বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১), হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২), বোয়া সাপের খপ্পরে, বে-ডর লছ্মণ, মানুষখেকো নেকড়ে , নেকড়ে মানুষ সিয়াল, বাঘমারা ভীম, ডাইনি প্যান্থার, মহিষাসুরের খপ্পরে, অরণ্যের সন্তান জুয়াং, জল হুপু, সাদা বাঘ
“সাহেবের কাছে কি পাখি মারবার ছররা বাদে ভারী কোনও কার্তুজ হবে? কাছাকাছি ভালুক আছে। পায়রার চাইতে ও-জিনিস শিকারে মজা বেশি।” দূরের কয়েকটা বড়ো গাছের দিকে চোখ আটকে রেখে ডালকির মুখিয়া হঠাৎ বলে উঠল। সেদিনের পাখি শিকার অভিযানে সে আমার গাইড।
মাথা নেড়ে বললাম, “কাছাকাছি ভালুক আছে তুমি বুঝলে কেমন করে?”
“বলছি। দূরের ওই গাছগুলোর দিকে দেখুন তো। মাথায় ধোঁয়া ধোঁয়া উঠছে দেখতে পাচ্ছেন? ও-জিনিস ধোঁয়া নয় সাহেব। ও হল উইয়ের ঝাঁক। সকালবেলা বৃষ্টি হয়ে যাবার পর সব গাছতলার ঢিবি ছেড়ে আকাশে উড়তে লেগেছে। আরও দেখুন—ওই যে পাখিগুলো উড়ে উড়ে উই ধরে খাচ্ছে, ওরা হল ধনেশ পাখি। ওরা এমনিতে ওভাবে উড়ে উড়ে মোটেই উই খায় না। নির্ঘাত কিছুতে ওদের ভয় দেখিয়েছে। তাই ওরা মাটির ওপর ঢিবিগুলোর কাছে নেমে বসতে পারছে না। তার মানে ঢিবিতে ভালুক এসেছে। ধনেশকে নামতে দিচ্ছে না।
“উই খেতে যে কী ভালো সাহেব, কী বলব! ভালুক তো বটেই, সে ছাড়া শেয়াল, কুকুর, বেড়াল, বাঘ, চিতা, হরেক জাতের পাখি, এমনকি মানুষও ও-জিনিস পেলেই পেট পুরে খায়। নতুন ভুট্টার দানার চাইতেও মিষ্টি। অনেকটা নারকেলের মতো স্বাদ। একবার খেলে ভুলতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, ভালুকের মতো উই খেতে আর কোনও জানোয়ার এতটা ভালোবাসে না। ও-জিনিস পেলে সে এমনই মহুয়ার ফল খাওয়া ফেলেও দৌড়ে আসবে। তবেই বুঝুন! তাই বলছিলাম, উই যখন উড়েছে, ভালুক তখন সেখানে থাকবেই। সঙ্গে যদি ভারী কার্তুজ থাকে তাহলে চলুন গিয়ে দেখিই না একবার!”
ভাগ্য ভালো সঙ্গে গুটি দুই ভারী কার্তুজ রাখাই ছিল আমার। পকেটে হাত দিয়ে সে-দুটো একবার দেখে নিয়ে বললাম, “চলো।”
পাহাড়ের গা বেয়ে কয়েকশো গজ উঠে একটা গভীর বন। তার ভেতরে ঢুকে একটা আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়ল। এদিক-ওদিক গাছের গোড়ায় বড়ো বড়ো উইঢিবি থেকে ফোয়ারার মতো উই ভেসে বেরিয়ে আসছে আর তাদের ঘিরে কাক, টুনটুনি, শালিক, ধনেশ, ফিঙে আর হাজারো জাতের পাখির বনভোজন চলেছে। হইচইতে বন সরগরম। একটা ক্ষয়ে যাওয়া গাছের গুঁড়িতে বিরাট বড়ো একটা ঢিবি ঘিরে ধরে এক মা-ভালুক তার দুই ছানাকে নিয়ে মহানন্দে ভোজ চালাচ্ছে। তাদের খাবার কায়দাটা ভারি মজার। থাবায় লালা মাখিয়ে ঢিবির মাথার গর্তের কাছে একেকবার ধরে, উড়ে বেড়ানো উইদের ডানা তাতে আটকে গেলে থাবা চেটে তাদের সাফ করে ফের বাড়িয়ে ধরে ঢিবির মাথায়।
খাওয়াদাওয়ায় তারা এতই ব্যস্ত ছিল যে আমরা তাদের পঞ্চাশ গজের মধ্যে চলে আসা অবধি তারা টেরই পায়নি কিচ্ছু। শুধু সাবধানী কাকের দল আমাদের খেয়াল করে খানিক দূরে সরে গিয়ে ফের এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সব পাখি মিলে তাদের সরু-মোটা গলায় তখন এমন হল্লা জুড়েছে যে তাতে আমাদের পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না।
প্রায় মিনিট পাঁচেক থ হয়ে দৃশ্যটার দিকে শুধু তাকিয়ে রইলাম আমি। তারপর হঠাৎ প্রায় গজ বিশেক আগে বন্দুকের শব্দ শুনে চমকে উঠে দেখি মুখিয়া কখন যেন চুপিচুপি সামনে এগিয়ে গিয়ে ভালুকগুলোর দিকে একটা গুলি ছুড়ে দিয়েছে। শব্দটা হতেই এক মুহূর্তের জন্য সব একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। পাখিগুলো দল বেঁধে উড়ে পালাল। ভালুকের বাচ্চা দুটোও দিল দৌড়। শুধু মা-ভালুক নড়ল না। দেখি, তার শরীরের পাশে গুলিটা গিয়ে লেগেছে। গুলি লাগা জায়গাটায় সে হিংস্রভাবে কামড় বসাচ্ছিল। আর সেই সঙ্গে গায়ের লম্বা লম্বা লোম টেনে টেনে তার সে কী গর্জন! প্রধান দেখি তাই দেখে ভয় পেয়ে, আমি যে গাছটার পেছনে লুকিয়ে আছি সেদিকে পিছিয়ে আসছে।
ওই করতে গিয়ে এক গাছের পেছন থেকে অন্য গাছের পেছনে ছুট দেবার ফাঁকে হঠাৎ মা-ভালুকের নজর গিয়ে পড়ল তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে তেড়ে গেল সে। ওরকম গদাইলশকরি চেহারা নিয়ে জন্তুটা যে কী অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটতে পারে তা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মুখিয়া আধা পথ আসতে না আসতে সে গিয়ে তার নাগাল ধরেছে। বিরাট বড়ো একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে মুখিয়া তখন তার থাবার ঝাপটা বাঁচায়।
মুখিয়াকে থামতে দেখে মা-ভালুক এইবার সেই গাছটার কাছে এসে দু-পায়ে উঁচু হয়ে দাঁড়াল। তারপর নাকটা উঁচু করে ঘোঁত ঘোঁত করে ডাক দিল কয়েকটা। খেলা দেখাতে নিয়ে আসা পোষা ভালুক বিরক্ত হলে যেমন শব্দ করে অনেকটা সেইরকম। তারপর গাছটার কাছে এগিয়ে গিয়ে সে দু-হাতে সেটাকে বেড় দিয়ে ধরবার চেষ্টা করতে শুরু করল। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াল গুঁড়িটার বেড়। বেজায় মোটা সেটা। মা-ভালুক কিছুতেই তার পেছনে লুকোনো মুখিয়ার নাগাল ধরতে পারে না। তখন সে ফের চার পায়ে উবু হয়ে পড়ে গাছটাকে ঘিরে মুখিয়াকে তাড়া করতে শুরু করল। তবে মুখিয়ার তাতে খানিক বেশি সুবিধে। ভালুকের চাইতে অনেক তাড়াতাড়ি সে বাঁক নিতে পারে। ফলে ভালুক তার নাগাল কিছুতেই ধরতে পারছিল না।
খানিক সেই চেষ্টা করে হালে পানি না পেয়ে ভালুক এবার ফের দু-পায়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। দেখা গেল এইবার কায়দা বদলেছে সে। বেড় দিয়ে ধরবার চেষ্টা ছেড়ে সরাসরি গাছটাকেই আক্রমণ করেছে। দু-হাতের বড়ো বড়ো নখ দিয়ে গাছটার গায়ে খাবলে খাবলে তার ছাল তুলে কাঠ খুঁড়ে মুখিয়ার নাগাল ধরবার তালে আছে। খানিক বাদে হাল ছেড়ে দিয়ে ভারি রেগে গিয়ে সে সামনের থাবা দুটো মুখে পুরে দেখি কামড়াতে লেগেছে। আর ওদিকে গাছের পেছন থেকে মুখিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে—“সাহেব গুলি করো, গুলি করো!”
গোটা দৃশ্যটা বেজায় হাস্যকর। তাছাড়া ওই মুহূর্তে মুখিয়ার প্রাণ যাবার খুব একটা আশঙ্কা ছিল বলেও মনে হচ্ছিল না। ভাবলাম একটু অপেক্ষা করে দেখি এরপর কী হয়। তা খানিক থাবা চিবিয়ে কোনও ফল না হতে ভালুক এবার ফের চার পায়ে নেমে মুখিয়াকে বেদম জোরে তাড়া করতে শুরু করে দিল। মাঝে মাঝে আবার দু-পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে সার্কাসের জোকারে মতো লাফও দেয়।
কতক্ষণ সার্কাসটা চলত বলা কঠিন। দিশি লোকের বেজায় দম। এক দৌড়ে মাইলের পর মাইল চলে যেতে পারে একেকজন। কিন্তু এবার এক নতুন বিপদ এসে হাজির হল। ছানা ভালুক দুটো তো প্রথমে গুলির শব্দ শুনে ছুটে পালিয়েছিল। কিন্তু খানিক দূর গিয়ে তাদের নিশ্চয় খেয়াল হয়েছে যে পেছনে কেউ তেড়ে আসছে না। তখন থেমে গিয়ে তাদের কানে গেছে মায়ের হাঁকডাকের শব্দ। কাজেই ব্যাপারখানা কী সেইটে দেখবার জন্য এইবার তারা হেলেদুলে এসে হাজির। তখনও তারা পুরো বেড়ে ওঠেনি। কিন্তু তবু, নিরস্ত্র একলা মানুষের পক্ষে তাদের শক্তি একেবারে দুচ্ছাই করবার মতো নয়। তারা যদি এইবার সব দেখেশুনে মায়ের দলে এসে যোগ দেয় তাহলে তো মুখিয়ার আজ কপাল খারাপ।
অবস্থা দেখে তখন আমারও ধাত ছেড়ে যাবার জোগাড়। কেন যে মরতে আগেই গুলি চালাইনি সেই ভেবে হাত কামড়াবার অবস্থা তখন আমার। সামনে তিন-তিনটে ভালুক, অথচ হাতে আছে মোটে দুটো ভারী কার্তুজ। ছানাহারা মা-ভালুক যে কী ভয়ংকর হয় সে তো দুনিয়াসুদ্ধু মানুষের জানা। কিন্তু আহত মা-ভালুক যখন তার বাচ্চাদের বাঁচাবার জন্য লড়াই দেয় তখন তার মতো সাংঘাতিক জীব দুনিয়ায় দুটি নেই।
বেশি ভাবনা-চিন্তা করবার সময় আর ছিল না তখন। আমি হাঁক দিয়ে মুখিয়াকে বললাম, “পাগড়িটা খুলে খানিক দূরে ছুড়ে দিয়ে ছুট দাও।”
মুখিয়া আর দেরি করল না। মাথার পাগড়িটা খুলে উলটোদিকে সেটা ছুড়ে মেরেই আমার দিকে দিল এক দৌড়। পাগড়িটা দেখেই মা-ভালুক তার দিকে তেড়ে গেছে। দু-হাতে সেটাকে ধরে দাঁত দিয়ে তাকে ফর্দাফাঁই করতে যখন সে ব্যস্ত সেই ফাঁকে আমি তার দিকে বন্দুক তুলে নিশানা নিলাম।
দূরত্ব বেশি ছিল না। গুলি ছোটার ঝাঁকুনিতে নলের মাথা ওপরদিকে ছিটকে উঠবে খানিক। আমি তাই বন্দুকের ব্যারেল দুটো একটু নিচের দিকে তাক করে পরপর দুখানা গুলিই ছুড়ে দিলাম মা-ভালুকের দিকে। গুলি দুটো খেয়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পড়ল ভালুকটা। তারপর মাটিতে পড়ে সে বার বার পাক খায় আর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।
খানিক অমনি করবার পর দেখি ফের উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বুঝলাম, বন্দুকের গুলি ঠিকঠাক নিশানায় লাগেনি। তাতে সে চোট পেয়েছে বটে, কিন্তু তা গুরুতর কিছু নয়। ছানা দুটো ফের গুলির ধমক শুনেই ছুট দিয়েছিল আগে আগে। তিন পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মা তাদের পিছু ধরেছে তখন। তার সামনের একটা পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। যেতে-যেতেই সে একেকবার থেমে আমাদের দিকে ঘুরে দেখে। যেন ভাবে, ফিরে এসে ফের একবার লড়াই দেবে কি না।
মুখিয়ার মতলব ছিল দৌড়ে পালাবে। তবে ও-অবস্থায় ছুট দেওয়া মানে ভালুককে তাড়া করবার নিমন্ত্রণ দেওয়া সে তো জানা কথা। সঙ্গে আছে মোটে আর একটা মাত্র ছ’নম্বর বুলেট। ওই দিয়ে ভালুক মারা যায় না। সে আধমরা হলেও নয়। সে-গুলি খেয়েও তেড়ে এসে আমাদের নিকেশ করে দিতে তার মোটেই দেরি হবে না। কাজেই বেজায় এক ধমক দিয়ে মুখিয়াকে আটকাতে হল। মা-ভালুকও গজরাতে গজরাতে আস্তে আস্তে বাচ্চাদের নিয়ে খানিক দূরের একটা টিলার ওপরের দিকে চলে গেল।
পরদিন সকালে ঠিকঠাক গুলি-বন্দুক সঙ্গে করে নিয়ে আমরা ফিরে এসে চললাম তার সন্ধানে। টিলা বেয়ে উঠে আবিষ্কার করা গেল, সেখানে একটা গুহার মধ্যে তার আস্তানা। তার ভেতর থেকে তার থাবা চোষবার শব্দ আসছিল। শব্দটা অনেকটা দিশি লোকজন যে হুঁকো খায় তার আওয়াজের মতো।
হাজার চেষ্টা করেও তাকে বাইরে বের করে আনা গেল না। পাথর ছুড়ে দেখা হল। মশাল জ্বালিয়ে তাও ছুড়ে দেওয়া হল ভেতরে। কিন্তু ভালুক আর তার ঘাঁটি ছেড়ে নড়ল না। সারাটা দিন সেই চেষ্টা করে অবশেষে দলবল নিয়ে খালি হাতেই ফিরতে হল আমায়। সেই থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি, পায়রা মারতে গিয়ে ভালুক শিকারের চেষ্টা আর কক্ষনো নয়।
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে