এই লেখকের আগের লেখা- মূর্তি উধাও রহস্য, প্রতিশোধ
এক
তখন মধ্যরাত। গভীর সুষুপ্তিতে নিমগ্ন প্রাসাদের সকলে। শয়নকক্ষ থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন রানি দুর্গাবতী। নিঃশব্দ কেল্লা। কেবলমাত্র দ্বাররক্ষীরা তাদের কর্তব্যপালনে ব্যস্ত আছে। রানি কক্ষ পেরিয়ে অন্দরমহলের ভিতর দিয়ে প্রাসাদের ছাদে ওঠার সোপানে পা রাখলেন। এত রাতে সোপানে কোনও আলো থাকে না। প্রায় নীরন্ধ্র অন্ধকারের ভিতর দিয়ে রানিমাতা সন্তর্পণে একটার পর একটা সিঁড়ি পেরিয়ে কেল্লার ছাদে উঠে এলেন। তাঁর সঙ্গে এখন কোনও দাসদাসী নেই, পাত্রমিত্র-সভাসদ, অমাত্য, প্রতিমিত্র, প্রতিহারী কেউই নেই। তিনি এখন সম্পূর্ণ একা। একটু নিরিবিলি থাকার জন্যে তিনি সকলের অগোচরে চলে এসেছেন এখানে।
ছাদে উঠে চারদিক একনজর দেখে নিলেন। তারপর মার্বেল পাথরের উপরে কারুকাজ করা আলসের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর সামনে অন্ধকার এক সমুদ্র। দূরে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তিনদিকে ঘেরা ঢেউ খেলানো ধ্যানমগ্ন সাতপুরা পর্বত—নর্মদা, তাপ্তী এবং গোদাবরীর জন্মদাত্রী। বহুবছর ধরে গন্ডোয়ানা রাজ্যকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে আসছে। কেল্লার একদিকে গভীর খাদ, অন্যদিকে বয়ে চলেছে পবিত্র নদী নর্মদা। কলকল ছলছল শব্দ শোনা যাচ্ছে প্রবাহমান জলধারার। বাতাসে ভেসে আসছে সেই শব্দ। কেমন যেন মনকেমন করা বিষণ্ণ এক সুর। কান পেতে শুনলে কান্নার মতো মনে হয়।
নদীটাও কি কাঁদছে তাঁরই মতো?
দুর্গাবতী ঝুঁকে পড়ে কয়েকশো ফুট নীচে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটাকে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঘন অন্ধকারে তার ছলছল শব্দ ছাড়া আর কিছুই তিনি দেখতে পেলেন না। কাছেই সিধা শাল আর ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা গেল। একটানা বেজে চলেছে। দূরে মহুয়ার জঙ্গল থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। একসঙ্গে গলা মেলাচ্ছে শৃগাল বাহিনী। সেই সঙ্গে ডেকে উঠল যত সারমেয়র দল। কী এক সকরুণ সুর তুলে তারা ডাকছে। রাত্রির নিস্তব্ধতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তাদের সম্মিলিত ক্রন্দন ধ্বনিতে। রানিমাতা ঘোর অমঙ্গলের আভাস পেলেন। কয়েকটা রাতচরা পাখি হঠাৎ ডানা ঝাপটে উঠল। দুর্গাবতী আকাশের দিকে তাকালেন। দেখলেন নীরব নক্ষত্ররাজি ঝুঁকে পড়ে তাঁকে দেখছে। একটা কালো পেঁচা মাথার উপর দিয়ে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেল। সামনের শাল-সেগুনের ঘন জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে দূরে কোথায় উড়ে গেল পেঁচাটা। তার সঙ্গে সঙ্গে একদঙ্গল বাতাস ছুটে গেল হায় হায় ধ্বনি তুলে।
অদূরে নদীর ও-পাড়ে বুনো বাঁশ, নিম আর মহুয়ার জঙ্গল থেকে বনভূমি কাঁপিয়ে হঠাৎ একটা শার্দূল হুংকার দিয়ে উঠল। রানি দুর্গাবতীর বুকের ভিতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। কিন্তু তিনি তো এই সামান্য কারণে ভয় পাওয়ার মতো মানুষ নন! তিনি তো বীরাঙ্গনা, অসামান্য শক্তিধর, তেজোদীপ্ত মহীয়সী এক নারী, যাঁর উপরে ন্যস্ত আছে গন্ডোয়ানা রাজ্যের সমস্ত প্রজার ভার। এই রাজ্যের প্রজারা তাঁকে মায়ের মতোই ভক্তি এবং শ্রদ্ধা করে থাকে। তাঁর রাজ্যের দিকে যদি কারও শ্যেনদৃষ্টি পড়ে, মুহূর্তের ভিতরে পিধান থেকে বেরিয়ে পড়া অসি ঝনঝনিয়ে ওঠে। বনের হিংস্র শার্দুলের মতোই তিনি শত্রুপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র পিছুপা হন না। প্রখর রৌদ্রের মতো তাঁর তরবারি ঝলসে উঠে শত্রুর মস্তক ছিন্ন করে। কিন্তু রানি আজ ভয় পেলেন। সত্যি সত্যি তাঁর বুকের ভিতরটা চমকিত হল। এক অশনি সংকেত টের পেলেন তিনি।
বন্য জন্তু ছাড়া আজ আর কোনও মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। একজন গোন্দ যুবকও আজ শিকারে যায়নি, না কোনও শিশুর কান্না শোনা গেল, না কোনও বৃদ্ধলোকের কাশির আওয়াজ। ধামসা, মাদল, কাড়ানাকাড়া স্তব্ধ হয়ে আছে আদিবাসী পল্লিগুলোতে। সবাই যেন চরম এক মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
আজই রানি দুর্গাবতীর কাছে পৌঁছেছে সেই দুঃসংবাদ। দেওয়ান বেওহার আধার সিমহা তাঁর দরবারে এসে জানিয়েছেন, মুঘল সৈন্যেরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে আসছে। মুঘলদের শক্তির কথা তাঁর অজানা নয়। মুঘলরা যে-রাজ্যের দিকে একবার শ্যেনদৃষ্টি ফেলেছে তার আর নিস্তার নেই। দ্রুত রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে এই সংবাদ। বাদশা আকবর তো একের পর রাজ্য গ্রাস করে চলেছেন। তাঁর করাল থাবা থেকে কারও নিস্তার নেই। যুদ্ধজয় তাঁর নেশা। গোলা, বারুদ, কামান, অসির ঝনঝনানি, অশ্বের হ্রেষা আর হস্তির বৃংহণ ধ্বনি না শুনলে তাঁর ঘুম আসে না। রানি দুর্গাবতী বুঝতে পারলেন এবারে তাঁদের পালা। একেকটা যুদ্ধ মানে চূড়ান্ত হত্যালীলা। সম্পত্তি ক্ষয় এবং ধ্বংসের খেলা চলবে অবিরাম যতদিন না শত্রুপক্ষের কামনা বাসনা চরিতার্থ হয়।
আজ তারই ভয়ে ভীত হয়ে আছে সমগ্র গন্ডোয়ানার রাজ্যবাসী।
ভীত না হলেও এক অজানা আশংকার ঘন কালো মেঘ বিস্তার লাভ করেছে রানি দুর্গাবতীর মনের আকাশে।
দিল্লির মসনদে বসে আছেন বাদশা আকবর। সাল ১৫৬২। আকবরের সাম্রাজ্য লিপ্সার কথা দুর্গাবতী ভালোরকম অবহিত আছেন। আকবর একের পর হিন্দু রাজ্য আক্রমণ করছেন, কখনো-বা ভয় দেখিয়ে, কখনও প্রায় জোর করে সেইসব রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করছেন। এই তো কিছুদিন আগেই মুঘলরা মালব্য অধিকার করল। মালব্য ছিল রাজা বাজ বাহাদুরের অধীনে। আকবর বাজ বাহাদুরকে যুদ্ধে পরাজিত করলেন। মালব্য মুঘল সাম্রাজ্যের আয়ত্তাধীন হল। যে মুহূর্তে রানি এ-কথা জানতে পারলেন, তখনই বুঝলেন এতে তাঁর চূড়ান্ত ক্ষতি সাধিত হল। কারণ, মালব্য ছিল তাঁদের সীমান্তবর্তী রাজ্য। বাজ বাহাদুরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মধুর না হলেও উভয়ের ভিতরে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল। মালব্য মুঘল হস্তগত হওয়া মানেই হল তাঁর রাজ্যসীমা মুঘল সাম্রাজ্যকে স্পর্শ করল। এরপর তো মুঘল সম্রাটের নজর তাঁর রাজ্যের উপরে এসে পড়বে।
বহুবছর ধরে গোন্দ রাজারা এই গন্ডোয়ানা শাসন করে আসছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সুশাসক। সকলেই রাজ্যের সুখ এবং সমৃদ্ধির জন্যে নানান সমাজ-কল্যাণমূলক কাজ করে গেছেন। মূলত মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই গোন্দ উপজাতির মানুষেরা ছড়িয়ে ছিলেন। বিন্ধ্য এবং সাতপুরা পাহাড়ের মধ্যবর্তী নিম্নভূমি দিয়ে প্রবাহিত নর্মদা নদী বিধৌত এইসব অঞ্চল শাসন করেছেন মহারাজা রুদ্র, মাধো সিং, অর্জুন সিং, সংগ্রাম শাহের মতো শাসক। সংগ্রাম শাহের সময়ে মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল। নর্মদা নদী উপত্যকা বিশেষ করে ভোপাল এবং মধ্যপ্রদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত তাঁর রাজ্যসীমা বিস্তৃত ছিল। এইসব গোন্দ শাসকেরা বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্যে পাহাড়ের উপরে কেল্লা নির্মাণ করতেন। পাহাড়ের অনেকটা উপরে অবস্থিত হওয়ায় সেখান থেকে বহুদূর অবধি নজর রাখা সহজ হত। পাহাড়ের উপরে শত্রুর আক্রমণ অতটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। চতুর্দিকে প্রহরীরা কড়া নজর রাখছে। এছাড়া সমতলের চাইতে পাহাড়ের আবহাওয়া অনেকটা আরামপ্রদ। যেমন সংগ্রাম শাহ বানালেন চৌরাগড় কেল্লা। কেল্লার চারদিকে ছিল নজর মিনার। মূলত এখান থেকে প্রহরীরা তাঁর রাজ্যের চারদিক খেয়াল রাখত। এটি ছিল সাতপুরা পাহাড়ের উপরে। একদিকে খাড়া পাথুরে দেওয়াল, পাশেই অতল গিরিখাদ। নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। ত্রিতল বিশিষ্ট এই কেল্লা। বহুবছর ধরে গোন্দ শাসকেরা এই দুর্গে বসবাস করতেন এবং রাজ্য শাসন, প্রজাপালন করতেন। এরপর ১১১৬ সালে রাজা মদনমোহন বানিয়ে ফেললেন একটি কেল্লা। উদ্দেশ্য সেই এক। নাম দিলেন মদন মহল কেল্লা। এটিও সাতপুরা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত।
গোন্দ প্রজারা দীর্ঘকাল বেশ সুখেই দিনাতিপাত করছিলেন। সুখ, সমৃদ্ধি এবং প্রাচুর্যে ভরা ছিল এই রাজ্য। রাজারা সর্বদা প্রজাদের সুখের কথা ভাবতেন। কীভাবে প্রজাদের মঙ্গল সাধিত হয় তার জন্যে সদা ব্যাপৃত থাকতেন।
কিন্তু আজ গন্ডোয়ানার রানির কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। যে আশংকা তিনি করেছিলেন সেটাই তাহলে সত্যি হল! মালব্য হস্তগত হবার পরপরেই মুঘল সম্রাটের লক্ষ্য এখন গন্ডোয়ানা রাজ্য।
রানি মনে মনে ভাবলেন, বাদশা আকবর, তোমার প্রবল প্রতিপত্তি, বিপুল ঐশ্বর্য থাকতে পারে, কিন্তু তুমি দুর্গাবতীকে চেনো না। তুমি আমার মনকে আঘাত করেছে। আমার অন্তরাত্মাকে অপমান করেছ। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছ আমাকে এক ক্ষুদ্র রাজ্যের রানি ভেবে। এতটাই দম্ভ তোমার। তুমি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে আমায় অবজ্ঞা করছ। তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করছ। আহত বাঘিনী যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা তুমি এখনও বুঝতে পারোনি।
দুই
প্রাসাদের ছাদে একলা আছেন মহারানি দুর্গাবতী। অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন ছাদের চারধার। আকাশপাতাল কত কিছু ভাবছেন মহারানি আজ। এখন তাঁর সামনে এক চরম দুঃসময় উপস্থিত। যে-কোনো মুহূর্তে মুঘলরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে আসবে। কিছুদিন আগে সম্রাট আকবর দূত মারফত এক পত্র পাঠিয়েছিলেন। রানির হাতে এসেছে সেই পত্র। তাতে লেখা আছে, হয় মুঘল সম্রাটের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে, নয় যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই তো মৃত্যুর মিছিল, সম্পত্তিনাশ, চূড়ান্ত ধ্বংসলীলা। রানি দুর্গাবতী কোনটি চান?
রানি বেশ কয়েকবার পত্রখানি হাতে নিয়ে পড়লেন। তারপর ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেললেন সেই পত্র। তাঁর দু-চোখে তীব্র ক্রোধ দেখা দিল। তিনি স্পষ্ট করে পত্রবাহককে জানিয়ে দিলেন, ক্লীবের মতো তিনি কিছুতেই মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করবেন না। তার জন্যে যদি যুদ্ধ করতে হয় তাতেও তিনি প্রস্তুত। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যাগ্র মেদিনী।
রানি পরিষ্কার করে দূত অর্থাৎ পত্রবাহককে কথাটি জানিয়ে দিলেন, মুঘলরা যদি তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে আসে তবে তার সমুচিত শিক্ষা পাবে। দুর্গাবতীর তেজ, বীরত্ব, সাহসের কথা হয়তো তারা জানে না। এবারে বুঝতে পারবে।
***
খাজা আব্দুল মজিদ আসফ খান ছিলেন সেই সময় মুঘল সেনাপতি। তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অত্যাচারী, নিষ্ঠুর, প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ। আসফ খান সম্রাট আকবরের কাছে এই সংবাদ প্রেরণ করলেন যে মালব্যের পাশেই গন্ডোয়ানা রাজ্য। সেখানকার রাজার মৃত্যু হলে রানি দুর্গাবতী রাজার অবর্তমানে রাজকার্য দেখাশুনা করছেন। অসীম তেজ এবং বীরত্ব তাঁর। সকলে তাঁকে ‘গন্ডোয়ানার বাঘিনী’ বলে জানে। এই মুহূর্তে রানি দুর্গাবতীর সাম্রাজ্য তাদের দখলে আনতে হবে। হয় দুর্গাবতীকে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে, নতুবা যুদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সম্রাটের কী অভিপ্রায়।
সম্রাট আকবর সেদিন বেশ খোশ মেজাজে ছিলেন। মাথাটা সামান্য ডানদিকে হেলিয়ে আয়েশ করে বসে সকলের কথা শুনছিলেন। আসফ খানের কথা শুনে সম্রাট আকবর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “এই সামান্য একটা কাজে তুমি আমার আদেশের অপেক্ষা করছ? এর চাইতে কত কত শক্তিধর রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের সাম্রাজ্য হস্তগত করেছি আমরা, সে-সব কথা কি ভুলে গেলে? মানছি, এই মুহূর্তে রানি দুর্গাবতী আমাদের প্রতিপক্ষ। কিন্তু কে এই রানি দুর্গাবতী, যার কথা ভেবে এতটা সময় নষ্ট করছ?”
আসফ খান বললেন, “সম্রাট, যাঁকে আপনি সামান্য নারী মনে করছেন তিনি কিন্তু সামান্য নন। তাঁর তেজ এবং পরাক্রমের কথা দাক্ষিণাত্যের অনেকেরই জানা। বয়সে আমাদের তুলনায় সামান্য হলেও তাঁর রণকৌশল, নিপুণতা, শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা এবং চাতুর্যের কথা অনেকেই জানেন। তাঁর পিতা কিরাত রাই কী বুদ্ধিবলে যুদ্ধ করতে করতে শের শাহ সুরিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন সে-কথা তো আপনার অজানা নয়। রানি দুর্গাবতী সেই কিরাত রাইয়ের একমাত্র সন্তান। পিতার কাছ থেকেই তিনি প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন যুদ্ধের। পিতার কাছেই তাঁর অস্ত্রচালনার হাতেখড়ি। তিনি যেমন অসিচালনায় পারদর্শী, তেমনি সুদক্ষ তিরন্দাজ। মল্লযুদ্ধে তিনি বড়ো বড়ো বীরদের হারিয়ে দিতে পারেন। তাঁর তরবারির এক আঘাতে দশজন কুপোকাত হয়ে যায়। লোকে বলে, তাঁর তরবারি নাকি স্বয়ং মহেশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট।”
মুঘল সম্রাটের কপালে ভাঁজ পড়ল। সত্যই কি সে বীরাঙ্গনা? আসফ খান ফালতু কথা বলার মানুষ নয়। তিনি তো দিল্লিতেই বসে থাকেন। সমস্ত খবরাখবর আসফ খানই জানে। বীরঙ্গনা তাতে কোনও সন্দেহ নেই, নইলে সে কিনা মুঘল সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি হয় না? মুঘলদের শক্তি তো কারও অজানা নয়। সে কিনা মূর্খের মতো এই যুদ্ধের আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইছে?
দূত মারফত রানি দুর্গাবতী মুঘলদের কাছে বিনা যুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করবেন না সে-কথা যখন জানিয়ে দিলেন, তখন থেকেই আকবরের অন্তরে কোথাও একটা অপমানের তির বিঁধে আছে। এত বড়ো স্পর্দ্ধা রাখে সামান্য এক নারী? কী ক্ষমতা আছে তার মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করার?
মুঘল দরবার থেকে দুই-দুইবার করে বশ্যতা স্বীকারের জন্যে দূত পাঠানো হয়েছে আর দুইবারই রানি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন, নিজের দেশকে রক্ষা করতে যদি মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় তাতেও তিনি প্রস্তুত আছেন। দ্বিতীয় পত্রে স্বয়ং আকবর রানিকে আরও একবার শান্ত মাথায় ভেবে দেখার সুযোগ দিলেন।
রানি দুর্গাবতী জানতেন সম্রাট আকবর একজন প্রবল পরাক্রান্ত সম্রাট। তাঁর শক্তির কথা তামাম ভারতবর্ষের সকলের জানা। তবু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন।
মুঘলদের অস্ত্রশস্ত্র, হাতি, ঘোড়া, উটের সংখ্যা অগণ্য, তাদের লক্ষ লক্ষ সৈন্য। কিন্তু সেই তুলনায় তিনি নগণ্য মাত্র। মুঘলদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে তাঁর পুরোনো কিছু কামান এবং অস্ত্রশস্ত্র সত্যি বেমানান। এই যুদ্ধে তিনি পরাজিত হবেন নাকি বিজয়ী হবেন এখন সে প্রশ্ন অবান্তর। পরাজয় অনিবার্য হলেও তবু তিনি কিছুতেই তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছুপা হবেন না। পরাজিত হওয়ার ভয়ে কে কবে যুদ্ধে নেমেছে? তাঁর পিতা তাঁকে সেই শিক্ষা দেননি। যথার্থ বীরের মতোই তাঁকে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। আজ সেইদিন এসেছে, তাঁর অগ্নিপরীক্ষার দিন।
প্রাসাদের ছাদে অস্থিরভাবে পদচারণা করতে লাগলেন রানি। কীভাবে শত্রুর মোকাবিলা করা যায় ভাবতে লাগলেন। চারদিক ঘন অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষের রাত। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। অসংখ্য নক্ষত্ররাজি যেন আজ উন্মুখ হয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি আকাশের তারাদের ভিড়ে পিতা কিরাত রাইকে খুঁজলেন। মনে পড়ছে আজ এই সংকটময় পরিস্থিতে পিতার কথা। তাঁর প্রথম অস্ত্র শিক্ষাগুরু। যিনি তাঁর হাতে প্রথম তরবারি তুলে দিয়েছিলেন। কীভাবে অসি চালাতে হয় শিখিয়েছিলেন, কীভাবে তির নিক্ষেপ করতে লক্ষ্যের দিকে। পিতার মতোই তিনি যেমন যুদ্ধের ব্যাপারে কঠোর, ঠিক তেমনি মায়ের মতোই কোমল হৃদয় তাঁর। সন্তানের জন্যেও ব্যাকুল তিনি। কিন্তু এই ঘোর দুঃসময়ে তাঁর মনে কোমলতার কোনও স্থান নেই। এখন একটাই লক্ষ্য, কঠোর হাতে মুঘল সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। তাঁর যতজন সেনা আছে প্রত্যেককে যুদ্ধের ব্যাপারে উৎসাহ দান করা। সেনাদের মনোবল বাড়ানো। আমির-ওমরাহ এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে জরুরি মন্ত্রণাসভা ডাকতে হবে আগামীকাল সকালেই। হাতে তাঁর এক মুহূর্ত সময় নেই।
***
সে কতকাল আগের কথা। কালিঞ্জর দুর্গে এমনই এক দিনে পিতা-পুত্রী ছাদে পদচারণা করছিলেন। কিরাত রাইয়ের কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় দুর্গাবতীকেই তিনি পুত্রের মতো মানুষ করেছিলেন। বিভিন্ন ধরনের শারীরশিক্ষা, কুস্তি, মল্লযুদ্ধ, অসিচালনা, কীভাবে হাতির পিঠের উপরে বসে কিংবা অশ্বের পিঠে বসে যুদ্ধ করতে হয় সেইসব কৌশল তিনি বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন। বাবা তাঁকে প্রতিদিন রাজসভায় নিয়ে যেতেন। পাশে বসে কীভাবে সভার কাজ পরিচালনা করতে হয়, কীভাবে মন্ত্রণা দিতে হয়, যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়, বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখার উপদেশ দিতেন তিনি। একজন রাজা কীভাবে দক্ষ প্রশাসক এবং সুশাসক হয়ে উঠতে পারেন সেইসব ব্যাপারে দুর্গাবতীর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাঁর রাজ্যের প্রজারা যাতে সুখী থাকে, খুশি থাকে তার জন্যে তিনি কতটা ব্যাকুল ছিলেন আজ বারে বারে সেইসব কথা মনে পড়তে লাগল দুর্গাবতীর। কালিঞ্জর দুর্গ, দুর্গের বিভিন্ন কক্ষ, মহল, অস্ত্রাগার, মন্দির, সভাগৃহ সবকিছু আজ কতকাল বাদে তাঁর মানসচক্ষে ভেসে উঠল।
তিন
অক্টোবরের ৫, ১৫২৪ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল চান্দেল রাজবংশে। তখন চান্দেলরা কালিঞ্জর দুর্গে বাস করতেন। কালিঞ্জর ছিল উত্তরপ্রদেশের বান্দা জেলায়। সমতল থেকে প্রায় ১২০০ ফুট উঁচুতে তৈরি করা হয়েছিল এই দুর্গ। চান্দেল শাসকেরা নির্মাণ করেন এই দুর্গ। নামকরণ করেন তাঁরাই। কালিঞ্জর শব্দের অর্থ ‘কাল’ মানে সময়, আর ‘জর’ শব্দের অর্থ মৃত্যু। অর্থাৎ সময়ের মৃত্যু। কথিত আছে, সমুদ্র মন্থনের সময়ে যে হলাহল উঠেছিল, সেই হলাহল পান করে শিবের কণ্ঠ নীলবর্ণ ধারণ করল। সেই নীলকণ্ঠ রূপেই নাকি শিব এইখানে আসেন। যেখানে তিনি কাল অর্থাৎ সময়কে উপেক্ষা করার শক্তি পান। আর সেই থেকে এই জায়গার নাম হয়েছে কালিঞ্জর।
দীর্ঘদিন হিন্দু রাজারা রাজত্ব করার ফলে এখানে বহু হিন্দু মন্দির গড়ে উঠেছে। চান্দেলরা ছিলেন জাতিতে রাজপুত। তিনদিকে ঘেরা বিন্ধ্য পাহাড়শ্রেণি। প্রহীরমতী চান্দেলদের রক্ষা করে এসেছে। সামনের কিছু কিছু পাহাড়ের উপরিদেশ ছিল টেবিলের মতো সমতল। পাহাড়ের ঢালে চরে বেড়াত গৃহপালিত জীবজন্তু। সবুজ গাছে ঘেরা পাহাড়। শীতে গাছের পাতা ঝরে বেশ রুখুশুখু হয়ে পড়ত চারপাশ। কিন্তু বর্ষায় অপূর্ব শ্যামলিমায় ভরে উঠত। দুর্গাবতীর সখী ছিল কুড়ি জন। বেশিরভাগই দাসদাসীদের কন্যা, কিছু আমীর, অমাত্য, মন্ত্রী, পারিষদ বর্গের। রানি ছেলেবেলায় সকলের সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করতেন, খেলে বেড়াতেন প্রাসাদের ছাদে। কত কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর। তাঁদের রাজবাড়িতে একজন গোয়ালিনী ছিল, সরমা তার নাম। সে তার মেয়েকে নিয়ে আসত রাজবাড়িতে দুধ দিতে। রাজবাড়ির জন্যে দুধ সে-ই জোগান দিত। পাহাড়ের ঢালে তাদের বাড়ি ছিল। গোয়ালভরা গরু ছিল, দুধ থেকে ঘি বানাত তারা। রাজকন্যার জন্যে বিশেষভাবে তৈরি ঘি। দুর্গাবতীকে সকলে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। রাজা-রানি তো চোখে হারাতেন।
সেই সময়ে অন্যান্য মেয়েদের চাইতে একটু বেশি বয়সেই দুর্গাবতীর বিবাহ স্থির হয়। নানান গনৎকার এসে তাদের দুই পক্ষের কোষ্ঠী দেখলেন, কুলপুরোহিত এলেন, এলেন রাজগুরু শাণ্ডিল্য। মধ্যপ্রদেশের গন্ডোয়ানার গোন্দ রাজকুমার দলপত শাহের সঙ্গে তাঁর বিবাহের কথা পাকা হল। সখীদের সেদিন কী আনন্দ দুর্গাবতীকে ঘিরে! সারাটা দিন তারা রাজকন্যাকে নিয়ে কত গান গাইল, ঘুরে ঘুরে আনন্দের গান গাইল, সুখের গল্প করল, হাসিঠাট্টা তামাশা করল হবু বরকে উপলক্ষ্য করে, তারপর একসময়ে রাজকন্যাকে জড়িয়ে ধরে সকলের সে কী কান্না। আনন্দের কান্না, সখীদের ছেড়ে যাওয়ার দুঃখের কান্না, আর তো কখনও ফিরে পাবে না এই মেয়েবেলা, এই হাসি খেলা, এই স্বাধীনতা, বাবার বাড়ির এই আনন্দঘন দিনগুলো, সে-কথা ভেবে কাঁদলেন দুর্গাবতী।
রাজা কিরাত রাই এই দৃশ্য দেখে তাঁর অশ্রু গোপন করলেন। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে তো এই দিনটা আসবে।
এরপর এল সেই শুভদিন। বুন্দেলখণ্ড সেদিন আনন্দে মেতে উঠল। গরিব দুঃখী প্রজাদের দুই হাতে দান করলেন কিরাত রাই। তাঁর মেয়ের এই শুভদিনে রাজ্যের কেউ যেন আজ অভুক্ত না থাকে। তিনি আর মহারানি ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলেন দেবাদিদেব নীলকণ্ঠের কাছে। জোড়হাতে দেবতার কাছে তাঁর একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন যাতে মধুর এবং সংকটশূন্য হয় তার জন্যে দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন।
সখীরা নিজের হাতে দুর্গাবতীকে সাজাল, তাঁকে দুধে স্নান করাল, মেহেন্দি দিয়ে রাঙানো হল হাত এবং পা, ধূপের ধোঁয়ায় রাজকন্যার মেঘের মতো ঘন কালো চুলের রাশি সুগন্ধে ভরে উঠল, বহুমূল্যবান মণি, মুক্তা, হিরের অলংকারে সাজানো হল তাঁকে, পরানো হল সোনার জরির অপূর্ব কাজ করা তাতে মূল্যবান পাথর বসানো লাল চান্দেরী শাড়ি। খোপায় জড়িয়ে দিল মুক্তার মালা।
নির্দিষ্ট সময়ে হাতির পিঠে চেপে এলেন কুমার দলপত শাহ। বর দেখে সখীদের সে কী উচ্ছ্বাস! রাজকন্যার কাছে সেই উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়ে গেল তারা। এরপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সখীরা ছাদনাতলায় ঘুরে ঘুরে বিবাহের গান গাইল। মন্ত্রোচ্চারণ, উলুধ্বনিতে মুখর হল পরিবেশ। মালাবদল, শুভদৃষ্টি, সিন্দুরদান সমাপ্ত হল।
এবারে পতিগৃহে যাবার পালা। দুর্গাবতী মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন, বাবা কিরাত রাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে ঠিক সেই ছোট্ট মেয়েটির মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। পিতা-পুত্রীর চোখের জলে বুক ভেসে গেল। সখীদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। কান্না সমাপনান্তে হাতির পিঠে কুমার দলপত শাহের সঙ্গে উপবেশন করলেন দুর্গাবতী।
চান্দেল রাজপুতেরা তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে চললেন। তাঁদের রাজ্যের সীমানা পার করে তাঁরা ফিরে আসবেন। বর এবং বরযাত্রীদের সঙ্গে ছিল প্রচুর গোন্দ সেনা। এরপর তারা পথ দেখিয়ে সাবধানে কুমার এবং নববধূকে প্রাসাদে নিয়ে যাবে। রাজবাড়ি থেকে যাঁরা এসেছিলেন ঘোড়ায় চেপে, তাঁরাও এগিয়ে গেলেন গন্ডোয়ানার দিকে। দিনে দিনে ফিরে যেতে হবে। পথে বেশ কয়েকটা বন পড়বে। সেখানে নানান হিংস্র জন্তুজানোয়ারের বাস। যদিও তাঁদের সঙ্গে যারা আছে, তাদের সামনে কোনও হিংস্র প্রাণী আসার সাহস পাবে না।
দলপত যখন রানি দুর্গাবতীকে নিয়ে গন্ডোয়ানার প্রাসাদে উপস্থিত হলেন, প্রাসাদে আনন্দের হিল্লোল উঠল। রানিমাতা পুত্র এবং পুত্রবধূকে বরন করে নিলেন। মহারাজ সংগ্রাম শাহ দুই হাত ভরে আশীর্বাদ করলেন। বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠরা সকলে দলপত শাহ এবং দুর্গাবতীকে আশীর্বাদ করলেন। মহারাজ সেদিন প্রাসাদে যত প্রজারা উপস্থিত ছিল সকলকে পেট পুরে খাওয়ালেন এবং প্রচুর দানধ্যান করলেন। গোন্দ প্রজারা তৃপ্ত হল। তারা মনে মনে ঈশ্বরের কাছে এঁদের মঙ্গল কামনা করল।
দলপত ছিলেন গন্ডোয়ানার রাজা সংগ্রাম শাহের একমাত্র সন্তান। এই বিবাহের ফলে চান্দেলদের সঙ্গে গোন্দ বংশের আত্মীয়তা স্থাপিত হল।
সেই সময়ে চান্দেলদের সামনে এক মস্ত বড়ো শত্রু ছিলেন। তাঁর নাম হল শের শাহ সুরি। তিনি ছিলেন একজন প্রবল পরাক্রমশালী আফগান বীর। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন মুঘল সম্রাট বাবরের একজন সাধারণ সেনা হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি মুঘলদের প্রধান সেনাপতি পদ লাভ করেন। বাবর তাঁকে বিহারের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন। এরপরে বাবরের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র হুমায়ূন দিল্লির মসনদে বসলেন। হুমায়ূন যখন অন্যত্র অভিযানে ব্যস্ত, সেই সময়ে শের শাহ সুরি বাংলা জয় করে সুরি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করলেন। নিজেকে বাংলার নতুন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সেনানায়ক এবং যোগ্য প্রশাসক। এই মেধাবী রণকৌশলবিদ একদিন চান্দেলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। চান্দেল রাজ কিরাত রাই শের শাহ সুরির শক্তিমত্তার কথা জানতেন। সেই সময়ে তাঁর যা সৈন্য ছিল সেই সৈন্যসামন্ত নিয়ে শের শাহ সুরির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে তাঁর পরাজয় অনিবার্য। কিরাত রাই তখন নতুন আত্মীয় গোন্দ রাজ সংগ্রাম শাহের কাছে চান্দেলদের সমূহ বিপদের কথা জানিয়ে একজন পত্রবাহককে পাঠালেন।
সংগ্রাম শাহ আদ্যোপান্ত সেই পত্র পাঠ করলেন। তারপর পত্রবাহকের কাছে পত্রের উত্তর পাঠালেন,
‘যথা বিহিত সম্মান পুরসরঃ নিবেদন মিদং,
শুনুন বৈবাহিক মহাশয়, আপনি অযথা ভীত হবেন না। শীঘ্রই আমার বিশ হাজার সেনা আপনার কালিঞ্জরে পৌঁছে যাবে। আমি বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভেবে যুদ্ধের প্রয়োজনে সামান্য কিছু অর্থ এবং যৎকিঞ্চিৎ খাদ্য-খাবার পাঠানোর বন্দোবস্ত করছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। অন্যান্য সকল সংবাদ কুশল তো? শরীরের দিকে খেয়াল রাখবেন। কোনোরকম সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় জানাবেন।
ইতি,
আপনার পরম সুহৃদ সংগ্রাম শাহ’
কিরাত রাই দেখলেন মাত্র দিন কয়েকের ভিতরে গোন্দরাজ তাঁকে বিশ হাজার সৈন্য, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো ছাড়াও বিপুল অর্থ এবং পঞ্চাশটি হাতি, দুইশত যুদ্ধ পটু ঘোড়া এবং পঞ্চাশটি সাধারণ ঘোড়ার পিঠে খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়ে তাঁকে সাহায্য করেন।
কিরাত রাই এখন অনেকটা স্বস্তিবোধ করলেন।
এদিকে শের শাহ সুরি তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন কালিঞ্জর দুর্গ দখল করতে। ত্রিশ হাজার সৈন্যসামন্ত নিয়ে রে রে করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলেন বিন্ধ্য পাহাড়ের পাদদেশে, কালিঞ্জর দুর্গের প্রায় সামনে।
এদিকে কিরাত রাইয়ের সেনাপতিরা তো আগেভাগে দুর্গের চতুর্দিকে সেনা নামিয়ে দিয়েছেন।
কী ভয়ানক লড়াই হল চান্দেলদের সঙ্গে শের শাহ সুরির সেনাদের! গোলা-বারুদে বাতাস ভারী হয়ে এল। মুহুর্মুহু কামানের গর্জন, গোলার শব্দ বিন্ধ্য পর্বতকেও কাঁপিয়ে তুলল। প্রচুর হাতি, ঘোড়া, উট মারা গেল। দুই পক্ষের প্রচুর সেনা নিহত হল। রক্তের বন্যা বইল বিন্ধ্য পাহাড়ে। শেষমেশ শের শাহ সুরি নিজেই নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে এগিয়ে এলেন। ওদিকে বিপক্ষে কিরাত রাই। যুযুধান দুই পক্ষ। তিনিও কম যান না।
যুদ্ধ করতে করতে কখন যেন শের শাহ সুরি কালিঞ্জর দুর্গের ভিতরে ঢুকে গেলেন সে খেয়াল নেই। কিরাত রাইয়ের সেনারা সেই অপেক্ষাতেই ছিল। তারা যেন ইচ্ছা করেই আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগল। উদ্দেশ্য, শের শাহ সুরিকে একবার দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করানো। কিরাত রাই সেনাদের সেইরকম নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন।
কালিঞ্জর দুর্গের একপাশে সুচারুরূপে রাখা ছিল বারুদের স্তূপ। শের শাহ সুরি যুদ্ধ করতে করতে একেবারে গিয়ে পড়লেন সেই স্তূপের সামনে। আর ঠিক সেই সময়ে চান্দেল রাজপুতদের একজন সেনা অত্যন্ত সুকৌশলে সেই বারুদে আগুন নিক্ষেপ করল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হল এবং সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সেই বারুদের স্তূপ। শের শাহ সুরির সঙ্গে প্রচুর সৈন্য, হাতি, ঘোড়া সেই আগুনে মারা গেল।
কিরাত রাই জয়ী হলেন। কালিঞ্জরে আবার খুশির বান ডাকল।
চার
বিবাহের পরে স্বামীগৃহে দুর্গাবতী খুব সুখে দিন কাটাতে লাগলেন। কত মধুর সেইসব দিনগুলো। দলপত অবসর সময়ে দুর্গাবতীর সঙ্গে গল্প করেন। তাঁদের বংশের নানান কীর্তির কথা, কত বড়ো বীর ছিলেন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা। তাঁর পিতামহ ছিলেন সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তিনি অনেক কাব্য রচনা করেছিলেন। তাদের ভিতরে একটি কাব্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। দলপতের নিজের কাছে রাখা আছে সেই কাব্যগ্রন্থ।
দুর্গাবতীর পুস্তকপ্রীতির কথা তিনি শুনেছিলেন। তাই তিনি সেইসব বই যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছিলেন নিজের দেরাজে। নতুন বধূকে দেখানোর জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে আছে।
কথা বলতে বলতে দলপত উঠে গিয়ে দেওয়ালের দেরাজ খুলে নিজেই বের করে আনলেন পিতামহের গ্রন্থখানি। দুর্গাবতী হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন ‘রাসরত্নমালা’ বইটি।
দলপতের অনেক আগেই পড়া হয়ে গেছে বইটি। এরপর পিতামহের এই বইটি দুর্গাবতী পুরোটাই পড়ে ফেললেন। কী সুন্দর বর্ণনা! পড়তে পড়তে মুগ্ধ হলেন রানি। মানসচক্ষে দাদামশায়কে যেন দেখতে পেলেন।
আস্তে আস্তে দুর্গাবতী দলপতের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠলেন। শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে দলপত অনেক সময়ে রানির সঙ্গে আলোচনা করতেন। উৎসবে, ব্যসনে রানি সবসময় তাঁর পাশে থাকতেন।
দলপত রানিকে নিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়তেন আশপাশ পরিদর্শনে। কখনো-বা কেল্লার ছাদে বসে দুইজনে বসন্ত পূর্ণিমা রাতে প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে বিভোর থাকতেন। দলপত শাহের কোলে মাথা দিয়ে গল্প শুনতে শুনতে দুর্গাবতী ঘুমিয়ে পড়তেন। মহারাজ দলপত শাহ রানির চুলের ভিতরে, তাঁর কপালে, মুখে হাত বোলাতেন। কখনও কপালে মিষ্টি করে চুম্বনরেখা এঁকে দিতেন। অবাক হয়ে চাঁদের মতো স্নিগ্ধ, লাবণ্যময়ী ঘুমন্ত রানির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতেন পৃথিবীতে দুর্গাবতীর মতো এমন সুন্দর মানুষ আর একটিও আছে কি?
দলপতের শিকারের নেশা। সপ্তাহে কোনও একদিন তিনি দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শিকার করতে। দলপত যখন শিকারে যান, শিকার থেকে না ফেরা পর্যন্ত রানি তাঁর পথের দিকে চেয়ে থাকেন কখন তিনি ফিরবেন। কেল্লায় মহারানির কক্ষসংলগ্ন রাস্তার দিকে ঝুলন্ত একটি ঘেরা বারান্দামতো ছিল, রানি সেখান থেকে ঝুঁকে পড়ে রাস্তার লোক চলাচল দেখতেন। পাহাড়ের ঢালে গরু, ভেড়া, ছাগল চরাত যে কিশোর-কিশোরীরা, তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। যখন কোনও গোন্দ কিশোর ছোট্ট হরিণছানা কিংবা সজারু কিংবা কাঠবেড়ালি কি বেজি শিকার করে ঝুলিয়ে পিঠের উপরে ফেলে নিয়ে যেত, তাঁর বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠত। তিনি যদিও জানতেন গরিব উপজাতি মানুষের এটাই খাদ্য। এটাই তাদের পেশা এবং নেশাও। তবুও।
বিভিন্ন পার্বণে মেতে উঠত মানুষ। গোন্দ উপজাতির মানুষেরা নানান ধর্মীয় উৎসব পালন করত। তারা শস্য রোপণের আগে যেমন মাটিকে পূজা করত, তেমন শস্য তোলা হয়ে গেলেও মাটিকে পূজা দিত। মাটি তাদের মায়ের মতো।
পূর্ণিমাতে রাতে তারা মহুয়া খেয়ে নাচগান করত, পুরুষ মহিলা সকলে একসঙ্গে ধামসা-মাদল-বাঁশি সহযোগে নাচগান করত, আমোদ করত। পার্বণের দিনে গোন্দ রমণীরা রানির কাছে আসত। রানির কাছে এলে তিনি গোন্দ বালিকা কিংবা রমণীদের খুশি হয়ে তাঁর হাতের বাজু, চুড়ি, অঙ্গুরীয় খুলে উপহার দিতেন। গলা থেকে খুলে গোন্দ কিশোরীর গলায় পরিয়ে দিতেন মুক্তার মালা। কোনও গরিব প্রজা যদি একবার প্রাসাদে কারও কাছে কিছু চাইতে আসত তিনি কখনও কাউকে নিরাশ করতেন না। তাঁর প্রজারা অভুক্ত আছে এ-কথা জানতে পারলে তিনি সেইদিন নিরন্ন উপবাসে থাকতেন। প্রজারা সকলে তাঁর সন্তানের মতো। তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন না করতে পারুক, কিন্তু তাদের খাদ্যের যেন কোনও অভাব না থাকে। তাঁর রাজ্যে তাঁর প্রজারা অভুক্ত থাকবে এটিকে তিনি ঘোর অমঙ্গল বলে মনে করতেন।
দলপত শাহ দুর্গাবতীর মতো এমন রমণীরত্ন পেয়েছেন বলে নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করতেন।
দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেল।
কিছুদিন বাদে তাঁদের প্রাসাদ আলো করে এক পুত্রসন্তান হল। রাজগুরু তার নামকরণ করলেন বীর নারায়ণ।
বীরই বটে সে। খুব ছেলেবেলা থেকেই সে নানারকম বীরত্বের পরিচয় দিতে লাগল। গোন্দ বালকদের সঙ্গে একবার কেল্লার পাশের জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এল তিনটি নরম তুলতুলে ছানা। ছানাগুলো রোদ্দুর পোয়াবার জন্যে সবেমাত্র বন থেকে একটু বাইরে এসেছিল। সেখানেই কুমার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে চলে গিয়েছিল। বিড়ালছানা মনে করে তাদের প্রাসাদে আনতেই মন্ত্রীমশায়ের চোখ কপালে উঠল। আরে, এ তো চিতার বাচ্চা!
রানি মাথা নাড়লেন, “তাই আমি বেশ কিছু সময় ধরে কেল্লার চারপাশে একটা চিতার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে কেল্লার চারধার ঘুরে ঘুরে চিতাটা ডেকে বেড়াচ্ছে। একজন দাসী এসে খবর দিলে, কেল্লার বাইরে একটা চিতা ঘোরাফেরা করছে। আমি তাড়াতাড়ি দেখতে এলাম নারায়ণ কেল্লার বাইরে খেলতে গেছে কি না। যা ভেবেছি ঠিক তাই, কী সর্বনাশ! ও আবার জঙ্গলে গিয়েছিল? ওই তো, শুনুন, মা-চিতা ছানাদের দেখতে না পেয়ে কেমন ভয়ংকর চীৎকার করছে।”
সকলে শুনতে পাচ্ছে চিতার সেই আর্তনাদ। সন্তান হারানোর শোকে মা-চিতাটা উন্মাদিনীর মতো ঘুরছে। এদিকে ছানাগুলোও কেমন কুঁইকুঁই করে ডাকছে। সম্ভবত ওদের মা ছানাদের গলা শুনতে পেয়েছে এবং গায়ের গন্ধ পেয়েছে। এক্ষুনি ছানাগুলোকে জঙ্গলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
জঙ্গলে ফেরত পাঠাতে হবে ছানাদের?
মায়ের মুখ থেকে কথাটা শোনামাত্র শিশু নারায়ণ বাচ্চা তিনটেকে কোলে জড়িয়ে ধরল।
“ছাড়ো, ছাড়ো, ছেড়ে দাও বলছি! ওদের মা কান্নাকাটি করছে শুনতে পাচ্ছ না?”
“পাচ্ছি, কিন্তু এদেরকে আমি পুষব।”
শিশু নারায়ণের কথা শুনে সকলে হেসে উঠল।
“কিন্তু ওরা যে মায়ের দুধ খায়। আমরা এখানে ওর মায়ের দুধ কোথায় পাব, বলো?”
সত্যি তো! নারায়ণেরও এখন চিন্তা হল। ছানাদের নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। সে তো অনেকক্ষণ আগে ছানাগুলোকে ধরে এনেছে। অবশেষে সে রাজি হল একটা শর্তে যে সে নিজেই যাবে এদেরকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে। চার বছরের শিশুর আচরণ দেখে রাজপরিবারের সকলের চোখ কপালে উঠেছে। একজন প্রহরী তখন নারায়ণের হাত থেকে বাচ্চা তিনটিকে নিয়ে কেল্লার ফটকের বাইরে গিয়ে বনের পথে ছেড়ে দিল। কেল্লা থেকে কিছুটা গেলেই জঙ্গল শুরু হয়েছে। ছানাগুলোকে ছেড়ে দিতেই তারা পাশের জঙ্গলে মায়ের কাছে একছুটে চলে গেল।
প্রাসাদের সকলের আদরে আহ্লাদে কুমার নারায়ণ বেড়ে উঠতে লাগল।
কিন্তু রানির এই সুখ খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না। কয়েক বছর বাদে ১৫৫০ সালে দলপত শাহ মারা গেলেন। তখন তাঁদের শিশুপুত্র বীর নারায়ণের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। অসহায় দুর্গাবতী তখন রাজ্যভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। দেওয়ান আধার সিমহা এবং মন্ত্রী মানসিংহ এগিয়ে এলেন। তারা গন্ড রাজত্বের এহেন দুর্দিনে রানিকে কথা দিলেন, রাজ্য পরিচালনার জন্যে যা যা করা প্রয়োজন সেই ব্যাপারে তাঁরা রানিমাতার সঙ্গে আছেন। যখন যে-কোনো পরিস্থিতিতে তাঁরা রানিমাতার আদেশ পালন করবেন। তখন তাঁরা সিং হরগড় কেল্লাতে থাকতেন। মন্ত্রী মানসিংহ এবং দেওয়ানের পরামর্শমতো রানি রাজধানী স্থানান্তরিত করার কথা ভাবলেন। সেইমতো সিং হরগড় থেকে রাজধানী সরিয়ে চৌরাগড়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব শুরু হল। অত্যন্ত সুকৌশলে নির্মাণ করা হয়েছিল দুর্গ। চারদিক ঘন জঙ্গলে বেষ্টিত এই দুর্গ ছিল বেশ সুরক্ষিত। হঠাৎ কেউ তাঁদের এই দুর্গে প্রবেশ করতে পারত না।
সেই কতকাল আগে ১৩০৮ সাল থেকে গোন্দ রাজারা সিং হরগড়ে রাজত্ব করতেন। রাজা সংগ্রাম সিং ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান একজন গোন্দ শাসক। গোন্দ রাজদের সুখ এবং সমৃদ্ধিতে মুঘলরা বরাবরই ঈর্ষাকাতর ছিল। সিং হরগড় ছেড়ে আসার সময়ে দুর্গাবতীর কষ্ট হয়েছিল ভীষণ। কারণ, এখানেই নববধূ হিসাবে তিনি প্রথম পা রাখেন। তাঁর পতিগৃহ বলতে তিনি এটাকেই বুঝতেন। এখানেই জন্ম হয়েছিল বীর নারায়ণের। আর এখানেই মারা যান তাঁর প্রাণসখা রাজা দলপত শাহ। কিন্তু মন্ত্রী আর বিচক্ষণ দেওয়ানের কথা তিনি অগ্রাহ্য করেন কী করে? তাঁরা যখন বলছেন এই স্থান মোটেও নিরাপদ নয়, তখন তো তাঁকে চলে যেতেই হবে। তবে সিং হরগড় ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবতেই রানির বুকের ভিতরটা কেঁদে উঠল। যখন দেখলেন তাঁর সামনে গোন্দ প্রজারা চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে। তিনি তাদের কথা দিলেন সুযোগ পেলেই তিনি এখানে চলে আসবেন। এই কেল্লা তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয়। কত স্মৃতি ধরা আছে এই পাষাণ প্রাচীরগাত্রে। তাছাড়া সিং হরগড় থেকে চৌরাগড় তো খুব বেশি দূর নয়।
পাঁচ
এদিকে বাদশা আকবর যখন আসফ খানের মুখ থেকে রানি দুর্গাবতীর রাজ্যের সমৃদ্ধির কথা শুনলেন তখন থেকেই তাঁর লক্ষ্য হল কীভাবে এবং কত তাড়াতাড়ি গন্ডোয়ানা দখলে আনা যায়। মালব্য জয় করার পরে তাঁদের লক্ষ্য হল গন্ডোয়ানা রাজ্য দখল করা। কিন্তু মুঘল সেনারা বেশ কিছুদিন যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত বোধ করায় আসফ খান একটু সময় নিলেন। সেই সময়ের ভিতরে তিনি গুপ্তচরদের কাজে লাগিয়ে রানির রাজ্যের নানান খবরাখবর সংগ্রহ করতে লাগলেন।
রানি শুনলেন প্রায় ৭০,০০০ সেনা নিয়ে আসফ খান তাঁর সিং হরগড় দুর্গ দখল করতে আসছে। খুব দ্রুত মুঘল সৈন্যরা সিং হরগড়ের চারদিক ঘিরে ফেলার জন্যে বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে তারা এই কাজ করছে যাতে কেউ টের না পায়। দিনেরবেলায় চুপ থাকে, কিন্তু রাতে যখন চারদিক শান্ত হয়ে আসে, রাজের মানুষেরা গভীর ঘুমে অচেতন, তখন একটু একটু করে তারা অগ্রসর হতে থাকে। গন্ডোয়ানার চারদিকে তখন ভয়ংকর জঙ্গল। সেই জঙ্গলের ভিতরেই মুঘল সেনারা ঘাঁটি গেড়েছিল। বেশিরভাগই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন। তারা সারাটা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে আর সন্ধের পরপরই ঘুমিয়ে পড়ে।
মাত্র কয়েকদিনের ভিতরে বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছে মুঘল বাহিনী। গন্ডোয়ানা রাজ্যের কাছাকাছি এসে দারুণ লুঠপাট চালাতে লাগল মুঘল সেনারা। দুর্গ পৌঁছাতে আর বেশি দূর নয়। রানি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এই দুর্গ ছেড়ে চলে যাবেন চৌরাগড় দুর্গে। চৌরাগড় সিং হরগড়ের চাইতে অনেক বেশি সুরক্ষিত।
সিদ্ধান্ত নেওয়া মাত্র দ্রুত তাঁর রাজধানী সিং হরগড় থেকে চৌরাগড় কেল্লাতে স্থানান্তরিত করলেন। কিছুদিনের ভিতরেই মুঘল সেনারা একদিন ঝাঁপিয়ে পড়ল সিং হরগড় দুর্গের উপরে। তখনও পর্যন্ত তারা জানত যে রানি এবং রাজ পরিবারের সকলে এই দুর্গেই আছেন। তাঁরা যে গোপনে অন্যত্র চলে গেছেন এ-কথা তাদের অজানা ছিল। প্রাসাদে ছিল কিছু গোন্দ প্রজা যারা পাহারা দিচ্ছিল এই দুর্গ। গোলা এবং কামানের আঘাতে কেল্লার অনেকাংশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। যারা পাহারা দিচ্ছিল অনেকেই মারা গেল গোলার আঘাতে। কেল্লার বেশ কিছু অংশ ভেঙে পড়ল। ততদিনে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সিং হরগড়।
চৌরাগড় ছিল সাতপুরা পাহাড়ের উপরে। তিনদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা এবং একদিকে খরস্রোতা নর্মদা নদী বেষ্টিত বেশ সুরক্ষিত অঞ্চল। রানি এখানে এসে আগের চাইতে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। শত্রুরা কিছুতেই এই দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করতে সাহস করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর একজন প্রহরী জীবিত থাকবে। পাহাড়ে ওঠার একমুখী রাস্তায় কঠোর পাহারার ব্যবস্থা করা হল। দুর্গের প্রধান ফটকে প্রচুর দ্বাররক্ষী মোতায়েন করা হল। রাজ্যের সর্বত্র গুপ্তচর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন খবর আদানপ্রদানের জন্যে। রানি প্রত্যহ নিজের মুখে গুপ্তচরদের কথা শুনতে লাগলেন। তাদের কাছ থেকেই খবর পেলেন, আসফ খান দুইদিক থেকে তাঁর দুর্গ আক্রমণের কথা ভাবছেন। তিনি এও ভাবছেন, পাহাড়ের পথ বন্ধ করে দিলে উপরের মানুষগুলো না খেতে পেয়ে একদিন মারা যাবে। তাদের কাছে তিন মাসের রসদ আছে, প্রয়োজনে আরও রসদ পাঠাবে দিল্লি থেকে। মুঘদের গোলার শব্দ এর ভিতরে তাঁর কানে এসে পৌঁছেছে। যেন রণমদে মত্ত হাতি হুংকার ছাড়ছে এমনি নাকি আসফ খানের গলা। রানি ভাবলেন, শীঘ্রই মুঘল সেনারা তাঁর কেল্লার খুব কাছেই এসে পড়বে। যেভাবে তারা অগ্রসর হচ্ছে। তাঁকে এখন কিছুটা কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
কিন্তু সেও হাতে গোনা কিছুটা মুহূর্ত। একবার যখন মুঘল সেনারা এগিয়ে এসেছে, তখন তারা এর শেষ দেখে ছাড়বে। রানি অনুচরদের সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন সংবাদ আনয়নের জন্যে।
রাজ অনুচর মারফত রানি খবর পেলেন মুঘল সেনারা বিশাল বাহিনী, হাতি, ঘোড়া, উট নিয়ে একটু একটু করে তাঁর রাজধানী চৌরাগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রানির গুপ্তচর এসে আরও একটি খবরটা দিল যে আজ রাতের ভিতরে নাকি তারা নারাইয়ের জঙ্গল পর্যন্ত এসে পড়বে। তাদের তাবু, কানাত, সেপাই-সান্ত্রী, ঘোড়া, উট, হাতি যা যা আছে সব নিয়ে চলে এসেছে। আজ সকলে ক্লান্ত। তাই বিশ্রাম চাইছে। পরের দিন প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হবে।
অচিরেই তো তারা দুর্গের চারপাশ ঘিরে ফেলবে! রানি শঙ্কিত হলেন।
দুর্গাবতী সেনাপতিদের ডাকলেন। আমীর এবং ওমরাহ, মন্ত্রীদের ডেকে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন মুঘলদের বিপুল সংখ্যক সৈন্যদের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করলে তাদের পরাজিত করা যায় এবং এই অঞ্চল থেকে হটিয়ে দেওয়া যায়। পরের দিন রানি যোদ্ধার বেশে নিজেকে সজ্জিত করলেন। মাথায় শিরস্ত্রাণ, কোমরে পরলেন কোমর বন্ধনী, বুকে লোহার জালি দেওয়া বর্ম, হাতে নিলেন ঢাল। তারপর চলে গেলেন নারায়ণ মন্দিরে। সেখানে রাখা আছে তাঁর অস্ত্রসকল। অস্ত্রাগার পাহারারত একজন রক্ষী রানিকে দেখে চমকিত হলেন। রানির কঠিন মুখ, দৃঢ় চোয়াল, দুই চোখে কঠোর প্রতিজ্ঞা। তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপ বহুদিন বাদে মনে করিয়ে দিচ্ছিল রাজা সংগ্রাম শাহের কথা। এমনি বীর ছিলেন সংগ্রাম শাহ।
রানি দুই পিধানে দুটি তরবারি এবং কোমরে আরও দুটি ভোজালি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর হাতের সোনার বাঁটে মিনে করা বিশাল তরবারি সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল। রানি তাঁর প্রিয় হস্তীর পিঠে উপবেশন করলেন। তাঁর সামনে কয়েক হাজার সেনা, আর পিছনে কয়েক হাজার। মাঝখানে তিনি চলেছেন যুদ্ধ করতে।
রানি তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে চলে এলেন নারাইতে, মুঘলদের সঙ্গে লড়াই করতে। এটি ছিল একটি অসম লড়াই। কোথায় হাজার হাজার মুঘল সৈন্য আর কোথায় রানির অল্প কিছু সৈন্য। কিন্তু নারাই ছিল পাহাড়ের উপরে একটি জায়গা। এর একদিকে ছিল গৌর নদী এবং অপরদিকে নর্মদা। রানি দুর্গাবতী ইচ্ছা করেই সেইদিকে অগ্রসর হলেন।
তাঁর আগমন সংবাদ পেয়ে আসফ খান তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে সেই পাহাড়ের উপরে অগ্রসর হলেন। কিন্তু এই পথ আসফ খান এবং তাঁর সেনাদের ছিল একেবারেই অচেনা একটি জায়গা। একধারে পাহাড় এবং গভীর জঙ্গল, অন্য দুইদিকে অতলস্পর্শী খাদ এবং নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা গৌর এবং নর্মদা নদী। ডানে-বাঁয়ে দুইদিকেই প্রতিরোধের প্রাচীর। সামনের দিকে তারা সাবধানে অগ্রসর হতে লাগল। অপরিচিত জায়গায় যুদ্ধ করার নানা সমস্যা। কোথা থেকে গোলা বর্ষিত হচ্ছে বোঝার আগেই অন্য আরেকদিক থেকে শত্রুপক্ষের ঝাঁকে ঝাঁকে তির এসে বিদ্ধ করে দিচ্ছে মুঘল সেনাদের। তারা ভূপতিত হয়ে পড়ছে তিরের অব্যর্থ লক্ষ্যে।
এদিকে দুর্গাবতীর সেনাদের কাছে এই অঞ্চল তো হাতের তালুর মতোই চেনা। তাই তারা অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল। পাহাড়ের উপরে বড়ো বড়ো পাথরখণ্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে রানির সেনাদল বীরবিক্রমে লড়াই করতে লাগল। রানি নিজেও অস্ত্র হাতে এগিয়ে গেলেন। একদিকে মুঘলদের প্রশিক্ষিত সেনা, প্রচুর গোলা-বারুদ, মজুত করা সেনা আর অন্যদিকে রানির স্বল্প সংখ্যক প্রশিক্ষিত সেনা।
রানি অনেক সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। দুই পক্ষের প্রচুর সেনা মারা গেল। দারুণ ক্ষয়ক্ষতি হল দুই পক্ষের। সাতপুরা পাহাড়ের উপরে রক্তের গঙ্গা বয়ে গেল। গোলা-কামানের শব্দে বনের পশুরা প্রাণভয়ে পালাতে লাগল। পাখির দল ডানা মেলে আকাশে উড়ল। বন থেকে বেরিয়ে পড়ল ভালুক তার ছানাপোনা নিয়ে, বেরিয়ে পড়ল হিংস্র শার্দূল, পালাল শিয়ালের দল, যত হায়েনা, চিতা, বন্য বরাহ আর বুনো কুকুরের দল। প্রাণভয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে গেল। বনের ভিতরেও এক হুড়োহুড়ি কাণ্ড বেধে গেল। শুধু কিছু সরীসৃপ ভয়ে গর্তের ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। ইঁদুর-খরগোশের দল জঙ্গল আগাছা আর পাতাপুতির ভিতরে লুকিয়ে রইল। হরিণের পাল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে গিয়ে তাদের শিঙে লতাপাতা জড়িয়ে গেল। বাঁদরেরা তাদের সাহায্য করতে ছুটে না এলে তারা ভয়েই মারা যেত। সবশেষে পালাল বানরের দল। এ-গাছ সে-গাছ লাফিয়ে বন থেকে বনান্তরে পালিয়ে গেল। গোলার আগুনে জঙ্গলে আগুন লেগে গেল। কতশত প্রাণী যে মারা পড়ল যুদ্ধের আগুনে তার কোনও হিসাব থাকল না। বাতাস ভারী হয়ে এল বারুদের গন্ধে। শকুনের দল আকাশে উড়তে লাগল। আগুনের লেলিহান শিখা বহুদূর থেকে দেখা গেল।
নারাই নালার এ যুদ্ধে রানির অসংখ্য সেনার সঙ্গে ফৌজদার বীর অর্জুন দাস মারা গেলেন।
মুঘলদেরও বিশাল সংখ্যক সেনা মারা গেল। যুদ্ধে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত রানি অপরাজিত থাকলেন। দুই পক্ষেরই প্রচুর ক্ষতি হল। কিন্তু রানির ক্ষতির পরিমাণ ছিল ভয়াবহ। রানি দুর্গাবতী অত্যন্ত কৌশলে নারাই নালার এই যুদ্ধে জয়লাভ করলেন। তাতে মুঘল সেনাপতি তখনকার মতো পিছু হটলেন।
আসফ খান নিজের বোকামি বুঝতে পারলেন। সমতল আর পাহাড়ের রণকৌশল আলাদা। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধ করতে হলে সেই জায়গা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় তাঁর এই হার হল। এবারে তাঁকে অন্য উপায় চিন্তা করতে হবে।
ছয়
রাত গভীর। রানি তাঁর একজন সহচরীকে সঙ্গে নিয়ে কেল্লা থেকে বেরিয়ে এলেন। কালো পোশাকে সর্বাঙ্গ ঢেকে নিয়েছেন দুইজনে। প্রহরীকে আগেই বলা ছিল, তাই দুর্গ থেকে বের হতে কোনও বাধা রইল না।
দুর্গাবতী এবং তাঁর সহচরী পদ্মা পাথুরে রাস্তা ধরে নীচে নেমে এলেন। এখান থেকে ভেদাঘাটের দূরত্ব অনেকটাই। প্রায় তিন কিমি পথ। একে নিশুতি রাত, রাস্তার দুইধারে ঘন জঙ্গল। তার উপরে বনে হায়েনা, ভালুক ছাড়াও রয়েছে হিংস্র চিতার উৎপাত। কখন অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ভয়ও আছে। কিন্তু আজ রানি দুর্গাবতী নির্ভয় চিত্তে পথ চলতে লাগলেন। দেবী পার্বতীর নাম করতে করতে তাঁরা দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলেন। মাথার উপর দিয়ে একটা উড়ন্ত কাঠবেড়ালি উড়ে গেল। সহচরী ভয়ে দুই পা পিছিয়ে এল। নিঃশব্দে তাঁরা পথ চলতে লাগলেন। পাথরে বেশ কয়েকবার ঠোক্কর খেলেন রানি। পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। কিছুটা যেতেই একটা ঝনঝন শব্দ শুনতে পেলেন তাঁরা। একটু বাদেই পথে এক পাল শজারুর দেখা মিলল। দ্রুত গতিতে শজারুর দলটা ডানদিকের বাঁশ আর ঘাসের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে বামদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল।। রানি বুঝতে পারলেন এর কাঁটার শব্দই তাঁরা শুনতে পাচ্ছিলেন। ভাবতে-ভাবতেই অন্ধকারের ভিতরে রাস্তার পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে গেল দুটি কৃষ্ণসার হরিণ। মাথার সামনে দুইজোড়া করে শিং তাদের। কেমন ভয়ার্তভাবে তারা ছুটে গেল। তবে কি তাদের পিছনে কোনও শ্বাপদ আছে? হতে পারে তাদের তাড়া করেছে শিকারের নেশায়।
শাল, সেগুন, আর মহুয়ার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে বনপথ। বামদিকে বয়ে চলেছে নর্মদা। কানে আসছে পাহাড়ি নদীর কলরব। পাথরের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিরাম গতিতে। কিছুটা যাওয়ার পরেই হঠাৎ লাফিয়ে অনেক নীচে আছড়ে পড়ে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে বহু ধারায় বিভক্ত করে ফেলছে নিজেকে। তারপর আস্ত একটা নদী হয়ে ছুটে যাচ্ছে। এত দূর থেকে তারই ভয়ংকর শব্দ শোনা যাচ্ছে। কী প্রকাণ্ড সেই জলরাশির স্রোতের তীব্রতা! চারদিকে সহস্র জলকণায় বিশ্লিষ্ট হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে একটা ঘন কুয়াশার জাল বিছিয়ে রেখেছে। দিনের বেলায় সেই জলকণায় সূর্যের আলো পড়ে রামধনুর সৃষ্টি করছে। সে এক অপরূপ বর্ণবৈভব রচনা করছে প্রকৃতি।
দুর্গাবতীর মনে পড়ে গেল বহুদিনের এক সুখস্মৃতি। এর আগেও দুর্গাবতী দলপত শাহের সঙ্গে বহুবার এই জলপ্রপাতের ধারে এসেছেন। কখনও দাঁড়িয়ে তিনদিক ঘেরা সাতপুরা পাহাড়ের অপরিসীম শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন; কখনো-বা বড়ো পাথরখণ্ডের উপরে বসে নদীর অপরূপ গীতধ্বনি শুনেছেন। বহুদূর থেকে ছুটে আসা নদীর প্রবাহ সংগীত শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়েছেন। এই জলপ্রপাতের ধারে পাথরখণ্ডের উপরে বসে দলপত তাঁকে কত মধুর গল্প শুনিয়েছেন। এই শহরের কথা, ইতিহাস আর পুরাণ মিশ্রিত সেই গল্প। শুনিয়েছেন গোন্দ রাজাদের নানান কীর্তির কথা, গোন্দদের নানান সংস্কৃতি, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, উৎসব, পালাপার্বণের কথা। বিয়ের পর সময় পেলেই দলপত তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়তেন। প্রকৃতির সংস্পর্শে তাঁরা আরও নিবিড় করে দুজন দুজনাকে কাছে পেতেন। পরস্পর পরস্পরের গভীর সান্নিধ্য সুখ উপভোগ করতেন। সে এক সুখের দিন ছিল। বড়োই মধুর সেইসব দিন। দলপতের কথা মনে পড়তেই রানির বুকের ভিতরটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। তাঁদের দাম্পত্য জীবন তো খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না। বিধাতার নির্মম পরিহাস তাঁকে একবিন্দু স্বস্তি দিল না। ভাগ্যের কাছে সকলেই হার মানতে বাধ্য।
রানি চিন্তা করতে করতে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে গেলেন। রাত বাড়ছিল। জঙ্গলের পথ কোথাও বেশ সংকীর্ণ। সাহসী পদ্মা বেশ কয়েকবার ঝুঁকে পড়া গাছের শাখা, কাঁটার আঘাত থেকে রানিকে রক্ষা করল। এই জনহীন পথ রানি নিজেই বেছে নিয়েছেন। পথ যেন কিছুতেই শেষ হতে চায় না।
সহচরী পদ্মাকে রানি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমরা তো প্রায় এসেই গেছি, তাই না?”
পদ্মা উত্তর দেয়, “হ্যাঁ মহারানি, আর মাত্র মিনিট পাঁচেকের পথ। এবারে আমাদের কিন্তু পথে নামত হবে।”
রানি দেখলেন সামনেই বিশাল উঁচু পাহাড়। একে টপকানো সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। অগত্যা বন ছেড়ে পাথুরে রাস্তায় পা রাখলেন অতি সাবধানে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে। যদিও কালো বস্ত্রে আবৃত তাঁদের সর্বাঙ্গ, তবু শত্রুর তো অভাব নেই। মুঘলদের গুপ্তচরেরা যে কত ধুরন্ধর আর কতটা খতরনাক এর আগেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা পৌঁছে গেলেন তাঁদের অভীষ্ট দেবীর কাছে। সেই কোন দশম শতাব্দীতে কলচুর বংশের একজন শাসক নির্মাণ করেছিলেন চৌষট্টি যোগিনী মন্দির। সাতপুরা পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় দেবী পার্বতীর মন্দির। পাহাড়ের ধাপ কেটে বানানো হয়েছে সিঁড়ি। অনেকটা খাজুরাহো মন্দিরের আদলে তৈরী করা হয়েছিল মূল মন্দিরটি। মন্দিরের ভিতরে নন্দীর পিঠের উপরে উপবেশন করে আছেন দেবী পার্বতী। সেই মন্দির ঘিরে গোলাকারভাবে প্রতিটি একক গ্রানাইট পাথর কেটে বানানো হয়েছে চৌষট্টিজন যোগিনীর মূর্তি। রানি দুর্গাবতী এর আগেও এসেছেন এখানে। নিজের হাতে পূজা দিয়েছেন দেবীকে। দেখেছেন বৃত্তাকারভাবে পরিব্যাপ্ত রয়েছেন বহুরূপা, তারা, নর্মদা, যমুনা, শান্তি, বারুণি, ক্ষেমংকরী, ঐন্দ্রী, বারাহী, রনবীরা, কালরাত্রি, ছিন্ন মস্তিকা, করাকালী, নারসিঙ্ঘী, মহালক্ষ্মী, কৌমারী, যক্ষিণী, বিনায়কী, মাহেশ্বরী, ঘটাবরী, জ্বালামুখী, আগ্নেয়ী, ধূমাবতী, ভদ্রকালী ইত্যাদি। ৬৪জন তান্ত্রিক যোগিনী প্রত্যেক আলাদা কক্ষে আছেন।
দুর্গাবতী দলপত শাহের মুখ থেকে শুনেছিলেন, দেবী দুর্গা এক প্রবল মহাশালী দৈত্যকে পরাজিত করার জন্যে নাকি ৬৪জন যোগিনীর রূপ ধারণ করেছিলেন।
পাহাড়ের ধাপ কেটে বানান হয়েছে সিঁড়ি। প্রায় দুইশত ধাপ পেরোলে তবে মূল মন্দিরে পৌঁছানো যাবে, দেখা মিলবে দেবীর।
রানি দুর্গাবতী সখী পদ্মিনীকে নিয়ে অন্ধকারের ভিতরে নক্ষত্রের আলোকে ভরসা করে আস্তে আস্তে পাহাড়ের একেবারে উপরে উঠে এলেন। লাল পাথরের মন্দির। দেবী পার্বতীর সামনে বিশাল একটি পিতলের দীপ জ্বলছিল। দুর্গাবতী প্রবেশ করলেন মন্দিরের গর্ভগৃহে। দেবী পার্বতীর সামনে নতজানু হয়ে বসলেন। তারপর হাতজোড় করে দেবীর কাছ থেকে শক্তি প্রার্থনা করলেন। মনে মনে বললেন, ‘হে মাতা, তুমি তো শক্তিদায়িনী, জগতের রক্ষাকর্ত্রী, পাপ বিনাশিনী, সর্বদুঃখ হন্তারক। তুমি অগতির গতি, বিপদতারিণী মাতা, তুমি তো জানো আমার রাজ্যে কী চরম দুর্দিন ঘনিয়ে এসেছে। মুঘলেরা আমার দুর্গ ঘিরে ফেলেছে। মুঘলদের সৈন্যসংখ্যার কাছে আমাদের সৈন্য নগণ্য। তার উপরে ওদের কাছে আছে প্রশিক্ষিত সেনা, অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। দামি কামান, অসংখ্য অস্ত্র, গোলা, বারুদ, হাতি, ঘোড়া, উট—কী নেই তাদের কাছে। তুমিই পারো মা এই বিপদ থেকে রাজ্যবাসীকে বাঁচাতে। আমি আজ তোমার কাছে আশীর্বাদ চাইতে এসেছি। আগামীকাল শুরু হবে সেই কালক্ষয়ী সংগ্রাম। গোন্দ প্রজাদের ভবিষ্যৎ, আমার জীবন-মৃত্যু, পুত্র নারায়ণের আগামী জীবন—সবকিছুই নির্ভর করছে এই যুদ্ধের উপরে। গোন্দ রাজ্য এবং আমার বালক পুত্রকে রক্ষা করো মা।’
কথাগুলো বলতে বলতে রানির চোখ ছলছল করে উঠল। চোখের জলের ধারায় চিবুক, গলা, বুক ভিজে গেল।
রানি দেখলেন হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে দেবীর সামনে প্রদীপ থিরথির করে কাঁপতে লাগল। সখী পদ্মা বাইরে থেকে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিল।
রানির বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। সখী পদ্মা বাইরে দাঁড়িয়ে মন্দিরের চৌকাঠে মাথা কুটতে লাগল, “রক্ষা করো মাতা, এই বিপদ থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করো।”
হঠাৎ জোরে বাতাস বইতে লাগল। সেই নির্জন পাহাড়-চূড়ায় ততোধিক নির্জন মন্দিরের সামনে প্রকাণ্ড শব্দে দেবীর মাথার উপরে বিশাল বড়ো পিতলের ঘণ্টাটা এলোপাথাড়ি ঢং ঢং ঢং ঢং শব্দে বাজতে বাজতে এক সময় থেমে গেল।
দুর্গাবতী ধীর পায়ে মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলেন। এবার আর রাস্তা নয়, জঙ্গলের পথ ধরলেন। সখী পদ্মার নির্দেশিত পথ। সম্পূর্ণ অন্য এক রাস্তা। কারণ, ঘণ্টার শব্দে সকলেই সজাগ হয়ে গেছে। যদি মুঘলদের কেউ ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারে তো তাঁদের পিছু নিতে পারে। সেক্ষেত্রে এই পথ তাঁদের জন্যে নিরাপদ নয়।
রানি চিন্তা করতে লাগলেন। যা করার আজ রাতের ভিতরেই করতে হবে। রানির নিতান্ত অনভ্যাসে খালি পা পাথরে ঠোক্কর খেল। তিনি এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। তাঁর মাথার ভিতরে চিন্তার সূত্রগুলো সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এত অল্প সময়ের ভিতরে কীভাবে নিজেদের প্রস্তুত করবেন, ভাবতে লাগলেন। তাঁর আধখানা মন পড়ে রইল যুদ্ধক্ষেত্রে আর আধখানা মন পুত্র বীর নারায়ণের জন্যে হাহাকার করে উঠল। পিতৃহারা বালক, একাকী কী করতে পারে যদি তিনি আগামীকাল আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে না আসতে পারেন?
তিনি তাঁর প্রজাদের কথা ভাবলেন। এই দুর্দিনে কী উপায় হবে তাদের? প্রজারা তাঁর সন্তানের মতো। পিতা সংগ্রাম শাহ তাঁকে যখন পুত্রবধূ হিসাবে বরণ করে নিলেন, তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই রাজ্যের সকল প্রজা তোমার সন্তান। তুমি তাদের মাতা। তাই এই প্রজাদের রক্ষার ভার কিন্তু তোমার উপরে রইল।’
রানি তাঁর প্রজাদের সন্তানের মতোই দেখেন। প্রজারাও তাঁকে মাতার মতোই সম্মান এবং শ্রদ্ধা করে। তিনি যতটা না রানিমাতা তার চাইতে অনেকটাই প্রিয় মাতা। এমন প্রজাবৎসল সম্রাজ্ঞী ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর একটিও ছিল কি না জানা নেই।
মহারানি দুর্গাবতী শেষপর্যন্ত গোন্দ প্রজাদের স্বার্থে লড়াই চালিয়ে যাবেন মনস্থির করলেন।
সাত
দ্বিতীয় পর্যায়ে আসফ খান নতুন উদ্যমে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হলেন। আহত নাগ যেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে, আসফ খান তেমনি ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠলেন। মনে মনে বললেন, ‘তুমি মুর্খের মতো কাল কেউটের লেজে পা দিয়েছ, তাকে আঘাত করেছ। এবারে বুঝতে পারবে কেউটের ছোবল কতটা মারাত্মক হতে পারে।’
এর আগে রানি দুর্গাবতী নারাই নালার যুদ্ধে জয়ী হলেও তাঁর প্রচুর ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। মুঘলদের তুলনায় তাঁর সৈন্য মারা গিয়েছিল প্রচুর। সেই সঙ্গে হাতি এবং ঘোড়ার নিহতের সংখ্যাও কম নয়। প্রচুর সংখ্যক সেনা নির্মমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রচুর আহত সেনা এবং হাতি-ঘোড়া ছিল অসুস্থ এবং ক্লান্ত।
আসফ খানের শিবিরে সেই একই অবস্থা। মৃতের স্তূপ, আহতের আর্তনাদ আর আহত পশুদের চিৎকারে ভারী হয়েছে বাতাস। তবে তাঁর কাছে সংবাদ আছে, রানির পক্ষেও প্রচুর হতাহত হয়েছে। তিনি কিছুটা চিন্তিত এবং বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। তাই বেশি সময় নিলেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি আক্রমণ করতে বদ্ধপরিকর।
দুর্গাবতী যত তাঁর আহত সেনাদের কথা ভাবেন ততই তাঁর ভিতরে একটা যন্ত্রণা শুরু হয়। কারও হাত কাটা পড়েছে, কারো-বা পা নেই। কারও পেটে, ঘাড়ে, গর্দানে তরবারির আঘাতে ছিন্নভিন্ন অবস্থা। শিবিরে তাদের শুশ্রূষা চলছে। আহত পশুদের সেই একই অবস্থা। রানি আহত বাঘিনীর মতো গর্জে উঠলেন। কোমর বন্ধনী থেকে তরবারি উঁচিয়ে ধরলেন আকাশের দিকে। বাঘিনী যেমন তার সন্তানদের বনের হিংস্র জন্তুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে সর্বদা মুখিয়ে থাকে, তিনিও সেইভাবে মুঘলদের দিকে এগিয়ে গেলেন। আগের রাত্রে মন্ত্রী, সেনাপতি, দেওয়ান সকলকে নিয়ে একটা গোপন সভা করে যুদ্ধের কৌশল সম্বন্ধে তাঁদের পরামর্শ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করেছিলেন।
রানি চেয়েছিলেন গভীর রাতে তিনি মুঘলদের অতর্কিতে আক্রমণ করবেন। কথাটা সভায় তুলতেই তাঁরা সেনাপতিরা বাধা দিলেন। জানালেন, সেটা সম্ভব নয়।
এদিকে মুঘল শিবিরে যুদ্ধপটু মুঘল সেনাপতি নতুন করে ঘুঁটি সাজালেন।
পরেরদিন মুঘল সেনারা কেল্লার চারদিক ঘিরে ফেলল। শুরু হল যুদ্ধ। অসির ঝনঝনানি, সেনাদের চিৎকার, বৃংহণ এবং হ্রেষা রবে সাতপুরা পাহাড় কেঁপে কেঁপে উঠল মুহুর্মুহু কামানের গর্জনে। বনের পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়ে পালাল। বন্যজন্তু ছানাপোনা নিয়ে বন থেকে বনান্তরে ছুটে পালাল। কতশত শহস্র সেনা যে মারা গেল কামানের গোলার মুখে পড়ে। কত সেনা যে কাটা পড়ল তরবারি আর ছুরির আঘাতে। নিহতের রক্তে নর্মদার জল রক্তিম হল। আকাশে শকুনের দল পাক খেতে লাগল। মৃতের স্তূপ বেড়েই চলল। গোন্দ সেনারা আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে গেলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজেদের জীবন দিয়েও তদের রোধ করতে পারল না। মুঘলদের অত্যাধুনিক কামানের গোলার মুখে গোন্দ সেনারা নিমেষে উড়ে গেল।
মহারানি দুর্গাবতী তখন পাহাড়ের আড়াল থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। রানির পদাতিক সেনারা পাহাড়ের আড়ালে প্রস্তরখণ্ডের মধ্যবর্তী স্থানে লুকিয়ে বহুক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে গেল। বিভিন্ন দিক থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুটে আসতে লাগল। মুঘল সেনারা হঠাৎ হকচকিয়ে গেল। এদিকের পথঘাট তাদের অচেনা অজানা। পাহাড় কতদূর বিস্তৃত, কোথায় যে পাহাড় বাঁক নিয়েছে, কোন পথে কী বিপদ অপেক্ষা করে আছে—সবই তাদের অজানা। অজানা জঙ্গলের পথঘাট। প্রথমদিকে মুঘল অশ্বারোহী সেনারা একটু একটু করে পিছু হটতে লাগল। সমস্ত দিন তুমুল লড়াই চালিয়ে গেল যুযুধান দুই পক্ষই। সূর্যদেব সেদিনের মতো সাতপুরা পাহাড়ের আড়ালে অস্তমিত হলেন। আস্তে আস্তে চারদিক আঁধার ঘনিয়ে এল।
মহারানি কেল্লায় ফিরে এসে প্রথমেই শিবিরে প্রবেশ করলেন। সেখানে তখন শয়ে শয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত রণক্লান্ত আহত অঙ্গচ্যুত রক্তাক্ত সৈনিকের সারি। তিনি শিবিরে ঢুকে আহতদের সামনে দাঁড়ালেন। কারও হাত নেই, পা কাটা পড়েছে, কারও দুটি হাতই কাটা পড়েছে শত্রুপক্ষের তরবারির আঘাতে। প্রিয় সেনাদের দিকে তাকিয়ে রানি দুর্গাবতীর বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কয়েক পা এগোতে তাঁর নজরে পড়ল মাটিতে শায়িত আছে বেশ কয়েকজন সেনা। চিকিৎসা করেও যাদেরকে ফেরানো সম্ভব হয়নি। সামনেই মৃতের ন্যায় পড়ে আছে তার প্রিয় সেনারা, যন্ত্রণায় ছটফট করছে অগণিত সেনা। রক্তের গন্ধ, বারুদের গন্ধ পাক খাচ্ছে বাতাসে।
দুর্গাবতী ধীর পায়ে শিবির থেকে বেরিয়ে প্রাসাদে নিজের মহালে ফিরে এলেন। যুদ্ধবেশ ছেড়ে ঘরের পোশাক পরিধান করলেন। আজকের যুদ্ধ তাঁর মনের উপরে গভীর রেখাপাত করেছে। তিনি এই মুহূর্তে আগামী দিনের কথা ভেবে চিন্তিত। আজ রাতের ভিতরে নিশ্চয়ই মুঘল সেনাপতি নতুন কিছু ভাববেন। এই হার তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। কাল সকাল হলেই শুরু হয়ে যাবে নতুন উদ্যমে লড়াই। দুর্গাবতী ভাবছিলেন, তাঁর কাছে যদি মুঘলদের মতো এমন কয়েকখানি কামান থাকত তাহলে তিনি দেখিয়ে দিতেন যুদ্ধ কাকে বলে। তিনি তো নিরুপায়, অসহায়। পদাতিক, অশ্বারোহী আর হস্তি বাহিনীই তাঁর সব।
রাতে রানি দুর্গাবতী শিশুপুত্রকে বুকের ভিতরে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর আধখানা প্রাণ কাঁদতে লাগল বালক পুত্রের জন্যে আর আধখানা প্রাণ হাহাকার করে উঠল গোন্দ প্রজাদের জন্যে। তিনি তো সকলের মাতা। এই রাজ্যের সকল প্রজাদের ভার তাঁর উপরেই ন্যস্ত। তাদের সুখদুঃখ, তাদের বিপদ-আপদের তিনিই রক্ষাকর্ত্রী। তিনি কি শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারবেন এই গন্ডোয়ানা রাজ্যকে? রানির দুই চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল।
পরমুহূর্তে তিনি নিজেকে শক্ত করলেন। ছিঃ, এখন কি কান্নার সময়? তিনি দুর্গাবতী, গন্ডোয়ানার রানি, তাঁকে কি এ কান্না শোভা পায়? তিনি মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন, যে করেই হোক মুঘলদের এই রাজ্য থেকে বিতারিত করতে হবে।
আট
দ্বিতীয়দিন আসফ খান নিজেই এলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তাঁর কোমরের দুইদিকে দুটি বিশাল তরবারি অসির পিধান থেকে ঝুলছে। আর হাতে ধরা পেল্লাই সাইজের তরবারি। সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল তরবারি। আসফ খান যুদ্ধে রানিকে আহ্বান জানালেন। এতদিন এত জায়গায় যুদ্ধ করেছেন, কখনও কোনও নারীর বিরুদ্ধে তাঁকে তরবারি ধরতে হয়নি।
সকালে উঠেই রানি নিজেকে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত করলেন। মাথায় শিরস্ত্রাণ, বক্ষে লোহার আবরণ, লোহার বর্ম, হাতে তরবারি নিয়ে তিনি চললেন তাঁদের আরাধ্য দেবতা মহেশ্বরের কাছে। মন্দিরের পাশেই তাঁদের অস্ত্রাগার। অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে তিনি মহাদেবের চরণে ন্যস্ত করলেন। তারপর মহাদেবের চরণ ছুঁইয়ে একটা তরবারি কোমরে গুঁজে অন্য তরবারিটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
মন্দির থেকে বেরিয়ে দুর্গাবতী তাঁর প্রিয় হাতি রণবীরের পিঠে চেপে বসলেন। সোনার হাওদা ঝকমকিয়ে উঠল। রানির হাতের তরবারি ঝলসে উঠল রোদে।
রাস্তায় এলেন গন্ডোয়ানার বাঘিনী, রানি দুর্গাবতী। প্রজারা সকলেই তাঁকে ভয়, ভক্তি এবং শ্রদ্ধা করে। এতটা কাল তাঁকে অন্যরূপে দেখেছে, আজ দেখল মহিষাসুরমর্দিনী রূপে।
পাহাড় কম্পিত হচ্ছে হর হর মহাদেব আর আল্লা হো, আকবর ধ্বনিতে। যুযুধান দুই পক্ষ কেউই কম যায় না।
বীরের মতো লড়াই করলেন রানি দুর্গাবতী। আসফ খানেরা যুদ্ধ করতে করতে পিছু হটল। আসফ খান ভাবছিলেন মহীয়সী এই নারীর কথা। এতদিন শুধু তাঁর কথা শুনেছেন, আর আজ তাঁকে স্বচক্ষে দেখলেন। সূর্যের তেজ আর চাঁদের স্নিগ্ধতার যুগপৎ মিশ্রণে তৈরি এই নারী। সত্যিই তিনি বীরাঙ্গনা। কিরাত রাইয়ের যোগ্য পুত্রী, গোন্দ রাজাদের যোগ্য রানি। তাঁর মতো যোদ্ধাকেও পিছু হটতে হল দুইবার।
কিন্তু এত সহজে কি আর হার মানেন আসফ খান। তিনি এবারে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রানির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ লড়াই চালানোর পরে হঠাৎ একটি তির অতর্কিতে মহারানির কানের কাছে এসে বিঁধল। রানি দুর্গাবতী অত্যন্ত কৌশলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ জায়গায় চলে গেলেন। বাকি সময় তাঁর সেনাপতি লড়াই চালালেন। পিছনে রয়েছে পুত্র নারায়ণ। সেও মাতার সঙ্গে চলে এসেছে আজ যুদ্ধক্ষেত্রে। নয় বছরের বালকের কী তেজ! যেন দেব সেনাপতি কার্তিকেয়। গোন্দ রাজাদের যোগ্য উত্তরসূরি।
কিন্তু তিনি চুপ করে থাকতে পারলেন না। পুনরায় চলে এলেন সামনে। তখনি অন্য একটি তির তাঁর ঘাড়ের কাছে এসে বিঁধল। রানি জ্ঞান হারালেন। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি বুঝতে পারলেন এইভাবে তাঁর পক্ষে যুদ্ধ চালানো অসম্ভব। পরাজয় অনিবার্য। মাহুতও বুঝতে পারল। মহারানির এই অবস্থা দেখে সে শঙ্কিত হল। তার অন্তর কেঁদে উঠল। সম্ভব নয়, আর কিছুতেই মহারানির পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সে আহত, ক্লান্ত, চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখোমুখি মহারানিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিল।
রানি বৃদ্ধ মাহুতের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। কিন্তু তাঁর দৃঢ় চিত্ত কিছুতেই পিছুপা হতে রাজি নন। এটা তাঁর পক্ষে চূড়ান্ত অপমানের যুদ্ধ করতে করতে ফিরে যাওয়া। এই অসম্মান তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারেন না। এর চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। এ তো একপ্রকার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। বাকি যে ক’দিন তিনি বেঁচে থাকবেন ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খাবে তাঁর এই পরাজয়ের গ্লানি, যুদ্ধবিমুখ মানসিকতা। শত্রুপক্ষের কাছে চূড়ান্ত অপমানের জ্বালা তিনি কিছুতেই সইতে পারবেন না। কিন্তু এইভাবে মুঘলদের হাতে তিনি তাঁর প্রিয় স্বদেশ ভূমিকে কীভাবে বিলিয়ে দেবেন?
রানি বুঝতে পারলেন, ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীটাকে তিনি কোনোমতে আর চালাতে পারছেন না। তাঁর সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। চোখ জড়িয়ে আসছে, মনে হচ্ছে তাঁর চোখের আলো ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। তবে কি তাঁর চিরজীবনের দেশ ছাড়ার সময় হয়ে এল? তিনি যখন বুঝতে পারলেন আর তাঁর পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়, জয়ের আশা ক্ষীণ, এরপর মুঘলদের হাতে যে-কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারেন, এর চাইতে লজ্জার আর কিছুই নেই। এর চাইতে তাঁর মৃত্যুই শ্রেয়। প্রাণ থাকতে মুঘলদের হাতে তিনি কিছুতেই ধরা দেবেন না। এ-কথাটা মনে করতেই তিনি এক মুহূর্ত আকাশের দিকে তাকালেন। উজ্জ্বল আলোক মালার দিকে তাকিয়ে কী ভেবে নিলেন। তারপর কোমর বন্ধনী থেকে এক টানে ছুরি বের করে নিজেই আত্মবলিদান দিলেন।
ঝকঝকে আকশের গায়ে ধূসর রঙের প্রলেপ পড়ল। বাতাস হায় হায় করে উঠল। নর্মদার ঢেউগুলো বিষাদে আছড়ে পড়ল প্রস্তরখণ্ডের উপরে। শতধারায় বিচ্ছিন্ন হয়ে, বিশ্লিষ্ট হয়ে সেই বিশাল বিপুল জলকণারাশি ‘নেই নেই’ ধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল জলস্রোতে। শাল-সেগুনের জঙ্গল থেকে ভেসে এল বিষণ্ণ বাতাস। চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের সেই বিশাল পিতলের ঘণ্টা পাগলপ্রায় হয়ে আপনিই বাজতে লাগল ঢং ঢং ঢং ঢং বেসুরো সুরে। সমগ্র পাহাড় কম্পিত হল। পাহাড়ের চূড়া থেকে ধ্বনিত হল সেই উচ্চনাদ। আর্তনাদের মতো শোনাল। ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে মনে হল নটরাজের প্রলয় নৃত্য শুরু হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো প্রস্তরখণ্ড ভূপতিত হল নর্মদার জলে। নদী পাগলপারা হয়ে ছুটতে লাগল।
মহারানি লুটিয়ে পড়লেন তাঁর প্রিয় হাতি রণবীরের পিঠের উপরে। তাঁর সমস্ত শরীর তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রণবীর বুঝতে পেরে শুঁড় উঁচুতে তুলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হল সেই বৃংহণ ধ্বনিতে।
সেই ক্রন্দন ধ্বনি পৌঁছে গেল কেল্লায়, রানি দুর্গাবতীর প্রাসাদের কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে, এক মহল থেকে অন্য মহলে। সকলে বুঝতে পারলেন গন্ডোয়ানার বাঘিনী আজ চিরতরে বিদায় নিলেন।
অলঙ্করণ- শিমুল সরকার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস