গল্প- বন্ধু-অনির্বাণ চৌধুরী -বসন্ত২০২৩

golpobondhu

মুকুন্দর পালা আসার আগে অবধি কিন্তু ব্যাপারটা বেশ মজাদারই ছিল। সে মোটেই ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সোজা হেডস্যারের চেম্বারে গিয়ে নালিশ। হেডস্যারও বেত হাতে একেবারে ক্লাস এইট-বি-র ঘরে। অমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ঋতম উঠে দাঁড়িয়ে, অকুতোভয় হয়ে কিছু একটা বলতে গেছিল। স্যার সে সুযোগই দিলেন না। মুকুন্দ ছাড়া ক্লাসের কোনও  ছেলে রেহাই পেল না সেদিন। সেসব দিনে স্কুলের ছাত্রদের রিফ্লেক্স ভালো থাকা অপরিহার্য ছিল। মাথা লক্ষ্য করে উড়ে আসা কাঠের ডাস্টার থেকে মাথা সরিয়ে নিতে হত ওপেনিং ব্যাটসম্যানের কায়দায়। বাউন্সারের সামনে ডাক করার মতো। কিংবা বেতটা পিঠ ছোঁয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পিঠের অ্যাঙ্গেলটা অল্প বদলে নেওয়া। খুব জরুরি ছিল এসব। প্রায় পড়াশোনার মতোই। এসব ট্রেড সিক্রেট। মাস্টারমশাইরা এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেননি কখনও। কাজেই মলয়, রতন, জয়দেবদের কাছে দু-চার ঘা বেত ব্যাপারটা খুব একটা নতুন কিছু ছিল না। সেই যে-বার সবার নামে মজাদার কবিতা লিখছে ঋতম আর সুর করে পড়ছে বাকিরা, সে-বারও মুকুন্দ নালিশ করেছিল অর্ক-স্যারকে। যথারীতি কবিতা পছন্দ হয়নি মুকুন্দর। সেই ক্লাস সেভেনের কবিতা আজও মনে আছে শুভ, মলয়, সুনীলদের।

মুকুন্দ মিত্র, প্রাণী সে বিচিত্র

এমনটি পাবে না হে খুঁজিয়া ধরিত্র।

উত্তম পাত্র সে, ছাত্র না মন্দ

নালিশের পথ তার দারুণ পছন্দ।

এইবেলা চুপি চুপি সাবধান করি ভাই,

পাঁজরের হাড় ক’টা যদি আজ গোটা চাই,

কবিতা পড়ার ভুল কোরো নাকো মিত্র,

নচেৎ বেতেতে পিঠে বহু রঙ চিত্র।

অর্ক-স্যার মেরেওছিলেন খুব। কিন্তু কবির নামটা বার করতে পারেননি কারও মুখ থেকে। ঋতমকে আড়ালে থাকার প্রমিস করিয়ে নিয়েছিল অন্যরা। তাই মুখ বন্ধ ছিল তারও। প্রায় সবার নামেই লেখা হয়েছিল কবিতা। কেউই কিন্তু রাগ-টাগ করেনি। শুধু ওই মুকুন্দকেই নিয়েই যা ঝামেলা। দুটো অরিন্দম ছিল ওদের ক্লাসে। অরিন্দম রাণার নামে একটা মারাত্মক লাইন ছিল। কিছু তো বলেইনি সে, উলটে হেসেছিল খুব। লাইনটা সবার মুখে মুখে ঘুরেছিল অনেকদিন।

শত্রু এলে দরজা ঠেলে মুখ লুকালে রাণা,

অরিন্দমের বন্ধু দমন সবার আছে জানা।

এবার ঋতমের পিঠে বেত পড়াটা মেনে নিতে পারছিল না কেউই। সেটা কিন্তু ঋতম শুধু লেখাপড়ায় ভালো বলে নয়। অমন ভালো ছেলে সব সেকশনেই দু-একজন করে ফার্স্ট বেঞ্চ আলো করে বসে থাকে। ড্যাবড্যাবে চোখে পড়া গেলে। মাস্টারমশাইদের সবকথায় ‘হ্যাঁ স্যার’, ‘হ্যাঁ স্যার’ করে। আর টপাটপ উঠে দাঁড়িয়ে পাতার পর পাতা মুখস্থ বলে চলে।

ঋতম কিন্তু ঠিক তেমনটা ছিল না। ওর ভালোটা ছিল অন্যরকম। কেউ স্কুলে যেতে না পারলে ঋতম স্কুলের পর সাইকেল করে তার বাড়ি গিয়ে সব খাতা তাকে দিয়ে আসত। আবার তার লেখা হয়ে গেলে রাতে ফেরত নিয়ে আসত। ছোট্ট শহরতলি। প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি সব বাড়ি। বিপ্লব সারা বছর ভুগত। সর্দিকাশি, জ্বর। বেশিরভাগ দিন বিপ্লবের বাড়ি হয়ে স্কুল থেকে ফেরাটা ছিল ঋতমের রুটিন। একবার গেমস পিরিয়ডে কবাডি খেলতে গিয়ে পা মচকে গেল সুকান্তর। পিটি-স্যারের সঙ্গে রিকশা করে সুকান্তকে নিয়ে ডাক্তারকাকুর কাছে ছুটল ঋতম। আর-একবার খুব ঝড়ে ঘুঘুর বাচ্চাটা গাছ থেকে গেল পড়ে। অন্য সবাই যখন আম কুড়োতে ব্যস্ত, ঋতম চুপিচুপি গাছে উঠে বাচ্চাটাকে মার কাছে ফেরত দিয়ে এসেছিল। এসব কথার ফর্দ বানালে সে এক মহাভারত হবে।

আসল কথাটাই কিন্তু বলা হয়নি এখনও। সে-বার নতুন মজা চাগাড় দিল ঋতমের মাথায়। সব বন্ধুদের নাম ও পদবির আদ্যক্ষর বদলে দেওয়ার খেলা। যেমন অরিন্দম দাস হল দরিন্দম আস। উজ্জ্বল সরকার হল সজ্জ্বল উরকার—এইরকম আর কী। এভাবে যখন মুকুন্দর নাম এল তখন এই নিয়মে সে হয়ে গেল মিকুন্দ মুত্র। ব্যস, সোজা নালিশ। নালিশে তার দক্ষতা ও সুনাম দুইই ছিল। এর থেকে বরং গুরুতর ঝামেলায় পড়েছিল মলয়। তার নাম পালটে হয়ে গেছিল পালয় মল। ছেলেরা খেপিয়েওছিল খুব। মলয় মজাদার ছেলে। নালিশেও দড় নয় মোটে। সেদিন মাস্টারমশাইদের কান পর্যন্ত পৌঁছয়নি কথাটা।

ক্লাসে কয়েকজন ছিল গুগলি এক্সপার্ট। একটু ঠান্ডা শান্ত স্যারেদের ক্লাসে এই গুগলি দেওয়াটা প্রায় জলভাতের পর্যায়ে এনে ফেলেছিল তারা। সুনীল ছিল এই দলের পান্ডা। আরও দু-চারজনকে তালিম দিয়ে নিয়েছিল। হাওয়াতে বলটা আলতো করে ভাসিয়ে দেওয়ার কায়দায় সামনে বসা কোনও ছেলের কান বা চুল ধরে দিত মোক্ষম টান। স্যারের চোখ এড়িয়ে। গুগলি মাটিতে পড়ে কোন দিকে বাঁক নেবে তা বোঝা অসম্ভব ছিল। সামনের ছেলেটি নালিশ করলেই স্যার জিজ্ঞেস করতেন—“এই, কে চুল টানলি রে? সুনীল, উঠে দাঁড়া।”

“আমি না স্যার, দিলীপ টেনেছে। আমি পরিষ্কার দেখেছি।”

“মিথ্যে কথা স্যার। রতন টেনেছে।”

“আমি অভীকের কান কেন টানব স্যার? অভীক আমার কী ভালো বন্ধু!”

“চারটেই বেরিয়ে যা। পুরো পিরিয়ড নিল ডাউন হয়ে বসে থাক।”

ব্যস, আর পায় কে। ব্যাজার মুখে বেরিয়ে গেল চারজন। স্যার বন্ধ করে দিলেন ক্লাস-রুমের দরজা। নিল ডাউনে বসেই পকেট থেকে বেরিয়ে পড়ল হজমি, লজেন্স, ঝুরিভাজা। আর পড়াশোনার বালাই নেই। একটা ক্লাস অন্তত রেহাই। দেদার মজা। সপ্তম স্বর্গ।

স্কুল শেষ হওয়ার পর প্যাডলে পা দিল ঋতম। অন্যদিনের মতোই। আজকের গন্তব্য অবশ্য অন্য। মুকুন্দর বাড়ি। আজ নিয়ে টানা চারদিন স্কুলে আসেনি মুকুন্দ। ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। ওদের বাড়িটা স্কুল থেকে একটু দূরে। এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। হাতে গোনা দু-চারটে বাড়িঘর। সব বাড়িতেই অনেক গাছপালা—ফুল, ফল, পাতাবাহার। মুকুন্দদের বাড়ি যাওয়ার পথে একটা বেশ বড়ো জায়গা পড়ে—জঙ্গল জঙ্গল। অনেক বড়ো বড়ো গাছ—ইউক্যালিপ্টাস, ঝাউ, কদম, বকুল। ঋতমরা এই জায়গাটার নাম দিয়েছে আমাজন। ঝুলনের আগের দিন খুব ভিড় হয় ছেলেদের। ঝুলনে সিনারি সাজাতে হয়। রাধাকৃষ্ণের দোলনার ব্যাকগ্রাউন্ড। পাহাড়ের গা জুড়ে লাগাতে হয় ঝাউ-ডাল। সাতদিনে শুকিয়ে নুয়ে পড়ে না। ঝুলনের আগের দিন ঝাউ-ডালের খুব ডিমান্ড। সেদিন কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। মুকুন্দ তো আর বন্ধুদের গায়ে হাত তোলেনি। মেরেছেন হেডস্যার। বাবা বলেন, জীবনে সবকিছুর বরাদ্দই ঠিক করে রাখা আছে। একেবারে পূর্ব নির্ধারিত। যার সারাজীবনে দশ হাজার পাঁচশো বাইশটা রসগোল্লা খাবার কথা সে যদি স্কুল শেষ হবার আগেই সাড়ে দশ হাজার খেয়ে ফেলে তবে তার করুণ জীবনটার কথা ভেবে ঋতমের চোখে জল আসে। বাকি জীবনটা শুধু বাইশটা রসগোল্লার ভরসায় টেনে চলা। তেমনি ছোটবেলায় মাস্টারমশাইদের কাছে বকা খাওয়ার কোটা শেষ না করে ফেলতে পারলে বড়োবেলায় বকা খাবার ভয় থেকে যায় যে। কী লজ্জার কথা! সেদিক দিয়ে মুকুন্দ তো উপকারই করেছে তাদের।

বারান্দায় বসে ফেলুদা পড়ছিল মুকুন্দ। বিকেলের সূর্যের আলোটা কেমন একটু মায়া মায়া। অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে ঋতম গিয়ে দাঁড়াল বন্ধুর সামনে।

“আরে ঋতম, তুই!”

“খুব লেগেছিল সেদিন, না রে ভাই?”

“হ্যাঁ রে। ঢিলটা বেশ বড়ো ছিল তো। এক্স-রে করতে হল। ভয়ের কিছু নেই রে। একটু নীল হয়ে আছে, এই যা। ফোলাও ছিল। এখন কমে গেছে।”

বন্ধুর সিন বোনে ব্যথার জায়গায় হাত বুলিয়ে দেয় ঋতম। বন্ধুর ব্যথা শুষে নিতে চায় যেন।—“আমাকে ক্ষমা করে দে মুকুন্দ। খুব ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দে ভাই।”

“ঢিলটা তুই মেরেছিলি তাহলে? আমাজনের মধ্যে তখন তো বেশ অন্ধকার। আমি শুধু সাইকেলটা দেখেছিলাম, আর স্কুলের ইউনিফর্ম।”

“আর এমন ভুল করব না রে। কোনোদিনও না।”

“না না, আমারই তো দোষ। আমিই তো বোকার মতো হেডস্যারকে বলতে গেলাম। খেলার মজাটাই নষ্ট করে দিলাম। কেন যে এত রাগ হয় আমার!”

“ভালোই তো। তোর রাগের বরাদ্দটা স্কুলেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর আর কারও ওপর রাগ করতে পারবি না। শুধু মজা আর মজা। তোর রাগ পেলে তুই রাগ করবি মুকুন্দ। আমরা কিচ্ছু মনে করব না।”

“তোর যতসব উদ্ভট উদ্ভট কথা। চল তোকে আমাদের গাছের বাতাবি পেড়ে দিই।”

“আর-একটা কথা বলি মুকুন্দ? যদি কিছু মনে না করিস ভাই…”

“না না। মনে করব কেন? বল না।”

“আমি তোকে ঢিল মেরেছিলাম। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি তোর কাছে। এসব কথা ক্লাসে বলিস না যেন। আমি তাহলে বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না আর।”

“কাউকে বলব না। তুই একদম নিশ্চিন্ত থাক।”

এর মধ্যে দিন দশ-বারো পার হয়ে গেছে। মুকুন্দ আবার নিয়মিত স্কুলে আসা শুরু করেছে। বন্ধুরা অবাক হয়ে দেখেছে যে তার নালিশ করার স্বভাবটা একেবারে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। ভাব হয়ে গেছে সবার সঙ্গে। অনেকদিন পর সুনীল, রতন, দিলীপরা নিজেদের ফর্ম ফিরে পেয়েছে। আজ অভীককে ছেড়ে মুকুন্দর পিছনে গিয়ে বসেছে ওরা তিনজন। আজ ওদের টার্গেট হল মুকুন্দ। থার্ড পিরিয়ড মিত্র-স্যারের। নরম-সরম মানুষ। স্যারের বিষয় ইতিহাস। তিনজন মিলে ক্লাসের বাইরে নিল ডাউন হতে সময় লাগল না বিশেষ। স্যার বন্ধ করে দিলেন ক্লাস-রুমের দরজা।

“আমাকে ক্ষমা করে দে মুকুন্দ।”

“না রে। খুব একটা লাগেনি কিন্তু।”

“মাথাতেও তো লাগতে পারত! কিংবা চোখে! আমি তো মাথাই তাক করেছিলাম। আমাজন অন্ধকার হয়ে গেছিল তাই লাগেনি। আসলে ঋতম মার খাওয়ায় আমার মাথাখারাপ হয়ে গেছিল। ওকে আমি খুব ভালোবাসি রে।”

“আমিও।”

“রমন লাম্বা, অত বড়ো ক্রিকেটার, অমন রাজপুত্রের মতো চেহারা—বল মাথায় লেগেছিল বলেই না জীবনটাই চলে গেল। আমায় মাফ করে দে ভাই।” সুনীলের মতো শক্ত ছেলেও চোখ মোছে।

“আচ্ছা দিলাম। তোকে কিন্তু আমি দেখতে পেয়েছিলাম সুনীল। আমাজনের অন্ধকার বাধা হয়নি। আর-একটা সাইকেলও কিন্তু ছিল। দূরে। কদমগাছের আড়ালে। তুই তাকে দেখতে পাসনি। সে আঁচ করেছিল যে তুই আমাকে মারবি। তোকে বুঝিয়ে বলে থামাতে পারবে না সে জানত। অপেক্ষা করছিল সে। যদি আমার কোনও সাহায্য লাগে। আমি সাইকেলে ওঠার পর সে ফিরে যায়। আমাকে জানতে দেয়নি।”

“সে কে ভাই? নামটা বল প্লিজ।”

“নামটা যদি এখনও তুই আন্দাজ করতে না পেরে থাকিস তবে কিন্তু তোর ক্লাস এইট-বিতে পড়াই বৃথা।”

থার্ড পিরিয়ড শেষ হবার ঘণ্টা পড়ে ঢং ঢং ঢং। চারজনকে ঘরে আসতে বলে মিত্র-স্যার টিচার্স রুমের দিকে পা বাড়ান।

চারজন মিলে জড়িয়ে ধরে ঋতমকে। প্রতিজ্ঞা করে রাগ, মনখারাপ—কোনও কিছুকেই আর মারামারি অবধি নিয়ে যাবে না। কোনোদিনও না। ভুল করে কখনও বন্ধুকে ব্যথা দিয়ে ফেললে সে-ব্যথা নিজের মনে এসে লাগে। আর সে লাগার জোর যে বড্ড বেশি। একটা গন্ধ ভেসে বেড়ায় সারা ক্লাস-রুম জুড়ে। বন্ধুত্বের গন্ধ। বড়ো মিষ্টি সে গন্ধ।

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s