সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০(পঞ্চম থেকে অষ্টম স্থান)
লম্বা পাঁচিলটার এই জায়গাটা সুবিধেজনক। বাইরের দিকে একটা আমগাছ আর ঠিক ভেতরে পাঁচিলের গায়েই একটা পেয়ারাগাছ। নোদো প্রথমে গামছাটা কোমরে বেশ করে কষে বেঁধে আমগাছে উঠল। আমগাছের ডাল বেয়ে পাঁচিলে। পাঁচিল থেকে অনায়াসে কোমর ঝুঁকিয়ে দুই হাত দূরে পেয়ারাগাছের ডালটা নাগালে পেয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে মাটিতে। অবশ্য এত হাঙ্গাম করার দরকার ছিল না। গেটটায় তালা পড়ে না। আলতো করে খুলে ঢুকে পড়লে কেউ টের পেত না। তাছাড়া পাঁচিলটা জায়গায় জায়গায় ভাঙা। জাস্ট হেঁটেই ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু যতই হোক ওইরকমভাবে চুরি করতে ঢুকতে তো একটু লজ্জা লাগেই। চুরির তো একটা ছিরি আছে নাকি!
কয়েক বছর আগে অবধি পাগলা জগাইয়ের বাড়িতে অনেক চোর ঢুকেছে। এ বাড়িতে ঢোকা আর কি এমন ব্যাপার! কিন্তু হলে কী হবে, সব ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কেউ হয়তো একটা পেতলের কলসি, কেউ একটা হ্যারিকেন, কেউ কয়েকটা খুচরো পয়সা ছাড়া কিছু বাগাতে পারেনি। কী-ই বা থাকবে! একটা প্রায় পোড়ো বাড়ি। বেশিরভাগ জায়গাই সাপ-খোপ-বাদুড়ের আড্ডা। পশ্চিমের একটা ছোট্ট ঘরে পাগলা জগাই মাটিতে মাদুর পেতে শোয়। তার পাশের একটা ঘরে মোক্ষদাবুড়ি থাকে। সেই ঘরেই একটা উনুন আছে। ছেলেরা যখন বুড়ি মাকে ঘর থেকে বের করে দিল তখন থেকেই বুড়ি পাগলা জগাইয়ের বাড়ি ঘাঁটি গেড়েছে। জগাইয়েরও ভালো একদিক দিয়ে। রান্নাবান্নার হুজ্জতি আর পোয়াতে হয় না। শুধু রান্নাবান্নাই বা কেন? সবকিছুই তো মোক্ষদাবুড়িকেই সামলাতে হয়। ও-পাগলার কোনোদিকে নজর আছে নাকি!
নোদো পেয়ারাগাছ থেকে নেমে আস্তে আস্তে দক্ষিণের ঘরটার দিকে এগোল। পশ্চিমের ওই ঘরদুটো ছাড়া এই দক্ষিণের ঘরটাই একমাত্র ভালো অবস্থায় আছে। তবে নোদো শুনেছে, আগে যে চোরেরা এই বাড়িতে ঢুকেছিল তারা কেউই ওই ঘরে ঢুকতে পারেনি। ওই ঘরে জগাই কীসব পরীক্ষানিরীক্ষা করে। ঘরভর্তি কিম্ভুতকিমাকার সব যন্ত্রপাতি আর হাজার গন্ডা শিশিবোতলে বিটকেল গন্ধওলা যত রাজ্যের তেল বা ওষুধ-টষুধ জাতীয় সলিউশন। আর ওই ঘরেই থাকে কমলাকান্ত আর দোলগোবিন্দ। কমলাকান্ত একটা ইয়াব্বড় হুলো বেড়াল আর দোলগোবিন্দ একটা গোখরো সাপ। দুজনে ভারি বন্ধুত্ব। পাড়ার অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছে দুজনকে খেলা করতে। দোলগোবিন্দর প্রায়ই শরীর খারাপ হয়, কমলাকান্ত তখন তার জন্যে ইঁদুর ধরে এনে দেয়। ক’দিন হল দোলগোবিন্দর শরীর খারাপ। কমলাকান্তও নাকি ডিপ্রেশনে ভুগছে। তা না হলে কি আর নোদো দক্ষিণের ঘরের দিকে যাওয়ার সাহস পেত?
পাগলা জগাইর আসল নাম জগন্নাথ জমাদার। নোদোর নাম যেমন নবদ্বীপ নন্দী। ওই নামটা আর কেই-বা মনে রেখেছে! সবাই নোদো বলেই ডাকে। নবদ্বীপ নামটা নোদো নিজেও ভুলে যেত, যদি না সেদিন ভুল করে রাখহরি মাস্টারমশাইর মেয়ের বাড়ি ঢুকে পড়ত। রাখহরি মাস্টারমশাইর বদগুণ ছিল, অঙ্ক না পারলেই তিনি ছেলেদের জুলপি ধরে টান দিতেন। তাঁর ভয়ে ছেলেরা জুলপি কামিয়ে ফেলতে শুরু করল। নোদো অন্যসব বিষয়ে গোঁত্তা খেতে খেতে এগোলেও অঙ্কে মন্দ ছিল না। ওর জুলপিতে তেমন একটা টান পড়েনি। তো যা বলছিলাম, সেদিন চুরি করতে গিয়ে রাখহরি মাস্টারমশাইর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়ে তার লজ্জার একশেষ। মাস্টারমশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘বাবা নবদ্বীপ, তুমি শেষে তস্করবৃত্তি গ্রহণ করলে! তা করেছই যখন আশীর্বাদ করি কর্মে উন্নতি করো। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রের সাফল্য তো কামনা করতেই হবে।’ তো সেরকমই পাগলা জগাইকে জগন্নাথ বলে ডাকার লোক প্রচুরই আছে। মাঝেমধ্যেই বাইরে থেকে লোকজন আসে, তারা পাড়ার লোকের কাছে জগন্নাথ জমাদারেরই খোঁজ করে। এই তো হপ্তাখানেক আগে নোদো সকালে জামশেদচাচার দোকানে চা খাচ্ছিল, তখন বিশাল লম্বা একটা গাড়ি থেকে একটা লালমুখো সাহেব নেমে এসে বলল, “ক্যান য়্যু শো মি দ্য হাউস অফ প্রফেসর জাগাননাথ জামাডার?”
নোদো সেভেনে পড়তে পড়া ছেড়ে দিলে কী হবে, ইংরেজি ভালোই বোঝে। সে সঙ্গে করে সাহেবকে পাগলা জগাইর বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল। আধঘণ্টা পরেই সাহেবকে দেখা গেল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে আসতে আর পাগলা জগাইকে তার পেছন পেছন একটা ঝুলঝাড়ু নিয়ে তাড়া করতে। মোক্ষদাবুড়ির থেকে পরে জানা যায়, সাহেব নাকি পাগলা জগাইয়ের কী একটা আবিষ্কার কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।
প্রফেসর জগন্নাথ জমাদার আসলে একজন বিজ্ঞানী। এর মধ্যে তিনি দু-দু’বার নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। দুঃখের বিষয়, দু-বারই তিনি নোবেল পুরস্কারটি খুইয়ে বসেছেন। প্রথমটা তাঁর প্যান্টের পকেটের ফুটো দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। আর দ্বিতীয়বারেরটা একটা বীর হনুমান নিয়ে চলে যায়। হনুমানটা জগন্নাথের হাত থেকে এক ডজন মর্তমান কলা ছিনিয়ে নিয়ে গেলে জগন্নাথ ভীষণ রেগে হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে নোবেলটাই ছুড়ে মারেন। সে সেটাকে লুফে নিয়ে এক বগলে নোবেল আর এক বগলে কলার ছড়া নিয়ে জগন্নাথকে মুখ ভেংচে পালিয়ে যায়। গলায় নোবেল ঝুলিয়ে তাকে দু-একবার গাছের মগডালে বসে থাকতে দেখা গেছে, তারপর আর তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। নোবেলের দৌলতে সে নাকি দলের রাজা হয়ে বসেছে। দলের অন্যরাই তার ফাইফরমাশ খেটে দেয়। জগন্নাথ এখন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় ব্যস্ত আছেন। এটাতে সাফল্য পেলে তাঁর তৃতীয় নোবেল বাঁধা। নোবেল কমিটি এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছে। যে লোক পুরস্কারটা ঠিক করে রাখতে পারে না, তাকে বার বার পুরস্কৃত করা কেন, এ নিয়ে নাকি বিভিন্ন দেশ আপত্তি জানাতে শুরু করেছে। ওই হনুমান কাণ্ডের পরই জগন্নাথ পড়ানো-টড়ানো ছেড়ে দিয়ে এই গ্রামে চাটুজ্জেদের বাড়িতে এসে থাকা শুরু করেন। নোবেল গেছে সে জন্য জগন্নাথের দুঃখ নেই, কিন্তু মর্তমান কলার ছড়াটা তিনি বেশ সস্তায় কিনেছিলেন। তাছাড়া একটা হনুমান তাঁকে মুখ ভেংচে অপমান করে যাবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এখানে তিনি নিজের মতো আছেন, গবেষণা করছেন। কেউ বিরক্ত করার নেই। মাঝেমধ্যে অবশ্য কলকাতা থেকে রিপোর্টাররা আসে জ্বালাতে। একবার একজন রিপোর্টারের কাঁধের ওপর উঠে কমলাকান্ত গোঁফ দিয়ে তার নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে দিয়েছিল। আরেকবার একজন রিপোর্টারের টুপিটা পছন্দ হওয়ায় দোলগোবিন্দ পা জড়িয়ে তার সেটা পেড়ে আনার চেষ্টা করতে গেছিল। তারপর থেকে রিপোর্টারদের আনাগোনা অনেকটাই কমেছে।
নোদো যেতে যেতে একবার পাগলা জগাইর ঘরে উঁকি মারল। সে অঘোরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। মোক্ষদাবুড়ির ঘুম পাতলা। পরশুদিন দুপুরবেলা বাড়িটা সার্ভে করতে এসেও নোদো এই জানালা দিয়েই উঁকি মারে। পাগলা জগাই তখন চৌকিতে বাবু হয়ে বসে বকবক করছিল। মেঝেতে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসে গোটা আষ্টেক ছেলেপুলে। জগাইর বাড়িতে এদের অবাধ যাতায়াত। তারা ইস্কুল থেকে ফেরার পথে গাছে উঠে পেয়ারা, জামরুল খেয়ে যায়। মোক্ষদাবুড়িও ওদের খুব ভালোবাসে। নানারকম খাবার বানিয়ে খাওয়ায়। জগাই পাড়ার লোকেদের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা না করলেও বাচ্চাগুলোকে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রায়ই গপ্পো শোনায়। সেদিনের গপ্পোটা বেশ মজার লাগছিল বলে নোদো জানালার পাশ নড়তে পারেনি।
জগাই বলছিল, “এই যে আমাদের আকাশে সূর্য, চাঁদ, গ্রহ, নক্ষত্র—এরা সব কীসের টানে চরকি পাক খাচ্ছে বল দেখি।”
একটা ছেলে বলল, “গ্র্যাভিটি, মানে মহাকর্ষ, যেটা আইজ্যাক নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন। মহাকর্ষের টানে পৃথিবী আর অন্য গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে আর চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। সূর্য আসলে স্থির আছে। পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে পাক খাচ্ছে বলে আমাদের মনে হয় সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।”
“একদম ঠিক। সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহ সব নিয়ে হল সৌরমণ্ডল। তেমনি সূর্যের মতো লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র নিয়ে হয় এক-একটা গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। আমাদের ছায়াপথটার নাম কী, দেখি কে বলতে পারিস।”
আরেকজন বলল, “আকাশগঙ্গা বা মিল্কি ওয়ে।”
“দারুণ!” আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল জগাই। “এইরকম কোটি কোটি ছায়াপথ মহাকাশে ছড়িয়ে আছে। ছায়াপথগুলোর কেন্দ্রটা আবার ভীষণ ভারী। মনে করা হয় কেন্দ্রে বিশাল বড়ো ব্ল্যাকহোল বসে আছে। সূর্য কিন্তু আসলে স্থির নয়। ছায়াপথের অন্য সমস্ত নক্ষত্রের মতো সূর্যও ওই কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে। সেও ওই গ্র্যাভিটির জন্যে। আচ্ছা, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটা একবার শুনি।”
“মহাবিশ্বের যে-কোনো দুটো বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। আকর্ষণ বলের মান বস্তুদুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক আর তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।”
“তার মানে দাঁড়াল, গ্র্যাভিটিতে বিকর্ষণের মতো কোনো ব্যাপার নেই। গ্রাভিটির জন্যে যে-কোনো দুটো বস্তু কাছাকাছি আসতে চাইবে, দূরে সরে যেতে চাইবে না। এই যে ন্যাপলা পেয়ারাগাছে উঠে পেয়ারাটা ফেললি, সেটা পঞ্চা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে লুফে নিল, সেও তো পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণের জন্য। বিকর্ষণ থাকলে পেয়ারাটা আকাশে উঠে যেত। তাহলে মহাকাশের যে নক্ষত্রগুলো রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও তো একই ব্যাপার হবে। তাদের পরস্পরের কাছে সরে আসা উচিত। কিন্তু আজ থেকে নব্বই বছর আগে এডুইন হাবল নামে এক বিজ্ঞানী একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছিলেন। তা হল সব গ্যালাক্সিগুলোই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যার দূরত্ব যত বেশী সে তত বেশী গতিবেগে সরে যাচ্ছে। ধর একটা বেলুনের গায়ে যদি কতগুলো ফুটকি আঁকিস আর বেলুনটাকে ফোলাতে থাকিস, তাহলে ফুটকিগুলো একটা অন্যটার থেকে দূরে সরে যাবে। অনেকটা সেরকম ব্যাপার। তাও সেটা হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেন, আজ থেকে চোদ্দশো কোটি বছর আগে এক বিরাট বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। বোমা ফাটলে যেমন টুকরোগুলো চারদিকে ছিটকে যায়, আকাশের তারাগুলোও তেমনি ছিটকে গেছে। বোমার টুকরোগুলো যত দূরেই যাক, তাদের গতি কিন্তু আস্তে আস্তে কমতে থাকে, তারপর অবশেষে পৃথিবীর অভিকর্ষের টানে মাটিতে এসে পড়ে। গ্যালাক্সিদের এই ছিটকে যাওয়ার পালা এখনো চলছে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন তাদের গতিবেগ কিন্তু কমছে না, বরং বাড়ছে। মহাকর্ষ বল শুধুমাত্র আকর্ষণ করলে তো এটা হতেই পারে না। অর্থাৎ মহাবিশ্বে এমন কিছু পদার্থ আছে যার মহাকর্ষ বিকর্ষণধর্মী। তাজ্জব ব্যাপার হল, মহাবিশ্বে মোট যত পদার্থ আছে তার প্রায় সত্তর শতাংশই হল এইরকমের। বিজ্ঞানীরা এইধরনের পদার্থের নাম দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি।”
তারপর আর নোদো শুনতে পায়নি, কারণ ওদিক থেকে মোক্ষদাবুড়িকে আসতে দেখে তাকে সরে পড়তে হয়েছিল। যদিও জগাইর বাড়িতে যে যখন খুশি ঢোকে, কিন্তু নোদোর তো খুব একটা সুনাম নেই। আগে একদিন নোদোকে আড়ি পাততে দেখে মোক্ষদাবুড়ি চেলাকাঠ নিয়ে তাড়া করেছিল। ততক্ষণে অবশ্য মোটামুটি সব দেখেই নিয়েছে। দোলগোবিন্দর অসুখ আর কমলাকান্তের মনখারাপের ব্যাপারটাও জানতে পেরে সেদিনই আজকের কাজটা ছকে ফেলেছিল।
মোক্ষদাবুড়িও ঘুমোচ্ছে। যদিও ঘুম পাতলা, তবে শব্দ না করে কীভাবে কাজ করতে হয় সে নোদোর জানা আছে। তাছাড়া পাগলা জগাইর নাক ডাকার আওয়াজ ছাপিয়ে মোক্ষদাবুড়ি অন্য কিছু শুনতে পাবে না।
নোদো দক্ষিণের ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল। যা ভেবেছিল, দরজায় তালা দেওয়া নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্য কেউ হলে কিছুই দেখতে পেত না। কিন্তু লোকে বলে অন্ধকারে নোদোর চোখ জ্বলে। তাই সে দেখতে পেল দরজা থেকে একটু দূরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে দোলগোবিন্দ। তার পাশেই চিৎপটাং হয়ে ঘুমোচ্ছে কমলাকান্ত। তাদের গায়ের গন্ধের সঙ্গে ঘরের মধ্যেকার নানারকম রাসায়নিক, বদ্ধ ঘরের ড্যাম্প মিলিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি গন্ধ নাকে আসছে। নোদোর অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না। চোখটা সয়ে এসেছে। ঘরের ভেতরটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। দেওয়ালের তাকে সারি দিয়ে সাজানো শিশিবোতলে রংবেরঙের তরল, এক জায়গায় বড়ো বড়ো কাচের বয়ামে নানারকম গাছপালা আর পতঙ্গের নমুনা কিছু তরল দ্রবণে ডোবানো রয়েছে। টেবিলে হরেকরকম যন্ত্রপাতি। একপাশের টেবিলে একটা আদ্দিকালের কম্পিউটার। নাহ্, এগুলো নিয়ে নোদোর কোনো আগ্রহ নেই। পাগলা জগাইর গবেষণা নিয়ে সে কী করবে? সেদিন হাটের মধ্যে একটা লোক তাকে ধরেছিল। জোরজার করে পোড়ো মন্দিরটার পেছনে নিয়ে গেছিল। নোদোর পেশাটা সে জানত। নোদো যদি পাগলা জগাইর খাতাপত্র আর কম্পিউটারে হার্ড ডিস্ক বলে কী একটা জিনিস আছে সেইটা খুলে আনতে পারে তাহলে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে বলেছিল। তক্ষুনি অ্যাডভান্স হিসেবে কুড়ি হাজার টাকাও ধরিয়ে দিচ্ছিল। নোদো সটান না করে দিয়েছে। এটা অবশ্য প্রথম নয়। এর আগেও জনা দুয়েক বাইরের লোক তাকে মোটা টাকা অফার করেছে পাগলা জগাইর খবরাখবর জোগাড় করে দেওয়ার জন্যে। নোদো কাউকেই পাত্তা দেয়নি। জগাই তাদের গ্রামের গর্ব, সে পাগলা হোক আর যাই হোক। তার গবেষণার কাজ সে বাইরের লোকেদের হাতে পাচার হতে দেবে না। তবে কিনা সে তো নোবেল প্রাইজের সঙ্গে প্রচুর টাকাপয়সা পেয়েছে। তার থেকে কিছুটা যদি নোদো নেয় তাতে ক্ষতি কী! এমনিও তো সে-টাকা জগাই খরচা করবে না।
নোদোকে বেশি খুঁজতে হল না। একটা টেবিলের ঠিক নীচে কালো লোহার বাক্সটা পেয়ে গেল সে। সেটা খুলতেই চোখ চড়কগাছ। লম্বায় চওড়ায় এক ফুট আর ইঞ্চি খানেক মোটা যে স্ল্যাবগুলো সাজানো রয়েছে সেগুলোর সোনালি রং চিনতে এই অন্ধকারেও নোদোর ভুল হল না। জগাই তাহলে সোনার পাত বানিয়ে রেখে দিয়েছে! অন্য কোনো চোর হলে হয়তো সবক’টাই নেওয়ার চেষ্টা করত। নোদো একটা পাত বের করে নিয়ে ঝোলায় পুরে বাক্সর ডালাটা বন্ধ করল। আপাতত এতেই হেসেখেলে অনেকদিন চলে যাবে।
ঠিক একইভাবে বাইরে বেরিয়ে নোদো কী ভেবে বাড়ির দিকে না গিয়ে উলটোদিকের রাস্তা ধরল। ওদিকে ওর ছোটোবেলার বন্ধু পচার বাড়ি। বাড়ির সঙ্গেই দোকান। ছেলেটা আজকে বায়না ধরেছে আইসক্রিম খাবে। এই রাত্তির তিনটের সময় আর কোন দোকান খোলা থাকবে! কিন্তু পচা একা থাকে। চুরি করে ফেরার সময় অনেকদিনই নোদো ওকে ডেকে নানারকম জিনিস নিয়ে ফিরেছে। আজ একটা বড়ো আইসক্রিমের বার নিয়ে নিল। নোদোর বাড়ির অন্য অংশে দুই দাদা থাকে। দুজনেরই দুটো করে ছেলেমেয়ে। একজন পঞ্চায়েত অফিসে চাকরি করে, আরেকজন স্বাস্থকেন্দ্রে। নোদোর জন্যে ওরা নাকি সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। বড়দা বলছিল কোন এক ঠিকাদার ওর হাতে খাম ধরিয়ে দিতে দিতে বলেছে, ‘স্যার, আপনার ভাই নাকি চুরি করে?’ কী লজ্জা, কী লজ্জা! সে যাই হোক, নোদো ওর ভাইপো-ভাইজিগুলোকে খুব ভালোবাসে। ছেলের জন্যে কিছু নিলে ওদের জন্যেও না নিয়ে পারে না। পচা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া বরফের মতো কী একটা দিয়ে দিল।
“এটা আইস প্যাক। আইসক্রিমের সঙ্গে রাখ। গলতে দেরি হবে। কালকে ফেরত দিয়ে যাস।”
আইসক্রিম বাড়ির দিকে রওনা দিল নোদো। ফেরার পথে জগাইর বাড়িটা পড়ে। সে দূর থেকেই দেখতে পেল গেট খুলে একটা লম্বা লোক বেরিয়ে আসছে। তার কাঁধেও ব্যাগ। এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল। অন্ধকারে এতটা দূর থেকে চেনা সম্ভব নয়, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি থেকে নোদোর বুঝতে অসুবিধে হল না, এ সেই সাহেবটা, জগাই যাকে ফুলঝাড়ু নিয়ে তাড়া করেছিল। সেও যে নোদোর মতো একই উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকেছিল তাতে সন্দেহ নেই। নোদো বাড়ির দিকে না গিয়ে সাহেবের পিছু নিল। ও বুঝতে পারছিল সাহেবকে আটকানো দরকার। চোর চোর বলে চিৎকার করে দৌড় দিল। লোকটাও একবার পেছনে তাকিয়ে এক দৌড়ে তার গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিয়ে দিল। যাহ্, পাখি তাহলে উড়ে গেল! কিন্তু নোদো ছুটতে ছুটতে অনুভব করল তার ঝোলাটা কেমন হালকা হয়ে গেছে। কোনো ওজন নেই। যেন গ্যাস বেলুনের মতো হাওয়ায় ভাসছে। আর তার পাদুটোও আর মাটিতে নেই। সে উড়ে গিয়ে পড়ল সাহেবের গাড়ির ওপর। আর ঘাবড়ে যাওয়া সাহেবের গাড়িটা সোজা ধাক্কা লাগল একটা অশ্বত্থগাছে। ছিটকে পড়তে পড়তে নোদোর ঝোলা থেকে আইসক্রিমের বারটা খুলে মাটিতে ছড়িয়ে গেল আর সোনার পাতটা উড়ে কোথায় চলে গেল। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে নোদো দেখল সেটা আর সোনা নেই। পাতটা কেমন যেন স্বচ্ছ, কাচের মতো হয়ে গেছে।
যখন জ্ঞান ফিরল, নোদো দেখল সে জগাইর দাওয়ায় শুয়ে আছে। মাথার কাছে মোক্ষদাবুড়ি বসে মুখে জল দিচ্ছে আর হাওয়া করছে। তার হাতটা ধরে বসে আছে তারক ডাক্তার। পাশে জগাই উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছে। নোদোকে চোখ মেলতে দেখে তার মুখে হাসি ফুটল। হৈ হৈ করে অনেকজনের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। তাকিয়ে দেখল, প্রায় গোটা গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে। তার বৌ আর ছেলেও রয়েছে। ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল নোদোর বুকে।
তারক ডাক্তার বলল, “আর কোনো চিন্তা নেই। হাতে-পায়ে সামান্য চোট লেগেছে। এবার গিয়ে বিশ্রাম নে।”
জগাই বলল, “আজ আর বাড়ি যেতে হবে না। তুই, তোর বৌ, ছেলে আজ আমাদের এখানে খাবি। তোর ভাইপো-ভাইজিগুলোকেও ডেকে নে। পিসি, আজ জমিয়ে মাংস-ভাত করো তো।”
নোদো খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বলল, “সাহেবের কী হল?”
“সে মিনসে মরেনি। পুলিস তাকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে। জগার অঙ্ক-খাতাগুলো আর কম্পিউটার থেকে একটা জিনিস নিয়ে পালাচ্ছিল।” বলল মোক্ষদাপিসি।
“আর সোনার পাতটা?”
জগাই হাতে তুলে দেখাল, দিনের আলোয় সোনা একদম ঝকঝক করছে। “এটা উড়ে গিয়ে ভটচাযদের বাগানে পড়েছিল।”
মাংস-ভাত খেয়ে সবাই জগাইয়ের ঘরে বসেছে। ন্যাপলা আর তার বন্ধুরাও এসে গেছে। সবার হাতে আইসক্রিম। জগাই বলল, “নোদো যেগুলোকে সোনা ভেবেছিল সেগুলো আসলে ডার্ক এনার্জি দিয়ে তৈরি। মহাকাশে যে ডার্ক এনার্জি আছে তার রহস্য আমি আগেই ভেদ করে ফেলেছি। সাধারণ তাপমাত্রায় সেগুলো অন্যান্য পদার্থের মতোই। কিন্তু শূন্য ডিগ্রি কেলভিন মানে মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি তাপমাত্রার কাছাকাছি ওই পদার্থগুলোর মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা যায়, যাকে ফেজ ট্রানজিশন বলে। আর ওই তাপমাত্রাটাকে বলে সংকট তাপমাত্রা। ফেজ ট্রানজিশন কী জানিস?”
পঞ্চা বলল, “জল ১০০ ডিগ্রিতে ফোটে, শূন্য ডিগ্রিতে বরফ হয়ে যায়।”
“কারেক্ট। ওগুলোও একধরনের ফেজ ট্রানজিশন। তারপর ধর, একটা চুম্বককে যদি গরম করিস তাহলে একটা সময় সেটা আর চুম্বক থাকবে না। এটাও আরেকরকম ফেজ ট্রানজিশন। তো এই ডার্ক এনার্জির যখন ফেজ ট্রানজিশন হয় তখন তার মধ্যে অ্যান্টি গ্র্যাভিটি এফেক্ট তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, তখন এগুলো আর আলোর রাস্তায় বাধা দেয় না, মানে স্বচ্ছ হয়ে যায়। এই পাতগুলো অবশ্য আমি তৈরি করেছি। প্রাকৃতিক ডার্ক এনার্জির সঙ্গে তফাত হল এগুলোর সংকট তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তারপর এর তাপমাত্রা যত কমবে, অ্যান্টি গ্র্যাভিটি এফেক্টও তত বাড়বে। নোদো আইস প্যাক আর আইসক্রিমটা ঝোলায় রাখতেই ওগুলো সংকট তাপমাত্রার নীচে চলে গেছিল। যদি আরো ঠান্ডা কিছু রাখত তাহলে ওকে সুদ্ধু আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যেত।”
নোদো এবার মুখ খুলল, “স্যার, আমি আপনার বাড়ি চুরি করতে ঢুকলাম আর আপনি আমাকে পুলিসে তো দিলেনই না, বরং বাড়িতে ঢেকে পেট পুরে খাওয়ালেন! আমার তো একটা শাস্তি পাওয়া উচিত।”
জগাই দাড়ির ফাঁক দিয়ে হেসে বলল, “উচিত তো বটেই। এখন থেকে তোর চুরি করতে বেরোনো বন্ধ। আমার তো বয়স হচ্ছে, একটা অ্যাসিস্ট্যান্টের দরকার। কাল থেকে তুই আমায় ল্যাবরেটরিতে সাহায্য করবি। এটাই তোর শাস্তি।”
অলঙ্করণ: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়