্গুসনকে ফোনে ধরি।—“তোমার ওই ফ্রেঞ্চ লুই গ্রাঁ লোকটা কীরকম?”
“কীরকম মানে? যথেষ্ট ভালো। ভদ্র এবং বন্ধুবৎসল। কেন বলো তো? তুমি কি ওদের এক্সপিডিশনে যাওয়ার কথা ভাবছ?”
“আমি ভাবিনি। ওরাই ভাবাচ্ছে।”
“তাহলে চলে এসো। ঠকবে না। লুই গ্রাঁ সে-ধরনের মানুষ নয় বলেই জানি। তবে ওর ধনকুবের বন্ধুটা সম্পর্কে সাবধান। সে ভীষণ উন্নাসিক। ফ্রেঞ্চ ছাড়া বিশ্বের সব মানুষকেই তার জংলি মনে হয়। লোকটা আস্ত আহাম্মক।”
“ওদের ব্যাপারে কিছু জানো? কোথায় যাচ্ছে? কী উদ্দেশ্য?”
“আমি নিজে এখনও এ-সম্বন্ধে কিছুই জানি না। তবে আমি একটা কাজ করতে পারি। লুই গ্রাঁকেই বলতে পারি যেন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেয়। অবশ্য তুমি এলে আমিও থাকতে পারি দলে।”
“থাক। সে-সবে দরকার নেই।”
ডিসেম্বর, ২৭
এসবের দিন দশেক পর আমার কলকাতার বাড়ির ঠিকানায় হঠাৎ করেই একদিন ক্যুরিয়ারে কায়রো যাওয়ার প্লেনের টিকিট আর হাতখরচের জন্য আপাতত তিন হাজার ডলার চলে আসে। সঙ্গে এই চিঠি।
প্রিয় ড. চন্দ্রা,
এটা বন্ধুত্বের সামান্য একটা উপহার। তোমার প্রতিভার কাছে এর মূল্যায়ন কিছুই নয়। তবু বন্ধুর ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যায় এমন প্রতিভাও হয়তো জগতে বিরল। তাই সাহস করে ভাবতে পারছি, তুমি আসবে। দেখা হবে। ইতি – লুই গ্রাঁ
কায়রোতে বাড়িভাড়া বাদ দিলে হাজার ডলারে একটা মানুষের মোটামুটি স্বচ্ছন্দে একটা মাস চলে যায়। আর আশ্চর্যের বিষয়, সেখানে বাড়িভাড়া কিছু না হলেও ব্যাঙ্গালোরের চেয়ে দশ শতাংশ কম। সেদিক দিয়ে টাকাটা কিন্তু অনেক। আর আমরা বোধকরি একমাসের জন্য যাচ্ছি না। তবে এসব ক্ষেত্রে অবশ্য দিনক্ষণের কোনও ঠিকঠিকানা থাকে না।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত স্থির হল, জানুয়ারির ১ তারিখে শুভযাত্রা। কায়রোতে পা দিয়ে তবে সবার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা। এখন তিনটে দিন তো আপাতত ছুটি কাটিয়ে নিই।
জানুয়ারি, ১
আজ সকালবেলা কলকাতা এয়ারপোর্টে ঢুকে থেকেই দেখছি একজন ষণ্ডামার্কা লোক আমার পিছু নিয়েছে। বেশ লম্বা দোহারা চেহারা। ফর্সা লম্বাটে মুখ। বিদেশি বিদেশি গড়ন। দারুণ হাট্টাকাট্টা। তবে এখনও পর্যন্ত শুধুই ছায়ার মতো অনুসরণ করছে আমাকে। কোনও উপদ্রব করেনি। আমিও তাই ঘাঁটাইনি ওকে। দেখা যাক ওর কী ইচ্ছে। তারপর না-হয় যা-হোক একটা বিহিত করা যাবে।
সম্ভবত এ-লোকটা ওই হিসহিসে গলার শাগরেদ হবে। লোকটা সারাদিনে এতবার ফোন করেছে, বোঝাই যাচ্ছে আমার প্রতিটি মুভমেন্ট ও কাউকে রিলে করে চলেছে। কী উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। বিরক্তিকর!
যাক সে-কথা। যেটা বলার জন্য কলম ধরেছি তা এই, এমিরেটসের বিমানে সবচেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি কায়রো পৌঁছানো যায় এবং সেটা প্রায় এগারো ঘণ্টার মধ্যে। ওদের সকাল ৯টা ৪৫-এ একটা উড়ান আছে যেটা দুবাইতে একবার থেমে কায়রো পৌঁছে যায় বিকেল পাঁচটার মধ্যে। ভাড়াও খুব কম এবং সেটা আমাদের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের বিমানের ভাড়ার তুলনায় নস্যি। এটা আমার অজানা থাকলেও আমার মিশরীয় বন্ধুদের জানা। তাই সেভাবেই টিকিটের বন্দোবস্ত করেছে ওরা
এখন সন্ধ্যা। ঘড়িতে প্রায় ছ’টার কাছাকাছি। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে এসেছি হোটেল এল তাহরিরে। আমার মিশরীয় বন্ধুরা এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। এখানে পাশাপাশি ঘরে আমি ছাড়াও আছে স্তেগার্ট আর দুজন। তাদের চিনি না।
হোটেলে ঢুকতেই রিসেপশনের সোনালি চুলের মেয়েটি মিষ্টি হেসে অভিবাদন জানিয়ে বলল, “ইওর গুড নেম প্লিস, স্যার?”
আমি পরিচয় দিয়ে বললাম, “ড. স্বর্ণেন্দুশেখর চন্দ্র, ফ্রম ইন্ডিয়া। আর আমার সঙ্গে আছেন এলফিন স্তেগার্ট। আর আমাদের দুজন সিকিউরিটি পার্সোনেল।”
“মিশরে আপনাকে স্বাগত, ড. চন্দ্রা। আমাদের সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট আপনাকে আপনাদের জন্য নির্দিষ্ট রুম দেখিয়ে দেবে। আপনারা আজ বিশ্রাম নিন। কাল মিস্টার লুই গ্রাঁ আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। আর যে-কোনো পরিষেবার জন্য আমাকে ফোন করবেন, প্লিজ।”
মেরুন রঙের স্কার্ট আর কোটে ভীষণ স্মার্ট দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। গভীর কালো চোখের তারায় নাইল ঝিলিক দিচ্ছে। ওর সোনালি চুলটা বাদ দিলে ওকে ভারতীয় বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। আমরাও প্রত্যুত্তরে ভদ্র হেসে খানিক আলাপ করলাম। তারপর সেখানে একটু জাবর কেটে আমাদের রুমে চলে এলাম।
আমার রুমে ঢুকে জানালায় চোখ রাখতেই প্রথমেই যেটা নজরে এল, যে-লোকটা আমায় সারাটা পথ অনুসরণ করে এসেছে, এই দুই মানিকজোড়ের সঙ্গে হয় তার একটা সম্পর্ক আগে থেকেই রয়েছে, আর নয়তো এখানে এসে লোকটা এই দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে। হোটেলের সামনের বড়ো রাস্তায় নেমে এখন ওরা তিনজন গল্প করছে।
পাশের ঘর থেকে স্তেগার্টকে ডেকে ওই তিনজনকে দেখালাম। ও সঙ্গে সঙ্গে ওর টেলিস্কোপিক বন্দুকটা নিয়ে ওদের দিকে তাক করতেই আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম।—“কী করছ?”
“তিনটেকেই উড়িয়ে দেব।”
“বাকি দুজন কী দোষ করল?”
“ওই তোমার ফেউটিকে বন্ধু বানানোটাই ওদের অপরাধ।”
“এত দ্রুত বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে নেই। বিবেচনাটা বাদ দিয়ে দিলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। আশা করি আমার সঙ্গে এ-বিষয়ে তুমি একমত হবে। আচ্ছা ভালো কথা, ওই দুজনকে কেন আমাদের সঙ্গে রাখা হয়েছে জানো?”
“মনে তো হয় ওরা আমাদের বডিগার্ড। আমি কথা বলতে চেয়েওছি। কিন্তু লোকগুলো একেবারে যা তা। না ইতালিয়ান, না স্প্যানিশ, না ফ্রেঞ্চ, না ইংলিশ—একটা ভাষাও বোঝে না। আমিই বোকার মতো পিছু হটে চলে এসেছি।”
“ভালো। তার মানে ওরা ওয়ান মাস্টারড ওয়াচ ডগ। আমাদের নিজেদের দিকটা নিজেদেরকেই ভাবতে হবে।”
“তোমার কাছে গান নেই? অবশ্য না থাকলেও চলবে, যতক্ষণ আমি আছি। তারপর কী হবে জানি না। ঈশ্বর ভরসা।”
“আছে। অনেক কিছুই আছে। মিনিয়েচার ইন্সট্রুমেন্ট।”
“সে আবার কী?”
“ছোটোখাটো কাজের যন্ত্রপাতি। যেমন ধরো, বিয়ার ওপেনার।”
“ঠাট্টা করছ?”
“না। মন থেকে ভয় তাড়াবার চেষ্টা করছি। চলো শোওয়া যাক।”
জানুয়ারি, ২
সকাল থেকে মাথাটা এখনও ঝিম ধরে আছে। এখন বেশ রাত্রি। রাতের বেলাও শহরটার চোখে এতটুকু ঘুম নেই। সকাল থেকে সেই যে তার দৌড় শুরু হয়েছে, এখনও থামেনি। হোটেলের জানালা দিয়ে জেগে থাকা শহরটাকে দেখছি আর তারই ফাঁকে ফাঁকে ডায়েরির সাদা পাতায় পেন চলছে।
আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তে হল স্তেগার্টের চিৎকার শুনে। কেউ বা কারা ওর ওপর হামলা করেছিল। ওই দুজন বডিগার্ড এসে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়। এখনও ওর চোখে-মুখে ভয় জমাট বেঁধে আছে। জেগে থাকলে যে-মানুষের বন্দুকের লক্ষ্য থেকে বাঁচার উপায় নেই, ঘুমের মধ্যে সেই মানুষটাই কতখানি অসহায়, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। যে-লোকটা হাসতে হাসতে প্রতিপক্ষের প্রাণ নিয়ে নিতে পারে, এখন সেই মানুষটাকে নিজের প্রাণের মায়া করতে দেখে একটু আশ্চর্য তো লাগছেই।
ওকে একটু সাহস দেবার জন্য বললাম, “শেষ পর্যন্ত মানিকজোড়ই কাজে লাগল। আগেরদিন তো ওদের উড়িয়ে দিতে গিয়েছিলে।”
“ঘুমের মধ্যে মেরে ফেলতে এসেছিল। কাপুরুষের দল। জানতে পারলে একটা একটা করে গুলিতে শেষ করে দেব।”
“কাউকে আইডেন্টিফাই করতে পারো?”
“না। দেখতে পাইনি। তবে মনে হয়েছে তার গায়ে অসুরের শক্তি। আর একটা অদ্ভুত গন্ধ।”
“কীসের?”
“জানি না। তবে গন্ধটা আমি চিনে নিতে পারব।”
“গুড! আর-একটু পরেই লুই গ্রাঁ আর আবাশি আবুবাকর এসে পড়বে। ফার্গুসনও আসবে। ফ্রেশ হয়ে নাও। জলদি।”
ঠিক সাতটায় আমাদের ডাক পড়ল হোটেলের বল রুমে। সেখানে আমাদের জন্য নাকি অতিথিরা অপেক্ষা করে আছে। বুঝে নিতে অসুবিধা হল না অতিথিরা কারা। দুই মানিকজোড়কে নিয়ে স্তেগার্ট আমার রুমে নক করতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম। বল রুমটা টেনথ ফ্লোরে। স্মোকড গ্লাসের দরজা ঠেলে আমরা রুমে ঢুকতেই এক মাঝবয়সি টাকমাথা লোক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে আমাদের স্বাগত জানালেন। ঢোকার পর থেকে দেখলাম স্তেগার্ট খোশমেজাজে ফার্গুসনের সঙ্গে বসে গল্প করছে। সেদিকে চোখ না দিয়ে বেশ উৎসাহ নিয়েই করমর্দন করে তাঁর আন্তরিকতা জ্ঞাপন করলেন লুই গ্রাঁ। তারপর নিজের পরিচয় দিলেন—“ড. চন্দ্রা, আমি লুই গ্রাঁ। আমাদের অভিযাত্রী দলে আপনাকে স্বাগত।” তারপর সঙ্গের পিপের মতো মোটাসোটা লোকটাকে দেখিয়ে বললেন, “ইনি আমার বন্ধু আবাশি আবুবাকর। ইনি মিশরের একজন ধনকুবের বললেও অত্যুক্তি হয় না। আর এঁকে তো আপনি বোধহয় চেনেন।”
“হ্যাঁ। ফার্গুসন ডোভারফিল্ড আমার পূর্বপরিচিত বন্ধু।”
তারপর স্তেগার্টের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন লুই গ্রাঁ। স্তেগার্টও নিজের পরিচয় দিল। মানিকজোড়ের সঙ্গে রুটিনমাফিক করমর্দন হলেও কথাবার্তা হল না। এরপর আর কোনও সময় নষ্ট না করে লুই গ্রাঁ বলতে লাগলেন নিজের কথা।
“যে-কারণে আপনাদের এখানে ডেকে এনেছি, সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। রানি প্রথম হেটেফেরেস খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে মিশরের রানি হিসাবে ক্ষমতায় আসেন। তিনি ছিলেন তৃতীয় সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট হুনির কন্যা এবং বলা হয় তাঁরই বৈমাত্রেয় ভাই স্নেফেরুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই ফারাও স্নেফেরু মিশরে চতুর্থ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র খুফুর রিজেন্ট হিসাবে তিনি একটা দীর্ঘ সময় মিশরের দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী হয়ে ওঠেন। মিশরে তাঁর পরিচয় ছিল রাজমাতা। তাঁকে ঈশ্বরের নিজের কন্যাও বলা হত। হেটেফেরেসের কীর্তি হিসাবে বলা হয় যে ইনি বিখ্যাত গিজার পিরামিড নির্মাণ করেছিলেন।
“এখন প্রশ্ন, কীভাবে পাওয়া যায় তাঁর সারকোফেগাস বা কফিন? ১৯০২ সালে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় এবং বোস্টন মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস একত্রে কাজ শুরু করে। ৯ মার্চ ১৯২৫ সালে একজন ফটোগ্রাফার একটি পাথরের দেয়ালে কিছুটা প্লাস্টার লক্ষ করেন যা থাকার কথা ছিল না। তাঁরা সেটি ভেঙে একটি গভীর হাতল পান জি-৭০০০-এক্স নামক স্থানে। তারপর তাঁরা ৮৫ ফুট খুঁড়ে একটি দেয়ালের কাছে পৌঁছান যার অপর প্রান্তে ছিল একটি সাদা অ্যালাব্যাস্টার সারকোফেগাস, আর তার সঙ্গে সোনার তৈরি কিছু সামগ্রী এবং আসবাব।
“যখন নিশ্চিত হওয়া গেল এটি সেই রানি হেটেফেরাসের, তখন ১৯২৭ সালে সারকোফেগাস খুলে দেখা যায় রানির মমি নেই। তারপর শুরু হয় খোঁজা এবং সেই খোঁজার সূত্রেই আবিষ্কার হয় আরও কিছু সম্ভাব্য তথ্যসূত্র। সেগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে এইভাবে হয়তো বলা যায়—
এটাই বিখ্যাত গিজা কমপ্লেক্স। আমাদের কাজ ইস্টার্ন সিমেট্রিতে (পূর্ব প্রান্তের কবরখানায়)। সেখানেই রানি হেটেফেরেসের সমাধি।
“হতে পারে রানিকে বাস্তবে জি-৭০০০-এক্স স্থানে সমাহিত করাই হয়নি। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় দাহসুর পিরামিডে, তাঁর স্বামী স্নেফেরুর পাশে।
“অথবা প্রকৃতপক্ষে তাঁকে জি১-এ-তে সমাহিত করা হলেও অ্যান্টিকের চোরা কারবারিরা হয়তো আগেই রানির সারকোফেগাস খুলে মমি ও বহুমূল্য সামগ্রী সরিয়ে ফেলে জি১-এ থেকে এবং একটি ধাঁধা তৈরি করা হয় জি-৭০০০-এক্-এর জায়গায়।
“অথবা এই জি-৭০০০-এক্স স্থানেই প্রকৃতপক্ষে তাঁকে সমাহিত করা হলেও সম্রাট খুফু পরবর্তীকালে সেটিকে জি১-এ-তে সরিয়ে নেন।
“অথবা জি-৭০০০-এক্স-ই আসল সমাহিত স্থান, কিন্তু যাতে কোনোভাবে সেখানে পৌঁছানো না যায় তাই ধাঁধা তৈরি করা হয়েছে।”
এক নিশ্বাসে লুই গ্রাঁ বলে গেলেন, আর আমরাও কান খাড়া করে তাঁর বর্ণনা করা ধাঁধা শুনে গেলাম। তারপর সব চুপ হয়ে গেলে লুইকে জিজ্ঞাসা করলাম, “অবশ্য এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে, রানিকে সমাহিত করার সময় আদৌ কি ধাঁধা তৈরি করার কথা কারও মনে হয়েছিল? সেটা কি আদৌ স্বাভাবিক বলে মনে হয় আপনার?”
লুই গ্রাঁ বললেন, “এখনও পর্যন্ত সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজা হলেও রানি হেটেফেরেসের মমিটি কিন্তু আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি যা রহস্যই রয়ে গেছে। অর্থাৎ, এই মমির সঙ্গে নিশ্চয়ই এমন কিছু ছিল যার কারণে এটিকে বহু পূর্বেই সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল এবং ধাঁধা তৈরি করতে হয় যাতে খুঁজে না পাওয়া যায়। কিন্তু কারা এই ধাঁধ তৈরি করেছে সেটা এখনও রহস্যই।”
লুই গ্রাঁকে মাঝপথে থামিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “জি-৭০০০-এক্স থেকে কী কী উদ্ধার করা গেছে এ-পর্যন্ত?”
লুই গ্রাঁ বললেন, “তেমন কিছুই নয়। কিছু সোনার সামগ্রী, কিছু গহনা, একটা কাঠের ওপর সোনার পাত দিয়ে মোড়া রানির আর্মচেয়ার এবং সে-সময়ের অনেকগুলি ক্যানোপিক জার, যেগুলোর মধ্যে কিছু মমিকৃত শরীরের প্রত্যঙ্গ পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে এগুলো রানির দেহাবশেষ।”
“আর কিছু?”
“আর কিছু না। কেন, আপনি কি আরও কিছু এক্সপেক্ট করেন, ড. চন্দ্র?”
“তা তো করিই। চতুর্থ সাম্রাজ্যের প্রথম রানি, যিনি সম্মানে ও ক্ষমতায় ফারাও-এর থেকে কোনও অংশে কম নন, তাঁর সমাধিতে শুধু এই ক’টি জিনিস? রহস্য তো কিছু একটা রয়েইছে। আপনার চোরা কারবারিদের ডাকাতির তত্ত্বটা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়, মি. লুই গ্রাঁ।”
মি. লুই গ্রাঁ হঠাৎই তাঁর বন্ধুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে উঠলেন, “সব এই তোমাদের জন্য, আবুবাকর। তোমরা যদি এই অ্যান্টিকের কারবার না করতে, তাহলে এইসব অনৈতিক চুরিচামারি নিয়ে গবেষকদের অন্তত মাথা ঘামাতে হত না। তোমাদের জন্যই এসবের চোরা কারবারের এত রমরমা।”
কথাটা লুই গ্রাঁ এমন রূঢ়ভাবে বলে ফেললেন, স্পষ্টত বোঝা গেল তাতে আবাশি আবুবাকর মোটেও খুশি হলেন না, তা সে যতই তিনি লুইয়ের বন্ধু হোন না কেন। আবুবাকরের মুখ-চোখ অপমানে লাল হয়ে উঠল। তারপর সে খানিক সহজ হবার চেষ্টা করল।—“এই তো ফার্গুসনও তো মিউজিয়ামের কিউরেটর। ওদের কাছেও তো অ্যান্টিকের চাহিদা আকাশছোঁয়া। ওরাও তো দেশবিদেশ থেকে অ্যান্টিক নিজের মিউজিয়ামে নিয়ে আসার জন্য চোরা কারবারিদেরই বরাত দেয়। ঠিক বললাম তো, ফার্গুসন?”
আলোচনাটা ক্রমশ আক্রমণাত্মক দিকে মোড় নিচ্ছে বুঝে আমি বললাম, “আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু আবাশি আবুবাকর বা ফার্গুসনের মধ্যে কে বেশি নীতিবাগীশ তা নির্ণয় করা নয়। আমরা বোধহয় রানি হেটেফেরাসের আসল মমিটা উদ্ধারের জন্য নিজেদের সময় নষ্ট করে এখানে মিলিত হয়েছি। আমার তো মনে হয়, এখন সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যা যা করণীয় সেগুলো ভাবাটা এই মুহূর্তে আমাদের জন্য খুব জরুরি।”
তারপর সবাই মিলে বসে মোটামুটি এই রূপরেখা তৈরি করে নেওয়া গেল। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাল আমরা খুব ভোরেই চলে যাব গিজায়। এখান থেকে দক্ষিণে নীলনদের গা বেয়ে বেয়ে গাড়িতে গেলে মোটামুটি মিনিট কুড়ি নেবে। যদিও আপাতত গিজায় থাকার কোনও পরিকল্পনা নেই। এইটুকু পথ স্বচ্ছন্দে দিনের শেষে ফিরে আসা যায়। অবশ্য যদি ফেরার রাস্তা খোলা থাকে।
ওরা চলে যাবার পর স্তেগার্ট আর আমি নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে নিতে চাইলাম। স্তেগার্ট বলল, “লুই গড়গড় করে যা বলে গেল, আমি তো তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। এক-আধটা ‘অথবা’র সমাধান যাও-বা মেলে, কিন্তু অতগুলো ‘অথবা’র আদৌ কোনও সমাধান বাস্তবে হতে পারে না। এটা সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়।”
আমি বললাম, “মাথামোটার মতো কথা বোলো না। অতগুলো ‘অথবা’ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? সমস্যা তো একটাই। হেটেফেরেসের সমাধিতে তাঁর মমি নেই। এখন যদি তা চুরি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আলাদা কথা। আর যদি তা রাজবংশের লোকেরা পরে স্থানান্তরিত করে থাকে, তাহলে প্রশ্ন, কোথায় নিয়ে যেতে পারে।”
“তোমার কী ধারণা, চুরি হয়ে গেছে?”
“হতে অসুবিধা কোথায়? প্রতিদিনই তো এখানে চুরি হচ্ছে। তুমি জোর দিয়ে বলতে পারো, চুরি হয়নি এতদিনে?”
“না, তা অবশ্য পারি না। কিন্তু চুরি হলে কি আমরা চোর খুঁজতে বেরোব?”
“আপত্তির কী আছে?”
“আরে, আমরা তো গোয়েন্দা নই। এসব কি আমাদের কাজ?”
“তাহলে যেটা আমাদের কাজ সেটা ভাবাই কি ভালো নয়?”
“অর্থাৎ?”
“অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি, রাজবংশের লোকেরা মমিটা পরে কোনও এক সময়ে স্থানান্তরিত করেছে। আমাদের শুধু এটুকু খুঁজতে হবে, কোথায় স্থানান্তরিত করেছে।”
“এতক্ষণে জিনিসটা সহজ হল।”
ওকে দেখে এখন মনে হচ্ছে যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে একটা বিষয়ে আমার সঙ্গে ও একমত হল, অভিযানে আমরা যে-অবস্থাতেই থাকি না কেন, আমরা এই দুজন সবসময় একে অপরকে সুরক্ষা দেবার চেষ্টা করব। আর কোনও হঠকারিতার ঝুঁকি নেব না। কারণ, যাদের সঙ্গে চলেছি তারা সবাই আমাদের অচেনা।”
এখানে একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি। সকাল থেকে আমরা যখন বল রুমে মিটিং করতে ব্যস্ত, সেই অবসরে কেউ স্তেগার্টের ঘরটা তছনছ করে গেছে। কেন তা স্তেগার্ট নিজেই জানে না, তো আমাদের আর কী কথা! আমাদের মানিকজোড় অবশ্য এসব ব্যাপারে কিছুই জানে না। তবে ঘটনাটা জানার পর থেকে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। তারা সেই বিকেল থেকে আমাদের পর পর তিনটে কম্পার্টমেন্টের ওপর নজর রাখছে, এটাই বড়ো সান্ত্বনা।
জানুয়ারি, ৪
কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম কে জানে! গত দুটো দিন খুব বাজে কেটেছে। মানে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েই। শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। অসময়ের বৃষ্টি ভীষণ বিরক্তিকর। কাল বিকেল থেকে অবশ্য বৃষ্টির পাট চুকেছে। সকাল সকাল গিজায় পৌঁছে থেকে লুইয়ের মুখ ভার। যে-দুজন ওর খুব বিশ্বস্ত কুলি, ও তাদের কিছুতেই হদিস করতে পারেনি। অবশেষে আজ গোটা একটা বেলা অপেক্ষা করার পর স্থানীয়দের মধ্যে থেকে দুজনকে বেছে নিতে হয়েছে। আমাদের গাইড আমাদের নিয়ে প্রথমেই গিজা পিরামিড গ্রাউন্ডে চলে এল।
গাইড ছেলেটি বলল, “এটাই বিখ্যাত গিজা কমপ্লেক্স। প্রাচীন মিনার সম্বলিত এই চত্বরেই রয়েছে তিনটি পিরামিড কমপ্লেক্স যা গ্রেট পিরামিড নামে পরিচিত। এর মধ্যেই গ্রেট স্ফিংক্স-এর বিশাল ভাস্কর্য, বিভিন্ন কবরস্থান, একটি শ্রমিকদের গ্রাম এবং একটা শিল্প চত্বর। এর চারদিকে শুধু বালি আর বালি, বালির অন্তহীন সমুদ্র। অথচ জায়গাটা নীলনদের থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং কায়রো শহরের কেন্দ্র থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে লিবিয় মরুভূমির মধ্যে গোটা এই এলাকার অবস্থান। তবে আমাদের কাজ ইস্টার্ন সিমেট্রিতে (পূর্ব প্রান্তের কবরখানায়)। সেখানেই রানি হেটেফেরেসের সমাধি।
গাইডের অন্ধ অনুসরণ করে আমরা প্রথমেই খুফুর পিরামিডের কাছেই অবস্থিত পূর্ব প্রান্তের কবরখানায় পৌঁছে গেলাম। গাইড ছেলেটি বলল, “এই সেই ইস্টার্ন সিমেট্রি। এখানেই জি-৭০০০-এক্স কবরখানা রানির সমাধি।”
আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থির হল জি-৭০০০-এক্স কবরখানা। ফলে আমরা আর কোনোদিকে সময় নষ্ট না করে সোজা সেখানে গিয়েই উপস্থিত হলাম। সেখানে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু হদিস পাওয়া গেল না। বরং চরম হতাশায় মনটা ভরে গেল। একটা সাদামাটা কবরখানা যেমন হয়, তেমনই। দেওয়ালটাও সাদামাটা। একখানা নিরাভরণ কফিন-বেদি, চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো পাথরের টুকরো। একদিকের দেওয়ালে একটা গর্ত। এখানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত নেই। অবশ্য আমাদের প্রত্যেকের কাছে প্রখর দ্যুতি-সম্পন্ন টর্চ রয়েছে। নিকষ কালো ঘন চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে ব্যাসল্টের মেঝের ওপর সে-আলো এখনও রহস্যের সৃষ্টি করতে পারে।
লুই গ্রাঁ এবং আবুবাকরের মুখ দেখে স্পষ্টতই অনুমান করা যায় তারা খুশি হয়নি। আমরাও খুশি হইনি। ফার্গুসন নিজে একজন প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ। তার সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, রাজকীয় সমাধিও যে এত আভরণহীন হতে পারে না দেখলে সত্যিই বিশ্বাস হত না।
হঠাৎ পিছন ফিরে দেখি সেই কবরখানার প্রকোষ্ঠে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ফার্গুসনকে আলোটা ধরতে দিয়ে পকেট থেকে আমার একটা কাজের যন্ত্রপাতি বার করে দেওয়ালগুলোতে ঠুকে ঠুকে দেখতে লাগলাম। ফার্গুসন চিৎকার করে ওঠে, “আরে আরে, করো কী?”
আমি কোনও উত্তর না দিয়ে আমার কাজ করতেই থাকলাম। একসময় সে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল। আমিও আমার কাজে লেগে রইলাম। মিনিট তিরিশ বাদে দেখলাম তার মুখে কথা ফুটেছে, তাও গোঙানির মতো। তার চোখ দুটো আস্বাভাবিক বড়ো, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কথা বেরোচ্ছে না, হাত-পাও উত্তেজনায় অবশ হয়ে আছে। যেন তার সামনে আমি নই, জলজ্যান্ত আনুবিস দাঁড়িয়ে আছে। ওর এই দশা দেখে আমি ওর গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকি, “ফার্গুসন, দেখো কী পেয়েছি।”
ও বলল, “সেটাই তো দেখছি। চুনাপাথরের আবরণের নীচে হেয়ারোগ্লিফিক্সে লেখা এ কীসের সংকেত? তুমি বুঝতে পারছ?”
“সেটা হয়তো উদ্ধার করাই যাবে। কিন্তু প্রশ্ন, গোটা দেওয়াল জুড়েই কি এইসব লেখা আছে, নাকি শুধু এখানেই যা আছে? আর-একটু খুঁড়ে দেখব নাকি?”
“এখন তো মনে হচ্ছে খুঁড়ে দেখাই যায়।”
আমি ততক্ষণে এটাকে ক্যামেরাবন্দি করে নিই।
আমার হাত চলতে লাগল বেশ দ্রুত। কিন্তু সমাধির কফিনের ওপরের দেওয়ালটা ছাড়া আর কোথাও কিছু লেখা দেখতে পেলাম না। আমরা আর দেরি না করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু বাইরে কাউকে না দেখতে পেয়ে ফার্গুসন খুব রেগে বলল, “স্কাউন্ড্রেলগুলো গেল কোথায়?”
বললাম, “রাগ কোরো না। ওরা আমাদের জন্য আসেনি। রানি হেটেফেরেসের গুপ্তধনের সন্ধান করতে এসেছে। ওরা তাতেই মজে আছে। চলো। আমার অনুমান ওরা সকলে জি১এ-তে গিয়ে থাকবে।”
সেখান থেকে বেরোনোর সময় একটা লোক এত জোরে ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকে গেল, তার মুখটাও দেখার সময় পেলাম না। মনে হল লোকটা খুব তাড়ায় আছে। যাই হোক, আমাদেরও খানিক উদ্বেগ ছিল। আমরাও দেরি না করে সেখানেই চলে গেলাম। সেখানে গিয়েও শূন্য হাতেই ফিরতে হল সবাইকে। কারণ, প্রত্যাশামতো সেখানেও কিছু তাদের চোখে পড়েনি। স্বভাবতই তারা খুব হতাশ।
হোটেলে ফিরেও লুইয়ের ধনকুবের বন্ধুকে দেখলাম বার বার একই কথা বিড়বিড় করে চলেছে—“তুমি আর লোক পেলে না, যত নিষ্কর্মার ঢেঁকিগুলোকে এনে জড়ো করেছ। তারা তো কিছুই উদ্ধার করতে পারল না। এখন আর আপশোশ করে-বা কী হবে?”
কিন্তু লুই গ্রাঁ খুব আশাবাদী। সে বলল, “শোনো, এসব কাজে এত অধৈর্য হলে হয় না। তোমার ধৈর্য না থাকলে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারো। তোমার টাকা আমি কোনও না কোনোভাবে ঠিকই ফেরত দিয়ে দিতে পারব। আর-একটা কথা, তোমার টাকা নিয়েছি ঠিকই, আমার অতিথিদের অপমান করার অধিকার তোমায় কিন্তু দিইনি।”
এই একটা কথায় দেখলাম আবুবাকরের মুখ চলা বন্ধ হল। কিন্তু চোখে-মুখে অসন্তোষের ছাপটা গেল না।
পরের দিনটা কোন পথে এগোতে হবে সেইসব পরিকল্পনাতেই ওদের কেটে গেল। এদিকে আমি আর ফার্গুসন ওই ক্যামেরাবন্দি লিপির পাঠোদ্ধারে লেগে রইলাম এবং তার লেখাটুকুও পড়তে পেরেছিলাম।—
অশ্বারোহী রানি নাইলের বিপরীত প্রিয়শয্যায়।
এবার ঘুম ভাঙালে তাঁর কালো অভিশাপ নিশ্চয়!
কিন্তু ওইটুকুই। দেড় দিনের চেষ্টাতেও লেখাটার কিছু মাথামুণ্ডু উদ্ধার করা গেল না। অবশ্য একটা কথা কিছুতেই আমার মাথায় আসছে না, স্তেগার্টের ঘরে ঢোকার পর থেকে আমার মাথাটা কেন ঝিম মেরে গেছে। এখনও ঝিম ভাবটা ঠিক কাটেনি।
জানুয়ারি, ৬
আজ আমরা সকাল সকাল এখানকার আর-একজন মিশরতত্ত্ববিদের কাছে এসেছি। তিনি জানিয়েছেন, পুরাতত্ত্ববিদরা কায়রোর দক্ষিণে একটি গোরস্থান থেকে বেশ কিছু প্রাচীন কফিন পেয়েছেন। ৩৬ ফুট গভীর তিনটি কুয়ো থেকে আবিষ্কার হয় এগুলি। সাক্কারার বিখ্যাত জোসের স্টেপ পিরামিড থেকেই পাওয়া গিয়েছে কফিনগুলি। এটি একটি বড়ো আবিষ্কারের সূচনা বলা যায়। কেননা, সাক্কারা মালভূমিতে অন্তত ১১টি পিরামিড রয়েছে, এগুলিতে রয়েছে কয়েকশো প্রাচীন কবর। এই কফিনগুলি ২,৬০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। বহু রাজরাজড়া ও আধিকারিকের মমি রয়েছে এখানে।
ফার্গুসন জানাল, সাক্কারা হল মিশরের প্রাচীন রাজধানী মেমফিসের গোরস্থানের একটি অংশ। এখানেই রয়েছে গিজার জগৎবিখ্যাত পিরামিড। যেখানে আমরা গিয়েছিলাম। এছাড়া আবু সার, দাহসুর ও আহু রুয়াওয়াইসের মতো তুলনামূলকভাবে ছোটো পিরামিডগুলিও এখানে রয়েছে।
আমি বললাম, “লুই গ্রাঁ বলেছিলেন, দাহসুরের পিরামিডে হেটেফেরেসের সারকোফেগাস সম্ভবত তাঁর স্বামী স্নেফেরুর সঙ্গে রাখা আছে। অন্তত সেটাই রীতি। তাহলে দাহসুরের পিরামিডেও একবার খুঁজে দেখা হোক। তারপর না-হয় লুইয়ের ম্যাপ অনুযায়ী খুঁজে দেখা ঠিক হবে, নাকি?”
আমার কথায় সেই মিশরতত্ত্ববিদ বেশ অবাক হলেন। বললেন, “আপনারা যে বলছেন, এখানে রানি হেটেফেরেসের কবর রয়েছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। এটা লোকের একটা ধারণা মাত্র।”
আমরা তাও সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম দাহসুরের উদ্দেশ্যে।
সাকারা যাবার পথে দেখলাম সবুজের সমারোহ। মনে পড়ে গেল সেই আইসিসের চোখের জল, যা পলিমাটি এনেছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে। দাহসুর তিনটে পিরামিডের জন্য বিখ্যাত। একটা বাঁকা পিরামিড যেটা আন্দাজ করা হয় যে মাঝপথে গিয়ে কারিগররা বুঝতে পারে যে অত বেশি ঢালে পিরামিড দাঁড়াতে পারবে না, তাই এই পরিবর্তন আর যার জন্য বাঁকা চেহারা।
অন্যটা লাল পিরামিড। এটি মিশরের তৃতীয় বৃহত্তম পিরামিড। এই দুটি ফারাও স্নেফেরুর তৈরি করা। গোলাপি রঙের পাথরে তৈরি বলে এটার এরকম নামকরণ। গিজার সবচেয়ে বড়ো পিরামিডটি নির্মিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এটাই ছিল পৃথিবীতে মানুষের তৈরি সবচেয়ে উঁচু পরিকাঠামো। এই পিরামিড আগে লাল ছিল না, এর গায়ে সাদা ‘টুরা’ চুনাপাথরের একটা আস্তরণ ছিল। মধ্যযুগে সেগুলো খুলে কায়রোতে বাড়ি তৈরির কাজে লাগানোতে ভেতরের লাল চুনাপাথর বেরিয়ে পড়ে।
আর-একটা কালো পিরামিড তৈরি করেছিলেন ১২শ রাজবংশের ৩য় আমেনেমহাট। এই পিরামিডের স্থাপত্যে অনেক গলদ ছিল তাই আজ এর এই ভগ্নদশা। অবশ্য এই পিরামিড পাথরের বদলে মাটির ইট দিয়ে তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু সেখান থেকেও খালি হাতেই আমাদের ফিরতে হয়েছে। কেননা অত শয়ে শয়ে কবরের মধ্যে কোনটা রানির, এটা বোঝা বা আন্দাজ করা এককথায় খানিক অসম্ভবই। সেই মিশরতত্ত্ববিদের মুখের কথা লুইয়ের বিশ্বাস হয়নি। তাই একবার নিজের চোখে দেখা আসা।
আর এসবের জন্য লুইয়ের মনমেজাজ একেবারেই ভালো ছিল না। ওকে কীরকম উদ্ভ্রান্ত আর পাগলের মতো মনে হচ্ছিল। ও মনেপ্রাণে যা খুঁজে চলেছিল, তার জন্য এই বার বার নিষ্ফল ফিরে আসা ওকে ক্রমশ ওর বন্ধুর মতোই হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু অত বড়ো একজন প্রত্নবিদ হিসাবে ওরও নিশ্চয় বোঝা উচিত ছিল ও যা খুঁজে চলেছে, হয়তো আদৌ তার কোনও অস্তিত্ব নেই; অথবা এমন কোথাও রয়েছে যা একমাত্র সময়ই বলে দিতে পারে জগৎ সমক্ষে তার প্রকাশ আদৌ সম্ভব কি না।
লুই গ্রাঁ খুব অস্থিরভাবে বললেন, “দেখো, এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কিন্তু কোনও অনুসন্ধান শুরুই করিনি। আমরা শুধু আমাদের কাছে আসা তথ্যগুলো যাচাই করেছি মাত্র। আর তাতে দেখা যাচ্ছে লোকের মুখে যা খবর সেটাই সত্যি। মমিটা কোথাও নেই। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা চলে না। এবার আমাদের অনুসন্ধানে নামতে হবে।”
লুই গ্রাঁ নিজে বহু গবেষণা করে একটা মানচিত্র তৈরি করেছেন। তার ধারণা, সেখানেই রানি হেটেফেরেসের মমি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অতএব তার মানচিত্র ধরেই কাল থেকে খোঁজা শুরু
জানুয়ারি, ৭
কায়রো থেকে পূর্বে চার কিলোমিটার গেলেই মৃতের নগরী। ভ্যালি অফ ডেথ। বিশাল বড়ো একটা শক্ত পাথরের পাহাড়। গোটা পাহাড়টার বুকের ভেতরটা খুঁড়ে খুঁড়ে ফাঁপা করে দেওয়া হয়েছে কবরখানা বানিয়ে। পাহাড়ের একদম নীচে ঢোকবার মুখে দুজন বিশালদেহী মুখোশ পরা পাথরের ফ্যারাও চেয়ারে বসে আছে। তাদের মাথা হেলান দেওয়া পিছনের নীল আকাশের গায়। লুইয়ের হিসাবে এইখানেই কোথাও রানির কবর লুকানো রয়েছে। আমাদের কাজ রাত্রে। তবু দু-দিন আগে এক সকালবেলা গিয়ে একবার চৌহদ্দিটা ঘুরে আসা গেল।
হোটেলে ফিরে থেকে স্তেগার্টের অবস্থা কাহিল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে বমি। ওকে ওষুধ পাঁচন দিয়ে হোটেলে রেখে আমরা সে-রাতেই বেরিয়ে গেলাম মৃতের নগরীর উদ্দেশ্যে। আর মানিকজোড়কে রেখে গেলাম ওর দেখভালের জন্য। আজকে আমাদের সঙ্গে জনা ছয়েক কুলি। প্রত্যেকের সঙ্গে গাঁইতি, শাবল, বেলচা জাতীয় কাজের যন্ত্রপাতি। এই রাত্তিরে সকালে দেখা মৃতের নগরীকে একদম চেনা যায় না। এখন এখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গোটা পাহাড়টা জুড়ে যেন অশরীরীদের অবাধ আনাগোনা। এই রাতের চাপ চাপ অন্ধকার মেখে দিব্যি তারা হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। আর আমাদের সঙ্গে আসা কুলিগুলো খালি চোখে তাদের দেখতেও পাচ্ছে। তারা ভয়ে এমন কুঁকড়ে আছে যে বলার নয়। তাদের দেখে আবুবাকরের মুখে আবার ফুটে উঠছে বিরক্তি। লুই গ্রাঁ নির্বিকার।
ঠিক এমন সময় লক্ষ করলাম স্তেগার্ট রহস্যের গন্ধ খুঁজতে খুঁজতে হোটেল ছেড়ে কখন বেরিয়ে পড়েছে, আর এখন ঠিক আমাদের পাশটিতে। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, এ-লোকটা এখানে এল কী করে? আর ফার্গুসনের মাথায় হেয়ারোগ্লিফিক্সের সেই চালচিত্র ভর করে আছে।
আগেই বলেছি, একমাত্র লুই গ্রাঁ অনেক পড়াশুনা করে একটা মানচিত্র খাড়া করেছেন। তাতে যা-সব মার্ক করা আছে সেই অনুযায়ী প্রথমেই উনি পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকের একটা জায়গায় এসে কুলিদের বললেন কাজ শুরু করে দিতে। পরমুহূর্তেই শুরু হয়ে গেল ঠং ঠং বাদ্য। পাথর আর লোহার যুগলবন্দি।
অনেকক্ষণ সে-সব চলার পর একটা মানুষপ্রমাণ সুড়ঙ্গ বানানো গেল যেখান দিয়ে আমরা সকলে প্রবেশ করলাম। আমাদের সকলের হাতে উজ্জ্বল আলোর টর্চ। কিন্তু ওই গুহামুখের ভিতরের ব্ল্যাকহোলের জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন নিমেষে গোগ্রাসে সব আলোটুকু শুষে নিচ্ছে। অন্ধকারের কঠিন পরত কিছুতেই ভেদ করা যাচ্ছে না।
এরই মধ্যে একজন কুলি একবার বীভৎস চিৎকার করেই হঠাৎ একেবারে চুপ করে গেল। স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে এখন আমাদের সকলের দৃষ্টি। চোখের সামনে অদৃশ্য কিছুর উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করতে করতে তার গলার স্বর ক্রমশ বসে যাচ্ছে। তার চোখ দুটো অক্ষিকোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাত-পা পাথরের মতো শক্ত হয়ে আসছে বুঝতে পারছি। তারপর আমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভীতি শিহরন জাগিয়ে লোকটা সত্যি-সত্যিই পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার হাতের গাঁইতি তখনও শক্ত করে মুঠোর মধ্যে ধরা। মুখটা এতটাই বিকৃত যে তাকে দেখে ভয় ছাড়া আর কিছুর উদ্রেক হয় না। আর এটা যে নেহাত একটা ইলিউশন তাই-বা বলি কী করে? চোখের সামনে যা দেখলাম সেটা সত্যিই অতিপ্রাকৃত। বুদ্ধিতে তার ব্যাখ্যা নেই।
অন্য কুলিরা এই গোটা ঘটনায় ভয় পেয়ে বেঁকে বসল। লুইয়ের সহ্যের সীমা পার করে যখন তারা ফিরে যেতে চাইল, তখন মরিয়া লুই গ্রাঁ চিৎকার করে ধমকে উঠলেন, “কেউ ফিরে যাবে না! যেতে চাইলে আমি তাদের কুকুরের মতো গুলি করে মারব।”
এই লুই গ্রাঁকে ভীষণ অচেনা মনে হচ্ছে। অথবা এটাই হয়তো ওর আসল চেহারা। এতকাল মুখোশ ব্যবহার করে আসছিল। সেই অষ্পষ্ট আলোয় আবাশি আবুবাকরও দেখলাম বন্ধুর সমর্থন ততক্ষণে দু-হাতে দুটো রিভলবার তাদের দিকে তাক করে আছে। কুলিরা ভয়ে ভয়ে এগোতে থাকল। আমরাও বুঝতে পারছি, লুই গ্রাঁ আমাদের এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন যেখান থেকে হয়তো ফেরার পথ নেই। অগত্যা আমাদের অগ্রগতিও থেমে থাকল না। সবাই এগিয়ে চলেছি পায়ে পায়ে অন্ধের মতো লুইয়ের পিছনে পিছনে।
একটা পাথরের দেয়ালের সামনে এসে গোটা সুড়ঙ্গটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। গোটা দেয়ালের মধ্যে একটাই মাত্র ছোটো জানালার মাপে দাগ কাটা। তার মধ্যে একটা লাল রঙের মানুষের ছবি যার মুখটা পাখির মতো। মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী এ-ছবিটা ঠাথের। ঠাথ ও দেশের সমস্ত-রকমের অতীন্দ্রিয় শক্তির দেবতা। আমাদের চমকিত করে লুই গ্রাঁ তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে ভিক্টোরিনক্সের একটা চকচকে ধারালো ছুরি বার করে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে টর্চের উজ্জ্বল আলোয় ওর ধারালো ছুরিটা পালিশ করা ঝকঝকে রুপোর মতো ঝলসে উঠছে।
আমাদের সকলের চোখে জ্বলজ্বল করছে শুধু বিস্ময়। আমাদের কারও কাছে ওঁর উদ্দেশ্য এতটুকু স্পষ্ট নয়। উনি আমাদের সঙ্গে ঠিক কী করতে চাইছেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এখান থেকে পালাবার পথ মানে পিছন দিকে ছুটতে হবে। তখন কি ওঁর হাতের রিভলবার থেমে থাকবে? আমরা সকলেই লুইয়ের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে মনে মনে একটা তত্ত্ব খাড়া করে নিতে ব্যস্ত, যদিও আমাদের সকলের প্রখর দৃষ্টি ওঁর ছুরির ওপরে স্থির নিবদ্ধ।
আমার ঠিক পিছনেই ছিল আমাদের একজন কুলি। আমি পিছনের দিকে এক পা পিছোতেই আমার পা গিয়ে পড়ল ওর পায়ের ওপর। আর তখনই কী ভেবে ও ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল। ও নিজেও উলটে পড়ল হুড়মুড়িয়ে টাল সামলাতে না পেরে। আর ওর হাত থেকে জ্বলন্ত টর্চটা ছিটকে পড়ল সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মেঝেতে। আর তখনই আমাদের সবার হৃৎস্পন্দন তুমুল বাড়িয়ে আবুবাকরের হাতের মুঠোয় ধরা রিভলবার হিংস্র গর্জন করে উঠল একবার।
আমরা দেখলাম আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গ বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠেই নিভে গেল। আর অনুভব করলাম, বুলেটটা আমার কানের পাশ দিয়ে তীব্র গতিতে বেরিয়ে গিয়ে ধাক্কা মারল সুড়ঙ্গের পাথরের দেওয়ালে। আর বন্দুকের আওয়াজটা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল সুড়ঙ্গের চার দেওয়ালের মধ্যে। কুলিটা পড়ে গিয়েছিল বলে এ-যাত্রায় হয়তো বেঁচে গেল।
“আবাশি আবুবাকর, পাগল হয়ে গেছ? আমাদের ওপর গুলি ছুড়তে তোমার লজ্জা করছে না? আমিও যদি গুলি ছুড়ি, তোমার কী হবে ভেবেছ? আমার টার্গেট কিন্তু তোমার মতো এত কাঁচা নয়। তোমার কপাল লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে সেটা তোমার দুটো ভ্রূর মাঝখানেই বিঁধে যাবে নির্ভুল নিশানায়। যার অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি বোধহয় তোমার আছে।”
স্তেগার্টের চিৎকারে আবুবাকরের সংবিৎ ফেরে। ও রিভলবারটা হঠাৎ করেই নামিয়ে নেয়। আমি কুলিটাকে হাত ধরে তুলি। ও থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ায় কোনোমতে। কিন্তু ওর হাত থেকে ছিটকে যাওয়া টর্চটা যে নিয়ে আসবে সেই সাহসটুকু আর নেই।
“আবুবাকর, স্তেগার্ট, এখন কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি করবার সময় নয়। তোমরা নিজেরা শান্ত হও।” আমি বলি।
“আমাকে শান্ত না করে ওই বুনো শুয়োরটাকে শান্ত করো, ডক্টর। নোংরামোটা ও শুরু করেছে।” স্তেগার্ট চিৎকার করে ওঠে।
ওর চিৎকারে আবুবাকরের চেতনা হয়। নামানো রিভলবার দুটো ধীরে ধীরে প্যান্টের পকেটে চালান করে দেয়। তারপর দলপতি লুইয়ের সম্মতির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ওই একটা মুহূর্তই নষ্ট করেছিলেন লুই গ্রাঁ। তারপর আমাদের সকলকে হতচকিত করে বিদ্যুৎ গতিতে নিজের বাম হাতের ওপর ধারালো ছুরিটা দিয়ে আঘাত করতেই সেখান থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। খুব নিশ্চিন্ত মনে লুই গ্রাঁ সেই দেবতার চিত্রের সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়লেন। তারপর সেই রক্তের ধারা ওই পাখিমুখো দেবতার মুখের ওপর ফেলতে থাকল। তাজা রক্তে ঠাথের ঠোঁট মুহূর্তে টকটকে লাল হয়ে উঠল। আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে লুইয়ের অদ্ভুত কার্যকলাপ দেখছি। আর-একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত বেরোচ্ছে না কারও মুখ থেকে।
আর কী আশ্চর্য, দেখতে দেখতে একটা বীভৎস ঘড়ঘড় আওয়াজ করে সেই ছোট্ট জানালার মাপের পাথরটা ক্রমশ ভিতর দিকে ঢুকে গেল। এরকম জাদু আমি অন্তত দেখিনি। এও যে সম্ভব ভাবতে পারছি না এখনও। অথচ চোখের সামনে দেখে অবিশ্বাস করতেও দ্বিধা হচ্ছে। কিন্তু এত ধীর-স্থিরভাবে কাণ্ডটা করলেন লুই গ্রাঁ, মনে হল এসব ওঁর আগে থেকেই জানা। আমাদের কোনও প্রয়োজনই ওঁর নেই। তবু কেন যে সঙ্গে করে আমাদের নিয়ে এসেছেন, এটাই এখন খটকা।
সুড়ঙ্গের মুখটা খুলে যেতে পকেট থেকে একটা ওয়াইনের বোতল বার করে ক্ষতস্থানে ঢেলে নিজে-নিজেই একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে নিলেন লুই গ্রাঁ। তারপর সেই জানালার ফোঁকর দিয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমরাও তাকে অনুসরণ করে চললাম। কতক্ষণ চলেছি, কোথায় চলেছি, কোথায় থামতে হবে, কিছুই জানা নেই। সকলেই ঘোরের মধ্যে আছি। চোখে অন্ধকারটা খানিক সয়ে গেছে। কিন্তু একটা অনুভূতি হচ্ছে, আমাদের যাত্রাপথের দুই পাশে সারি সারি অসংখ্য মৃত মানুষেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। গায়ে যেন তাদের নিশ্বাস পড়ছে টের পাচ্ছি। তাদের জ্বলন্ত চোখ আমাদের নিঃশব্দে অনুসরণ করছে। লুই গ্রাঁ এতটাই আগে আগে যাচ্ছেন যে এই অন্ধকারের মধ্যে ওঁর স্থিতিটুকু ওর টর্চের আলোতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ওই চলমান জ্যোতিটুকু লক্ষ্য করেই বুঝে নিতে হচ্ছে উনি এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু কতদূর?
এর মধ্যে স্তেগার্ট কোনও একটা শব্দ শুনে একবার ফায়ার করতেই গোটা অন্ধকারটা অস্বাভাবিক আন্দোলনে দারুণভাবে নড়ে উঠল। একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার এবং চিৎকারটা মেয়েলি। আমাদের মধ্যে কোনও মেয়ে ছিল না। তাহলে এটা কার কণ্ঠস্বর? কে বলতে পারে?
লুই গ্রাঁ অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ আর তিরিক্ষি মেজাজে চিৎকার করে উঠলেন, “কে তোমাকে গুলি চালাতে বলেছে?”
শান্ত স্বরে স্তেগার্ট জবাব দেয়, “শব্দটা তোমার দিকেই কিন্তু এগোচ্ছিল।”
“তোমাকে আমার ভাবনা ভাবতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দাও।”
বলতে-বলতেই একটা অদ্ভুত কোলাহলে সুড়ঙ্গটা ভরে উঠল। এতগুলো প্রাণী, কি মানুষ, অথবা অতিমানুষের অস্তিত্ব এতক্ষণ কোথায় ছিল তবে? আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামনের আলোটা হঠাৎ করেই পিছু হটছে। আমরা থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের সামনের আলোটা এবার খানিকটা নেমে গেল। তারপর একেবারে নীচে, মানে আমাদের পায়ের স্তরে নেমে এল। তবে কি লুই গ্রাঁ শুয়ে পড়েছেন? কিন্তু কেন? ইনি কি তবে পৌরাণিক দেবতাদের উদ্দেশে প্রার্থনা শুরু করে দিলেন?
কিছুই বুঝতে পারছি না। তারপর হঠাৎই একসময় দেখলাম, আমাদের চোখের সামনের আলোটা দ্রুত চলতে লাগল। মনে হল কেউ বা কারা যেন আলোটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা লুইয়ের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, “আমেন! আনুবিস!”
আনুবিস নামটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম কুলিগুলো একেবারে ফ্যাকাসে মেরে গেল।
“ওরা বোধহয় লুই গ্রাঁকে নিয়ে যাচ্ছে!” আবাশি আবুবাকর বলে উঠল। ওর স্বরে নিদারুণ ভয় আর অসহায়তা। এখন ওর স্বর থরথর করে কাঁপছে।
“কিন্তু ওরা কারা?”
“অশরীরী আত্মারা। লুই গ্রাঁ বলছিল।”
আমরা আর কিছু না ভেবে সবাই সেই অন্ধকারের মধ্যেই দৌড়তে লাগালাম। দেখতে পাচ্ছি আলোটা ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। অর্থাৎ কোনও অদৃশ্য ঢাল বেয়ে আমাদেরকেও উঠতে হবে। ঠিক তখনই পায়ের নীচে অনুভব করলাম পথটা সত্যিই ঢালু হয়ে ওপরের দিকে চলে গেছে। প্রায় পাঁচশো ফুট মতো ঢাল বেয়ে তরতর করে উঠে গিয়ে আমাদের সামনের আলোটা হঠাৎ থেমে গেল। আমরাও চলা থামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এতটা ঢালু পথে উঠতে গিয়ে কুলিগুলো পর্যন্ত ছুটতে ছুটতে হাঁফিয়ে গেছে। আমাদের অবস্থা তথৈবচ। স্তেগার্ট আর কিছু না ভেবে সামনের আলোটার চারপাশে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করল। ওহ্, সে কি কোলাহল! কান পাতা যায় না। যখন সব শান্ত হয়ে পড়ল, সবাই ছুটে গিয়ে দেখি লুইয়ের আধমরা শরীরটা সেখানেই পড়ে আছে। আর সারা গায়ে অজস্র আঁচড়ের দাগ।
তার গায়ে আলো ফেলতেই কুলিগুলো সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, “আনুবিস! আমেন!”
“আনুবিস!”
“ওই আঁচড়গুলো দেখুন।” কুলিরা বলে উঠল। ভয়ে তাদের হাড় হিম হয়ে গেছে। তারা এখনই ছুটে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। কোথায় পালাবে, কীভাবে পালাবে যদিও সে-সব এই মূহূর্তে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিপদটা যে সাধারণ নয়, সে-সম্বন্ধে একটা অস্বচ্ছ ধারণা হয়তো সবার মনেই ততক্ষণে গেঁথে বসেছে।
আমরা বিপদের গুরুত্ব বুঝে সবাই গোল হয়ে লুই গ্রাঁকে ঘিরে দাঁড়ালাম। এই মুহূর্তে ওঁকে নিয়ে কোথাও নড়া যাবে না। আবার ওঁকে ফেলে চলে আসাও যায় না। ওই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে চারদিকে টর্চের আলো ফেলেও কিছু ঠাহর করা গেল না আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। শুধু কালো দিয়ে চারদিক ঢাকা। তবে এটা বুঝতে পারছিলাম, আমরা অনেক উঁচু কোনও একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি যেখানে মৃত্যুপুরীর গাঢ় গহন অন্ধকার সাপের মতো আমাদের সর্বাঙ্গ পাকে পাকে পেঁচিয়ে জড়িয়ে রয়েছে, আপাতত যার হাত থেকে নিস্তার নেই। বাকি রাতটুকু টর্চের আলো আর চোখ জ্বেলে সারারাত অসংখ্য অগণন আনুবিসের চিৎকারের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া সেই মুহূর্তে কিছু করার ছিল না।
“তাহলে ওই মেয়েলি গলায় চিৎকার? সেও কি আনুবিসের? যত্ত সব গাঁজাখুরি!” আবুবাকরের অধৈর্য আর ঘৃণা ঝরে পড়ে কুলিদের উদ্দেশে।
আমি আর না বলে পারলাম না—“আবুবাকর সাহেব, যেটা বুঝিনি তা নিয়ে কিছু বলব না। কিন্তু যেটা বুঝেছি তা বলতে অসুবিধা নেই। আপনি যদি কখনও মধ্যরাতে কোনও বেদনাপূর্ণ কান্নার শব্দ শুনে থাকেন যা কোনও মহিলার চিৎকারের মতো শোনায়, তবে আপনি সম্ভবত কোনও মেয়ে শেয়ালের চিৎকার শুনে থাকবেন।”
“তার মানে আপনি বলতে চান অতীন্দ্রিয় ব্যাপার-স্যাপারে আপনি বিশাস রাখেন?”
“রাখি। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবী নিজেই রহস্যের আকর। তার গর্ভে প্রতিনিয়ত রহস্যের জন্ম। সব রহস্য যে বিজ্ঞানের গোচরে এসেছে তা নয়। বিজ্ঞান যে সব রহস্যের সমাধান করতে পারবে তাও নয়। বরং আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর কিছু কিছু রহস্য তার আদিম সত্ত্বায় চিরকাল স্থায়ী হলেই ভালো। সব রহস্যের সমাধান হতে নেই। হওয়ার প্রয়োজনও আছে বলে মনে করি না। কিন্তু অতীন্দ্রিয়কে বোঝার জন্যও পরিশীলিত জ্ঞানের প্রয়োজন। কিন্তু শুধুমাত্র কুসংস্কারের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখলে জ্ঞানের আর কী মূল্য?”
“এই মুহূর্তে তাহলে আপনার কী অভিমত?”
“স্তেগার্টের গুলি খেয়ে শেয়ালগুলোই আর্তনাদ করে উঠেছিল, যেটা মহিলাদের তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকারের মতো শুনিয়েছে। লুই গ্রাঁ সম্ভবত যে ঘোরের মধ্যে ছিলেন, তাতে তিনি এই চিৎকারের প্রেক্ষিতে আক্ষরিক অর্থেই আনুবিসের উপস্থিতি বোধ করেছেন। আর এইজন্যই তিনি স্তেগার্টকে গুলি করতে বারণ করেছিলেন। যাই হোক, জায়গাটা আমাদের পক্ষে এখন সত্যিই নিরাপদ নয়। এখানে চারদিকে আর কত আনুবিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কে জানে! যতক্ষণ টর্চের আলো জ্বলছে ততক্ষণ ওরা হয়তো দূর থেকেই চিৎকার করবে। অবশ্য আক্রমণ করতেও যে পারে না তা নয়। সেক্ষেত্রে স্তেগার্টের বন্দুকের ওপর ভরসা।”
যদিও আমার সঙ্গেই রয়েছে শত্রুঘ্ন, তবে মনে হয় না এত সামান্য কারণে তাকে ব্যবহারের প্রয়োজন হবে।
ভোরের আলো ফুটতে দেখা গেল আমরা একটা পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে রয়েছি। যার অর্থ সে-রাতে যে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল সেটা এই পাহাড়ের পাদদেশে এসে মিশেছিল। আর অন্ধকারে এরই ঢাল বেয়ে আমরা ক্রমশ ওপরে উঠে গিয়েছি। যাই হোক, এখন সবাই মিলে ধরাধরি করে ওই উঁচু থেকে লুই গ্রাঁকে নামিয়ে এনে হাসপাতালে দেওয়া হল। এখন ওখানকার নার্স আর ডাক্তাররাই ওঁকে দেখবেন।
জানুয়ারি, ১০
একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, সব জায়গা থেকে যদি শূন্য হাতেই ফিরতে হয়, তাহলে রানির মমিটা গেল কোথায়? সত্যিই কি সেটা লুটেরাদের কবলে পড়ে শেষ হয়ে গেছে? তার অর্থ, যারা লুট করেছে তাদের ধারণাই ছিল না এটা কার মমি। তারা শুধু ধনসম্পত্তি লুট করে বাকিটা নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু মন থেকে এসব মেনে নিতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না।
হোটেলে ফিরে এসে সব কাজ ফেলে ফার্গুসন আর আমি বসে গেলাম সেই কবিতাটা নিয়ে। ভারি আশ্চর্য কবিতা।—
অশ্বারোহী রানি নাইলের বিপরীত প্রিয়শয্যায়।
এবার ঘুম ভাঙালে তাঁর কালো অভিশাপ নিশ্চয়!
আমাদের সঙ্গে স্তেগার্ট আর আবুবাকরও রয়েছে। স্তেগার্ট এখন সুস্থ। আবুবাকর প্রথম মুখ খুলল।—“এটা কি তবে সেই অভিশাপের ফল?”
বললাম, “সঠিক জানি না। তবে নাও হতে পারে।”
“তার মানে, ড. চন্দ্রা, আপনি বলতে চাইছেন কুলিরা বা লুই গ্রাঁ যে আনুবিসের ভয় করছিল, আসলে তার সঙ্গে আনুবিসের কোনও যোগ নেই?”
“তাই তো মনে হচ্ছে। অবশ্য যদি এই কবিতার মানে খুঁজে পাওয়া যায় শেষ পর্যন্ত।”
ফার্গুসন বলল, “কবিতাটার কি আদৌ কোনও মানে আছে, ড. চন্দ্রা? আমরা ভুল ভাবছি না তো?”
আমি বললাম, “হতেই পারে আমরা ভুল ভাবছি। কিন্তু কবিতাটা যারা লিখল তারাও কি ভুল ভেবেই লিখল? মানে জেনেশুনে ভুল ভাবল? সেটা কি সম্ভব? সেটাই ভাবছি।”
“আপনারা ভাবুন। আমি একবার লুই গ্রাঁকে দেখতে যাব।”
আবাশি আবুবাকর উঠে চলে গেল। স্তেগার্ট ওর সঙ্গে গেল।
আমি ফার্গুসনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, নীলের বিপরীত শয্যার কী মানে হতে পারে? কিছু আন্দাজ করতে পারো?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়। রানি হেটেফেরেসের সমাধি তো নাইলের বিপরীত তীরেই। মানে বলতে চাইছি, নাইলের যে তীরে কায়রো, তার বিপরীত তীরে গিজা। মিলে যাচ্ছে। কিন্তু অশ্বারোহী কেন? আগেকার দিনে অবশ্য ঘোড়াই প্রধান পরিবহণ ছিল। তাই কি অশ্বারোহী?”
“একবার লুইয়ের দেওয়া ধাঁধায় যদি ফিরে যাই? লুই গ্রাঁ বলেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে রানিকে জি-৭০০০-এক্সে সমাহিত করা হলেও অ্যান্টিকের চোরা কারবারিরা হয়তো আগেই রানির সারকোফেগাস খুলে মমি ও বহুমূল্য সামগ্রী সরিয়ে ফেলে জি-৭০০০-এক্স থেকে এবং একটি ধাঁধা তৈরি করা হয় জি১-এ-এর জায়গায়। কিংবা রানিকে বাস্তবে জি-৭০০০-এক্স স্থানে সমাহিত করাই হয়নি। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় দাহসুর পিরামিডে তাঁর স্বামীর পাশে। কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখেছি, সেখানেও রানির সারকোফেগাস নেই। এর কী মানে হতে পারে?”
“বলতে পারব না।”
“একটু যদি ইতিহাসে ফিরে যাই? প্রাচীন মিশরের অনেক অনেক হাজার বছর আগে থেকে ভারতীয় সভ্যতার শুরু ও উন্মেষ। এই ভারত থেকে দাবাখেলা প্রাচীন মিশর ও সুমেরীয়রা শিখেছিল এবং ভারতের মতোই তাদের নিজেদের দেশেও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এই অশ্বারোহী কথাটার মধ্যে তেমন কোনও ইঙ্গিত থাকতে পারে।”
“হঠাৎ এ-কথা কেন মনে হচ্ছে?”
“এটা নেহাতই একটা ক্লু। তোমার কী মনে হয়, নাইলের সম্বন্ধে তুমি যা বললে সেইটাই ধরা আছে এই কবিতায়? আর কিছু হতে পারে না?”
“তোমার মাথায় কিছু আসছে? আমার আসছে না।”
ওর সামনে মিশরের মানচিত্রটা খুলে দিয়ে বললাম, “একবার মানচিত্রের দিকে তাকাও। নাইল দক্ষিণে না গিয়ে উত্তরে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে মিশেছে। ‘নাইলের বিপরীত শয্যা’ বলতে তবে কি প্রথম যেখানে রানিকে সমাহিত করা হয়, তার পরে সেখান থেকে দক্ষিণের কোনও সমাধিতে তাঁর সারকোফেগাস স্থানান্তরিত করা হয়েছে? নিশ্চয় হয়েছে, না-হলে ‘এবার’ কথাটার প্রয়োজন ছিল না। দ্বিতীয়ত, ‘প্রিয়শয্যা’ কথাটা প্রধানত স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীর শয্যাকেই নির্দেশ করে হয়তো। কিন্তু এখানেও আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। তাঁর স্বামীর সমাধিতে রানির সারকোফেগাস নেই। তাহলে রানির প্রিয়শয্যা কোনটি?”
ফার্গুসন এবার আমাকে রীতিমতো জেরা করে বসে—“এতক্ষণ যে দাবা নিয়ে বলছিলে সে-প্রসঙ্গ কেন এল বলতে পারো?”
“বলছি, বলছি।” আমি বললাম, “যদি দাবাখেলার কথা ভাবো, তাহলে অশ্বারোহী বলতে আড়াই চালের কথা মাথায় আসে। এবার রানির সারকোফেগাস নিয়ে ধাঁধার কথা ভাবো। আমি এঁকে বোঝাই। বুঝতে সুবিধা হবে। কী মনে হয়? এভাবে ভাবতে পারি আমরা?”
“তা ভাবতে পারি। কিন্তু ওই প্রিয়শয্যার ব্যাপারটা? সেটার সম্বন্ধে কিছু নিশ্চিত হতে পারছি না।”
“আসছি। জি-৭৩৫০। দ্বিতীয় হেটেফেরেসের সমাধি। খুফুর বড়ো ছেলে কাওয়াবের স্ত্রী, পরে দজেদফ্রের স্ত্রী। আবার দাবি করা হচ্ছে জি-৭০২০-ও দ্বিতীয় হেটেফেরেসের সমাধি। কিন্তু প্রশ্ন, একই লোকের দুটি অরিজিনাল সমাধি কী করে হতে পারে? বরং এটা ভাবা যেতে পারে, রীতি অনুযায়ী জি-৭০২০-এ কাওয়াবের সঙ্গেই তাঁর স্ত্রী দ্বিতীয় হেটেফেরেসকে সমাহিত করা হয়। আর জি-৭৩৫০ দ্বিতীয় নয়, প্রথম হেটেফেরাসের সমাধি। সেখানেই আছে রানির সারকোফেগাস আর অক্ষত মমি। আর সেটা এই অশ্বারোহীর আড়াই চালের সঙ্গেও মিলে যায়। আর এই শয্যা, যেটি তাঁর নামে নামাঙ্কিত, তাঁরই নাতির স্ত্রীর শয্যা বলে পরিচিত। তাই বলা হয়েছে ‘প্রিয় শয্যা’।”
জানুয়ারি, ১১
এইমাত্র জি-৭৩৫০ থেকে আসছি। খননকার্য শেষ। মূল সমাধি কক্ষের ভেতর গিয়ে আমরাও কিছু দেখতে পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কফিনের ঠিক পিছনের দেওয়ালে চুনাপাথরের প্লাস্টারের স্তরে বেশ কিছুটা অসামঞ্জস্য লক্ষ করা গেল। আমাদের কুলিরা সেখানে গাঁইতি চালাতেই দেখা গেল একটা ফাটল। ফাটলটা ভেঙে পরিষ্কার করতেই একটা গভীর সুড়ঙ্গ নজরে এল। কিন্তু তার গভীরতা যে এতটা হতে পারে ভাবিনি। প্রায় আটচল্লিশ ফুট লম্বা চৌকো সুড়ঙ্গটা ভারি যত্ন নিয়ে খনন করা। সোজাসুজি পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। তার দেওয়ালগুলি রঙিন হেয়ারোগ্লিফিক্সের অক্ষরে সুসজ্জিত। স্বাভাবিকভাবেই এটা দেখার পর আমাদের সবার মুখে রোদ্দুরের মতো হাসি ফুটে ওঠে। যখন সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের কাছে পৌঁছানো গেল, দেখা গেল সুড়ঙ্গটা যেখানে দেওয়ালে মিশেছে সেখানে হেয়ারোগ্লিফিক্সে লেখা সেই কবিতাটি। আর সেটা দেখেই ফার্গুসন চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল, “ড. চন্দ্রা, দেখো, সেই রহস্য কবিতা! এখানেও!”
বললাম, “তবেই তো ধাঁধার উত্তর মিলছে। কিন্তু মুশকিল হল, এখন এই দেওয়াল খোলা যাবে কী করে। লুইয়ের মতো নিজের হাতের রক্ত দিয়ে? আমাদের মধ্যে জাদুবিদ্যা কে জানে?”
ফার্গুসন সে-কথায় উত্তর না দিয়ে বলল, “এই দেওয়ালের পাথরটাকে না ভেঙে টিকিয়ে রাখা যায় না কোনোভাবে?”
বললাম, “সেটা নির্ভর করছে কীভাবে এটা বানানো হয়েছে তার ওপর। যদি আমরা তাদের নির্মাণ কৌশল বুঝতে পারি।”
তারপর অনেক কসরত করে শেষ পর্যন্ত বোঝা গেল পাথরটা প্রকৃতপক্ষে স্লাইডিং দরজার মতো পাশাপাশি খোলে। অতএব আমরা সেভাবেই সেটাকে খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশেষে প্রায় ঘণ্টা আটেকের প্রচেষ্টায় সে বন্ধ দুয়ার অবশেষে খুলল। আর খুলতেই একটা বীভৎস গন্ধে প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে সবাই দেখলাম সেই গোটা সমাধি কক্ষের দেওয়াল জুড়ে রঙিন চিত্র আঁকা। সেও এক দেখার মতো অসাধারণ কারুকার্য। কক্ষের ঠিক মাঝখানে একটা অসামান্য কারুকাজ করা অ্যালাবাস্টার সারকোফেগাস। এখন এর রাজকীয় সৌকর্য আর গরিমা দেখার পর আমাদের কারও আর কোনও সন্দেহ রইল না এটাই রানি হেটেফেরেসের সারকোফেগাস। এবার এটা খোলার পালা। আর সেটা খুলতেই আবার সেই বীভৎস গন্ধটা চাগাড় দিয়ে উঠল। আর চোখের সামনে ভেসে উঠল রানির মমি।
ফার্গুসন বলল, “একটা প্রশ্ন আছে। দ্বিতীয় হেটেফেরেসের মমি রীতি অনুযায়ী তাঁর স্বামীর সমাধিতে রাখা হল অথচ হেটেফেরেসের মমির ক্ষেত্রে রীতি মানা হল না কেন?”
“কারণ হেটেফেরেসের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী প্রথমে তাঁকে তাঁর নিজের তৈরি গিজায় সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু তাঁর প্রিয় নাতির স্ত্রী রীতিনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে সম্ভবত মমি স্থানান্তর করেন। কিন্তু পুরোহিতরা এই কাজ সমর্থন করেনি। আর এই কারণেই সম্ভবত রানির দুটি সমাধিতে ওই অভিশাপ দেওয়ার কবিতাটি লিখে রাখা হয়, যাতে পরবর্তীকালে আর কেউ এধরনের আবদার না করে।”
ফার্গুসন তখন আনন্দে বাকরুদ্ধ। তাকে বললাম, “এ সবই এখন মিশরের সরকারি সম্পত্তি। তোমরা তোমাদের নিয়ম অনুযায়ী এগুলোর দায়িত্ব তুলে নিলে আমাদের কাজ শেষ হয়।”
ফার্গুসন এখনও আপ্লুত। তার মুখের কথা ফুরিয়ে গেছে।
কফিনের পাশে পাওয়া গেল দুটো বড়ো সিন্দুক। একটায় পরকালের ব্যবহারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। আর অন্যটার মধ্যে গুপ্তধন যা পাওয়া গিয়েছে এককথায় তা অসামান্য। বিভিন্নরকমের অজস্র সোনার হার, আংটি, বালা এমনকি ভারতীয় নূপুর। আর অসংখ্য সোনার মুদ্রা। এত মুদ্রা, গুনে শেষ করা যায় না। আর এই রুপোর বালা। তাতে নীলকান্তমণি, বৈদূর্যমণি এবং রক্তনীলা দিয়ে অদ্ভুত কারুকার্য করা। এই তার ছবি। লিখতে লিখতে আমি মনে মনে দারুণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছি। এর সঙ্গে আমাদের বর্ধমানে পাওয়া হরপ্পা যুগের সেই বালার বিবরণ হুবহু মিলে যাচ্ছে।
এর অর্থ হয়তো এরকম হতে পারে, সে-সময়ে ওইরকম বালা ভারতে তৈরি হত এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের কল্যাণে নূপুরের মতো তারই অনুকৃতি পৌঁছে গিয়েছিল মিশরের রানির কাছে। অসম্ভব একেবারেই নয়। এসবের বহু আগে সেই বৈদিক যুগেও ভারতে অলংকারের ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং ভারতের মন্দিরগাত্রে খচিত ভাস্কর্যে সেইসব অলংকারেরই প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। এছাড়াও সে-যুগে ভারতের সঙ্গে মিশরের বাণিজ্যিক যোগাযোগের কথাও আজ রীতিমতো সিদ্ধ। আর শুধু তা-ই নয়, এখন যে বলা হয় রক্তনীলা অশুভ, ওই জিনিস ধারণ করা খুব বিপজ্জনক, কিন্তু এসব দেখেশুনে মনে হয় না তখনকার দিনে এরকম কিছু কুসংস্কার মানুষের মধ্যে ছিল। থাকলে এরকম জিনিস এভাবে তৈরিও হত না আর সুদূর ভারত থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মিশরের রানির হাতে এসে পৌঁছতও না।
স্তেগার্ট জিজ্ঞাসা করল, “এটা না জানলেও চলে তবু জিজ্ঞাসা করছি, আমেন তো আমরা বলি। মিশরীয়রাও বলে কেন?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “আমেন বা আমন মিশরীয় সূর্যের দেবতা, যিনি এক পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিলেন। বলা হয়, ইহুদিরা মিশরে তাদের দাসত্বের সময় আমন সম্পর্কে জানতে পেরেছিল এবং শব্দটি তাদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত করেছিল। শেষ পর্যন্ত এটির বর্তমান অর্থ এই দাঁড়িয়েছে যেটা তুমি এখন জানো। আর-একটা কথা তোমায় বলি স্তেগার্ট, এটাও তোমায় না বললেও চলে, তবু বলছি, ওই যে দ্বিতীয় বারে হিসহিসে গলায় যে ফোনটা পেয়েছিলাম, সেটা আসলে তোমার ফোন। আমাকে ভয় দেখিয়েছিলে যাতে শুধু ওই কারণেই এখানে আসার একটা জেদ আমার মধ্যে পেয়ে বসে। ও, আরও একটা কথা। খুব বেশি সহজ সরল হওয়াটাও কিন্তু বিপদ ডেকে আনে। তুমি যে মানিকজোড় আর ওই সন্দেহভাজন লোকটাকে গুলি করে উড়িয়ে দেবার কথা অত বিশ্বাস করে মানিকজোড়কে বলেছিলে, তার ফলটা তো হাতেনাতেই দেখতে পেলে। ওরাই তোমার ঘর তছনছ করেছিল।”
স্তেগার্টের মুখটা এখন সত্যিই দেখার মতো।
জানুয়ারি, ১৫
বর্ধমান থেকে যে বালা পাওয়া গিয়েও খোয়া গিয়েছে, সেটা হয়তো পুলিশ উদ্ধার করবে। আবাশি আবুবাকর আমার কাছে স্বীকার করেছে, ব্যাবসার প্রয়োজনে চোরা কারবারিদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ যোগাযোগের কথা। সে আমায় কথা দিয়েছে, এই বালা যদি হাত ঘুরে তার কাছে বা তার সার্কিটে কারও কাছে আসে, সে তৎক্ষণাৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতকে সেগুলো ফিরিয়ে দেবার সবরকমের সাহায্য করবে। আপাতত আবাশি আবুবাকরকে ভরসা করতে কোনও দ্বিধা নেই। আশা করি সেরকম কিছু হলে ভারত নিশ্চয় তার হারানো ইতিহাসের গুপ্তধন ফিরে পাবে।
তবে আমায় কে বা কারা ফলো করছিল সেটা এখনও বুঝিনি। হয়তো সেটা পুলিশই খুঁজে বার করবে। আর গন্ধটা সম্ভবত হাইড্রোজেন সায়ানাইডের। ওটা রানির সমাধি কক্ষেও পেয়েছিলাম। কিন্তু সে-গন্ধ স্তেগার্টের ঘরে কী করে পৌঁছল সেটা সত্যিই জানি না। স্তেগার্ট হয়তো জানলেও জানতে পারে। তবে মনে হয় জি-৭০০০-এক্স থেকে বেরিয়ে আসার সময় যে-লোকটি ধাক্কা মেরে আমাদের পরে ঢুকেছিল সে আর কেউ নয়, এই স্তেগার্ট। তখনই সম্ভবত সেখানে ক্যানোপিক জারে রাখা রানির দেহাবশেষ যেগুলো মমি তৈরির সময় খুলে বার করে নেওয়া হয়, তারই একটা হয়তো নিয়ে আসে লোভে পড়ে। আমি আর ওকে এইসব বলে লজ্জা দিতে চাইনি, যদিও ও যা করেছে তা অন্যায়।
এই শেষ লেখাটুকু লিখতে লিখতে হঠাৎই একটা ফোন এল। সুরেন্দ্রর। ফোনটা তুলতেই ও-পার থেকে প্রশ্ন ভেসে এল—“বালাগুলোর হদিস পেলেন, ড. চন্দ্র?”
বললাম, “হদিস পেয়েছি। তবে সেটা এখন মিশরীয় সম্পত্তি। হেটেফেরেসের মমির সঙ্গে ছিল। তুমি যা বর্ণনা দিয়েছিলে হুবহু তার সঙ্গে মিলে যায়। আমি তার ছবিও দেখাতে পারি।”
“যাক, তাও ভালো। আমরা ভাগ্যিস এখানে ছবি তুলে রেখেছিলাম। আপনি এলে আপনার ছবিটাও দেখবার ইচ্ছা রইল।”
“আচ্ছা, একটা কথা বলবে? তুমি কি আমার পিছনে ফেউ লাগিয়েছিলে?”
“ফেউ নয় ডক্টর, আপনার সুরক্ষার জন্য একজন ব্ল্যাক-ক্যাটকে লাগিয়েছিলাম। কত কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে জোগাড় করা হল, আর আপনি বলছেন ফেউ? কোনও কাজে লাগেনি বুঝি?”
“লেগেছে বইকি! অনেক কাজে লেগেছে।”
শীর্ষচিত্র- জয়ন্ত বিশ্বাস