বড়োগল্প- অস্ত্র সিন্দুকের রহস্য-অবন্তী পাল -বসন্ত২০২৩

golpoastrasindukrohosyo

॥ ১॥

আমার মামাবাড়ির গ্রামে প্রতিবছর একটু আগে থাকতেই শরতের হাওয়া লেগে যায়। স্কুল ছুটি পড়ামাত্রই আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আসি এখানে। মামাতো ভাইয়েদের সঙ্গে পুজোর সময়টা বেশ রমরমিয়ে কাটানো যায়। মামাবাড়ির গ্রামের ছেলে ভূপেন্দ্র, মানে আমাদের ভূপি আমার মতনই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ওদের বাড়িতে প্রতিবছর বারোয়ারি পুজো হয়। এই সময়টা ভূপিদের বাড়ির দুর্গাপুজো হয়ে ওঠে গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। বহু বছরের পুরোনো কুমোর হরিশজ্যাঠা তাঁর ছেলে মহিম দাদাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রতিমা গড়তে। আমরাও বিকেলে মাঠে খেলা ছেড়ে হাজির হই ভূপিদের বাড়ির ঠাকুরদালানে। বহু বছর ধরে হয়ে আসছে এই পুজো। এখন গ্রামে কাঁচা মাটির বাড়ি হাতে-গোনা গুটিকয়েক হলেও, এখানে সবথেকে পুরোনো পাকা বাড়ি হল গিয়ে ভূপিদের। সেই তাদের ঠাকুরদা-বাবার আমল থেকে। দুর্গাপুজো একশত বছরের উপর পুরোনো। বংশপরম্পরায় হরিশজেঠুরাই প্রতিমা গড়ে এসেছেন এ-যাবৎ। এই মূর্তি আবার যে-সে মূর্তি নয়। কাঠামোয় প্রতিবছর একই ছাঁচ ফেলে দেবীমায়ের মুখ তৈরি হয়। দশভুজার রঙ হয় ঝকঝকে সোনালি বর্ণ। মা দুর্গার হাতে ত্রিশূল মামুলি কাগজের বা পাতলা অ্যালুমিনিয়াম পাতের সামান্য সামগ্রী নয়, খাঁটি সোনার পাতের তৈরি! সেই ত্রিশুল প্রতিবছর ভূপিদের বড়ো মন্দিরের সিন্দুক খুলে বের করা হয় মহালয়ার দিনে। এই সময় প্রতিমা সাজানো দেখা নিয়ে সারা গ্রামে রমরমা পড়ে যায়। হাজার হোক, মা আসছেন যে! এইসব মুখর সন্ধ্যায় গ্রামের আরও অনেক কচিকাচাঁরা এবং বড়ো দাদা-দিদিরাও এসে জুটে যায় ঠাকুরদালানের সামনে। টুকাই, শ্যামল, নকুড়ের মতন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির ছোটোরা নিজেদের মধ্যে বেশ হুড়োহুড়ি করে খেলায় মত্ত থাকে। আবার রঘুদাদা, যতীনদাদা, বিন্নিদিদি, দূর্বাদিদি, মিছরিদিদিদের মতন দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির বড়োরাও দারুণ গল্প জমায় ভূপিদের বাড়ির বড়োদের সঙ্গে।

এ-বছর যথারীতি সাজসজ্জা পুরোদমে চলছে। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন বিকেলে আমি, আমার মামাতো ভাই খগেন, গ্রামের ছেলে পুকাই আর কাঞ্চা ঠিক গিয়ে হাজির হয়ে যাই ভূপিদের ঠাকুরদালানের সামনে। তারপর আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে ভূপির জ্যাঠাইমার দেওয়া মুড়ি-শিঙাড়া আর মাখা সন্দেশে মনোনিবেশ করি আর পরিকল্পনা করি কেমন করে কাটাব পুজোর দিনগুলো। গল্পগুজবে মশগুল থাকলেও, আমাদের মন পড়ে থাকে হরিশজ্যাঠার নিপুণ হাতের কাজ দেখায়। আহা, না জানি কী জাদু আছে তাঁর হাতে! নিখুঁত গড়নে মৃন্ময়ী মূর্তিকে এমন রূপ দেন, দেখলে মনে হবে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, মুখে স্মিত হাসি বুঝি সত্যি, এই দেবীপ্রতিমা বুঝি মনের গহিনের সবটুকু দেখতে আর বুঝতে পারছেন, মানে এক্কেবারে জীবন্ত!

এ-বছরের প্রস্তুতি চলছিল বেশ। কিন্তু গণ্ডগোলটা বাধল মহালয়ার দিন। সেদিন স্কুল ছুটি। সক্কাল সক্কাল রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণদাদুর স্বর্গীয় মহালয়া পাঠ শুনে, লুচি-আলুরদম-বোঁদে খেয়েই আমি ছুটলাম ভূপিদের বাড়িতে। আজ মা দুর্গার চক্ষুদান হবে বলে কথা।

আমাকে দেখেই ভূপি সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নিল—“এসেছিস নারান? চল আমার ঘরে শিগগির।”

“কী ব্যাপার ভূপি? আমরা মায়ের চক্ষুদান দেখব না? পুকাইরা কোথায়? ওরা আসবে না?”

“সবাই এসে গেছে, আমার ঘরে আছে। চল চল, ওখানে গিয়ে সব বলছি।”

লাফিয়ে লাফিয়ে দোতলার ঘরটায় পৌঁছে দেখলাম ভূপির কথামতন সকলেই উপস্থিত। এই ঘরটার সামনে বিশাল বারান্দা আর ঠিক সেখান থেকে সরাসরি দেখা যায় নীচের ঠাকুরদালান। যেখানে প্রতিমা নির্মাণের কাজ চলছে, তার পাশেই বড়ো মন্দির। সেখানে একটা ছোটোখাটো জটলা তৈরি হয়েছে। ভূপির জ্যাঠামশাই, বাবা, কাকা, হরিশজ্যাঠা আর মহিমদাদা সেখানে খুব উত্তেজনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করে চলেছে।

“ব্যাপারটা কী?”

আমি জিজ্ঞাসা করতে, ঘরের ভেতরে ভূপি গম্ভীর মুখে আমাদের মুখোমুখি এসে বসল। তারপর বলল, “তোদের এখানে উপরের ঘরে নিয়ে আসার কারণ হচ্ছে, আজ নীচে বড্ড গোল বেধেছে। আজ কখন যে মা দুর্গার চক্ষুদান শুরু হবে, কে জানে।”

“কেন, কী হয়েছে, কী হয়েছে?” আমরা সকলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

“আমাদের বাড়ির পুজোয় তো জানিসই মা দুর্গার হাতের ত্রিশূল সোনার তৈরি।” বলল ভূপি, “এই অস্ত্র তোলা থাকে বড়ো মন্দিরের সোনার সিন্দুকে। আমাদের বাড়ির বহু বছরের পুরোনো প্রথা, প্রতিবছর মহালয়ার দিনে এই অস্ত্র বের করে সূর্যোদয়ের সময় পরিচ্ছন্ন করে ঠাকুরমন্দিরে রেখে পুজো করা হয়।”

“আরিব্বাস, অস্ত্রের পুজো? মহালয়ার দিনে? কিন্তু কেন?” অবাক হয় পুকাই।

“দেখ, আমরা বাড়ির ছোটোরা সেই কবে থেকে বড়োদের কাছে শুনে আসছি আর দেখে আসছি এই প্রথা। ঠিক কবে থেকে আর কেন এর সূত্রপাত, সেটা তো আমার জানা নেই। তবে এই প্রথাকে ঘিরেই আজ ভীষণভাবে চাপা উত্তেজনা শুরু হয়েছে।”

“কেন, কেন?” আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে আর-একটু ঝুঁকে পড়লাম ভূপির দিকে।

“অস্ত্র-পূজা সমাপন হলে তবেই মা দুর্গার চক্ষুদান শুরু হয়। কিন্তু এই অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে না।”

“পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কোথায় গেল?” কাঞ্চার প্রশ্ন।

“প্রতিবছরের মতন ভোর রাত্রে জ্যাঠাইমা আর মা বড়ো মন্দিরে গিয়েছিল সিন্দুক খুলে অস্ত্র আনার জন্য। লাল কাপড়ে মোড়া থাকে মা দুর্গার ত্রিশূল। কিন্তু গিয়ে দেখল কী জানিস? সিন্দুকের লাল কাপড় তো আছে, কিন্তু তার মধ্যে ত্রিশূল নেই।”

“ত্রিশূল নেই?” হাঁ হাঁ করে উঠলাম ঘরভরতি আমরা সকলে।

“তাই তো বলছি। সেই ভোরবেলা থেকে ত্রিশূল খোঁজা চলছে, কিন্তু এখনও এর কোনও হদিস মেলেনি।”

“কী সাংঘাতিক কাণ্ড!” আমি বললাম।—“হ্যাঁ রে ভূপি, সিন্দুক কি খোলা অবস্থায় ছিল?”

“একদমই নয়। তাহলে তো বুঝতাম চুরি গেছে। কিন্তু সিন্দুক ছিল তালাবন্ধ। ভেতরে লাল কাপড়টাও অক্ষত রয়েছে, নেই শুধু ত্রিশূলটা।”

“শেষ কবে ওই ত্রিশূল রাখা হয়েছিল ওই সিন্দুকে?” জিজ্ঞাসা করল খগেন।

“নিয়ম অনুযায়ী, দুর্গাপুজো শেষ হলে দ্বাদশীর দিন তুলে রাখা হয়। আগের বছরও নিশ্চয়ই তাই হয়েছিল।” উত্তরে জানায় ভূপি।

“তারপর যে একবারের জন্যও বের হয়নি, সেটা কি আমরা কেউই সঠিক বলতে পারি?” ভ্রূযুগল কুঁচকে চিবুকে তর্জনী ঠেকিয়ে জিজ্ঞাসা করে পুকাই।

“ঠিক বলেছিস, আমারও এটা মনে হয়েছে।” আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।

“কিন্তু সারাবছর ঠাকুর মন্দির বন্ধ থাকে। তিনটে তালা ঝোলে সোনার সিন্দুকে, আজও ঝুলছিল। এরকম আরও একটা সিন্দুক আছে যেখানে মা দুর্গার অন্যান্য অস্ত্র থাকে। আরও একটায় ঠাকুর পুজোর বাসনপত্র, শাঁখ, প্রদীপ এসব রাখা থাকে। সেই দুটোতেও তিনটে করে তালা ঝোলে। ওই সিন্দুক দুটোর ডালা খুলে কিন্তু দেখা গেছে যে সবকিছু ঠিক জায়গা মতন আছে। একমাত্র ত্রিশূল অস্ত্রের সিন্দুকেই রহস্যজনকভাবে কোনও একটা গণ্ডগোল ঘটেছে।”

“সারাবছর তালাবন্ধ থাকে ঠাকুর মন্দির? তুই ঠিক বলছিস ভূপি?” জিজ্ঞাসা করে কাঞ্চা।

“হ্যাঁ, একমাত্র পূজা-আহ্নিকের সময় খোলা হয়, আর হয় অন্যান্য পূজা-পার্বণে। কিন্তু তোরাই বল, ওই সময় তো ঠাকুরমশাই আর ঘরের লোকজন বাদে আর কেউই প্রবেশ করে না মন্দিরে। তাহলে অন্য কারও হাতে যাওয়াও সম্ভব নয়।”

রহস্যের গন্ধ পেয়ে আমরা সবাই উত্তেজিত। সকলেই এর সমাধান খুঁজতে উৎসুক। আকাশ-কুসুম নানারকম চিন্তাভাবনা আমাদের মাথায় ভিড় করতে লাগল।

এর মধ্যে খগেন বলে বসল, “হ্যাঁ রে ভূপি, তোদের ঠাকুর মন্দিরে গুপ্ত সুড়ঙ্গপথ নেই তো? যেখান দিয়ে কেউ উঠে এসে সিন্দুক খুলে অস্ত্র হরণ করেছে? অথবা ফাঁকা গরাদওয়ালা উঁচু জানালা, যেটা টপকে কেউ এসেছে আর নিয়েই পগারপার হয়েছে!”

আমরা সবাই ব্যস্তসমস্ত হয়ে খগেনের এমন অদ্ভুত যুক্তিকে নিরস্ত করলাম।

কিছুক্ষণ পর পুকাই বলল, “এ নির্ঘাত ভূতের উপদ্রব না হয়ে যায় না।”

এবার আমরা বাকিরা বকাঝকা করে উঠলাম। ভূপি তো খুব ক্ষেপে গেল।—“তোর চিরকালই যত্তসব বিটকেল বুদ্ধি পুকাই। আর তাছাড়া ঠাকুর মন্দিরে ভূত কোন সাহসে ঢুকবে বল দিকিনি? ভূতের কি ঠাকুর-দেবতাকে ভয় পেতে নেই? তাছাড়া ভূতে ত্রিশূল নিয়ে করবে কী শুনি? নেত্য?”

“আহ্‌, চটে যাস কেন!” আমতা আমতা করে পুকাই।

“আচ্ছা, আজ সকালে জ্যাঠাইমাদের সঙ্গে আর কেউ লুকিয়ে ঢুকে পড়েনি তো মন্দিরে?” জিজ্ঞাসা করল কাঞ্চা।

“ঢুকলে তো দেখতে পেত, নাকি? আর তখন ঢুকলেও কী যায় আসে? অস্ত্র তো তার আগে থেকেই নিরুদ্দেশ।” বললাম আমি।

“জ্যাঠা-বাবা-কাকা মিলে এর হদিস পাচ্ছে না কিছুতেই।” উদ্বিগ্ন ভূপি—“এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অস্ত্র পুজো না হলে তো মা দুর্গার চক্ষুদান পর্ব শুরু করা যাবে না। সবার মাথায় হাত পড়েছে। কোন জাদুবলে যে উধাও হয়ে গেল… নিশ্চয়ই ভগবানের রোষ পড়েছে আমাদের ওপর।” মুষড়ে পড়ে ছেলেটা।

ভগবানের রোষ… ভগবানের রোষ… ভূপিদের বাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে এই কথাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমি সে-কথা অল্পসল্প জানি। ভূপির কথায় আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।—“হ্যাঁ রে ভূপি, বলি সিন্দুক বদলে যায়নি তো? কেউ আসল অস্ত্রের সিন্দুক সরিয়ে, তার জায়গায় অন্য সিন্দুক বসিয়ে যায়নি তো?”

সকলেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, “অত ভারী সিন্দুক সরানো কি সোজা কথা?”

কিন্তু ভূপির চোখ নিমেষে চকচক করে উঠল। ও দৌড় লাগাল ঠাকুর মন্দিরের উদ্দেশ্যে। আমরা বাকিরা ওর পিছু নিলাম। কিন্তু আমাদের মতন সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছোটোদের কি কেউ পাত্তা দেয়? একেই এই শোরগোল, তার ওপর আমরা গিয়ে জটলা পাকাতে ভূপির জ্যাঠামশাই গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আজ এখানে একদম খেলা চলবে না।”

“না না জেঠু, আমরা খেলতে আসিনি।” হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ভূপি, “আমরা দেখতে এসেছি যে অস্ত্রের সিন্দুক এখন ঠাকুর মন্দিরে আছে, সেটা আসল না নকল।”

ভূপির এমন দাবিতে জেঠুর চক্ষু চড়কগাছ। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে বললেন, “এ আবার কেমন অবান্তর যুক্তি? সিন্দুক বদলাবে কেন?”

“আচ্ছা দাদা, ও বলছে যখন একবার দেখাই যাক না।” বললেন ভূপির কাকা।

“তোমার মাথাখারাপ হয়েছে সীতেশ।” হুংকার ছাড়লেন ভূপির জেঠু।—“ওই ভারী সিন্দুক বদল হবে? কে সরাবে? কার সাধ্যি আছে? আর তাছাড়া ঠাকুর মন্দিরে আমাদের মধ্যে বিশ্বস্ত লোকজন ছাড়া আর সকলের প্রবেশ নিষেধ, এই কথা কি তোমার জানা নেই?”

“সব মানছি দাদা,” বেগ ধরেন ভূপির বাবা—“তবুও একবার দেখতে ক্ষতি কী? এমনিও তো এখনও পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হওয়া ত্রিশূল সম্পর্কে কোনও কূলকিনারা পাইনি।”

এরপর বড়োরা সকলে মিলে ছুটল মন্দিরের ভেতরে।

কিছুক্ষণ পর ভূপির বাবা বেরিয়ে এসে আমাদের ডেকে বললেন, “ঠিকই তো! এ সিন্দুক তো সেই সোনার সিন্দুক নয়! একই হরফে সমস্ত লেখা, অবিকল এক দেখতে। কিন্তু তাড়াহুড়োতে আমরা খুব সূক্ষ্ম একটা জিনিস দেখতে ভুলে গেছিলাম। এই সিন্দুকের ডালার মাথায় সিংহের বদলে পদ্মফুল আঁকা। এ তো অন্য সিন্দুক!”

আমাদের মধ্যে আবার ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল।

একটু পরে জ্যাঠামশাই বেরিয়ে এসে চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন আমাদের—“সূত্রটা কে ধরালে? কে জানালে এটা নকল সিন্দুক?”

সবার চোখ আমার দিকে। আমি বেশ গর্ব বোধ করতে লাগলাম। ভাবটা এমন যে, কেমন বুদ্ধিটা দিলাম? আমার মাথায় না এলে তো তোমরা ভেবেই সারা হচ্ছিলে। কিন্তু এ কি! জ্যাঠামশাই ভীষণ ক্রুদ্ধভাবে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলতে লাগলেন, “নীরেন্দ্রনাথ, তুই কি করে জানলি সিন্দুক বদলের কথা? তুই তো ঠাকুর মন্দিরের সিন্দুক কোনোদিন দেখিসনি পর্যন্ত। তাহলে তোকে এ-কথা কে বলল? সত্যি করে বল!”

এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্সপেক্টরের এমন কথায় আমি হকচকিয়ে গেলাম।

“আমি কী করে জানলাম?” আমতা আমতা করতে লাগলাম আমি—“আমি তো জানতাম না, আমি আন্দাজ করলাম।”

“আন্দাজ করারও একটা সূত্র থাকে বইকি। যদি না আগে থেকেই কেউ ব্যাপারটা জেনে থাকে, তাহলে এরকম আন্দাজ কিন্তু মোটেও যুক্তিগত নয়।” বললেন জ্যাঠামশাই।

“আরে দাদা, বলেন কী! ও তো ছেলেমানুষ, ও কী করে জানবে? নিশ্চয়ই বুদ্ধি করে বলেছে।” ঘটনার এমন আকস্মিক আর অনভিপ্রেত মোড় ঘুরতে দেখে ভূপির বাবা আর কাকা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

আমি তখন ভিরমি খেয়ে দরদরিয়ে ঘামছি। ভূপিরাও সম্মিলিতভাবে বোঝাতে উদ্যত হল যে আমরা একটু আগেই এই ঘটনা শুনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করি আর যে-যার মতন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করি। কিন্তু সক্কলকে থামিয়ে জ্যাঠামশাই ফের গর্জে ওঠেন—“আহা, তোরা বড্ড গোল বাধাস! নীরেন্দ্রনাথ, আমায় বল তো, এরকম জিনিস বদলের গল্প কি সত্যিই তোর মস্তিষ্কপ্রসূত? নাকি গল্পের বই থেকে উদ্ধার করেছিস? নাকি কেউ তোকে কখনও কিছু বলেছে, যেটা থেকে তোর মাথায় এল এরকম কথা? খুব ভেবে-চিন্তে বলবি, কারণ তোর উত্তর আমাদের অস্ত্র সন্ধানে বিশেষ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।”

কেন ভাবলাম এরকম? তাহলে কি ওঁদের সত্যিটা বলে দেব? নাকি কথাটা ঘুরিয়ে নিজেই একবার চুপিসারে বিশেষ একজনকে জিজ্ঞাসা করে আসব?

॥ ২॥

জ্যাঠামশাই আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করেন সিন্দুক বদলির কথা, তখন কিছু উত্তর না দিলেও আমার মনে আসে ভূপির ঠাম্মির কাছে শোনা এই বাড়ির প্রাচীন ইতিহাসের গল্প। তার মধ্যে সত্যি আর মিথ্যে যে ঠিক কতটা, সেটা আজ পর্যন্ত কেউই যাচাই করে উঠতে পারেনি। তবে বংশের সবাই লোকমুখে জানে এই সমস্ত গল্পকথা।

ঠাম্মির মুখেই শোনা, বহু বছর আগে পুজোর আগ দিয়ে ঘটে যাওয়া চমকপ্রদ সব ঘটনা। যেমন, ঢাকির ফেটে যাওয়া ঢোলকের ভেতরে শঙ্খ খুঁজে পাওয়া, লক্ষ্মী-প্রতিমার মূর্তি বদল, গ্রামের দিঘির জলের তলায় খুঁজে পাওয়া রাধামাধবের হিরে বসানো মুকুট, বাগানে আমগাছের তলায় খুঁজে পাওয়া ঠাকুর পূজার কাঁসর-ঘণ্টা, আরও কত কী। লোকমুখে প্রচলিত, যখন গ্রামে কোনোরকম বিপদ আসে, অদ্ভুতভাবে তখনই এসব বিভ্রান্তিকর কাণ্ড ঘটে। এর পেছনে যে আদৌ কারও হাত আছে, তা বলা যায় না। সব্বাই মেনে নিয়েছে, এসব অলৌকিক কাণ্ড। আসন্ন কোনও সাংঘাতিক বিপদের সংকেত। আর এর থেকে বাঁচার একটাই উপায়—একে অপরের সঙ্গে একত্রিত হয়ে থাকা, যাতে আসন্ন বিপদের মোকাবিলা করা যায়। অনেক সময় দেখা গেছে, সমস্যার সমাধান হওয়ার পরে অন্তর্ধান হওয়া জিনিস আপনা থেকেই স্বস্থানে ফিরে এসেছে।

এইখানে একটা কথা বলে রাখি। বিপদ বলতে একটা ব্যাপারই আমার মাথায় এসেছিল। আমার মামাবাড়ির গ্রাম গঙ্গার একেবারে পাড় ঘেঁষে। নদীর ও-পাড়েই কয়েকটা গ্রাম জুড়ে, বেশ কয়েকমাস যাবৎ শুরু হয়েছে চুরি-ডাকাতির উপদ্রব। কানে যেটুকু আসে, এসব যেন-তেন ছিঁচকে চুরি নয়, রীতিমতন ঘরের দরজা ভেঙে কিছু লাঠিধারী মুশকো চেহারার লোক বাড়িতে হানা দেয়। তাদের উদ্দেশ্য যে ঠিক কী, সেটা বোঝা মুশকিল। কারণ তারা যে শুধুমাত্র জিনিস লুঠপাট করে চলে যায়, এমনটাও নয়। কিছু দুষ্প্রাপ্য জিনিসের খোঁজ নেয়। না পেলেই ধমক-ধামক জুড়ে দেয়। গুপ্ত কোষাগারের খবর চায়। ওদের বক্তব্য, এইসব এলাকায় গুপ্তভাবে সন্ত্রাসবাদীদের কাজকর্ম হচ্ছে। তাদের মূলধন আর গোপন কারখানা খুঁজে বের করাই নাকি ওদের উদ্দেশ্য। যারা এই সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করছে, তাদের ন্যায্য শাস্তি দিতে এরা বদ্ধপরিকর। অবশেষে কিছু খুঁজে না পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোর থেকে অন্ন-বস্ত্র কেড়ে তবে বিদায় হয়। অনেকবার পুলিশ দলবল নিয়ে তাদের পাকড়াও করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুতেই নাগালের মধ্যে পায়নি। আর গুপ্ত সন্ত্রাসবাদীদের কারবার? সে এখনও অধরাই থেকে গেছে। ওই গ্রামের কোনও সদস্য অথবা বছর শয়েকের মধ্যে তাদের কোনও পূর্বপুরুষ কস্মিনকালেও সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে জানা যায় না। তাহলে কীসের খোঁজে আসে লাঠিয়াল লোকগুলো? সেটা জনসাধারণের কাছে যেমন কৌতূহলের, তেমনই আতঙ্কের।

তবে কি সেইসব লাঠিয়ালদের সন্ত্রাস এই গ্রামে এসে উপস্থিত হল অবশেষে? অস্ত্র চুরি যাওয়া কি তারই পূর্বাভাস? আশঙ্কায় বুকটা কেমন ধড়ফড় করে উঠল। অবশ্য এটা নিছকই আন্দাজ। বহুদিন ধরে নদীর ও-পাড়ে এসব উৎপাত থাকলেও, আমি শুনেছি এদিকটায় আশ্চর্যজনকভাবে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। তাই পুজোর মরসুমে এসব উটকো চিন্তা না করাই ভালো, এই ভেবে মনকে প্রবোধ দিলাম।

কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। এর কিছু কিনারা তো পেতেই হবে। ত্রিশূল না পাওয়া পর্যন্ত যে মা দুর্গার চক্ষুদান শুরু করা যাচ্ছে না। যদিও ভূপির জ্যাঠামশাইয়েরা একবার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, অন্য অস্ত্র ব্যবহার করে নিয়ম এবারের জন্য একটু হলেও বদলানো হোক, কিন্তু এই অস্ত্র পূজা প্রথা থেকে বাড়ির আর সকলেই সম্মিলিতভাবে অনড় থেকেছে। কেউই যে চায় না এই প্রাচীনকালব্যাপী দুর্গাপুজোর ছেদ ঘটুক। মা প্রতিবারের মতন সোনার ত্রিশূল ধরে ঘরে আসবেন না, তা কি কখনও হয়? এমন অঘটন যে বিগত ত্রিশ বছরে একবারও ঘটেনি!

আমরা ছোটোরা কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, যে এসবের পেছনে কারও হাত নেই। নিশ্চয়ই কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে এর পেছনে বড়ো কারও হাত থাকে প্রতিবার। তা না হলে, হাজার হোক, জড়বস্তু কি আর পায়ে হেঁটে যায়-আসে? কক্ষনো নয়!

ঠাম্মিকে এবারের গণ্ডগোলের কথা বলতেই উনি মস্ত দেওয়ালজোড়া জানালাটার পাশে গিয়ে চুপ করে বসলেন। ওই জানালা থেকে বড়ো মন্দির স্পষ্ট দেখা যায়। রাতের অন্ধকারে কেউ যদি মন্দিরে যাওয়া-আসা করে থাকে, তাহলে এই জানালায় দাঁড়ালে সেই আগন্তুককে পরিষ্কার দেখা যাবে। ঠাম্মি কি দেখতে পেয়েছিল তাকে? নাকি অন্যদের মতন এটা তাঁর কাছেও ধোঁয়াশা?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠাম্মি বললেন, “নিশ্চয়ই কোনও পুণ্যসাধনের জন্য অস্ত্র বেরিয়েছে এই বাড়ি ছেড়ে। সেটার নিরসন হলে আশা রাখি ত্রিশূল যথাস্থানে ফেরত আসবে।”

“তার মানে কী ঠাম্মি?” গোল গোল চোখ করে জিজ্ঞাসা করলাম আমি, “সত্যিই কোনও বিপদ আসন্ন? তোমার মুখে শোনা পুরোনো দিনের সবকথা কি তাহলে সত্যি?”

“তা বলতে পারব না দাদুভাই। তবে উমার কাছে প্রার্থনা করি, কারও কোনও অমঙ্গল যেন না হয়।” এই বলে উনি দুই হাত তুলে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।

“তাহলে এবার কী হবে ঠাম্মি?” ভূপি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এবার কি পুজো হবে না?”

“নিশ্চয়ই হবে দাদুভাই, শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা।” বড়ো মায়াবী হেসে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ঠাম্মি।

॥ ৩॥

আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নীচে ঠাকুরদালানে নেমে এসে দেখি, খগেনের স্কুলের নিমাই-মাস্টার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন এদিকে। কী ব্যাপার? মাস্টার ভারি স্বল্পভাষী মানুষ। কেউ কোনোদিন তাঁকে গল্পগুজব করতে, গ্রামের দশজনের সঙ্গে মিশতে, এমনকি অযথা হাসিটুকু খরচ করতেও দেখেনি। এহেন মানুষ তো অকারণ গায়ে পড়ে কারও বাড়িতে আসবেন না! তার মানে নিশ্চয়ই তাঁর আগমনের পেছনে কোনও গুরুগম্ভীর কারণ না থেকে যায় না।

মাস্টার এসে ভূপির জ্যাঠামশাইকে উদ্দেশ করে বললেন, “আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম জিতেশবাবু।”

“কী ব্যাপার নিমাই? তোমাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে?”

“কতকগুলো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটছে গ্রামে। আজ ভোরে আমার সঙ্গে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে।”

“আহা, কী হয়েছে খুলেই বলো না!”

“হ্যাঁ, আমি বরং প্রথম থেকেই বলি। আজ ভোরবেলায় নদীপাড়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলাম প্রতিদিনের মতন। এইসময় ঘাটগুলো ব্যস্ত থাকে, তাছাড়া কুমোরের লোকজন গঙ্গামাটি নিয়ে যাওয়ায় জায়গাটা বেশ এবড়োখেবড়ো হয়ে উঠেছে। তাও আমি তার মধ্যে দিয়েই হাঁটছিলাম বুঝলেন। কিছুটা নিরিবিলি জায়গায় এসে পৌঁছেছি, ওই যেখানটা নদীটা বাঁক নিয়ে পুবে চলে গেছে। জায়গাটায় আবার লোকচলাচল বরাবরই কম, জানেনই তো। আমিও কিন্তু সচরাচর ওদিকে যাই না। জোয়ারের জল হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ওই জায়গায়। তায় আবার নদীর প্রায় পাড় ঘেঁষে শালবন শুরু। তো সেখানেই কাদামাটির একজায়গায় আচমকা আমার পা হড়কে গেল। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম আর-একটু হলে, কোনোরকমে শক্ত মতন একটা ঢিবি পেয়ে সেটা ধরে কোনোক্রমে সামলে নিলাম। কিন্তু আমার চশমাটা বেকায়দায় গেল কাদায় পড়ে। আর সেটা হাতড়াতে গিয়ে হাতে বাধল শক্ত কিছু।” এতটা বলে থামলেন মাস্টার।

“শক্ত কিছু? কী?” উৎসুক জ্যাঠামশাই।

“সেটাই তো বলছি। চশমা পেয়ে ভালো করে খুঁজে দেখি, একটা বেজায় বিশালাকার মোটা লোহার পাত। সরানো যায় না, পরিধি এর অনেক বড়ো। কাদামাটির অনেকটা তলায়, তাই ওপর থেকে চোখে পড়ারও কোনও সুযোগ নেই। আগে তো নদী এতটা ভেতরে এসে বাঁক নিত না। গতিপথ বদলে, জোয়ারের জল মাটিকে নরম করে ফেলেছে। তাই নরম কাদার উপরে পড়লেই একমাত্র এর অস্তিত্ব টের পাওয়া সম্ভব। আমি মনে হয় দৈবচক্রে এর হদিস পেলাম। অনুমান করছি, এটা কোনও প্রবেশপথকে ঢেকে রাখার একটা ঢাল।”

“বলো কী!”

“হ্যাঁ জিতেশবাবু, ঠিকই বলছি। বেশ শক্তভাবে কিছুর সঙ্গে গাঁথা আছে নীচে। তবে আমার একার পক্ষে কাদামাটি আর শক্ত মাটি সরিয়ে সেটা যাচাই করা অসম্ভব।”

“পুলিশে খবর দিয়েছ?”

“হ্যাঁ, আমি কিছুক্ষণ আগেই ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দেখা করে এখানে এলাম।”

“তবে আমার কাছে আসা কী উদ্দেশ্যে? আমি তো কবেই এই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। আমি কি তোমাকে বিশেষ কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“এইটা পেলাম কাদামাটির মধ্যে।” এই বলে নিমাই-মাস্টার একটা ময়লা জরাজীর্ণ পাথুরে বস্তু এগিয়ে দিলেন জ্যাঠামশাইয়ের দিকে।—“দেখুন তো, এটা চিনতে পারছেন কি না?”

কাদামাটি লেগে যতই ময়লা ধরে যাক না কেন, চোখে এসে পড়ল একটা ক্ষুদ্র অংশ চকচক করছে।

“শিবের সোনার ডমরু!” রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলেন জ্যাঠামশাই।—“এ তো বছর ত্রিশেক আগে আমাদের ঠাকুর মন্দির থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। আমার বাবার মুখে শুনেছিলাম সে-কথা। মনে পড়ে, সে-বছর ভয়ানক ভূমিকম্প হয়েছিল। নদীর জলে গ্রাম ভেসে গিয়েছিল। অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছিল। সে এক হুলুস্থুল অবস্থা তখন। এই সবের মধ্যে এই উধাও হয়ে যাওয়া ডমরু আমরা আর খুঁজে পাইনি। ধরেই নিয়েছিলাম চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি।”

“ইনস্পেক্টরকে দেখাতে উনিও বললেন এটা আপনাদের না হয়ে যায় না। কে না জানে আপনাদের বাড়ির সোনার ডমরুর কথা? তবে অনেক বছর বাদে এভাবে ফিরে পাওয়া একটা মহামূল্যবান সামগ্রী বলে কথা। তাই আপনাকে একবার থানায় যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন ইনস্পেক্টর। উনি নিজেই আসতেন, কিন্তু হঠাৎ আমাদের গ্রামের বিন্নি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।”

“বলো কী? বিন্নি নিখোঁজ?” আঁতকে উঠলেন জ্যাঠামশাই আর তাঁর সঙ্গে সমবেতভাবে আমরাও।

“হ্যাঁ। গ্রামে কী যে শুরু হয়েছে! আজ সকাল থেকে ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” জানালেন নিমাই-মাস্টার।

প্রথমে অস্ত্র নিরুদ্দেশ, তারপর গঙ্গার ঘাটে সন্দেহজনক ঢাল খুঁজে পাওয়া, সেখান থেকে ভূপিদের সোনার ডমরু উদ্ধার আর তারপর এখন শুনছি বিন্নিদিদি নিরুদ্দেশ। আজ গ্রামে হচ্ছেটা কী? একটা অশনিসংকেত পেয়ে আমাদের হাত-পা বুঝি শিথিল হয়ে আসতে লাগল। পুজোর মরশুমে কার নজর পড়েছে এই আনন্দমুখর গ্রামে?

॥ ৪॥

নবম শ্রেণিতে পড়া বিন্নিদিদিকে আমরা সবাই বিন্নি বলেই ডাকি। শুনেছি বিন্নি ভারি ভিতু প্রকৃতির। বাড়ির লোকজন খুব ভেঙে পড়েছেন। সরলামাসি—বিন্নির মা খুব কান্নাকাটি করছেন। বিন্নির বড়ো দিদি বিন্তিদিদি জানাল যে ওরা দুজন একসঙ্গে ঘুমোয় একতলায় উত্তরমুখী ঘরে। রাত্রে বিন্নি কখনও ঘর ছেড়ে একা বেরোয় না। যদি দরকার পড়ে, তাহলে সে অবশ্যই দিদিভাইকে ডেকে, আলো জ্বেলে তবেই বের হয়। কিন্তু আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বিন্তিদিদি দেখল, পাশে বোন নেই। মহালয়ার দিন, হয়তো মা-কাকিমাদের ঘরে গেছে—এই ভেবে প্রথমটা অতটা গ্রাহ্য করেনি। কিন্তু তারপর যখন সমস্ত বাড়ি খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সবাই। মেয়ে হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে কি উবে গেল? একা এই সকালে বাইরে চলে যাবে কাউকে না জানিয়ে, এমন মেয়ে তো বিন্নি নয়!

ভূপি জানতে চাইল—“বিন্তিদিদি, কালও তো বিন্নি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। সন্ধেবেলা পর্যন্ত দেখেছি। তারপর আর খেয়াল করিনি, নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে এসেছিল?”

“ও তো কাল অনেকটা রাত করে ঘরে ঢুকল, ভূপি। অন্যান্য দিন সাধারণত সন্ধে ছ’টা সাড়ে ছ’টার মধ্যে চলে আসে, কিন্তু গতকাল এল রাত তখন প্রায় আটটা।”

“সে কি! কোথায় গিয়েছিল কিছু বলেছিল?” চমকে ওঠে পুকাই।

“পুজো আসছে, তাই আমরা ভেবেছিলাম ও বেশিক্ষণ বাইরে থাকছে। ছুটির দিনে বিন্নি একটু বেশি সময় বাইরে কাটায়। যেহেতু এমনটা হয়ে থাকে মাঝেমধ্যে, তাই এই নিয়ে আমরা কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।”

‘আরে তোরা কেউই কি দেখিসনি?” বলল কাঞ্চা—“ও তো ভূপিদের বাড়িতেই ছিল। আমরা কাল যখন বেরোচ্ছিলাম, তখন আমি ওকে ঠাম্মির ঘরে যেতে দেখেছি।”

“মানে সাতটা নাগাদ? আমি তো খেয়াল করিনি।” বলল ভূপি।

“তোদের এই সময় ব্যস্ত বাড়ি। কত লোকজনেরই না যাতায়াত। সবাই কোনও না কোনও কাজে যাওয়া-আসা করছে সারাক্ষণ। তাই হয়তো চোখে পড়েনি।” বললাম আমি।

“কিন্তু ঠাম্মি যে কিছু বলল না এই ব্যাপারে!” খানিকটা নিজের মনেই বলল ভূপি।

“কী আর বলবে রে? ঠাম্মির ঘরে তো আমরা সবাই যখন-তখন যাওয়া-আসা করি গল্পের টানে আর নাড়ু-মুড়কির লোভে।” বলল খগেন।

“আচ্ছা বিন্তিদিদি, বিন্নিকে কি কেউ তাহলে অপহরণ করল?” প্রশ্নটা করেই ফেলল কাঞ্চা।

আমরা সবাই ওর মাথায় টোকা মেরে ধমক দিলাম।

“আরে না না, তোরা কাঞ্চাকে বকছিস কেন?” বলল ঠিকই, তবু আর নিজেকে সামলাতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল বিন্তিদিদি। খানিক বাদে চোখের জল মুছে বলল, “আমার একটা কথা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না, বিন্নির মতন লক্ষ্মীমন্ত মেয়েকে কেউ কেন অপহরণ করবে? আর আমরা বাড়িভরতি লোক কেউ টের পাব না?”

“বিন্নি তো খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে, তাই না বিন্তিদিদি? ও নিজে থেকেই কোথাও গেছে, এমনটা নয় তো?” জিজ্ঞাসা করে খগেন।

“বিন্নি না বলে কোথাও যাওয়ার মেয়ে তো নয়। আর তাছাড়া, গ্রামের সমস্ত বাড়িতে খোঁজখবর নেওয়া হয়ে গেছে। বিন্নি কোত্থাও নেই।”

“আমার জ্যাঠামশাই নিজে ব্যাপারটা দেখছে বিন্তিদিদি। তুমি এতটুকু চিন্তা কোরো না। দেখো না, কত বছরের হারানো ডমরু আমরা আজ ফেরত পেলাম! নিশ্চয়ই বিন্নিকেও আমরা খুঁজে পেয়ে যাব খুব তাড়াতাড়ি।”

“তাই যেন হয় ভূপি, তাই যেন হয়।” ভূপির কথায় বুঝি সামান্য একটু আশার আলো দেখা দিল বিন্তিদিদির মনে।

॥ ৫॥

আমরা নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে ঢাকনা তোলার কাজকর্ম দেখছি। সকালে নিমাই-মাস্টারের বার্তার পর জ্যাঠামশাই পৌঁছে যান থানায়। সেখানে নিশ্চয়ই কোনও গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়ে থাকবে। কারণ তারপরেই গ্রামের কিছু লোকজন আর আরক্ষী সঙ্গে নিয়ে পুলিশের দলবল লেগে পড়ে মাটি খোঁড়ার কাজে, ঠিক যেখানে নিমাই-মাস্টার নির্দেশ দিয়েছিলেন খুঁজে পাওয়া ডমরুর।

মিঠে শরতের সকাল গড়িয়ে বেলা আর লোকজনের ভিড় তালে তাল রেখে বাড়তে লাগল। তার মধ্যেও উদগ্রীব হয়ে আমরা মুখিয়ে আছি। এই বুঝি চমকপ্রদ কিছু উদ্ধার হল, সেটা দেখার কৌতূহল ছাড়তে পারছি না।

এখানকার পুলিশ ইন্সপেক্টর হিমবন্ত রাহা, আমাদের হেমুকাকা শুনলাম জ্যাঠামশাইকে ফিসফিসিয়ে বলছেন, “আমার একটা জায়গায় খটকা লাগছে স্যার। এই সোনার ডমরু আপনারা ফেরত পেলেন প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, তাই তো?”

“হ্যাঁ ঠিকই বলেছ, সেরকমই হবে। আমি এই জিনিস এর আগে কোনোদিন হাতে নিয়ে দেখিনি।”

“কিন্তু ভেবে দেখুন তো,” ফের বললেন হেমুকাকা, “এ-জিনিস দেখে কি মনে হচ্ছে যে এত বছর এখানেই পড়ে ছিল? মানছি, নদীর চলনপথ বদলেছে, জায়গাটায় আরও বাঁক নিয়েছে গঙ্গা। কিন্তু আপনার কি বিশ্বাস হয় যে এই জিনিস এত বছর জলের তলায় কাদামাটিতে পড়ে ছিল? জোয়ারের সময় তো এদিকটা সম্পূর্ণ ভেসে যায়।”

“তুমি ঠিকই বলেছ হেমু। আমার কিন্তু জিনিসটা দেখে মনে হয়নি এর অতটাও ক্ষয় হয়েছে যতটা হওয়া উচিত ছিল। খুব বেশিক্ষণ আগেও যে এইটা এখানে পড়ে ছিল, এমনটা কিছুতেই মনে হয় না।”

“কিন্তু আমরা এই ব্যাপারে সুনিশ্চিত যে নিমাই-মাস্টার এখান থেকেই জিনিসটা উদ্ধার করেছেন।”

কথোপকথন কানে এলেও উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম মাটি খোঁড়ার কাজ। জোয়ার আসতে আর কিছুক্ষণ। তার আগেই যদি না জায়গাটা পরিষ্কার করা যায়, তাহলে সমস্ত আবার জলের তলায় চলে যাবে। তখন আবার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

“বিন্নির ব্যাপারটা কিছু এগোল?” জ্যাঠামশাই ফের জিজ্ঞাসা করলেন।

“কয়েকজন পুলিশকর্মী বহাল করা হয়েছে, নতুন খবর পেলেই আপনাকে জানাব স্যার।”

গভীর চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল জ্যাঠামশাইয়ের কপালে। এমন সময় নদীপাড়ে কর্মরত লোকগুলো সমবেতভাবে ডেকে উঠল। সবাই দৌড়ে গেলাম সেদিকে। একটা বিশালাকার লোহার ঢাল আগেই সরানো হয়েছে মাটি থেকে। তার নীচে পাওয়া গিয়েছিল আর-একটা গম্বুজাকার লোহার ঢাকনা। এইমাত্র সেটা সরাতেই বেরিয়ে পড়েছে একটা প্রশস্ত সুড়ঙ্গপথ। গুপ্তপথ! গ্রামের পাশেই আমাদের চোখের তলায় এতদিন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল এই কবেকার বন্ধ হয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গ। কী আছে এর ভেতরে? কবে, কারা, কতকাল আগে এর ব্যবহার করত? কোথায় এর শেষ? সে অবশ্য আমাদের জানার উপায় নেই, যতক্ষণ না ওর মধ্যে তরতরিয়ে ঢুকে পড়া পুলিশকাকারা খবর উদ্ধার করে আনছেন।

হঠাৎ কানে এল তীক্ষ্ণস্বরে কেউ ডাকছে। ডাকছে, না আর্তনাদ করছে? আওয়াজটা ভেসে আসছে নদীপাড় সংলগ্ন শালবন থেকে। ওখানে তো কেউ সচরাচর ঢোকে না। কয়েকজন পুলিশকাকা আর নিমাই-মাস্টার দৌড় লাগালেন সেদিকে, আমরাও পিছু নিলাম তৎক্ষণাৎ।

॥ ৬॥

শালবনটা বরাবরই নিরিবিলি। দিনের বেলাতেও আমরা ভুল করে এদিকটায় পা বাড়াই না। কেমন যেন অকারণেই গা ছমছমে পরিবেশ। নিমাই-মাস্টার যে সোজা ওই জঙ্গলে ঢুকে গেলেন সবাইকে নিয়ে! তাই বলে আমরা ছোটোরা সেখানে কোন সাহসে ঢুকি?

খগেন সাহস জুগিয়ে বলল, “চল না, বড়োরা তো আছে আমাদের সামনে। দেখ চারদিকে এখন দিনের আলো। ভয় কীসের?”

সেটা শুনে কাঞ্চা বলল, “সামনে থাকলেও পশ্চাতে যে কে আসবে সেটা কি আর জানা আছে? আর এখানেই তো সেই কালী মায়ের মন্দির আছে যেখানে এককালে কীসব পৈশাচিক কাণ্ড হত—শুনিসনি সে কথা? ওই মন্দিরের আশেপাশে দিন হোক বা রাত, কারোরই যাওয়া উচিত নয়।”

ভূপি বলল, “জানিস, এই মন্দির আর তার আশেপাশের জমির ব্যাপারে বহুকাল ধরে অনেক অদ্ভুতুড়ে গপ্প শুনেছি। জ্যাঠামশাই এই এলাকা আর মন্দিরের সংস্কার করে জায়গাটা ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে চায়। সাধারণ মানুষের জন্য এই জায়গাটা অকারণেই আতঙ্কের হয়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু ওপরমহল থেকে অনুমতি পায়নি। বাড়ির সকলেরও এতে প্রবল আপত্তি। জেঠিমা বলে, এইসব জঙ্গুলে জায়গায় না জানি কী বিপদ লুকিয়ে আছে—কী করতে গিয়ে কার অভিশাপ এসে পড়বে! এরকম জায়গা আবার সংস্কার করাটা কি সুবিধাজনক? তাই আমি বলি কী, ওদিকে যখন সবাই গেল, চল না আমরাও একবার গিয়ে দেখে আসি ব্যাপারখানা কী। এমনিতে তো না-হলে ওদিকটায় একলা যাওয়া অসম্ভব।”

আমরা ঢোঁক গিলে সম্মত হলাম। তারপর দুরুদুরু বুকে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম শালবনের ভেতরে। দিনের বেলাতেও শুনশান, থমথমে ভাব। কারা যেন আড়ি পেতে শুনছে আমাদের সমস্ত চলাফেরা, শ্বাস-প্রশ্বাস। পায়ের তলায় শুকনো পাতার মচর-মচ আওয়াজে একটা নাম-না-জানা বিশাল পাখি ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। কাউকে কি জানান দিতে গেল সে, যে আমরা এসেছি? ঝপাং করে ওই আর্তনাদ করে ওঠা বিপদ যদি আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে, তাহলেই-বা আমরা কী করব?

আমাদের সামনে পুলিশকাকারা এগিয়ে গেছেন, কাউকেই দেখা যায় না। প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর আমরা এসে পৌঁছলাম সেই ভগ্ন কালীমন্দিরের সামনে। পৌঁছেই ধড়াস করে উঠল আমাদের বুকটা। কেউ কোত্থাও নেই। তবে বড়োরা শালবন দিয়ে গেল কোথায়?

“ভূপি, এখানে যে কেউ নেই!” কাঁপা গলায় বলল পুকাই।

“চল চল ফিরে যাই।” বলল খগেন।

কিন্তু ঠিক তখনই আমার চোখে কিছু একটা পড়ল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম—“ওইটা কী বয়ে আসছে? রক্ত যে!”

এগিয়ে গেলাম মূল মন্দিরের ভেতরে।

আমার আচমকা চিৎকারে কতগুলো বাদুড় উড়ে পালাল, কিন্তু তখন আর কোনোদিকে আমাদের নজর নেই। ভাঙা কালীমন্দিরের দরজা দিয়ে কয়েক শত বছরের পুরোনো মা দুর্গার মূর্তি দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, কালীমন্দির হলেও দীর্ঘকাল আগে মা দুর্গাকে বিভিন্ন অবতারে পুজো করা হত এখানে। আর সেই বিশালাকায় দুর্গাপ্রতিমার পায়ের তলাতেই পড়ে আছে কেউ। তারই উৎস এই রক্তের সরু স্রোত। ভীষণভাবে ভয় পেয়ে হুড়োহুড়ি করে সরে যাচ্ছিলাম আমরা, কিন্তু পরক্ষণেই একটা কণ্ঠস্বরে আমাদের চক্ষু কপালে ওঠার জোগাড়!

“হেইইইই!”

এ যে বিন্নির গলা! চকিতে ফিরে দেখি, ওই তো, মূর্তির একদম পেছন দিক থেকে উঁকি মারছে একটা ফ্যাকাশে মুখ। বিন্নির উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে যেটা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল আর বেরিয়ে এল আমাদের সমবেত বিস্ময়, সেটা হল বিন্নির হাতে ধরা ধাতব জিনিসটা। কোথা থেকে একফালি রোদ্দুর এসে পড়েছে বিন্নির ওপরে আর সেই কাঁচা সোনা রোদ্দুর গায়ে লেগে ঝলসে উঠেছে ওর হাতে ধরা সোনার ত্রিশূল!

“এ যে দুর্গা মায়ের ত্রিশূল!” চমৎকৃত হয়ে বলল ভূপি।

॥ ৭॥

আমরা সবাই ফের জড়ো হয়েছি ভূপিদের বাড়ির বড়ো মন্দিরের সামনে। এবার আমাদের মধ্যে ঠাম্মি আর বিন্নিও উপস্থিত। হরিশজ্যাঠার প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে আবার। সেইটাই দেখছি আর চলছে মুড়ি-বেগুনি সহযোগে জোরদার আলোচনা।

“তোর ধারণা নেই বিন্নি, তুই কাদের ধরিয়ে দিয়েছিস আমাদের হাতে, কতটা সাহায্য করেছিস আমাদের তদন্তে!” সগর্বে বললেন হেমুকাকা।

কালীমন্দিরে বিন্নির সঙ্গে দেখা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা দেখেছিলাম, উলটোদিকের দেওয়াল, থুড়ি ছদ্ম-দেওয়াল ঠেলে বেরিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন পুলিশকাকা। তাঁদের সঙ্গে ঘাড় ধরে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়েছিলেন লম্বা-চওড়া দশাসই চেহারার একটা লোককে। হাতে ছিল তার ইয়া বড়ো বড়ো মাকড়ি, কোমরে কোঁচানো লাল ধুতি, মাথায় মস্ত পাগড়ি।

“বের করছি তোদের যত অপকর্ম! চল, চল এখনই!” ধমকের সঙ্গে হাতকড়া পরানো লোকটাকে প্রবল ধাক্কা দিতে দিতে পুলিশেরা অবশেষে থানায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছিলেন।

কিছুক্ষণ পরেই দেখেছিলাম নিমাই-মাস্টার সেই ছদ্ম-দেওয়াল ঠেলে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তবে আমাদের উপস্থিতিতে একটুও বিচলিত না হয়ে বিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “ঘরে চল বিন্নি। রাজকীয় কাজ করলি যে!”

“আর ওই লোকটা স্যার?” মাটিতে লুটিয়ে থাকা লোকটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল বিন্নি।—“ওই অসুরকে আমি মনে হয় বধ করে ফেলেছি।”

“চিন্তা নেই, বেঁচে আছে। সুস্থ করার পর থানায় দেওয়া হবে, তুই একদম ভাবিস না। এত সহজে বধ হলে ওদের পুরো দল ধরা পড়বে কী করে? ওদের অপরাধ আটকাতে গেলে ডাকাত দলের পুরো চক্রান্ত জানতে হবে না?”

ভূপির জ্যাঠামশাই খবর পাঠাতে বিন্নির বাড়ির লোকজনও এসে উপস্থিত হয়েছে। সকলেই বিন্নিকে বাহবা জানাচ্ছে।

হেমুকাকার কথায় বিন্নি জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আমি ঠিক কাদের ধরালাম বলো তো হেমুকাকা?”

“এরা কারা সেটা তো আগে বল? তুই আদৌ এদের চিনলি কী করে বিন্নি?” স্তম্ভিত বিন্নির বাবা।

‘এরা বহু পুরোনো একদল ডাকাত গোষ্ঠী।” উত্তর দেয় বিন্নি।—“খেলা থেকে ফেরার পথে আচমকাই এদের দেখে ফেলি একদিন। সন্ধ্যাবেলায় শালবনের মধ্যে কয়েকজন অদ্ভুত বেশের লোক চুপিচুপি মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে কিছু খুঁজছিল। ওদের দেখেই মনে হয়েছিল ডাকু না হয়ে যায় না। তারপর আর-একদিন দেখতে পেলাম নদীপাড়ে।”

“তু্ই শালবনে আর নদীর পাড়ে একা গিয়েছিলিস বিন্নি!” সবিস্ময়ে বলে ওঠে বিন্তিদিদি, বিন্নির দিদি।—“বাড়ি ফেরার পথ তো উলটোদিকে। আর তুই এমন ভিতু মেয়ে, তুই সন্ধের দিকে গেলি ওইসব নিরিবিলি জায়গায়?”

“আসলে আমি প্রথমবার ওই লোকগুলোকে দেখার পরে বন্ধুদেরও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারপর ভাবলাম কেউ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে, আমাকে সঙ্গ না দেয়, উলটে বাধা দেয়? তাই মনস্থির করলাম একলা গিয়েই দেখে আসি। কেমন অদ্ভুত পাখি ডাকার আওয়াজে কথা বলত ওরা। ওই যে, বলে না—সংকেত, ওই সাংকেতিক ভাষায় কথা বলত বলেই আমার বিশ্বাস। আমারও আগ্রহ বেড়ে গেল। আর ভয়? আমি ভিতু বলে আমাকে স্কুলের দিদিমণিরা প্রায়ই বকেন। এই তো সেদিন নিমাই-স্যার আমাকে ডেকে বুঝিয়ে বললেন, ‘সবেতে এত ভয় পেলে চলবে বিন্নি? পা বাড়িয়ে, চোখ-কান খুলে দু-দণ্ড পৃথিবীটাকে উপভোগ কর। আমাদের নীল গ্রহমণ্ডলীকে প্রাণ ভরে দেখ, তবেই দেখবি কত সুন্দর চারদিকটা। সব ভয় কেটে যাবে।’ তাই তো আমি অনেক সাহস সঞ্চয় করে যাচাই করতে গিয়েছিলাম। যদি একটু বীরত্বের কাজ করতে পারি আবার ভয়ও কাটাতে পারি—এই আর কি।”

“বিন্নির এই ভয় কাটানো অভিযানের কথা আমি গতকাল রাত্রে জানতে পারি।” এবার বললেন ভূপির জ্যাঠামশাই—“তবে যদি এর আগে জানতে পারতাম, তাহলে আমাদের গুপ্ত তদন্ত আরও আগেই হয়তো তরতরিয়ে এগিয়ে যেত।”

“দিন দুয়েক হল দেখছি। কিন্তু কী দেখছি তাই তো ঠিক বুঝিনি, বলব কী জ্যাঠামশাই? মানে এটা যে এত বড়ো বিপদের দিকে আমাদের গ্রামকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে, সেটা তো ভাবতেই পারিনি।” বলল বিন্নি—“শুধু দেখছিলাম কতগুলো লোক অন্ধকারে চুপিচুপি মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করছে জঙ্গলের মধ্যে। হন্যে হয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে। কত লোকই তো এই নদী দিয়ে যাতায়াত করে, তাদের তো চিনি না, তাদের ক্রিয়াকলাপেও নাক গলাই না। তবে যদি বুঝতাম এরা এত ভয়ানক লোকজন, তাহলে দু-দিন আগেই সবকথা এসে বলতাম।”

“জানি রে মা।” বিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হাসলেন জ্যাঠামশাই।—“কিন্তু ভাগ্যিস তুই ভূপির ঠাম্মিকে সবকথা জানালি। তাই তো পরিকল্পনা করে আমরা এমন ফাঁদ পাততে পারলাম। না-হলে তোর তো বড়ো বিপদ হতে পারত।”

“কী হয়েছিল একটু বলেন দেখি?” এবার আর বিস্ময় চেপে রাখতে পারেন না নিমাই-মাস্টার।—“আপনারা তো দেখছি অনেক কিছুই জানতেন। এসব আপনাদের মিলিত পরিকল্পনা ছিল নাকি?”

আমরাও ততোধিক আগ্রহ নিয়ে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট দেখার মতন একবার এর মুখের দিকে তাকাই, একবার ওর।

“আমি সবটা বলছি স্যার।” বলল বিন্নি।—“গতকাল তখন সন্ধে প্রায় হয়ে এসেছে, শালবনের ভেতরে ঢুকে কিছুদূর এগোতেই আমি আবার ওই অচেনা লোকগুলোর সন্দেহজনক কাণ্ড দেখে ফেলেছিলাম। আমি ছিলাম একটা ঝোপের আড়ালে, তাই আমাকে অত অন্ধকারে ওরা দেখতে না পেলেও, আমি ওদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বেশ কতগুলো মস্ত ঝুলি রাখা ছিল যত্রতত্র। কী ছিল সেইসব ঝুলির সংগ্রহে জানি না, তবে ঝোপের আড়ালে আর-একটু ভালোভাবে আড়াল হতে গিয়ে একটা জিনিসে পা লেগে যায়। আমি না বুঝে সেটাকে তুলতে গিয়ে খানিক বেজে উঠল। একটা কত পুরোনো ডমরু! কিন্তু ওই আওয়াজ পেয়েই আমাকে একজন দেখে ফেলল। তখন আমি অবশ্য খুব ভয় পেয়ে যাই। কোন দিকে যাব বুঝতে না পেরে দৌড়তে শুরু করি শালবনের ভেতর দিয়ে। তারপর বেরিয়ে আসি নদীপাড়ে। একটা লোক আমাকে তাড়া করছিল। আমি বুঝলাম আমার ওই নেওয়া জিনিসটার জন্যই বুঝি ছুটে আসছে, তাই ভয়ে দূরে নদীর দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমি আবার দৌড়াতে লাগলাম। আর পিছন ফিরে দেখিনি। ততক্ষণে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে। ভালো দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু অনুমান করলাম যে আমাকে আর কেউ ধাওয়া করছে না। তবু বলা কি যায়, কে কোন আড়াল থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছে? সুযোগ পেলেই যে ঝপাং করে ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না, এমনটা তো জানা নেই। তাই কালবিলম্ব না করে গ্রামে ঢুকে সবার আগে যে-বাড়িটা পড়ে, আমি দৌড়ে সোজা সেখানেই, মানে ভূপিদের বাড়িতে ঠাম্মির কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তোমরা কেউই তো ছোটোদের কথা বিশ্বাস করো না। কিন্তু আমি জানি আর কেউ না করুক, ঠাম্মি আমার সবকথা বিশ্বাস করবেই করবে।”

“মা কাল রাতেই জানতে পেরেছিলেন বিন্নির কীর্তির কথা।” বললেন জ্যাঠামশায়।

“আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়ে তখন হাঁপাচ্ছিলাম। আর বলেছিলাম, অসুর ধাওয়া করেছে আমাকে ঠাম্মি, অসুর!” ফের বলতে থাকে বিন্নি।—“ওই যে, পুরোনো কালীমন্দিরের ভেতরে ওই লোকটা মাটিতে পড়ে ছিল না? ওই লোকটিই তো ধাওয়া করেছিল গতকাল রাতে।”

“ঠাম্মি তো আমাদের কাউকে কিছু বলেনি!” ভূপি অবাক হয়ে বলল।

“ঠাম্মি তোদের কিছু না বললে কী হবে, আমাকে শান্ত করে বসিয়ে অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করছিল গতকাল।” আবার বলল বিন্নি—“যেমন, ওই লোকগুলোর পরনে কেমন জামাকাপড় ছিল, কেমন চেহারা, কোনও কথা বলেছিল কি না, কী অস্ত্র ছিল ওদের হাতে—আরও কত্ত কিছু।” বলল বিন্নি।

“তারপর?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

“যেই আমি বললাম ওদের পাখির মতন ডাক শুনেছিলাম, কোনও কথা বলতে শুনিনি, তক্ষুনি ঠাম্মি জিজ্ঞাসা করল ওরা কী রঙের পাগড়ি পরেছিল আর হাতে কিছু ছিল কি না। লাল টকটকে রঙের পাগড়ি আমি অত অন্ধকারেও ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম। আর সবসময় ওদের কাছে লাঠি থাকত, কানে আর হাতে ইয়া মোটা মাকড়ি আর বালা। চোখে কাজল, কপালে এদের লম্বা লাল তিলক।”

“এখানে আমি একটু বলি।” বলে উঠলেন হেমুকাকা।—“নদীর ও-পাড়ের গ্রামগুলোকে উত্যক্ত করতে থাকা ডাকাত দল এরা। শোনা যায়, এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলার হারানো পোক্ত লাঠিয়াল। আন্তঃজমিদার বিরোধের মীমাংসা করতে অথবা অবাধ্য প্রজাদের দমন করতে প্রায়শই বেসরকারি লাঠিয়াল নিয়োজিত হত। তবে ১৯৫০ সালে লাঠিয়ালবাহিনী সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেলেও অনেক লাঠিয়াল ওই সময় জমাদারি, চৌকিদারি এইসব কাজে লেগে পড়ে। তাদের মধ্যে কয়েকজন বেকারত্বের ফলে লাঞ্ছনায় থাকে, সুযোগ পেয়েই ডাকাতের দলে যোগ দেয়। এই পরিণত লাঠিয়ালদের অথবা বলা ভালো, ডাকাতের দলকে সব্বাই চেনে তাদের তাজ্জব পোশাক-আশাকের কারণে। এদের সাজপোশাকে দেখতে লাগে ভয়ংকর, কাজকর্ম আরও ভয়ংকর। এরা যে বছর কয়েক আগে পর্যন্ত খুব একটা সক্রিয় ছিল, সেটা বলা চলে না। কিন্তু হঠাৎ এরা কার্যকরী হয়ে উঠেছে। কেন? কারণ শোনা যায়, এরা এখন সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তলে তলে অনেক বড়ো মতলব আঁটছে।”

“যদি এই ছোট্ট মেয়েটা আজ এত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে না আসত, তাহলে সাংঘাতিক কেলেঙ্কারি হতে পারত। আমরা এদের হদিস পাওয়ার আগেই হয়তো এদের কোনও মস্ত অপকর্ম সারা হয়ে যেত।” বললেন জ্যাঠামশাই।

“আচ্ছা, বিন্নি কি তার মানে এই লাঠিয়ালদের হাতে অপহৃত হয়নি? এগুলো সবই পরিকল্পনামাফিক কোনও ফাঁদ পাতা হয়েছিল?” জিজ্ঞাসা করলেন বিন্নির বাবা—“আর তাই জন্যই আপনি আমাকে সকালে থানায় ডেকে পাঠিয়ে খবর দিলেন যে বিন্নি একদম সুরক্ষিত আছে?” হেমুকাকার দিকে এবার তাকালেন বিন্নির বাবা।

“হ্যাঁ। বুঝতেই পারছেন, ওই মুহূর্তে আমার হাত-পা বাঁধা ছিল, তাই তখন বেশি তথ্য দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিলাম মাত্র।”

“ব্যাপারটা কী? এরাই তার মানে সেই লাঠিয়ালেরা, যারা নদীর ও-পাড়ের গ্রামের ঘরগুলোতে হানা দিত, সব্বাইকে অতিষ্ঠ করে বেড়াত ইদানীং?” জিজ্ঞাসা করলেন নিমাই-মাস্টার।

“ঠিক ধরেছেন স্যার, এরাই তারা। যেটুকু জানা গেছে, বহুদিন যাবৎ এক সন্ত্রাসবাদীর দল ইংরেজদের উপনিবেশিকতার সময়কার কিছু হারিয়ে যাওয়া সম্পদ খুঁজছিল। এমন সময় বহু পুরোনো কিছু মানচিত্র এসে পড়েছিল তাদের হাতে। তারা খোঁজ পেয়ে যায় প্রচুর হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রের। দুর্লভ সেই সমস্ত মানচিত্র অনুযায়ী, চোরাচালান কারবারের জন্য একটা বিশেষ সুড়ঙ্গপথের ব্যবহার হত। খবর পায়, সেই সুড়ঙ্গপথ সমুদ্র বাণিজ্যের একটা প্রসারিত পথ। অখ্যাত সেই পথ ঢাকা পড়ে আছে বহু বছর। এরা সম্প্রতি সেই সুড়ঙ্গপথ সন্ধানের কাজ শুরু করেছিল। সাধারণ গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের অথবা বেআইনি গুপ্তচর খোঁজা একটা অজুহাত মাত্র। এরাই আসলে এখন সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামবাসীদের মধ্যে কেউ এই সুড়ঙ্গের কথা জানে কি না, সেটা বের করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। তাদের জমি-জায়গা-বাগানে লক্ষ রাখছিল। আসলে খুঁজছিল সেই বহু বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গপথ। জানা গেছে, পুরোনো মানচিত্র আর পুথিপত্র ঘেঁটে ওরা নিশ্চিত হয়েছিল যে নদী বরাবর এই এলাকাতেই আছে বহু বছরের পুরোনো সেই গুপ্ত পথ। একেবারে ঘন বসতির মধ্যে, ভাবতে পারছেন? যদি একবার সেটা খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সেটা কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও সাজানো হয়ে গিয়েছিল। কেউ জানতেও পারবে না, নদীকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের বুকের মধ্যে ঘটে চলবে ওদের অপকর্ম।”

“সেইসব তো নদীর ও-পাড়ে বললেন। এতকাল তো এদিকে ওরা কেউ হানা দেয়নি। তাহলে আকস্মিকভাবে এখানে আসার সূত্রটা পেল কবে আর কীভাবে?” প্রশ্ন করেন বিন্নির কাকা।

“আমরা যেটুকু তথ্য পেয়েছি, তাতে দাঁড়াচ্ছে যে ওদের কাছে যে মানচিত্র ছিল, সেটা জরাজীর্ণ। বেশ কিছু জায়গায় বুঝতে ভুল হয়েছিল। নতুন মানচিত্র হাতে পেয়ে ওরা জানতে পেরেছিল যে জায়গা আন্দাজ সঠিক হলেও, নদীর ভুল দিকে সন্ধান করছে। গঙ্গার ও-পাড়ে কোনোদিন কিছু ছিলই না। এটা জানার পরেই আমূল পরিবর্তন আসে ওদের পরিকল্পনায়।” বললেন হেমুকাকা।

“আমরা কয়েক মাস যাবৎ তদন্ত চালিয়েও ওদের ধরতে পারছিলাম না। তবে আমার ধারণা, আমাদের এলাকার এদিকে ওদের কাজকর্ম খুব প্রাথমিক স্তরে শুরু হয়েছিল।” বললেন জ্যাঠামশাই—“যে ভুল ওরা নদীর ও-পাড়ে করেছিল, সেটার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক, সেই কারণে দলবল নিয়ে কাজে নামার আগে ওরা সুনিশ্চিত হতে চেয়েছিল, যে এবারের মানচিত্রে দাগানো এলাকাটি আসলে সঠিক তো? তাছাড়া, পুলিশ ওদের কাজের ধরনে হুঁশিয়ার হয়ে যাওয়ায় এখানে ওদের ধরা পড়ে যাওয়ার সুযোগও বেশি। সেই কারণেই হামলা না করে চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যাচ্ছিল। আমাদের বহু বছরের লুপ্ত ডমরু ওদের হাতে এসে পড়ে নদীর ও-পাড়ে একটা ভগ্ন বাড়ির এককালীন অন্দরমহল থেকে। তার মানে, নদীর জলে ভেসে গিয়ে দৈবক্রমে ও-পাড়ে পৌঁছে গেছিল ডমরু। সেখান থেকে কেউ এই ডমরু তুলে নেয়। বিন্নি সৌভাগ্যক্রমে লোকগুলোকে দেখতে পেয়ে যায়, না-হলে তো ওরা আমাদের চোখে ধরা পড়ার আগেই হয়তো নিজেদের কাজ সমাপন করে ফেলত। আমাদের আগেই সুড়ঙ্গের দুই দিক বের করা হয়ে যেত ওদের। তারপর, কে বলতে পারে এরপর ওরা কী করত, আমাদের সাধারণ মানুষের কতরকম ক্ষতি হত? সবথেকে বড়ো কথা, এ তো ওদের মস্ত অনৈতিক দেশদ্রোহী কাজ!”

“আচ্ছা! তবে কি নদীপাড়ে খুঁজে পাওয়া ওই প্রবেশপথটি আমাদের গ্রামে হারিয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গপথটা?” বেশ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে উঠলাম আমি।

“হ্যাঁ নারান, আমরা তো সেটাই খুঁজে বের করলাম।” বললেন জ্যাঠামশাই।

“ওটা কোথায় গিয়ে শেষ হচ্ছে?” উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল পুকাই।

“সেই ভগ্ন কালীমন্দিরে।” হেমুকাকার উত্তর।

চমকে উঠলাম আমরা। সবটা এবার আস্তে আস্তে জলের মতন পরিষ্কার হতে লাগল। আর সেই ধারণা সুনিশ্চিত করলেন হেমুকাকা।—“ওই নদীপাড়ের সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ আমরা দৈব্যবলে খুঁজে পেয়েছি। না-হলে সেটা বের করা যথেষ্টই মুশকিল। বহু বছর আগে নদীপথ দিয়ে আসা বহু বাণিজ্যিক নৌকার চলাচল ছিল। এর মধ্যে কোনও নৌকা বোঝাই করা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে টুপ করে এই সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করা ছিল অত্যন্ত সহজ। এখানে সবটাই আগে ছিল জঙ্গল। ধারেকাছে না ছিল বন্দর, না কোনও গ্রাম বা ঘাট। কিন্তু এর শেষ কোথায়? কোথাও তো সুনিশ্চিতভাবে এসব অস্ত্রশস্ত্র খালাস করতে হবে। এত বড়ো নদীর পাড়ে সঠিক কোথায় যে প্রবেশপথ, সেটা খোলা আকাশের তলায় মাটি খুঁড়ে বের করতে গেলে মানুষজনের চোখে পড়বেই। তাছাড়া এইসব এলাকায় সবসময় পুলিশের কড়া নজর থাকার কারণে ওই লাঠিয়ালদের দল সরাসরি নদীর ওপর ওদের খননের কাজ চালাতে পারেনি। ওদের শুরু করতে হয়েছিল সুড়ঙ্গের অন্য মুখ খোঁজার কাজ। আমরা যেখানে বিন্নিকে  খুঁজে পেলাম, সেটা ছিল এক বহু পুরোনো কালীমন্দির। কে অথবা কারা এই মন্দির স্থাপন করেছিল সেটা সঠিক জানা নেই, কারণ এর আশেপাশে সেই সময়ে কোনও গ্রাম ছিল না। এই মন্দির স্থাপন করার পেছনে একটা বড়ো উদ্দেশ্য ছিল—এই জায়গাটা চিহ্নিত করে রাখা। সেই সময় এই জায়গা একরকম দুর্গম ছিল, সাধারণ মানুষজনের চলাচল ছিল শূন্যপ্রায়। তাই চেনার সুবিধা হলে, সেটা একমাত্র তাদেরই হবে যারা এই মন্দির আর সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ করেছিল। এই মূল মন্দির প্রাঙ্গণের ঠিক পেছনে সুড়ঙ্গের শেষ, যেটা পরিমার্জিতভাবে ঢাকা হয়েছিল সামনের দেবীমন্দির দিয়ে।”

“ঠিক সেই কারণেই,” কথার হাল ধরলেন এবার জ্যাঠামশাই—“সাধারণ মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য শোনা যায় এই মন্দিরে নৃশংস সব কাণ্ড হত। এমনকি দেবীর আরাধনার নাম করে বলি পর্যন্ত হত বলে রটনা আছে। এত কাছে গ্রাম গড়ে ওঠার পরেও আজ পর্যন্ত কেউ ভুলবশত এদিকটায় আসত না, এসবের আতঙ্কে।”

“হ্যাঁ স্যার। আপনি বহুবার এই এলাকা জরিপ করে পরিমার্জিত করার প্রস্তাব দিলেও ওপর মহল থেকে সেটা নাকচ হয়ে এসেছে বরাবর। আমরা এগোতে পারিনি। এখন দেখছেন তো, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ল!” বললেন হেমুকাকা।

“যা বলেছ।” সায় দিলেন জ্যাঠামশাই।

“কিন্তু এইসবের মধ্যে বিন্নি কীভাবে আপনাদের সাহায্য করল, সেটাই তো বোধগম্য হল না।” মাথা চুলকালেন নিমাই-মাস্টার।

“এই এত বড়ো বিপজ্জনক ঘটনা রুখতে ও এগিয়ে এসেছিল, এ যে আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!” বিন্নির বাবাও বললেন।

“সে-কথায় আসছি। আমি বেশ বুঝতে পারছি বিন্নি, মা গতকাল রাত্রে তোর ওপর ভরসা রাখতে বলে একটুও ভুল করেননি।” স্মিত হেসে বললেন জ্যাঠামশাই।—“মা জানতেন, ডমরু যখন পাওয়া গেছে মন্দিরের আশপাশ থেকে, তখন ওই বদ লোকগুলোকেও পাওয়া যাবে। অতর্কিতে ওদের ধরাটাই হচ্ছে শ্রেয়। আর তোকে দেখতে পেয়ে গেলেও তখনও ওরা কেউ আন্দাজ করেনি যে ব্যাপারটা গুরুতর হতে পারে। না-হলে কি আর এত সহজে তোর পিছু ছাড়ত! তাই কাল রাত্রে যখন তুই সবটা জানালি, তখন তোর হাতে মা নির্দ্বিধায় নিজের ঘরে রাখা আসল অস্ত্র সিন্দুকের থেকে সোনার ত্রিশূল বের করে দিয়েছিলেন। ঠিক বলছি তো?”

“হ্যাঁ জ্যাঠামশাই, একদম ঠিক বলছ। ঠাম্মি আমাকে মা দুর্গার ত্রিশূল দিয়ে বলেছিল, এইটা আমারই সবথেকে বেশি প্রয়োজন ওই মুহূর্তে। মা দুর্গার অসুরদের বধ একমাত্র আমিই করতে পারব।”

“ঠাম্মি তোকে এত বড়ো ত্রিশূল দিল? আর তোকে বলল অসুর বধ করতে? তুই এত বড়ো ত্রিশূল নিয়ে কখন এলি ঘরে?” বিন্তিদিদির চোখ কপালে।

“ধুস, দরকার পড়লে নিতে বলেছে। ত্রিশূল তো ঠাম্মির ঘরেই ছিল।” বলল বিন্নি।

“তাহলে তুই কেন ভোরবেলা উঠে চলে গেলি? ভয় হল না যে ওই ডাকু লোকটা ধাওয়া করবে?” ততোধিক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল কাঞ্চা।

“ঠাম্মি জানিয়ে রেখেছিল, কোনও অসুবিধা মনে করলেই যেন আমি বড়োদের জানাই। প্রয়োজনে সরাসরি ঠাম্মির কাছে চলে যাই।”

“জানাসনি কেন রে মা?” আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন বিন্নির বাবা।

“অকারণ জানালে তোমরা হয় মানতে না, না-হলে ভয় পেতে। তুমি আর কাকা তর্পণ করতে বেরিয়ে পড়েছিলে ভোররাতে। কাকে জানাতাম? আমি তো দেখেছি লাঠিয়ালদের নামেই মা-কাকিমাদের মুখ শুকিয়ে যায়। আর বিপদ না এলে শুধু শুধু সবাইকে অতিষ্ঠ করে কি লাভ আছে? আজ মহালয়া বলে কথা, কত ব্যস্ততা বাড়িতে!”

“এ তোর ভারি বোকামি হয়েছে বিন্নি। সাহসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে যদি তোর কিছু হয়ে যেত?” বলে ওঠে বিন্তিদিদি।

“আহা, আপনারা এভাবে ভাবছেন কেন? যদিও গ্রামের কেউই জানত না, আমরা কিন্তু সতর্ক ছিলাম গত কয়েকদিন থেকে। বিন্নির কথা শোনার পর গতকাল রাত থেকেই কড়া পাহারায় ছিল গোটা গ্রাম। বিন্নি সব বলতে চায়, ওর মুখ থেকেই শুনুন না সে-কথা।” বললেন জ্যাঠামশাই।

“গ্রামে পাহারা বসেছে সে-কথা তো আর আমি জানতাম না। আমি তো আমাদের বাগানে ঝুপ ঝুপ আওয়াজ পেয়েছিলাম ভোরের দিকে।” ফের বলতে শুরু করে বিন্নি।—“মনে হলো কারা যেন এসেছে আমাদের বাগানে। তাই তো ভাবলাম, বড্ড ভুল হয়ে গেল, ঠাম্মির থেকে ত্রিশূলটা নিজের সঙ্গে এনে রাখলে ওদের তক্ষুনি শায়েস্তা করতে পারতাম।” মাথা নাড়িয়ে বীরদর্পে বলল সে।

“বলিস কী রে? তুই বয়োজ্যেষ্ঠদের খবর দিবি তো?” আবারও আতঙ্কিত গলায় বললেন বিন্নির কাকা।

“বললে কী করত? হুলুস্থুল কাণ্ড হতে পারত। প্রয়োজনে ডাকুরা জোর খাটিয়ে ঘরে ঢুকে ক্ষয়ক্ষতিও করতে পারত। তোমরা তো আর ত্রিশূল-কাহিনী জানতে না। আমি জানতাম। জানতাম ওটা থাকলে সহজেই আমরা সবাই রক্ষা পাব। তখন আকাশ সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে, তাই আমি পেছনের দরজা দিয়ে লুকিয়ে এক্কেবারে সোজা ঠাম্মির কাছে ত্রিশূলটা নিতে চলে গিয়েছিলাম। জেঠিমারা তখন মন্দির প্রাঙ্গনে। ঠাম্মি তখন ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু আমাকে গতরাতে বলেই রেখেছিল প্রয়োজনে ত্রিশূল নিতে হলে বাড়তি কাউকে সে খবর জানানোর প্রয়োজন নেই, যথাসময়ে সবাইকে সব জানানো হবে। তাই আমি নিজেই ডালা খুলে ত্রিশূল নিয়ে ফেরত যেতে যাই। কিন্তু বাড়ির পথে পা বাড়াতে গিয়ে ঘটল সেই আকস্মিক ঘটনা।”

“কী ঘটনা, কী হয়েছিল?” জিজ্ঞাসা করলাম আমরা সবাই। এই ভিতু পরিচিতির মেয়েটা যে এত রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে, সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমাদের।

“জ্যাঠামশায় আমাকে দেখে ফেলল। তখন সবটা জানাতে হল।” বিন্নি বলল।—“অবশ্য জ্যাঠামশাই সবটা আগে থাকতেই জানত, ঠাম্মিই জানিয়ে রেখেছিল। পরে জানলাম সেই কারণেই জ্যাঠামশাই একজন পুলিশকাকাকে নির্দেশ দিয়েছিল আমাদের বাড়িটা বিশেষভাবে চোখে চোখে রাখার। তাই তো সে সারারাত আমাদের বাড়ির বাইরে পাহারা দিচ্ছিল আর তার আওয়াজেই আমি ভেবেছিলাম ডাকু পড়েছে। জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে দেখা হতে আমাকে নিরস্ত করতে চাইল। বলল বড়োরাই সবটা সামলে নেবে। কিন্তু আমি রাজি হলাম না কিছুতেই। এরকম সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? আমি বললাম আমি দেখেছি লোকগুলোকে, আমি সাহায্য করব ওদেরকে ধরিয়ে দিতে। আমিও যে সাহসিকতা দেখাতে পারি, সেটা বোঝাতে হবে না? তাই জ্যাঠামশায় তখন আমাকে আজকের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল। আমি ইচ্ছে করে ওই ডাকু লোকটার নজরে পড়ে তাকে শালবনের দিকে নিয়ে এলাম। জঙ্গলময় পুলিশকাকারা নানান জায়গা থেকে পাহারা দিচ্ছিল। তাদের ধরে ফেলার কথা ছিল লোকটাকে, মাহেশের দিঘির কাছে। কিন্তু কীভাবে যেন সবার চোখ এড়িয়ে ডাকুটা কালীমন্দির অবধি পৌঁছে গিয়েছিল।” গোল্লা গোল্লা চোখ করে বলল বিন্নি।

“সে কি!” সমস্বরে বললাম আমরা।

“তারপর ঠিক কী হল বিন্নি? আর কেনই-বা তোকে এই ত্রিশূল ব্যবহার করতে হল?” বিন্নিকে উৎসাহ দিলেন জ্যাঠামশাই।

“ত্রিশূলটা আমি হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম, যেমনটা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলে তুমি জ্যাঠামশাই। ঠাম্মিও একই কথা বলে দিয়েছিল বার বার। আমি জানতাম আমার বিপদে এই ত্রিশূলই আমাকে প্রাণে বাঁচাবে। মন্দিরে পা দেওয়ার পরেই আমার কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল। কোনোদিন পুজো হতে তো আমরা শুনিইনি, উলটে কীসব ভয়ানক ব্যাপার হত বলে শুনেছি। কিন্তু তখন আমার আর ভাবার সময় ছিল না। ওই ডাকুটা একেবারে আমার কাছাকাছি চলে এসেছিল, তাই মরিয়া হয়ে আমি ভগ্ন মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পড়ি। মা দুর্গার মূর্তির আড়ালে লুকিয়েও পড়ি। কিন্তু কী যেন একটা হয়ে গেল জানো! লোকটা খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিল। আমাকে তখনও খুঁজে চলেছে। আমি একবার ভাবলাম উলটোদিক দিয়ে পালানোর পথ ধরব। কিন্তু আচমকা দেখি আর-একটা ডাকু মতন লোক—ওই যে যাকে ধরে তোমরা নিয়ে গেলে—সে উলটোদিক থেকে এগিয়ে আসছে।”

“কী সাংঘাতিক কথা বলছিস বিন্নি! তারপর তুই কী করলি?” বিন্তিদিদির চোখ বিস্ফারিত।

“তারপর আমি কিছুই করিনি—যা করার মা দুর্গা করল, আমি ঠিক জানি।” বিশালাকৃতির মা দুর্গার চেহারা মনে পড়ল বিন্নির কথায়।

“মানে?” জিজ্ঞাসা করলেন নিমাই-মাস্টার।

জ্যাঠামশাই দেখি অল্প অল্প হাসছেন। এটাও কি পরিকল্পনামাফিক কোনও কাণ্ড যেটার ব্যাপারে বিন্নি অজ্ঞাত ছিল?

“মুখোমুখি হতেই আমার হাতে ধরা ত্রিশূলটাই আমাকে যেন টেনে নিয়ে গেল ওই ডাকুটার দিকে। অলৌকিক মনে হলেও এটাই সত্যি। আপনা হতেই ত্রিশূলটা খুব জোর খোঁচা মারল লোকটার হাতে, ঠিক বালাটার কাছে।” বলল বিন্নি—“আর লোকটার চিৎকারে অন্য ডাকুটাও মনে হয় ভয় পেয়ে কোথায় পালিয়ে গেল।”

“তারপর?” জিজ্ঞাসা করলাম আমরা।

“তারপর আমি সাহস পেয়ে গেলাম। লোকটা ততক্ষণে চেপে ধরেছে তার হাতটা। সাহস পেয়ে তার দিকে এগোতে গেলাম, কিন্তু এইবারে ত্রিশূলটা গিয়ে বিঁধল ডাকুটার মাকড়ির কাছে, ঠিক কানের নীচে।”

“লোকটার আর্তনাদের স্বর আমরা শুনতে পেয়েছিলাম বিন্নি। সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটালি তো!” বললেন নিমাই-মাস্টার।

“আমি ভয় পেয়ে আবার লুকিয়ে পড়েছিলাম। ত্রিশূলে কী ছিল জানি না, আমাকে বাঁচিয়ে তো দিলই, লোকটা দেখলাম আমার ওই খোঁচাতেই নেতিয়ে পড়ল মাটিতে।” এখনও বিস্ময় কাটেনি বিন্নির।—“আর-একজন পালাল! ভাবা যায়!”

আমরা সকলে মুগ্ধ ওর কথা শুনে। মন বলছিল এ যে মা দুর্গার হাতে অসুর বধ!

“এই জায়গাটা আমি ঠিক বুঝলাম না—সোনার ত্রিশূল নিজে থেকে কী করে আক্রমণ করল লোকটাকে?” জিজ্ঞাসা করল পুকাই।

“আমি বুঝিয়ে বলছি।” বললেন জ্যাঠামশাই—“সোনার ত্রিশূলের ভেতরে মূল দাঁত বরাবর পুরো অস্ত্র বেয়ে নেমে গেছে একটা সরু চুম্বকীয় পাত। এই লাঠিয়ালদের হাতের বালা আর কানের মাকড়ি ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এগুলো লোহার তৈরি ভারী গহনা। ত্রিশূলের মাথাটা সেদিকেই ছিল যেদিক দিয়ে লোকটা এগিয়ে আসছিল, আর লোকটা একদম কাছাকাছি এসে পড়াতে, তার ওই লোহার বালার আকর্ষণে ত্রিশূল টান অনুভব করে। এই প্রবল টানই বিন্নিকে সামনের দিকে হ্যাঁচকা টেনে নিয়ে যায়। আর-একটা ব্যাপার—ত্রিশূলের মাথাটা পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে, ওখানে অল্প এমন কিছু পদার্থ মেশানো আছে, যেটা মানুষের চামড়া ভেদ করে রক্তে মিশলে, তাকে নিমেষে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। আজ সকালেই বিন্নি ত্রিশূল নেওয়ার আগে ওই ওষুধটা আমি নিজে লাগিয়ে দিই সেখানে। সেই কারণেই তো বলা, এই ত্রিশূল রক্ষা করতে পারবে বিন্নিকে। কী বিন্নি মা, করলে তো অসুরকে পরাজয়?” হেসে বিন্নির মাথায় সস্নেহে এবারে হাত বোলালেন জ্যাঠামশাই।

“অসমসাহসীনির কাজ করে দেখিয়েছে এই একরত্তি মেয়ে আজকে।” গর্বে বুক ফুলে গেল বিন্নির বাবার।

“কিছুটা পরিকল্পনা, কিছুটা ভাগ্য কিন্তু অনেকটা সাহস দরকার এই কাজের জন্য। আমাদের লোকজন চারদিকে ঘিরে থাকলেও কয়েক মুহূর্তের জন্য বিন্নি একেবারে একা হয়ে গেছিল আর তখনই দুর্বল হওয়ার জায়গায় ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এ যেন সাক্ষাৎ মা দুর্গা! আর ওর মধ্যে এই শক্তি দেখতে পেয়েছিলেন মা।” দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বললেন জ্যাঠামশাই—“তাই তো ওকে বিরত করেননি ওর প্রচেষ্টায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন পুরো ব্যাপারটা, যাতে আমরা আগাম পদক্ষেপ নিতে পারি।”

“ঘটনাচক্রে আমরা এক আবিষ্কার করে ফেললাম।” বললেন হেমুকাকা—“জোয়ার এসে যাওয়ায় তো নদীপাড়ের ওদিকের প্রবেশপথ আপাতত বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। কাজটা থেমে ছিল। কিন্তু বিন্নি মন্দিরে এসে পড়ায় আর অন্য পালিয়ে যাওয়া লোকটাকে ধরার তাগিদে আমরা সুড়ঙ্গের অন্য প্রবেশপথটাও পেয়ে যাই। বহু বছরের পুরোনো, স্তূপীকৃত কিছু বিস্ফোরক রাখা আছে সেদিকের সুড়ঙ্গের মুখে। উদ্ধারকাজ শুরু করে দিতে হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। তাছাড়া আমাদের এবার বিস্তারিতভাবে এই দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হবে, যারা এই একদা লাঠিয়ালদের অপকর্মের মূল হোতা।”

“কিন্তু জেঠু,” ইতস্তত করলেও প্রশ্নটা চুপিচুপি করেই বসল ভূপি, “অস্ত্র সিন্দুক বদলাল কে?”

“তোদের না জানালেও, সত্যি কথা এটাই যে আসল অস্ত্র সিন্দুক বরাবর তোদের ঠাম্মির ঘরেই থাকে। কালীপুজোর তিনদিন পর আসল সিন্দুক চলে যায় তোদের ঠাম্মির বাক্স-খাটের ভেতরে। ওখানেই থাকে সযত্নে। ঠিক মহালয়ার আগের দিন ভোর রাত্রে সেটা দিয়ে আসা হয় বড়ো মন্দিরে। সেই কারণেই তো নারান যখন সিন্দুক বদলির কথা বলল, তখন আমি চমকে গিয়েছিলাম। তাহলে কি আরও কেউ জানতে পেরেছে এই ব্যাপারে? কারণ, আমাদের তদন্ত চলছিল খুব গোপনীয় স্তরে—বুঝতে পেরেছিস নিশ্চয়ই? সিন্দুক তো এ-বছর বদলানোই হয়নি ভোর রাত্রে, সেটা মায়ের ঘরেই ছিল।”

“এত কিছু হয়ে গেল, অথচ আমরা কেউ টেরও পেলাম না!” অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বলল ভূপি।

॥ ৮॥

সকাল থেকে আকস্মিক এতগুলো ঘটনা একের পর এক চিত্রনাট্যের মতন হয়ে চলেছে, যে আমরা কেউই তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে দম ফেলার সময়টুকু পাইনি। অবশেষে সবকিছুর অবসানে এখন পুজোর আনন্দে মেতে উঠেছি। যাক! গ্রামের ওপর থেকে আসন্ন ফাঁড়াটা তাহলে কেটে গেল। সকলের মনটাই বেশ ফুরফুরে।

এখন আমরা সবাই ঠাকুরদালানের সামনের মাঠে বসে মা দুর্গার চক্ষুদান দেখছি। আসল অস্ত্র সিন্দুকও স্বস্থানে হাজির। ডালায় তার সগর্বে দর্পে বেড়াচ্ছে সিংহ! দুর্গাপ্রতিমার দুই হাতের মধ্যে ধরা সোনার ঝকঝকে ত্রিশূল। ত্রিশূলের সোনালি আভায় বুঝি চিন্ময়ী হয়ে উঠছেন মৃন্ময়ী মা।

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s