এই লেখকের আগের গল্প- ম.জা.রু এল বঙ্গে
এক
সপ্তমীর ভোরবেলা তীব্র একটানা ঘণ্টার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল রাজুর। পাড়ার পুজো মণ্ডপের ঠিক পাশের বাড়িটাই রাজুদের। রাজুর মনে হল, তবে কি কলাবউ স্নানের সময় হয়ে গেল? প্রতিবছর দুর্গাপূজার সপ্তমীতে রাজু আর তার দুই বন্ধু তীর্থ আর কৌশিক একসঙ্গে কলাবউ স্নানের সময় ঠাকুরমশাইয়ের পিছন পিছন পূজা মণ্ডপ থেকে একসঙ্গে গঙ্গার ঘাটে যায়। ওই ভোরবেলায় পুরোহিতমশাইয়ের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে ঢাকের বাদ্যি আর পাড়ার কাকিমা-জেঠিমাদের শাঁখ-উলুর আওয়াজ তাদের দারুণ লাগে। তাই প্রতিবছরই পাড়ার পূজার এই দায়িত্বটুকু তাদের তিনজনকেই দেওয়া হয়, আর তারাও মহানন্দে সেটা উপভোগ করে। আজকেও তাদের একসঙ্গে গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘণ্টার শব্দে রাজু ভাবল তার বুঝি দেরি হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠতে। চটপট বিছানা থেকে উঠে পড়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, না, দেরি তো হয়নি। তবে ঘণ্টার আওয়াজ কেন? অস্থির মনে চটপট ব্রাশ করে স্নানের ঘরে ঢুকে পড়ল রাজু। ঘণ্টার আওয়াজটা কিন্তু একটানা বেশ কিছুক্ষণ চলে বন্ধ হয়ে গেছে।
অস্থির মনে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নতুন জামা-প্যান্ট পরে বাইরে বেরিয়ে পূজামণ্ডপের সামনে এসে অবাক হয়ে গেল রাজু। কই, সে ছাড়া কেউ তো এখনও আসেনি। তবে ঘণ্টা বাজাল কে? নিজের মনের ভুল ভেবে প্রথমে একচোট খুব হেসে নিল রাজু। তারপর মনে হল, মা দুর্গাই তাকে জাগিয়ে দিয়েছেন। এমনিতে যা ঘুমকাতুরে ছেলে সে। তাই দু-হাত জোড় করে ভক্তিভরে প্রণাম করল মাকে। মিনিট কয়েক কাটতে না কাটতেই কৌশিক আর তীর্থ হাজির। ওদের আর ঘণ্টা বাজার আওয়াজের কথা বলল না রাজু। কী জানি কী ছুতো করে আবার ওর পিছনে লাগা শুরু করে! এমনিতেই যা বিচ্ছু ওরা! লেগ পুলিংয়ের একটু সুযোগ পেলেই আর ছাড়ে না; তবে রাজুও কিছু কম যায় না। কিন্তু বন্ধু হিসেবে ওরা তিনজনই হরিহর আত্মা। পড়াশুনা, খেলাধুলা, দুষ্টুমিতে তিনজনেই একটা ইউনিট হিসেবে চলে। বিচিত্র সব চিন্তাভাবনা আসেও বটে ওদের মাথায়! স্কুলের স্যাররা আদর করে ওদের নাম দিয়েছেন ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। তবে আজ ওরা তিনজনেই খুব এক্সসাইটেড কারণ, আগের দিন পুরোহিতমশাই বলেছিলেন যে আজ তাদের কলাবউয়ের কাহিনি শোনাবেন। তবু সেই অদ্ভুত ঘণ্টার আওয়াজের রেশ তখনও রাজুর কানে লেগে আছে বলে সে একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। তবে কলাবউ স্নানের এক্সাইটমেন্টে তীর্থ-কৌশিকের সেটা চোখে পড়ল না।
এর মধ্যে পুরোহিতমশাইও এসে পড়লেন। কলাবউকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ঢাকের বাজনা আর শাঁখ-উলুর আওয়াজের সঙ্গে মনটা নেচে উঠল তিনজনের।
গুটিগুটি পায়ে পুরোহিতমশাইয়ের একদম কাছাকাছি গিয়ে রাজু বলল, “ঠাকুরমশাই, আজ আমাদের কলাবউয়ের কাহিনি শোনাবেন বলেছিলেন।”
ঠাকুরমশাই মুখ ঘুরিয়ে তিনজনকে একবার দেখে নিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, সে তো বলবই। তার আগে তোমরা বলো তো দেখি তোমরা কী জানো।”
ফস করে কৌশিক বলে বসল, “কলাবউ হল গণেশের বউ।”
একগাল হেসে ঠাকুরমশাই বললেন, “অনেকেই এটা বলে, তবে এটা একেবারেই ভুল। এটি আসলে ন’টি পাতা বা গাছের সমাহার। নবপত্রিকা।”
“নবপত্রিকা কী?” অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল তীর্থ।
তাদের তিনজনের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে পুরোহিতমশাই বলে চললেন, “নবপত্রিকা হল দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীক, যা অবশ্যই কল্পিত। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে আরও আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি বধূর রূপ আনা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নামই কলাবউ। এই নবপত্রিকার মাধ্যমে দেবীর নয়, রূপের পূজা-অর্চনা চলে। এই নয় দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’ নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পূজিতা হন।”
এবার রাজু প্রশ্ন করে উঠল, “দেবীর নয় রূপ কী কী? আর কলাগাছ ছাড়া বাকি উদ্ভিদগুলো কী কী?”
পুরোহিতমশাই গম্ভীর স্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করে উঠলেন, “রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।”
তিনজনে তো হাঁ করে পুরোহিতমশাইয়ের দিকে চেয়ে রইল। এ-বছর তাদের স্কুলের পাঠক্রমে সংস্কৃত যুক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরোহিতমশাইয়ের মন্ত্রের একবর্ণ তাদের মাথায় ঢুকল না। আমতা আমতা করে কৌশিক বলল, “কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। একটু সহজ করে বুঝিয়ে বলুন না, ঠাকুরমশাই।”
পুরোহিতমশাই হেসে উঠে বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা, বলছি। ভালো করে মন দিয়ে শুনে নাও তোমরা। কলাগাছ বা রম্ভার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী; কচুগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা; হরিদ্রা বা হলুদ গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা; জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী; বিল্ব বা বেলগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা; দাড়িম্ব অর্থাৎ ডালিম বা বেদানা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা, অশোকগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা; মানকচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা; ধানগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী।”
তিনজনেই মন দিয়ে শুনে একেবারে মাথায় গেঁথে নিচ্ছিল পুরোহিতমশাইয়ের কথাগুলো।
এবার রাজু পুরোহিতমশাইয়ের কাছে জানতে চাইল, “আচ্ছা ঠাকুরমশাই, এই ন’টি গাছ দিয়েই কেন নবপত্রিকা হয়? আরও তো অন্য অনেক গাছ আছে। এই ন’টিই কেন?”
পুরোহিতমশাই এই তিনজনকে এই জন্যেই খুব ভালোবাসেন। অনেক ছোটোবেলা থেকেই এদের দেখছেন, জানার আগ্রহ এদের মধ্যে খুব। পুরোহিতমশাই খুব খুশি হয়ে বললেন, “সেসব কি আর আমি অত বলতে পারি! তবে কিছু গবেষকদের মতে, নবপত্রিকার পূজা প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীর পূজা। এই শস্য-বধূকেই দেবীর প্রতীক গণ্য করে প্রথমে পূজা করতে হয়, তার কারণ শারদীয় পূজা মনে হয় শস্য-দেবীরই পূজা। আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশে আছে। তবে বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।”
“আচ্ছা, রামচন্দ্র তো অকালবোধন করে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। রামায়ণে নিশ্চয়ই এই নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ আছে?” বলে উঠল তীর্থ।
পুরোহিতমশাই বললেন, “কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ণে উল্লেখ আছে, ‘বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস’।”
এইসব আলোচনা করতে-করতেই তারা গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে গেল। পুরোহিতমশাই তড়তড় করে গঙ্গার ঘাট দিয়ে নবপত্রিকা কাঁধে নিয়ে গঙ্গায় নেমে গেলেন। আরও দু-একটি পূজা কমিটিও এসে পড়েছে নবপত্রিকা স্নান করানোর জন্য। ঢাকের মিলিত আওয়াজের সঙ্গে শাঁখ-উলুর মেলবন্ধন যেন এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। তার সঙ্গে গঙ্গার বুকের ওপর ছড়িয়ে পড়া হালকা কুয়াশা ভেদ করে সদ্য ওঠা সূর্যের হালকা রঙিন ছোঁয়া এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতির সেই মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে রাজু মনের ভিতর একেবারে গেঁথে নিচ্ছে পুরোহিতমশাইর কাছ থেকে সদ্য শেখা নবপত্রিকার ব্যাখ্যা। সে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, নবপত্রিকা আসলে নবদূর্গা আরাধনার একটি রূপক পন্থা এবং সাধারণ জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন ন’টি উদ্ভিদকেই এই নবপত্রিকার জন্য বেছে নিয়েছেন আমাদের শাস্ত্রকাররা। কোথাও যেন শস্য-মা আর দেবী-মা এক হয়ে মিলে গেল রাজুর মনের মণিকোঠায়। একটু অন্যমনস্ক হয়েই ঘাটের ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ঠিক সেই সময়েই রাজুর কানের কাছে ফিসফিস করে তীর্থ বলে উঠল, “এই সময় তোর হাতে ঘণ্টাটা থাকলে ঠিক ভাব-সমাধি লাভ করতিস তুই।” বলেই হো হো করে উঠল তীর্থ আর কৌশিক। আর চমকে গিয়ে বাস্তবে ফিরে এসে ভোরের সেই ঘণ্টার কথা আবার মনে পড়ে গেল রাজুর। তার অনুসন্ধিৎসু মন যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই ঘণ্টার আওয়াজের প্রকৃত কারণ উদ্ধার করতে পারছে, একটু বিচলিতই হয়ে রয়েছে। কিন্তু ঘণ্টার আওয়াজটা যে সত্যিই হয়েছিল কি না সেটা নিশ্চিত না হয়ে রাজু তার অভিন্নহৃদয় বন্ধুদের কাছে তা প্রকাশই করতে পারছে না। একটু বিক্ষিপ্ত মন নিয়েই সে তার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে পুরোহিতমশাইর পিছন পিছন গঙ্গার ঘাট থেকে পাড়ার দিকে ফিরতে শুরু করল।
দুই
পাড়ায় ফিরেই তারা লক্ষ করল, ঠিক মণ্ডপের পিছনটায় যেখানে একশো বছরেরও বেশি পুরোনো বটগাছটা চারদিকে ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার নীচটায় বেশ ভিড়। সকলেই মাথা উঁচু করে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। মণ্ডপের ভিতরে প্রতিমার সামনে মাত্র দু-চারজন। বেশ অবাক করার মতোই ব্যাপার। পুরোহিতমশাই অবশ্য সেসব গ্রাহ্যই করলেন না। সোজা প্যান্ডেলের ভিতর ঢুকে নতুন লাল-পাড় সাদা শাড়ি পরানো ঘোমটা দেয়া নববধূর সাজে সজ্জিতা নবপত্রিকাকে দুর্গা প্রতিমার ডানদিকে একটা কাঠের সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে শুরু করে দিলেন মাতৃবন্দনা।
পুরোহিতমশাই পূজা করতে করতে হাতের ঘণ্টাটা নাড়াতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক মণ্ডপের ওপর দিক থেকে ভেসে এল একটানা তীব্র ঘণ্টার আওয়াজ। প্রথমেই চমকে উঠল রাজু; এমনই ঘণ্টার আওয়াজ সে আজ ভোরবেলায় শুনেছে। রাজু, তীর্থ আর কৌশিক পরস্পর চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল, তারপর আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে চুপচাপ বেরিয়ে এল মণ্ডপের বাইরে। মণ্ডপের পিছনেই ঠিক বটগাছের গোড়ায় যেখানে পাড়ার সব কাকুরা জড়ো হয়েছে, দাঁড়াল গিয়ে সেখানে; বুঝতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা ঠিক কী। ততক্ষণে জোরদার আলোচনা শুরু হয়ে গেছে ওই অদ্ভুত ঘণ্টার আওয়াজের উৎস নিয়ে। মোটামুটি ওখানে সবাই একমত হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, যেহেতু তাদের পাড়ার পূজা খুব ভক্তিভরে হয় আর দুর্গা মা এখানে খুব জাগ্রত, তাই মার আরাধনার জন্য কৈলাস থেকে স্বয়ং বাবা মহেশ্বর এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে এক মহা ভক্তিভরে প্রণামের ঢল নামল বটতলাতেই।
রাজু আর তীর্থর কিন্তু এই যুক্তি মোটেই মনঃপূত হল না। তারা দুজনে ভিড় থেকে একটু সরে এসে দাঁড়াল নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়ে কৌশিককে কোথাও খুঁজে পেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন কৌশিকের টিকির দেখা পাওয়া গেল না, রাজু আর তীর্থ গুটিগুটি পায়ে আবার মণ্ডপের সামনে এসে দাঁড়াল। ঠিক তখনই তারা দেখতে পেল, কৌশিক এবারের পূজার সম্পাদকমশাই দুলালকাকুর সঙ্গে কী যেন কথা বলতে বলতে মণ্ডপের দিকেই আসছে। দুজনের মুখেই চাপা হাসি। তাদের সামনে এসে দুলালকাকু বললেন, “দেখো কৌশিক, তোমাদের তিনজনের ভরসাতেই কিন্তু এত বড়ো রিস্ক নিচ্ছি। ডুবিয়ে দিও না যেন।”
একগাল হেসে কৌশিক বলল, “একদম চিন্তা করবেন না কাকু। দেখুন না কী মজাটাই না হয়।”
দুলালকাকু তিনজনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “তোমরাই তো আমাদের পাড়ার আশা, তোমাদের ভরসা করব না তো কাকে ভরসা করব! যাই, চটপট মিটিংটা সেরে নিই। যা করার এখুনি তো করতে হবে।” বলেই তাদের তিনজনের দিকে আরেকবার হাসিমুখে তাকিয়ে ক্লাব-ঘরের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন।
রাজু আর তীর্থ তো এতক্ষণ ধরে হাঁ করে সব কিছু শুনছিল। ওদের মাথায় তো কিছুই ঢুকছিল না। এবার দুলালকাকু চলে যেতে তারা চেপে ধরল কৌশিককে। তীর্থ বলল, “ব্যাপারটা কী বল তো? আমার তো সব মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।”
রহস্যময় হাসি হেসে কৌশিক বলল, “বোঝাব, বোঝাব, সব বোঝাব। এখন যা বলি, সেটা মন দিয়ে শোন। চট করে বাড়ি গিয়ে ব্রেকফাস্ট করেই সাইকেল নিয়ে মণ্ডপের সামনে চলে আয়। কাজ আছে।”
“কী কাজ?” প্রশ্ন করল রাজু।
“এই না, তোদের এক বড়ো দোষ! সবসময় প্রশ্ন করিস। তাড়াতাড়ি চলে আয়, তখন সব বলব।” বলেই আর কথা না বাড়িয়ে কৌশিক হনহন করে হাঁটা দিল নিজের বাড়ির দিকে।
অগত্যা রাজু আর তীর্থও নিজেদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। তবে তাদের দুজনের মনে একটা সন্দেহ উদ্রেক হল, কিছু একটা রহস্য আছে। সেটা কী? দুলালকাকু এমনিতে তাদের খুবই ভালোবাসেন, কিন্তু আজ হঠাৎ করে এসে পিঠ চাপড়ে দিলেন কেন? তবে এটা তারা নিশ্চিত হল যে, কৌশিক এ ব্যাপারে সবটাই জানে। ব্রেকফাস্ট করে ফিরে এসে সবটা জানতে হবে কৌশিকের থেকে, এমনটা ভেবে রাজু আর তীর্থও দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা দিল।
তিন
আধঘণ্টাটাক পর রাজু, কৌশিক আর তীর্থকে দেখা গেল সাইকেল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে রাস মাঠের দিকে যেতে।
“কী ব্যাপার বল তো কৌশিক? একটু ঝেড়ে কাশ তো। ব্যাপারটা ঠিক কী?” প্রশ্ন করল তীর্থ।
রহস্যময় হাসি হেসে কৌশিক বলল, “ভরসা রাখ, আর একটু ধৈর্য ধর। সব জানতে পারবি।”
“সে না-হয় হল, কিন্তু আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?” ভুরু কুঁচকে বলল রাজু।
“শোন, আপাতত যতজন বেশি বন্ধুর বাড়িতে আমরা যত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারি সেটাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। আর ওদের গিয়ে আমাদের পাড়ার পূজা দেখতে আসার আমন্ত্রণ করাই আমাদের উদ্দেশ্য।” কৌশিক বলে চলল, “এর বেশি আর কিছু এখন জিজ্ঞেস করিস না। কথা দিচ্ছি রাতের বেলায় উদ্দেশ্য-বিধেয় সমেত গোটা বাক্য সবিস্তারে ব্যাখ্যা করব।”
রাজু আর তীর্থ বুঝে গেল, কৌশিকের পেট থেকে আসল কথা এখন বের করা যাবে না। তাই এই প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে তারা দুজন সেই আশ্চর্য ঘণ্টার ব্যাপারে কথা বলতে থাকল। কিন্তু যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ তাদের মাথায় এল না। তবে এটাও তারা লক্ষ করল যে, এই অদ্ভুত ঘণ্টা সম্পর্কে কৌশিক যেন উদাসীন। গোটা রাস্তায় এই নিয়ে একটিও কথা বার হয়নি কৌশিকের মুখ থেকে। ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্য লাগল রাজু আর তীর্থর, কিন্তু মুখে আর কিছু প্রকাশ করল না তারা।
রাস মাঠের পূজা মণ্ডপে পৌঁছেই তারা দেখতে পেল মণ্ডপের ঠিক সামনেই পাপা, পটকা, তাপস সমেত বেশ কয়েকজন জমিয়ে গুলতানি করছে। তাদের দেখেই ওরা হইহই করে উঠে বলল, “কী রে, দিনের বেলাতেই ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিস!”
“না রে, ঠাকুর দেখতে বার হইনি। তোদের একটা ইম্পর্ট্যান্ট নিউজ দিতে এসেছি। বলতে পারিস আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি আমাদের পাড়ায় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার জন্য।” কৌশিক বলল।
“এটা আবার একটা কথা হল! তোদের পাড়ার সনাতনী একচালার ডাকের সাজের প্রতিমা আমার খুব ভালো লাগে। আমি তো প্রতিবছরই যাই। তা এই বছর বিশেষ কী হল যে ঘটা করে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিস?” পটকা বলল।
পটকার সনাতনী হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি ভালোলাগার কথা সবারই জানা। কৌশিকেরও অজানা নয়। তাহলে হঠাৎ এভাবে আমন্ত্রণ জানাবার কোনও কারণ বোধগম্য হল না তীর্থ আর রাজুর। বরং তারা দুজনে বেশ অবাকই হয়ে গেল যখন কৌশিক রহস্যময় হেসে বলল, “এবার আমাদের আকর্ষণ সনাতনী পূজায় সনাতনী ঘণ্টা।”
“মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?” চেঁচিয়ে উঠল পাপা।
কৌশিক আর কিছু না বলে সাইকেলের মুখটা ঘুরিয়ে তীর্থ-রাজুকে উদ্দেশ করে বলল, “চল, এবার সুমন-নীলাদ্রিদের পাড়ায়।” বলেই সাইকেলের প্যাডেলে পায়ের চাপ দিয়ে পিছনে মুখ ঘুরিয়ে পটকা-পাপাদের উদ্দেশ করে একটু জোরে চেঁচিয়ে বলল, “গেলেই বুঝবি মানেটা কী, আর না গেলেই মিস।”
এতক্ষণে রাজু-তীর্থর কাছে পরিষ্কার হল হুড়মুড়িয়ে সাইকেল নিয়ে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাতে আসার কারণ। ওই অদ্ভুত ঘণ্টা নিয়ে নিশ্চয়ই কৌশিকের নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যান আছে। আর দুলালকাকুও নিশ্চয়ই সেটা জানেন; কারণ, দুলালকাকুর সঙ্গেই কৌশিক কিছু আলোচনা করছিল সকালবেলায়।
সাইকেল চালাতে চালাতে বেশ রাগত স্বরে কৌশিককে তীর্থ বলল, “তুই যে দুলালকাকুর সঙ্গে আলোচনা করেই কিছু একটা প্ল্যান বানিয়েছিস, সেটা বেশ বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমাদের কেন সেটা জানাচ্ছিস না সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
হাসতে হাসতে কৌশিক বলল, “দেখ, তোদের বলতে গেলে তো পুরোটাই বলতে হবে। তখন তোদের চোখা চোখা প্রশ্ন ধেয়ে আসবে আমার দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবটাই তো জানবি তোরা। সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেজন্যই রাতের দিকে একটু সময় নিয়ে সবটাই বলব তোদের।”
রাজুর মনে হল কৌশিক ঘণ্টা রহস্য উদ্ধার করে ফেলেছে। সেজন্যই ও এত কনফিডেন্ট আছে। মনে মনে খুব আনন্দ হল রাজুর। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ না করে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা। তোরা আর ঝগড়া না করে তাড়াতাড়ি সাইকেল চালা।”
একে একে অরিন্দম, নীলাদ্রি, সুমন সবার বাড়িতে গিয়ে আজ রাতে তাদের পাড়ায় ঠাকুর দেখতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে তারা এল জিৎ-এর বাড়ির সামনে। জোরে চেঁচিয়ে দু-তিনবার জিৎ-এর নাম ধরে ডাকার পর জিৎ ঘরের বাইরে এল হাতে একটা ব্যাডমিন্টন রাকেট নিয়ে। পরনে হাফ-প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি, পায়ে স্পোর্টস শু। ওকে দেখে অবাক হয়ে তীর্থ বলল, “কী রে, তুই কি ঘরের ভিতরেই ব্যাডমিন্টন খেলছিস নাকি!”
“না, একটু শ্যাডো প্র্যাকটিস করছিলাম। সামনের মাসেই কলম্বিয়ায় একটা টুর্নামেন্ট আছে কিনা তাই। তা তোদের কী ব্যাপার বল।” ব্যাডমিন্টনের চাপ মারার ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠে রাকেট সমেত হাতটাকে একবার উপর থেকে নীচে নামিয়ে বলল জিৎ।
জিৎ-এর এই বাড়াবাড়ি রকমের লোকদেখানো আজগুবি স্বভাবের কথা তাদের বন্ধুদের কারোই অজানা নয়। তবু এসব দেখে রাজু মুখ ঘুরিয়ে হাসতেই থাকল। আর একবার হাসি পেলে সে যে কিছুতেই হাসি চাপতে পারে না।
তীর্থ রাজুর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে কোনোমতে গার্ড করে তাদের পাড়ার ঠাকুরের মণ্ডপে বাজতে থাকা অদ্ভুত ঘণ্টার কথা জানিয়ে জিৎকে অবশ্যই মণ্ডপে আসার আমন্ত্রণ জানাল।
বড়ো বড়ো চোখ করে সবটা শুনে জিৎ দারুণ খুশি হয়ে বলল, “জানিস, গতবার যখন মায়ানমার গিয়েছিলাম, এরকমই এক অলৌকিক ঘণ্টাধ্বনি শুরু হয়েছিল আমি বুদ্ধমূর্তির সামনে দাঁড়ানোর দাঁড়ানোর। আর এক মায়াবী আলোয় ভরে গিয়েছিল পুরো গুহাটা। সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য, বলে বোঝাতে পারব না।”
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল জিৎ। কিন্তু তাকে বলার আর কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে তিনজনেই সাইকেলের প্যাডেলে পায়ের চাপ দিল। কৌশিক শুধু বলল, “আজ একদম সময় নেই রে, অন্য একদিন শুনব তোর কাহিনি। অবশ্যই আসিস কিন্তু।”
সামনের বাঁকটা ঘুরেই তিনজনেই একটু মন খুলে হেসে নিল। গুণ যে আছে জিৎ-এর সেটা তাদের অজানা নয়, কিন্তু নিজের সেই গুণকীর্তন করতে গিয়ে সেটা যে হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে সেটা সে নিজেও ধরতে পারে না।
মন খুলে একচোট হাসির পর রাজু বলল, “অতঃকিম?”
“এবার শেষ অভিযান, মিত্র পাড়ায় অমিত।” কৌশিক বলল।
তীর্থ বলল, “বাবা! সে যে বড়ো কঠিন ঠাঁই।”
“সেটা ঠিক। তবে ঠিকমতো লক্ষ্যভেদ করতে পারলে ওখানেই কেল্লাফতে।” আত্মবিশ্বাসী কৌশিক বলল।
রাজু মিচকি হেসে বলল, “কৌশিক, তোর প্ল্যান একেবারে ফুলপ্রফ।”
“কেন এমন বললি?” প্রশ্ন করল তীর্থ।
“দেখ, আমরা যে-কাজটাই করি তার বিরোধিতা করে অমিত। স্বাভাবিক নিয়মে ও এটারও বিরোধিতা করবে। মানে, আমরা যা চাইছি ও ঠিক তার উলটোটাই চাইবে। আমরা যে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি আজ আমাদের মণ্ডপে আসার জন্য, এটা জানতে পারলে ও সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে সবার আসা আটকাতে। আর এটা সায়েন্টিফিক্যালি প্রুভড যে পাবলিসিটির থেকেও নেগেটিভ পাবলিসিটি বেশি কাজে দেয়।” যেন অঙ্কের সমাধান করছে এমন ভঙ্গিতে বলল রাজু।
“জিও, গুরু! অসাধারণ ব্যাখ্যা। আয়, বুকে আয় ভাই।” চেঁচিয়ে উঠল তীর্থ।
“একটু পায়ের ধুলো দে ভাই।” মজা করে কৌশিক বলল।
“নে নে, আর ইয়ার্কি মারতে হবে না। তাড়াতাড়ি চল, কাজ সেরে বাড়ি ফিরে একটু ঘুমাতে হবে। সেই কোন ভোরবেলায় উঠেছি। আর যা বুঝছি, রাতেও শুতে যেতে বেশ দেরি হবে।” ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলল রাজু।
মিত্র পাড়ার মোড়েই তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অমিতের। তাদের দেখে বাঁকা হেসে অমিত বলল, “কী হে, তিনমূর্তি! এই অসময়ে তোরা এখানে কেন?”
“আমরা তো তোর কাছেই আসছিলাম একটা বিশেষ আর্জি নিয়ে।”
“তবে আর দেরি কেন? প্রকাশ করে ফেলো তোমাদের গুপ্ত আর্জি।”
“আজ আমাদের পড়ার পূজা মণ্ডপে তোকে একবার অবশ্যই আসতে হবে।”
“কেন? বিশেষ কোন ব্যাপার আছে নাকি? তোদের পুজোয় আর আছেটা কী? সেই তো আদি অনন্তকাল ধরে একইরকম মার্কামারা প্রতিমা, ধ্যাড়ধেড়ে প্যান্ডেল আর সাদা টিউব লাইট। পুজো তো হয় এই মিত্র পাড়ায়। লাইট, প্যান্ডেল, প্রতিমা সবকিছুতে আমরাই সেরা।”
এতক্ষণ ধরে অমিত আর কৌশিকের কথা শুনতে শুনতে তীর্থ বলে উঠল, “তবুও একবার আসিস। এক অদ্ভুত ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে আমাদের মণ্ডপে। সেটার জন্যই বলছি।”
“মা-মা-মানেটা কী?” সামান্য তুতলে বলল অমিত।
অমিতের ভূতের ভয় সম্বন্ধে ভালোই ওয়াকিফহাল রাজু। তাই শেষ ঢিলটা রাজুই ছুড়ল, “মানে, আধিভৌতিক ব্যাপার আর কী। এসব দেখার সুযোগ তো আর সবসময় হয় না। তাই সব বন্ধুকেই বলেছি আজকে আসতে। তুইও অবশ্যই আসিস কিন্তু।”
“কোনও কালেই তোদের আর বোধবুদ্ধি হবে না। এমন একটা জায়গায় আমাকে যেতে বলছিস! অন্যসব বন্ধুদেরও যেতে বলেছিস! চ্যাংড়ামি হচ্ছে নাকি! আমি এখুনি সব বন্ধুদের বারণ করে দিচ্ছি।” ভয়ানক রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠল অমিত।
রাজু, তীর্থ, কৌশিক ততক্ষণে সাইকেলের প্যাডেলে জোর চাপ দিয়ে দিয়েছে। মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি। তারা জানে তাদের কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে।
চার
বিকেলে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল রাজুর। তড়িঘড়ি নতুন জামা-প্যান্ট পরে বেরিয়ে এল বাইরে। ঘরের ভিতর থেকেই সে শুনতে পাচ্ছিল অনেকরকম আওয়াজ, লোকের কোলাহল ভেসে আসছে বাড়ির সামনে থেকে। এবার বাইরে এসে সে বেশ অবাক হয়ে গেল। ইতি মধ্যেই গোটা মাঠ জুড়ে বেশ একটা মেলা বসে গেছে। ঘুগনি, আলুকাবলি, ফুচকা, এগরোল, আইসক্রিমের স্টল যেমন বসেছে, বেলুন, পুতুল এসবের দোকানও আছে। একদিকে আবার ছোটো একটা নাগরদোলাও আছে। রাজুর মন খুশিতে ভরে গেল। তাদের পাড়ার পূজায় যে এমন হতে পারে সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না। কী যাদুমন্ত্রে এমন হল ভাবতে ভাবতে রাজু বাড়ির সামনেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কৌশিক আর তীর্থ এসে তাকে একটানে নিয়ে এল মণ্ডপের ভিতর। তিনজনেই মহা খুশি। এমন সময় দুলালকাকু এসে একগাল হেসে বললেন, “ওয়েল ডান, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স! তোমাদের জন্যই আজ এখানে এত লোকের মেলা হতে চলেছে। তোমাদের কথামতোই মণ্ডপের পিছনের দিকের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে আর মাইকও শুধু পূজা চলাকালীন ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্র আর বিশেষ কোনও ঘোষণা ছাড়া সবসময় বন্ধ থাকবে। তোমরা শুধু মণ্ডপের মধ্যে থাকো আর দেখো পূজাপার্বণের জিনিসে যেন কেউ হাত না দেয়।”
রাজু-তীর্থ বুঝল, কৌশিক যতই ওদের সবটুকু না বলুক, দুলালকাকুকে নিশ্চয়ই বলেছে যে এটা তাদের তিনজনের প্ল্যান। কিন্তু মাঝে-মাঝেই যে তীব্র একটানা ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে সেটার কারণটা যে ঠিক কী সেটা রাজু-তীর্থ তখনও উদ্ধার করতে পারেনি। আর যতক্ষণ না সেটা উদ্ধার করতে পারছে, তাদের দুজনের মনটাই একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকে যা ভিড় হতে শুরু করল, সেসব ভুলে গিয়ে তারা মণ্ডপের ভিতর যে দড়িটা দিয়ে পূজা সামগ্রীর সামনের অংশটা ঘেরা আছে সেটার রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকল। মাঝে-মাঝেই বাজতে থাকল সেই অদ্ভুত একটানা ঘণ্টা। আর আগত দর্শনার্থীরা তা শুনে বিস্মিত হতে থাকল। এক-একজন এক-একরকম মত প্রকাশ করতে থাকল; কেউ বলল, মায়ের লীলা, কেউ বলল, অপদেবতার ছায়া আবার কেউ বলল, নিশ্চয়ই পূজা কমিটির চালাকি।
যত রাত বাড়ছে তত ভিড় বাড়ছে আর পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছে সেই ঘণ্টার আওয়াজ। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজুরা এক এক করে তাদের সব বন্ধুকেই দেখতে পেল, এমনকি অমিতকেও। ক্রমশ রাত বাড়তে থাকল আর রাজুর ঘুম আর খিদে দুইই পেতে থাকল। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দুলালকাকু এসে তাদের বললেন, “এবার তোমরা বাড়ি যাও। যাবার আগে ক্লাব-ঘর থেকে একবার ঘুরে যাও।”
ক্লাব ঘরে গিয়ে রাজুরা দেখল তাদের তিনজনের জন্য স্পেশাল বাসন্তি পোলাও আর কষা মাংস আনা হয়েছে। মহানন্দে তাই খেতে খেতে তীর্থ বলল, “ভাই কৌশিক, এবার ঘণ্টা রহস্যের রহস্যভেদ কর।”
পোলাও-মাংসের দারুণ স্বাদের আস্বাদ চেখে নিতে নিতে কৌশিক বলল, “রহস্য কিছুই নয়। ওটা একটা পোকার আওয়াজ।”
দারুণ বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল রাজু আর তীর্থর। দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “মানেটা কী? ক্লিয়ার কর।”
এক ঝলক দুজনের দিকে চোখ বুলিয়ে কৌশিক বলে চলল, “মাস কয়েক আগেই আমরা গোটা ফ্যামিলি ডুয়ার্স গিয়ে ছিলাম, সেটা তোদের মনে আছে নিশ্চয়ই। সেই ডুয়ার্সের জঙ্গলে আমি এই ঘণ্টাধ্বনি শুনে প্রথমে ভীষণ চমকে গিয়েছিলাম। তারপর বাবা আমাকে সবটা বুঝিয়ে দেয়।”
নতুন কিছু জানার আগ্রহ তখন রাজু-তীর্থর চোখেমুখে।
কৌশিক বলে চলে, “এই আওয়াজ বাবা প্রথম শুনেছিল মেঘালয়ের গ্রামীণ এলাকায়। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারে, এটা একটা পোকার আওয়াজ। স্থানীয় ভাষায় যার নাম নিয়াং কালিয়া বা ওই জাতীয় কিছু। ঘণ্টা-পোকা বা সিকাডাস সাধারণত অসম-মেঘালয়ের জঙ্গলে পাওয়া যায়। আমি যখন গতবার ডুয়ার্সের গরুমারা জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিলাম, এই আওয়াজ শুনেছিলাম। মহাকালের মন্দিরের নিস্তব্ধতার মধ্যে ঘণ্টাধ্বনির এই আওয়াজ যে কী অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করে, তা তোদের বলে বোঝাতে পারবো না।” কথা বলতে-বলতেই কৌশিক যেন ডুয়ার্সের গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেল।
“ওই পোকারা এমন জোরালো আওয়াজ কী করে করে?” প্রশ্ন করল রাজু।
“ওদের শব্দ অঙ্গ আছে—টিম্বালস। তার ভিতর অসংখ্য দৃঢ় আর নমনীয় মেমব্রেন আছে। পেশির নাড়াচাড়ায় ওগুলি একে অপরের সঙ্গে ঠোকা খেয়ে আওয়াজ সৃষ্টি করে। এদের বায়ুস্থলি থাকায় সেই আওয়াজ অনুরণনের ফলে তীব্ররূপ ধারণ করে। এবার একসঙ্গে যখন অনেক পোকা আওয়াজ সৃষ্টি করে তখন ওই আওয়াজ অত জোরে শোনা যায়।” কৌশিক খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলল।
তীর্থ বলল, “বুঝলাম। ওদের আওয়াজ যেন মাইকের আওয়াজে হারিয়ে না যায় সেজন্যই তুই দুলালকাকুকে দিয়ে মাইক বন্ধ করিয়েছিস, তাই না?”
“আর মণ্ডপের পিছনে আলোও নেভানো সেই কারণে। যাতে পোকাগুলো বিরক্ত হয়ে উড়ে না যায়।” আপনমনেই বলল রাজু।
“এই তো সবটা ক্লিয়ার তোদের কাছে।” নিশ্চিন্ত মনে পোলাও-মাংসের স্বাদ নিতে নিতে বলল কৌশিক।
“কিন্তু এত ভিড় হওয়ার কারণ কী? আমরা তো শুধু আমাদের বন্ধুদের মধ্যেই প্রচার করেছি।” জানতে চাইল তীর্থ।
“আমরা প্রচার করেছি আমাদের বন্ধুদের মধ্যে, পাড়ার দাদারা তাদের বন্ধুদের মধ্যে, কাকুরা তাদের বন্ধুদের মধ্যে। সেইসব বন্ধুরা আবার তাদের বন্ধুদের মধ্যে। সিম্পল ম্যাথম্যাটিক্যাল ক্যালকুলেশন।” নিশ্চিন্তে বলে উঠল রাজু।
রাজুর কথায় সমর্থন জানিয়ে কৌশিক বলল, “একদম ঠিক। এক ও অভিন্ন প্রচার সূচি—সনাতনী পূজায় সনাতনী ঘণ্টা।”
“কিন্তু সনাতনী ঘণ্টা বলাটা কি ঠিক হল?” দুই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল তীর্থ।
“অবশ্যই ঠিক। যা আদি-অনন্ত-অকৃত্রিম তাই তো সনাতনী।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল রাজু।
সেই সময় হঠাৎ মাইকে ভেসে এল, “অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের পাড়ার সার্বজনীন দুর্গাপূজার প্রতিমা জেলার সেরা প্রতিমা নির্বাচিত হয়েছে আর পরিবেশ রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য আমাদের সংঘকে সরকারের তরফ থেকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।”
রাজু, কৌশিক, তীর্থ একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল, “হুররে!”
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস