গল্প-গল্পদাদুর আসর- শুভময় মণ্ডল-শীত ২০২০

অবসর গ্রহণের পর বৃদ্ধ শিশিরবাবুর এখন একটাই রিক্রিয়েশন, বিকেলবেলা গঙ্গার ধারে বাচ্চাদের খেলার মাঠে, তাদের নিয়ে আসর বসানো। প্রথম প্রথম নিজের নাতনি তিতাসের দু-একজন বন্ধু ছাড়া আর কেউ খুব একটা কাছে ঘেঁষত না তাঁর। একে তিনি প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, তায় ইয়া পেল্লাই তাঁর গোঁফজোড়া, বাবা রে, দেখলেই কেমন ভয় করে।

কিন্তু তাঁর আসরটি হত খুব জমজমাট। নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি হাতড়ে রোজ একেকটা মজার কাহিনি হাজির করেন তাদের সামনে। সেইসব ঘটনা শুনে তো হেসেই লুটোপুটি খায় সবাই। তাই দিনে দিনে তাঁর আসরে ভিড় বাড়তে থাকে।

তিনি আবার নিয়ম করেছেন, আগে একটু খেলাধূলা না করলে তাঁর আসরে এন্ট্রি নেই কারোর। এমনকি তিতাসকেও রোজ খেলাধূলা দৌড়ঝাঁপ করতে হয় দাদুর আসরে বসার আগে। আসলে তিনি বিশ্বাস করেন, খেলাধূলা করাটা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ভীষণ জরুরি। তাই আগে খেলা, পরে গল্প।

সেদিন মনামী বলল, “আচ্ছা দাদু, তুমি যে এত বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে মিশেছ, তোমাদের মধ্যেও ঝগড়া হয় আমাদের মতো? আমাদের যেমন রোজই খেলতে খেলতে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়!”

“তোমাদের মতো ঝগড়া করা কি আমাদের সাজে দিদিভাই? আমাদের মন যে তোমাদের মতো পরিষ্কার নয় গো। না মন খুলে বড়োরা ঝগড়া করতে পারে, না খোলাখুলি ভালোবাসতে পারে।”

মিঠাই বলল, “মন খুলে ভালোবাসতেও পারে না দাদু? এটা কীরকম কথা হল?”

“ওই যে বললাম না, ছোটোদের মতো তো বড়োদের মন সাফ নয়। তাই ভালোবাসাও তারা সরাসরি প্রকাশ করতে পারে না। এই যেমন দুজন বিখ্যাত লোকের মধ্যে কী দারুণ একটা মিষ্টি সম্পর্কের কথা বলি শোনো। আমাদের গ্রামের নাম কী জানো?”

তিতাস উত্তর দিল, “হ্যাঁ, দেবানন্দপুর।”

“জানো, কার জন্য এই গ্রামের এত খ্যাতি, নামডাক?”

মিঠু বলল, “আমি জানি দাদু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমি লালু গল্পটা পড়েছি তো, ওঁর লেখা।”

শিশিরবাবু বললেন, “ওঁর আরো অনেক কাহিনি আছে, বড়ো হয়ে পড়বে তোমরা। নিজের গ্রামের যা কিছু সুন্দর, সমস্ত বিষয়, সুখ, শান্তি, ভালোলাগাকে তিনি বার বার তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। তবু একটু বোধ হয় বাকি থেকে গিয়েছিল। সেটা কীভাবে পূর্ণ হল জানো?”

সকলে সমস্বরে প্রশ্ন করল, “কীভাবে দাদু?”

“তোমরা আম আটির ভেঁপু পড়েছ? অপু-দুর্গার কথা, কাশবন, ট্রেন লাইন, নদীর চর?”

অয়ন উত্তর দিল, “হ্যাঁ দাদু, অপু-দুর্গার গল্প পড়েছি তো। গতবছর আমাদের স্কুলে না, একটা সিনেমা দেখিয়েছিল, পথের পাঁচালী। ওটাও দেখেছি।”

“বাহ্‌। ওই গল্পেও পাবে, আর ওই খুব সুন্দর সিনেমাটিতেও, গ্রামভর্তি বড়ো বড়ো গাছের সারি, সবুজ চাষের জমি ঢালু হয়ে গেছে নদীর দিকে, তার দু-ধারে কাশবন, আর সেইসব পার হয়ে দেখা যায় রেল লাইন, হুশ হুশ করে যাচ্ছে কত রেলগাড়ি, দুই ভাইবোন ছুটছে সেদিকে… তাই না?”

অয়ন জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ। তোমারও বুঝি সিনেমাটা খুব ভালো লাগে দাদু?”

শিশিরবাবু উত্তর দিলেন, “এই সিনেমা যে সারা বিশ্বের ভালোলাগা সিনেমা দাদু। কিন্তু আমি যে মাঠ, নদী, কাশবন, রেল লাইনের কথা বলছি সেটা ওই সিনেমার নয়—দেবানন্দপুরের। বিভূতিভূষণ কখনো এখানে এসেছেন কি না জানি না, কিন্তু কাহিনিটা পড়লে মনে হয়, তিনি যেন এই গ্রামের প্রকৃতির কথাই লিখেছেন তাঁর গল্পতে। কী দারুণ না? হয়তো তিনি শরৎচন্দ্রের জন্মস্থানকে শ্রদ্ধাই জানিয়েছেন এইভাবে, কী জানি।”

মেঘা বলল, “আচ্ছা দাদু, তোমরা যখন ওই গ্রামে থাকতে, মানে যখন কারেন্ট ছিল না, রাস্তাঘাটও ভালো ছিলো না, তখন কষ্ট হত না থাকতে ওখানে? তোমাকে তো তখনো রোজ অপিস যেতে হত।”

“হ্যাঁ, সে আর বলতে? কত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আছে আমার! সেই কাহিনি শুনবে?”

সকলে জানাল, “হ্যাঁ দাদু, বলো বলো, শুনব।”

তিতাস আবার জুড়ল, “দাদা, ভূতের গল্প?”

শিশিরবাবু বললেন, “ভূত? হ্যাঁ, প্রায় তাইই। আমায় আর একটু হলেই…”

সকলে আবদার করল, “ও দাদু, প্রথম থেকে, প্রথম থেকে বলো।”

শিশিরবাবু এবার হেসে শুরু করলেন, “সে তখন আমিও ছোটো। তোমাদের মতো এতটা ছোটো নই, আর একটু বড়ো, ক্লাস এইটে পড়ি। ব্যান্ডেল স্টেশন পার হয়ে পড়তে আসতাম। একদিন রাত হয়ে গেল ফিরতে ফিরতে। সেদিন আবার ছিল অমাবস্যা। যাই হোক, দুরু দুরু বুকে একাই বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি, আমার রাস্তার আগের বাঁকটায় বু্ড়ো বটতলার কাছে কারা যেন হাঁটছে আমার আগে আগে। পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায় নিঝুম রাতে। তারপর খেয়াল করে তাকিয়ে দেখি, শুধু মাটি থেকে হাঁটু অবধি চারজোড়া পা, মানুষেরই পা, পায়চারি করছে বটতলায়। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে চলতে চলতে প্রায় তাদের কাছাকাছিই এসে পড়েছি, এমন সময় সমস্বরে কারা বলে উঠল, ‘বলো হরি, হরিবোল।’ ব্যস, ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম রাস্তার ধারে। পরদিন জ্ঞান ফিরল সকালবেলা বাড়ির বিছানায় শুয়ে। যারা বাড়ি এনেছিল আমায়, তাদের থেকেই শুনলাম, শবদাহ করতে যাওয়া একটি দল ওখানে জিরিয়ে নেবে বলে দাঁড়িয়েছিল। তাদের হ্যারিকেনের আলোয় যতটা দূর থেকে নজরে আসে, সেই অনুযায়ী শুধু তাদের পায়ের হাঁটু অবধিই আমি দেখতে পেয়েছিলাম। এদিকে এত রাতে কে আবার আসছে তাদের দিকে ভেবে, তারাও সমস্বরে ‘হরিবোল ধ্বনি’ দিয়ে উঠেছিল।

“যাই হোক, এটা তো শুধুই অন্ধকারে ভুল বোঝার ফল ছিল। কিন্তু পরেরবার যা হল, বাবা রে, আমার মনে পড়লেই ভয় করে এখনো।”

সকলে উদগ্রীব, “কী হয়েছিল দাদু? বলো বলো!”

“বলছি, বলছি। তোরা আবার শুনে ভয় পাবি না তো, এটাই ভাবছি।”

“না না, ভয় পাব না দাদু, বলো বলো!”

শিশিরবাবু আবার শুরু করলেন, “গ্রামে আমাদের এক প্রতিবেশী ছিল পাঁচু পাগলা। সে কখনো সেনাবাহিনীতে কাজ করত। পরে গ্রামে ফিরে আসে। বিয়ে-থা করেনি, মায়ের কাছেই থাকত। সারাদিন তার টিকিটিও দেখতে পেত না কেউ। কিন্তু মাঝরাতে মদ্যপ পাঁচু পাড়ার নেড়িগুলোর সঙ্গে আওয়াজে পাল্লা দিয়ে তারস্বরে গান করতে করতে টলমল করে ঘরে ফিরত রোজ। পাড়ার খুব কম লোকজনের সঙ্গেই তাদের মা-বেটার ভাব ছিল। আমি ছিলাম তাদেরই একজন। রোজই আমার রাত হয়ে যেত অপিস থেকে ফিরতে তখন। আর প্রায় রোজই পাঁচুর সঙ্গে রাস্তায় দেখাও হয়ে যেত। হয়তো নাচতে নাচতে পাঁচু রাস্তা দিয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার (তাকে আর নাহয় গান করা নাই-বা বললাম) করতে করতে টলমল পায়ে যাচ্ছে। তাকে একটু আওয়াজ দিয়ে সাবধান করে, পাশ কাটিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম।

“তো, এইরকমই একদিন প্রায় মাঝরাত করে বাড়ি ফিরছি সাইকেল চালিয়েই। সেই বুড়ো বটগাছটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে এসেছি, হঠাৎ দেখি রাস্তার মাঝখান দিয়ে পাঁচু পাগলা টলমল করে নাচতে নাচতে চলেছে। পূর্ণিমার আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, হ্যাঁ, সেই পাঁচু পাগলাই নাচতে নাচতে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। আরেকটা মোড় ঘুরলেই মুখার্জীদের আমবাগান। সেটা পার হলেই তাদের বাড়ি। হঠাৎ খেয়াল হল, এটা কী করে সম্ভব? পাঁচু পাগলা তো মারা গেছে মাস খানেক হতে চলল! আর ওইরকম চেহারা, ওইরকম চালচলনের অন্য কোনো লোকও তো এই গ্রামে নেই! তাহলে? কে ও? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতেই আমার কপালে সপাটে এসে লাগল রাস্তার ওপর নুয়ে পড়া একটা বাঁশ। অন্য কেউ হলে জ্ঞান হারাত, কিন্তু ওই আঘাতে ছিটকে পড়েও কীভাবে যেন উঠে বাড়ি এসেছিলাম আমি জানি না। পরের এক সপ্তাহ তীব্র জ্বরে শয্যাশায়ী থেকে, তারপর সুস্থ হয়ে অপিস যাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু রাত করে বাড়ি ফেরা ছেড়ে দিয়েছিলাম তার পর।

“আজ পর্যন্ত আমি ভেবে পাইনি, গ্রামের কোথাও না থাকা সত্ত্বেও সেদিন ওখানে বাঁশঝাড়ই-বা এল কোত্থেকে? আর তার নুয়ে পড়া ডালে আঘাতই-বা আমি পেলাম কী করে? তোমরা বলো দেখি, কী ঘটেছিল সেদিন?”

সকলে বলে উঠল, “ভূত দাদু, তুমি পাঁচুর ভূতের পাল্লায় পড়েছিলে! তোমার সঙ্গে পাঁচুর সম্পর্কটা ভালো ছিল বলে খুব প্রাণে বেঁচে গেছ।”

শিশিরবাবু বললেন, “তাই হবে বোধ হয়, নয়তো আমি সেই রাতে বাড়ি ফিরলাম কী করে আমার আজও মনে পড়ে না। চলো, আজ ওঠা যাক, কালকে বরং অন্য গল্প শোনাব। সন্ধে হয়ে আসছে৷ চলো চলো, বাড়ি ফিরতে হবে।”

সকলে হৈ হৈ করতে করতে শিশিরবাবুর সঙ্গে এগিয়ে যায় তাদের সোসাইটির দিকে।

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s