এই লেখকের আগের গল্প- সেই রাত
বসার ঘরের চৌকিতে বসে দুলে দুলে নামতা পড়ছিল সন্তু। কাল থেকে কিছুতেই উনিশের ঘরের নামতাটা মুখস্থ হচ্ছে না। মান্তুর বেশ মজা। সকাল-সন্ধে স্লেটে একটু অ আ, এ বি সি ডি লেখা আর দু-একটা ছড়া বললেই পড়া শেষ। এখন কী সুন্দর ঘরের মেঝেতে বসে দিব্যি পুতুল খেলছে। এই সময় কি কারও পড়াশুনো করতে ইচ্ছা করে! বুবাই, ঝন্টু, ছোটুরা সবাই রেলের মাঠে ফুটবল খেলছে। সন্তুকেই শুধু ঘরে বসে নামতা মুখস্থ করতে হচ্ছে।
এইসব কথা ভাবতেই মনটা হঠাৎ কেমন যেন করে ওঠে সন্তুর। পাশের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে চোখ চলে যায়। ভেন্তি ওর দাদার সাইকেলটা নিয়ে সামনের রাস্তায় দিব্যি চালাচ্ছে। এই তো দু-দিন আগেও খিচির খিচির করে হাফ প্যাডেল করছিল। ভেন্তি মেয়ে হয়ে সাইকেল চালানো শিখে গেল, অথচ সন্তু এখনও শিখতে পারল না। সাইকেল শেখার কথা বললেই মায়ের কড়া হুকুম, আগে ক্লাস ফাইভে ওঠো, তারপর শিখবে। পাশের বাড়ির জেনি পাঁচিলে বসে আয়েশ করে রোদ পোহাচ্ছে। মনখারাপ হয়ে যায় সন্তুর। জেনিটাও সন্তুর থেকে ভালো আছে, ওকেও এই অসময়ে বসে বসে নামতা মুখস্থ করতে হয় না। পড়তে পড়তে কখন যে থেমে গিয়েছিল নিজেও বুঝতে পারেনি সন্তু।
“দু-দিন ধরে নামতাটুকু মুখস্থ করতে পারছে না, আর পড়া বন্ধ করে বাইরে তাকিয়ে থাকা হচ্ছে? আজ চোদ্দ থেকে কুড়ির ঘর নামতা মুখস্থ করে ঠিকঠাক লিখে দেখাবি, তারপর খেতে পাবি।”
পিঠে গুম করে একটা কিল আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চিৎকারে হুঁশ ফেরে সন্তুর। সেই কোন সকালে চাউমিন খেয়েছে। রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজার গন্ধ আসছে। এখনই পেটের মধ্যে খিদেটা যেন ঝোড়ো হাওয়ার মতো শনশন করে ওঠে। সন্তু কী যেন বলতে যাচ্ছিল মাকে। কিন্তু মায়ের রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোঁক গিলেই থেমে যায় সন্তু। কাল বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় কেক এনেছিল, মান্তু বাটি করে নিয়ে কেক খাচ্ছে। হঠাৎ কান্না পেয়ে যায় সন্তুর। মা ওকে একটুও ভালোবাসে না। একদিন ইস্কুল থেকে ফেরার সময় ইচ্ছা করে হারিয়ে যাবে সন্তু। আর বাড়িতে ফিরবে না। যেখানে খুশি, যেমন খুশি ঘুরে ঘুরে বেড়াবে, যা খুশি খাবে। তখন তো আর মা ওকে পড়ার জন্য বকতেও পারবে না, মারতেও পারবে না। হাজার কাঁদলেও তখন আর খুঁজেই পাবে না সন্তুকে।
মা রান্নাঘরে কাজ করছে, মান্তুও খেলা ফেলে কোথায় উঠে গেছে; নামতার বইটা বন্ধ করে আনমনে জানালার শিক ধরে বাইরে তাকায় সন্তু। নামতা মুখস্থ করে না লিখতে পারলে তো খেতে দেবে না। সন্তু সারাদিন না খেয়েই থাকবে। ওর পড়তে একদম ভালো লাগছে না। আশুকাকুদের বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তাটা গিয়ে মিশেছে বড়ো রাস্তায়। রাস্তার ও-পারেই রেলের মাঠ। শীতের রোদ গায়ে মেখে খেলা করছে ছেলের দল। সন্তুর বন্ধুরাও আছে ওখানে। সন্তুর এখন যেন খেলতে যেতেও ইচ্ছা করছে না। তার থেকে একজন পাখিওয়ালা খাঁচায় কতগুলো পাখি নিয়ে ওদের গলি দিয়ে যাচ্ছে, ওই লোকটার মতো হতে ইচ্ছা করছে সন্তুর। হঠাৎ জানালা দিয়ে গায়ে কী একটা এসে পড়তেই চমকে ওঠে সন্তু। ওমা, এটা তো একটা পাখির পালক! কী সুন্দর দেখতে! এমন সোনালি পাখির পালক আগে কখনও দেখেনি সন্তু। পালকটা যত্ন করে বইয়ের মধ্যে ভরে রাখতে গিয়ে ও চমকে ওঠে। কোথায় বইখাতা আর কোথায় ও! এখনই তো ঘরের মধ্যে ছিল, বাইরে এল কী করে! নিজের দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে সন্তু। নীল সবুজ ডোরাকাটা লুঙ্গি আর একটা লাল গেঞ্জি কখন পড়ল সে! পরমুহূর্তেই মনে পড়ে, একটু আগে জানালা দিয়ে যে পাখিওয়ালাটাকে দেখছিল, সে তো ঠিক এইরকম পোশাক পরেছিল। তখনই দেখে ওর পাশেও তিনখানা পাখির খাঁচা নামানো আছে। তাতে বেশ কতগুলো ছোটো ছোটো রঙবেরঙের পাখি কিচিরমিচির করছে। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই গোলাপি দোতলা বাড়ির মণ্ডলকাকিমা দোতলার বারান্দা থেকে হাঁক দেয়, “ও পাখিওয়ালা, তোমার কাছে বদরী পাখি আছে গো?”
সন্তু কি আর বদরী পাখি চেনে! সে বোকার মতো মুখ করে বলে, “কোনটা বদরী পাখি গো মণ্ডলকাকিমা?”
“এই, কে তোমার কাকিমা! যাও, পাখি নেব না।”
বারান্দা থেকে ঘরে চলে যায় মণ্ডলকাকিমা। অবাক হয় সন্তু। মণ্ডলকাকিমাকে তো সেই ছোটো থেকে কাকিমাই বলে, আজ হঠাৎ কী হল কাকিমার!
দুলুদাদা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সাইকেল থামিয়ে একটা খাঁচার দিকে আঙুল তুলে জানতে চায়, “ওই পাখি দুটোর দাম কত?”
সন্তু এক মুখ হেসে দুলুদার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দুলুদা মনে হল ওকে চিনতেই পারছে না। ওর সঙ্গে কথা তো বললই না, উপরন্তু পাখির দাম বলতে না পারায় রাগে গজগজ করতে করতে সাইকেল নিয়ে চলে গেল।
মনটা খারাপ হয়ে যায় সন্তুর। কেউ ওকে চিনতে পারছে না কেন! আর ও এমন পাখি নিয়ে রাস্তাতেই-বা এল কী করে! রাস্তায় দাঁড় করানো একটা মোটর সাইকেলের আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে ওঠে সন্তু। নিজেকে দেখে তো নিজেকেই চিনতে পারছে না। মা-বাবা কেউ তো তার মানে ওকে চিনতেই পারবে না। কী হবে তাহলে! একটু আগে তো ও পাখিওয়ালাই হতে চাইলাম। কিন্তু এখন তো পাখিওয়ালা হয়ে বেশি মনখারাপ করছে। জেনিই সবথেকে ভালো আছে। পড়াশুনোর চাপ নেই, বকুনি নেই। সারাদিন দিব্যি বাড়ির সবার কোলে চেপে আদর খাচ্ছে, নয়তো গোল হয়ে শুয়ে আছে আর লেজ নাড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। এ কি, ঝড় উঠল নাকি! কিছু একটা গায়ে পড়তেই চমকে ওঠে সন্তু। আরে, এটা তো সেই সোনালি পাখির পালকটা! ভাবতে-ভাবতেই সন্তু ঠিক জেনির মতোই একটা সাদা বিড়াল হয়ে যায়। বিড়াল হয়ে কী করবে এবার? সবে একটু হরনাথকাকুদের বাড়ির রোয়াকটাতে শুয়ে চোখ বন্ধ করেছে, এমনি একটা দুষ্টু ছেলে এসে ভীষণ জোরে ওর কানটা টেনে ধরে। উফ্, কী লাগছে! ব্যথায় ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। এর থেকে ও তো নিজের বাড়িতেই ভালো ছিল। ছেলেটার হাত থেকে নিজের কানটা ছাড়ানোর জন্য জোরে জোরে মাথা নাড়াতেই শুনতে পায় মায়ের গলা, “পড়া ফেলে ঘুমোচ্ছিস! মার খেয়েও তোর এতটুকু লজ্জা নেই! ও কি, তোকে নামতা মুখস্থ করতে বলে গেলাম আর ওটা কী বই খুলে রেখেছিস সামনে?”
মায়ের কানমলা আর চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেলেও ধাতস্থ হতে কিছুটা যেন সময় লাগে সন্তুর। কোথায় পাখিওয়ালা, কোথায় সাদা বিড়াল, কোথায়ই-বা সেই সোনালি পাখির পালক! জন্মদিনে ছোটোমামার দেওয়া গল্পের বইটা মা পড়তেই দেয় না। নামতা না পড়ে গল্পের বইটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল সন্তু। বইটা খোলা পড়ে আছে এখনও। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পের পাতাটা।
ছবি- রাহুল মজুমদার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
বাহ্ খুব সুন্দর
LikeLike