গল্প-লজেন-পরির জাদুকাঠি-সুস্মিতা কুণ্ডু -শীত ২০২২

আগের সহজ গল্প- পুঁচকে গাছের কথা, লালু নীলু আর ভুলু, জিকো ও মিকির খেলাধূলা,ছোটো মাকড়শার কাহিনি 

golpolojenpori

এক ছিল লজেন-পরি। তার জাদুকাঠিটি কিনা কাঠির মাথায় লজেনের মতো দেখতে তাই সব খোকাখুকুরা তাকে আদর করে লজেন-পরি বলেই ডাকত। লজেন-পরির দুই ডানাতে গোল গোল জিলিপির মতো নকশা আঁকা। রোদ পড়লে ঠিক যেন লজেনের গায়ের রাংতার মোড়কের মতো ঝিকমিক করে সেই ডানা। মাথার চুলগুলো তার গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো ফুরফুরে ফিরফিরে। লজেন-পরি নিজেই যেন লজেনের মতো মিঠে একটা খুকি।

লজেন-পরি তার ললিপপের মতো জাদুকাঠিটা বাতাসে নাড়লেই ঝরঝরিয়ে টফি, লজেন, বাতাসা, নকুলদানা, মিহিদানা সব ঝরে পড়ে। যেখানেই যায় দুনিয়ার ছেলেমেয়ে সব ভিড় করে এসে তার কাছে ‘এই দাও’ ‘ওই দাও’ ‘সেই দাও’ বায়না জোড়ে। লজেন-পরিও হাসিমুখে তাদের সব সাধ পূরণ করে। তার একটুও জিরেন নেওয়ার ফুরসত নেই।

তা সেইদিন সারাবেলা হইচই খাটাখাটুনির পর ফুলবাহারি বাগানে ইয়াবড় একটা ফুলের পেটের ভেতর শুয়ে গায়ে একটা পাপড়ি চাপা দিয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল লজেন-পরি। এমন সময় সাতভাই মৌমাছি এল ফুলের মধু খেতে। তারা তো লজেন-পরিকে দেখে ভেবেছে ‘এ আবার নতুন কোন বড়ো মৌমাছি এল রে বাবা আমাদের মধু নিতে!’ মৌমাছিরা এইসান জোরে সবাই মিলে বোঁওওও, বোঁওওও করে আওয়াজ তুলল যে লজেন-পরি ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল। মারমুখী মৌমাছির ঝাঁক দেখে তো সে-বেচারা ভয়েই কাঁটা। কোনোমতে ডানা মেলে ঝটপট উড়ে পালাল। তবে পালালে কী হবে! গোটা মাথায় ডানায় চুলে তো ফুলের রেণু মাখামাখি হয়ে গেছে। এবার যত ডানা ঝাপটায় তত নাকের ভেতর ফুলের রেণু সেঁধিয়ে যায়। অমনি শুরু হল হাঁচি। একটার পর একটা হাঁচি। হাঁচতে হাঁচতে টলমল করে উড়তে উড়তে লজেন-পরির হাতের জাদুকাঠিটা বেসামাল হয়ে নীচের মাটিতে পড়ে গেল। যেখানে জাদুকাঠিটা পড়ল সেইখানে ছিল একটা মানুষদের গাঁ।

জাদুকাঠিটা গিয়ে পড়ল গাঁয়ের একটা মিঠাইয়ের দোকানের সামনে। দোকানের মালিক তো আকাশ থেকে এমনধারা একটা কাঠির মাথায় লজেনের মতো দেখতে একটা কী যেন কী খসে পড়তে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। তারপর কৌতূহলী হয়ে গুটিগুটি পায়ে গিয়ে লাঠিটা কুড়িয়ে নিল। এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে যেই না ওটা নাড়ল অমনি চারটি বাতাসা ঝরে পড়ল। অবাক হয়ে ফের যেই না নাড়ল, অমনি নকুলদানা। এ কী জাদু রে বাবা! মনে মনে ভাবলে দোকান মালিক। তারপরই মাথায় একটা মতলব খেলে গেল দোকান মালিকের। এই এত বাতাসা, নকুলদানা বেচলে তো অনেক অনেক টাকা লাভ হবে। তয়ের করার কোনও খরচই নেই তাই বেচলে পরে শুধুই লাভ।

যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দোকানের সব ময়রাদের কাজ থেকে বিদেয় করে দিল দোকান মালিক। ময়রারা চাকরি হারিয়ে মনের দুঃখে গাঁ ছেড়ে চলে গেল। দোকান মালিক সারাদিন জাদুকাঠি নেড়ে হাঁড়ি হাঁড়ি মিঠাই তৈরি করে আর কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সায় বেচে। এদিকে ছোটো ছোটো খোকাখুকুদের মন খারাপ, মুখ ভার। লজেন-পরি তো তাদের এমনি-এমনিই চকলেট, টফি, বাতাসা, নকুলদানা যা চাই স-অ-অ-ব দিত। এখন আর লজেন-পরির দেখাও নেই আর দোকান থেকে ওসব খাবার কেনার মতো অত টাকাপয়সাও নেই। ওদিকে লজেন-পরিরই কি ছাই মন ভালো আছে? কতদিন ছোটো খোকাখুকুদের সঙ্গে লুকোচুরি ধরাধরি খেলা হয়নি, সবাই মিলে বাতাসা-নকুলদানার চড়ুইভাতি করা হয়নি!

নাহ্! এমনি করে তো চলতে পারে না। জাদুকাঠি ফের খুঁজে বার করতেই হবে। শুধু মিঠাই তয়ের করাই তো নয়! জাদুকাঠি না থাকলে পরে পরিরাও আর বেশিদিন পরি থাকতে পারে না। আকাশের মেঘ হয়ে যায় তারা। ওই দেখো না! লজেন-পরিরও ডানার সব ঝিকমিকে রঙ কেমন ফিকে হয়ে এসেছে। গোলাপি হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চুলগুলোও আর আগের মতো রেশমি ফুরফুরে নেই। জট পাকিয়ে গেছে। হাতে সময় বেশি নেই, আর দেরি করা চলবে না।

লজেন-পরি সব মনের জোর এক করে উড়ান দিল। গিয়ে পৌঁছল সেই গাঁয়ে যেখানে তার জাদুকাঠিটা পড়ে গিয়েছিল। ডানাজোড়া লুকিয়ে নিল জামার আড়ালে। মাথায় একটা রঙিন রুমাল বেঁধে আড়াল করে চুলটা। তারপর এদিক ওদিক শুধোয় লোকজনকে নানা কথা।—“গাঁয়ের খোকাখুকুরা সব কই গেল? খেলতে আসে না বুঝি? চড়ুইভাতি করে না বুঝি?”

দু-চারজন লোক হেথাহোথা ঘুরছিল। তাদেরই কেউ জবাব দিল, “খোকাখুকুদের কি আর মন ভালো আছে! মিঠে খাবার না খেয়ে খেয়ে দিনগুলোই তো কেমনপারা তিতকুটে হয়ে গেছে। ওদের আর দোষ কী?”

লজেন-পরি অবার হয়ে শুধোয়, “কেন? মিঠে খায় না কেন? দাঁতে পোকা হবে বলে ভয়ে বুঝি? আহা! সে তো খাওয়ার পর নিমকাঠি দিয়ে দাঁতন করে নিলেই…”

লজেন-পরির কথা শেষ হতে না হতেই লোকটা বলল, “পাবে কই যে খাবে? গাঁয়ের একটি মোটে মিঠাই দোকানের মালিক তো সোনার দরে মিঠাই বেচছে। বড়োলোকেরা ছাড়া সাধারণ গরিবগুরবো লোকেরা সে-মিঠাইয়ের নাগাল পাবে কী করে? সোনাই বটে! দোকানমালিক যেন জাদু জানে। দোকানে ময়রা নেই, কড়ায় টগবগিয়ে ফোটা দুধ নেই, ছানায় পাক নেই, চিনির রস নেই তাও কতরকমের মিঠাই থরে থরে সাজানা কাচের তাকে!”

কথাক’টা শুনেই লজেন-পরি মনে মনে ভাবল, হুম! এই মিঠাই দোকানের মালিক মোটেই সুবিধের ঠেকছে না। আগে তো খোকাখুকুরা বলত ওই দোকানের মিঠাই লজেন নাকি মুখেই তোলা যায় না। আর এখন সেই জিনিসই সোনার দরে বেচছে। তায় আবার ময়রা নেই, মালমশলা নেই! গিয়ে দেখতেই হবে একবার সরেজমিনে।

যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। লজেন-পরি চলল মিঠাই দোকানের মালিকের কাছে।

দোকানের সামনে গিয়ে তো থ লজেন-পরি! তাকে তাকে কতরকমের মিঠাই! কত নকশা! দেখলেই জিভে জল আসবে। কয়েকজন খোকাখুকু ঘুরঘুর করছে বটে আশেপাশে, তবে একটা রাগীমতো লোক কাঁধের গামছা নেড়ে মাছির মতো করে তাড়িয়ে দিল তাদের। লজেন-পরি একটু এগিয়ে ভালো করে চেয়ে দেখে, এই মিঠাইগুলো তো বড়ো চেনা চেনা ঠেকছে। সব মিঠাইয়ের গায়েই গোল গোল জিলিপির মতো নকশার আবছা ছাপ। এই ছাপ তো শুধু লজেন-পরির জাদুকঠি দিয়ে বানানো মিঠাই আর লজেনের গায়ে থাকে! বোঝো! তার মানে এই শয়তান দোকান মালিক লজেন-পরির জাদুকাঠিখানা কুড়িয়ে পেয়েছে আর সেই দিয়ে জাদু করে মিঠাই তৈরি করছে। তাই ছানা-চিনি-দুধ-ময়রা কোনও কিছুরই দরকার পড়ে না ওর দোকানে। শুধু একগাদা টাকা নিয়ে জাদুমিঠাই বেচে। লাভই লাভ দোকান মালিকের।

নাহ্, একে তো ছাড়া চলে না! লজেন-পরি মনে মনে একটা মতলব ভাঁজল। খোকাখুকুদের কাছে ডেকে বলল, “মিঠাই খেতে চাও গো খোকাখুকুরা? তাহলে আমার কথামতো একটা কাজ করতে হবে। তাহলেই আবার আগের মতো মিঠাই লজেন রাশি রাশি আর এত এত হাসিখুশি।”

ঝপাঝপ মাথা নাড়ল খোকাখুকুরা। লজেন-পরি তাদের কানে ফিসফিসিয়ে মতলবখানা বলতেই তো তারা নাচতে শুরু করল।

তারপর সবার চোখের আড়ালে ডানা মেলে লজেন-পরি উড়ে গেল সেই ফুলবাহারি বাগানে। সেখানে সাত ভাই মৌমাছি তো ফুলের পাপড়ির ভেতর মধু খেয়ে বসে বসে গুলতানি করছিল। লজেন-পরিকে আসতে দেখে রে রে করে তেড়ে এল। বুঝি তাদের মধুতে ভাগ বসাতে এসেছে। চেঁচিয়ে উঠল, “এইয়ো পরি! ভাগো হিঁয়াসে!”

লজেন-পরি হাত নেড়ে, মাথা নেড়ে বলল, “আরে আরে মৌমাছি ভাইয়েরা! আমি ফুলের মধু নিতে আসিনি। বরং তোমাদেরই মিঠাই খাওয়ার ডাক দিতে এসেছি। মানুষদের গাঁয়ে এক মিঠাইয়ের দোকানে ভারি ভালো মিঠাই পাওয়া যায়। তবে কিনা দোকান মালিকটি খুব বদমাইশ। সে যদি তোমাদের তাড়া করে, তোমরাও বোঁওও করে হুল ফুটিয়ে দিও, কেমন?”

সাত ভাই মৌমাছি তো মিঠে জিনিস খেতে বেজায় ভালোবাসে। তারা তাই আর দেরি না করে লজেন-পরির পিছু পিছু উড়ে চলল সেই মিঠাইয়ের দোকানে। লজেন-পরির ফিকে হয়ে আসা ডানায় ভর দিয়ে উড়তে ভারি হাঁপ ধরছে, তবে কী আর করা যাবে। আর একটু লড়াই যে করতেই হবে।

মিঠাইয়ের দোকানে পৌঁছে দেখে সেখানে খোকাখুকুর দল দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ‘মিঠাই দাও’ ‘লজেন দাও’ বায়না জুড়েছে। দোকান মালিক বেজায় রেগে তাদের বকছে, হুট হুট করছে। এমন সময় সাত ভাই মৌমাছিও এসে দোকান মালিকের কানে নাকে বোঁ বোঁ করে হুল ফোটাতে শুরু করল। নাক ফুলে ঢোল, কান ফুলে লাল। সাংঘাতিক চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি। সেই গোলমালের সুযোগে লজেন-পরি পা টিপে টিপে দোকানে ঢুকল। তারপর চারদিকে খুঁজতে শুরু করল নেড়েঘেঁটে। অনেক খুঁজে অবশেষে দোকান মালিকের বসার আসনের তলা থেকে মিলল সেটি। চুপিসারে সেই ললিপপ জাদুকাঠিটা বার করে নিল লজেন-পরি।

যেই না জাদুকাঠিটা হাতে নিল লজেন-পরি, অমনি চারদিক চোখ ধাঁধানো আলোয় ঝিলমিলিয়ে উঠল। লজেন-পরির ফিকে ডানায় আবার জিলিপির নকশা ফুটে উঠল। মাথার চুলগুলো আবার টুকটুকে গোলাপি রঙের রেশমের মতো ফুরফুরিয়ে বাতাসে দোল খেল। লজেন-পরি জাদুকাঠি তুলে বলল, “দরবেশ, নকুলদানা, বাতাসা, লজেন, ললিপপ, চকোলেট, জিলিপি, টফি…”

একটা একটা করে মিঠাইভরা থালা অমনি খোকাখুকুদের সামনে হাজির হল। ওদিকে বদমাইশ দোকান মালিকের দোকানের তাক থেকে একটা একটা করে মিঠাইয়ের থালা ফুস, হাওয়া! তাই না দেখে দোকান মালিক ফোলা নাক আর লাল কান নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

তারপর?

তারপর খোকাখুকুরা মনের সুখে পেট ভরে মিঠাই খেল আর সাত ভাই মৌমাছি খেল মিঠাইয়ের রস। ওদিকে লজেন-পরি যে খুশিতে মাতোয়ারা হল সেটা কি আর বলতে হয়!

 ছবি : সঙ্গের ছবিটা লেখিকারই আঁকা, ইন্টারনেট থেকে দেখে।

খুদে স্রষ্টাদের সমস্ত কাজের লাইব্রেরি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s