গল্প-গিরিগুহার কাপালিক- রাজীব রঞ্জন সরকার-বসন্ত ২০২১

মিঠুরা যখন দেবুদের বাড়ির নীচতলাটায় ভাড়াটিয়া হয়ে উঠে এল, তখন মিঠুর চার কি পাঁচ বছর বয়স। ভাই তুতুন তখনো জন্মায়নি। মিঠুর বাবা জগৎমোহন মিত্রের বদলির চাকুরি। এর আগে রানাঘাট না কোথায় একটা ছিলেন। কিন্তু সেখানে মিঠুর মন টিকত না। সেখানে এ বাড়ির মতো না ছিল খেলার সাথী, না ছিল ঠাকমা। ঠাকমার কোলে চড়ে যে কী মজা, দেবুর ঠাকমার কোলে না চড়লে তা তার জানাই হত না। এ বাড়ির লোকজন মিঠুর মায়ের নাকি দূরসম্পর্কের আত্মীয়। সেই সম্পর্কের জেরে বাড়ির তিন কিশোরী তার পিসি। কিন্তু তারই বয়সী দেবু কী করে তার কাকু হতে পারে, এ সে ভেবে পায় না। হাতিবাগানের এই বাড়িটা মিঠুর কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। পুরোনো আমলের কড়িবরগা লাগানো ঘর। প্লাস্টার খসে যাওয়া মোটা মোটা দেয়াল। লম্বা ছাদ। চিলেকোঠা। ঘুলঘুলি ভর্তি চড়ুই। পুরোনো পুরোনো গন্ধ। বাড়ি ভর্তি খেলার সঙ্গী-সাথী। দেবু, রাণুপিসি ঝুমাপিসি, বুলাপিসি। চওড়া উঠোন। উঠোনে ক্রিকেট আর ডাংগুলি পিটিয়ে সে কী মজা!

এই বাড়িতে আসার বছর খানেক পরে তুতুনের জন্ম হয়। বাড়ির সবার ছোটো দেবু জন্মেছিল তাও বছর সাতেক আগে। এতদিন পর ছোট্ট এক অতিথি পেয়ে দুই পরিবারের লোকজনের সে কী আনন্দ! জ্যাঠাইমা এসে গায়ে তেল মাখিয়ে দেন তো, ঠাকমা এসে তার নাকে তেল ঘষে ঘষে নাক তুলে দেন। কে কোলে নেবে এই নিয়ে রাণু-ঝুমা-বুলার মধ্যে মারপিট লেগেই থাকে। এমনি করে তুতুন বছর পাঁচেকের হয়ে গেল। এই বয়সেই সে যেমনি বড়সড়, তেমনি সুন্দর গোলগাল হয়ে উঠেছে। প্যাকাটির মতো লিকলিকে দুই বোন ঝুমা আর বুলা তাকে আর কোলে করে হাঁটতে পারে না। তবু তাকে তাদের কোলে নেওয়া চাই। তুতুনও পিসিদের ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।

এদিকে মিঠু আর দেবুর দুষ্টুমি বেড়েই চলেছে। এই তো সেদিন বিকেলে তিন বোন মাটির কলসির ভাঙা টুকরো দিয়ে উঠোনে দাগ কেটে কিৎ-কিৎ খেলছিল। একজন কিৎ-কিৎ দিচ্ছিল আর বাকি দুজনের কোলে পালা করে চড়ে তুতুন পিসিদের সেই খেলা দেখছিল। এমন সময় স্কুল থেকে ফিরে দেবু নবাবের মতো রাজ্যের দখল নিতে এল। ঘোষণা করল, “দিদি, তোরা ছাদে গিয়ে খেল গে যা। আমরা এখন ডাংগুলি পেটাব।”

বড়দি জবাব দিলে, “আমরা আগে থেকে খেলছি। তাই এখন জায়গা ছাড়া যাবে না।”

মেজদি বলল, “তোরা ছাদে গিয়ে খেল গে দেবু।”

দেবু মুখ ভেঙিয়ে বললে, “তোরা ছাদে গিয়ে খেল গে দেবু! কী বুদ্ধি তোর মেজদি! ছাদে ডাংগুলি খেলা যায় বুঝি?”

বুলার কোল থেকে তুতুন বলে উঠল, “তোমলা যাও।”

মিঠু বললে, “এই পিসির চ্যালা, চুপ কর।”

দেবু জায়গার দখল নিতে কিৎ-কিৎ খেলার দাগগুলো পা দিয়ে মুছে দিতে লাগল। রাণুদি তখন কাঠ-মল্লিকার ডাল ভেঙে তাদের পিছনে যেই না তাড়া করলে, অমনি দেবু আর মিঠু দে দৌড়। তারা এক দৌড়ে ছাদে উঠে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে লুকিয়ে পড়ল। সেখানে বসে দুটিতে ফন্দি আঁটতে লাগল কী করে দিদিদের জব্দ করা যায়।

হঠাৎ দেবুর মাথায় এক ফন্দি এল। সে চিলেকোঠা ছেড়ে বেরিয়ে এল, পিছন পিছন মিঠু। তারা এক বালতি জল নিয়ে ছাদে লুকিয়ে রইল। তারপর সুযোগ বুঝে উপর থেকে কিৎ-কিৎ খেলার জায়গাটার উপর জল ঢেলে দিল। ঝুমা তখন কিৎ-কিৎ দিচ্ছিল। এক পা দিয়ে কিৎ-কিৎ দিতে দিতে যেই না জলের উপর পা, অমনি চিৎপটাং। পিসির পড়ে যাওয়া দেখে তুতুনের সে কী হাসি! সেদিন তিন বোন মিলে সারা বিকেল দুটিকে তাড়া করে বেড়ালে। কিন্তু দেবু আর মিঠুকে ধরে কার সাধ্য!

চৈত্রমাস। চাঁদি ফাটা রোদে মাঠঘাট সব ফুটিফাটা হয়ে গেছে। দেবুদের পরীক্ষা শেষ। তাদের একটাই কাজ, রেজাল্ট বেরনোর অপেক্ষায় বাড়ি বসে থেকে দুষ্টুমি করা। তারই মাঝে এদিক সেদিক থেকে চড়কপুজোর সন্ন্যাসীদের ঢাক-কাঁসরের শব্দ ভেসে আসছে। উঠোনের ও-পাশে ডালিমগাছের ঝোপে একটা ঘুঘুর বাসা হয়েছে। দর্জিপাড়ার ছোঁড়াগুলোর নজর ওই বাসার দিকে। তাদের ধান্দা, বাচ্চা হলে সেই বাচ্চা নিয়ে গিয়ে তারা পুষবে। ঠাকমা বলে, তুতুন যেমন আমাদের আদরের, পাখির ছানাও তার মায়ের কাছে তেমনি। দেবু আর মিঠু তাই শপথ নিয়েছে, ঘুঘুর ছানাগুলোকে কিছুতেই তাদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা হতে দেবে না। তাই দুপুর-রোদে পালা করে তারা বাচ্চা পাহারা দেয়। ওদিকে দত্তবাড়ির আমবাগানে আমের গুটিগুলো বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে। তাদের একটা সদগতি করতে হবে। দত্ত-বুড়ো বাগানের পাঁচিলটা ভারি উঁচু করেছে। সে করুক। ওতে বুড়ো ওদের আটকাতে পারবে না। কিন্তু গাছে চড়ার পর বুড়ো চলে এলে বিপদ। এর থেকে বরং একটা বাঁশের লগি হলে বেশ হয়।

সেদিন ভরদুপুরে বাড়ির সবাই খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করছে। সুযোগ বুঝে দেবু আর মিঠু দে ছুট। চড়কতলায় গিয়ে তারা দেখে আশেপাশে কেউ নেই। প্যান্ডেল করার বাঁশগুলো মণ্ডপের সামনে পড়ে। দেবু একখানা সরুমতো বাঁশ হাতে তুলে নিয়ে বললে, “বাবা ভোলানাথ, আম পাড়ার লগি বানাব। এই বাঁশখানা আমাদের দাও।”

ভোলানাথ নিরুত্তর।

সে বাঁশ নিয়ে হাঁটা লাগালে। মিঠু বলল, “বাঁশ রাখ। বাবা কি তোকে নিতে বলেছে? না বলে নিচ্ছিস! যদি পাপ দেয়?”

দেবু মুচকি হেসে উত্তর দিলে, “চুপ করে থাকা সম্মতির লক্ষণ বৎস। দেবার ইচ্ছে না থাকলে ভোলে বাবা না বলে দিত। তা কি বলেছে?”

মিঠু বলল, “বাবা হ্যাঁ না কিছুই বলেনি।”

“তবে? বাবা চুপ থেকে নেবার সম্মতি জানিয়েছে।”

বাড়ি ফিরে আরেক হাঙ্গামা—বাঁশ কোথায় পেলি? ঠাকমা তাও শিবের গল্পটা বিশ্বাস করল। কিন্তু বাকি কেউ আর বিশ্বাস করতে চাইল না। ঝুমাদি সবথেকে বেশি হম্বিতম্বি করতে লাগল। দেবু বেশ বুঝতে পারল, সেদিন কিৎ-কিৎ খেলতে খেলতে পড়ে যাওয়ার অপমানটা মেজদি এখনো ভুলতে পারেনি। সে ভাইকে এক চড় কষিয়ে বললে, “কারো কাছ থেকে কিছু না বলে নিয়ে আসাকে চুরি বলে বাঁদর!”

দেবু গাল ডলতে ডলতে বিড়বিড় করে বললে, “দত্তবাগানের কাঁচামিঠে আমের ভাগ যদি তোকে দেই তো আমি দেবু বোস নই।”

ঝুমার হাতে দেবুর মার খাওয়া দেখে মিঠু বেশ মজা পেল। একগাল হেসে বললে, “আমরা তো না বলে চেয়ে এনেছি মেজপিসি।”

ঘর থেকে জগৎমোহনবাবু গর্জন করে উঠলেন, “চুপরাও! সারাদিন রোদে টো টো। এদিকে এসো, তোমার কান ছিঁড়ে নেব।”

জগৎমোহনবাবু মিঠুদের কান অবশ্য ছিঁড়ে নেননি। তার বদলে তাদের জন্য নন্টে ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা, গিরিগুহা রহস্য, বাক্স রহস্য মিলিয়ে খান-দশেক বই এনে ফতোয়া জারি করলেন, “চৈত্রমাসের রোদে আর বেরনো যাবে না। ঘরে বসে চুপচাপ বই পড়তে হবে।”

বই পেয়ে উপর-নীচের বাচ্চাগুলো তো ভীষণ খুশি। বই নিয়ে তাদের সকাল বিকেল কাটতে লাগল। বই দখলের বেলায়ও দেবু আর মিঠু সবার আগে। তাদের পড়া শেষ হলে তবে অন্যরা পড়তে পাবে।

সেদিন চিলেকোঠায় বসে দেবু বাক্স রহস্য পড়ছিল আর মিঠু বসে বসে সেদিনের আনা বাঁশখানা চেঁছে লগি তৈরি করছিল। এমন সময় আচারের শিশিটা রোদে রেখে ঠাকমা মুচকি হেসে বললেন, “দু-একটুকরো তোমরা খেলে খাও। কিন্তু খবরদার কাকে যেন মুখ না দেয়।”

ফলে কাজের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখ চলতে লাগল। বাঘের কাছে ছাগল পাহারা দিতে রেখে গেলে যা হয় আর কী!

হঠাৎ ঢাক আর কাঁসর বাজার শব্দ শুনে তারা চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এল। দেখল, চড়কপুজোর সন্ন্যাসীরা গেরুয়া ধুতি, পাঞ্জাবি, পাগড়ি পরে হরি ঘোষ স্ট্রিট ধরে তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে দর্জিপাড়ার সেই চিমসে লোকটা আছে, যে কিনা দত্ত-বুড়োর আমবাগান পাহারা দেয়।

দেবু বললে, “আগের বছর আম চুরি করতে গিয়ে হনুমানটার হাতে কী তাড়া খেয়েছিলাম মনে আছে?”

মিঠু বললে, “সে আর বলতে। এক হপ্তা ঠিকঠাক স্কুল যেতে পারিনি। দেখলেই তাড়া করত।”

“লগিটা দে তো মিঠু, মজা দেখাচ্ছি।”

দেবু মিঠুর হাত থেকে লগি নিয়ে হ্যাঁচকা টানে লোকটার পাগড়ি উপড়ে নিয়ে বললে, “এই তোমার পাগড়ি বাক্সবন্দি করলুম।” বলে ছাদের উপর লগি ফেলে একছুটে চিলেকোঠার ঘরে।

লোকটা ভিড়ের গুঁতোয় কিছু বুঝে উঠতে পারলে না। সে বোকার মতো উপরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

পরদিন দুপুরে বুলা মায়ের চাল ঝেড়ে দিচ্ছিল আর তার পাশে বসে তুতুন খেলা করছিল। আজকাল সেও দাদার মতো দুষ্টু হয়ে উঠেছে। চালের উপর এই গড়িয়ে পড়ে তো, পরমুহূর্তে চালের উপর পিছল খায়।

বুলা বললে, “মেজদি, তুতুনটাকে নে তো।”

ঝুমা বললে, “এদিকে আয় তুতুন।”

তুতুন বললে, “যাব না। আমি ছোটো পিসির সঙ্গে খেলব।”

তুতুনকে বাগে আনার মন্ত্র ঝুমার ভালোই জানা আছে। গল্প শোনার কথা বললে সে উড়ে আসে। ঝুমা বললে, “আমার কাছে আয়, তোকে গল্প শোনাব।”

তুতুন ছুটে এসে বললে, “সেই গল্পটা আবার বলো মেজপিসি।”

“কোনটা?”

“সেই কাপালিকের গল্পটা।”

তুতুনের এই এক দোষ। এক গল্প সে বার বার শুনতে চায়। ‘গিরিগুহা রহস্য’ গল্পটা সে ঝুমাপিসির কাছে যে কতবার শুনেছে তার ঠিকঠিকানা নেই। শুনতে শুনতে গল্পটা তার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। আর শুনতে বসলে একশো-দেড়শো পাতার বই গোটাটা তাকে পড়ে শোনাতে হয়। চালাকি করে এক-দু’পাতা বাদ দিলে সে টের পেয়ে যায়।

ঝুমা বললে, “এক গল্প কতবার শুনবি তুতুন? তোকে বরং নন্টে ফন্টের গল্প শোনাই।”

“না। আমার কাপালিকের গল্পটাই চাই।”

“হবে না, যা।”

“আমি তবে ছোটো পিসির সঙ্গে খেলব।”

অগত্যা ঝুমাকে ‘গিরিগুহা রহস্য’ বইটা খুলে বসতে হল। ঝুমা পড়ে চলেছে আর তুতুন একমনে গল্প গিলছে। জমিদারবাড়ি, পাশের জঙ্গল, কাপালিকের কালীমন্দির, শ্মশান এসবের মধ্যে যেন তুতুন একাত্ম হয়ে যেতে লাগল।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। কিন্তু গল্প শেষ হল না। ক্রমে সন্ধে নামল। দেবু আর মিঠু ফুটবল খেলে বাড়ি ঢুকে দেখল ঠাকমা, জগৎমোহনবাবু, তাঁর স্ত্রী সবাই রকে বসে গল্প করছেন। ভীষণ গরম। এক ফোঁটা বাতাস নেই। তার মধ্যে কারেন্টও নেই। গরমে ঠাকমা চুলগুলো মাথার উপর ঝুঁটি বেঁধে রেখেছে। তারা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে শুনল, মেজদি তুতুনকে গল্পের শেষটা পড়ে শোনাচ্ছে। মুহূর্তে দেবুর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে ফুটবলটা চিলেকোঠার ঘরে ঠেলে দিয়ে মেজদিকে গিয়ে বলল, “তুতুনকে নীচে ডাকছে।”

তারপর নীচে নেমে ঠাকমাকে গিয়ে বলল, “মেজদি তোমায় ডাকছে ঠাকমা।” বলে তাঁর গায়ে সেই গেরুয়া পাগড়িটা পেঁচিয়ে দিল।

ঠাকমা সিঁড়ি ভেঙে উঠছেন আর বলছেন, “ঝুমা, ও ঝুমা!”

ঝুমা অন্ধকারে তুতুনকে কোলে করে নীচে নামাতে যাবার সময় সিঁড়ির মুখে, এমন সময় তুতুন চেঁচিয়ে উঠল, “পিসি, ওই দেখো গিরিগুহার কাপালিক!”

ঝুমা দেখে, সত্যিই তাই। সিঁড়ির মুখ অন্ধকার হলেও সে স্পষ্ট দেখতে পেল, কাপালিকের গায়ে গেরুয়া বসন, মাথায় ঝুঁটি, আর পিছন থেকে কারা যেন বলছে, “ভোম ভোলে! ভোম ভোলে!”

ঝুমা ‘বাবা গো, মা গো’ বলে সেখানে এলিয়ে পড়ল। আর পড়বি তো পড় কাপালিকের পায়ের গোড়ায়। সে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর যখন জ্ঞান ফিরল, ঝুমা দেখল, সে কাপালিকের কোলে শুয়ে। আর সেই কাপালিক অন্য কেউ নয়, তার ঠাকমা স্বয়ং।

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s