অমর মিত্রের আগের গল্প চম্পকলাল
আমতলী গাঁয়ের সব চেয়ে সাহসী লোক ভুবন চোর। এত বাঁশবন, খড়বন, শ্যাওড়া গাছ, বটতলি, নিঃঝুম কালীতলা, কবরখানা, গাঙের ধারে শশ্মান, এত সব ভয়ডরস্থান, গা ছমছমে দুপুর, হাড় হিম করা রাত, রাতভর তেনাদের চলাফেরা, চাঁদের আলোয় পেত্নির পা দুলোন, পথে বাঁশ ফেলে রাস্তা আটকে দেওয়া, সব কিছুর ভিতরে ভুবন তার কাজ করে বেড়ায়। তার প্রধান কাজ চুরি। চুরি বিনে তার দিন কাটে না। সাত গাঁয়ে ঘুরে বেড়ায়, সুযোগ পেলেই চুরি, তারপর ফকিরহাটখোলায় গিয়ে বেচে আসা। কেনার জন্যবসে থাকত গুলু কুন্ডু। চোরাই মাল বেচে সে লাখপতি হয়েছে ক’বছর আগে। তখন বড় ভোজ দিয়েছিল। বামুন ভোজ, গরিব নারায়ণ ভোজন সব করিয়েছিল।
ভুবন খুব সাহসী বটে। নইলে দিনে রাতে বাঁশতলা, বটতলা, কালীতলা, শ্যাওড়াতলা করে বেড়ায়, কখনো ভয় পায়নি। তাকে দেখে তেনারা রাস্তা ছেড়ে দেয়, ভুবন বস্তা বোঝাই মাল নিয়ে মাঠ পেরিয়ে কবরখানার পাশ দিয়ে, শ্মশানে পড়ে থাকা কাঁথা মাদুর হাঁড়িকুড়ি পার হয়ে, মড়া পোড়ার ধোঁয়া ভেদ করে রাত দুপুরে ফকিরহাটখোলার গাঁয়ে গুল কুন্ডুর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক মারে, ভুবন এল গো গুলুদা ও গুলুদা, গুলুবাবু, গুলকু। কু মানে কুন্ডু।
গুলু হল শুকনো বাঁশের মতো রোগা, সিড়িঙ্গে একটা লোক। সে জেগে থাকে ভুবনের ফোন পেয়ে। ভুবন চোর হলে কী হবে, রীতিমতো ফোনে কথা চালাচালি করে। মেসেজ পাঠায় খবর দিয়ে। ফোনটা সে নিজের টাকায় কিনেছে বসিরহাটের এক দোকান থেকে। সঙ্গে এক ডজন হাত সাফাই করেছিল দিনেদুপুরে। সাফাই করা মোবাইল সব গুলু কিনেছিল ডজন দরে। মোবাইলে খুব সুবিধে হয়েছে ভুবনের। যেদিন জিনিস দেবে, মানে চুরি হলো, ফোন করে সে গুলুকে জানিয়ে দেয়। চুরির মালের ছবি পাঠিয়ে দেয় হোয়াট’স অ্যাপে। আগে যখন ভুবন চোর ফোন ব্যবহার করত না সেই মাঝ রাত্তিরে এসে রীতিমতো হল্লা লাগিয়ে দিত। ততে ঘুমকাতুরে গুলুর খুব কষ্ট হতো ঘুম চটে গিয়ে। এখন সে অপেক্ষা করে ভুবনের ফোন আর হোয়াট’স অ্যাপ মেসেজের। ফোন না পেলে কষে ঘুমোয়। আর ঘুমের ভিতরে চোরাই মালের স্বপ্ন দ্যাখে। ইচ্ছে বড় একটা চোরা বাজার খুলবে ফকিরহাটখোলায়। আলপিন থেকে এরোপ্লেন সব বেচবে। ভুবন যদি এখন এরোপ্লেন হাতিয়ে আনতে পারে। বিমান ছিনতাই।
গুলুর সামনে পিঠ থেকে বস্তার বোঝা নামিয়ে ভুবন হাত পাতল, দাও কত দেবে।
রাত তখন অনেক। চাদ্দিক ঝিমঝিমে। ঘোলাটে জোছনায় উঠোনে নিজের ছায়া দেখলেই গা কেমন করে। গুলু বলল, কী আছে?
একটা সিন্দুক, ছবি পাওনি হোয়াট’স আপে?
খুলে কী দেখলাম ঘুম ঘোরে, তোর ছবি কী?
দূর, সিন্দুক, ভালো করে দেখো। ভুবন বলল।
ফোন ভিতরে, ছবি দেখে কী হবে আসলটা দেখা। গুলু কুন্ডু বলল।
সিন্দুক আছে বস্তায়, কত দেবা বলো। ভুবন আবার হাত পাতল।
সিন্দুক না হয় হলো, তার ভিতরে কী আছে?
ভুবন বলল, খুলে তো দেখিনি।
আগে দেখা কী আছে। গুলু কুন্ডু বলল।
তুমি কামার ডেকে চাবি করে নিয়ে খুলে দেখ। বলল ভুবন।
কোন কামার?
কেন উদো কামার। বলে ভুবন খি খি করে হাসতে থাকে।
নলকোড়ার উদো?
ভুবন বলল, হাঁ, সেই উদো, বেটার কী ঘুম, নাকের কী ডাক, ঘর কাঁপে থরথর করে।
তুই গিসিলি চাবি করাতে?
ভুবন বলল, ওই ধরতি পার গুলদা।
সিন্দুকটা কার ঘরের?
অত বলা যাবে না।
বাহ, না বললে হয়, আমি তো বেচব।
ভুবন বলল, বেচবা কেন, নিজির ঘরে রেখে দাও রং বদল করে।
কথাটা মনে ধরল গুলুর। একটা সিন্দুক বাড়িতে থাকলে সুবিধে কত। চোরাই সোনাদানা, গয়নাগাটি টাকার তাড়া সব রেখে দেওয়া যায়। একটা সিন্দুক থাকলে মনে হয় কিছু আছে বাড়িতে। উঠোনের ঝুপসি আলোয় বস্তা থেকে সিন্দুক বের করে দিল ভুবন। বেশ ভালো সাইজ, তার কপালে সিঁদুর। ভিতরে কী আছে? সিন্দুকে কি সোনা রুপো তামা থকবে? নোটের বান্ডিল আছে?
চাবি কই? জিজ্ঞেস করল গুলু।
বললাম তো নলকোড়ার উদো কামারকে ডেকে করে নিয়ো।
কেন, তুই চাবি আনিসনি?
কত দেবা বলো। ভুবন হাত পতে।
কত চাস তুই?
দু’হাজার দু টাকা গুণে দিও গুলুদা। বলল ভুবন।
অত হবে না, একশো এক দেব।
তাইলে চাবি পাবা, সিন্দুক পাবা না। বলল ভবন, বাতাসে চাবি ঘুরায়ে দেখো।
আমার আর দিবার সামর্থ্য নাই।
সামর্থ্য নেই তো তুমি নিও না, নিয়ে যাই। বলল ভুবন।
গুলু বলল, ভেতরে কী আছে বল দেখি।
বলা যাবে না। বলতে বলতে ভুবন বস্তায় সিন্দুকটা ঢুকিয়ে আবার কাঁধে তুলে নল। ক্ষমতাও আছে বটে। বস্তা নিয়ে চলল। তা দেখে গুলু বলে, আরে যাবি কোথায়?
গাঙে ফেলে দেব, আমি আমার ঘরে চোরাই মাল রাখিনে, চোরাই মাল ব্যাভার করিনে।
গাঙে তো ডুবে যাবে।
যাবে, তাতে আমার কী?
আচ্ছা দেড়শো এক টাকা দেব, রেখে যা।
ভুবন বলল, গুলুদা, দুই হাজার দুইয়ের এক টাকাও কম হবে না।
এমনি যখন দামাদামি হচ্ছে, তখন হঠাৎ করে একটা লোক নেমে এল যেন আকাশ থেকে, জোছনার ভিতরে অন্ধকার মেখে। বেঁটে আর মোটা। গোলগাল। থপ থপ। দেখে চেনা মনে হয় গুলুদার। কিন্তু মনে করতে পারে না। কিন্তু গা কেমন করে ওঠে। শীত শীত করে। এল কোথা থেকে। ভুবন বলল, বসতে আঁজ্ঞা হয়।
লোকটা গুলুর দিকে তকিয়ে বলল, তুই খুব ছ্যাঁচড়া লোক গুলু।
গুলু বলল, তুমি কে হে?
বহুক্ষণ থেকে শুনছি দরাদরি, ওরে গাধা, ওই সিন্দুক বয়ে আনতেই দু’হাজার টাকা মজুরি, তুই দেড়শ দিবি বলছিস, কান ধরে উঠবস কর।
গুলু রেগে যেতে যেতে মাথা ঠান্ডা করে। সে তো চোরাই মালের কারবার করে, তাকে সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখতেই হয়। এই লোকটা কে? তার কাছে সস্তায় চোরাই মাল কেনে নাকি? নাকি পুলিশের খোচড়, সিন্দুক ঘরে ঢোকালেই দরজায় এসে কড়া নাড়বে? দেড়শো টাকায় কেনা সিন্দুক জলে যাবে। থানায় ঢুকিয়ে নিলাম করে দেবে। গুলু বলল, আপনি কে স্যার?
তোর জেনে কী হবে রে ছাগল, টাকা বের কর।
গুলুর মনে হলো ভুবন চোর এই লোকটাকে ফিট করে এনেছে সিন্দুক বেশি দামে বেচার জন্য। তার ঘটে কি বুদ্ধি নেই? সে চুপ করে থাকে। কিন্তু লোকটাকে তর্জন গর্জন করতে থাকে, এই গুলু, ফোন যখন করা হল, হ্যঁ বললি কেন, তোরে ছবিও পাঠানো হল ইয়েস বললি কেন?
এত দাম আমি দিতে পারব না। গুলু কুন্ডু সাফ বলে দিল।
লোকটা তার মাথা দুলিয়ে বলল, দিতেই হবে, না দিবি তো তোর চোরাই কারবার ঘুঁচিয়ে দেব, এই গুলু, একশোবার উঠবস দে।
তুমি কে? গুলু জিজ্ঞেস করে, তোমার সঙ্গে তো কথা হয়নি।
কথা হয়নি মানে, এই তো হচ্ছে, যা বলছি কর গুলু মাছ না পাকাল।
এই, এসব বলবে না। গুলুর খুব রাগ হয়ে গেল। ভুবন তখন তফাতে বসে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। কখন এই কোঁদল শেষ হবে তারপর সে কথা বলবে। এতে যদি হাজার দুই আয় হয়, সে একটা চুরির যন্তর কিনবে। বিলিতি মাল। সবে বাজারে এসেছে। ব্যাটারিতে চলে।ব্যাটারি চার্জ দিতে হয়। সেই যন্তর দিয়ে নাকি সিঁদ কাটা যায় যেমন, আলমারি, সিন্দুক খোলা যায়। তালা বন্ধ বাড়ির সব তালা চিচিং ফাঁক করে খুলে দেওয়া যায়। গুলু বলল, ভুবন, তুমি যাও, আমার দরকার নেই।
নেই মানে, আলবাত আছে। লোকটা খরখর করে উঠল।
আমি নেব কি নেব না, আমি বুঝব, তুমি কেন মাথা গলাচ্ছ?
লোকটা বলল, আমার মাথা কই যে গলাব?
আরিব্বাস! মাথা তো নেই, গলাবে কী করে, সত্যি তো মাথা কই। গুলুর গা ছমছম করে ওঠে। আরে ভুবন চোর এ কাকে সঙ্গে নিয়ে এল? নমঃ নমঃ, রাম আম, আম রাম।
এই আম আম করবিনে, চোপ! মুন্ডহীন লোকটা ভুসভুস করে বলল কথাটা।
ভুবন বলল, একটু ঝিমিয়ে নিই গুলদা, তুমি কথা শেষ করে নাও।
গুলু তো বুঝতে পারছে আমতলীর তেনাদের কেউ। হায় হায় রাত দুপুরে এ কী হাঙ্গামা! সে হাত জোড় করল, স্যার, আমাকে ক্ষমা করুন, কিন্তু আপনি কে?
নিয়ে আয় তোর মোবাইল।
গুলু ভিতরে গিয়ে মোবাইল এনে ছবির গ্যালারি খুলেই দ্যাখে এই লোকটার মুখ। এইটাই পাঠিয়েছিল ভুবন। ঘুমঘোরে দেখেছিল বলে চেনা মনে হয়েছিল। এই হলো চোরাই মাল। ইয়ার্কি পেয়েছে ভুবন। ভুবন ভুবন, তুই কিসের ছবি দিয়েছিলি?
ঘুমিয়ে পড়েছে ভুবন, ঘুমঘোরেই জবাব দিল, সিন্দুক।
কই সিন্দুক? গুলু ভয়ও পাচ্ছে, আবার ভুবনের উপর তার রাগও হচ্ছে। দাঁত কিড়মিড় করতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার দাঁতে দাঁত ঠেকে যাচ্ছে। উনি আছেন সামনে। সে জোড় হাতে বলল, স্যার, সিন্দুকের ছবি পাঠায়নি ভুবন, আপনার ছবি।
দূর গাধা, আমার কি ছবি হয়, সিন্দুকেরই ছবি। তেনার ঘাড়ে আবার মুন্ডু ফিরে এসেছে। বলল, ঐটা সিন্দুকই।
ভুবন উঠে এল নাক ডাকা বন্ধ করে, বলল, আমি সিন্দুকের ছবি দিইছি গুলুদা, উনি সিন্দুকে থাকেন, সিন্দুকের ভূত, সিন্দুক মানে উনি, উনি মানে সিন্দুক, দেখুন ভালো করে, সিন্দুক মনে হচ্ছে তো, ও স্যার, সিন্দুকটা খুলে বেরিয়ে এস।
গুলু কুন্ডু আম আম করতে লাগল। বস্তার ভিতর থেকে নিজে নিজে বেরিয়ে এল সিন্দুক। তার ভিতর থেকে আবার লোকটা। সিন্দুকের ভূত। পি,সি,সরকারের ম্যাজিক হয়ে গেল অবিকল। ভিতর থেকে উনি বেরিয়ে আবার বললেন, গুলু টাকা দিয়ে ঘরে নিয়ে যা, আমি আর থাকব না ওর ভিতরে, তোর কোনো ভয় নেই, উদো কামার আমারে ঢুকিয়ে চাবি লাগিয়ে দিয়েছিল, জানে না, চাবি আমার কাছে চিচিং ফাক, বেরোতে পারি, ঢুকতে পারি বেরোতে পারি, সিন্দুক নিয়ে উড়তে পারি, ম্যাজিক ম্যাজিক ম্যাজিক পারি।
সেই সিন্দুক এখন গুলু কুন্ডুর ঘরে শোভা পাচ্ছে। উদো কামার এসে চাবি করে দিয়ে গেছে। যেতে যেতে সে বলেছিল, তার একটা এমনি সিন্দুক ছিল, ভূতে নিয়ে গেছে, বারো ভূতের জ্বালায় আর টিকতে পারে না সে।
এমনি সিন্দুক? গুলু জিজ্ঞেস করেছিল।
প্রায় এমনি, চাবি আর রংটাও এমনি প্রায়, কিন্তু এইটি হবে যে তা বলতে পারে না জোর দিয়ে। বলতে বলতে উদো কামার বাড়ির পথে হেঁটেছিল মনের দুঃখে। এই সিন্দুক দেখে তার হারানো সিন্দুকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যে খুব।
চমৎকার ভাষা , দারুণ গল্প
LikeLike
ভালো গল্প,
LikeLike