গল্প আমাজনের আতংক পুষ্পেন মণ্ডল বসন্ত ২০১৭

পুষ্পেন মণ্ডলের আগের লেখা সমুদ্রগুপ্তের তরবারি

golpoamazoner-golpoatonko-1-mediumপুষ্পেন মণ্ডল

রোববারের বিকেলে সবে খেলার মাঠ থেকে ফিরে সনু হাতমুখ ধুয়ে এসে বসেছে কম্পিউটারের সামনে, এমন সময়ে বিশু কাকুর আগমন। আজকে বাবাও ঘরে আছে। তাই সন্ধ্যায় জমিয়ে আড্ডা বসবে। সেখানে সাধারণত সনুর প্রবেশ নিষেধ থাকে। কিন্তু আজকে হঠাৎ কাকু এসেই তাকে তলব করল। হাজির হতে হাতে ধরিয়ে দিল একটা ‘একশো এক ভূতুড়ে গল্প’ নামে একটা বই। দেখে তার আনন্দ আর ধরে না। বিশু কাকু বলল, “একটা কেসের ব্যাপারে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় গতকাল গিয়েছিলাম, আমার একটা বন্ধুর বইয়ের দোকান আছে ওখানে। সে এই বইটা গিফট করল। ভাবলাম, এ বইয়ের কদর আমার থেকে তোর কাছে ঢের বেশি। কী? ঠিক তো?”

“একদম!” সনু ঘাড় নাড়ল হাসিমুখে।

কিন্তু বাবা নাক কুঁচকে মন্তব্য করল, “তুই এত বড়ো পুলিশ অফিসার হয়ে শেষে ভূতের বই দিলি আমার ছেলেকে? তুই নিজে ভূতে বিশ্বাস করিস? যত সব কুসংস্কার।”

চোখ বড়ো বড়ো করে বিশু কাকু বলল, “কী বলিস বুম্বা! আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা শুনলে চমকে যাবি। তবে সেটাকে ভূত না বলে একটা অলৌকিক অভিজ্ঞতা বলতে পারিস। তাছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষের মনে অনেকটা প্রভাব ফেলে। ফলে অনেক কিছু দেখা যায়, যার যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে কোন উত্তর পাওয়া যায় না।”

এরপর আয়েশ করে স্পেশাল দারুচিনির চায়ে চুমুক দিতে দিতে বিশু কাকু গল্পটা বলল –

ঘটনাটা ঘটেছিল উত্তরবঙ্গের এক জঙ্গলে। তখন আমি সদ্য পা দিয়েছি কর্মজীবনে। শিলিগুড়িতে পোস্টিং। সময়টা ছিল মার্চ এপ্রিল মাস। প্রচণ্ড গরম। সপ্তাহ খানেকের ছুটি পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম একা একা। ভুটান লাগোয়া একটা নির্জন ‘হোম স্টে’র খোঁজ পেয়েছিলাম। ওদিকে বেশ আরামদায়ক ঠাণ্ডা ছিল তখন।

আমি যে পুলিশের লোক সেটা এখানে প্রকাশ করিনি। তাক লেগে গেল বাংলোটার ইন্টিরিয়র দেখে। পালিশ করা কাঠের মেঝে, দেয়াল। তার উপর বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের স্টাফ। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরের লনে দাঁড়িয়ে দেখলাম বেশ কিছুটা দূরে পাহাড়ের ঢালে কলকল করে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। দেখেই মনটা নেচে উঠল আনন্দে। দূরের আকাশটা পরিষ্কার, ঘন নীল। গতকাল রাতে যখন এখানে এসে পৌঁছেছি, তখন এই ছবির মত নৈসর্গিক দৃশ্যটা চোখে পড়ার সুযোগ ছিল না। পুরানো গাড়িটা অনলাইনে বেচে নতুন একটা ভালো ক্যামেরা কিনেছিলাম। ইচ্ছা, ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় একটা ছাপ ছেড়ে যাওয়ার।  

প্রথম দুদিন নিশ্চিন্তে ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ আর দুর্দান্ত সব পাখির ছবি ক্যামেরাস্ত করলাম। আর একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এখানে টুরিস্টের ভিড় খুবই কম। ম্যানেজার দুজন কর্মচারী ছাড়া কাউকে দেখাই যায় না।

একদিন রাতে দেখলাম কোণের একটা টেবিলে এক ভদ্রলোক একা খেতে বসেছেন। কেন যেন খুব চেনা চেনা লাগল। গায়ে একটা ছাই রঙের ফুল হাতা জামা, মাথায় গোল সাদা কাপড়ের টুপি। মুখ ভর্তি সাদা দাড়িগোঁফের জঙ্গল। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। এক মনে খাবার মুখে পুরছেন। আমি গুটি গুটি পায়ে গিয়ে বিনম্র গলায় জানতে চাইলাম সামনের ফাঁকা চেয়ারে বসা যাবে কিনা। তিনি সানন্দে অভ্যর্থনা করলেন।

একটু পরে প্রশ্ন করলাম, “কিছু মনে করবেন না, আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি। প্রেসিডেন্সিতে আপনি কি একবার স্পিচ দিতে এসেছিলেন?”

তিনি হেসে বললেন, “না, আমি নয়।”

“ও আচ্ছা, তাহলে আমারই ভুল। ………. তা এখানে বেড়াতে এসেছেন বুঝি?” 

“হ্যাঁ,” মুখে একটা গ্রাস পুরে কিছুক্ষণ পর বললেন, “তবে আমার বেড়ানোটা একটু আলাদা। ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে দিয়ে আমি দুনিয়াকে দেখি না।”

কথাটার মধ্যে একটা শ্লেষ ছিল। বুঝলাম আমাকে নিশ্চয়ই কোন সময়ে ক্যামেরা হাতে দেখেছেন। আগ্রহ নিয়ে বললাম, “কী রকম?”

একটু থেমে তিনি বললেন, “খেতে খেতে কথা বলা পছন্দ করি না আমি। আমার কথা শুনতে হলে খাওয়ার পরে কিছুটা সময় দিও।”

“আমার এখন অখণ্ড সময়।”

খাওয়া সেরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম নদীর দিকে। রাতের পরিবেশটা ভারি সুন্দর। কোটি কোটি নক্ষত্রের টিমটিমে আলো অগুণতি আলোকবর্ষ পেরিয়ে এসে পৃথিবীর অন্ধকার সামান্য হলেও দূর করছে।

কী একটা নিশাচর পাখি ‘চিকচিক’ আওয়াজ করে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। আর আমার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল, “পাখিরা কি স্বাধীন, তাই না? যখন খুশি যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারে!”

দু হাত পিছনে দিয়ে হাঁটছিলেন ভদ্রলোক, হঠাৎ আমার কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, “পাখিরা কি সত্যিই স্বাধীন?”

“মানে? ওরা যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারে। কী মজা ওদের!”

“হাহাহা…” করে দমকা হেসে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। “এ কথা ঠিক যে পাখিদের ডানা আছে বলে, ডানায় ভর দিয়ে ওরা যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারে। কিন্তু কোনদিন ভেবে দেখছ কি, যে পাখিরা দূর দূরান্তে, অনেক সময়ে হাজার হাজার মাইল উড়ে বেড়ায়, তা কি শুধু বেড়াতে ভালবাসে বলে? না। ওরা যে উড়ে বেড়ায় সেটা মোটেই নিজের খেয়ালে নয়। প্রয়োজনের তাগিদে। পাখিদের বাসা বদলানোর অভ্যাস গড়ে উঠেছে লক্ষ বছর ধরে অসংখ্য প্রজন্মের জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ হেটে গিয়ে আবার বললেন, “যেমন ধর, পাখিরা সব জায়গায় উড়ে বেড়াতে পারে। কিন্তু কখনও দেখেছ যে কাকা, চড়াই বা ঘুঘুর মত একেবারে সমতলের পাখি কখনও উত্তরের দেবদারু বার্চের জঙ্গলে উড়ে বেড়াচ্ছে? সেটা কোন দিনই সম্ভব নয়। দুনিয়ার প্রত্যেকটা পাখির নিজের নিজের জায়গা আলাদা। কেউ বাস করে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে, কেউ বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে আবার কেউ সমুদ্রের ধারে। অদৃশ্য দেয়াল দিয়ে সব ভাগ করা আছে। আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু ওরা পায়।”

হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা লম্বা পাইন গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। মাথা উঁচিয়ে উপর দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুধু অদৃশ্য দেয়াল নয়। এই যে জঙ্গল দেখছ সেটা ভাগ করা আছে বেশ কয়েকটা তলাতে। শহুরে মানুষ যখন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তখন সে একটাই জঙ্গল দেখে। কিন্তু এর মধ্যেই আছে ভিন্ন ভিন্ন বন, আলাদা আলাদা তলা। যেমন পাইন গাছের বন সাধারণত দোতলা, কি তিনতলা। আবার শাল বা সেগুন গাছের বন হয় সাততলা। মানুষ প্রায়ই বাসা বদল করে। উঠে যায় অন্য তলায়। কিন্তু জঙ্গলের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে অন্য তলার বাসিন্দাদের সাথে বাড়ি বদল করা একেবারে অসম্ভব। বন মোরগ তার স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘর ছেড়ে কক্ষণো শুকনো খটখটে চিলেকোঠায় উঠে আসবে না, আবার চিলেকোঠার বাসিন্দা চিল, সেও তার ঘর ছেড়ে গাছের গোড়ায় বাসা বাঁধতে যাবে না।”

আমি বললাম, “বাবা! কত কিছু জানার আছে!”

“গাছের মাঝামাঝি তার ভিতরটা কিন্তু খুব ঠাণ্ডা। শীতকালে সেখানে কেউ থাকলে জমে যাবে। গ্রীষ্মকালে অবশ্য বেশ আরামদায়ক। বিশেষত পেঁচা আর বাদুড়দের পক্ষে। দিনের বেলা তারা কোথাও কোন জঙ্গলের কোণে ঝিমিয়ে কাটিয়ে দেয়। কাজে বের হয় রাতের শিফটে।”

“আপনার তো দেখছি এসব বিষয়ে বিশাল জ্ঞান। সারা জীবন জঙ্গলেই কাটিয়েছেন মনে হয়।”

“তা একরকম ঠিকই বলেছে। পৃথিবীর এমন কোন বড়ো জঙ্গল নেই যেখানে আমার পা পড়েনি। বছর পনের আগে আমাজনের জঙ্গলে মরতে বসেছিলাম প্রায়।”

“তাই! কীভাবে?”

“একটা এক্সপিডিশানে গিয়েছিলাম। নতুন ধরনের কিছু প্রাণীর খোঁজ করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। ‘মানাকাপুরু’ থেকে সোলিমস নদী ধরে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে ‘আনোরি’ নামে এক জায়গায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক ধরনের লাল রঙের বাদুড়ের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে সাধারণত যে লালচে বাদুড় দেখা যায় তার থেকে এটা আলাদা। এদের রং ঘন খয়েরি, কানগুলো অন্য বাদুড়ের থেকে অনেকটা লম্বা। আর সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হল এদের খাদ্যাভ্যাস। এরা অন্য বড়ো প্রাণীর রক্ত চুষে খায়।”

এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ চুপ করে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর কী হল?”

হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললেন, “আজকে অনেক রাত হল। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। এখন তুমি ঘুমাতে যাও। পরে কথা হবে।”

আমি বললাম, “চলুন এক সাথে ফিরব।”

“না, আমি পরে ফিরব। তুমি যাও।” বলে নদীর দিকে চলে গেলেন।  আমি একটু হকচকিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে উঠে ক্যামেরাটা নিয়ে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময়ে পিছন থেকে আওয়াজ এলো, “নতুন কিনলেন? এতে নাইট ভিশান আছে?”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মাঝারি উচ্চতার একজন মধ্যবয়স্ক লোক। মাথায় গোল টুপি, গায়ে ফুল হাতা ঢলঢলে সবুজ রঙের জামা, আর টেরিলিনের প্যান্ট। সূচালো মুখের উপর ঝোলা গোঁফ। কোঠোরে বসা চোখ। তার উপর গোল গোল চশমা। বয়েস পঞ্চাশের উপরে।

হেসে বললাম, “হ্যাঁ, তা আছে।” বলেই পাশ কাটিয়ে এগোতে যেতে আবার পিছন থেকে মন্তব্য করলেন, “এদিকে কি প্রথম এলেন নাকি মশাই?”

দাঁত চেপে গম্ভীর গলায় বললাম, “হ্যাঁ।”

“আমি অনেক দিন ধরে আসছি। আপনি যদি জঙ্গলের ছবি তুলতে চান আমাকে বলবেন, এমন জায়গায় নিয়ে যাব যে চমকে যাবেন। চারিদিকে শুধু বড়ো বড়ো গাছের সারি। যেখানে মাটিতে সূর্যের আলো পৌঁছায় না।”

আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনি কি গাইড?”

“হা হা হা! আমাকে দেখে কি তাই মনে হয় নাকি! আমি বনের মধ্যে থেকে ঔষধি গাছগাছড়া সংগ্রহ করি।”

আমি থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মানে আয়ুর্বেদিক, আপনি কবিরাজ?”

হেসে বললেন, “ঠিক ধরেছেন, অধমের নাম শ্রী রমেশচন্দ্র বৈদ্য। শিলিগুড়িতে একটা ডিস্পেনসারি আছে। এই রিসর্টের মালিকেরই দোকান ওটা। তাই এক আধ দিন কাটিয়ে যাই বিনা পয়সায়। হেহে!”

“আচ্ছা?”

“হ্যাঁ, আমার দেয়া ওষুধ খেয়ে ভদ্রলোকের বহু পুরানো হাঁপানি সেরে গেছে। তাই আমাকে খুব শ্রদ্ধা করেন।”

আমি বড়ো ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটি আমার পিছু ছাড়লেন না। পিছন পিছন এসে বললেন, “তা আপনার এই ছবি তোলার শখটা তো একেবারেই নতুন, তাই না?”

“কী করে বুঝলেন? আপনি কি আয়ুর্বেদের পাশাপাশি জ্যোতিষচর্চাও করেন?”

“ও ঠিক বোঝা যায়। প্রফেশনালরা যেখানে সেখানে ক্যামেরা তাগ করে না।”

কথাটা শুনে একটু মানে লাগল। কোন সাড়া না দিয়ে পাথর বেয়ে খাড়াই কিছুটা উঠে মোটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। গাছের গোড়ায় নাম না জানা পাহাড়ি ছোটো ছোটো রঙিন ফুল গুলো কি সুন্দর! হাঁটু মুড়ে বসে গোটা কতক ক্লিক করলাম। উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম, এখান থেকে একটা ভালো ভিউ পাওয়া যাচ্ছে নদীটার। তারপরে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। আর একদিকে পাহাড়ের ধাপে চায়ের বাগান। ঐ দিকে দু চারটে ক্লিক করে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি ভদ্রলোক আবার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। চোখাচোখি হতে বললেন, “হেহে… রাগ করবেন জানি, তবু আজকে আপনার পিছন ছাড়ব না।”

“কেন বলুন তো?”

গম্ভীর গলায় বললেন, “আসলে আপনার সাথে আমার একটা দরকার ছিল। এবং সেটা একটু গোপনে।”

আমি অবাক হয়ে গেলাম, “মানে? সবে দু মিনিট আগে আপনার সাথে আমার আলাপ হল। এখনও আমার নাম পর্যন্ত আপনি জানেন না। তা আমার সাথে গোপন কি দরকার থাকতে পারে?”

“আপনার নাম আমি জানি। কৌস্তব দত্ত। বাড়ি বেহালা, কলকাতা।”

আমি ভ্রূ কুঁচকে তাকাতে হেসে বললেন, “আপনি যখন রেজিস্টারে নাম লিখছিলেন আমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, খেয়াল করেননি।” তারপর একটু ইতস্তত করে চাপা গলায় বললেন, “আসলে ব্যাপারটা সবাইকে বলা যাবে না বুঝলেন। আর বললে সবাই বিশ্বাসও করবে না। সপ্তাহখানেক হল আছি এখানে, একটা অদ্ভুত লোককে দেখছি। আচরণটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। সারা দিন ঘুমায়। আর রাত্রিবেলা চুপি চুপি বেরিয়ে যায়। আবার ভোরবেলা ফিরে আসে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে  থেকে বললাম, “তা আমি কি করব? পুলিশে খবর দিন। টেররিস্ট হতে পারে।”

“না ওসব নয়। এটা অন্য কেস।”

“সেটা আপনি জানলেন কি করে? আপনিও কি নিশাচর নাকি?”

“না না, তা কেন? আসলে ঐ লোকটার আর আমার রুম একেবারে সামনা সামনি। তাই আমি খেয়াল করেছি ব্যাপারটা। আর দুদিন আগে রাতে আমি চুপি চুপি লোকটার পিছনে ধাওয়াও করেছিলাম।”

“ধাওয়া করেছিলেন? কেন?”

“আসলে তার আগের দিন, ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে নদী পেরিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিলাম কিছু ঔষধি গাছের সন্ধানে। হঠাৎ দেখি ঐ লোকটা বেরচ্ছে জঙ্গলের ভিতর থেকে। আবছা আলোয় যা দেখলাম, তাতে পিলে চমকে গেল। লোকটার কষে রক্ত তখনও লেগে আছে।”

“রক্ত? অন্ধকারে রক্ত বুঝলেন কী করে?”

“লোকটা চলে যাবার পর জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে দেখলাম, একটা পূর্ণবয়স্ক শিংওয়ালা সম্বর তখনও থরথর করে কাঁপছে। কাছে গিয়ে দেখি তার গলায় দুটো ফুটো। শরীরের পুরো রক্ত শুষে খেয়ে নিয়েছে।” বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, “লোকটা আসলে একটা ভ্যাম্পেয়ার!”

“মানে রক্তচোষা বাদুড়?”

“একদম। ওঁর কাণ্ডকারখানা খুব ভয়ানক বুঝলেন? ওদের একটা দল আছে। আমি একা এগোতে ঠিক সাহস পাচ্ছিনা। তাই বলছিলাম কি, আপনি যদি আমার সঙ্গ দেন তাহলে লোকটাকে একেবারে হাতে নাতে ধরতে পারি।”

“হা.. হা..” করে আমি এত জোর হেসে উঠলাম যে পাশের গাছ থেকে দুটি পাহাড়ি মুনিয়া ভয়ে উড়ে পালাল।

তিনি রেগেমেগে বললেন, “আমার কথা তাহলে বিশ্বাস হল না। বেশ, ঠিক আছে।”

ভদ্রলোক উলটো দিকে পা বাড়ালেন। আমি বললাম, “আরে দাঁড়ান মশাই। রেগে গেলেন নাকি! বলছিলাম ভদ্রলোকটি কে?”

আমার কথা শুনে রমেশবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে বললেন, “ঐ তো যার সাথে আপনি কথা বলছিলেন সেদিন রাতে। অমরনাথ বরকন্দাজ।”

আমি অবাক গলায় বললাম, “উনি তো খুব ভালো মানুষ। জঙ্গলের উপরে কত জ্ঞান।”

“আরে রাখুন মশাই, জঙ্গলের উপরে জ্ঞান ওর থেকে আমার ঢের বেশি।”

“আচ্ছা! তা সে কথা বাদ দিন। রাতে পিছনে ধাওয়া করে কী অদ্ভুত কাণ্ড দেখলেন সেটা বলুন।”

একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কদিন আগে, খাওয়া দাওয়া সেরে হাঁটতে হাঁটতে লন পেরিয়ে পাইন গাছের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি সবে। অন্ধকারের মধ্যেও হালকা আলোতে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল চারপাশ। আমার ধূমপানের অভ্যাস বহুদিনের। সিগারেটটা ধরিয়ে সবে টান দিতে শুরু করেছি, এমন সময়ে দেখি লোকটা চুপিসাড়ে বেরিয়ে এল বাংলোর গেটের বাইরে। এদিক ওদিক লক্ষ করে দেখল কেউ কোথাও নেই। আমি ততক্ষণে আগুনটা নিভিয়ে লুকিয়ে পড়েছি গাছের আড়ালে। দেখি সুড়সুড় করে বনের মধ্যে ঢুকে গেল। আমিও কৌতূহল চাপতে না পেরে কিছুটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করলাম। কিছুটা গিয়ে নদীর সামনে এসে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে দেখলাম খালি পায়ে কনকনে বরফ গলা জলে নেমে পড়লেন। চোখের পলকে নদীটা পেরিয়ে আবার সেঁধিয়ে গেলেন ওদিকের জঙ্গলে।”

“তারপর?”

“আমিও নাছোড়বান্দা। নামলাম জলে। খুব গভীর নয়। হাঁটুজল থেকে উঠে নুড়ি বালি পেরিয়ে ওপারে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলাম। প্রথমে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে, বেশ কিছুটা গভীরে ঢুকে হঠাৎ চোখ গেল একটা মোটা গাছের নিচে লোকটার গায়ের কোট, জুতো আর টুপিটা পড়ে রয়েছে। উপরে তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক মাকড়শার মত গাছটার মগডালের দিকে এগুচ্ছেন। গাছে তো আমিও উঠতে পারি। তা বলে মশাই ঐ রকম খাড়াই গাছে এই বয়েসে ওঠা কোন মানুষের কম্ম নয়। বললে বিশ্বাস করবেন না, কিছুক্ষণ পরেই একঝাঁক বাদুড় তেড়ে এলো আমার দিকে। পড়িমরি করে দৌড় লাগালাম।”

বললাম, “আপনার কথাগুলি শুনতে বেশ মজা লাগল। কোন ছোটো বাচ্চাকে বললে সে হয়ত রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে। আমার মনে কোন রেখাপাত করেনি।”

কথাটা শুনে মুখটা কাঁচুমাচু করে বললেন, “বেশ, বিশ্বাস আপনাকে করতে হবে না। শুধু একটা অনুরোধ, দূর থেকে একটু লক্ষ রাখবেন।”             

তা সেই তথাকথিত ভ্যাম্পেয়ার ওরফে অমরনাথবাবু আর কবিরাজ দুজনকেই দূর থেকে লক্ষ রাখছিলাম ক’দিন। দিনের বেলা সব কোথায় থাকে কিছুই বোঝা যায় না। যত কার্যকলাপ শুরু হয় সব রাতে। কিছু একটা সন্দেহজনক ব্যাপার তো আছে।  

একদিন রাতে খাওয়ার পর ভাবলাম অমরনাথবাবুকে ফলো করব। প্রতি রাতে কোথায় যান একবার দেখতে হবে। আসলে পুলিশের লোক তো, সন্দেহজনক কিছু দেখলে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। দেখি কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে সামনের ছোটো জঙ্গলটা পেরিয়ে নদীর পাড়ে নেমে গেলেন।

এমন সময়ে কবিরাজমশাই অন্ধকার ফুঁড়ে এসে পাকড়াও করলেন আমাকে। ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, “কী বুঝলেন মশাই?”

আমি গলা ঝাড়া দিয়ে বললাম, “কী আবার বুঝব?”

“এত রাতে কোথায় যাচ্ছে দেখবেন না একবার?”

বললাম, “আমি দেখে কী করব? সব ব্যাপারে কৌতূহল দেখানো ভালো নয়।”

“আপনি দেখছি ভিতু মানুষ। ভয় পেয়েছেন, সে কথাটা পরিষ্কার করে বলুন না।”

কথাটা মানে লাগল। রেগেমেগে বললাম, “এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? এখন রাতবিরেতে ওঁর পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে যদি আমরাই কোন বিপদে পড়ি? জঙ্গলে সাপ-খোপ, বিছে কত কিছু আছে, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, বুনো হাতি।”

“আরে না না, ওসব প্রাণীদের সামনাসামনি পড়ার সম্ভাবনা খুব কম। চোখ কান খোলা রেখে একটু যেতে হবে এই যা। আগে আপনার ঐ ক্যামেরাটা নিয়ে আসুন।”

“ক্যামেরা দিয়ে কী হবে?”

“নাইট ভিশান আছে তো? অন্ধকারে ছবি তোলা যাবে। লোকটার বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ চাই।”

কী মনে হল, আমি দৌড়ে গিয়ে রুম থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে এলাম। ফিরে এসে দেখি আর একজন টুপি পরা লোক কথা বলছেন কবিরাজমশাইয়ের সঙ্গে। বেঁটেখাটো চেহারা, ছোটো ছোটো চোখ, মুখের গড়ন নেপালীদের মত, আনুমানিক তিরিশের আশেপাশে বয়েস। কোমরে গোঁজা একটা বড়ো ভোজালি। পিঠে একটা কালো ব্যাগ। কবিরাজ মশাই পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এ হল দেবা। পাশের গ্রামে থাকে। কিছুদিন হল এদের গ্রামের পোষা জন্তুগুলো ঐ রক্তচোষা বাদুড়দের শিকার হচ্ছে।”   

 পিছু নিলাম ওদের। নদীর পাড়ে নামতে দেখি বালি আর নুড়ি গুলি রাতের অন্ধকারে চকচক করছে। জলের স্রোত কিছুটা দূরে। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে তীর বেগে ছুটে চলেছে হিমালয় থেকে নামা বরফ গলা জল। কবিরাজ বললেন, “এবার জুতো গুলো খুলে হাতে নিন। আর প্যান্টটা গোটান।”

তাই করলাম। জলে পা দিতেই মনে হল পাটা বুঝি কেউ কেটে নিয়ে চলে গেল। এত ঠাণ্ডা। নদীটা পেরিয়ে একটা পাথরের উপর বসে আবার পরে নিলাম জুতো। পকেটে একটা ছোটো পেনসিল টর্চ রাখা ছিল। জঙ্গলে আসব বলে কিনেছিলাম। টর্চটা জ্বালতেই হাঁহাঁ করে উঠলেন কবিরাজ মশাই। “করছেন কি? নেবান, নেবান। খবরদার আলো জ্বালবেন না।” জঙ্গলের গভীরে ঢুকতেই একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। এত নিঝুম শান্ত বন আগে কখনো দেখিনি। নিশাচর প্রাণীরাও যেন সব লুকিয়ে পড়েছে। যদিও মাঝে মাঝে রাতজাগা পাখিদের ডাক কানে আসছিল। আমি কবিরাজের পিছন পিছন এগোচ্ছি। সবার সামনে দেবা। মনের মধ্যে একটা ভয় চেপে বসছে। এই সদ্য পরিচিত লোক গুলোর সাথে দুম করে এত রাতে জঙ্গলে চলে আসাটা কি ঠিক হল! সার্ভিস রিভলভারটাও সঙ্গে নেই।   

প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর বললাম, “অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যাচ্ছি আমরা? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

“চিন্তা করবেন না। এ জঙ্গল আমার হাতের তালুর মত চেনা। আরও কিছুটা যেতে হবে।”

চোখটা সয়ে গেছে ততক্ষণে। অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি চারপাশটা। পাহাড়ের সানু দেশে এসে পড়লাম। এদিকে যত এগোচ্ছি বন আরও ঘন হচ্ছে। ঝোপ ঝাড় ঠেলে চলতে গিয়ে গুল্ম কাঁটায় ছড়ে গেল হাত। শুকন পাতার উপর আমাদের পায়ের শব্দ ‘মচ মচ’ করে কানে আসছে শুধু। শেষে একটা মোটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। উপরে তাকিয়ে দেখি লম্বাতেও বিশাল।  

নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একটা পেঁচা চিৎকার করতে করতে উড়ে গেল। বহু দূর থেকে শুনতে পেলাম হায়েনার হাঁসি। 

কবিরাজ মশাই ফিসফিস করে বললেন, “এই সেগুন গাছের উপরে হচ্ছে ওদের বাসা।”

“এখানে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

“সব দেখতে পাবেন। আসুন আমার সাথে।” বলে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে, পাশে একটা ঝোপ টেনে ফাঁক করে বললেন, “দেখুন তো এখানে কী আছে?”

আমি পকেট থেকে পেনসিল টর্চটা বের করে এক ঝলক দেখেই চিনতে পারলাম। অমরনাথবাবুর গায়ের জামা, প্যান্ট, টুপি সব এখানে পড়ে আছে। লোকটা গেল কোথায়? আশ্চর্য!

চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা কী করব এখন?”

“ঐ পালের গোদাটাকে খতম করব।”

“আমরা কেন? বনদপ্তরের লোককে বলুন?”

“সরকারি লোকজন সব ফাঁকিবাজ। এত গভীর জঙ্গলে ওরা আসে না। তাই দেখতেও পায় না। যা করার আমাদেরই করতে হবে। এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি। কারণ আজকালের মধ্যেই এরা ছড়িয়ে পড়বে বিভিন্ন জঙ্গলে। তখন আর এদের আটকানো যাবে না।”

“আপনি কী বলছেন কিছুই ঢুকছে না আমার মাথায়।”

“মাথায় ঢোকার দরকার নেই। শুধু জেনে রাখুন, ঐ লোকটা দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল থেকে শয়তানকে সঙ্গে করে এনেছে। এই জঙ্গলের সমস্ত জন্তুজানোয়ার শেষ হয়ে যাবে।”

এরপর কবিরাজ মশাই দেবাকে কানে কানে কীসব বললেন। সে সেই মোটা গাছাটার ফুটদশেক দূরে অন্য একটি লম্বা গাছে উঠে গেল নিঃশব্দে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ক্যামেরাটা চোখে লাগিয়ে দেখুন তো এই গাছটার মাথার দিকে কিছু দেখতে পান কিনা।”

আমি ক্যামেরার নাইট ভিশান চালু করে আই হোলে চোখ দিলাম। জুম করতে ফিল্ম নেগেটিভের মত সাদাকালো ছবি ভেসে উঠল। প্রায় পঞ্চাশ ষাট ফুট উপরে গাছের ডালপালা আর পাতার আড়ালে কিছু প্রাণীর নড়াচড়া বেশ বোঝা যাচ্ছে। এবং প্রাণীগুলি যে বাদুড় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সাদা চোখগুলি চকচক করছে। এরা তো নিশাচর প্রাণী। সেগুন গাছের কাণ্ডের মধ্যে একটা বড়ো ফোকর চোখে পড়ল। কিন্তু ওটা কী? একটা মানুষ! পা উপর দিকে আর মাথা নিচের দিকে করে ঝুলছে একটা মোটা ডাল থেকে। আশ্চর্য! আরও জুম করতে, দেখলাম ঠিক মানুষ নয়, তবে মানুষের মতই বড়োসড়ো চেহারা। কানটা সূচালো লম্বা, থ্যাবড়া মুখ, হাতের সাথে জোড়া বাদুড়ের মত ডানা। স্থির হয়ে নেই। ক্রমাগত দুলছে। গাছের ডালে পাটা আটকে দুলতে দুলতে কিছু একটা জিনিস ফোকরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ওটা কি অমরনাথ বাবু!  

এই পর্যন্ত বলে বিশু কাকু আমাদের গোল গোল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সনু প্রশ্ন করল, “তারপর?”

বিশু কাকু খালি চায়ের কাপটা রেখে আবার শুরু করল।

সেই রাতে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসতে পেরেছি আমার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য ভালো। কবিরাজ আর সেই ছোকরার সাংঘাতিক প্ল্যানের কথা যদি আগে থেকে জানতাম, তাহলে ওদের সাথে কখনই যেতাম না।

আমি অমরনাথ বাবুর ঐ চেহারা দেখে যখন রীতিমত ঘাবড়ে গেছি, কবিরাজ কানের কাছে এসে বললেন, “যা দেখছেন রেকর্ড করে রাখুন। পরে কাজে আসবে।”

আমি রেকর্ডিং সুইচটা অন করতে আবার বললেন, “ওটার পাশের লম্বা গাছটায় দেখুন তো, কোন কিছু লক্ষ পড়ছে?”

ক্যামেরার মুখটা ঘুরিয়ে পাশের গাছটায় ফোকাস করতে দেখি, দেবা কখন সেখানে উঠে গেছে। ফিস ফিস করে প্রশ্ন করলাম, “ও কী করছে?”

“দেখুন না কী করছে।”

golpoamazoner-atonko-2-mediumদেখলাম দেবা দু পা মুড়ে একটা ডাল থেকে ঝুলে পড়ল। তারপর পিঠের ব্যাগ থেকে একটা ছোটো বাক্স বের করে দড়ির সাহায্যে সেটাকে ঘোরাতে শুরু করল। তারপর টুক করে ছেড়ে দিতে সেটা সাঁ করে গিয়ে ঢুকে গেল ওক গাছের বড়ো ফোকরের মধ্যে।

“কী আছে ঐ বাক্সের মধ্যে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

হিসহিসে গলায় কবিরাজ বলল, “ডিনামাইট।”

ডিনামাইট! তরতর করে নেমে আসছে দেবা। আচমকা বেশ কিছু বাদুড় উড়ে গিয়ে তাকে কামড়ে দিল। দেবা আর্তনাদ করে উঠল যন্ত্রণায়। তারপর গাছের উপর থেকে হাত ফসকে ডালপালা ভাঙতে একদম নিচে এসে পড়ল। চিৎকার করে শুধু বলল, “পালাও!” দেখলাম পোশাকের উপর দিয়েই পাঁচ ছটা বাদুড় তার সারা গায়ে কামড়ে বসে আছে। আর সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে সেগুলোকে ছাড়ানোর।  

পাশে ঘুরে দেখি কবিরাজমশাই ততক্ষণে দৌড় লাগিয়েছেন। আমিও ঘাবড়ে গিয়ে ছুটলাম তাঁর পিছনে। কিন্তু হঠাৎ উড়ে এসে কবিরাজের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল সেই বিশাল বাদুড়। চোখগুলো অন্ধকারের মধ্যে সবুজ বাল্বের মত জ্বলছে। হিংস্র দাঁতগুলি ফুটিয়ে কামড়ে ধরলেন তাঁর গলায়। তিনি মাটিতে পড়ে চিৎকার করে উঠলেন। এই দৃশ্য দেখে আমার তখন আত্মারাম খাঁচাছাড়া। তারপরেই মাথার উপরে একটা কানফাটা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি। ছিটকে পড়ে গেলাম। কেঁপে উঠল বনপাহাড়। একটা আগুনের গোলা তেড়ে আসছে। কানে তালা লেগে গেছে, কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা। বড়ো গাছটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। কোন রকমে উঠে দৌড় লাগালাম। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার পড়লাম লতানে গাছে পা জড়িয়ে, মাথাটা গিয়ে লাগল একটা পাথরে। গড়িয়ে গেলাম একটা খাদের মধ্যে। আর কিছু মনে নেই।  

যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম একটা কুঁড়ে ঘরে বাঁশের বিছানায় শুয়ে আছি। অচৈতন্য অবস্থায় আদিবাসীরা খাদের মধ্যে থেকে ভোরবেলা তুলে এনেছে আমাকে। রাতে প্রচণ্ড আওয়াজে সবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ভোরে জঙ্গলে গিয়ে দেখে অনেকটা জায়গা জুড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। একটু ধাতস্থ হতে দু জন আদিবাসীর কাঁধে ভর দিয়ে ফিরলাম বাংলোয়। তখন সূর্য মাথার উপরে। দামী ক্যামেরাখানা আর খুঁজে পাওয়া গেল না।   

পরে ম্যানেজারকে প্রশ্ন করতে বলল, “সেই দিন রাত থেকে অমরনাথ বরকন্দাজ আর রমেশচন্দ্র আচার্য দুজনেই বেপাত্তা। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, তবে এখানে আঠারো মাসে বছর।”       

হোটেল ছাড়ার সময়ে দুজনেরই নাম ঠিকানা নোট করে নিয়েছিলাম। পরে বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ খবর নিয়ে যা জানলাম, সেটা খুবই সাংঘাতিক।  

কবিরাজের আসল নাম সুহাস আচার্য। অমরনাথবাবু আর সুহাস আচার্য দুজনেই জুলজিস্ট, মানে প্রাণীবিদ। বছর পনের আগে অমরনাথ বাবু একটা অভিযানে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের জঙ্গলে। সেখানে ওঁর সঙ্গী ছিলেন সুহাস বাবু। দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে এক ধরনের নতুন প্রজাতির রক্তচোষা লাল বাদুড়ের খোঁজ পেয়েছিলেন ওনারা। এই বাদুড়গুলি ছিল লুপ্ত প্রায় প্রজাতির। অতি কষ্টে দুটি নমুনা সংগ্রহ করে এনেছিলেন সেখান থেকে। পরে বাদুড়গুলিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় এদের লালার মধ্যে একধরনের ব্যাক্টিরিয়া রয়েছে যার থেকে ক্যান্সার সমেত বেশ কিছু জটিল রোগের এন্টিভাইরাস তৈরি করা সম্ভব। আরও কিছু জটিল জৈব রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল তাদের শরীরে। 

এই তথ্যগুলি আমাকে দিলেন প্রফেসার বিজয়া রমন। ইনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁদের কলিগ ছিলেন। যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যে ল্যাবরেটরিতে একটা দুর্ঘটনায় সুহাস বাবুর একদিকের মুখ পুড়ে যায়। অমরনাথ বাবুর অসাবধানতার জন্যই এটা হয়েছিল। কিন্তু সুহাসবাবুর ধারণা সেটা তিনি ইচ্ছা করে করেছিলেন। তারপরেই সেই বাদুড়দুটি হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যায়। বিজ্ঞানের একটা নতুন আবিষ্কার থমকে যায়। পরে আবার একটা টিমকে আমাজনে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তারা আর খুঁজে পায়নি বাদুড়ের ডেরাটিকে।

এদিকে সুহাস আচার্য ওরফে কবিরাজ প্ল্যাস্টিক সার্জারি করিয়ে ফিরে আসেন দেশে। পরে ভুটানের জঙ্গল লাগোয়া ঐ বাংলোর মালিক সুরিন্দর সিংএর সাথে হাত মিলিয়ে চোরাচালান করছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। গণ্ডার আর হরিণের সিং, হাতির দাঁত, জন্তুদের চামড়া বিদেশে পাচার করতেন।  হঠাৎ করে সেই বাংলোয় হাজির হন অমরনাথবাবু। আর প্রতি রাতে জঙ্গলে যাওয়া শুরু করেন। এতে সুহাসবাবুদের কাজের অসুবিধা হয়। কারণ রাত্রিবেলাই জন্তু জানোয়ার ধরা বা মারার কাজটা হত। সুহাসবাবু তাঁকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু অমরনাথবাবু চিনতে পারেননি তাঁর পুরানো সহকর্মীকে। নিজের চেহারা অনেক পালটে ফেলেছিলেন সুহাস আচার্য।

অমরনাথবাবু সেই বাদুড়গুলিকে এতদিন ধরে সযত্নে লালন পালন করে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন নিজের তত্ত্বাবধানে। বাকি ছিল শুধু তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া। সেটাই করতে গিয়েছিলেন জঙ্গলে। কিন্তু বাদ সাধলেন সুহাসবাবু। পুরানো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এমন সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাননি তিনি। এদিকে আমি গিয়ে পড়লাম ওদের মাঝখানে। আমাকেও মেরে ফেলার প্ল্যান ছিল। আসলে কোন সাক্ষী রাখতে চায়নি অপরাধীরা। কিন্তু ঘটনাক্রমে ওঁরাই মারা গেলেন। আমি বেঁচে গেলাম কপাল জোরে।

এতটা বলে বিশু কাকু থামলেন। সনু কিছুক্ষণ ভেবে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, অমরনাথবাবু বাদুড় হয়ে গেলেন কী করে?”

“এই প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া মুশকিল। এমন হতে পারে যে ঐ বাদুড়গুলির কামড়ে তাঁর শরীরে জিনগত পরিবর্তন এসেছিল। ফলে রাত হলেই তাঁর চেহারাটা বাদুড়ের মত হয়ে যেত। কিছুদিন আগে একটা বইয়ে পড়ছিলাম, ঘাসের বনে এক রকম পিঁপড়ে থাকে, তারা লম্বা লম্বা ঘাসের গোড়া বেয়ে নিচে থেকে উপরে ওঠে আর ঝুপ করে নিচে পড়ে। আবার উপরে ওঠে। সারাদিন এই করতে থাকে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে ঐ পিঁপড়েগুলোর মস্তিষ্কের মধ্যে ‘ল্যাংসেট ফ্লুক’ নামে এক ধরনের প্যারাসাইট বাসা বেঁধে থাকে যারা তৃণভোজী প্রাণীর পেটের ভিতরে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করে। ঐ প্যারাসাইটগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে পিঁপড়েকে। মানে গরু, ছাগল বা এই ধরনের কোন প্রাণী ঘাস খাওয়ার সময়ে ঐ পিঁপড়েগুলিকে খেয়ে ফেলবে। তখন তার পেটের মধ্যে গিয়ে ওরা বংশবৃদ্ধি করবে। আবার ‘নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম’ নামে এক ধরনের ফিতাকৃমি প্যারাসাইট আছে যারা গঙ্গাফড়িঙের মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে, ফলে গঙ্গাফড়িং জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে, যাতে ঐ ফিতাকৃমিগুলি জলের মধ্যে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। সেরকম হয়ত এখানেও ঘটেছিল। অসাবধানতাবশত ঐ বাদুড়গুলি হয়ত কামড়ে নিয়েছিল অমরনাথবাবুকে। আর তাদের লালার মধ্যে থাকা কোন ব্যাকটেরিয়া ওনার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করছিল। ফলে রাত হলেই তাঁর আচরণ পালটে যেত। তিনি হয়ে যেতেন ভ্যাম্পায়ার!”

এতক্ষণ পরে মা বলল, “আবার এমনও তো হতে পারে যে, মানসিক চাপে আপনার দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল। আপনি সেই মুহূর্তে যা দেখেছিলেন, সেটা ছিল আপনার কল্পনা।”

“হ্যাঁ, তাও হতে পারে। সেটা তো আমি শুরুতেই বলেছি।”

সনু গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ বইয়ের পাতাটা ওলটাল। আর সূচিপত্রের মধ্যে চোখে পড়ল, একটা গল্পের নাম “আমাজনের আতঙ্ক”। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের মত মাথায় খেলে গেল, আরে গল্পবইটা তো বিশুকাকু আগেই পড়ে নিয়েছে। সেটাই শুনিয়ে গেল এতক্ষণ ধরে!

ছবিঃ শিমুল

    জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

3 thoughts on “গল্প আমাজনের আতংক পুষ্পেন মণ্ডল বসন্ত ২০১৭

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s