আগের সহজ গল্প- পুঁচকে গাছের কথা, লালু নীলু আর ভুলু, জিকো ও মিকির খেলাধূলা
একটা বড়সড় পুরোনোমতো বাড়ির কাঠের ভাঙাচোরা জানালার কোণে বাস করত চারজন মাকড়শা। বড়ো মাকড়শা, মেজো মাকড়শা, সেজো মাকড়শা আর ছোটো মাকড়শা। বড়ো, মেজো আর সেজো মাকড়শা তিনজন সারাটি দিন ফিনফিনে জাল বুনত, শিকার ধরত, খাবার জোগাড় করত। আর ছোটো মাকড়শাটি সারাদিন মুখ ভার করে বসে থাকত। জালও বুনত না, শিকারও ধরত না। বাকি তিন মাকড়শা তাকে শুধোয়, “তুই জাল বুনতে শিখলিনে, শিকার ধরতে শিখলিনে, আমরা যখন থাকব না তখন কেমনি করে দিন চলবে তোর শুনি?”
ছোটো মাকড়শা কোনও জবাব দেয় না। জানালার বাইরে চেয়ে থাকে।
একদিন ছোটো মাকড়শা আনমনে জালের সুতোয় গিঁট পাকাতে পাকাতে কী জানি কী ভাবছিল। বড়ো মাকড়শা সেটা দেখতে পেয়ে খুব রেগে গেল। জোরে চেঁচিয়ে বকা দিল ছোটো মাকড়শাকে, “সারাদিন কাজ নেই কাম নেই, শুধু সুতোগুনো ছিঁড়ে বরবাদ করছিস। আজ থেকে আর আমরা মোটেই তোকে বসে বসে খাওয়াব না। তোকে কিছু করে দেখাতে হবে, তবেই আমরা তোকে দলে নেব ফের, নইলে তুমি নিজের পথ নিজে দেখো।”
বড়ো মাকড়শা এমন রেগে গেছে যে মেজো আর সেজো মাকড়শাও ভয়ের চোটে আর কিছু বলে উঠতে পারল না। মনে মনে ভাবল, খানিক পরে রাগ পড়লে বড়ো মাকড়শা মাফ করে দেবে’খন ছোটো মাকড়শাকে।
ওদিকে ছোটো মাকড়শা মনে মনে খুব দুঃখু পেল। এমনি করে অপমান করল বড়ো মাকড়শা! আর থাকবেই না এই জানালার কোণে। ভারি তো একটু জাল বুনে দিত, খাবার এনে দিত—ও-কাজ ছোটো মাকড়শা নিজে নিজেই করতে পারবে। হতে পারে পুরোনো ঘর, তাই বলে কি জায়গা কম নাকি? ডানপাশের দেওয়ালের জানালায় গিয়ে থাকবে, বাঁয়ের দরজার কোণে থাকবে সেরকম হলে। ওই দূরের দেওয়ালে বইয়ের তাকে, ছবির আড়ালে যেখানে খুশি সেখানে গিয়ে থাকবে। বড়ো মাকড়শার সঙ্গে কিছুতেই থাকবে না। মেজো আর সেজো মাকড়শাও মুখ খুলে দুটো কথা কইল না ছোটোর হয়ে। কেন থাকবেই-বা এখানে?
যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। একটা বাতিল জালের সুতো দিয়ে বানানো পুঁটুলির ভেতর নিজের সব ঢেয়ো-ঢাকনা গুছিয়ে নিয়ে ছোটো মাকড়শা বাড়ি, মানে জানালা ছাড়ল। আট পায়ে পিল পিল করে চলতে চলতে চলতে অবশেষে এসে পৌঁছল ডাইনের জানালার কোণে। এটাও পুরোনো জানালাটার মতোই ভাঙাচোরা। লোহার শিক দিয়ে গরাদ দেওয়া। কোন কোণাটায় বাসা বাঁধা যায় উলুকঝুলুক করে সেটা দেখতে লাগল ছোটো মাকড়শা। এমন সময় আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা গাবদাগোবদাপানা টিকটিকি। ছোটো মাকড়শাকে দেখে বলে উঠল, “তুমি পুবদিকের জানালার মাকড়শা পরিবারের ছোটোটি না? তা হেথায় দোখনো জানালায় কী মনে করে শুনি? বেড়ু বেড়ু বেইরেচো বুঝি?”
ছোটো মাকড়শা অতশত পুব-দখিন বোঝে না। সে বলে, “না, বেড়াতে বেরোব কেন? আমি নিজের বাসা খুঁজতে বেরিয়েছি। তোমার যদি অসুবিধে না হয় আমি কি এই জানালায় জাল বুনে বাসা বাঁধতে পারি?”
টিকটিকি জিভটা বার কয়েক ভেংচি কাটার মতো বার করে বলে, “সে তুমি জাল বুনতেই পারো, তবে আগেভাগে সাবধান করে দিই বাপু। পরে যেন দোষ দিওনি। এ হল দোখনো জানালা। ভারি ঝোড়ো বাতাস বয় হেথায়। তোমার ওই ফিরফিরে জাল টিকবে বলে তো মনে হয়নাকো আমার।”
ছোটো মাকড়শা আটটা চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, “বটে? বাতাসের এত জোর?”
টিকটিকি বলে, “নয়তো কী! এই দেখো না আমার লেজখানার দশা। গেল বার কালবোশেখির ঝড়ে জানালার কপাটটা এমন দমাস করে আছড়ে পড়ল যে আমাদের লেজের ডগাটাই কেটে উড়ে গেল। দেখো না, দেখো!”
টিকটিকির কাটা লেজখানা দেখে তো ছোটো মাকড়শার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। না বাবা, এই আপদের ঝোড়ো হাওয়ার জানালায় সংসার পেতে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং ওই পাশের দেওয়ালটার ছবিটার পেছনে গিয়ে ঢোকাই ভালো।
ঝোলা গুটিয়ে ছোটো মাকড়শা চলল পাশের দেওয়ালে। ফের আট পায়ে পিলপিলিয়ে চলে। চলতে চলতে এসে পৌঁছল দেওয়ালের মাঝটিতে যেখানে কাঠের চৌকো খোপের ভেতরে কাঁচ দিয়ে ঘিরে কাগজের একটা ছবি রাখা। মানুষরা যে কীসব আজব জিনিস বানায় তার ঠিকঠিকানা নেই। ছোটো মাকড়শা যেই না ঢুকতে যাবে সেই ছবির পেছনে অমনি ফড়ফড়িয়ে একটা বাদামি আরশোলা বেরিয়ে এসে খড়খড়িয়ে একখানা শুঁড় উঁচিয়ে বলে উঠল, “কে রে, কে রে, কে রে তুই? আমার ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসছিস যে বড়ো! ভয়ডর নেই বুঝি?”
ছোটো মাকড়শা তো চমকে ঘাবড়ে একশা। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “ঘ-ঘর ম-মানে? বললেই হল তোমার ঘর? এতখানি জায়গা, তুমি একা কেন থাকবে শুনি? আমিও থাকতে চাই এখানে।”
আরশোলা তো এই মারে সেই মারে। বলে, “জানিস আমি কে? আমি এক-শুঁড়ো মারকুটে আরশোলা। আমার এই শুঁড়টা কী করে খুইয়েছি জানিস? মানুষদের সঙ্গে লড়াই করে। হুঁহ্! খাবারের চারদিকে সাদা দাগ দিয়ে ভেবেছিল আমায় আটকাবে। তবুও কি আমি হার মানলুম? মোটেও না। আমিও সোজা তেড়েফুঁড়ে ঢুকে গেলুম। তারপর সে কী বনবন করে মাথা ঘোরা। তবুও কি আমি হার মানলুম? মোটেও না। ওইভাবেই লাগালুম দৌড়। কী জানি কোথায় ঠুকে একটা শুঁড় ছিঁড়ল। তবুও কি আমি হার মানলুম? মোটেও না। ছুটে এসে ঢুকে পড়লুম আমার এই ঘরে। আর সেই আমার সঙ্গে কিনা তুই লড়তে এলি?”
আরশোলার লড়াইয়ের কাহিনি শুনে তো ছোটো মাকড়শা মনে মনে ভাবে, ‘এখেনে থেকে কাজ নেইকো! এমন মারকুটে আরশোলার সঙ্গে লড়াই করে ঠ্যাং ভেঙে লাভ নেই। মানে মানে পথ দেখাই ভালো।’
যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। ছোটো মাকড়শা ফের পোঁটলাপুঁটলি গুটিয়ে নিয়ে হাঁটা দিল। আর একটাই দেওয়াল বাকি রয়েছে ঘুরে দেখতে।
সেই দেওয়ালে ঝুলছে ইয়াবড়ো একটা দেওয়াল ঘড়ি। ছোটো মাকড়শা খুঁজেপেতে ঘড়ির গায়ে একটা ফুটোর হদিশ পেল। সেইটে দিয়েই হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে সেঁধিয়ে গেল ভেতরে। ভেতরটা বেশ বড়সড়। নানারকম কল তাতে। কোনটার গা-টা সরল, কোনটা আবার খাঁজকাটা। কোনটা জোরে ঘুরছে তো কোনটা ঢিমেতালে। ভালোই হল, এত ঘোঁজ-ঘাঁজে বেশ জাল বুনতে সুবিধেই হবে ছোটো মাকড়শার। আর দেরি না করে কাজে লেগে পড়ল সে।
এমন সময় ছোটো মাকড়শার চেয়েও আকারে অনেক ছোটো এতটুকুনি একটা ঘুণপোকা বেরিয়ে এল কোথা থেকে। আকারে ছোটো হলে কী হবে, হাবেভাবে সে ভারি বুড়োদের মতো। ছোটো মাকড়শাকে দেখে সে বললে, “তা বাছা, এখেনে কী মনে করে? এই ঘড়িঘরে তো চট করে কেউ সেঁধোয়নে বাপু। তোমার মতলবটা কী শুনি?”
ছোটো মাকড়শা সেই তখন থেকে এ-দেওয়াল সে-দেওয়াল ঘুরে বেজায় হাঁপিয়ে পড়েছিল। এবারে বেচারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেও ঝেঁঝে বলল, “তোমার অত হাঁড়ির খবরে কাজ কী শুনি?”
ঘুণপোকা মাথা নেড়ে বলে, “বাড়ির খবর? সে আমি জানিনে। আমি এই ঘড়িঘর থেকে বিশেষ বেরোই না কিনা! তা তুমি কোন দেওয়াল থেকে এলে হে ছোঁড়া?”
ছোঁড়া বলে ডাকাতে ছোটো মাকড়শার একটু ইয়েতে লাগল। সে বলল, “বাড়ির খবর জানতে চাইনি, কথাটা হাঁড়ির খবর বলেছিলুম। আর আমায় ছোঁড়া বলে ডাকবে না। আমার একটা ভালো নাম আছে।”
ঘুণপোকা ফের বলে, “খোঁড়া! ওই তো তোমার আটটা পা-ই ঠিক আছে দেখছি। আমায় কি কোবরেজ ঠাউরেছ নাকি? ভালো দাম দিলেও ওষুধ দিতে পারব না আমি।”
ছোটো মাকড়শা এবার চটেমটে একশা। বলে, “এ তো মহা মুশকিল! তুমি কি কানে শুনতে পাও না? বলছি এক আর জবাব দাও আরেক!”
ঘুণপোকা কিছু একটা বলবে বলে সবে মুখ খুলেছিল এমন সময় ‘ঢং ঢং ঢং ঢং’ করে পরপর যেন বাজ পড়তে শুরু করল আকাশ থেকে। সে কী কানফাটানো আওয়াজ রে বাবা! বেশ কতকগুলো ‘ঢং’ হয়ে তবে থামল সে ভয়ানক আওয়াজ।
এদিকে ছোটো মাকড়শার তো কানে পুরো তালা পড়ে যাওয়ার জোগাড়। অথচ ঘুণপোকা বকবক করেই চলেছে। তার মানে যা ভেবেছিল তাই। ঘুণপোকা কানে শুনতেই পায় না। হঠাৎ মনে পড়ল ছোটো মাকড়শার, এই ‘ঢং’ তো বাজ পড়ার আওয়াজ নয়। এ তো দেওয়াল ঘড়ি সময় জানান দিল। এই আওয়াজই তো ওরা চার মাকড়শা রোজ শুনত পুবের জানালায় জাল বুনতে বুনতে। তখন তো এমনধারা বিকট লাগত না। আসলে ঘড়ির ভেতরে বসে আওয়াজটা যে আরও বহুগুণ হয়ে কানে বাজে। পুরোনো জানালায় থাকতে অতটা বোঝা যেত না। পুরোনো জানালাটার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে ছোটো মাকড়শার। কেন যে বাড়ি ছাড়ল! শেষমেশ কি লেজকাটা টিকটিকি, শুঁড় ছেঁড়া আরশোলা আর কানে খাটো ঘুণপোকার মতো দশা হবে তার? ডুকরে কেঁদে উঠল ছোটো মাকড়শা।
নাহ্! বেশি দেরি হওয়ার আগেই ফিরে যেতে হবে নিজের দেওয়ালে নিজের পুরোনো জানালায়। তড়িঘড়ি ঘড়িঘরকে বিদায় জানিয়ে দৌড় দিল ছোটো মাকড়শা। সোজা গিয়ে থামল নিজের পুবের জানালায়। সেখানে বড়ো, মেজো আর সেজো মাকড়শা কখন থেকে সকালের জলখাবার সেজে বসে আছে। ছোটো মাকড়শা আসতেই আট তিনে দুই ডজন হাত-পা দিয়ে তারা জড়িয়ে ধরল ছোটোকে। নতুন বোনা জালের ওপর সকালের সোনা রোদও ঝলমলিয়ে উঠল। ছোটো মাকড়শা মনে মনে ভাবল আজ থেকেই ভালো করে জাল বোনা শিখতে শুরু করবে। আর একটুও দেরি নয়।
বাঃ, খুব সুন্দর। বাঁচার লড়াইয়ের গল্প।
LikeLike