আমাদের ইশকুলের সবচে’ সহজ বুদ্ধির পড়ুয়া ছেলেটার নাম হুজায়ফা। বাঁকা দাঁত। দুষ্টুমিতে বাঁদরও তার কাছে হার মানে, তবে সবসময়ই তার ঠোঁঠের কোণে যে জিনিসটা লেগে থাকে, সেটা হাসি। গেল বার বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে একটি নাটিকায় সে করল অভিনয় আর সবাইকে তাকও লাগিয়ে দিল। সেই থেকে ইশকুলের স্যার-ম্যাম তাকে চেনেন একনামে।
সেদিন ছিল হুজায়ফার দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার তৃতীয়দিন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার খানিক বাদে হেডস্যার তাকে ডেকে নেন অফিসে।
“মিস্টার হুজায়ফা, কেমন আছেন আপনি?”
“জি, ভালো স্যার।”
“পরীক্ষা কেমন হল?”
“জি, ভালো স্যার।”
“আজকে পরীক্ষার খাতায় কী লিখেছ?”
“ঢেঁড়স স্যার। ঢেঁড়স এঁকেছি আর শহীদ মিনার।”
“ঠিকঠাক মতন রঙ করেছ তো?”
“জি স্যার, করেছি। কিন্তুক লাল রঙটা আপু লুকিয়ে রেখেছিল, তাই সূর্যটা ঠিকমতো লাল হয়নি।”
“তাহলে তো ম্যাম তোমার নম্বর যে কাটবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই!”
হুজায়ফার মুখে তখন শ্রাবণ-মেঘের আকাশ। চোখের কোণে জলের রেখা। হেডস্যার প্রসঙ্গ পালটে কইলেন, “সকাল থেকে ঘুমানোর আগপর্যন্ত কী করে কাটাও তুমি?”
“অনেক কিছু করি স্যার।”
“যা কিছু করো লিখে দিতে পারবে কাগজে?”
“পারব স্যার। লিখব এখন?”
হেডস্যার একটি কাগজ তাকে ধরিয়ে বললেন, “লিখো।”
হুজায়ফা চুপচাপ লিখতে শুরু করল। হেডস্যারের মন তখন মোবাইলের স্ক্রিনে। একটা নীরবতায় ছেয়ে গেছে পুরোটা কক্ষ।
মিনিট দশেক পরে হুজায়ফার লেখা শেষ। কাগজটা স্যারের হাতে ধরিয়ে সে চলে যায় বাইরে। হেডস্যার চোখ বুলাতেই দেখেন, সে শিরোনামে লিখেছে ‘নিজের পত্র’।
শিরোনাম দেখে হেডস্যারের আগ্রহটা বাড়ল বৈ কমল না। পড়তে লাগলেন পত্রখানা। সে আপন মনে মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখেছে,
‘আমি ভোরবেলা ছয়টায় ঘুম থেকে উঠি। তখন ঘরের কেউ ওঠে, কেউ ওঠে না। তারপর আস্তে জানালা খোলে দিই আর আকাশ দেখি। আকাশ আমার ভালো লাগে।
এরপর জানালা দিয়ে আমাদের ঘরে আলো আসে। সেই আলো আমার অনেক পছন্দ। তারপর দাঁত ব্রাশ করি। এরপর পড়তে বসি। তারপর নাস্তা খাই। এরপর ইশকুলে যাই। তারপর বাসায় আসি। এরপর ইউনিফর্ম খোলে গোসল করি। তারপর উঠানে খেলি। বৌছি খেলা আমার পছন্দ।
এরপর ঘরে যাই। তারপর পড়তে বসি। এরপর বাসার সবাই আমাকে আদর করে। কিন্তু দুঃখ একটাই, আপু আমাকে চড় মারে আর আম্মু খালি বকে।’
লেখাটা পড়ে হেডস্যার কোনো নম্বর দিলেন না। মুচকি হেসে কাগজের কোণে লাল কালির জেল কলমে লিখলেন,
‘তারপর লেখাটা ভালোই হয়েছে।’
অলঙ্করণ:মৌসুমী রায়