সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০(পঞ্চম থেকে অষ্টম স্থান)
ব্রেকিং নিউজটা টিভিতে দেখেই পিঠটা টানটান। শিরদাঁড়া সোজা করে বসলাম। আজকাল এই এক অভ্যেস তৈরি হয়েছে। সারাদিন এবং রাতেও যতক্ষণ জেগে থাকি ততক্ষণ ধরেই খবর শোনা। অবশ্য শোনা বলা ভুল। আজকাল সবই তো দেখা, দৃশ্যমানতা। দৃশ্যকল্প। কতরকমের নিউজ চ্যানেল—বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি। অন্যান্য ভাষারও আছে বহু নিউজ চ্যানেল, তবে আমি এই তিনটেই দেখি, মানে এই তিনটে ভাষা বুঝি বলেই। গত প্রায় পাঁচ মাসে রিটায়ার্ড লাইফের মতো হাল হয়েছে আমার। অবশ্য আমার একার, এ-কথাই-বা বলছি কেন? গোটা পৃথিবীটাই তো যেন থমকে গেছে আচমকাই ওই কোভিড-১৯-এর বদান্যতায়। খুব খারাপ অবস্থা পৃথিবীবাসীর। লড়ছে সবাই যে যার নিজের মতো করে। তবে যুদ্ধটা পুরোপুরি জয় হয়নি এখনো। এইরকম একটা দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে এইরকম একটা খবরে আমার পিলে শুধু চমকেই উঠল না, আমাকে একটানে নিয়ে গিয়ে ধড়াম শব্দে ফেলল বছর পঁচিশেক পেছনে।
আমি যেদিন প্রথম ছেলেটিকে ওর বাড়িতে পড়াতে যাই সেদিনই প্রথম দেখাতেই থমকে গিয়েছিলাম। মাত্র আট বছরের ছেলে, ক্লাস ফোরে উঠেছে, সমবয়সী বাচ্চাদের তুলনায় বেশ লম্বা আর অসম্ভব রকমের ধীরস্থির। ওই বয়সের শিশুরা যেরকম ছটফটে চঞ্চল হয়, এই ছেলেটি মোটেই তেমন নয়। মোটা পাওয়ারের চশমার কাচের পেছনে উজ্জ্বল দুটি চোখ। কী গভীরতা—চাউনিতে, হাবেভাবে! আমি এসেছিলাম ছেলেটিকে বাংলা পড়াতে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে, জন্ম থেকে দিল্লিতে। বাংলায় গড়গড় করে কথা বলতে পারলে এবং বেশ ভালো করে পড়তে পারলেও বাংলায় লেখার ক্ষমতা খুবই দুর্বল। বাড়িতে মায়ের কাছে সামান্য বাংলা অক্ষর পরিচয়মাত্র হয়েছে। সুতরাং ওকে বাংলা শিখিয়ে সবল করার জন্যই আমার আগমন। আমি তখনো স্কুলের চাকরিটা পাইনি। চাকরির জন্য তৈরি হচ্ছিলাম আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াতাম—ক্লাস ওয়ান থেকে টেন, নির্বিশেষে। প্রথমদিন আমি যেতেই গুরুগম্ভীর চালে আমাকে সম্বোধন করে, “ম্যাম, আপনাকে আমি দিদি ডাকতে পারি?”
একটু হকচকিয়ে গেলেও ওই বয়সের ছেলের ভদ্রতাবোধ দেখে মুগ্ধ হলাম। অন্য শহরে জন্ম থেকে বড়ো হয়েছে। এ শহরের সবকিছুর সঙ্গে ওর মানিয়ে নিতে তো একটু বেগ ওকে পেতেই হবে। ওর সঙ্গে আমার প্রথমদিন থেকেই একটা অসমবয়সী সখ্য গড়ে উঠল। ওর কথার উত্তরে হেসে আমিও বললাম, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারো। ইন ফ্যাক্ট তুমি ম্যাম না ডেকে দিদি ডাকলেই আমার ভালো লাগবে।”
আমাকে হতবাক করে দিয়ে বলল, “ইন ফ্যাক্ট কথাটা কি বাংলা অভিধানেও আছে?”
আমি ধাতস্থ হয়ে কিছু বলবার আগেই আবার বলে, “আসলে আমি যখন আপনার কাছে বাংলা ভাষাটাই শিখব, তখন সবকথা বাংলাতেই বলি আমরা?”
আমি সেদিন ছাব্বিশ বছর বয়সে নতুন কিছু শিখলাম। সত্যিই তো, আমি বাংলা ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মানুষ হয়েও কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ বা বাক্যাংশ কেন গুঁজে দিই নিজের বক্তব্যে? এই তো, দিব্যি গড়গড় করে বাংলা মনে পড়ছে! অভ্যেস ফেরাতে হবে। হেসেই বললাম, “ঠিক বলেছ। আর আপনি করে বোলো না। তুমি করে বোলো।”
প্রথমদিনেই তো আর পড়াশোনা প্রচুর হওয়া সম্ভব নয়, আলাপ-পরিচয়পর্বই চলতে থাকল তাই।
“তোমার নামটা আমাকে বললে না তো!”
“ডাকনাম পাবলো। তুমি ওই নামেই ডেকো। তবে পোশাকি নামটাও জেনে রাখো, পিকাসো নেরুদা দত্তঘোষ।”
ভয়ানক বিষম খেতে খেতে সামলালাম কোনোমতে। আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। এমন নাম তো কখনো আগে শুনিনি। আমার অবস্থা দেখে পাবলোই ওর নাম-রহস্য ফাঁস করল।
“আমার বাবা স্থপতি। আর মা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ায়। বাবা পাবলো পিকাসোর অন্ধ ভক্ত। এদিকে মা প্রবলভাবে পাবলো নেরুদার ভক্ত। আমার জন্মের পরে দুজনের তুমুল ঝগড়া আমার নামকরণ নিয়ে। বাবার ভয়ানক ইচ্ছা আমার নাম রাখে পাবলো পিকাসো দত্তঘোষ। এদিকে মায়েরও ভীষণ ইচ্ছা আমার নাম রাখে পাবলো নেরুদা দত্তঘোষ। নাম নিয়ে টানা সাতদিন বিশাল ঝড়ঝঞ্ঝা বয়েছে বাড়িতে। শেষপর্যন্ত বাবা-মায়ের ঝগড়ার মীমাংসা করেন দাদু-ঠাকুমা। ওঁরা বলেন, দুজনের নামই যখন পাবলো, তখন আর এত সমস্যা কীসের? বাড়িতে ডাকনাম থাক পাবলো। আর পাবলোর পোশাকি নামে একসঙ্গে দুজনকে মিলিয়ে দেওয়া হোক, পিকাসো নেরুদা। দাদু-ঠাকুমার অভিমত ছিল যে নাম যেমন ইচ্ছা রাখা যায়। যদি কেউ তার সন্তানের নাম বঙ্গোপসাগর বা আরব সাগর বা হিমালয় পর্বত রাখে তাহলেও কারুর কিচ্ছু বলার নেই। শুধু যার নাম তাকে নামটা বহন করতে জানতে হবে। বুঝলে? এই হলো আমার নাম-রহস্য।”
পাবলো আমার দিকে উজ্জ্বল বড়ো বড়ো চোখজোড়া মেলে তাকিয়ে আছে। কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছে চাউনিতে। প্রথমদিনেই ভীষণ ভালো লেগে গেলো আমার পাবলোকে। অত্যন্ত মেধাবী, বুদ্ধিমান ছেলে। আর কী সুন্দর ঝরঝরে বাংলা বলছে! অথচ এতদিন প্রবাসেই ছিল। আমার অনেক ছাত্রছাত্রীই কলকাতায় জন্ম থেকে বড়ো হয়েও এত সুন্দর বাংলা বলতেই পারে না। কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, “দিল্লিতে জন্ম থেকে এতদিন থেকে এত সুন্দর বাংলা কী করে শিখলে?”
মুহূর্তেই পাবলোর সপ্রতিভ উত্তর, “কেন? দিল্লিতে থাকলে বাংলা শেখা যায় না বুঝি? আমি তো বাংলা শিখেছি সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার, অবন ঠাকুরের কাছে!”
পাবলোর এতদিনকার বাংলা শিক্ষকদের তালিকা হয়তো আরো লম্বা হত, আমিই ওকে মাঝপথে থামালাম, “বুঝেছি, তার মানে তুমি অনেক বাংলা গল্পের বই পড়ো। খুব ভালো।”
মিষ্টি করে হাসল পাবলো। আর আমাদের মধ্যে গড়ে উঠল একটা অদৃশ্য সেতু প্রথম সাক্ষাতেই। পছন্দ-অপছন্দের তালিকায় আমরা বন্ধু হলাম ছাত্র-শিক্ষিকা সম্পর্কের ঊর্দ্ধে উঠে।
পাবলোকে নিয়ে আমার তেমন খাটনি ছিল না। পাবলো অবশ্য নিজেকে বলত ‘গ্রন্থকীট’। সত্যি সত্যিই গ্রন্থকীটই বটে। কতশত বিচিত্র বিষয়ে যে ওর আগ্রহ ছিল, আর সেইসব বিষয়ে পড়াশোনা করত স্কুলের পড়াশোনার বাইরে গিয়ে, তাতে আমি অবাকই হতাম। আর পাবলোর এইসব বইয়ের জোগানদার ছিলেন ওর দাদু। নাতিকে কিছু বই তো কিনে দিতেনই, তার সঙ্গে নিজে বিভিন্ন লাইব্রেরির মেম্বার হয়ে সেখান থেকেও বইপত্র এনে দিতেন নাতির জন্য। আসলে তখনোও তো আমাদের দেশে ইন্টারনেটের এমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না। জানার মাধ্যম ও উৎস দুইই ছিল বই। আমিও যখন যা নতুন বিষয়ের বই পেতাম পাবলোকে এনে দিতাম পড়ার জন্য। ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত আমি ওকে বাংলা পড়িয়েছি। পড়িয়েছি বলছি বটে, আসলে বলা ভালো, আমরা দুজনেই একসঙ্গে পড়েছি। পাবলোকে পড়ানোর ওই কয়েক বছরে আমি নিজেও অসম্ভব সমৃদ্ধ হয়েছি। সত্যি বলতে কী, আমি ওর সামনে কোনো বিষয় উত্থাপন করতে বেশ ভয়ই পেতাম। ওই বিষয়ে পাবলো ইতিমধ্যেই কতটা জানে সেটা আন্দাজ করে নিতাম। এমনকি বহু বিষয় আমি পাবলোর কাছেই প্রথমবারের জন্য জেনেছি একথা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। আমি যখন প্রথমবার পাবলোর মুখে পরাবাস্তববাদের ব্যাখ্যা এবং সে সম্পর্কে ওর নিজস্ব মতামত শুনলাম, তখন পাবলোকে সমীহ না করে আমি পারিনি। পাবলো যে আমার ছাত্র তাই নিয়ে আমি আগেও গর্বিত ছিলাম, এখনো আছি। তবে আজকের এ খবরে আমি স্তম্ভিত—করেছে কী পাবলো!
পাবলো আমার কাছে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আবার দিল্লিতেই ফিরে গিয়েছিল। ওখানেই ইলেভেন টুয়েলভ শেষ করেছিল। তবে তখনো পর্যন্ত ওর সঙ্গে আমার কিন্তু নিয়মিত যোগাযোগ ছিল চিঠিতে। একবার লিখল, ‘দিদি, তুমি চিঠি দিও নিয়মিত। নইলে বাংলা লেখাটার চর্চা আর হবে না।’ পাবলোর কথামতোই ওকে নিয়মিত চিঠি লিখতাম বাংলায়। তারপর ও এইমসে ডাক্তারিতে ভর্তি হল। ও আমাকে বলত যে ও হরমোনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করতে চায়। আরো কতরকমের আইডিয়ার কথা জানাত। আমার মতামত জানতে চাইত। আমি বাংলার ছাত্রী, আমি কি অতশত বিজ্ঞানের বিষয়ে জানি? আমি উলটে ওকেই বলতাম, ‘তুই-ই বল, আমি আর কী বলব? আমি শুনব।’
যখন পাবলো এম.বি.বি.এস ফাইনাল ইয়ারে তখন একবার কলকাতায় এল পারিবারিক অনুষ্ঠানে। আমিও নিমন্ত্রিত ছিলাম। সারা সন্ধে ও আমাকে কতকিছু বলে গেল। তার মধ্যে আমার বেশ মনে আছে ওর যে কথাগুলো—“দিদি, মানুষের রাগ কোথায় তৈরি হয় জানো?”
আমার উত্তর, “কেন? মনে!”
পাবলো আবার বলে, “মনটা কোথায় থাকে বলো তো।”
আমি হেসে বললাম, “কোথায় আবার? হৃদয়ে!”
পাবলো মাথা নাড়ে সজোরে, “না না, একদম নয়। অ্যারিস্টটল পর্যন্ত এই ধারণা পোষণ করতেন, মন থাকে হৃদযন্ত্রে। কারণ রক্ত সংবাহিত হয় হৃদযন্ত্রের মাধ্যমে। আর রক্তের অক্সিজেন জীবের প্রাণশক্তি। তাই এমন ধারণা ছিল। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় মনও আসলে মানুষের মস্তিষ্কেই থাকে। মন তো আসলে অনুভূতি-কেন্দ্র। আর আমাদের সব অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের মাধ্যমে। আচ্ছা দিদি, বলো তো যদি এমন কোনো ওষুধ বা আর্টিফিশিয়াল হরমোন যদি আবিষ্কার করা যায় যাতে মানুষের অনুভূতি মানে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তবে কেমন হবে?”
এতক্ষণ ধরে পাবলোর কথাবার্তা এমনিতেই আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, এবার আমার কান-মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠল। এ-ছেলে বলে কী, অ্যাঁ! ওষুধ দিয়ে মানুষের মন নিয়ন্ত্রিত করতে চায়? নির্ঘাত কোনো আমেরিকান থ্রিলার-ট্রিলার পড়েছে বা দেখেছে।
বললাম, “বাহ্, বেশ, বুঝলাম! আপাতত এম.বি.বি.এস ফাইনালটায় রেজাল্ট ধরে রাখা চাই। হায়ার স্টাডি করবি না?”
পাবলো প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, “পরীক্ষা নিয়ে চাপ নেই। আমি তৈরিই আছি। দিদি, আমি ভাবছি হায়ার স্টাডির জন্য বিদেশে যাব কি না। অবশ্য দেশেও থাকতে পারি। কী করলে ভালো হয় বলো তো।”
যেন আমার মতামতের ওপরেই পাবলোর ভবিষ্যতের পদক্ষেপ নির্ভর করছে, এমন একটা উদ্বিগ্ন মুখ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বুঝলাম, পাবলো আমার মানসিক সমর্থনকে সঙ্গী করতে চাইছে। আমি ওর পিঠ চাপড়ে বললাম, “কারুর কথা শুনবি না। শুধু নিজের মনের কথা বা তোর মতে তোর মস্তিষ্কের কথাই শুনবি।”
হা হা করে হেসে পাবলো বলে, “আমি নই, আমি নই দিদি, প্লেটো ভেবেছিলেন মস্তিষ্ক একটি গোলাকার আদর্শ ঘনবস্তু এবং মস্তিষ্কই সমস্ত চেতনা ও অনুভূতির আধার।”
পাবলোকে আশিস জানিয়ে বলি, “আজ আসিরে পাবলো, রাত হয়েছে। পরে একদিন আমার বাড়িতে আসিস। অনেক আইডিয়া তোর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বুঝতে পারছি, সেইসব শুনব। আজ আর আমার মস্তিষ্ক নিতে পারছে না রে।”
অপ্রতিভ পাবলো। হেসে আমি বিদায় নিই।
তারপর সঙ্গত কারণেই সাংসারিক এবং কর্মস্থলের কাজের চাপে পাবলোর বলা কথাগুলো মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে বন্ধও হয়েছিল। তবে পাবলোর মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝেই সুপার মার্কেটে বা শপিং মলে দেখা হত। তখনই শুনেছিলাম, পাবলো বিদেশ থেকে মেডিসিনে পোস্ট ডক্টরাল পর্যন্ত পড়ে দেশে ফিরে এসেছে। তারপর থেকে পাবলো, মানে ডক্টর পিকাসো নেরুদা দত্তঘোষ দেশেই রাজস্থানের প্রত্যন্ত একগ্রামে বসে নিজের ছোট্ট অপ্রতুল ল্যাবরেটরিতেই আবিষ্কার করেছে মানুষের মনকে কী করে হরমোন ড্রাগসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর এই আবিষ্কারের জন্যই ভারত সরকার পাবলোর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে নোবেল কমিটিকে। তবে এই আবিষ্কারের কারণে পাবলো বিভিন্ন দুষ্টচক্রের শিকারও হয়ে যেতে পারে। পিঠ টানটান করে বসে পুরো খবরটাই খুব মন দিয়ে দেখলাম। সঙ্গে পাবলোর একটা ছোট্ট সাক্ষাৎকারও ছিল। আমার বিস্ময় ও আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই। আমি গর্বিত যে একজন নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত ডাক্তার বিজ্ঞানী আমার এককালের ছাত্র।
পরদিন বোধ হয় দেশের সবক’টি খবরের কাগজেই পাবলোর খবরটি বেশ ফলাও করে বিস্তারিত ছাপা হয়েছে। আমিও হকারকে অনুরোধ করে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সবক’টি খবরের কাগজ সংগ্রহ করলাম। যতই প্রবাসে জন্মাক আর প্রবাসেই আপাতত থাকুক না কেন, আদতে তো পাবলো কলকাতারই এক বঙ্গসন্তান। শহর গর্বিত হোক পাবলোর কীর্তিতে। আমি বেশ বড়ো এককাপ গরম চা নিয়ে আর আমার সংগৃহীত সবক’টি কাগজ নিয়ে বসলাম বেশ জমিয়ে বাবু হয়ে বসার ঘরের ডিভানের উপর।
প্রথম খবর, এই আবিষ্কারের জন্য পাবলো জাতীয় নিরাপত্তা পাচ্ছে। কারণ এই আবিষ্কারের যেমন ভালো দিক আছে, তেমন ভুল প্রয়োগের আশঙ্কাও আছে। পাবলোর, মানে ডক্টর পিকাসো নেরুদা দত্তঘোষের অভাবনীয় সাফল্যের কথাই জানানো হয়েছে। কত অল্প সরঞ্জামে এবং নামমাত্র খরচে এত বড়ো রাজসূয় যজ্ঞের সূচনা করেছে। ভারত মায়ের যোগ্য সন্তান এই কীর্তিমান ডাক্তারের জন্য সরকারের কাছে ভারতের সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’-এর জন্যও দাবি জানিয়েছে কলকাতার একটি নাগরিক মঞ্চ।
আমার মনটা আনচান করে উঠল একবার পাবলোর সঙ্গে কথা বলার জন্য। ঠিক যেরকম স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর দিনে ওকে চকলেট বা আইসক্রিম খাইয়ে পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিতাম, ঠিক তেমনভাবেই ওকে আবার অভিনন্দিত করতে ইচ্ছা হল। ভাবলাম, এই অকল্পনীয় সাফল্যের পরে ঠাকুমা, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে পাবলো কলকাতায় আসবে নিশ্চয়ই। তখনই জানব ওর পরীক্ষানিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ সম্বন্ধে। একবার বরং ওদের বাড়িতে ফোন করে ওর বাবা-মাকেই অভিনন্দন জানাই।
ফোন করলাম ভাবনাটা মাথায় আসামাত্রই। কোভিড-১৯ সম্পর্কে সতর্কতামূলক ডায়াল টোন শেষ হতেই ফোনটা ধরলেন পাবলোর ঠাকুমা। দাদু গত হয়েছেন জানতাম। ফোন ধরেই নাতির সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ঠাকুমা। তারপর আমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, প্রায় মাস দেড়েক ধরে পাবলোর বাবা-মা রাজস্থানেই, পাবলোর কাছে। কোভিড এমার্জেন্সিতে আটকে আছেন ওখানে ছেলের কাছে। দুটো ফোন নাম্বার বলে দিলেন ভদ্রমহিলা। একটি পাবলোর, আরেকটি পাবলোর বাবার। আর পাবলোর মায়ের ফোনটি তো কলকাতায় পাবলোর ঠাকুমার কাছেই। ফোন নাম্বারগুলো আমি নিলাম ঠিকই, তবে আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এটুকু বুঝলাম যে পাবলোর এই যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্পর্কে অবশ্যই ফোনে কথা বলা ঠিক হবে না। এটা পাবলোর ও পাবলোর পরিবারের নিরাপত্তার কারণে। তবে ওরা কবে কখন কীভাবে ফিরবেন কলকাতায়, সে ব্যাপারে কথা তো বলা যেতেই পারে।
পাবলোর ঠাকুমার দেওয়া নাম্বার দুটো লিখে নিয়েছিলাম ডায়েরিতে। পাবলোর নাম্বারটাতে ডায়াল করলাম। রিং হতে না হতেই পাবলো কল রিসিভ করল, “আমি জানতাম দিদি, তুমি ঠিক ফোন করবেই। আর কয়েকদিন অপেক্ষা করো। আমি বাবা-মাকে পৌঁছাতে কলকাতায় আসছি। সরকারি সহযোগিতা পেয়েছি এখান থেকে কলকাতায় যাবার জন্য। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। সাবধানে থেকো। রাখছি এখন।”
এইটুকুই কথা হল। বুঝলাম, পাবলোর ফোন হয়তো ট্যাপ করা হতে পারে এমন আশঙ্কায় সম্ভবত সারভেইল্যান্সে আছে এখন পাবলো। যাক বাবা, কলকাতায় আসার পরেই না-হয় কথা হবে। কৌতূহলে রসের মধ্যে রসগোল্লার মতো ফুটছি আমি। ভাবলেই বুকটা ভরে উঠছে গর্বে, পাবলো আমার ছাত্র ছিল একদা, এ কী কম কথা!
দিন পাঁচেক বুকে হাত দিয়ে বসে অপেক্ষায় রইলাম। পাবলো আসছে কলকাতায়। পাবলোর এক্সপেরিমেন্ট সম্বন্ধে শুনতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছি। ওসব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা সম্বন্ধে বুঝি আর না বুঝি, শুনতে আর বোঝার চেষ্টা করতে তো বাধা নেই। পাবলো ঠিক সহজ সরল করে বুঝিয়ে দেবে, সে বিজ্ঞানে যতই আমার অজ্ঞান হবার মতো নিরেট মাথা হোক।
ছ’দিনের দিন সকালে সাতটার সময়ে চায়ে চিনি গুলছি, মোবাইলটা ‘মা তুঝে সলাম বন্দে মাতরম’ সুরে বেজে উঠল। মোবাইল স্ক্রিনে নামটা না দেখেই আমি বুঝলাম যে এটা পাবলোরই ফোন। লাফিয়ে গিয়ে ধরলাম। পাবলোই।
“দিদি, আমার জন্য এককাপ চা করে নাও, তোমার সেই বিখ্যাত লেবু চা। আমি মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই ঢুকব তোমার বাড়িতে।”
“একদম করে রাখছি।” বলেই নিজের চা-টা চাপা দিয়ে পাবলোর জন্যও এককাপ চা বানিয়ে ফেললাম। ওর ভীষণ পছন্দের লেবু চা, তার মধ্যে এক চিমটি বিট নুন আর গোল মরিচের গুঁড়ো।
পাবলোর পাঁচ-সাত মিনিট মানে পাঁচ-সাত মিনিটই। সব গুছিয়ে-গাছিয়ে নিতে নিতেই দরজায় ঘণ্টি। পাবলো। ট্রেতে চায়ের কাপ আর কুকিজ সাজিয়ে নিয়েছিলাম। এই নারকেল কুকিজও পাবলোর খুব প্রিয়। ও আসবে বলে আমি দিন চারেক আগেই পাড়ার বেকারি থেকে আনিয়ে রেখেছি ফোনেই অর্ডার দিয়ে। ট্রেটা সেন্টার টেবিলে রেখেই দরজা খুলে দিলাম। সামনে দাঁড়িয়ে পাবলো। সাড়ে ছয় ফুট প্রায় দীর্ঘকায় সুদর্শন যুবক, চশমার কাচ আরো মোটা হয়েছে। চোখের উজ্জ্বলতা মোটা কাচ ভেদ করে বুদ্ধিদীপ্ত আলোর মতো আমার অন্তঃস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে। একমুখ হাসি দুজনেরই। বললাম, “ওয়েলকাম, ডক্টর পিকাসো নেরুদা দত্তঘোষ!”
দরজার বাইরে থেকেই পায়ে হাত দিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকেই ঘোষণার ভঙ্গিতে বলল, “স্বাগতম দিদি, স্বাগতম।” বলতে বলতেই ওর চোখ চলে গেছে আমার পিছনে সেন্টার টেবিলে। জোরে শ্বাস টেনে বলে, “আহ্, কতদিন পরে এই নারকেল কুকিজের গন্ধ!”
আমাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে ও সেন্টার টেবিলের সামনের বড়ো সোফাটায় বসে পড়েছে। আমি দরজা বন্ধ করে এসে বসলাম পাশে। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, “তারপর? ডক্টর পিকাসো নেরুদা দত্তঘোষ, এবারে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কাহিনি একটু শুনি!”
পাবলো ঘাড় দুলিয়ে বলল, “আগে চা-টা শেষ করে নিই দিদি। খুব খিদে পেয়েছে। জগিং সেরেই তো তোমার কাছে চলে এসেছি। হাতে যথেষ্ট সময় আছে।” বলেই বাঁহাতে ট্র্যাক স্যুটের পকেট থেকে নিজের মোবাইলে সময়টা দেখে নিল।
বেশ তারিয়ে তারিয়ে লেবু চা আর গোটা ছয়েক কুকিজ খেয়ে পাবলো বেশ আরাম করে পা তুলে বসল। তারপর প্রথমেই বলল, “দিদি, আজকে আর বিশুদ্ধ বাংলায় পুরো কথোপকথন চালানো যাবে না। কারণ অনেক কিছুর নামেরই কোনো বাংলা প্রতিশব্দ হয় না, বুঝলে? এবারে বলো, কী কী জানতে চাও।”
আমি ট্রের ওপরে খালি কাপ-প্লেটগুলো তুলতে তুলতেই বললাম, “সবটা। যেমন-যেমনভাবে তুই এগিয়েছিস, তোর আইডিয়া, তোর এক্সপেরিমেন্ট—সব।”
তাড়াতাড়ি করে ট্রেটা নামিয়ে রেখে এসে নতুন কিছু জানার আনন্দে শিশুর মতো উচ্ছ্বল আগ্রহে পাবলোর মুখোমুখি বসলাম। পাবলো দু-চোখ বন্ধ করে নিজেকে মনে মনে গুছিয়ে নিল। ঠিক সেই ছোটোবেলার মতোই। তারপর সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “দিদি, তুমি ফিল-গুড হরমোনের নাম শুনেছ? নিউরো-হরমোন।”
আমি স্মৃতি হাতড়াতে থাকি শূন্য ভাঁড়ারে। পাবলো আবার শুরু করে, “বলতে পারো আমার কৈশোর থেকেই মাথায় আইডিয়াটা একটু একটু করে লালন-পালন করেছি। মানুষের মনে এত রাগ থাকবে কেন? এত ক্ষোভ-ঘৃণা-বিদ্বেষ থাকবে কেন? পড়তাম বিভিন্ন বই, ম্যাগাজিন, জার্নাল, যা পেতাম ওই বিষয়ে হাতের কাছে। কিন্তু কোথাও আমার অনুসন্ধানের ঠিকঠাক দিশা ছিল না। তারপর মেডিকেল পড়ার সময় সু্যোগ হল বিস্তারিত পড়ার ও জানার—হরমোন, তার কাজ, তার প্রভাব মানুষের মনের ওপরে।”
কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে পাবলো আবার শুরু করল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি।
“তারপর জানো তো দিদি, হরমোন আর মানুষের মস্তিষ্ক যেন আমাকে নেশার মতো পেয়ে বসল। আমি আর অন্য কোনোদিকে মনঃসংযোগ করতেই পারি না এমন অবস্থা হল। তারপর এম.বি.বি.এস ফাইনাল শেষ করেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে হরমোনের প্রভাবে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার গবেষণা করব। এতে সাধারণ মানুষের তো উপকার হবেই, অবসাদে ভোগা, বিষণ্ণতায় ভোগা এসবের চিকিৎসা সহজ হবে। আর বিপুলভাবে এর প্রয়োগ হতে পারে পৃথিবী থেকে আতঙ্কবাদ নির্মূল করতে।”
আমি নড়েচড়ে বসলাম। ছেলেটা বলে কী! কোথায় হরমোন আর কোথায় আতঙ্কবাদ, টেররিজম! স্ট্রেঞ্জ!
তারপর পাবলো যা-যা বলে গেল আর আমি শুনে গেলাম, তা তো কোনো স্বপ্নাতীত অদৃশ্য কল্পলোকের কথা। পাবলোর গবেষণালব্ধ ফল যদি সমাজের একাংশেরও কাজে লাগে, তবে সত্যিই সেদিন পৃথিবী ইউটোপিয়া হবে।
পাবলোর কথায় চমক ভাঙল, “দিদি, এই যে দুটো নিউরো-হরমোন অক্সিটোসিন আর ভেসোপ্রেসিন, এই দুই হরমোনের ব্যালান্সের ওপরেই নির্ভর করছে মানুষের মনের ক্রিয়াকলাপ। ভারসাম্যের অভাব হলেই মানুষের মস্তিষ্কের অনুভূতি-কেন্দ্র ওলটপালট। ভালোবাসা সরে গিয়ে রাগ বেড়ে যাবে। সহ্যশক্তি কমে গিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বেড়ে যাবে। কাজেই এই দুই গুরুত্বপূর্ণ হরমোন নিয়েই আমার গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল সে তো তোমাকে বললামই। সমস্যা হল আমেরিকায় বসে এ বিষয়ে কাজ করা। অনেক কাজ যেহেতু আমার আগেও অনেকেই করেছেন এই দুই নিউরো-হরমোন নিয়ে, কাজেই সেক্ষেত্রে আমার গবেষণার ফল সম্বন্ধে স্পষ্ট রূপরেখা না পেলে গ্রান্ট জোগাড় করা মুশকিল। বিপুল খরচবহুল গবেষণা। তখন আমি আবার অন্যভাবে ভাবতে শুরু করলাম। আমি ভারতবর্ষের সন্তান, আর ভারতবর্ষ আয়ুর্বেদশাস্ত্রের পীঠস্থান। সুতরাং প্রাকৃতিক ভেষজ থেকে যদি আমি খুঁজে পেতে চেষ্টা করি অক্সিটোসিন আর ভেসোপ্রেসিনের উৎস, তবে কেমন হয়? আশা করা যায় কম খরচে ও বহুলাংশে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। আমি দেশে ফিরে এলাম। কাজ শুরু করলাম পাঞ্জাব লাগোয়া রাজস্থানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে। অনেকটা জায়গার দরকার ছিল আমার। সরকারি সহায়তায় ওখানেই বিস্তৃত জমি নিয়ে তৈরি হল আমার ল্যাবরেটরি কাম খামারবাড়ি।”
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি পাবলোর মুখের দিকে।
পাবলো আবার শুরু করল, “খুব সস্তায় কাজ করার উদ্দেশ্যে শুরু করলাম তরমুজের, লেবুর, পেঁপের, কালোজামের বীজ আর ছোলা নিয়ে। সহজলভ্য হওয়া চাই। কাঁচা উৎসের উৎপাদন সুবিধাজনক হওয়া চাই। ধীরে ধীরে গবেষণা এগোল। প্রাকৃতিক উপাদান, অথচ প্রাণীদেহের বাইরে তৈরি হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল অক্সিটোসিনের যথেচ্ছ ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছিল। তাই অক্সিটোসিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন যদিও আদালতের রায়ে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠেছে, তবে সে তো কৃষিকাজে। মানুষের শরীরের অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিনের মাত্রার বৈষম্যের ফলেই তো মন প্রভাবিত। ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ ইত্যাদি অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ করে এই দুই হরমোন। সুতরাং মানুষের শরীরে এই ভারসাম্য এমন একটা পর্যায়ে রাখা, যেখানে মানুষের মন থেকে ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ সব সরিয়ে দেওয়া যাবে। আর আমার প্রজেক্ট হল এইভাবে আতঙ্কবাদ দমন। গোটা পৃথিবীই সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে বলে, সে প্রথম-বিশ্ব অথবা তৃতীয়-বিশ্ব, যে-বিশ্বের দেশই হোক, অথচ কার্যক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদেশের কথা ছেড়েই দাও, আমাদের দেশেই যখন এই আতঙ্কবাদী হামলা চলে, সন্ত্রাসবাদীরা ধরাও পড়ে যায়, তারপর কখনো কখনো তাদের সংগঠনের দেওয়া চাপের কাছে রাষ্ট্র নতিস্বীকার করে সন্ত্রাসবাদীদের ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয়। আমার মাত্র দুটো দিন লাগবে। ধরা পড়া আতঙ্কবাদীদের খাবার ও জলের সঙ্গে ওষুধটা খাওয়ানো হবে অক্সিটোসিন ভেসোপ্রেসিন ভারসাম্য বজায় এবং ফিল-গুড হরমোন রিলিজটা নিয়ন্ত্রণ করতে। তাদের মধ্যে থেকে ক্রোধ সরলেই তাদের বোঝানো হবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। আশা করি গোটা পৃথিবী উপকৃত হবে আমার এই স্বপ্নের প্রজেক্টে। ওই দুই নিউরো-হরমোনের উৎস তো খুব সহজপ্রাপ্য করেই খুঁজে পেয়েছি। থিওরিটিক্যালি পুরোপুরি সফল। আর তোমাকে চুপিচুপি বলি, প্র্যাকটিক্যালিও। আমি যদিও সরকারিভাবে স্টেটমেন্ট দিয়েছি পশুদের ওপরে প্রয়োগে সাফল্য। পর্যায়ক্রমে বিবাদমান দুই ইঁদুর, দুই বেজি, দুই ভেড়া, দুই কুকুর, দুই চিতা এবং একজোড়া সিংহ-সিংহির ওপরে। তোমাকেই বলছি দিদি, হিউম্যান ট্রায়ালও হয়েছে। ওই জন্যই তো আসলে বাবা-মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
শুনেই আমার এগারো হাজার ভোল্টের ঝটকা লাগল। উলটে পড়েই যাচ্ছিলাম। “বলিস কী রে? বাবা-মা জানে? কেন করলি এটা? কিছু লাভ হয়েছে?”
আমার লম্বা প্রশ্নমালা শুনে মিটিমিটি হাসে পাবলো, “তোমার সবক’টা প্রশ্নের একই উত্তর, হ্যাঁ, একটা বাদে। জানলে ঝগড়া করার আনন্দ-উত্তেজনার উপভোগ ছাড়ত? আমার ওই ওষুধ খেয়ে বাবা-মা গত দেড় মাসেরও বেশি একদিনও ঝগড়া তো করেইনি, উলটে ভয়ানক ফ্রেন্ডলি হয়ে গেছে। ওহ্, সারাজীবন কী ঝগড়াটাই না করেছে! অবশ্য ওদের ওই ঝগড়াটাই আমার ইনস্পিরেশন হয়ে গেছে।” হা-হা হাসিতে ঘর ভরিয়ে পাবলো বলে, “এবার বলো আতঙ্কবাদী সংগঠনের হেডরা আমার খোঁজ পেলে আমাকে ছেড়ে দেবে? হয় ভর্তা বানিয়ে খেয়ে ফেলবে, নয়তো আমার কাছ থেকেই ওই ওষুধের কুফলগুলো জেনে নিয়ে তার অপপ্রয়োগ করবে। আচ্ছা দিদি, তোমার মনে শান্তি হচ্ছে না ভেবে অদূর ভবিষ্যতে আগামী প্রজন্মকে আমরা একটা সন্ত্রাসবাদ মুক্ত পৃথিবী উপহার দিতে পারব?”
পাবলোর চোখেমুখে কী প্রত্যয়! কী আশাবাদী! নোবেল পুরস্কারের জন্য ও বিবেচিত হবে কি হবে না তা জানি না, তবে এটুকু জানি যে ওর এই সদ্ভাবনা সত্যিকারের পুরস্কৃত হবে সেদিন, যেদিন সত্যি সত্যিই পৃথিবীর ইতিহাস থেকে সন্ত্রাসবাদ শব্দটা মুছে যাবে। আমার প্রাণভরা আশীর্বাদ রইল পাবলোর গবেষণালব্ধ ফলের সার্বিক প্রয়োগের জন্য।
অলঙ্করণ: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়