আয় আয় ঘুম -গাঁদাফুলের গল্প-সৌরাংশু,ঈশান- শীত ২০২০

আগের সংখ্যার আয় আয় ঘুম-এর গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটিকোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প, ইদ্রিশ মিঞাঁর উটের গল্প, তিমি আর ডলফিনের গল্প জাফরি আর রেলিঙের গল্প, হাঁসুমনির গল্প, নিমগাছের গল্প, রঙমিলান্তি পেনসিলের গল্প, কুয়োর ব্যাং

লেখা সৌরাংশু  সিংহ। ছবি ঈশান মিস্ত্রী

“গোলাপবাগে ফুল ফুটেছে খোকার মুখে বোল, শিশুর হাসি আলোকিত করছে মায়ের কোল।

মুক্তা আঁকা প্রজাপতি ঘাস ফড়িংয়ের গায়, একটু ছুঁয়ে দেখতে তোরা ফুলবাগানে আয়।”

“গাঁদা ফুল নিয়ে ছড়া হয় না কেন গো?” আমাদের গাঁদা ফুলটি মালীকে জিজ্ঞাসা করেছিল। মালী উত্তর দেয়নি। শুনতেই পায়নি হয়তো।

গাঁদা ফুলটি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল। কিন্তু তখনও ছোট ছিল। গাঁদা ফুলের বাগানে আমাদের গাঁদা ফুলটির গাছের বাকি সব কুঁড়ি মালী কেটে নিয়েছিল, যাতে আমাদের গাঁদা ফুলটি ইয়াব্বড় মস্ত হতে পারে। কিন্তু আমাদের গাঁদা ফুলটির মনের মধ্যে দুঃখ ছিল খুব। ঘুরে ফিরে রোজই ঘুম থেকে উঠে দেখত সে, বাকি গাঁদা ফুলের গাছের চারটে পাঁচটা, দশটা বারোটা ফুল নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে। খিলখিলিয়ে হাসছে।

“আহা কি সুন্দর ওরা! খুশী খুশী থাকে। ওদের দেখে দেখে আমারও রঙ কি সুন্দর হলুদ হয়ে উঠছে!” গাঁদা ফুলটি মনে মনে বলত। তারপর সূয্যি ডুবে গেলে বাকী ফুলগুলোর মতো সেও ঘুমিয়ে পড়ত। রাতে স্বপ্ন দেখতো, মুক্তো আঁকা প্রজাপতি, ঘাস ফড়িং তার কাছেও আসছে, গল্প করছে, খেলা করছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখতো সব ফাঁকা। তাও বড় হচ্ছিল সে, একা একা বড় হচ্ছিল।

একদিন ভোরবেলা উঠে দেখলো তার নিজের পাপড়িগুলো একদম বিকশিত হয়ে হলুদ আলোকবর্ণ ধারণ করেছে। আনন্দ হলো খুব তার। কিন্তু শুনতে পেলো বাকী গাঁদাফুলগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, “ব্যাস এবার আমাদের গাছ থেকে নিয়ে যাবে!” একটু চিন্তা হল আমাদের গাঁদা ফুলটির। কাছের ফুলগাছটার ডানদিকে একই বৃন্ত থেকে দুটো গাঁদা পাশাপাশি ফুটেছে। তারা একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে তাকায়, একসঙ্গে খেলে, একসঙ্গে খিলখিলিয়ে বা মিটিমিটি হাসে আবার একসঙ্গে কথাও বলে।

তাদের দিকে তাকিয়ে আমাদের গাঁদা ফুলটি জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় নিয়ে যাবে গো?”

একই বৃন্তের দুটি গাঁদা পাশাপাশি একসঙ্গে বলে উঠল, “ওমা জানো না? মালীর মেয়ে নিয়ে গিয়ে মালা বানাবে তো! বড় বড় গাঁদার মালা। সব্বাইকে নিয়ে!”

আমাদের গাঁদা ফুলটির চোখ মুখ আলো হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করল, “আমাকেও নিয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে?”

একই বৃন্তের দুটি গাঁদা পাশাপাশি আবার বলে উঠল, “হ্যাঁ তো! জানো না? তোমাকেই তো একদম মাঝখানে রাখবে। তুমিই তো আমাদের সবার মধ্যে বড়। ঠিক যেভাবে পাশের গলি, তার পাশের গলি, তারও পাশের গলিতে, প্রতিটি গলিতে একটা করে বড় গাঁদা ফুল আছে। যারা একা একা বড় হয়। আর তাদের খুব বড় করার জন্য বাকি কুঁড়িগুলো কেটে ফেলে। জানো না?”

ঘাড় নাড়ল আমাদের গাঁদা ফুলটি। সে এতো কিছু জানতো না বটে। তবে তার এই ভেবে খুব আনন্দ হল যে সে সবার সঙ্গে মিলে মিশে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে পারবে।

তারপর মালী ফুলগুলো তুলে নিয়ে গেলো মেয়ের কাছে। আমাদের গাঁদাটিকেও। তারপর সে বিস্ময়ে ভয়ে ভয়ে দেখলো, ইয়াব্বড় একটা ছুঁচ আর তার পিছনে সুতো নিয়ে মালীর মেয়ে পায়ের তলা দিয়ে ঢুকিয়ে মাথা দিয়ে বার করছে প্রতিটি গাঁদা ফুলের। শেষে তার সুযোগ এলো। আলতো করে আমাদের গাঁদা ফুলটিকে তুলে মালীর মেয়ে ইয়াব্বড় ছুঁচ নিয়ে হাঁটুর কাছটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল আমাদের গাঁদা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তার একটুও লাগল না। তারপর আবার বাকি গাঁদা ফুলগুলোর মাথা আর পা ফুঁড়ে ফুঁড়ে একটা গোটা মালা করে ফেলল মেয়েটি, যত্ন নিয়ে, নিমেষে। এইভাবে আরও আরও মালা গেঁথে মেয়েটি নিয়ে গেল কাছের মন্দিরে। একটা ঝুড়িতে করে।

আমাদের গাঁদা ফুলটা সবকিছু বুঝছিল না। কিন্তু তার সবকিছু খুব ভালো লাগছিল। মজাও হচ্ছিল। সবার সঙ্গে মিলে মিশে মালা হয়ে ঝুড়িতে থাকতে পারছিল বলে। তারপর দুলতে দুলতে সে, হাজির হল দেবতার গলায়। চারিদিকে কাঁসর ঘন্টার শব্দ, মন্ত্রোচ্চারণ, ধূপ ধুনোর গন্ধ সব মিলিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো তার। আর আরও আনন্দ পেলো সে, যখন দেখল সকলে তার দিকেই নমস্কার করছে। আহা, এতো সুখও কপালে ছিল?

দিনের শেষে, সন্ধ্যারতির সুন্দর শব্দ, বর্ণ আর গন্ধ নিয়ে সে ঘুমোতে গেলো। আজকে ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেলো, কে যেন গাঁদা ফুল নিয়েও কবিতা লিখে গেছে:

“হলুদ গাঁদার ফুল
রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে নইলে
বাঁধব না বাঁধব না চুল!”

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s