সুমনা সাহার আগের লেখা- এমন আমি ঘর বেঁধেছি, পাখি কেন গায় (১ম)
(২)বুলি-বিলুর বিকেল
বুলি আর বিলু অনেকক্ষণ ধরে মাঠে ঘোরাঘুরি করল, পিকলাকে ডাকল, রনিকে ডাকল, কিন্তু ওরা আজ কেউ খেলতে এল না। আজ খেলা জমছে না। বিলু বলল, “আমাদের সুইটির বাচ্চা দেখবি?”
ওরা দুজনে চলে এল সি-ব্লকের ছাদে ওঠবার সিঁড়ির মুখে। একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখা আছে, তার নীচে ঘুমাচ্ছে চারটে চোখ না ফোটা বেড়ালছানা! কী মিষ্টি! কী মিষ্টি! বিলু ঢাকাটা একটু তুলতেই কুঁই কুঁই শব্দ করে উঠেছে আর ওর মা-টা, মানে সুইটি, বোধ হয় কাছেই ছিল, ঠিক পায়ের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ‘ম্যাও!’ মানে বোধ হয় বলছে, “এই, তোরা আমার বাছাদের বিরক্ত করিস না, যা তো এখান থেকে!”
বুলি-বিলুও সরে পড়ল। কী জানি বাবা! সুইটি আজকাল খুব হিংস্র হয়ে গেছে, যদি আঁচড়ে দেয়! বিলু বলল, “চল, কাকাইয়ের ঘরে গিয়ে পাখির ছবি দেখি।”
বিলুর কাকাই বি.এস.সি জুলজি অনার্স পড়ছে। ওর ঘরে পাখির ছবিওলা সুন্দর সুন্দর জার্নাল আছে। পশুপাখি সম্বন্ধে ওর অগাধ জ্ঞানের ভাণ্ডার অর্ক এই দুই অর্বাচীন শিশুর কাছে ঢেলে দিয়ে এক আচার্যসুলভ সুখ অনুভব করে। দুজনের মাথাও ভালো। অর্ক যা শেখায়, বেশ মনে রাখতেও পারে।
দুই ক্ষুদে অর্কর ঘরের সামনে এসে দেখে কাকাই গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে। টেবিল ফ্যানের হালকা হাওয়ায় দুলছে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। একটা পাখি ডাকছে একটানা ‘কুব কুব কুব কুব’ করে। দুজনেই একটু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাকাইটা খুব মুডি, অনেক সময় ওদের একদম পাত্তা দেয় না। নাহ্, কাকাইয়ের দৃষ্টি পড়ল অবোধ শিশুদুটোর দিকে। চোখ নাচিয়ে বলল, “কী রে বোলবোলাও? চোখে ঘুম নেই?”
অর্কর আদরের ডাক শুনে স্বস্তি পেয়ে দুটিতে ঘরে ঢোকে, “কাকাই সেই ছবির বইটা বার করো না!”
“ছবি না দেখে ডাইরেক্ট দেখ, নীচে তাকা।”
ওরা একছুটে কাকাইয়ের জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখে একটা বেশ বড়সড় উজ্জ্বল তামাটে রঙের পাখি বসে আছে, খুব রাগী রাগী দেখতে, ওই মনে হচ্ছে ডাকছে।
বিলু বলে, “ওটা কী পাখি, কাকাই?”
“কেমন দেখতে বর্ণনা দে।”
“পাখিটা কাকের চেয়ে আর একটু বড়ো, প্রায় দাঁড়কাকের মতো। পুরো গা-টা চকচকে কালো, ডানার রঙ বাদামি, কালো রঙের চওড়া লেজ, চোখদুটো টকটকে লাল চেরির মতো!”
“ঠিক বলেছিস, ওটা হল কুবো পাখি, গ্রামের লোকেরা বলে কানাকুয়ো। গম্ভীরভাবে ওরকম ‘উক উক কুব কুব’ করে ডাকতে থাকে। একটানা ছয় থেকে সাতবার ডেকে একটু থামবে, আবার ডাকবে। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো জায়গায় এর গম্ভীর ডাক অমঙ্গল ও অপদেবতার আগমনের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করে।
“খুব মারকুট্টে পাখি, বুঝলি? এরা ‘কুকুলিডি’ গোত্রের ‘সেন্ট্রোপাস’ গণের পাখি, সারা পৃথিবীতে এই গণের কুবোর প্রায় ৩০টা প্রজাতি আছে। আন্দামানে, ফিলিপাইনস দ্বীপে, শ্রীলঙ্কায়, বাংলাদেশে, মায়ানমারে, পাকিস্তানে সব জায়গায় এই পাখিটাকে দেখা যায়—কোনোখানে এর কালো ঠোঁট, কোথাও সবুজ, কোথাও লাল, কোথাও আবার কালো গলা, তামাটে, ধূসর এমনিসব রঙের নানা বৈচিত্র্য।
“নানা জায়গায় নানা নামে ডাকে এদের। কেউ বলে কুবো, কেউ কুপো, আবার কোথাও কানাকুয়ো বলে। বনবাদাড়ে, বাগানে ও জনবসতির কাছাকাছিই বাস করে। সাধারণত একা বা জোড়ায় থাকে।”
“এরা খায় কী, কাকাই?”
এদের খাদ্যতালিকা বেশ বড়ো। বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, শুঁয়োপোকা, শামুক, এমনকি ছোটোখাটো মেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন, ব্যাঙ, টিকটিকি, ইঁদুর এইসবও এরা খায়। এছাড়া পাখির ডিম, পাখির ছানা, ফল ও বীজ এদের প্রিয় খাদ্য। দক্ষিণ ভারতে বড়ো কুবোর মূল খাদ্য এক প্রজাতির শামুক (Helix vittata)। এছাড়া এরা কলকে ফুলের বিষাক্ত ফল খায়। মাটিতে ধীরে হাঁটে, হঠাৎ শিকারকে ঠোঁট বা পা দিয়ে চেপে ধরে শিকার করে। ঝোপের তলায় তলায় ঘুরে ওরা যখন খাবার খোঁজে, তখন লম্বা লেজটা প্রায় মাটি ছুঁয়ে থাকে। বিপদ টের পেলে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে, কখনো অল্প উড়ে কাছেই গিয়ে লুকিয়ে পড়ে।
“এদের আরেকটা প্রিয় কাজ কী জানিস? সূর্যস্নান! সকালবেলা প্রায়ই উঁচু গাছের চূড়ায় একা অথবা জোড়া জোড়ায় লেজ আর ডানার পালক ছড়িয়ে দিয়ে আরাম করে রোদ পোহাতে দেখা যায়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস এদের মেটিং সিজন।”
“মেটিং কী কাকাই?”
“তার মানে হল, ওই সময় ওরা ডিম পেড়ে বাচ্চা দেবে। বড়ো কুবো একটাই বিয়ে করে, বুঝলি? ওরা বেশি উড়তে পারে না। মাটিতেই ভালো দৌড়ায়। পূর্বরাগের সময়, পুরুষ কুবো মাটিতে স্ত্রী কুবোকে তাড়া করে ও তাকে নানারকম খাবারদাবার নিবেদন করে। স্ত্রী কুবো লেজ ও ডানা নামিয়ে বশ্যতা দেখায়।”
“পূর্বরাগ কী কাকাই?”
“এই রে! বৌদি যদি জানতে পারে তোকে আমি পূর্বরাগ শিখিয়েছি, আস্ত রাখবে না!” কাকাই মিটিমিটি হাসে। আবার বলে, “তাহলে তো চখাচখির ভাব শুনলে তোরা অবাক হয়ে যাবি!”
“বলো না কাকাই!” উৎসাহী দুই সরল শ্রোতাকে অর্ক বলে, “সে এক পাখি আছে, জ্যোৎস্নাভূক, কেবল চাঁদের আলো পান করে।”
বুলি আর বিলু অবাক হয়ে যায়, “চাঁদের আলো খায়?”
“সে-সব আস্তে আস্তে বলব। এখন কুবো পাখি সম্পর্কে জেনে নাও। এরা কিন্তু বাসা বানায়। ছোটো পাখিদের বাসার সন্ধান পেলে তছনছ করে দেয়। পায়ের শক্ত নখ আর তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে বাসাকে ফালা ফালা করে ডিম-বাচ্চা বের করে আনে। যে-সব পাখি গাছের কোটরে ডিম পাড়ে, ওদের ডিম-বাচ্চাও গাছের কোটরে লম্বা পা ঢুকিয়ে বের করে আনে। অন্যদের মারধোর করলেও নিজেরা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। রোজ নিয়ম করে স্নান করে। ছেলেটাই বাসা তৈরি করে। তিন থেকে আটদিনের মতো সময় নেয়। শুকনো বাঁশপাতা, খড়কুটো, কচি ডালপালা এইসব দিয়ে ঝোপের আগায় বা বড়ো গাছের ডালে বড়ো আকারের অগোছালো একটি বাসা করে। বাসার মাঝখানটায় ওলটানো বাটির মতো একটা খাপ থাকে। মাটি থেকে বাসা সাধারণত ৬ মিটার উঁচুতে বানানো হয়। বাসা বানানো হয়ে গেলে মেয়ে পাখি ৩ – ৫টা ডিম দেয়। বাবা-মা দুজনেই ডিমে তা দেয়। ১৫ – ১৬ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ১৮ থেকে ২২ দিনে ছানারা উড়তে শেখে। এদের শত্রু দাঁড়কাক, প্রায়ই বাসায় হানা দিয়ে ডিম খেয়ে ফেলে।
“আগে লোকে খুব পাখি শিকার করত। এখন তো আইন করে সে-সব বন্ধ করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া নতুন ইংরেজ সেনারা মুরগি জাতীয় এই পাখিটাকে শিকার করত আর বলত, এর ‘শয়তানি স্বাদ’। ওরা পাখিটির নাম দিয়েছিল ‘গ্রিফের মথুরা’। কেন, তা কে জানে। একসময় লোকে ফুসফুসের রোগের জন্য এর মাংস উপকারী মনে করে টোটকা হিসেবে খেত।”
বিলু জানতে চায়, “পাখিটা কী খায়?”
“কেন, বললাম যে, খাওয়ার লিস্ট লম্বা! এদের খাবার তালিকায় আছে শামুক, ব্যাঙ, পোকামাকড়, টিকটিকি, সাপ, পাখির ডিম ও ছানা, ইঁদুর এইসব আর কি?
“ওই দেখ, দেখবি? কেমন ছুটে পালাবে?” বলতে বলতে কাকাই একটা কাগজ ডেলা পাকিয়ে ছুড়ে মারে জানালা দিয়ে আর বুলি-বিলুর চোখের সামনে দিয়ে তরতর করে দ্রুত দৌড়ে তামা রঙের লাল-চোখো পাখিটা পেঁপে-খেজুর-জামরুলগাছের অগোছালো পিছন বাগানের লতাপাতার ঘন ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
বুলি একটু আবদারের সুরে বলে, “কাকাই, সেই ঠকঠকাঠক কাঠুরে পাখির কথা বলো না!”
“ওহ্, কাঠঠোকরার কথা বলছিস? হ্যাঁ, ওটা তো রোজ সকাল বিকেল আমার চোখের সামনে এই রাধাচূড়াগাছটার ডালে বসে ঠক ঠক করে ঠোকরায়। এই যে হলুদ কাঠঠোকরাটা আসে, এটা বেঙ্গল উড পেকার, পিসিডি পরিবারের, বৈজ্ঞানিক নাম হল ডিনোপিয়াম বেঙ্গলেন্স, নামের মানেও সেইরকম। ডিনোস-এর গ্রিক ভাষা অনুযায়ী মানে হল শক্তিশালী, ওপোস মানে চেহারা, আর বেঙ্গলেন্স তো বাংলার পাখি। তার মানে দাঁড়াল বাংলার শক্তিমান, বুঝলি?”
বুলি খুশিতে হাততালি দিয়ে ওঠে। এই ওর এক স্বভাব, মজা পেলেই হাততালি দেয়।
বিলু গম্ভীর মুখে বলল, “আমাদের অঞ্জলিমাসি কাল বলছিল, ওরা নাকি জামাইবাবু। তাই অত সাজগোজ করে আসে শ্বশুরবাড়িতে। শাশুড়ি-মা খেতে দেয় না, বলে ঘরে কাঠ নেই তো! রান্না হবে কী করে? তাই ও কাঠ কাটে ঠক ঠক করে। এসব কি সত্যি, কাকাই?”
অর্ক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ঠোঁট উলটে বলে, “ধুর, অঞ্জলিদি কিচ্ছু জানে না! শুনে রাখ, একটা কাঠঠোকরা দিনে আট থেকে বারো হাজার বার গাছের শক্ত ডালে ঠোক্কর দেয়। তাতে কী হয় জানিস? ওই জায়গায় গর্ত হয়ে যায়, আর কাঠের গুঁড়ির ভেতরে বাসা বেঁধে থাকা পোকামাকড় বেরিয়ে পড়ে, ওরা তখন সেগুলো খায়। এদের ঠোঁট খুব শক্ত। গাছের গায়ে গর্ত করে বাসাও বানায় এরা, সেই বাসায় ডিম পাড়ে। আবার শত্রুর চোখে ধুলো দেবার জন্য বাসায় ঢোকার দুটো পথ রাখে। সামনের দিকের পথটা মিছিমিছি। গর্তটা খানিকদূর গিয়ে শেষ হয়ে যাবে। আর নিজেদের ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য নীচের দিকে গর্ত করে, সোজা ঢুকে ভিতরে আবার ডানহাতে বা বাঁহাতে গলির মতো বেঁকে একটা সমান জায়গা করে, সেখানে কাঠের গুঁড়ো বিছিয়ে নরম জায়গা করে ডিম পাড়ে। বাচ্চা ফুটে বেরোলে ডানা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ২৫-৩০ দিন ওখানেই থাকে।”
বুলি জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা কাকাই, কাঠ ঠোকরাতে গিয়ে কাঠের গুঁড়ো এদের চোখে-নাকে ঢুকে যায় না?”
অর্ক খুশি হয়, “গুড কোয়েশ্চেন। জেনে অবাক হবে, এদের চোখের সামনে খুব অল্প সময়ের জন্য ছোটো একটা পর্দা চলে আসে আর নাকের ফুটোর কাছে কিছু পালক থাকে বলে এই সমস্যা থেকে বেঁচে যায়। পায়ের আঙুলও এমন বিশেষ ধরনের যে বেশ ভালোভাবেই গাছের ডালে আটকে থাকে, কাঠ ঠোকরাতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। পৃথিবীতে ১৮০টারও বেশি প্রজাতির কাঠঠোকরা আছে আর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর দুয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় এদের দেখাও যায়। পোকামাকড় ছাড়াও এরা ফলমূল আর বাদামও খায়। কোনো কোনো কাঠঠোকরা দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে, কেউ কেউ আবার চায় একাই থাকতে। একা থাকতে পছন্দ করে, এমন কাঠঠোকরাদের থাকে একেকটি নির্দিষ্ট এলাকা। কাঠ ঠুকরে যে আওয়াজ করে, সেই আওয়াজ দিয়েই নিজের নিজের এলাকা চিহ্নিত করে বুঝিয়ে দেয়, ‘এখানকার কাঠ আমি ঠোকরাব, তোমরা তফাত যাও।’ কিন্তু অন্য পাখিদের মতো গান গাইতে পারে না। ওই ঠক ঠক শব্দ করে আর তীক্ষ্ণ ‘ক্ররর ক্ররর’ শব্দ করে ডাকে। যখন উড়ে যাবে, দেখবি, যেন একটা ঢেউ তুলে যায়। যা, তোরা এখন ঢেউ তুলে পালা তো! আমার অনেক পড়া বাকি।”
বুলি আর বিলু বলে, “ঠক ঠক ঠক ঠকাই/কাল ফের আসব কাকাই!”
(৩)
বিলুর রাত্রি
এখন ঘড়িতে আটটা। বিলুর বাবা টিভিতে খবর শুনছেন। মা রান্নাঘরে অঞ্জলিমাসিকে নিয়ে রুটি আর ডিম-তড়কা বানাচ্ছে। বিলু সকালে অঞ্জলিমাসির কাছে ‘দুঃখী জামাই’ কাঠঠোকরার গল্প শুনেছে। আরো দেখেছে হাঁড়িচাচা পাখি। ও নাকি খুব লোভী। একটা বৌ তার বরের জন্য রান্না করেছিল, হাঁড়িচাচা এসে ঢাকা সরিয়ে ওটা খেয়ে ফেলল। বৌটা তখন রাগ করে হাঁড়ির নীচে লেগে থাকা উনুনের কালি ওর মাথায় লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকেই পাখিটার মাথাটা কুচকুচে কালো, আর নামটা হল হাঁড়িচাচা। এসব ভাবতে ভাবতে সে খাতায় পটাপট কয়েকটা ছবি এঁকে ফেলে। বড়ো গেটের কাছে যে ঝাঁকড়া মাথা ঝুড়ি নামা বিরাট দাদামশাই বটগাছটা, সকালে সেখানে এত টিয়াপাখি আসে যে, চেঁচামেচিতে বিলুর ঘুম ভেঙে যায়। তাই প্রথমেই ও আঁকল টিয়া, আর মনের সুখে সবুজ প্যাস্টেল রঙ ঘষতে ঘষতে গান ধরল, “টিয়া টিয়া টিয়া, অজ পাড়াগায়ে থাকে, ট্যাঁরা চোখে তাকায় টিয়া নোলক পরা নাকে!” এই গানটা ও কাকাইকে গাইতে শুনেছে যখন আগেরবার সরস্বতী পুজোর দিন আইভিদি সবুজ শাড়ি পড়েছিল, সেদিন।
মা-র কাজ সারা। ড্রয়িং রুমে এসে বসে বলল, “তোমরা এখন খাবে তো বলো, আমার ডিনার রেডি।”
বাবা বলল, “একটু পরে।”
মা কাকাইয়ের দিকে তাকাল, “অর্ক?”
কাকাইও পরে খাবে বলল।
বিলু বলল, “আমার খিদে পেয়েছে মা, আমাকে খেতে দাও।”
মা বিলুকে চুমু খেয়ে বলল, “আমার বিলু সোনা খাবে! ডিম দিয়ে তরকা আর গরম গরম রুটি, ঝাল লাগলে শেষে দেব পায়েস এক বাটি!”
“কী মজা! মা, পায়েসও বানিয়েছ?”
“তোমার প্রিয়, লুতুপুতু!”
সিমাইয়ের পায়েসকে বিলু বলে লুতুপুতু। বিলুর এখন খেতে চাওয়ার আরো একটা উদ্দেশ্য হল মাকে একলা করে পাওয়া। অঞ্জলিমাসির কাছে শোনা গল্পগুলোর সত্যতা যাচাই করতে চায় সে।
বিলু খাচ্ছে, মা পাশে বসে গল্প করছে। বিলু মনের সব জিজ্ঞাসাগুলো মাকে এখন ঢেলে দেয়। “মা, টিয়াপাখিরা সবাই কথা বলতে পারে?”
“কতরকমের টিয়া আছে, সবুজ টিয়া, বাসন্তী লটকন টিয়া, ফুল মাথা টিয়া, মেটে মাথা টিয়া, লাল মাথা টিয়া, চন্দনা টিয়া… প্রায় সবাই কথা বলতে পারে। তবে মানুষের কাছাকাছি এলে, কথা শিখলে তবেই না কথা বলা শিখবে? যারা বনে জঙ্গলে থাকে, তারা কথা বলে না, কিন্তু জন্তুজানোয়ারের ডাক নকল করে। মোট কথা, এরা তাড়াতাড়ি নকল করতে শিখে যায়। তোর মনে নেই রানাঘাটের পিসির বাড়ির সেই খাঁচায় পোষা চন্দনা পাখিটাকে? কেমন আমরা গেলেই বলত, ‘মামি এসেছে, ভাই এসেছে, কী মজা, কী মজা!’ তারপর আমরা খেতে বসলেই ও-ও ‘ভাত দাও ভাত দাও’ বলত, ছোলা দিলে রাগ করত, আমাদের সঙ্গে ভাত খেতে চাইত! মনে পড়ে?”
বিলুর আবছা মনে পড়ে। তখন ও খুব ছোটো ছিল। মিলিপিসির সেই চন্দনাটা মরে গিয়েছিল। মিলিপিসি খুব কেঁদেছিল, আর পাখি পোষেনি কোনোদিন। আবছা আবছা মনে পড়ে বিলুর সেই পাকা পাকা কথা বলা চন্দনাটাকে। খুব সুন্দর ছিল দেখতে। একদম কলাপাতার মতো সবুজ রঙ, গলার চারপাশে একটা লালচে গোলাপি রিঙের মতো দাগ, আর টুকটুকে লাল বাঁকানো বড়শির মতো ঠোঁট দিয়ে ছোলা খেত। মিলিপিসি ওকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসত।
মা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। তারপর বলে, “জানিস বিলু, গাছের ডালপালার ভিতর দিয়ে এরা কী কৌশলে চলে-ফেরে! এদের পায়ের প্রথম ও চতুর্থ আঙুল পেছনমুখী। তার জন্য এরা হাত দিয়ে ধরার মতো করে খাবার নিয়ে ধরে নিয়ে মুখে পুরতে পারে, যা অন্য কোনো প্রজাতির পাখিতে দেখা যায় না। গাছে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায় টিয়ারা। তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে বেরনো বাচ্চাগুলো অন্ধ থাকে। বাসায় বাচ্চারা দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত মা-বাবার কাছে যত্নে কাটায়; ওরা মুখে করে খাবার এনে বাচ্চাদের মুখে উগরে দিয়ে খাওয়ায়।
“একেকটা প্রজাতির টিয়া প্রায় ৫০ বছরও বাঁচে। কথা বলার কথা জিজ্ঞেস করছিলি তো? সবচেয়ে ভালো কথা শেখে আফ্রিকার গ্রে-টিয়া। আমাজন জঙ্গলের টিয়াও ভালো কথা শেখে, তবে এদের স্বর কর্কশ। পোষা পাখির মধ্যে টিয়ার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি, শুধু কথা বলাই তো নয়! এরা আবার হাত-পা দিয়ে কতরকম খেলা দেখায়! বুদ্ধি খুব এই পাখির। আর যার বুদ্ধি থাকে, সবাই তার কদর করে।”
“হ্যাঁ গো মা, অঞ্জলিমাসি বলছিল যে, হাঁড়িচাচার মাথায় একটা বৌ হাঁড়ির তলায় লেগে থাকা উনুনের কালি মাখিয়ে দিয়েছে? সত্যি মা?”
অপর্ণা হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, “তুই হাঁড়িচাচা দেখলি কখন? ওগুলো তো ডাকাত পাখি। অন্য পাখিদের ডিম আর বাচ্চা চুরি করে খায়।”
“আমি তো রোজ দেখি পাখিটাকে! আমাদের রান্নাঘরের পিছনের বাগানের পেঁপেগাছটায় বসে পাকা পেঁপে ঠুকরে ঠুকরে খায়, আর ঝিঙে লতায় ঝুলে থাকা কচি কচি ঝিঙেগুলো ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে নেয়। আমি দেখেছি তো! পাখিটার লাল চোখ, পিঠটা বাদামি-খয়েরি রঙের, পেটের দিকটা সাদাটে খয়েরি, লেজটা কালো, আর যেই না উড়ান দেয়, ওর ডানায় সাদা পট্টি দেখা যায়। মাথাটা স্লেটের মতো কালো। ওর ডাকও শুনেছি, ‘কিট্রি কিট্রি চুক চাক চাক কিয়াওও’।”
“ওমা! একদম ঠিকঠাক লক্ষ করেছিস তো তুই! এতদিন তো খুব একটা হাঁড়িচাচা পাখি এদিকটায় দেখিনি। এই ক’মাস হল আসছে। খয়েরি হাঁড়িচাচা সাধারণত খোলা বনের ধারে, গাছপালা ঘেরা এলাকায়, গ্রামের বাগানে একা, জোড়ায় জোড়ায় বা দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। এদের জুটিতে খুব ভাব, বছরের পর বছর একসঙ্গে থাকে। ঘন পাতাওলা গাছে বা মাটিতে ঝরা পাতা উলটে এরা খাবার খোঁজে। মাটিতে খুব কমই নামে। খায় পোকামাকড়, পাকা ফল, ফুলের মধু, গেছো ব্যাঙ, ছোটো সাপ, বাদুড়, ইঁদুর, ছুঁচো, কাঠবিড়ালি, পাখির ছানা ও ডিম।”
বিলু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। খাওয়া হয়ে গেছে, তবুও হাত ধুতে যেতে ইচ্ছা করে না। ওর মনে এখন চখাচখির কথাটা ঘুরছে। ফিসফিস করে গোপন কথা বলার মতো বলে, “মা, কাকাই বলছিল, একটা পাখি নাকি চাঁদের আলো খায়?”
অপর্ণার মুখটা নরম আলোয় ভরে যায়। বিলুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ওসব কবিদের কল্পনা। আসলে কী জানো? ওগুলো একরকম হাঁস। ওদের স্বামী-স্ত্রীতে খুব ভাব, সবসময় একসঙ্গে থাকে। তাই ছেলে আর মেয়ে পাখিকে একসঙ্গে একটা নামে লোকে চখাচখি বলে। বেশ বড়সড় হাঁস, প্রায় দু-ফুট লম্বায়, ওজন দেড় কেজির মতো। আর গায়ের রংটা খুব সুন্দর! কেমন জানিস? বেশ কমলা-বাদামি, অনেকটা মরচের মতো বা দারুচিনির মতো। চোখগুলো বাদামি, লেজ কালো। বাবা হওয়ার আগে চখার গলায় কালো বলয়ের মতো দাগ হয়, ডানায় সবুজ ভাব, ডানা সাদা পালকে ঢাকা। বাচ্চা হওয়ার সময় এদের গায়ের সব পালক ঝরে যায়। তখন মাস খানেক এরা উড়তেই পারে না।”
“তাহলে কি ওরা জ্যোৎস্না খায় না?”
“ধুস বোকা! জ্যোৎস্না খেয়ে কি পেট ভরে? বর্ষাকাল শেষ হয়ে গেলে যখন নদীতে জল কমে আসে, ঝাঁক বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় চখাচখি নদীর চরে বালিতে ঘুরে বেড়ায়। এরা নিশাচর পাখি। ভোরবেলা ও সন্ধ্যাবেলায় এদের কাদামাটিতে, জলা ঘাসজমিতে খাবার খুঁজে বেড়াতে দেখা যায়। এরা সর্বভূক পাখি। শস্যদানা, অঙ্কুরিত চারা, নরম পাতা, চিংড়ি—এইসব খায়, আবার শামুক, কেঁচো, ব্যাঙও খায়। চাঁদনী রাতে, বালির চরে ঝাঁকে ঝাঁকে চখাচখি ঘুরে বেড়ায় খাবারের খোঁজে, দেখতে ভারি ভালো লাগে! তাই কবিরা বুঝি বলেন, ওরা জ্যোৎস্না পান করে।”
“ওরা কেমন করে ডাকে মা?”
“ভয় পেলে ওরা হর্ন বাজাবার মতো ডাকে—‘গাঁ আঁক আআং আঁক আংক পক পক পকা পক পক’, ডাকটা শুনতে মিষ্টি নয়।”
মা-র গলায় চখাচখির ডাক শুনে বাবা ডাইনিং হলে হাজির। “কী ব্যাপার? তোমাদের মায়ে-পোয়ে কী এত গপ্প হচ্ছে আমিও শুনব।”
অপর্ণা লাজুক হেসে বলে, “তোমার ছেলে পাখি-বিশারদ হবেন, দেখে নিও!” তারপর বিলুকে আদর করে বলেন, “যা, এখন শুয়ে পড় গে যা, একটু ধ্যান করে ঘুমিয়ে পড়। আমরা খেয়ে আসি।”
অনেক রাত্রে ‘টিউ টিটিউ, টিউ টিটিউ, টিউ টিটিউ’ এমন একটানা ডাক শুনে বিলুর ঘুমটা ভেঙে গেল। পাশের বিছানায় মা-বাবা নেই। পা টিপে টিপে বিলু এল ব্যালকনিতে। সুন্দর শিউলি ফুলের গন্ধ। সাদা ধবধবে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আর বাতাস চাঁদের আলো মেখে সুর তুলছে, ওই… টিউ টিটিউ…। মা-বাবা ব্যালকনিতে বসে মৃদু স্বরে গল্প করছে। বিলুর ঘুম ভেঙে গেছে, তাই সোজা বাবার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে বসল, “বাবা, ওটা কী পাখি ডাকছে?”
“ওটা ‘পিউ কাহাঁ’ ‘পিউ কাহাঁ’ বলে ডাকে, আবার কেউ কেউ শুনতে পায় ‘চোখ গেল’, ‘চোখ গেল’ বলছে। একটানা ক্রমশ সুর চড়িয়ে ডাকে, সারারাত ধরে ডাকে অনেক সময়। একেবারে মাথা খারাপ করে দেয়। তাই তো ওর ডাককে ‘ব্রেন ফিভার’ বলে। ওর নাম পাপিয়া। তুই গান শুনেছিস না, ‘পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বোলে’? নজরুল গীতি?”
“পাখিটা খুব সুন্দর, তাই না বাবা?”
“পাখিরা সবাই সুন্দর। তবে এর ডাকের মতো মিষ্টি একে দেখতে না! বাদামি-খয়েরি রঙের গা-পেট, লাল চোখ, লেজ-পিঠ ধূসর রঙের, ওড়ার সময় লম্বা লেজে কালচে বাদামি আড়াআড়ি দাগ দেখা যায়। খায়ও বিচ্ছিরি সব পোকামাকড়, শুঁয়োপোকা, নয়তো ডুমুর-টুমুর যা পায়!”
অপর্ণার দিকে ফিরে বিলুর বাবা জিজ্ঞেস করে, “তোমার মনে পড়ে, আমাদের সেই ঝাড়গ্রাম বেড়াতে যাওয়ার কথা! সারারাত এমনই ডেকেছিল পিউ কাঁহা!”
অপর্ণা মাথা নীচু করে হাসে, “সেদিন আমরা সারারাত ঘুমাইনি!”
বিলু অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি তখন কোথায় ছিলাম মা?”
বাবা বিলুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ওর মাথার ঘ্রাণ নিয়ে বলেন, “তুই তো তখন আমাদের সঙ্গে ছিলিস না। ওই পাখিটাই তো সারারাত ধরে ডেকে ডেকে তোকে ডেকে নিয়ে এল!”
ফুলের গন্ধে, বাবার বুকের গন্ধে মুখ ডুবিয়ে, চাঁদের আলো আর বাতাসের গান শুনতে শুনতে বিলু ঘুমের রাজ্যে পাখির মতো আনন্দে ভাসতে লাগল।
[Photo Courtesy: Dr. Bikas Bepari, HIT, Haldia. All Photos taken from the periphery of HIT Campus.]
তথ্য সহায়ক:
- রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮)
- জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯)
- সূত্র: মানবকণ্ঠ, লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।
- Goodwin, Derek (১৯৭৩)। “Notes on woodpeckers (Picidae)”। Bulletin of the British Museum (Natural History)। 17 (1): 1–44।
- Dewar, Douglas (১৯১২)। Jungle folk, Indian natural history sketches.। John Lane, London (e-book).
- Thurston, Edgar (১৯০৬)। Ethnographic notes in Southern India। Government Press, Madras (e-book).
- wikipaedia.com
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে
কি সুন্দর করে লিখছিস নিজের ছোটবেলা মনে পড়ে গেলো❤️❤️❤️❤️❤️
LikeLike