এই লেখকের আগের গল্প- দোসর, গল্পদাদুর আসর
আজ একটা মজার ঘটনা ঘটেছে তিতাসদের সোসাইটিতে। এক বুড়ি এসে নাকি একাই তিন-তিনজনের খাবার খেয়ে নিয়েছে, আর তাকে পেট ভরে খাওয়াতে গিয়ে ওদের সোসাইটির মালি-আঙ্কলদের তিনজনের কারোরই আজ আর কিছু খাওয়াই হয়নি। তাই নিয়ে দারোয়ান-আঙ্কল খুব মজা করছিলেন তাঁর বন্ধু ওই মালি-আঙ্কলদের সঙ্গে। খেলতে খেলতে ওরাও তাঁদের সেই সব ঠাট্টা-তামাশা শুনে ভারি মজা পাচ্ছিল।
শিশিরবাবু, মানে ওদের গল্পদাদু মাঠের চারদিকে এক চক্কর দিয়ে এসে গেটের কাছে ঘাসের ওপর বসতে না বসতেই ওরাও খেলা ফেলে এসে ঘিরে ধরল তাঁকে। শিশিরবাবু বললেন, “কী ব্যাপার দাদুভাইরা, আজ এত তাড়াতাড়ি খেলা থামিয়ে আসরে চলে এলে কেন?”
মিঠাই বলল, “ও দাদু, খুব রোদ উঠেছিল না আজ, তাই গরমে ঘেমে যাচ্ছি। পুরো এক বোতল জল খেয়ে ফেলেছি। আর দৌড়াদৌড়ি করতে পারছি না গো, একটু বসি।”
মনামি বলল, “না গো দাদু, আজ দারোয়ান-আঙ্কল তোমার কাছে কবে কী একটা নাকি গল্প শুনেছে বলছিল, সেটাই শুনবে বলে মিঠাই এইসব বানিয়ে বলছে। কে যেন এক পেনোর শাউড়ি এসেছিল নাকি আজ সোসাইটিতে।”
মিঠু, অয়ন, মেঘা একসঙ্গে বলে উঠল, “ও দাদু, বলো না, বলো না আজ সেই পেনোর শাউড়ির গল্পটা। তিতাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ও তো জানে না বলছে। বলো না দাদু, বলো না!”
শিশিরবাবু ওদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা বলছি। তবে পেনোর শাউড়ি নয়, পেনোর কাহিনি বলব। পেনোর মতো কেউ আশ্চর্যজনক কোনও কাজকারবার করলেই তার সঙ্গে তাঁর তুলনা করে হাসি-ঠাট্টা করা হয়। আসল কাহিনি শুনতে হলে তাই পেনোর কাহিনিই শুনতে হবে। কিন্তু তার আগে তোমরা মুখ-হাত-পা সব ধুয়ে এসো গেটের পাশে কলে গিয়ে। আর ফেরার সময় দারোয়ান-আঙ্কলকে বলে এসো, আমি ডেকেছি তাকে।”
সকলে আহ্লাদে হইহই করে দৌড়ল সোসাইটির গেট পানে। হাত-পা-মুখ সব ধুয়ে তারা ফেরার আগেই দেখে দারোয়ান-আঙ্কল নিজেই দাদুর কাছে এসে হাজির। ওরা ফিরতেই গ্লুকোজ জলের গ্লাস ধরালেন তিনি তাদের সকলের হাতে। খাওয়ার পর পাশেই রাখা ‘ইউজ মি’ বক্সে ডিসপোজেবল গ্লাসগুলো ফেলে সবাই এসে ঘিরে বসল তাদের গল্পদাদুকে।
শিশিরবাবু শুরু করলেন, “যার কথা শুনেছ তোমরা এই আঙ্কলের কাছে, সেই পেনোর আসল নামটা যে কী তা এখন আমারও আর মনে নেই। তবে এটা হলপ করে বলতে পারি, পেনো তাঁর পিতৃদত্ত নাম নয়, তিনি তো মস্ত পালোয়ান ছিলেন। খুব সম্ভবত পেনো নামটা পালোয়ান থেকে অপভ্রংশ হয়েই তৈরি হয়েছিল।”
তিতাস জিজ্ঞেস করল, “দাদা, তুমি তাঁকে দেখেছ?”
শিশিরবাবু বললেন, “দেখেছি বৈকি। তবে তিনি তখন বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর যুবক বয়সের নানান কাণ্ডকারখানা দেখেছেন আমার বাবা-কাকারা। সে এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর উচ্চতা ছিল প্রায় আট ফুট, ওজন দুশো কেজির থেকে সামান্য বেশি। পরনে কোঁচা মেরে ধুতি ছাড়া আর কিছু থাকত না। আমাদের সাধারণ মানুষের দু-হাতের থাবায় ধরে বেড় পাওয়া যেত না তাঁর বাহু। কিন্তু মানুষটা তিনি ছিলেন খুব সাধাসিধে আর বড্ড সরল। গ্রামের সব বাচ্চা-কাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন তিনি; তারা তাঁর হাত দুটোকে দোলনা বানিয়ে দোল খেত। কাঁধ ধরে ঝুলত, কিন্তু তিনি থাকতেন শান্ত, নিরুত্তাপ।
“ওহো, বলাই তো হয়নি দেখেছ! তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বর্ধমানের কাটোয়ার কাছাকাছি কাঁটার নামে এক গ্রামে। ওদিকে তখনও বনবাদাড় ছিল। এমনি সময়ে একবার বর্ধমানের মহারাজা খবর পেলেন সেদিকের এক গ্রামে বনের মধ্যে এক অদ্ভুত শিবলিঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেছে। মাটি খুঁড়ে যত নীচের দিকে যাওয়া যায়, সেই শিবলিঙ্গ নাকি ততই চওড়া হয়ে যায়! তো তাকেই দর্শনের জন্য মহারাজ সদলবলে স্বয়ং এলেন সেখানে। তখনও সেই অঞ্চলে জনবসতি বিশেষ ছিল না। মূলত বনের মধ্যে দিয়েই সেই শিবলিঙ্গের কাছে যেতে হত।
“সেখানেই মহরাজার সঙ্গে পেনো মানে ওই পালোয়ানের দেখা হয়। মহারাজের কাছে তাঁর আর্জি ছিল, তাঁর সবে-সাকুল্যে পৈতৃক পঞ্চাশ বিঘে জমিতে খেয়েই কুলায় না, তো তিনি খাজনা দেবেন কী করে? তাই তাঁর আবেদন ছিল, মহারাজ যদি তাঁর খাজনাটা মুকুব করে দেন। মহারাজ তাঁর আবেদন শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাড়িতে মোট কতজন সদস্য তোমার?’ পেনো উত্তরে বললেন, ‘মহারাজ, আমি একলা মানুষ। আমার নিজেরই খেয়ে কুলায় না, সংসার করে কী করব?’ মহারাজ অবাক হলেন।—‘একলা মানুষের পঞ্চাশ বিঘে জমিতে খেয়ে কুলায় না? কত ভাত খাও তুমি?’ পেনো বললেন, ‘সে মহারাজ ছোটো মুখে বড়ো কথা হয়ে যাবে, কিন্তু সত্যিই ওই জমির ফসলে আমার কুলায় না।’
“তোমরা নিশ্চয়ই জানো, তখন বছরে একবারই ফসল ফলত, মানে ধান চাষ হত শুধু বর্ষাকালে। বাকি বছরে টুকটাক আনাজপাতি ছাড়া আর কিছু ফলত না তখন জমিতে।
“মহারাজ বললেন, ‘তাই নাকি? ঠিক আছে, আজ তুমি আমার এখানেই খাও তাহলে। দেখি কত ভাত খাও তুমি যে তোমার পঞ্চাশ বিঘে জমির ধানেও কুলায় না।’
“মহারাজের নির্দেশে তাঁদের তাঁবুতে রান্না চাপানো হল। পেনো গিয়ে কাছেই নদী থেকে স্নান করে একটা গামলা ভর্তি করে খাওয়ার জল নিয়ে ফিরলেন। মহারাজ তাঁকেই সবার আগে খেতে বসতে ডাকলেন। পেনো এসে বললেন, ‘মহারাজ, পেটে কটা গিঁট দিয়ে বসব?’ মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, ‘পেটে গিঁট দিয়ে বসবে! সে আবার কী? কেন?’ পেনো উত্তর দিলেন, ‘মহারাজ, অপরাধ নেবেন না, কিন্তু আমি পুরো পেট ভরে খেতে গেলে তো আপনাদের খাবারই বাঁচবে না। আর আমার তো অত খাবার জোটেও না কোনোদিন, তাই পেটে কাপড় জড়িয়ে গিঁট বেঁধে রাখি, যাতে একটু কম খিদে পায়।’ মহারাজ ভারি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘না না, তার দরকার নেই, তুমি সব গিঁট খুলেই বসো, যতটা পারো পেট ভরেই খাও।’ পেনোও তখন রাজার কথামতো তাঁর পেটে বাঁধা কাপড়ের সব গিঁট খুলে খেতে বসলেন।
“তারপর কী হল জানো?”
সকলে জিজ্ঞেস করল, “কী হল দাদু? পেনো সব ভাত খেয়ে নিলেন?”
শিশিরবাবু বললেন, “শুধু সব ভাত নয়, পরের বার আবার যা রান্না হল তারও সব তিনি একাই খেয়ে ফেললেন। মহারাজ তো অবাক। আধ-মন চালের ভাত একবার খেতে বসে কেউ যে খেয়ে ফেলতে পারে তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তাই দেখে পেনো ভারি লজ্জা পেয়ে মহারাজের কাছে এসে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে বললেন, ‘মহারাজ, ক্ষমা করে দিন। আমি ওই জন্যই পেটে গিঁট দিয়ে খেতে বসি, আপনাকে বলেছিলাম না? আমার তো পেট ভরে খাওয়া হল, এখন আপনাদের খাওয়ার কী হবে? সব খাবারই তো শেষ! আপনি আজ্ঞা করলে আমি দৌড়ে গিয়ে গ্রাম থেকে কয় বস্তা চাল-ডাল-নুন আর এক টিন তেল নিয়ে আসি?’ মহারাজ আর কী বলবেন, তাঁর মুখে তখন রা-টি নেই। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। পেনো একবার দৌড়ে গিয়েই পাশের গ্রাম থেকে দু-বস্তা চাল, এক বস্তা করে ডাল আর নুন আর এক টিন সর্ষের তেল নিয়ে হাজির হলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। একখানা গোরুর গাড়ি লাগে যে জিনিস কয়টা আনতে, তিনি একাই নিয়ে হাজির! মহারাজ তাঁর কাজকারবার দেখে আরও একবার হতভম্ব হলেন। কিন্তু এটাও বুঝলেন যে লোকটা সরল মনের এক ভালো মানুষ আর তাঁর গায়ের জোরও অস্বাভাবিক।
“কাটোয়া থেকে বর্ধমান যাবার পথে নর্জা নামে এক জায়গায় বনের মধ্যে তখন একটা নদীর ঘাট পার হতে হত। আর সেই জায়গায় ছিল ডাকাতের উৎপাত। কেউ রেহাই পেত না তাদের হাত থেকে। লোকে বলত, পেরোলি তো নর্জনা/ নেয়ে ধুয়ে ঘর যা না।
“মানে নর্জা পার হয়ে গেলেই উদ্ধার হয়ে গেল মনে করত লোকে। সেই ডাকাতদের দল কাউকেই রেয়াত করত না, এমনকি তারা লুঠ করত স্বয়ং মহারাজের খাজনাও। তাই মহারাজ বিবেচনা করে দেখলেন, এই সুযোগ। এত বড়ো একজন পালোয়ান যখন হাতের কাছেই আছে, তখন একেই কাজে লাগাতে হবে। তাই তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমার সব জমি নিষ্কর ঘোষণা করলাম। আরও পঞ্চাশ বিঘে জমি তোমায় দিচ্ছি। কিন্তু তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। এই এলাকা থেকে আমার খাজনাটা পৌঁছে দিতে হবে কাছারিতে। পারবে?’ পেনো তো খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন, ‘যে আজ্ঞে মহারাজ, খুব পারব!’
“তারপর কী হল বলো দেখি।”
সকলে জিজ্ঞেস করল, “কী হল দাদু, ডাকাতগুলো ধরল পেনোকে?”
শিশিরবাবু জানালেন, “আরে সে তো আরও এক নাটকীয় ব্যাপার। পেনো তো একটা বড়ো থলেতে খাজনার সব টাকাকড়ি নিয়ে নর্জার সেই ঘাটে এসে হাজির হলেন। তখন দুপুর গড়িয়েছে, কিন্তু সেই ডাকাতদের কাউকেই আশেপাশে দেখতে পেলেন না। অগত্যা জলে নেমে আঁজলা ভরে জল খেয়ে যেই নদীর ওই পাড়ে উঠেছেন, একটা ফুট পাঁচেক লম্বা তেল চকচকে বাঁশের লাঠি এসে পড়ল তাঁর পায়ের কাছে। পেনো কোনও কথা না বলে ডাঙায় উঠে থলেটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সেটার পাশে বসে বললেন, ‘ওসব লুকোচুরি করে লাভ নেই বাছাধনেরা। তিন মাসের খাজনা আছে, বাপের ব্যাটা হলে বেরিয়ে আয়, এসে নিয়ে যা।’
“জনা বিশেক ডাকাতের সেই দল ভরদুপুরে তাদেরই ডেরায় এসে তাঁকে একা এইরকম চ্যালেঞ্জ ছুড়তে দেখে কি আর চুপ থাকতে পারে? রে রে করে তেড়ে এল তারা দল বেঁধে। পেনো তাঁর কাছে সব থেকে আগে যে পৌঁছল, তার দুটো পা একহাতে ধরে চাগিয়ে নিলেন এমন যেন মাটিতে দাঁড় করানো একটা খেলনা পুতুলকে তুলে নিলেন। তারপর তাকেই লাঠির মতো ব্যবহার করে বেধড়ক মারতে লাগলেন ডাকাতগুলোকে। কিছুক্ষণ পর তাকে মাটিতে ফেলে আরেকজনকে তুলে নিয়ে লাঠির মতো ব্যবহার করতে লাগলেন!
“মানে হল কী, ডাকাতদের দল লাঠি দিয়ে মারলেও সেই মারটাও পড়ছিল তাদেরই দলের লোকের গায়ে, পেনোর গায়ে নয়। ওদিকে পেনো তাদের দলের লোককে লাঠির মতো ব্যবহার করে তাকে দিয়েই তাদের পেটাচ্ছিলেন। বুঝতেই পারছ, আধঘণ্টার মধ্যে কুড়িখানা জাঁদরেল ডাকাতকে মেরে আধমরা করে ফেললেন তিনি। তারপর বুনো লতা পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে তাদের সবক’টাকে একসঙ্গে বোঝা বাঁধার মতো করে বেঁধে টানতে টানতে হাজির হলেন মহারাজার কাছারিতে।
“ওদিকে তাঁর আসতে দেরি দেখে সবাই হা-হুতাশ করছে তখন সেখানে—পালোয়ানকে বোধহয় মেরেই ফেলেছে ডাকাতের দল, সঙ্গে মহারাজের তিন মাসের খাজনাটাও গেল বুঝি! এমন সময় খাজনার থলে আর বিশ-বিশটা ডাকাতকে পিঠে বোঝাই করে বইতে বইতে পেনো এসে হাজির হলেন সেখানে। সবাই তো দেখে তাঁকে ধন্য ধন্য করল। কিন্তু পেনো মানুষটা ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি হাতজোড় করে মহারাজের কাছে মিনতি করলেন, ‘মহারাজ, এদের এখনই চিকিৎসা না করাতে পারলে একজনকেও আর বাঁচানো যাবে না। আমার হাতে মার খেয়ে ওদের আর হাড় ক’খানাও আস্ত নেই বোধহয়। ওদেরও ঘরসংসার আছে নিশ্চয়ই, ওরা না বাঁচলে তারা সব ভেসে যাবে যে। ডাকাতি করা তো আর এ জন্মে ওদের কর্ম নয়। এবার ওদের যা হোক করে বাঁচান।’
“মহারাজ যে তাঁর কাণ্ড দেখে খুশি এবং অবাক হয়েছিলেন সে তো বলাই বাহুল্য। তিনি পেনোর অনুরোধমতো ডাকাতগুলোর তাঁর রাজবৈদ্যকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। অবশ্য সেই ডাকাতদের আর ক’জন সত্যিই বেঁচে ছিল জানি না, কিন্তু নর্জার সেই ডাকাতির দুর্নাম ওই একদিনেই ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন ওই পালোয়ান।”
মেঘা বলল, “সত্যি গো দাদু, পেনো লোকটা কিন্তু খুউব ভালো ছিল।”
শিশিরবাবু বললেন, “বলেছিলাম না লোকটা খুব সাধাসিধে, সরল মনের মানুষ ছিলেন? হ্যাঁ, তাঁর খিদেটা একটু বেশি পেত এই যা, তাই না? হো হো হো… চলো এবার, সন্ধে হয়ে আসছে, ফিরতে হবে। কই হে বাহাদুর, নাও, এবার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও দেখি।”
সবাই মিলে হাসতে হাসতে সোসাইটির দিকে এগিয়ে গেল। দারোয়ান বাহাদুর এসে জলের বোতল, ট্রে আর সবশেষে ডাস্টবিনটা তুলে নিয়ে গেল সোসাইটির ভিতরে।