গল্প-প্রফেসর মানবেশের ফর্মুলা -অরূপ দাস-বসন্ত ২০২২

অরূপ দাসের আগের গল্প পথের পথিক, নিয়তি, মিন্টু যখন গোয়েন্দা

golpomanabesh

(১)

কাঁচুমাচু মুখ করে কেল্টু মাঠের এক ধারে গিয়ে বসল। কেল্টুর মনখারাপ। মনখারাপ হবারই কথা, বাবা আজ কেল্টুকে খুব বকেছে।

কেল্টু আরেকবার ভেবে দেখল, পড়াশোনা করবে নাকি কাজ করবে।

কেল্টুর স্কুল-জীবন মাত্র একদিনের। মানে যেদিন কেল্টু প্রথম স্কুল গেছিল, সেদিনই তার স্কুলের শেষদিন ছিল। মাস্টারমশাইয়ের গোল গোল চোখ দেখে ভয় পেয়ে সেই যে স্কুল থেকে পালাল, আর কোনোদিন স্কুলমুখো হয়নি কেল্টু।

আজ হঠাৎ কেল্টুর পড়াশোনার বিষয়টা আবার উঠে আসার কারণ কী তা বলা যাক। কেল্টুদের বাড়িতে এক মাস্টারমশাই ঘর ভাড়া নিয়েছেন। কেল্টুর বাবাকে আজ সকালে মাস্টারমশাই বললেন, “কেল্টু যখন স্কুল যেতে চাইল না তখন তো বাড়িতে বসেই পড়াতে পারতেন। একটু-আধটু পড়া-লেখা তো প্রয়োজন। আপনি যদি সম্মতি দেন তাহলে রোজ সন্ধেবেলায় কেল্টুকে পড়াতে পারি।”

কেল্টুর বাবা খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন, “বিলক্ষণ। এ যে বড়ো খুশির খবর হে।”

কেল্টুর এতেও আপত্তি। সে কোনোমতেই পড়তে চায় না। তার একটাই কথা, পড়াশোনা করে কোনও লাভ নেই। মূর্খ থেকে জীবন কাটালে কী এমন সমস্যা হবে শুনি? কেল্টুর এই কথা শুনে অধৈর্য হয়ে বাবা একটা কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, “যদি পড়াশোনা না করিস তাহলে  কাজে ঢুকে যা। তোকে আর এমনি এমনি  ঘরে বসিয়ে রাখব না। পড়াশোনা কর, নয়তো কাজ কর—দুটোর মধ্যে একটা বেছে নে।”

বাবার মুখে এই কথা শোনার পর কেল্টু আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না, ঘর থেকে বেরিয়ে এল কাজ খুঁজতে।

কেল্টুকে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে থাকতে দেখে দিনুকাকু বলে ওঠে, “কী রে কেল্টু, কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছিস যে?”

দিনুকাকু প্রফেসর মানবেশ মুখার্জির বাড়িতে কাজ করে। কেল্টুর বাবার মুদিখানা থেকে মাসকাবারি পণ্যদ্রব্য কিনে থাকে।

কেল্টু জবাব দেয়, “আমার একটা কাজের দরকার গো। তুমি একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারবে দিনুকাকু?”

দিনুকাকু হাসতে হাসতে বলল, “হঠাৎ তোর কাজ করার ইচ্ছে হল কেন?”

দিনুকাকুকে বিস্তারিতভাবে কেল্টু সব জানাল।

সব কথা শুনে দিনুকাকু বিজ্ঞের মতো বলল, “বুঝলাম। দেখ কেল্টু, তোকে দেওয়ার মতো এই মুহূর্তে আমার হাতে কোনও কাজ নেই। তবে হ্যাঁ, তোকে দাদাবাবুর কাছে নিয়ে যেতে পারি। তিনি হেল্পার  রাখার কথা বলছিলেন।”

আগ্রহী হয়ে কেল্টু বলে, “তুমি যার বাড়িতে কাজ করো?”

“হ্যাঁ, তাঁর বাড়ি।”

”ঠিক আছে, আমায় নিয়ে চলো।”

“আমি তো এখন বাজার করতে যাচ্ছি, বাড়ি ফেরার পথে তোকে নিয়ে যাব। তুই ততক্ষণ এখানেই বসে থাক, বুঝলি?”

“আচ্ছা।”

দিনুকাকু বাজারের দিকে গটগট করে হাঁটা ধরল। আর কেল্টু বটগাছের নীচে গিয়ে বসল।

(২)

বাজার থেকে ফেরার পথে কেল্টুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি এল দিনুকাকু। এর আগে কোনোদিনও প্রফেসর মানবেশের সঙ্গে কেল্টুর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তবে লোকমুখে হামেশাই কেল্টু শোনে প্রফেসর মানবেশ নাকি কীসব আবিষ্কার-টাবিষ্কার করে বেড়ান।

প্রফেসর মানবেশ ল্যাবরেটরিতে কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাই বেশ কিছুক্ষণ কেল্টুকে বসে থাকতে হল। তবে হাত গুটিয়ে মোটেই কেল্টু বসে ছিল না। ফুলকো ফুলকো লুচি আর আলুর দম খেতে দেওয়া হয়েছে তাকে। সঙ্গে  দুটো মতিচুরের লাড্ডু। সেগুলো বসেই খাচ্ছিল সে।

এরই মধ্যে প্রফেসর মানবেশ চলে আসেন। কেল্টুর খাওয়ার পাট সমাপ্তির পরেই প্রফেসর মানবেশ আগ্রহী হলেন কেল্টুর কাজে ঢোকার কারণ জানতে। পুরো কথা কেল্টুর মুখেই শুনলেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত কেল্টুর দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, “বুঝলাম, তোমার ধারণা পড়াশোনার কোনও মূল্য নেই। ঠিক আছে, বিষয়টা নিয়ে একটু আমাকে ভাবতে দাও।”

প্রফেসর মানবেশ পায়চারি করতে লাগলেন। একটা সময় পায়চারি দেওয়া বন্ধ করে তিনি বললেন, “আমি তোমায় আজ থেকে কাজে রাখছি। তার আগে তোমার বাবার সঙ্গে আমায় একটু কথা বলিয়ে দাও। তোমার বাবাকে না জানিয়ে কাজে নেওয়াটা খারাপ দেখায়, তাই না? আমার মোবাইল নম্বর দিচ্ছি, তুমি গিয়ে বাবাকে বলো এই নম্বরে আমায় একটা ফোন করতে। আমি কথা বলে নেব।”

একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে দিলেন প্রফেসর মানবেশ।

খুশিতে ডগমগ হয়ে কাগজটা নিল কেল্টু। মনের মধ্যে কথাটা আসতেই কেল্টু বলে উঠল, “মাইনে কত দেবেন সে-কথাটা তো বললেন না?”

প্রফেসর মানবেশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, “মাইনে নিয়ে তোমার বাবার সঙ্গে কথা হবে।”

কেল্টু বলল, “ঠিক আছে, আমি চলি।”

প্রফেসর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেন। কেল্টু বাড়ির উদ্দেশ্যে নাচতে নাচতে রওনা দিল।

(৩)

কেল্টুর বাবা এক খদ্দেরকে জিনিসপত্র দিচ্ছিলেন, এমন সময় কেল্টু সামনে এসে দাঁড়ায়।

খদ্দেরকে জিনিসপত্র দিয়ে কেল্টুর উদ্দেশে বাবা বলে উঠলেন, “এমন হাঁদারামের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পাগল হয়ে গেছিস নাকি, বিনা কারণে হাসছিস দাঁত বের করে!”

কেল্টু বুক চওড়া করে বলে ওঠে, “কাজ পেয়ে গেছি।”

কথা শুনে বাবা মাথা চুলকান। বেশ কৌতূহলী হয়ে বললেন, “মানে!”

“ওই যে বৈজ্ঞানিক আছেন না, তাঁর বাড়ি। তোমাকে এই ফোন নাম্বারে একটা ফোন করতে বলেছেন।”

“কী ঘটিয়ে এসেছিস শুনি? কোমরে দড়ি বেঁধে দারোগাবাবু ধরে নিয়ে যাবে না তো?”

“না না, ওসব কিছু নয়, তুমি ফোন করে দেখো না।”

“নাম্বারটা দে দেখি।”

নাম্বার নিয়ে প্রফেসর মানবেশকে ফোন করেন কেল্টুর বাবা। অনেকক্ষণ ধরে কথা হচ্ছে দুজনের। কেল্টুর বাবা ‘হ্যাঁ’ ‘আচ্ছা’ এই দুটো কথাই বার বার বলে চলেছেন। কিছুই কেল্টু বুঝতে পারছে না। তবে সে এটা বেশ বুঝতে পারছে, বাবা বেশ খুশি। এত খুশি হতে বাবাকে সে কোনোদিনও দেখেনি।

যাই হোক, অবশেষে দুজনের কথা বলা শেষ হল। ফোন রেখে বাবা আপ্লুত হয়ে কেল্টুর উদ্দেশে বলেন, “শোন কেল্টু, আমি রাজি। আজ থেকেই কাজ কর গিয়ে। আয়ুষ্মান ভবো বেটা।”

কেল্টুর কী যে আনন্দটাই না হচ্ছে! তার নাচতে ইচ্ছে করছে। আর পড়তে হবে না যে।

বাবা ক্যাশ বাক্স থেকে কুড়ি টাকা বের করে কেল্টুকে বলে ওঠেন, “রিকশা করে যাবি, কেমন?”

বাবা নিজে থেকে এত টাকা দিচ্ছে, ভাবা যায় না! কেল্টু কুড়ি টাকাটা বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। কেল্টু রিকশায় যাবে না। বরং সেই টাকা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে জিলাপি আর শিঙাড়া কিনবে। এই কথা মাথায় আসা মাত্র মনে-মনেই কিল্টু খিক খিক করে হাসতে লাগল।

(৪)

প্রফেসর মানবেশ ল্যাবরেটরিতেই ছিলেন। দিনুকাকু কেল্টুকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে এল।

ল্যাবরটরিতে ঢুকে কেল্টুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একদিকে খাঁচায় পাখি, ব্যাঙ, গিনিপিগ আটক করে রাখা হয়েছে। আর একদিকে কাচের সব পাত্র রাখা। পাত্রগুলোতে রঙবেরঙের তরল জাতীয় কিছু রাখা আছে। কোনও পাত্রের তরল দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আবার কোনও পাত্রের তরল বুদবুদ করছে। আরও কত কী কাণ্ড কারখানা ঘটছে ল্যাবরেটরি জুড়ে!

প্রফেসর মানবেশ একটি শিশি নাড়াচাড়া করে দেখছেন। দিনুকাকু বলে ওঠে, “দাদাবাবু, কেল্টু এসেছে।” এই বলে দিনুকাকু চলে গেল।

কাজে ছন্দপতন ঘটিয়ে প্রফেসর মানবেশ বলেন, “এসো কেল্টু, তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। আরে দূরে কেন, কাছে এসো। দেখবে এসো আমার নতুন আবিষ্কার।”

কাছে এসে কেল্টু জিজ্ঞাসা করে, “কোথায়?”

“এই যে আমার হাতে, শিশির ভিতরে।”

“শিশির ভিতরে তো নীল জল।”

“এই নীল জলের গুণ শুনলে অবাক হয়ে যাবে। এই নীল জল এক ফোঁটা কেউ যদি জিভে ছোঁয়ায় তাহলে সেই ব্যক্তি নিজের ইচ্ছেমতো অদৃশ্য হতে পারবে। শুধু মনে মনে বলতে হবে আমি অদৃশ্য হতে চাই, তাহলেই সেই ব্যক্তি অদৃশ্য হয়ে যাবে। আবার পুনরায় ফিরে আসতে হলে বলতে হবে আমি সশরীরে ফিরে আসতে চাই। তাহলেই আবার সেই ব্যক্তি সশরীরে ফিরে আসবে।”

“অদৃশ্য হওয়া যাবে!”

“তবে বলছি কী? কিন্তু এর মেয়াদ দশদিন থাকবে। ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আবার এই নীল জল এক বিন্দু  জিভে ছোঁয়ালে আবারো দশদিন থাকা যাবে। শিশির গায়ে এই কাগজের লেখাটা দেখেছ, এটা এই আবিষ্কারের নাম। নাম দিয়েছি অদৃশ্য হওয়ার চাবিকাঠি। আর এর নীচে লেখাগুলো দেখো। যে কথাগুলো এক্ষুনি তোমায় বললাম সেগুলোই লেখা আছে। শিশিটা তুমি একটু ধরে দাঁড়াও। আমি আসছি।”

শিশিটা কেল্টুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রফেসর মানবেশ ল্যাবরটরি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

শিশিতে লেখা নামটা ভালো করে দেখছে কেল্টু। কেল্টুর চোখের অনেক সামনে প্রফেসর মানবেশ লেখাটা তুলে ধরেছিলেন। পড়তে না পারার যদিও কোনও আফসোস নেই কেল্টুর মনে। না পড়তে পারলে তো আর পৃথিবী উথালপাতাল হয়ে যাবে না। তাই লেখা নামটার পেছনে পড়ে থেকে সময় নষ্ট করতে চাইল না সে।

কতবার কেল্টু অদৃশ্য হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। শেষবার অদৃশ্য হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল মাস তিনেক আগে। মহাপ্রভু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে গুজিয়া কিনতে গিয়ে। দোকান ঘিরে কতরকমের মিষ্টি। তা দেখে কেল্টু লোভ সংবরণ করতে পারছিল না।  কিন্তু কী করবে, তার কাছে তো টাকা ছিল না। তাই দেখে মনের আশ মেটাচ্ছিল। আর ভাবছিল, সে যদি অদৃশ্য হতে পারত তাহলে দোকানের সমস্ত মিষ্টি  খেয়ে ফেলত। কেউ কোনও বাধা  দিতে পারত না। আর বাধা দেবেই-বা কাকে, কেল্টুকে তখন দেখতে পেলে তো!

ভাবতেই পারছে না কেল্টু, বাস্তবে এরকম সম্ভব! সম্ভব না হলে প্রফেসর মানবেশ মিথ্যে কথা বলতে যাবেনই-বা কেন?

কেল্টু অদৃশ্য হতে পারলে তখন কি শুধু মহাপ্রভু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নিয়ে পড়ে থাকবে? আরও কত ভাণ্ডারে হাজিরা দেবে। ট্রেনে-বাসে বিনা টিকিটে  ঘুরে বেড়াবে। ট্রেন-বাস কেন, প্লেনে করে যখন খুশি বিদেশ ঘুরে আসতে পারবে।

অদৃশ্য হলে কী কী করতে পারবে তাই ভেবে মোটেও কেল্টু সময় নষ্ট করল না। হাতে যখন অদৃশ্য হওয়ার উপায় আছে তখন ব্যবহার করে দেখাই যাক। এই ভেবে শিশির এক ফোঁটা নীল জল জিভে ছোঁয়াল। কেমন নোনতা নোনতা। এরপর কেল্টু  মন থেকে বলে উঠল, ‘আমি অদৃশ্য হতে চাই।’

নীল জল জিভে ছোঁয়ানোর পর কেল্টুর মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। অদৃশ্য হয়েছে কি না তা কেল্টু কীভাবে বুঝবে!

অনেক কিছু ভাবনা-চিন্তার পর কেল্টু সিদ্ধান্ত নিল ল্যাবরেটরির বাইরে বেরিয়ে কারও সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কেল্টুর দিকে তাকানোর পর সেই ব্যক্তির মধ্যে যদি কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখা যায় তাহলে ধরে নেওয়া হবে অদৃশ্য হয়েছে। এই ভেবে কেল্টু হাতে থাকা শিশিটা টেবিলে রেখে দিয়ে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এল।

কেল্টু ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই দিনুকাকুকে দেখতে পায়। দিনুকাকু প্যাকেট থেকে মতিচুরের লাড্ডুগুলো বের করে প্লেটে সাজাচ্ছে। কেল্টু এগিয়ে গিয়ে দিনুকাকুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কেল্টু অচিরেই বুঝতে পারল, প্রফেসর মানবেশ ঠিক কথাই বলেছিলেন, নীল জলটা অদৃশ্য হওয়ার চাবিকাঠি। দিনুকাকু বার বার কেল্টুর দিকে দেখছে। কেল্টু যে দাঁড়িয়ে আছে তা নিয়ে দিনুকাকুর মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। দিনুকাকুর মুখের কাছে কেল্টু হাত নাড়িয়ে দেখল, এই ক্ষেত্রেও দিনুকাকুর মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

আনন্দে কেল্টু লুটোপুটি খাচ্ছে। কতদিনের স্বপ্ন তার পূর্ণ হয়েছে। দিনুকাকুর সঙ্গে একটু মজা করার জন্য কেল্টু প্লেট থেকে একটা মতিচুরের লাড্ডু তুলে মুখে পুরে নিল। তাই দেখে দিনুকাকুর অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। মা গো, বাবা গো বলে চেয়ার ছেড়ে দিনুকাকু ছিটকে মেঝেতে পড়ল। প্রফেসর মানবেশ পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন।  দিনুকাকুকে অমনভাবে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে প্রফেসর মানবেশ জিজ্ঞাসা করেন, “কী হয়েছে তোমার, মেঝেতে পড়ে আছ কেন?”

ভয়ার্ত কণ্ঠে দিনুকাকু বলল, “দাদাবাবু, অদ্ভুত ঘটনা ঘটল চোখের সামনে। প্লেট থেকে লাড্ডু হাওয়ায় ভেসে অদৃশ্য হয়ে গেল।”

কথাটা শুনে প্রফেসর মানবেশের মাথায় হাত। ছুটে গেলেন ল্যাবরেটরির দিকে। তাই দেখে দিনুকাকুও মেঝে থেকে উঠে প্রফেসর মানবেশের পিছু নিল।

কিছুই বুঝতে পারছে না কেল্টু। প্রফেসর মানবেশ হঠাৎ ল্যাবরেটরির দিকে দৌড়ালেন কেন? তবে কি তিনি বুঝতে পেরেছেন যে কেল্টু অদৃশ্য হয়েই এই ঘটনা ঘটিয়েছে! কেল্টু আর দেরি না করে মনে মনে বলল, ‘আমি সশরীরে ফিরে আসতে চাই।’ এই বলে কেল্টুও হাঁটা ধরল ল্যাবরেটরির দিকে। যেতে যেতে সে একটা বুদ্ধি পাকিয়ে নিল। প্রফেসর মানবেশকে  সে মিথ্যা কথা বলবে। বলবে, ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরে দেখছিল আর কি।

ল্যাবরটরির সামনে প্রফেসর মানবেশ আর দিনুকাকু বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। দিনুকাকুর উদ্দেশে প্রফেসর মানবেশ কান্না জড়ানো গলায়  বলেন, “কেল্টুকে আমি মজা করে বলেছিলাম যে শিশির মধ্যে অদৃশ্য হওয়ার ফর্মুলা আছে।  কিন্তু নীল জলটা আসলে বিষ। আর সেই বিষ কেল্টু জিভে ছুঁয়ে  মারা গেল। আমি ওকে শিশির গায়ে লেগে থাকা কাগজটা দেখিয়েছিলাম। কিন্তু কেল্টু তো পড়তে পারে না। যদি কেল্টু পড়তে পারত তাহলে সে দেখত ওখানে অদৃশ্য হওয়ার চাবিকাঠি নাম লেখা নেই, লেখা আছে বিষ।”

দিনুকাকু দুঃখ করে বলে, “কেল্টু খুব ভালো ছেলে ছিল। আহা রে, কেল্টুর মৃতদেহটা নীল হয়ে পড়ে আছে ল্যাবরেটরির মেঝেতে।”

দিনুকাকুর কথা শোনা মাত্র কেল্টুর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এসব কী বলছে, শিশিতে নাকি বিষ ছিল! তার মানে কেল্টু অদৃশ্য নয়, মরে ভূত হয়ে গেছে বলে দিনুকাকুরা দেখতে পাচ্ছে না? কেল্টু হাঁটু গেড়ে বসল। তার অনুতাপ হচ্ছে, আজ যদি সে একটু আধটু পড়াশোনা করত তাহলে আজ এই দিনটা দেখতে হত না। যখন প্রফেসর শিশির গায়ে লেখাটা দেখাচ্ছিলেন তখনই সে পড়ে ফেলে  জেনে নিতে পারত শিশির ভিতরে কী আছে।

এদিকে প্রফেসর মানবেশের উদ্দেশে দিনুকাকু বলে উঠল, “আচ্ছা দাদাবাবু, এখন কেল্টুর মৃত শরীর নিয়ে কী করবেন কিছু ভাবলেন? জানাজানি হয়ে গেলে যে পুলিশ কেস হতে পারে।”

কথা শেষ না হতে-হতেই প্রফেসর মানবেশ বলেন, “কেল্টুর মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে দেব। কেউ টের পাবে না।”

এই কথা শুনেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করে দেয় কেল্টু। আর সে বলছে, “মা-বাবা, তোমরা আমাকে আর কোনোদিনও দেখতে পারবে না। আমি যে মরে ভূত হয়ে গেছি।”

প্রফেসর মানবেশ আর দিনুকাকু হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি যেন দুজনের থামে না। হাসি বজায় রেখে প্রফেসর মানবেশ বলে উঠলেন, “ওরে ও কেল্টু বাছাধন, তুই অদৃশ্যও হোসনি আর মরে ভূতও হোসনি। শিশির মধ্যে নুন মেশানো জল ছিল। আর যে কেমিক্যাল মিশিয়ে জলের রং নীল করেছি তা বিন্দুমাত্র ক্ষতিকর নয়।”

কান্নাকাটি বন্ধ করে কেল্টু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল প্রফেসর মানবেশের দিকে।

দিনুকাকু বলে ওঠে, “তোর ভুল ভাঙানোর জন্যই দাদাবাবু একটা ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করেছিলেন। এতক্ষণে তোর সঙ্গে যে নাটক করা হয়েছে, সেটাই ছিল দাদাবাবুর ভুল ভাঙানোর ফর্মুলা।”

প্রফেসর মানবেশ বলে উঠলেন, “আচ্ছা কেল্টু, এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়াশোনা যে মূল্যহীন নয় সেটা বুঝতে পারলে তো?”

কেল্টু মাথা নীচু করে বলে উঠল, “বুঝতে পারলাম। আজ যদি আমি পড়তে পারতাম তাহলে এত বড়ো ভুলটা হত না।”

দিনুকাকু হাসতে হাসতে বলে উঠল, “এই কয়েক মিনিট কেল্টুর ওপর যা গেল তাতে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। কী রে কেল্টু, কাল থেকে পড়াশোনা করবি তো?”

কথা শেষ হতে না হতেই কেল্টু বলে, “কাল থেকে কী বলছ গো দিনুকাকু, আজ থেকেই পড়াশোনায় মন দেব। পড়াশোনা করিনি বলে অনেকের কাছে অনেকভাবে বোকা বনেছি। অনেকে টোকিও নিয়েছে। কিন্তু ততবার সবকিছু ভুলে গিয়ে সেই নিজের ধ্যানধারণাতেই চলতাম। আসলে কেউ এভাবে কোনোদিনও বোঝায়নি পড়াশোনার মূল্য কতটা। আমি আজ বুঝেছি। আমি কথা দিচ্ছি, একদিন আমি ঠিক পড়তে পারব শিশির গায়ে কী লেখা আছে।”

আনন্দিত হয়ে ওঠেন প্রফেসর মানবেশ। বলেন, “সাব্বাস, এই না হলে আমাদের কেল্টুবাবু! তুমি যখন পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছ তখন কেন নিজেকে পিছিয়ে রাখবে?” এই বলে কেল্টুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। আবারও বলে উঠলেন, “উঠে এসো।”

প্রফেসর মানবেশের হাতটা শক্ত করে ধরল কেল্টু, উঠে দাঁড়ানোর জন্য।

ছবি-মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s